Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

থিয়েটার গেইমস্ : অভিনয় প্রশিক্ষণে নতুন ভাবনা [সপ্তম কিস্তি]

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

অনুবাদ: অসিত কুমার

দশম অধ্যায়
সাক্ষাৎ ও মোকাবেলা

এক্ষেত্রে কাজ শুরু হয় দ্বন্দ্ব-ক্রীড়া দিয়ে। এবং শুরুতে যে-দুটো খেলার বর্ণনায় যাব সেগুলোকে আবার পরে ব্যবহার করা হয়েছে অন্য খেলাগুলোতে কী ঘটছে তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা খোলাসা করার স্বার্থে আমি প্রথমে তুলে ধরবো এর প্রেক্ষাপটের অনুশীলনগুলো।

চেয়ার বদল

দলকে প্রথমে দুই ভাগে ভাগ করতে হবে: খেলোয়াড় দল এবং পর্যবেক্ষক দল। খেলোয়াড়দের জোড়া বেধে দেয়া হয়। ৩/৪ গজ পর পর চেয়ার বসানো হয়। প্রতি জোড়া চেয়ারের মাঝে যথেষ্ট পরিমান জায়গা রাখতে হবে যাতে করে প্রত্যেক চেয়ারকে ঘিরে সহজে চলাচল করা যায়। সহজ একটা কর্ম পরম্পরা দাঁড় করানো হয়। একজন খেলোয়াড় অন্য একজন খেলোয়াড়কে এক চেয়ারে বসা অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে আরেক চেয়ারে নিয়ে বসিয়ে দেবে। কাজটা অনেকটা হাসপাতালে নার্স কর্তৃক রুগীকে স্থানান্তরের মত। (তবে এক্ষেত্রে তেমন কোনো সাদৃশ্যকল্প মাথায় আনা যাবে না।) যাকে স্থানান্তর করা হচ্ছে সে প্রতিরোধও করবে না, স্বেচ্ছায়ও যাবে না। তাকে নিয়ে যাওয়া হবে।

এই একই কাজের পুনরাবৃত্তি করা হবে তিন বার। প্রথমবার বহনকারীকে বলা হবে অন্য কিছু না ভেবে কেবল স্থানান্তরের কাজটা করতে। দ্বিতীয়বার বলা হয় কাজটা করার সময় ঠিক এই কাজটা নিয়ে না ভেবে ক্রীড়া পরিস্থিতির বাইরে অন্য কিছু ভাবতে; যেমন, সে ভাবতে পারে নাস্তায় সে কী খেয়েছে বা আগের রাতে টেলিভিশনে কী দেখেছে, ইত্যাদি। তৃতীয়বারের আগে তাকে বলা হয় কাজটা যত দ্রুত সম্ভব সারতে; অর্থাৎ তার মাথায় ভবিক্রিয়ার একটা পূর্বধারণা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে মনে রাখতে হবে যে, ‘যত দ্রুত সম্ভব’ কথাটা খুব আপেক্ষিক। ‘যত দ্রুত সম্ভব’ হাঁটা আর খাড়া দৌঁড় লাগানোর পার্থক্য তো আছেই!

তিনবারের এক আবর্তন সারলে পর পালা বদল হবে। এভাবে খেলোয়াড়দের সকলের করা শেষ হলে তারা হয়ে যাবে পর্যবেক্ষক; আগের পর্যবেক্ষকরা খেলোয়াড় হয়ে ঐ খেলাটা খেলতে শুরু করবে। সেটাও সম্পন্ন হলে পর একটা তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করে পুরো খেলাটা আবার শুরু হবে। দ্বিতীয় পর্বের খেলায়, বসে থাকা নিষ্ক্রিয়জনকে বলা হয় স্থানান্তরকালে সঙ্গীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। বিপরীতে সক্রিয়-সঙ্গী ইচ্ছে ক’রে দৃষ্টি এড়িয়েও যাবে না বা উল্টো দৃষ্টি আকর্ষণও করবে না। সে কেবল সঙ্গীকে বহন করবে প্রথমত ‘স্বাভাবিকভাবে’, দ্বিতীয়ত ‘চলমান পরিস্থিতির বাইরের অন্য যে-কোনো বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে’ এবং তৃতীয়ত ‘যত দ্রুত সম্ভব’। এরপর এই অনুশীলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলাপে বসা।

অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চালে যখন চোখাচোখি হয় তখন চলনে ছেদ পড়ে, হিক্কা ওঠে অথবা একেবারেই থেমে যাবার মত ব্যাপার ঘটে। চলার ছন্দে পরিবর্তন এবং মাথা-ঘাড়-শীরদাড়া-পেলভিস এর স্থিতি পরিবর্তন করে শরীরকে পুনঃসমন্বয় করার কথাও আসে। মুচকি দিয়ে বা সশব্দে হাসতে হাসতে রণেভঙ্গ দেয় অনেকে।  

এ থেকে যে-শিক্ষা নিতে হবে তা খুব পরিষ্কার, সহজ এবং গুরুত্বপূর্ণ। নানাভাবেই আমার মনে হয় এটাই হচ্ছে আমার ব্যবহৃত খেলাগুলোর মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ একক খেলা। মন যখন অন্য কিছুতে মগ্ন বা আগে থেকে নির্দিষ্ট করা কোনো অভীষ্ট সাধনে নিবিষ্ট থাকে তখন, একই সাথে, দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে অপরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব নয়।

থিয়েটারের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য মৌলিক। মঞ্চে হেসে ফেলা বা ‘মরা মানুষের শরীরের মত ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া’- এসবের মূল কারণ ওখানেই। অভিনেতৃ যখন নাট্যক্রিয়ায় তার নিজের অংশ নিয়ে আত্ম-সচেতন হয়ে ঘোরের মধ্যে রয়েছে - তার যা যা করতে হবে, যেমন অভীষ্ট এবং সেটা অর্জনের প্রণোদনা, প্রযোজনার নানা দিক, নিজের চরিত্র, একটু পরেই তাকে যে লাইনগুলো বলতে হবে- এতসব নিয়ে যখন সে সচেতনভাবে মনোসংযোগ করছে ঠিক তখন যদি অন্য অভিনেতৃর সাথে তার চোখাচোখি হয় তাহলেই সে ‘গেল’। দৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে আদি অকৃত্রিম মানবিক সংযোগ ঘটে যায় তা আর সব কিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

এই অভিজ্ঞতা এ-কথাই জোর দিয়ে বলে যে, পুরো থিয়েটার ব্যাপারটা এবং তাকে ঘিরে আমাদের কর্মপন্থা - এসব নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা যদি মনে করে থাকি থিয়েটার মানে একটা পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে তাকে পরিবেশন করার একটি মানবিন্দু নির্দিষ্ট করে সেই মান অর্জনের জন্য মহড়া করা এবং প্রদর্শনী বলতে আমরা যদি বুঝি কোনো অতীত বাস্তবতার পরিশিলিত পুনরাবৃত্তি তাহলে মঞ্চে প্রকৃত অর্থে কোনো মানবিক সংযোগ বা সম্পর্ক স্থাপন করা আর হবে না; হবে শুধু কিছু দৃশ্য আর কিছু শব্দ দিয়ে তৈরি ‘কিছু একটা’। আমার বিশ্বাস মত থিয়েটার যদি হয় ক্রিয়াশীল মানবিক সম্পর্কের জীবন্ত শৈলী, তাহলে স্বয়ং পরিবেশনাকেই বাস্তবতা বলে মনে করতে হবে। পাঠ-বিশ্লেষণ-মহড়া হচ্ছে একটি প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি, কোনো কাজের ভিত্তি; একটি নির্দিষ্ট ফল লাভের মাধ্যম নয়। সে-কারণেই, আপাত স্বতঃস্ফূর্ত মানবিক আচরণের মাধ্যমে বিনোদন দিতে চাইলে পাঠ-বিশ্লেষণ-মহড়াজাত কাঁচামাল মজিয়ে নিতে হবে নিজের পশ্চাৎ-মস্তিষ্কের স্বয়ংক্রিয় প্রতিবর্তী ক্রিয়ার সাথে এবং কাজ করতে হবে অবচেতন শরীর-চিন্তন প্রক্রিয়াদির আওতায় সহজাত বিশ্বস্ততা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে। মঞ্চাভিনয়ে অপরাপর অভিনেতৃর সাথে বিনিময়ের এটাই একমাত্র পথ।

আমার কাজের সামগ্রিক মূলনীতিই হলো অভিনেতৃকে তার অবচেতন কর্মকাণ্ডের এক কায়িক প্রতিভাস (kinesthetic) আবিষ্কার-অনুভবে সাহায্য করা। এখান থেকেই উঠে আসে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করার প্রয়োজন যেখানে অভিনেতৃ অন্যের সাথে সংযোগ স্থাপনের ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা লাভ করবে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এই যে, দৈনন্দিন পরিস্থিতিতে মানুষের সাথে একটানা অনেকক্ষণ প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপনের সুযোগ বিরল। সুযোগ যদিবা আসেও, তা আসে কোনো না কোনোরকম আবেগঘন পরিস্থিতিতে।

দৃষ্টি বিনিময়

এর জন্য চাই ষোল গজ দৈর্ঘ্যরে একটি ঘর যার সব দিক সমানভাবে আলোকিত। এবারও দলকে খেলোয়াড় ও পর্যবেক্ষক ভাগে আলাদা করতে হবে। যুগলেরা ঘরের দুই প্রান্তে মুখোমুখি দাঁড়াবে এমন দূরত্বে যেখান থেকে চোখে চোখ রাখলেও একের দৃষ্টিসীমা অপরের পায়ের পাতা পর্যন্ত ব্যপ্ত হয়। অর্থাৎ দৃষ্টিনিবেশকালে উভয়ের চোখে উভয়ের শরীরের একটি পুর্ণাঙ্গ আবছায়া ধরা পড়বে।

দৃষ্টি সংযোগ বজায় রেখে খুব ধীরে ধীরে পরস্পর পরস্পরের দিকে অগ্রসর হবে; চলতে চলতে তারা (শরীর-চিন্তন প্রক্রিয়ার কায়িক প্রতিভাসে) নিজ নিজ পরিবর্তনশীল অবস্থা সম্পর্কে সজাগ থাকবে। চলনের কোনো বিন্দুতে (মানসিক) প্রতিক্রিয়া অতি তীব্র হয়ে উঠলে তারা দাঁড়িয়ে পড়বে, পেছনে হাঁটবে এবং আবার সামনে যাবে যতক্ষণ না সেইসব মানসিক প্রতিক্রিয়ার দৈহিক অনুভব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এরপর পর্যবেক্ষকদের খেলার পালা। সবশেষে হবে এই খেলাটা এবং এর প্রভাব বা কার্যকারিতা নিয়ে নিজেদের মাঝে আলাপ আলোচনা।

অভিনয়মণ্ডলে (space) সঙ্গীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার এই পদ্ধতির মাধ্যমে দুটো জিনিস পাওয়া যায়। এর মধ্য দিয়ে ১. পরিবেশ-প্রতিবেশের চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং ২. ব্যক্তিগত অভিনিবেশের উত্তরোত্তর উন্নয়ন সাধন হয়। দৃষ্টি থেকে ঘরের দেয়ালগুলো ক্ষীণ হয়ে যেতে থাকলে সঙ্গীর অবয়বগ্রাহ্যতার প্রাধান্য বাড়তে থাকে। ধাপে ধাপে কয়েকটি জটিল মুহূর্ত আসতে পারে যখন অতি শক্তিশালী কায়িক সংবেদন জাগবে। এই পর্যায়গুলো পড়ে সাধারণত বার, সাত ও দুই গজ দূরত্বে। পরস্পর অভিমুখে এই সরণ আদৌ মসৃণ হয় না। এটি স্পষ্টতই চলতে থাকে থমকে থমকে ধাপে ধাপে ভেঙে ভেঙে। এই চলন যতটা মানসিক তারচেয়ে অনেক বেশি শারীরিক অভিজ্ঞতার বিষয়; এটা শরীরসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তের জটিল কতগুলো মুহূর্তের অভিজ্ঞতা। সরণের ধাপে ধাপে শরীর একটু আধটু পুনঃসমন্বয় করে নেয়। এতে করে চলনের ধারাবাহিকতা ব্যহত হয়, ছন্দ পরিবর্তিত হয়, পদক্ষেপে আড়ষ্টতা আসে এবং হাঁটার তালে ফাঁক পড়ে। প্রত্যেক খেলোয়াড়েরই এই অভিজ্ঞতাগুলো ঘটে; প্রত্যেকেই এ সম্পর্কে অবগত হয় যার যার মত করে। আমার নিজের ক্ষেত্রে যা হয় তা হলো ঐ ক্রান্তি-বিন্দুগুলোতে আমি পিঠের দুই স্কন্ধপেশীগুচ্ছের মাঝখানে হঠাৎ চাপ বোধ করি। বলে রাখা ভালো যে এই অনুশীলন তাদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে কার্যকর হয় যাদের দৃষ্টিসীমা ১৮০ ডিগ্রি; কারণ এরা যুগলের স্পর্শসীমায় চলে আসা পর্যন্ত পুরো সময়টায় দুই পার্শ্বের দেয়ালের সাপেক্ষে সঙ্গীর অবস্থান আদ্যোপান্ত ধরে রাখতে পারে।

এইভাবে সবার খেলা হয়ে যাবার পর আবার একেবারে প্রথম থেকে খেলাটা শুরু হবে। এবার সবাইকে বলা হবে খুব দ্রুত চলতে বা পরস্পরের দিকে ছুটে যেতে। সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দিলে যে যার ডানে সরে যাবে। এটা বুঝতে পারলে আর শারীরিক বিপদের সম্ভাবনা থাকে না। তারপরও দেখা যায় তারা পরস্পর থেকে পাঁচ গজ দুরত্বেই সরণরেখা থেকে বিচ্যূত হয়। (পরস্পরের মাঝে বার গজ দুরত্বেও একটা ক্রান্তিবিন্দু পড়ে যেখানে ছন্দপতন হবার কথা; কিন্তু গতির প্রাবল্যে সেটা কোনো রকমে অতিক্রান্ত হয়।)

এই অনুশীলনের মধ্য দিয়ে দুরত্বের তারতম্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন ও গভীরতায় যে ভিন্নতা আসে সে-সম্পর্কে অভিনেতৃ সজাগ হয়ে উঠে। এরপর এই অনুশীলনকে কাজে লাগাতে হবে থিয়েটারের এক বিশেষ সংকট নিরসনে। প্রায়শ দেখা যায় অনেক বড় ও খোলা মঞ্চে নিবিড় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও পাত্র-পাত্রীকে কিছুটা দুরত্বেই অবস্থান নিতে হয়। আবার ছোট মঞ্চে অবলম্বন করতে হয় এর বিপরীত কৌশল। তবে এক্কেবারে ছোট্ট মঞ্চে মানবিক সম্পর্কের দৃশ্যায়নে উদ্ভুত সমস্যা ছাড়াও, কোনো কোনো নাটকে (যেমন ওথেলো) এমন পরিস্থিতি আসে যেখানে পাত্র-পাত্রী শারীরিক-নৈকট্যের মধ্যে থেকেও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্নতা অন্বেষণ করে। আমি যেসব দলের সাথে কাজ করেছি তাদের সবারই এই গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি হয়েছে যে গায়ে গায়ে না থেকেও সুগভীর অন্তরঙ্গতার ভাব ফুটিয়ে তোলা যায়।

থিয়েটারী মোকাবেলা

থিয়েটার হচ্ছে ক্রীয়াশীল মানবিক সম্পর্কের কলা। এই সংজ্ঞা যেমন একদিকে পূর্বারোপিত- কাঠামোবিহীন তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনজাত আধুনিক নাট্যের বেলায় প্রযোজ্য, অন্যদিকে আচারকলা (rituals) ও সুপ্রতিষ্ঠিত আদি নাট্য আঙ্গিকসমূহের বেলায়ও তাই। থিয়েটারে মানুষে মানুষে সাক্ষাৎ হয় এবং তাদের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় প্লট। যবনিকায় পরিস্থিতি তেমন থাকে না যেমন ছিল শুরুতে। কারণ, সেখানে মানুষের অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া। এবং নাট্যকার বা অভিনেতৃ বা চরিত্রের সাথে বিনিময়ে দর্শক-স্বাতন্ত্রের মাঝেও সেই পরিবর্তন সাধিত হয়ে যায়।

আগেই আমি এই তর্ক রেখেছি যে দর্শক প্রথমত নাট্যপরিস্থিতির অনুকূলে তার শারীরিক প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিবেশনাকে নিজের ভেতরে নেয় এবং অনেক পরেই সে কেবল এই প্রাথমিক অভিজ্ঞতাকে সচেতন-চিন্তা-প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে যায়। যদি তাই হয়ে থাকে, দর্শকের কাছ থেকে সবচে শক্তিশালী সাড়া পাওয়া যায় তখনই যখন মঞ্চে পারস্পরিক সাক্ষাৎ-মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে অভিনেতৃ যে-নাটকীয় আদান-প্রদানের রূপায়ন করছে তার কায়িক সংবেদন (kinesthetic sensation) কাল্পনিকভাবে শরীরে জাগিয়ে তুলতে পারে। অভিনেতৃ যদি কেবল যান্ত্রিকভাবে পূর্বঅভিজ্ঞতা/অতীত পরিস্থিতি হাতড়াতে থাকে অর্থাৎ তার পুনরাবৃত্তি করতে সচেষ্ট হয় অথবা যদি তারা অভীষ্ট-চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকে তাহলে দর্শক-সাড়া মিলবে না। যদি তাই হয়, দর্শক কেবল মঞ্চের উপর তৈরি হতে থাকা ছবিগুলো এবং উচ্চারিত পাণ্ডুলিপির সরল অর্থ অনুসরণ করতে থাকবে। আপাতদৃষ্টে মনে হবে যেন সত্যিকার মিথস্ক্রিয়া ঘটছে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে দর্শক তার শরীরে পরস্পরবিরোধী টান ও চাপ অনুভব করতে শুরু করবে। একটা অস্বস্তি সে অনুভব করবে। অচিরেই সে বোধগম্যতা এবং আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তার একঘেয়ে লাগতে শুরু করবে যার পরিণামে মিথস্ক্রিয়ার প্রক্রিয়া থেকে সে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবে।

সেকারণেই অভিনয় প্রশিক্ষণের বৃহত্তর অংশজুড়ে থাকা উচিত সাক্ষাৎ-মোকাবেলা-আদান-প্রদানের মাধ্যমে মানবিক সম্পর্কের অন্বেষণসংশ্লিষ্ট ক্রীড়া। চরিত্র প্রস্ফুটিত হয় ক্রিয়ার মাধ্যমে, বলেছেন স্বয়ং এ্যারিস্টোট্ল। এই শর্ত না মানলে চরিত্র হয়ে পড়ে একটি অচল ও স্থবির ধারণা এবং এর মধ্য দিয়েই থিয়েটার তার সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে।

দ্বন্দ্ব

মানবিক বিনিময়ের সবচে তীব্র ও খোলাখুলি নাটকীয় আঙ্গিক হচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় পরিস্থিতি। এটা বহু নাট্যের মূল ও শক্তিশালী উপাদান। এটাতো প্রায় স্বতঃসিদ্ধ যে নাটক নিয়ে পাঠ-বিশ্লেষণ বা প্রযোজনা নির্মাণের পথে প্রশ্ন আসে ‘নাটকের দ্বন্দ্বটা কোথায়’। কোনো মানুষই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। স্বতন্ত্র চরিত্রের মনের ভিতর দ্বন্দ্ব তৈরি হয় বাইরের চাপ থেকে; প্রায়শই দেখা যায় এই দ্বন্দ্বটা হয় ব্যক্তিগত রুচি ও প্রতিষ্ঠিত সামাজিক আচরণের মধ্যে।

ছোঁও তোমার সঙ্গীকে

দুইজন খেলোয়াড় পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। দুইজনেরই লক্ষ্য প্রতিপক্ষের পিঠের নিম্নভাগের সরু অংশ স্পর্শ করে করে পয়েন্ট তোলা এবং একই সাথে নিজেকে বাঁচিয়ে প্রতিপক্ষকে পয়েন্ট তুলতে না দেয়া। ঐ অংশটুকু ছাড়া দেহের অন্য কোনো অংশে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো স্পর্শ করা যাবে না। প্রতিদ্বন্দ্বীর বাহু বা হাত খপ করে ধরে ফেলা যাবে না বা ধস্তাধস্তি করা যাবে না। এটা আসলেই একটা অত্যন্ত সরল কৌতুকপূর্ণ খেলা। তবে প্রথমে খেলাটা কুশলতার সাথে খেলা যায় না। এর কারণগুলো সবার কথা থেকে উঠে আসে:

    - খেলোয়াড়েরা প্রতিপক্ষকে ‘খেয়াল’ করে না বললেই চলে।
    - তারা প্রতিপক্ষের হাতকে অনুসরণ করে, চোখকে করে না;
    - আক্রমণ ও আত্মরক্ষার বিপরীত সম্ভাবনার মাঝামাঝি একটা ভারসাম্যে তারা অবস্থান করে না যেটা মুষ্টিযুদ্ধ ও অসিক্রীড়ায় দেখা যায়;
    - একটানা আক্রমণ বা একটানা আত্মরক্ষা করতে থাকে যাতে করে বিপরীতমুখি ক্রিয়ার অন্তর্বর্তীতে সহজ অঙ্গসঞ্চালন ব্যহত হয়।
    - ঝুঁকির কথা আমলে না এনে তারা দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আক্রমণ চালায়।
    - অথবা ঐযে বীমা’র কথা বলেছিলাম, পরাজয়ের বিরুদ্ধে সেই আত্মরক্ষা বীমা নিয়ে তারা এমন দুরত্বে অবস্থান করে যেখান থেকে আর পয়েন্ট সংগ্রহ করা যায় না।

খেলাটা খেলোয়াড়ের ব্যক্তিত্বের কিছু কিছু দিকও তুলে ধরে। সেই পরিস্থিতিতে কেন সে ওভাবে আচরণ করে?

উপরের প্রবণতাগুলোকে ব্যবহার করে বুঝানো যেতে পারে আসলে কী পার্থক্য রয়েছে সচেতন মনঃক্রিয়াদি এবং শরীর-চিন্তন প্রক্রিয়াদির মাঝে (মুষ্টিযোদ্ধা বা অসিযোদ্ধারা সহজাতভাবেই এর উপর নির্ভর করে থাকে)।

খেলাটার কাঠামোই এইসব ভ্রমের জন্য দায়ী। এই খেলাটার যে-পরিস্থিতি তাকে নাট্য পরিভাষায় বলা চলে পরস্পর একচেটিয়া লাভালাভের ‘বিরোধ’, যার মধ্যে ছাড় দেবার কোনো সুযোগ নেই। এর অনুশীলন ক্রিয়ায় হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে যায় যখন পয়েন্ট ছিনিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠা দুজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। কিন্তু মুষ্টিযুদ্ধ খেলায় থাকে দ্বন্দ্বের বিরোধ; এতে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিপক্ষ সম্পর্কে গভীরভাবে সজাগ হওয়ার মাধ্যমে দক্ষতার উচ্চ স্তরে পৌঁছানো সম্ভব। তাই আমাদের দেখতে হবে কোন কোন বিষয় এই বৃত্তিগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে। এক্ষেত্রেও কারণগুলোকে পাওয়া যায় এই অনুশীলনের মধ্যেই।

খেলাটা খেলতে মজা লাগে কারণ এর মধ্য দিয়ে দেহশক্তির নিঃসরণ হয় এবং এটা অত্যন্ত উত্তেজনাকর। বইয়ের শুরুতে এই ধারণাটা এনেছিলাম যে শারীরিক দক্ষতা অর্জনের পথে একঘেয়েমি একটা প্রয়োজনীয় ধাপ। এখন সেই সম্পর্কে একটি রূপরেখা তৈরি করবো।

কয়েকবার খেলবার পর খেলাটা যখন চলে যায় দক্ষতার উচ্চতর স্তরে। তখন ‘এসো, তোমার সঙ্গীকে স্পর্শ করো’ বলবার পর ওরা একঘেয়ে বোধ করে; তাড়নাদায়ী হরমোন নিঃসৃত হয় না; একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকায় এবং ঢিলেঢালা মনোভাব নিয়ে খেলতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে অজান্তেই তারা ছলাকলা-ভানভনিতায় পরস্পরকে ধোকা দেবার কৌশল অবলম্বন করে; আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ করে এবং এইভাবে চলতে থাকলে খেলাটি মুষ্টিযুদ্ধ ও অসিক্রীড়ায় যেমন দক্ষতার প্রয়োজন সেই ধরনের দক্ষতা দাবী করে। প্রথমবার খেলাটি উপভোগ্য হয় অংশগ্রহণের ব্যক্তিনিষ্ঠ (subjective) অভিজ্ঞতার কারণে। দ্বিতীয় পর্যায়ে হয় খেলার জন্য খেলা। এরপর আসে আরো উচ্চতর দক্ষতার পর্যায় যখন খেলাটা উপভোগ্য হয় এর মধ্য দিয়ে কী বেরিয়ে আসে সেই ঔৎসুক্যের কারণে অর্থাৎ নাট্যপরিস্থিতি বিনির্মাণের কাঠামো হিসেবে এর প্রয়োগের জন্য। সেই দিকে আসছি পড়ে। কিন্তু ক্রীড়া-অনুশীলনে এটা উপলব্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রারম্ভিক শক্তি-মোক্ষণের রেশ না মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রশিক্ষণের সুফল তুলে আনা সম্ভব নয়। উদ্দেশ্যবিহীন শরীরচর্চার বিষয়ে আমার যে-সমালোচনা তা হচ্ছে এই যে, তাতে নিঃসরিত শক্তিকে প্রক্রিয়াজাত করে কাজে লাগানো যায় না। গা-গরম করার বেশিরভাগ পর্বগুলোতেই দেখা যাচ্ছে যে শক্তিপ্রবাহ নিস্তেজ হয়ে গেলে তবেই অন্যান্য শক্তিমোক্ষণ-ক্রীড়ার খোঁজ চলে। ফলে অভিনেতৃও ক্লান্তি বোধ করে।

এক খেলা থেকে আরেক খেলারদিকে মোড় নেয়ার মুহূর্তটি চেনা যায় একঘেয়েমির অনুভূতি দিয়ে। এক্ষেত্রে যেটা ঘটে সেটা মানুষের অন্যান্য ক্রিয়ায়ও প্রতিফলিত হয়। যেমন, ফুটবল খেলার বেলায় একটি বালক প্রথমে আনন্দ পাবে বলটাকে কেবল মাঠের অনির্দিষ্ট কোনো দিকে লাথি মারার মাধ্যমে। এটা উপভোগ্য হয় কারণ এর মধ্য দিয়ে শক্তিমোক্ষণ হয়। এই যে কেবলি মাঠের দিকে বলটা লাথি মারা এতে সে এক পর্যায়ে আর মজা পায় না এবং তার অতৃপ্তি আসে। পরের পর্যায়ে দুই পায়ের দুই জুতো দিয়ে গোলবার বানানো। তারও পরের ধাপে দুইজনের চার পায়ের জুতায় দুই গোলবার। দুই দলের খেলা। এরও শেষ আছে। সে চাইবে আনুষ্ঠানিক নিয়ম-কানুনের আওতায় দর্শকভরা মাঠে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ম্যাচ খেলতে এবং সত্যিকার পুরস্কার পেতে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে বালক চলে যেতে পারে খেলাটার পেশাদার স্তরে। তাতে খেলাটা পরিণত হয় তার জীবনযাপনের একটি পন্থায় যার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে প্রকাশ করবে।

প্রত্যেক শিল্পী এই ক্রান্তিরেখাগুলো পেরিয়ে তবেই সামনে অগ্রসর হন। অভিনেতৃর ক্ষেত্রেও এটা কম খাটে না। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে এই পর্যায়গুলো চিহ্নিত হতে পারে এইভাবে: শিশুক্রীড়াকে নাট্যের মাঝে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা বোধ; নিজেকে প্রশিক্ষণের জন্য হাজির করা; তারপর ‘থিয়েটার স্কুল’ ছেড়ে পেশাদার হিসেবে কাজ করা। তবে, এই কথাগুলোর স্বচ্ছতা প্রয়োগের পর্যায়ে গিয়ে ঝাপসা হয়ে যায় কারণ এই নিরাপত্তাহীন জগতে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে যখন তিন বছরের কোর্স একজন অভিনেতার সৃজনশীল ও কৌশলগত উন্নতির জন্য আদৌ যথেষ্ট নয়। একদিকে সদ্য থিয়েটারী খেলার নিয়মকানুন শিখে প্রয়োগের উপায়ান্তর অন্বেষণ অন্যদিকে নিরুত্তাপ, আত্ম-নিরপেক্ষ (objective), পেশাদারী দক্ষতার উচ্চপর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এক অভাবনীয় সমস্যার জন্ম দেয়।

খেলার মধ্য দিয়ে রূপান্তরের পর্যায়গুলোকে সহজ করার কয়েকটি পথ আছে। কিন্তু সেখানে তাড়াহুড়োর কোনো সুযোগ নেই। কারণ শক্তিমোক্ষণ থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান পর্যন্ত ধাপগুলো আমি যেমন বিচিত্র পরিসরের মধ্য দিয়ে পরিচালিত করি তাতে প্রতিটি পর্যায় হয়ে দাঁড়ায় একটা সামগ্রিক শিল্পরীতি বা কর্মকৌশলের অংশ যা পরিবর্তী প্রতিটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে সম্প্রসারিত ও বিকশিত হয়। সচেতন মনপ্রক্রিয়াদিকে প্রতিস্থাপিত করে শরীর-চিন্তন প্রক্রিয়াদিকে প্রতিষ্ঠার নীতিতে এত ব্যাপক কর্মপরম্পরা পরিচালিত হয় যে অভিনেতৃ সহজাতভাবেই বুঝতে শুরু করে কোন খেলায় তার কাছ থেকে কী চাওয়া হচ্ছে। শুধু একটু অপেক্ষা করে দেখতে হবে অভিনেতৃ কখন বিরক্ত হতে শুরু করে। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে খেলাটা সহজ সরলভাবে প্রথমে কয়েকবার খেলা হয়ে যাবার পরেই কেবল নিয়ম-নীতি আরোপ করতে হবে। খেলার উপর নিয়মের বাঁধনে শিশুদের সমস্যা হতে পারে, বড়দের হয় না বললেই চলে। ব্যাপারটা তাদের নৈমিত্তিক জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে রূপান্তরটা কৃত্তিমভাবে জাগিয়ে তোলা দুরূহ নয়। তাছাড়া, ঐ যে খেলার মর্মটাকে নিয়ে ফেলতে হবে থিয়েটারের ফ্রেমে এবং অনুশীলনাদির অনেক ক্ষেত্রই যে মহড়া এবং পরিবেশনার সাথে সম্পর্কযুক্ত - এই দিকগুলোও অভিনেতৃকে বুঝতে সাহায্য করে যে খেলাটা হেলাফেলার বিষয় নয় বরং সবকিছুই একটা বিশেষ গন্তব্যের দিকে ধাবিত; ফলে সে প্রায়শই আগ্রহী হয়ে উঠে নিজের ভিতর তাড়না সৃষ্টি করে।

খেলার ক্ষেত্রসীমাকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ‘ছোঁও তোমার সঙ্গীকে’ নামের দ্বন্দ্ব-ক্রীড়ায় একটা নিয়ম চালু করা যেতে পারে। যেমন, চক দিয়ে একটা ছোট বৃত্ত এঁকে দিয়ে বলা যেতে পারে যে এর বাইরে পায়ের পাতা পড়তে পারবে না। এই কানুন দিয়ে শরীরকে বেঁধে দিলে দেখা যাবে চোখের উপর নির্ভরতা বাড়ছে এবং চোখে চোখে সংযোগ ঘটছে। এক্ষেত্রে প্রথমে হয়তো দৃষ্টি বিনিময় অটুট রাখা কঠিন হবে। কিন্তু অঙ্গসঞ্চালন অবাধ থাকাকালে দেখা গেছে অভিনেতৃ সচেতন হয়ে উঠলেই কেবল চোখের কথা মনে পড়ে, নয়তো নয়। মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে, হাতের দিকে তাকানো ফলপ্রসু হয় না; এতে করে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং এর দরুন ভারসাম্য হারিয়ে যেতে বাধ্য।

খেলাটাকে একটা নাটকীয় পরিস্থিতির সরল দৃশ্যকল্প হিসেবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেই নাটকীয় পরিস্থিতির সূত্র ধরে ধাপে ধাপে শৃঙ্খলাবিধান করা হয়। এই ধরনের খেলাগুলো শরীর-কেন্দ্র-অভিমুখি শক্তিপ্রবাহকে বহির্মুখি করে চাপ নিঃসরণে কার্যকর হয়। এই অবস্থাকে পর্যায়ক্রমিকভাবে সঠিক খাতে প্রবাহিত করে দিতে হয় যার সূত্র অনুসরণ করতে করতে অভিনেতৃ তিলে তিলে মানবিক বিনিময়ের একটি জটিল বুননে নিমগ্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেটা আদৌ ঘটবে না যদি তাকে আচমকাই পুরো পরিস্থিতিটি এক নিমিষে তৈরি করতে বলা হয়।

ধাতব  মুদ্রা

আরো জটিলসব খেলা বের করা যায় যার মাধ্যমে আরো নানাবিধ মৌলিক সংঘাতময় পরিস্থিতি তুলে আনা যেতে পারে। এই ‘ধাতব মুদ্রা’ খেলাটি হচ্ছে ‘ছোঁও তোমার সঙ্গীকে’ নামক খেলার একটি ভিন্ন সংস্করণ। এক্ষেত্রে খেলোয়াড় দুজনের প্রত্যেকে বাম হাতের তালুতে একটি করে কয়েন নেবে। খেলার লক্ষ্য হচ্ছে কয়েনটাকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের মনোযোগ সরিয়ে  দিয়ে তার কয়েনটা ছিনিয়ে নেয়া যায়। যাকে বলে ‘শরীর-চিন্তন প্রক্রিয়া’ তা সক্রিয় করে তোলা অত্যন্ত জরুরি এই খেলায়। প্রতিপক্ষের কয়েনটাকে অনুসরণ করতে থাকলে নিজের কয়েনের কথা খেয়াল থাকে না যার পরিণতি পরাভব মানা। বিপরীতে নিজের ধন সামলাবার কথাই যদি কেবল ভাবা হয় তাহলে অন্যের ধন চোখেও পড়বে না ছিনিয়েও আনা যাবে না। সাফল্যের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে প্রতিপক্ষের চোখ অনুসরণ করা এবং নিজের সহজাত শরীর-চিন্তন প্রক্রিয়ার হাতে বাকিটা ন্যস্ত করা। এই খেলাটাতো আগেরটার চেয়ে অনেক বেশি সূক্ষ্ম একটা দ্বন্দ্বের অবতারণা করে: যা চাই তা পেতে হলে যা আছে তাকে হারাবার ঝুঁকি নিতে হবে।

দলীয় দ্বন্দ্ব এবং যুগোপযোগী চালচলন

চলমান অনুশীলনটিকে দলীয় ক্রীড়ার দিকে নিয়ে যাওয়া যায় এবং এগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে কোনো নির্দিষ্ট যুগের মানুষের গড়পড়তা চালচলন আয়ত্ব করার চর্চায়। ইতিহাসের যে-কোনো পর্বের মানুষের চালচলন নির্ভর করে সেই সময়ের মানুষের উদ্দেশ্য হাসিলের পন্থার উপর; তা দ্বন্দ্ব বা বিনিময় যেভাবেই হোক না কেন। সেটাই হচ্ছে এই খেলার সামাজিক বিধান। একেক যুগ এবং একই যুগের একেক নাটকের পরিবেশনার জন্য প্রয়োজন একেক ধরনের ক্রীড়া কাঠামো। সে-সম্পর্কে ধারণা দিতে আমি একটি নাটক বেছে নিচ্ছি।

সপ্তদশ শতকের প্রথম চতুষ্টকের রাস্তার দৃশ্য

ছোঁয়াছুঁয়ির দ্বন্দ্ব থেকে আমরা যাব মুদ্রা নিয়ে সংঘাতের খেলায়। খেলোয়াড়দের বলা হল মুদ্রাগুলো হাতের তালু বন্ধ না করে খোলা অবস্থায় ধারণ করতে; তবে এক্ষেত্রে আর সামনে নয় মুদ্রা রাখা হাত থাকবে শরীরের পিছন দিকে। তারা না পারবে দৌড়াতে না পারবে হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে; দেয়াল থেকে দুই ফুটের কম দুরত্বে অবস্থান করে মুদ্রা রক্ষার চেষ্টাও নাস্তি। খেলোয়াড়দের লক্ষ্য হচ্ছে নিজের মুদ্রা রক্ষা করে অন্য যতজনের সম্ভব মুদ্রা চুরি করা; কোনো অবস্থাতেই মুষ্টি বদ্ধ করা যাবে না। নিজের মুদ্রা হারানো মাত্র অবসর।

খেলাটা প্রত্যক্ষভাবে অন্য সেইসব খেলার সাথে সম্পর্কযুক্ত যেগুলোর মধ্য দিয়ে ৩৬০ ডিগ্রী  পরিসর-চেতনা (awareness of space) অর্জিত হয়। আবার এটা সেই লম্ফক্রীড়ারও একটি ঠাণ্ডা সংস্করণ যেখানে তিনজন খেলোয়াড় স্থানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্পর্কের পরিবর্তন সূত্রে ২:১ / ১:২ অনুপাতে ঐক্য গড়ে ও ভাঙে। এই দুই খেলার দ্বিভিদ উপাদান বর্তমান খেলাটার মধ্যে রয়েছে আরো জটিলভাবে।

চলতে চলতে খেলাটা আরেকটা বৈচিত্র্যের দিকে ধাবিত হয়। ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে আসবে রুমাল যার একপ্রান্ত কোমরের পেছনে বেল্টে গুজে আরেক প্রান্ত ঝুলিয়ে নিতে হয়। খেলাটা খেলতে হয় বেশ কয়েকবার। ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ আরোপ করতে করতে এগুতে হবে যতক্ষণ না এই কাঠামোটা দাঁড়ায়- রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে রক্ত-গরম যুবকেরা; গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাচ্ছে। সেখানকার আইনে পরিস্কার বলা হয়েছে যে, ডুয়েল লড়ার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যদি না খুনি প্রমাণ করতে পারে সে আত্ম-রক্ষার্থে খুনটা করেছে। এই সূত্রে অন্য সব খেলোয়াড়রা এমন উস্কানিমূলক আচরণ করতে থাকে যেন কেউ তাদের আক্রমণে উদ্যত হয় অথবা সংঘর্ষ এড়াতে নিজেকে গুটিয়ে নেয় যা তাদেরকে কাপুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এখানে ওস্তাদিটা হচ্ছে ইজ্জত বাঁচিয়ে উস্কানিমূলক পরিস্থিতি থেকে নিজেকে দূরে রাখা অথবা প্ররোচনার বিপরীতে এমন নির্দোষ প্ররোচনা দেয়া যাতে আইনের কাছে এটা প্রমাণ করা যাবে না যে সে খুন হবার মত উস্কানি দিয়েছে। রোমিও এন্ড জুলিয়েট নাটকের অভিনয় নির্মাণের কাজে এই খেলাটা বেশ ভালো যায়।

অন্য খেলোয়াড়েরা পকেটমারের ভূমিকায় পকেট (রুমাল) চুরি করতে থাকবে ধরা না পড়ে, খতম না হয়ে বা গ্রেফতার না হয়ে। এতে তারা তোষামদসহ যে-কোনো ছল করতে পারে। যদিও কথা বলা যাবে না যতক্ষণ না খেলাটা মহড়ায় বা তার কাছাকাছি পর্যায় পর্যন্ত গড়ায়।

৩৬০ ডিগ্রীতে ব্যাপ্ত পরিসর-চেতনা ও তার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট আত্মবিশ্বাস এবং নিয়মকানুনের প্রভাবে পারস্পরিক সম্পর্কের যে-ধরন পাওয়া যায় তা ক্রমে ক্রমে একটি জটিল সামাজিক পরিস্থিতি নির্মাণ এবং দুই দল চরিত্রের জন্য সামাজিক চালচলনের একটি সাধারণ ছাঁচ তৈরি হওয়াকে সম্ভব করে তোলে। চাল-চলন-আচার-আচরণের এই সাধারণীকৃত ধরনকে সুনির্দিষ্টকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় স্বতন্ত্র চরিত্র ও স্বতন্ত্র পরিস্থিতি সম্পর্কিত নিয়মকানুন আরোপের মাধ্যমে। বিশেষ কালের একটি চরিত্রের চালচলন কেমন হওয়া উচিত এই প্রশ্নের মিমাংসায় অতি ব্যবহারে জীর্ণ একটি আদল না হাতড়ে অভিনেতৃ তার বিনির্মাণ প্রক্রিয়াকে দাঁড় করায় ধাপে ধাপে গড়া শরীর-চিন্তন কর্মকাঠামোর উপর। সেটাই তার বিশ্লেষণী হাতিয়ার।

রেস্টোরেসন-কমেডির জন্য খেলা

এখানে আমাদের কাজ ‘স্পর্শ দ্বন্দ্ব’ ও ‘মুদ্রা সংঘাত’র মধ্য দিয়ে আরো মসৃণ একটি ক্রীড়াকাঠামোর দিকে যাত্রা করা। খেলোয়াড় থাকবে দুইজন। একজন মহিলা ও একজন পুরুষ।

মুদ্রাটা আছে মহিলাটির হাতে। সে একজনের উত্তরাধিকারী এবং টাকাটা তার বরপণ। এ দিয়ে সে একজন ‘ভালো’ মানুষকে আকৃষ্ট করবে স্বামী হিসেবে পাবার জন্য। লোকটা হবে এমন একজন যে দেখাশোনায় এবং আচার-আচরণে তার যোগ্য। মহিলা চায় টাকার লোভে হলেও পুরুষটি তাকে প্রেম নিবেদন করুক; উদ্দেশ্য, বুদ্ধি করে তাকে এমন অবস্থায় আসতে দেয়া যাতে করে সে তার বাহুর নিচে পুরুষটির বাহুযুগল বন্দি করে ফেলতে পারে।  ব্যাপারটাকে দেখতে হবে রূপক হিসেবে: এক মহিলা একজন পুরুষকে শহর থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নটিংহ্যামশায়ারের গ্রামের বাড়িতে বসবাস করবে বলে। এখন সে যদি তার টাকাটা অতিরিক্ত শক্ত করে ধরে থাকে তাহলে পুরুষটি প্রেম নিবেদন করবে না বা তার কাজটা হয়ে যাবে কঠিন। আবার সরাসরি হাত পাকড়াও করতে গিয়ে যদি তার উদ্দেশ্য ফাঁস হয়ে যায় তাহলে পুরুষটি বিপদের গন্ধে গা গুটিয়ে নেবে।

মহিলার ঐ সম্ভাব্য স্বামীটি পিতার কনিষ্ঠ পুত্র, সেরা পোশাক পরিধানে অভ্যস্ত, হালের ক্লাবে মদ খাওয়া জুয়া খেলা, বনেদি ঘরের লোকেদের সাথে ঘোড়দৌড়, রাজপথে বা থিয়েটারে সপ্রশংস দৃষ্টিলাভে অভ্যস্ত। এসব করতে টাকা লাগে। কিন্তু অত টাকা তার নেই। সুতরাং ঐ মহিলাকে মুগ্ধ করে প্রেম নিবেদন করে টাকাটা বাগিয়ে নিতেই হবে। আবার নিজের মত করে টাকাটা উড়াতে গেলে যে করেই হোক মহিলার শরীরের ফাঁদ এড়িয়েই চলতে হবে। শব্দ ব্যবহারে মানা আছে কিন্তু ধ্বনি চলতে পারে। এছাড়া শুরুতে আর কোনো বিধিনিষেধ নেই।

খেলাটা বেশ কয়েকভাবেই খেলা যায়। সবচে ভালো হয় প্রথমে সংশ্লিষ্ট দুজন খেলাটার ভিতর নিজেদের মত করে কী পায় তা আবিষ্কার করতে দেয়া। দুজনের যে কেউ কোনোরকম ভুল করলে পরে খেলাটা বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। (যেমন, যদি দেখা যায় পুরুষটি টাকায় থাবা দিয়ে ফেলেছে যার মানে সে মর্যাদা হারাল এবং সে আর ‘সুযোগ্য’ পাত্র রইল না।) ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা বিধান করা বা সে-যুগের আচরণবিধি আরোপ করা যেতে পারে। প্রত্যেক যুগেরই থাকে নিজস্ব আচরণপ্রথা যেমন, শরীরের কোনো কোনো স্থানে স্পর্শ করা যায় বা যায় না। এভাবে সামাজিক আচরণের চালচিত্রকে পর্যায়ক্রমিকভাবে বিস্তৃতি দিতে হয়।

কখনো কখনো ভুল করা সত্ত্বেও খেলোয়াড়কে থামানো হয় না। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে কী পন্থা সে খুঁজে বের করে তা দেখা। সব কালে সব মানুষই সামাজিক ষড়যন্ত্র¿ তৈরি করেছে। এবং নাটকগুলোও এমন অনেক পরিস্থিতিতে ঠাসা যেগুলো সেই ভুলকে কাজে লাগিয়েছে। কখনো খেলাটাকে সাজানো হয় রিলে রেসের মত করে যেখানে একজন ‘প্রেমিক’র পর আরেকজন এবং একজন ‘উত্তরাধিকারী’র পর আরেকজন আসতে থাকবে যাতে করে আগেরজনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এসে পরেরজন নিজের পর্যবেক্ষণকে চর্চার মাধ্যমে যাচাই করে নিতে সক্ষম হয়।

খেলার হাত ধরে চলে অধ্যয়ন এবং পাণ্ডিত্য অর্জন। নাটক এবং নাটকের সামাজিক প্রেক্ষিতসংশ্লিষ্ট পাঠ-অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জিত আত্ম-নিরপেক্ষ (objective) জ্ঞানকে বাহিত করতে হবে প্রত্যক্ষ চর্চা ও প্রয়োগের খাতে। এই প্রক্রিয়ায় যা বেরিয়ে আসবে তা হলো সপ্তদশ শতকের ষাটের দশকের (restoration) ইংরেজ চালচলন।

অসিত কুমার ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ) : অনুবাদক, সদস্য- ঐকিক থিয়েটার, নারায়ণগঞ্জ।