Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গ্রুপ থিয়েটারে রবীন্দ্রনাটক : পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

রবীন্দ্রনাথের নাটকের তত্ত্ব বা রস বিশ্লেষণ অভিপ্রায় নয়। মূলত এ রচনা গ্রুপ থিয়েটারের (পশ্চিমবঙ্গসহ) নাট্যচর্চায় রবীন্দ্রনাটকের সম্পৃক্ততা অনুসন্ধানের প্রয়াস প্রসূত। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে দেবেন্দ্রনাথের ভাই গিরীন্দ্রনাথ দেশী যাত্রার অনুসরণে যাত্রাপালা রচনা করে অভিনয় করাতেন। পাশাপাশি যাত্রাদল ভাড়া করে এনে তাঁরা বাড়িতে দেশি যাত্রার অভিনয়ের ব্যবস্থা করতেন। রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব প্রবাহমান এই দুই ধারায়, পারিবারিক নাট্যাভিনয়ের ঐ আবহাওয়ায় তিনি বড় হয়েছেন।

বাঙালির আধুনিক নাট্যপ্রয়াস চরিতার্থ হয়েছে ইংরেজি নাটক এবং তার আদর্শ, অভিনয়রীতি ইত্যাদি অনুসরণ করে। বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে মূলত সংগঠিত ও নিয়মিত নাট্যপ্রয়াস বলতে গ্রুপথিয়েটারের নাট্যচর্চা (যদিও এর পূর্বের পেশাদার নাট্যপ্রচেষ্টাগুলোও নিয়মিত প্রয়াস ছিলো)। পেশাদার নাট্য মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের নাটকের অভিনয় স্বল্পতা মোটেই অবাক হবার মতো বিষয় নয়। কারণ, পেশাদার নাট্যদলগুলো রবীন্দ্রনাথের নাটকের আদর্শ, ভাব ও রুচি অনুধাবনে ছিলো ব্যর্থ। আরো সহজ করে বললে পেশাদার দলগুলোর দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের নাটকে বাণিজ্য করবার মতো উপাদান ছিলো না। তাই পেশাদারি থিয়েটারের সমান্তরাল বিকল্প ধারার নাট্যরসিক যখন ডাকঘর বা রাজা নাটকের অভিনয়ে নতুন রীতির মুখোমুখি হচ্ছিলো তখনও পেশাদার দলগুলোতে কন্ঠহার, মোগল পাঠান, কিন্নরী, দেবলাদেবী এসব নাটক প্রযোজনার মধ্য দিয়ে সুস্পষ্ট ছিলো অর্থ উপার্জনের চেষ্টা।

১৮৬৮ সালের দিকে রবীন্দ্রনাথ যখন বাল্মীকি প্রতিভায় অভিনয় করছেন গিরীশচন্দ্র তখন বাংলার প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা ও পরিচালক, কিছু কিছু পেশাদার মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের নাটকের অভিনয় হলেও তখনকার নটসূর্য গিরীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের নাটকে কোনো অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। বিখ্যাত নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা অমরেন্দ্রনাথ দত্ত একবার গিরীশচন্দ্রকে ‘চোখের বালি’র নাট্যরূপ দিতে বলেছিলেন কিন্তু তিনি রাজি হননি বা উৎসাহ বোধ করেননি। এটা গিরশিচন্দ্রের কোনো অক্ষমতা বা ত্রুটি হয়তো নয়। কারণ, তখনকার ঐ স্রোতে অর্থাৎ কোলকাতার পেশাদার মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত ছিলো। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ভাবনা ছিলো। যাকে কৈফিয়ৎ বা প্রতিজবাবও বলা চলে। বনফুলের সঙ্গে নাট্য প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় পেশাদার ( দেশে এবং বিদেশেও) নাট্যমঞ্চ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন -‘নাট্যকাররা লোক ভোলানো নাটক লিখতেন জনপ্রিয় হবার জন্য। থিয়েটার করা তাদের পেশা ছিলো। নাটক জনপ্রিয় না হলে তাদের চলতো না। সে জন্যেই মানুষের মনের মোটা মোটা ভাবকেই নাটকের উপদান হিসেবে ব্যবহার করতেন। তীব্র প্রেম, ঘৃণা, প্রতিহিংসা, ভাঁড়ামি, সস্তা চটকদার নাচ গান এসব তারা নাটকের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করতেন। কারণ, লোকে সহজে বুঝতে পারবে এবং লোকের চিত্ত সহজে উদ্বুদ্ধ হবে। সুক্ষ্ম ভাবের নাটক সাধারণত জনপ্রিয় হয় না। সুক্ষ্ম ভাবের রসিক কম। দেশের বুদ্ধি বৃত্তিকে জাগরিত করে মানুষকে বৃহত্তর মুক্তির মন্ত্রে চালিত করাও নাট্যকারের কাজ। কিন্তু সে কাজে অগ্রসর হওয়ার বিস্তর বাধা। এধরনের নাটক পেশাদার রঙ্গমঞ্চ অভিনয় করতেই চাইবে না। আমি এ পথে কিছু চেষ্টা করেছি কিন্তু সে জন্য আমার নিজেকেই সব করতে হয়েছে। নিজের স্টেজ, নিজের দল, সব। জনসাধারণের কাছ থেকে বিশেষ উৎসাহ পাইনি।’

বনফুল রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- ‘আপনার শেষ রক্ষা এবং চিরকুমার সভা তো খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। ওরকম আর লিখলেন না কেন? রবীন্দ্রনাথ নাকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন- ‘লেখাটাতো উনপঞ্চাশ বায়ুর লীলা। কখন কি যে এসে মাথায় ভর করে কিছু বলা যায় না। তাছাড়া একঘেঁয়ে জিনিস লিখতেও ভালো লাগে না।’

বলা যায় পেশাদার নাট্যমঞ্চে অসফল উপেক্ষিত রবীন্দ্রনাটকের অভিনয়ের যে বিচ্ছিন্ন খতিয়ান পাওয়া যায় তার মধ্যে ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ এর নাট্যরূপ দিয়েছিলেন গিরীশচন্দ্রের অন্যতম সহযোগী কেদার চৌধুরী। নাট্যরূপে ঐ নাটকের নাম হয়েছিলো রাজা বসন্ত রায়। ঐ নাটক ১৮৮৬-র ৩ জুলাই গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত হয়। নাটকটি ১৮৯৫ এর ২৩ জুন পর্যন্ত গ্রেট ন্যাশনাল ও এমারেন্ড থিয়েটারে ৪৩ বার অভিনীত হয়েছিলো। অর্ধেন্দ্বু শেখর নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে পেশাদার মঞ্চে এ নাটকের অভিনয় দেখেছিলেন এবং বলেছিলেন-‘মুস্তোফি মহাশয়কে আমরা এতদিন হাস্যরসের অবতার বলিয়াই জানিতাম। সেদিন প্রতাপাদিত্যের অভিনয়ে তাহার বীর-রৌদ্ররসের চূড়ান্ত অভিনয় দেখিয়া তাহাকে সর্বরসের অবতার বলিয়া ধারণা হইল’। ঐ সমসাময়িককালে রবীন্দ্রনাথের ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’র নাট্যরূপ দু কড়ি দত্ত এমারেন্ড থিয়েটারে ১৮৯৫ সালের ৬ এপ্রিল অর্ধেন্দ্বু শেখরের নির্দেশনাতেই মঞ্চস্থ হয়েছিলো।

এমারেন্ড থিয়েটারে ১৮৯০ এর ৭ জুন থেকে ১৮৯৩ এর ৯ এপ্রিল পর্যন্ত রাজা ও রাণী নাটকটি মোট ৩৬ বার অভিনীত হয়। এরপরে আবার ক্লাসিক থিয়েটারের প্রযোজনায় রাজা ও রাণী নাটকের পুনরাভিনয় শুরু হয় ১৮৯৭ সালের ২৪ জুলাই। ঐদিন থেকে ১৯০০ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত রাজা ও রাণী আরও ১২ বার অভিনীত হয়েছিলো। নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন অমরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি বিক্রমদেবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীকালেও বিচ্ছিন্নভাবে একাধিকবার পেশাদার মঞ্চে রাজা ও রাণী অভিনীত হয়েছিলো। ১৯১২ সালের ১৮ মে থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছর বয়স পুর্তি উপলক্ষে অমরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিচালনাতেই রাজা ও রাণী মঞ্চস্থ হয়েছিলো। পেশাদার নাট্যমঞ্চে সম্ভবত ১৯২৩ সালের আগস্ট মাসে স্টার থিয়েটার মঞ্চে আর্ট থিয়েটারের প্রযোজনায় রাজা ও রাণী র শেষ অভিনয় হয়েছিলো।

জানা যায় ১৯২০ সালে উপেন্দ্রনাথ মিত্র মিনার্ভা থিয়েটারের দায়িত্ব নিলে হেমেন্দ্র কুমার রায় তাকে রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকে অভিনয়ের অনুরোধ করেন কিন্তু উপেন্দ্রনাথ মিত্র রাজী হননি। এর অনেক পরে শিশিরকুমার ভাদুড়ী পেশাদার মঞ্চে বিসর্জন নাটকটি মঞ্চস্থ করেন ১৯২৬ সালে। এই ঘটনার পূর্বে ১৯২৫ এ রবীন্দ্রনাথ নিজে চিরকুমার সভা নাট্যরূপ দিয়ে প্রযোজনার দায়িত্ব দিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর উপর কিন্তু শিশিরকুমার ভাদুড়ী নাটকটি নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকায় অতীন্দ্র চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে নাটকটি অভিনয় করার সম্মতি নিয়ে আর্ট থিয়েটারের প্রযোজনায় ১৯২৫ সালের ১৮ জুলাই গানে, অভিনয়ে, কৌতুকে জমজমাট চিরকুমার সভা মঞ্চে আনলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে প্রথম অভিনয় রজনীতে উপস্থিত ছিলেন। এরপর মিনার্ভা, স্টার, নাট্যনিকেতন, নাট্যভারতী সহ বিভিন্ন মঞ্চে প্রায় নিয়মিত অভিনয় হয়েছে চিরকুমার সভা। বলা যায় পেশাদার মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে সফল বা দর্শকপ্রিয় নাটক চিরকুমার সভা। পাশাপাশি একথাও মনে রাখা দরকার রবীন্দ্রনাথের লঘু রসের বা রঙ্গ ব্যঙ্গের নাটকগুলো ছাড়া বিষয়ের দিক থেকে ভারি বা সিরিয়াস কোনো নাটক পেশাদার মঞ্চে স্থান পায়নি। তবুও পেশাদার মঞ্চে বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে রবীন্দ্রনাথের যে নাট্যপ্রয়াসগুলো হয়েছিলো তার একটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এখন তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

১৯১০ সালে ৯ জানুয়ারি গোড়ায় গলদ অভিনীত হয় কোহিনুর থিয়েটারে এবং ‘মুক্তির উপায়’ গল্পের সৌরিন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায়ের নাট্যরূপে দশচক্র নামে নাটকটির অভিনয় হয় স্টার থিয়েটারে। স্টার থিয়েটারেই ১৯১২ সালের ১৯ অক্টোবর অমরেন্দ্রনাথের একক অভিনয়ে মঞ্চস্থ হয় বিনি পয়সার ভোজ। এরপর মিনার্ভা থিয়েটারে ১৯২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উপেন্দ্র মিত্র করেন বশীকরণ। পরবর্তীকালে আবারও ১৯২৮ সালে বশীকরণ নাটকের পুনরাভিনয় হয় ২২ সেপ্টেম্বর ও ২১ অক্টোবর। মনোমোহন নাট্যমন্দিরে এবং স্টার থিয়েটারে ১৯৩৩ সালের ১৪ জুন ও ২৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বৈকুন্ঠের খাতা নাটকটির অভিনয় হয়েছিলো।

পেশাদার মঞ্চে রবীন্দ্রনাটক মঞ্চায়নের সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে ঐ সময় আর্ট থিয়েটার। ১৯২৩ সালে ২৯ আগস্ট রাজা ও রাণী হবার পর থেকে আর্ট থিয়েটার পরবর্তী দশ বছরে ৮ টি রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়ন করে। এরপর আর্ট থিয়েটার ভেঙে যায়। অহীন্দ্র চৌধুরী তবুও রবীন্দ্রনাটক করার চেষ্টা চালিয়ে যান। অহীন্দ্র চৌধুরীর নির্দেশনায় চিরকুমার সভা র সাফল্য দেখে রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ‘শেষের রাত্রি’ গল্পটির নাট্যরূপ দিয়ে দেন অহীন্দ্র চৌধুরীকে। গৃহপ্রবেশ নামে স্টার থিয়েটারে নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে কিন্তু নাটকটি মঞ্চসফল হয়নি। রবীন্দ্রনাথ আবারও তাঁর ‘কর্মফল’ গল্পটির নাট্যরূপ দিয়ে শোধবোধ নামের  নাটকটিও তুলে দেন অহীন্দ্র চৌধুরীর হাতে। নাটকটি ১৯২৬ সালের ২৩ জুলাই স্টার থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। ঐ বছরই ১৫ এপ্রিল বিদায় অভিশাপ কাব্যনাট্যটি এবং ১৯২৭ সালে ১০ মে চিত্রাঙ্গদা র অভিনয় হয় রাধিকা নন্দ ও সুশীলা এই দু’জনের উদ্যোগে।

আর্ট থিয়েটার ভেঙে যাওয়ার পরেও অহীন্দ্র চৌধুরীর রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়নের প্রচেষ্টা তাঁর রবীন্দ্রনাটকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা ভালোবাসা। ঐ সময় বিভিন্ন দলে রবীন্দ্রনাটকে তাঁর অভিনয়ের একটি তালিকা থেকে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে:

তারিখ            নাটক             চরিত্র          থিয়েটারের নাম
০৫-০১-১৯৩৬   গোরা (নাট্যরূপ)  পরেশবাবু      স্টার
০৮-০৪-১৯৩৬  চিরকুমার সভা    চন্দবাবু        স্টার
০৮-০৪-১৯৩৭   চিরকুমার সভা    চন্দবাবু        স্টার (নাট্যমন্দিরের পক্ষে)
১৪-০৭-১৯৪০    চিরকুমার সভা    চন্দবাবু        স্টার (নব নাট্যমন্দিরের পক্ষে)
২৩-১২-১৯৪২    চিরকুমার সভা    চন্দবাবু        রঙমহল
১১-০৫-১৯৫২    চিরকুমার সভা    চন্দবাবু        শ্রীরঙ্গম

‘বাংলা নাটকে রবীন্দ্রনাথ গণনাট্য ও শম্ভুমিত্র’ নামক গ্রন্থের একটি প্রবন্ধে অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের দেয় উপরোক্ত তালিকাতে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, সন বদল হয়েছিলো দল বদল হয়েছিলো বার বার কিন্তু অহীন্দ্র চৌধুরী মহাশয়ের অভিনীত চরিত্রটি কখনোই বদল হয়নি।

এরপর ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রঙমহলে আবারও চিরকুমার সভা এবং অন্যদিকে স্টার এ কাবুলীওয়ালা মঞ্চস্থ হয়। নাট্যরূপ দিয়েছিলেন দেব নারায়ণ গুপ্ত। অভিনয়ে ছিলেন ছবি বিশ্বাস, শ্যাম লাহা, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমাংশু বসু, মালাবাগ ও আরো অনেকে। ঐ একইদিনে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে মিনার্ভায় লিটল থিয়েটার গ্রুপমঞ্চস্থ করে তপতী। ঐ নাটকে উৎপল দত্ত, শোভা সেন, অরুন মিত্রসহ আরো অনেকেই অভিনয় করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের মূল নাটকগুলোসহ গল্প ও উপন্যাস থেকে নাট্যরূপ দেয়া নাটকের যে মঞ্চায়ন চিত্র ১৮৮৬ সাল থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত পেশাদার মঞ্চে আমরা লক্ষ্য করি সেটা পর্যালোচনায় আমরা রবীন্দ্রনাটক পেশাদারী মঞ্চে মঞ্চায়নের বিশেষত্ব হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে উল্লেখ করতে পারি।

১.    পেশাদারী মঞ্চ রবীন্দ্রনাথের নাট্য প্রয়াস থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি।
২.    পেশাদারী মঞ্চের যেহেতু বানিজ্য একটা পূর্বশর্ত, সে কারণেই তাদের নজর ছিলো রবীন্দ্রনাথের অপেক্ষাকৃত লঘু রসের হাস্য রসাত্মক বা রঙ্গ কৌতুকে পূর্ণ নাটকগুলোর দিকে।
৩.    একই কারণে পেশাদারী মঞ্চের দৃষ্টি ছিলো রবীন্দ্রনাথের মূল নাটকগুলো পাশ কাটিয়ে গল্প বা উপন্যাসের রূপান্তর নাটকে।
৪.    রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে ভালো নাটকগুলো ( যেগুলোতে ব্যঙ্গ কৌতুকের অভাব) পেশাদার মঞ্চে স্থান পায়নি।

একমাত্র ব্যতিক্রম শিশিরকুমার ভাদুড়ীর কর্নওয়ালিশ থিয়েটারের হয়ে নাট্যমন্দিরে মঞ্চস্থ করা বিসর্জন নাটকটি। শিশির ভাদুড়ী নিজে রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। অন্যান্য চরিত্রগুলোতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন রবি রায় (জয়সিংহ),মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্য ( গোবিন্দ মানিক্য), নরেশমিত্র (নক্ষত্র রায়), চারুশীলা (গুণবতী), ঊষা (অর্পণা), অমিতাভ বসু (চাঁদ পাল) ও কৃষ্ণ চন্দ্র দে (ভিখারি)। এই প্রযোজনা শিল্পোত্তীর্ন, সফল ও দর্শকপ্রিয় হয়েছিলো শোনা যায়। এ নাটকে সংগীত প্রয়োগের কাজটি করেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নাটকটির শিল্প নির্দেশনায় শোনা যায় অনেক নতুনত্ব ছিলো। বাংলা থিয়েটারে বিসর্জন এর আগে মুড লাইটের ব্যবহার ছিলো না। এই নাটকে সর্বপ্রথম শিশির ভাদুড়ী মুড লাইট ব্যবহারের মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন যে মঞ্চে নাটকের ক্রিয়ায় ও পাত্র-পাত্রীদের ভাব প্রকাশের সঙ্গে আলোক সম্পাতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে (সূত্র : শিশির কুমার ও বাংলা থিয়েটার : মনি বাগচী)। বিসর্জন নাটকেরই দশম প্রদর্শনীতে শিশির ভাদুড়ী জয়সিংহের চরিত্রে অভিনয় করেন। ঐ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গোড়ায় গলদ’ প্রহসনটিকে শেষ রক্ষা নামে রূপান্তর করেন এবং কয়েকটি গান যুক্ত করে শিশির ভাদুড়ীর হাতে তুলে দেন। নাট্যমন্দিরের হয়ে ১৯২৭ সালে ৭ সেপ্টেম্বর কর্নওয়ালিশ থিয়েটারে সেটা মঞ্চস্থ হয়। শিশির ভাদুড়ীর আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ শেষ রক্ষা র অভিনয় দেখতে এসেছিলেন। সেদিন তাঁর সঙ্গে দর্শক হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত কুমার সেন গুপ্ত ও নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ সাহিত্যিকরা।

১৯২৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর নাট্যমন্দিরে শিশিরকুমার ভাদুড়ী রবীন্দ্রনাথের তপতী প্রযোজনা ও ঐ নাটকের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন। তার আগে সেপ্টেম্বরে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতেও তপতী মঞ্চস্থ হয়েছিলো। নাটকটি ঐ সময়ে পেশাদার মঞ্চে কোনো সফলতা পায়নি। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমার ভাদুড়ীর জন্য। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যাশা করেছিলেন শিশিরকুমার তাঁর সবচেয়ে ভালো লাগার নাটক রক্তকরবী র অভিনয় করাবেন। নাচঘর পত্রিকায় ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ১৩ ভাদ্র সংখ্যায় এ নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি তখন ছাপা হয়েছিলো-‘রসিক সমাজকে আজ আমরা একটি আনন্দ সংবাদ দিতে চাই। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ অনুগ্রহে শিশিরকুমার ভাদুড়ী তাঁর নতুন ও অপূর্ব নাটক রক্তকরবী অভিনয় করবার অধিকার পেয়েছেন। নাটকটি শীঘ্রই প্রবাসী পত্রে আত্ম প্রকাশ করবে’। শিশির ভাদুড়ী রক্তকরবী মঞ্চস্থ করতে পারেননি অথবা করেননি। তা সত্বেও ঐ পেশাদারী থিয়েটারের যুগে যখন বানিজ্যিক প্রবণতাই থিয়েটারের মূল সত্য- তখন শিশির ভাদুড়ী রবীন্দ্রনাটক প্রয়োগে নতুন কিছু সংযোজন প্রয়াসী হয়েছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকা অবস্থায় ১৯৪০ সালের ১৩ জুলাই রঙমহলে ‘গোরা’ নাটকের অভিনয় (পুনরাভিনয়) শেষ মঞ্চায়ন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর শিশির ভাদুড়ী মন্তব্য করেছিলেন-‘ আমাদের রঙ্গমঞ্চের দুর্ভাগ্য, সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধ ঘনিষ্টভাবে ঘটে উঠলো না।’।

শিশিরকুমার ভাদুড়ীর আক্ষেপের ঐ ‘ঘনিষ্ট সম্বন্ধ’টির সূচনা হয় গণনাট্য সংঘে মে-১৯৪৬ এ মুক্তধারা নাটকের মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। তারপর এখানেও এক খন্ডকালীন নিরবতা। অথবা এ-ও বলা যায় গণনাট্য সংঘের রবীন্দ্রনাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা। কারণ, তখনকার ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির রবীন্দ্রনাথকে ভুল বিশ্লেষণ। রবীন্দ্রনাথ বিশ্লেষণে তখন কমিউনিস্ট পার্টি এ জাতীয় সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলো যে, রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষের জন্য নয়- তাঁর সাহিত্য ভাব বা আধ্যাত্মবাদে পূর্ণ। পরবর্তীকালে যদিও কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদের পূর্বের মূল্যায়ন ভুল ছিলো বুঝতে পেরে পুনর্মূল্যায়নে ব্রতী হয়েছিলো। আর ঐ পুনঃ ও নব মূল্যায়নের জোয়ারে গণনাট্য সংঘ রবীন্দ্রনাথের সব ধরনের (গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্যসহ) একের পর এক মঞ্চস্থ করেছে। মঞ্চায়নের ঐ দীর্ঘ তালিকায় ছিলো- বিসর্জন, ডাকঘর, অচলায়তন, চিত্রাঙ্গদা, মালিনী, মুক্তধারা, রক্তকরবী, ফাল্গুনী, তপতী, কালের যাত্রা, রশের রশি, মুক্তির উপায়, খ্যাতির বিড়ম্বনা, বৈকুন্ঠের খাতা ও চার অধ্যায়। ঐ সময় গণনাট্য সংঘে রবীন্দ্রনাটকের উল্লেখযোগ্য পরিচালকরা ছিলেন বীরেশ মুখোপাধ্যায় (দক্ষিণ কলকাতা), সমীর ,মুখোপাধ্যায় (রাজাবাজার), ইন্দ্র রায় (সঞ্চারী), জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় (প্রান্তি), উৎপল দত্ত (কেন্দ্রীয় শাখা), দিগিন্দ্র চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (দেশবন্ধুনগর), মমতাজ আহমেদ (অনুশীলন), অমল গুহ (কলাকার) ও নির্মল ঘোষ (উত্তর কলকাতা)। উল্লেখিত তালিকাটি অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাংলা নাটকে রবীন্দ্রনাথ গণনাট্য ও শম্ভুমিত্র’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবিতকালে এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রবীন্দ্রনাট্যানুরাগীরা বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে পুঁজা পার্বণ ও উৎসবকে কেন্দ্র করে সৌখিন মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের নাটকের অভিনয়ের চেষ্টা করেছে। কিন্তু শিশিরকুমার ভাদুড়ী মহাশয় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর বাংলা রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘনিষ্ট সম্বন্ধ’ না হওয়ার যে আক্ষেপটি করেছিলেন নতুন চেতনায় নতুন যুগের মঞ্চে সেই ‘ঘনিষ্ট সম্বন্ধ’টি পরিণত হয় বাংলা নাটকের এক অনন্য, স্বতন্ত্র দিগন্ত শম্ভুমিত্র মহাশয়ের সময়ে এসে। গণনাট্য সংঘ থেকে আলাদা হয়ে মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ও শম্ভুমিত্র একত্রে ১৯৪৮ সালে গড়ে তোলেন প্রথম গ্রুপথিয়েটার (সংগীত ও নাট্যদল) ‘বহুরূপী’ আর ঐ দলের প্রথম রবীন্দ্র প্রযোজনা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে নাটক চার অধ্যায়- শ্রীরঙ্গম এ ১৯৫১ সালের ২১ আগস্টে। উপন্যাস থেকে চার অধ্যায় নাটকের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শম্ভুমিত্র নিজে। ‘বহুরূপী’র প্রযোজনায় ও শম্ভুমিত্রের পরিচালনায় ঐ চার অধ্যায় নাটকটি রবীন্দ্রনাটক অভিনয়ের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দেয়। বলা যায় চার অধ্যায় নাটকের মধ্য দিয়ে গ্রুপথিয়েটারে রবীন্দ্র নাটকের নব জয়যাত্রা সূচিত হলো। যদিও ঐ সময় শম্ভুমিত্রের চার অধ্যায় নাটকের নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক উঠেছিলো, এমনকি নাটকটির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্যরে মনেও দ্বিধা ছিলো। বিপুল মঞ্চ সাফল্য সত্বেও ঐ সময় বামপন্থী মহল ‘বহুরূপী’ ও শম্ভুমিত্রকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে চিহ্নিত করে।

ঐ সময়কার বাংলা নাটকের আরেক নক্ষত্র উৎপল দত্ত তাঁর লিটল গ্রুপের হয়ে ১৯৫৩ সালে পরিচালনা করেন রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন নাটক। একই বছর জাতীয় নাট্য পরিষদ তরুণ রায়ের পরিচালনায় মঞ্চস্থ করে গুপ্তধন এবং অশোক সেনের পরিচালনায় সন্ধ্যা নীড় নামের একটি দল মঞ্চস্থ করে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটক। সম্ভবত এটিই রক্তকরবী নাটকের প্রথম সৌখিন মঞ্চায়ন। অশোক সেনের রক্তকরবী মঞ্চ সাফল্য পায়নি কিন্তু এক বছর পরেই ১৯৫৪ সালে ১০ মে রেলওয়ে ম্যানসন ইনস্টিটিউট হলে শম্ভুমিত্রের পরিচালনায় খালেদ চৌধুরীর মঞ্চস্থাপত্য ও সংগীতে, তাপস সেনের আলোক পরিকল্পনায়, দেবব্রত বিশ্বস ও সুচিত্রা মিত্রের গানে ‘বহুরূপী’র রক্তকরবী নাটকের অভিনয় এক অনন্য ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করলো। এই প্রযোজনার চারিদিকে জয়জয়কার সত্বেও রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী কে বিকৃত করা হয়েছে এই অভিযোগ তুলে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ চাইলেন নাটকটি বন্ধ করে দিতে  কিন্তু নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর, অতুল গুপ্ত, হিরণ কুমার সান্যাল ও অন্নদা শংকর রায় প্রমুখদের সমর্থনের কারণে বিশ্ব ভারতী কর্তৃপক্ষ স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তাদের অভিযোগ যুক্তিযুক্ত বা গ্রহণযোগ্য ছিলো না। ঐ বছর অর্থাৎ ১৯৫৪ সালেই ভারতীয় সংগীত নাটক আকাডেমির উদ্যোগে দিল্লী নাট্য সংঘ যে প্রথম সর্ব ভারতীয় নাট্য প্রতিযোগিতা আয়োজন করে সেখানে ২১ ডিসেম্বর ‘বহুরূপী’ তার সফলতম প্রযোজনা রক্তকরবী অভিনয়ের সুযোগ পায়। ঐ প্রতিযোগিতায় রক্তকরবী শ্রেষ্ঠ আধুনিক ভারতীয় নাট্য প্রযোজনা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এ নাটকে রাজার ভূমিকায় শম্ভুমিত্র ও নন্দিনীর ভূমিকায় তৃপ্তিমিত্র বাংলা নাট্যভিনয়ের ক্ষেত্রে আজও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

উৎপল দত্ত রক্তকরবী সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন ”বহুরূপী বাংলা মঞ্চের প্রকৃত ঐতিহ্যটি ধরেছে- এই ঐতিহ্যে আছে দুটি ধারার মিলন- প্রথমটা দেশজ যাত্রার ও দ্বিতীয়টা য়্যূরোপিয় বাক্সবন্দি মঞ্চের। .... কোথায় যেন বহুরূপী খাঁটি বাংলা নাট্যরূপটা ধরেছে। বিশেষ করে বাচিক অভিনয়ে- এখানেই বিশেষ করে তাঁরা খাঁটি বাঙালি‘বহুরূপী’ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রক্তকরবী’র দৃশ্যপটে যেমন রং আছে তেমন রেখাও আছে, এই সব কিছু একসুরে এক রংয়ে, এক রেখায়, এক ছন্দে গাঁথাই আধুনিক য়্যূরোপিয় থিয়েটারের প্রধান তত্ত্ব। শম্ভুবাবু রক্তকরবী’তে দৃঢ়তার সঙ্গে সেদিকে পা বাড়িয়েছেন।” (উৎপল দত্ত : বহুরূপী ও রক্তকরবী পাদপ্রদীপ, সূত্র : বাংলা নাট্য আন্দোলনের ত্রিশ বছর : সুনীল দত্ত, পৃষ্ঠা ৭৯-৮৭)।

১৯৫৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মডার্ন স্কুল কাব্যকলা সংঘমের আমন্ত্রণে ‘বহুরূপী’ দিল্লীতে রক্তকরবী মঞ্চস্থ করে। ঐ অভিনয় দেখতে উপস্থিত হয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, সুধীর রঞ্জন দাস, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ, দেবকান্ত বড়–য়া ও পৃথ্বিরাজ কাপুর। ঐ বছরই নভেম্বর মাসে বোম্বাইতে প্রথম বিশ্বনাট্য সম্মেলনে ‘বহুরূপী’ তাদের রক্তকরবী মঞ্চস্থ করে। একই সময় ইউনেস্কোর প্রতিনিধি দলের সম্মানে দিল্লীর আই প্যাক্স মঞ্চে রক্তকরবী অভিনয় করতে হয়। রক্তকরবী নাটকের মধ্য দিয়ে বহুরূপী নাট্যদল ও শম্ভুমিত্র দেশব্যাপী ও আন্তর্জাতিকভাবেও পরিচিত ও সম্মানের স্থান লাভ করেন। ১৯৫৭ সালের ২০ ও ২১ মার্চ বাংলাদেশে বুলবুল চারুকলা কেন্দ্রের আমন্ত্রণে ঢাকার নিউ পিকচার হাউজে বহুরূপী নাট্যদলের রক্তকরবী নাটকের অভিনয় বাংলাদেশের দর্শকদের কাছেও বিশেষ সমাদৃত হয়।

১৯৫৫ সালে উৎপল দত্তের পরিচালনায় লিটল থিয়েটার মঞ্চস্থ করে কালের যাত্রা নাটক। ১৯৫৬ সালে থিয়েটার ইউনিট শেখর চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ করে খ্যাতির বিড়ম্বনা। ক্ষুধিত পাষাণ মঞ্চস্থ করে থিয়েটার সেন্টার তরুণ রায়ের পরিচালনায়। মধুবসুর পরিচালনায় ক্যালকাটা আর্ট প্লেয়ার্স করে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে। ১৯৫৭ সালে বীরেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় শৌভনিক মঞ্চস্থ করে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের অবলম্বনে নাটক গোরা। এবং আবারও বহুরূপী ১৯৫৭সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নিউ এম্পায়ার হলে খালেদ চৌধুরীর মঞ্চস্থাপত্য ও তাপস সেনের আলোয় মঞ্চস্থ করে ডাকঘর। এবার পরিচালনার ভূমিকায় শম্ভুমিত্র নয়, তৃপ্তিমিত্র। বহুরূপীর এই প্রযোজনাটিও বাংলার নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসের একটি উজ্জ্বলতম ঘটনা। ১৯৫৮ সালে রবীন্দ্রনাথের তপতী ও ডাকঘর নাটক দুটি মঞ্চে আনে অসীম চক্রবর্তী ও মুক্তধারা মঞ্চে আনে থিয়েটার সেন্টার। ১৯৫৯ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপরবি ঘোষের পরিচালনায়- শোধবোধ নাটকটি মঞ্চস্থ করে। ঐ বছরই ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্র মঞ্চে আসে। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত দক্ষিণী শিক্ষায়তনের নাট্য শাখা আশীষ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের রবিবার, রাসমনির ছেলে, ক্ষধিত পাষাণ, নষ্ট নীড়, নাটকগুলো মঞ্চস্থ করে সে সময় নাট্যরসিক দর্শকদের প্রসংশা অর্জন করেছিলো।

আবারও ‘বহুরূপী’ এবং শম্ভুমিত্র ১৯৫৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর নিউ এম্পায়ার মঞ্চে অভিনীত হলো মুক্তধারা। প্রযোজনায় মঞ্চ সজ্জায়, আলোক সম্পাতে ও সংগীত ব্যবহারে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেও শম্ভুমিত্রের এ প্রযোজনাটি দর্শক গ্রহণ করেনি। বিশেষত নাটকটির স্বল্প দৈর্ঘ্য দর্শকদের ভালো লাগেনি। তথাপিও পরপর শম্ভুমিত্রের হাতে রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চায়ন ও মঞ্চ সাফল্য গ্রুপথিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করার একটা প্রবণতা বা জোয়ার তৈরি করলো। ফলে সে সময় বাংলা মঞ্চে ব্যাপকভাবে রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়নের একটা চেষ্টা দুই বাংলাতেই চলেছে, যদিও সম্পূর্ণভাবে সেসব তথ্য পাওয়া যায়নি, তবুও পশ্চিম বঙ্গের বিশিষ্ট নাট্য গবেষক অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের সংগৃহীত নিচের তালিকাটি হয়তো আগ্রহী পাঠকদের সেই সময়কার রবীন্দ্রনাটক মঞ্চায়নের প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবে:

দলের নাম               পরিচালকের নাম        রবীন্দ্রনাটক
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ     ?                       মুক্তধারা
ঐ                       ?                       ডাকঘর
ঐ                       ?                       কালের যাত্রা
ঐ                       ?                       রথের রশি
ঐ                       অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়   মালিনী    
ঐ                       ?                       অচলায়তন
বহুরূপী                  শম্ভু মিত্র                 বিসর্জন
ঐ                       বীরেশ মুখোপাধ্যায়       বাঁশরী
শৌভনিক                ঐ                       রাজা ও রাণী
ঐ                       ঐ                       মুক্তির উপায়
ঐ                       ঐ                       রাজা
হাওড়া অ্যামেচার্স         ?                       খ্যাতির বিড়ম্বনা
ঐ                       ?                      ডাকঘর
ঐ                       ?                      শেষ রক্ষা
থিয়েটার ইউনিট         শেখর চট্টোপাধ্যায়        যোগাযোগ
ঐ                      ঐ                      চিরকুমার সভা
অভিনেতা সংঘ          ছবি বিশ্বাস              তপতী
ঐ                      ?                      বউঠাকুরাণীর হাট
ঐ                      ?                      নষ্টনীড়
লোকমঞ্চ                বঙ্গেন্দু মুখোপাধ্যায়     ঠাকুরদা
ঐ                      ঐ                     কঙ্কাল
নান্দীকার               অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়  চার অধ্যায়
গন্ধর্ব                   শ্যামল ঘোষ            বিসর্জন
খেলাঘর                বনানী চৌধুরী           চোখের বালি
ঐ                      অসিত ভট্টাচার্য         বিসর্জন
ঐ                      ঐ                     ছুটি
চতুর্মুখ                 অসীম চক্রবর্তী         বিসর্জন
চতুরঙ্গ                 বরুণ দাশগুপ্ত           গুরুবাক্য, রোগীর বন্ধু
উত্তর সারথী           ?                       রক্তকরবী
শ্রীমঞ্চ                  প্রেমাংশু বসু            অরূপ রতন
ঐ                     ঐ                      নতুন অবতার
লোকরঞ্জন শাখা        ?                       প্রায়শ্চিত্ত
রূপান্তর                ?                      শেষ রক্ষা
অঙ্গন                  ?                      ডাকঘর
ঐ                     ?                      শাস্তি
অনুশীলন              মমতাজ আমেদ খাঁ      কাবুলিওয়ালা
অভ্যুদয়               কিরণ মৈত্র               নিস্কৃতি
উদায়চল              অমর ঘোষ              ল্যাবরেটরি
ক্যালকাটা থিয়েটার্স     বিজন ভট্টাচার্য          মাস্টারমশায়
চারণ সাহিত্যচক্র       তরুণ রায়              শাস্তি
ঐ                     ঐ                      পোস্টমাস্টার
দর্পণ                   অনিল সেন গুপ্ত        ঠাকুরদা
নাটমহল               দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়     ল্যাবরেটরি
রঙবেরঙ               মণি মজুমদার          তোতা কাহিনী
রঙ্গসভা                পীযূষ বসু              দালিয়া
রূপকার                সবিতাব্রত দত্ত         জীবিত ও মৃত
শিল্পী নাট্যম            ?                      দেনা পাওনা
উত্তর সরণি            প্রেমাংশু বসু            চার অধ্যায়
চক্রবৈঠক              রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়      ঘরে বাইরে
মরুতীর্থ               কানু বন্দ্যোপাধ্যায়       দুই বোন
শিল্পীমৈত্রী সংঘ         মিহির ভট্টাচার্য          গোরা
থিয়েটার সেন্টার       তরুণ রায়              ক্ষুধিত পাষাণ

উপরের তালিকাটি একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে একই পরিচালক একাধিক দলের হয়ে রবীন্দ্রনাথের নাটক পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং পঞ্চাশ থেকে সত্তুর দশক পর্যন্ত ভারতীয় বাংলা নাট্যাঙ্গনে যাঁদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো তাঁরা প্রায় সকলেই এক বা একাধিকবার রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

বাংলা মঞ্চে শম্ভুমিত্রের হাতে রবীন্দ্রনাথের নাটকের বিপুল মঞ্চ সাফল্যের পূর্ব পর্যন্ত একটি অপবাদ রবীন্দ্রনাটক সম্পর্কে বেশ প্রচলিত ছিলো। রবীন্দ্রনাটক অভিনয় যোগ্য নয়- এককভাবে শম্ভু মিত্র এবং তার দল ‘বহুরূপী’ রবীন্দ্রনাটককে ‘অভিনয় যোগ্য নয়’ জাতীয় অপবাদ থেকে মুক্ত করলো। একের পর এক রবীন্দ্রনাথের নাটক প্রযোজনা করে শম্ভুমিত্র ও ‘বহুরূপী দর্শক মনে রবীন্দ্রনাথের নাটকের গড়লেন স্থায়ী আসন, রবীন্দ্রনাটক সম্পর্কে কৌতুহল ও তৃষ্ণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হোল শম্ভুমিত্র ও ‘বহুরূপী’। ১৯৫৯ সালে শম্ভুমিত্রের হাতে রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা নাটকটি মঞ্চ সফল হোল না। কিন্তু তাতেই দমে যায়নি ‘বহুরূপী’। এরপরেও পর্যায়ক্রমে ১৯৬৪ সালের ১৩ জুন রাজা তার দশ বছরের ব্যবধানে ১৯৭৪ সালের ৯ জুন ঘরে বাইরে এবং তারও ১২ বছর পরে ১৯৮৬ সালের ১ মে ‘বহুরূপী’ তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের মালিনী নাটকটি মঞ্চে আনলো।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরবর্তী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ঐ মধ্যবর্তী সময়ে আমাদের পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাটক, রবীন্দ্র সংগীত সামগ্রীকভাবে রবীন্দ্র সাহিত্যের উপরই পাক সরকারের খড়গ নেমে এসেছিলো। তাই এ সময়কালে পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়নের বিচ্ছিন্নভাবে (কারণ তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা সংগঠিত হয়নি।) যে প্রয়াসগুলো চালানো হয়েছিলো তারমধ্যে সফলতম প্রয়াস ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের ছাত্র ইউনিয়নের সংস্কৃতি সংসদ সৈয়দ হাসান ইমামের পরিচালনায় ১৯৭০ সালে ৩ জানুয়ারি বর্তমান বাংলা একাডেমি মাঠে আনুমানিক দশহাজার দর্শকের সামনে রক্তকরবী নাটকের মঞ্চায়ন। খোলা মাঠে দুই ঘন্টার বেশি সময় ধরে উপস্থিত দর্শকরা নাকি নিরবে নিঃশব্দে উপভোগ করেছিলো রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকের অভিনয়।

পূর্ববঙ্গে তখন পাকিস্তান বিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলনের উত্তুঙ্গ সময়। তাই রবীন্দ্র সংস্কৃতির উপর তখন যে পাক সরকারের খড়গ নেমে এসেছিলো তাঁর বিরুদ্ধে ঐ রক্তকরবী মঞ্চায়ন একটি সফল প্রতিবাদ বলা যায় নিঃসন্দেহে। ১৯৭০ সালের ঐ রক্তকরবী মঞ্চায়নের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেন মতিউর রহমান (বর্তমানে দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক), মালেকা বেগম (নারী আন্দোলনের নেত্রী), আসাদুজ্জামান নূর (অভিনেতা, রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য), মাহফুজ আনাম (সম্পাদক ডেইলি স্টার), মফিদুল হক (বিশিষ্ট সংস্কৃতিসেবী ও পুস্তক প্রকাশক), আবুল হাসনাত (সাংবাদিক), বাবু (কবি জসিমউদ্দিনের পুত্র), বেবী (পরবর্তী সময়ে বাবুর স্ত্রী), গোলাম রাব্বানী (প্রকৌশলী), ডঃ ইনামুল হক (অভিনেতা), দিলীপ চক্রবর্তী (প্রয়াত সাংবাদিক), ফখরুল ইসলাম প্রমুখ।

ঐ সময় সংস্কৃতি সংসদ তাসের দেশ ও বৈকুন্ঠের খাতা নাটক দু’টিও মঞ্চস্থ করেছিলো। যদিও রক্তকরবী নাটকের মতো ঐ দু’টি প্রযোজনা তেমন আলোচিত হয়নি। ১৯৭০ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকায় মঞ্চায়িত রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী -র মঞ্চে যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন- গোলাম মুস্তাফা, কাজী তামান্না, আবুল হায়াত, গোলাম রাব্বানী, আসাদুজ্জামান নূর, ফারুক, সিরাজুল ইসলাম, ফখরুল ইসলাম, লায়লা হাসান, দিলীপ চক্রবর্তী, আবদুল মতিন, আলতাফ হোসেন, ড. ইনামুল হক, মাহমুদুল কবীর, কাজী টুলু, শাহাবুদ্দিন সিদ্দিকী, জুবাইর সাঈদ, নাজমুল বারী, জামান প্রমূখ। তখনকার দিনের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় ও ব্যস্ততম অভিনেতা আনোয়ার হোসেনকে ‘রাজা’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য একদিন মহড়ায় আনা হয়েছিলো। কিন্তু সময় দিতে অপারগতা প্রকাশ করে পরবর্তী সময়ে তিনি আর আসেননি। এই প্রযোজনায় নেপথ্যে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা হলেন - ইকবাল আহাম্মেদ, ফ্লোরা আহাম্মেদ, মিলিয়া গণি, সাকেরা খান, স্বপন চৌধুরী, এমদাদ হোসেন, বিশু মুখোপাধ্যায়, রাজিউল্লাহ, মানিক, সুরেশ দত্ত (আমাদের ঢাকার মঞ্চের প্রয়াত রূপসজ্জাকর বঙ্গজিৎ দত্তের পিতা), খুরশীদ খান।

১৯৬৯ সালের আন্দোলন আর গণ অভ্যুত্থানের ছায়াতলে সারাবছর ধরে রক্তকরবী নাটকের রিহার্সেল চলে। কখনো ড. ইনামুল হকের বুয়েট স্টাফ কোয়ার্টারের বাসায়, কখনো বকশীবাজারে শান্তদের বাসায় আবার কখনোবা তৎকালীন জিন্নাহ এভিন্যূর (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিন্যূ) পাক সোভিয়েট মৈত্রী সমিতির দপ্তরে। ঐ সময় ছাত্র আন্দোলনের কারণে বারবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়েকবার রক্তকরবী মঞ্চায়ন প্রচেষ্টা ব্যহত হবার পর ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি দীর্ঘদিনের ঐ নাট্যচেষ্টা সফল পরিণতি লাভ করে।

বাংলাদেশের গ্রুপথিয়েটার চর্চায় রবীন্দ্রনাটকের সর্বাধিক প্রযোজনাকারী দল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। তার সংক্ষিপ্ত তালিকা নিচে দেয়া হলো:

নাটক (যততম প্রযোজনা)    মঞ্চায়ন সংখ্যা (পর্যন্ত)    নির্দেশক    
অচলায়তন (১৪ তম)        ৭০ (এপ্রিল ২০০০)       আলী যাকের
বিসর্জন (২০ তম)            ৩২ (১৯৮৫)            আবুল হায়াত    
মুক্তধারা (২৪ তম)           ২২ (১৯৮৯)            খালেদ খান
কর্ণকুন্তী সংবাদ (কর্মশালা)    ২                       আতাউর রহমান
রথের রশী (৩১ তম)         ৬                      আবুল হায়াত
রক্তকরবী (৩৪ তম)         ২৬ (ফেব্রুয়ারি’০৩)*    আতাউর রহমান

(* এই লেখা পাঠকদের কাছে পৌঁছার সময়কালে রক্তকরবীর মঞ্চায়নসংখ্যা ৫০ পার হয়ে গেছে - সম্পাদক।)

বাংলাদেশের প্রথিতযশা অভিনেতা, নাট্য পরিচালক আলী যাকের তাঁর দলের ১৪তম প্রযোজনা ও তাঁর নিজের ৬ষ্ঠ পরিচালনার জন্য বেছে নেন অচলায়তন  নাটকটি। ১৯৮০ সালে প্রথম মঞ্চে আসে নাটকটি। নাটকটি বিপুলভাবে দর্শক নন্দিত হয়েছিলো। ঢাকার বাইরে নাটকটির চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশালে প্রদর্শনী হয় এবং বাংলাদেশের বাইরে কোলকাতা, বালী, চন্দন নগরেও নাটকটির প্রদর্শনী হয় এবং সব জায়গাতেই নাটকটি বিপুলভাবে দর্শক নন্দিত হয়। জনাব আলী যাকেরের হাতে মঞ্চায়িত হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশেতো নয়ই পশ্চিমবঙ্গেও নাটকটির এতো মঞ্চ সাফল্যের কথা শোনা যায়নি। বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাটকের সর্বাধিক প্রযোজনাকারী দল নাগরিকের স্যুভেনিরে  নির্দেশক আলী যাকের ১৯৮০ সালে লিখেছিলেন ‘নিষেধের বেড়ায় আবদ্ধ এক অচলায়তনে আমাদের বাস। আলো হাওয়া এবং প্রাণস্পন্দন বিবর্জিত আরও এক নৃশংস এক অচলায়তন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমাদের ঋণ আমাদের মুক্তিতে, আমাদের পথ চলায়, আমাদের অস্তিত্বে। তাই অস্তিত্বের বিপন্নতায় রবীন্দ্রনাথের কথাই হয় আমাদের প্রতিবাদের ভাষা, আমাদের প্রতিরোধের আহ্বান। রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন  থেকে উৎসারিত আহ্বান আজকের ‘অচলায়তন’কে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে এক মুক্ত এবং কর্মময় পৃথিবী সৃষ্টিতে আমাদের আগ্রহী করুক এই আমাদের কামনা।’

অচলায়তন নাটকে যারা অভিনয় করেছেন তারা হলেন - মোহাম্মদ হোসেন দুলু, জামাল উদ্দিন হোসেন, সাইদুল আলম, সানাউল হক, আবুল কাশেম, লাকী ইনাম, মাসুদ ইকবাল, সারা যাকের, আলম খোরশেদ, ইনামুল হক, আতাউর রহমান, সালেক খান, গোলাম সারোয়ার, রাফিউল আলম, মিজানুর রহমান, নিমা রহমান, শৈবাল দেব। নাটকটির নেপথ্যে যারা ছিলেন তারা হলেন- ইখতিয়ার ওমর, মাহমুদ হোসেন, নাদিয়া ওমর, সামিনা মাহমুদ, শাম্মি রাব্বানি, লাকী ইনাম, সারা যাকের, নিমা রহমান, গোলাম সারোয়ার, রাফিউল আলম, খালেদ মাহমুদ খান, কে বি আল আজাদ, সৈয়দ লুৎফর রহমান, সিরাজ আহমেদ, খ ম হারুন, অশোক মুখার্জি প্রমূখ। নাটকটির মঞ্চ পরিকল্পনা ও নির্মাণে ছিলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ।

নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় রবীন্দ্রপ্রযোজনা বাংলাদেশের আরেক প্রথিতযশা অভিনেতা আবুল হায়াতের হাতে ১৯৮৫ সালে। তিনি মঞ্চে আনলেন রবীন্দ্রনাথের আরেক দুরূহ নাটক বিসর্জন এবং এই প্রযোজনাটিরও সাফল্যের সাথে ৩২ টি প্রদর্শনী হয়। বিসর্জন নাটকের স্যুভেনিরে নির্দেশক আবুল হায়াত তখন দাবি করেছিলেন বিসর্জন রবীন্দ্রনাথের রচিত নাটকগুলোর মধ্যে সর্বাধিক মঞ্চায়িত। তাঁর দাবি অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। নাটকটিতে রওশন আরা হোসেন, জামাল উদ্দিন হোসেন, লাকী ইনাম, ইনামুল হক, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল কাশেম সহ আরো অনেকে অভিনয় করেন। নাটকটিতে নেপথ্য কন্ঠ দেন কলিম শরাফী এবং প্রযোজনা উপদেষ্টা ছিলেন আতাউর রহমান। এই নাটকটিরও মঞ্চ পরিকল্পক ছিলেন বরেণ্য ডিজাইনার-নিদের্শক সৈয়দ জামিল আহমেদ।

নাগরিকের তৃতীয় রবীন্দ্রপ্রযোজনা মুক্তধারা ১৯৮৯ সালে। নাগরিকের তৎকালীন তরুণ অভিনেতা খালেদ খান তাঁর নির্দেশনার প্রথম নাটক হিসেবেই বেছে নিলেন রবীন্দ্রনাথের আরেকটি দুরূহ এবং জটিলতম নাটকটি। উল্লেখ্য, প্রণম্য শম্ভুমিত্র মহাশয়ের নিদের্শনাতেও রবীন্দ্রনাথের এই মুক্তধারা নাটকটির কপালে দর্শক নৈকট্য জোটেনি। খালেদ খানের মুক্তধারা নাটকটিতে দলের নতুন আর তরুণরা অভিনয় করেছিলেন। প্রবীণদের মধ্যে রঞ্জিত চরিত্রে আতাউর রহমান নিয়মিত এবং অভিজিৎ চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর কয়েকটি প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছিলেন। নাটকটি বিপুলভাবে দর্শক নন্দিত না হলেও প্রথম নিদের্শনাতেই খালেদ খান উৎসাহী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯৯৯ সালে নাগরিকের চতুর্থ রবীন্দ্রপ্রযোজনা আবুল হায়াতের নিদের্শনায় রথের রশী। এ নাটকটির ৬টি প্রদর্শনী হয়।

এরপর নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও দলের অন্যতম প্রধান নাট্যনির্দেশক আতাউর রহমান ২০০১ সালে মঞ্চে আনলেন রবীন্দ্রনাথের বহুল আলোচিত নাটক রক্তকরবী এবং এই নাটকের প্রযোজনা সূত্রে নাগরিক ও নির্দেশক আতাউর রহমান বহুল আলোচিত হয়ে উঠলেন। এর একটি অন্যতম কারণ ছিলো নাটকে নন্দিনী চরিত্রের অভিনেত্রী নির্বাচন। প্রথমে তিনি নন্দিনী চরিত্রে দলের সদস্য আফসানা মিমি’র নাম এবং এই চরিত্রের বিকল্প অভিনেত্রী হিসেবে নূনা আফরোজের নাম ঘোষণা করলেন। মহড়া শুরু হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই আফসানা মিমি ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে অনিয়মিত হয়ে পড়লেন। তখন নূনা আফরোজকে নিয়ে নির্দেশক মহড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং কিছুদিন মহড়া চলার পর নূনা আফরোজকেই নির্দেশক নন্দিনী চরিত্রে মূল অভিনেত্রী হিসেবে ঘোষণা করলেন। তারপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আফসানা মিমি আবার মহড়ায় উপস্থিত হলে নির্দেশক আবারো নন্দিনী চরিত্রে আফসানা মিমির নাম ঘোষণা করলেন। কয়েকদিন পর মিমি আবারো অনুপস্থিত হয়ে পড়লে দল থেকে যোগাযোগ করেও তার সাথে সাক্ষাৎ করা যায়নি। এরপর অনেকদিন মহড়া বন্ধ থাকে। এক পর্যায়ে মহড়া আবার শুরু হলো, কিন্তু নন্দিনী চরিত্রে নূনা আফরোজকে মহড়া করতে না দিয়ে দলের বাইরে থেকে অপি করিমকে নিয়ে আসা হলো, যিনি তখনও পর্যন্ত একজন মডেল তারকা ও টেলিভিশন অভিনেত্রী হিসেবেই পরিচিত। ব্যাপারটি কেবল দলেই নয় দলের বাইরে গ্রুপথিয়েটারের প্রায় সবাই গ্রুপথিয়েটার রীতির পরিপন্থি হিসেবে দেখেছে। কিন্তু যেহেতু নির্দেশক দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, তাই তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নাগরিক রক্তকরবী মঞ্চে আনলো। এছাড়াও দেশবরেণ্য অভিনেতা আলী যাকের ‘রাজা’ চরিত্রে অভিনয় করার কথা থাকলেও দীর্ঘদিন মহড়া চালিয়ে যাওয়ার পর মঞ্চায়নের মাত্র ৪দিন পূর্বে তিনি (আলী যাকের) অভিনয় না করার সিদ্ধান্ত নেন। এসব কারণে মঞ্চে আসার পূর্বে রক্তকরবী নাট্যমহলে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে নির্দেশক আলী যাকের ‘রাজা’ চরিত্রে অভিনয় করেন। নাটকটিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন- আতাউর রহমান, খালেদ খান, অপি করিম, শিরিন বকুল, গাজী রাকায়েত, অনন্ত হিরা, লুৎফর রহমান জর্জ, শামীম শাহেদ প্রমুখ। নাটকটির মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা করেছেন যথাক্রমে মোঃ সাইফুল ইসলাম ও নাসিরুল হক খোকন। নাটকটির বর্তমানে ৫০টির বেশি প্রদর্শনী হয়েছে। জনাব আতাউর রহমান তাঁর নির্দেশনায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে সেখানকার শিক্ষার্থীদের নিয়ে মঞ্চস্থ করেন তাসের দেশ। জনাব আতাউর রহমান নাগরিকের এক কর্মশালায় কর্মশালাভিত্তিক প্রযোজনা হিসেবে কর্ণকুন্তি সংবাদ মঞ্চস্থ করেন। তাঁর ঐ প্রযোজনাটিও দর্শক নন্দিত হয়েছিলো। কর্ণকুন্তি সংবাদ-এ অভিনয় করেছিলেন - আফসানা মিমি, শাহিন খান, শর্মিষ্ঠা রহমান, অনন্ত হিরা, কাজী রুমা, টনি ডায়েস।

স্বাধীনতার পূর্বসময়ে ১৯৬৪ বা ১৯৬৫ সালে সংস্কৃতি সংসদের হয়ে সৈয়দ হাসান ইমাম ও মাসুদ আলী খান যৌথ নির্দেশনায় তাশের দেশ মঞ্চে আনেন। ঐ প্রযোজনায় গায়ক হিসেবে যুক্ত ছিলেন প্রয়াত জাহেদুর রহিম ও ফাহমিদা খাতুন প্রমুখ। এছাড়াও স্বাধীনতা পূর্বকালে ড্রামা সার্কেল রক্তকরবী বজলুল করিম ও মকসুদ-উস-সালেহীন এর যৌথ নির্দেশনায় ও মাসুদ আলী খানের নির্দেশনায় তাশের দেশ মঞ্চস্থ করেন। তৎকালীন সময়ে প্রযোজনাটি বিপুলভাবে দর্শক নন্দিত হয়েছিলো। আমাদের দেশের নাট্যাঙ্গনের কীর্তিমান অনেকেই প্রযোজনা দুটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এব্যাপারে ড. ইনামুল হক ও মাসুদ আলী খান আরো অনেক তথ্য দিতে পারবেন।

স্বাধীনতার পূর্বে চট্টগ্রামেও কামাল এ খানের নির্দেশনায় রক্তকরবী সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়।

স্বাধীনতার পরপরই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিরাট মঞ্চ বেঁধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুস্তাফা মনোয়ারের পরিচালনায় মুক্তধারা  মঞ্চস্থ হয়। শোনা যায় লক্ষাধিক দর্শক এই নাটক উপভোগ করেছিলেন। মঞ্চের আকার ছিলো ১০০ ফুট  X ১০০ ফুট। বাঁধভাঙা দর্শক সমাগমে দমকল বাহিনীর ৬টি পানিবাহী গাড়ি ভাড়া করে আনা হয়েছিলো। ঐ প্রযোজনায় মুক্তধারা নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র যন্ত্ররাজ বিভূতির মঞ্চ ছিলো ৪তলা দালানের সমান উঁচু। নাটকটির মঞ্চ, আলো, পোষাক পরিকল্পনা ও সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার নিজে। নাটকটিতে বিভূতির চরিত্রে অভিনয় করেন জনাব আতাউর রহমান। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এখন যেটা ‘নাটমণ্ডল’, সেখানে খোলা স্টেজে ডাকঘর নাটকটি মঞ্চস্থ হয় মুস্তাফা মনোয়ারের পরিচালনায়। নাটকটিতে চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা অভিনয় করে। নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা ও নির্মাণ করেন মুস্তাফা মনোয়ার নিজে, কেবল দড়ি ব্যবহার করে। পরিকল্পনাটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিলো। নাটকটিতে কেরামত মাওলা, মহিউদ্দিন ফারুক, টেলি সামাদ, শামসুল ইসলাম নান্নু ও বাবলী আনোয়ার সহ আরো অনেকে অভিনয় করেন।

পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট নাট্য পরিচালক বাদল সরকার রক্তকরবী কে ভিন্ন আঙ্গিকে ও মাত্রায় দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন। তাঁর ঐ প্রযোজনাটিও দর্শক নন্দিত ও আলোচিত হয়েছিলো। নাটকটি বাংলাদেশেও অভিনীত হয়।

এছাড়া সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার প্রযোজনা করে রাজা নাটকটি। নাটকটি নায়লা আজাদ নুপুর নির্দেশনা দেন। এছাড়াও পোশাক, সেট, মিউজিক ও কোরিওগ্রাফী পরিকল্পনাও করেন নির্দেশক স্বয়ং। নাটকটির আলোক পরিকল্পক ছিলেন নাসিরুল হক খোকন। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় সংসদ বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব ড. ইনামুল হকের নির্দেশনায় চিরকুমার সভা মঞ্চস্থ করে। নাটকটিতে মাহমুদা আক্তার রুমা, অলক দাশগুপ্ত, নূনা আফরোজ প্রমুখ অভিনয় করেন। নাটকটিতে আলোক পরিকল্পনা করেন ঠাণ্ডু রায়হান।

আধুনিককালের সর্বশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্র প্রযোজনা হিসেবে ধরা হয় প্রখ্যাত জার্মান নির্দেশক মেহরিঙ্গ-এর করা ডাকঘর নাটকটি। প্রযোজনাটি জার্মান কালচারাল সেন্টার বাংলাদেশ ঢাকায় এনেছিলেন। নাটকটি বহুল প্রশংসিত হয়।

প্রবন্ধটিতে বিভিন্ন তথ্য সন্নিবেশনে যেসকল সূত্রের সাহায্য নেয়া হয়েছে সেগুলো হলো :

নাট্য ভবিতব্য ও রবীন্দ্র : কুমার রায়, গণনাট্য আন্দোলনের প্রথম পর্যায় : দর্শন চৌধুরী, কালের মাত্রা ও রবীন্দ্র নাটক : শঙ্খ ঘোষ, রবীন্দ্র নাট্যসমীক্ষা : দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, প্রসংগ - নাটক : শম্ভু মিত্র, বহুরূপী পত্রিকা, নাট্যচিন্তা পত্রিকা, রক্তকরবী ও ইতিহাস : আবুল হায়াত (প্রথম আলো  সাহিত্য সাময়িকী, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০২), নাট্যপত্র : নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ২০ বছর পূর্তি স্মারক সংখ্যা, স্যাস, রঙ্গমঞ্চ : জগন্নাথ ঘোষ, আগুন এবং অন্ধকারের নাট্য : রবীন্দ্রনাথ : সরোজ চট্টোপাধ্যায়, ২০০ বছরের বাংলা প্রসেনিয়াম থিয়েটার : বিশ্বকোষ পরিষদ, শিশিরকুমার ও বাংলা থিয়েটার : মনি বাগচী।

(বি.দ্র- প্রবন্ধকার বিনীতভাবে জানিয়েছেন, লেখাটি কোনোভাবেই পূর্ণাঙ্গ নয়। আমরাও তাই মনে করি। আমাদের জানা মতে ঢাকায় আলেয়া ফেরদৌসের নির্দেশনায় তার দল থেকে প্রযোজিত হয় ডাকঘর নাটকটি। থিয়েটার স্কুলের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তাদের সমাপনী প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চস্থ করে রক্তকরবী। এছাড়াও খোরশেদুল আলমের সদ্য প্রকাশিত ‘চট্টগ্রামের তিন দশকের নাটক’  গ্রন্থ  থেকে পাওয়া যায় যে, ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে শেষ রক্ষা, ১৯৯১ সালে তির্যক প্রযোজনা করে আহমেদ ইকবাল হায়দারের নির্দেশনায় রথযাত্রা, ১৯৯৩ সালে তির্যক মঞ্চস্থ করে টাপুর টুপুর (ছন্দ নাটক) এবং নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, ১৯৯৫ সালে একই দল মঞ্চস্থ করে ডাকঘর ও বিসর্জন। ১৯৯৫ সালে তির্যক নাট্যদল মঞ্চে আনে তাদের ৩৯তম প্রযোজনা রক্তকরবী। সুতরাং বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় রবীন্দ্রনাটক প্রযোজনাকারী দল হিসেবে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সাথে তির্যক নাট্যদলও সমান অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। এছাড়াও নান্দিকার গোড়ায় গলদ ও কথক নাট্য সম্প্রদায় শাস্তি, কঙ্কাল ও দেনা পাওনা, প্রতিনিধি নাট্য সম্প্রদায়, চট্টগ্রাম দুই বিঘা জমি মঞ্চস্থ করে। আমাদের ধারণা বাংলাদেশ প্রেক্ষিত আলোচনা করতে গেলে এধরনের অনেক তথ্যই সন্নিবেশিত হতে হবে। আশা রাখছি আরো অনেক তথ্য সংগ্রহ করে প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাট্য চর্চার উপর একটি পূর্ণাঙ্গ রচনা অচিরেই পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেবেন। - সম্পাদক)

অনন্ত হিরা : নাট্যজন, সংগঠক, সদস্য- প্রাঙ্গণেমোর