Full premium theme for CMS
বাংলাদেশের কাব্যনাটক : বিষয়-বৈচিত্র্য ও প্রকরণশৈলী [দ্বিতীয় কিস্তি]
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
বাংলা কাব্যনাটকের উন্মেষ-পর্ব : প্রসঙ্গ বিষয়-আঙ্গিক
ক.
বাংলা সাহিত্যের প্রাগাধুনিক যুগে কাব্যনাটকের সন্ধান পাওয়া যায় না। আধুনিককালে সার্থক বাংলা কাব্যনাট্যের প্রাথমিক ভিত্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) হাতে রচিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাটক রচনা-প্রয়াসের পূর্বে মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-’৭৩) রচিত দু’একটি কাব্যেও কাব্যনাটকের কিছু বৈশিষ্ট্য-উপাদান পরিলক্ষিত হয়। মধুসূদনের বীরাঙ্গনা কাব্য (১৯৬২) বাংলা কাব্যনাটকের ভিত্ নির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। বীরাঙ্গনা কাব্য-র নায়িকাদের লেখা প্রত্যেকটি পত্রের গীতিময়তায় (লিরিক) নাটকীয়তা আছে। বীরাঙ্গনার পত্রে নায়িকাদের একক মনোকথার মধ্য দিয়েও কাব্যভাষার সাবলীলতায় মধুসূদন নাট্যগুণের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এ পত্র-কাব্যের নায়িকাদের বিরহ-তপ্তশ্বাসে কামনা-বাসনার ঈর্ষাময় যন্ত্রণার যে উদ্গীরণ তা অবলীলায় গীতিকবিতাকে আত্মস্থ' করে নিয়েছে এবং কখনো কখনো এই গীতিময় প্রকাশভঙ্গি নাটকীয়তায় রূপান্তরিত হয়েছে। বীরাঙ্গনা কাব্যর ‘সোমের প্রতি তারা’, ‘দশরথের প্রতি কৈকেয়ী’, ‘লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখা’ এবং ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ চিঠিগুলোতে অসাধারণ কাব্যগুণ এবং চরিত্রের অন্তর্গত দ্বন্দ্বের মধ্যে নাট্যধর্মিতা রয়েছে। কিন্তু চরিত্রের শুধুমাত্র স্বগতচিন্তা নাটক হয়ে উঠতে পারে না। এজন্য বীরাঙ্গনা-য় যথেষ্ট পরিমাণে নাট্যগুণ থাকা সত্ত্বেও এটিকে কাব্যনাটক বলা যায় না, বরং মনোনাট্য হিসেবে গণ্য করা শ্রেয়। তবে একথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, বীরাঙ্গনা-য় কাব্যনাটকের উপাদান বিদ্যমান ছিল- যা পরবর্তীকালে বাংলা কাব্যনাটকের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বীরাঙ্গনা-র মতো একটি পত্র-কাব্য রচনা করতে গিয়েও অসচেতনভাবে এতে যে নাট্য-মুহূর্ত সৃষ্টি করেছিলেন তার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কাব্যনাটকের বীজ বুনে দিয়েছিলেন। বীরাঙ্গনা-য় কাব্যনাটকের বীজ আছে একথা সত্য; কিন্তু এতে কাব্যনাটকের সকল বৈশিষ্ট্য নেই। এজন্য মধুসূদনের বীরাঙ্গানা-কে মনোনাট্য (Dramatic Monologue) হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।১ দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্য যে, মধুসূদনের সময় হয় নি বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন ছাড়া অন্যদিকে মনোনিবেশ করার; ফলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চলেছে দীর্ঘ অপেক্ষার পালা- সার্থক কাব্যনাটকের জন্য।
খ.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতে সমান দক্ষতায় বিচরণ করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের যে-শাখায় তিনি হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। তাঁর অভাবনীয় সৃষ্টি-প্রতিভা দিয়ে বাংলা সাহিত্যে নানামাত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যার মধ্য দিয়ে কখনো কখনো সৃষ্টি হয়েছে- সাহিত্যের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কোনো এক শাখা। দেশী-বিদেশী সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকলেও তিনি ইউরোপীয় সাহিত্যের অনুকরণের পরিবর্তে এ-দেশীয় পটভূমিতে সৃষ্টিশীল মননচেতনার দ্বারা কাব্যনাটক রচনার প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর এই কাব্যনাটক রচনার প্রয়াস এলিয়ট প্রবর্তিত কাব্যনাটকের তত্ত্বানুসরণে কাব্যনাটক নয়। তবে ডব্লিউ.বি. ইয়েটস্ প্রবর্তিত কাব্যনাট্যের তত্ত্বের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাট্য-প্রয়াসের তাত্ত্বিক সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
রবীন্দ্র-কাব্যনাট্য প্রয়াসের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটেছে। এ-দেশীয় রীতি-পদ্ধতিতে কাব্যনাটক রচনায় ব্রতী হয়ে তিনি রুদ্রচণ্ড (১৮৮১) রচনার মাধ্যমে প্রাথমিক পরীক্ষা করেছিলেন। রুদ্রচণ্ড-এ মূল বিষয় হিসেবে প্রেমের সাথে প্রতিহিংসার দ্বন্দ্ব উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। নির্জন নির্বাসনে রুদ্রচণ্ড নিজেকে এবং অন্যদেরকে প্রেমহীন শুষ্ক জীবনের দাবদাহে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। তাই পৃথ্বীরাজের পরাজয়ের সাথে সাথে তার এই প্রতিহিংসার আগুন নিভে গেছে; তখন কন্যা অমিয়াকে রুদ্ধদ্বার হৃদয়ের অর্গল মুক্ত করে দিয়ে রুদ্রচণ্ড অবলীলায় স্নেহপরায়ণ আহ্বান জানিয়েছে। রুদ্রচণ্ড নাট্যকাহিনীতে প্রেমের সাথে প্রতিহিংসার দ্বন্দ্ব; তবে প্রতিহিংসা রুদ্রচণ্ডের চরিত্রকে অহেতুক ভারাক্রান্ত করে তোলে নি। আর তাই মহাম্মদ ঘোরীর গোপনে সাহায্য করার ব্যাপারটিকে ভিক্ষা মনে করে প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছে। পৃথ্বীরাজ তার শত্রু, সেই শত্রুর যথোপযুক্ত শাস্তি বিধান করার প্রবল বাসনা নিয়ে রুদ্রচণ্ড বেঁচে আছে; তবে পৃথ্বীরাজ শুধুই তার একার শত্রু। তাই রুদ্রচণ্ড অন্যের সাহায্য নিয়ে তার সেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সুযোগ গ্রহণ করে নি। এই বিবেচনায় বলা যেতে পারে, রুদ্রচণ্ড আত্মবিনাশী হয়েও দৃঢ়চেতা বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত। এই নাট্যকাহিনীতে অন্য চরিত্র অমিয়া স্নেহ-ভালবাসা, মায়া-মমতা-করুণার প্রতিমূর্তি। অমিয়ার মায়া-মমতা-কারুণ্য রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন-এর অপর্ণা চরিত্রের সমগোত্রীয়।
খ. ১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রুদ্রচণ্ড রচনার মাধ্যমে কাব্য ও নাট্যের সমন্বয় সাধনের যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন তা প্রকৃতির প্রতিশোধ (১৮৮৪)-এ আরো একধাপ অগ্রসর হয়েছিল। প্রকৃতির পরিশোধ-র বিষয়বস্তু চিত্তাকর্ষক। নাটকের প্রধান চরিত্র গুহাবাসী সন্ন্যাসী হঠাৎ করেই একদিন সংসার জীবনে প্রবেশ করে দেখলেন, এখানকার (সাংসার-জীবনের) নয়নাভিরাম দৃশ্য কিন্তু জাগতিক (সাংসারিক) জীবনের কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ করতে পারল না। অথচ সন্ন্যাসী এক অনাথা বালিকার লাঞ্ছনা, দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, তাকে পথের ধূলো থেকে তুলে এনে পিতৃস্নেহে লালন-পালন করতে লাগলেন। ইত্যবসরে তিনি অনুভব করলেন যে, তিনি সংসারের মায়াজালে জড়িয়ে পড়ছেন। তিনি সংসারের মায়াজালে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে ভীত হলেন এবং একদিন অতিসন্তর্পণে বালিকাটিকে একা ফেলে পুনরায় সংসার থেকে পলায়ন করলেন। কিন্তু সন্ন্যাসী সেই করুণ বালিকামূর্তি কিছুতেই ভুলতে পারলেন না। বরং তিনি প্রকৃতির সর্বত্রই সেই বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখতে লাগলেন। প্রকৃতির এক উন্মাতাল ঝড়োরাতে সন্ন্যাসী সেই বালিকার কান্নার শব্দ শুনে পুনরায় বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিনি যখন বালিকাকে খুঁজে পেলেন, ততক্ষণে সে প্রকৃতির মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেছে। তখন সন্ন্যাসীর মনে হল, একদিন মায়াজ্ঞানে যে প্রকৃতিকে তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন- তাই যেন পরম ও চরম সত্য। অর্থাৎ বালিকাটির মৃত্যুর মধ্যদিয়ে সংসার-জীবনই সন্ন্যাসীর নিকট একমাত্র সত্যরূপে প্রতিভাত হল। প্রকৃতির প্রতিশোধ সন্ন্যাসীর জীবনসত্য উপলব্ধি করার বিষয়টিই মুখ্য। নাট্যকাহিনীর এই তাত্ত্বিকতা প্রসঙ্গে সমালোচক বলেন, ‘এই তত্ত্ব পরিবেশনই এ নাটকের মুখ্য ভাববস্তু, তত্ত্ব বাদ দিলে এ নাটকের বিশেষ কোনও মূল্য নেই। সন্ন্যাসীর দীর্ঘ স্বগতোক্তি নাটকের রসহানি ঘটিয়েছে। ঘটনা সংস্থাপনা দুর্বল ও দৃশ্যগুলি অনেক ক্ষেত্রেই অর্থহীন বোঝা স্বরূপ।’২
প্রকৃতির প্রতিশোধ-র প্রধান চরিত্র সন্ন্যাসী। আত্ম-অহংকারী এই সন্ন্যাসীর আত্মপ্রসন্ন স্বগতোক্তির মাধ্যমে নাট্যকাহিনীর শুরু। এই স্বগতভাষণে তিনি বলেছেন, বৈশ্বিক মায়ার বন্ধনকে তিনি অনেক সাধনায় ও কষ্টে শেষ-পর্যন্ত বিসর্জন দিতে সক্ষম হয়েছেন। ‘একসময় আর-সবার মতো তিনিও প্রকৃতির দাস ছিলেন, বাসনায় ও আশা-নিরাশায় আবদ্ধ ছিলেন; সেইসময়ে তিনিও অনুধাবন করতেন সেইসব পার্থিব সুখ, যা আস্বাদমাত্রই অন্তর্হিত হয় এবং পিছনে ফেলে যায় অনন্ত তিক্ততা।’৩ এই আত্ম-অহংকারী সন্ন্যাসী পৃথিবীর মায়ার বন্ধন ছিন্ন করতে পেরেছেন বলে যে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছেন, প্রকৃতার্থে তিনি নিজের জীবনে তা পালন করতে সক্ষম হন নি। যার প্রমাণ নাটকের পরিণতিতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। তিনি জগৎকে ঘৃণা ও অবজ্ঞায় ত্যাগ করেছেন অথচ সেই পৃথিবীরই এক ক্ষুুদ্র সমাজচ্যুত বালিকার সংস্পর্শে তার সকল ঘৃণা-অবজ্ঞা ভালোবাসায় উন্নীত হয়েছে। অনাথ বালিকাটিকে যখন সন্ন্যাসী পথের ধূলো থেকে তুলে নিয়ে আসার পর বালিকা যখন তাকে পিতা সম্বোধনে জড়িয়ে ধরল, সেই সময় এই সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর হৃদয়েও স্নেহ-ভালোবাসার সুর অনুরণিত হয়েছে। তথাপি সন্ন্যাসী আত্ম-অহংকারে জাগতিক এই মায়া-মমতার বন্ধনে বিরক্তবোধ করলেন। অর্থাৎ একদিকে বালিকাটির জন্য স্নেহের উদ্রেক, অন্যদিকে সন্ন্যাস-জীবনের অহংকার; উভয়ের টানাপড়েনে সন্ন্যাসী ক্ষতবিক্ষত হলেন।৪ তিনি বেশ কয়েকবার এই অবহেলিত সমাজ-পরিত্যক্তা অনাথ মেয়েটিকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছেন; কিন্তু মেয়েটি যখন তাকে খুঁজে বের করে তখন তিনি সাদরে-সস্নেহে তাকে কোলে তুলে নিয়েছেন। শেষ-পর্যন্ত তিনি বালিকাটিকে ত্যাগ করে সন্ন্যাস-জীবনেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও তাকে পুনরায় ঐ বালিকার টানেই ফিরে আসতে হয়েছে। এবার সন্ন্যাসীই বালিকাটির খোঁজ করেছেন। গ্রামময় খোঁজাখুজির পর তাকে না পেয়ে নিজের গুহায় ফিরে এসে তার মৃতদেহ দেখতে পেয়ে অবচেতনেই সন্ন্যাসী বলে ওঠেন, ‘হায় হায় এ কী নিদারুণ প্রতিশোধ?’ সন্ন্যাসীর এই উক্তিতে প্রতীয়মান হয়, প্রকৃতি তার ওপর চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। প্রকৃতির এই প্রতিশোধ সম্পর্কে আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন-
কে নিলো এই প্রতিশোধ তাঁর উপর? নাটকের শিরোনাম ঘোষণা করছে এ প্রকৃতির প্রতিশোধ। কিন্তু কোন প্রকৃতি? এ কি সেই তুচ্ছ অবজ্ঞেয় প্রকৃতি যার সীমিত রূপ আগেই দেখেছিলেন সন্ন্যাসী? না কি এ সেই আশ্চর্য মহিমময় প্রকৃতি যার সীমাহীন আয়তন তিনি হৃদয়ে উপলব্ধি করেছিলেন কন্যাটির মৃতদেহ আবিষ্কার করার পূর্বমুহূর্তে? আধিভৌতিক জড়প্রকৃতি তো প্রতিশোধ নিতে পারে না। যদি-না অবশ্য কবিকল্পনায় আমরা প্রকৃতির মধ্যেও মানবিক অনুভূতিগুলি আরোপ করি। আর আধ্যাত্মিক প্রকৃতিকে কি প্রতিশোধ-পরায়ণা ব’লে কল্পনা করা সঙ্গত? বালিকার এই মৃত্যুকে ভাগ্যের লীলাই মনে করা হোক কিংবা আর-কিছু, নাটকটি যখন চরম পরিণতিতে পৌঁছায় তখন এ-ঘটনাকে কিছুতেই শাস্তি ব’লে ব্যাখ্যা করা যায় না।৫
অথচ নাট্যকাহিনীতে প্রতিশোধ বলতে, সন্ন্যাসীর স্নেহ-ভালোবাসার এই মৃত্যুকেই প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। প্রকৃতির এই প্রতিশোধ গ্রহণের পূর্বেই সন্ন্যাসীর অন্তরের অহংবোধ দূরীভূত হয়েছিল এবং তিনি বালিকাটিকে খুঁজে পেতেও চেষ্টা করেছেন। তারপরও সন্ন্যাসীর এই প্রকৃতির দ্বারা প্রাপ্ত এই আঘাত থেকে প্রতীয়মান হয় প্রকৃতিকে আমরা যতোই প্রেমের চোখে, ভালোবাসার চোখে দেখি না কেন, প্রকৃত-প্রস্তাবে সে নিষ্ঠুর ও ভয়ানক। প্রকৃতির প্রতিশোধের এই পরিণতি মূলত অতি-নাটকীয় হয়ে উঠেছে, যা এর নাট্যিক দুর্বলতার অন্যতম লক্ষণ। তারপরও প্রকৃতির প্রতিশোধ রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক কাব্যনাট্য প্রয়াস হিসেবে বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচ্য।
খ. ২
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত রাজা ও রাণী (১৮৮৯) তাঁর সাবলীল কাব্যনাট্য প্রয়াস।৬ গীতিকবিতার উচ্ছ্বাসে যদিও এর নাট্যগুণ অনেকাংশেই খর্ব হয়েছে তথাপি বাংলা কাব্যনাট্যের ইতিহাসে রাজা ও রাণী নাটকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ নাটকের কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র বিক্রমদেব কামনার লেলিহান শিখায় পতঙ্গের ন্যায় ঝাঁপ দিয়ে সুমিত্রাকে কামনা করেছে। রাজার এই কামতাড়িত প্রবল প্রেমের প্রতিহিংসা সমস্ত রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্রমদেব নিজেও তার এই প্রবল কামাগ্নির ক্রোধে পুড়ে ছারখার করা পরিপার্শ্ব সম্পর্কে অনুতপ্ত হৃদয়ে উচ্চারণ করেছেন :
... আমি কোন্ সুখে ফিরি
দেশ-দেশান্তরে, স্কন্ধে বহে জয়ধ্বজা,
অন্তরেতে অভিশপ্ত হিংসাতপ্ত প্রাণ।
কোথা আছে কোন্ স্নিগ্ধ হৃদয়ের মাঝে
প্রস্ফূটিত শুভ্র প্রেম শিশিরশীতল।
ধুয়ে দাও, প্রেমময়ী, পুণ্য অশ্র“জলে
এ মলিন হস্ত মোর রক্তকলুষিত।৭
প্রতিহিংসা পরায়ণ বিক্রমদেব মানবিক গুণে গুণান্বিত হয়ে উঠছেন, ইলার সঙ্গ লাভ করে। অনিবার্য পরিণামে রাজা হিংসা-দ্বেষ-হিংস্রতা এবং উদগ্র কামবাসনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে ঋষিতুল্য মানুষে পরিণত হয়েছেন। বিক্রদেবের এই চারিত্রিক পরিবর্তন নাট্যঘটনায় অস্বাভাবিক।
সুমিত্রা রাজা ও রানী-র কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। নাট্যকাহিনীতে নায়িকার সকল ঐশ্বর্য সুমিত্রা চরিত্রে সংযুক্ত হয়েছে। সুমিত্রা মনে করে, প্রকৃত প্রেমের বিষয়টি ভোগের মধ্যে নয়, ত্যাগেই নিহিত। তবে তার এই ধারণা দ্বারা তিনি বিক্রমদেবকে উদ্বোধিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর তাই সুমিত্রার আত্মবিনাশ নাট্যঘটনায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। সুমিত্রার এই আত্মত্যাগে ইলার প্রেমের সকল গুণাবলী যেন তাকেই মহিমান্বিত করেছে। শঙ্কর ও কুমার চরিত্রদ্বয় নাট্যকাহিনীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কুমার চরিত্রের নিয়তি নির্ধারিত নির্মম পরিহাস পাঠকমনে করুণ রসের সঞ্চার করে। রাজা ও রাণী-র মূল কাহিনীর সাথে রেবতী চরিত্রের মানবিক প্রাণচাঞ্চল্য সঙ্গতিপূর্ণ। বিশেষত রেবতী চরিত্রটি মানবিক আবেদন সঞ্জাত, তাই নাট্যঘটনায় অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। নাট্যকাহিনীতে ত্রিবেদী চরিত্রটিও যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ ও জীবন্তরূপে আবির্ভূত হয়েছে। সর্বোপরি ইলা চরিত্রটি নাটকের ভাবৈশ্বর্যকে সমৃদ্ধতর করে তুলেছে। ইলা চরিত্র সম্পর্কে সমালোচক বলেন-
ইলা রবীন্দ্র কবি মানসের ‘জলাভূমি’ থেকে তার চারিত্রিক গুণাবলী আহরণ করেছে। ইলা একটি গীতি কবিতা, একটি ছন্দ, একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। এ চরিত্রটিকে অনাঘ্রাত কুন্দ কুসুমের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। এর পুর্ণ পবিত্র আকর্ষণে মানব মন স্বতঃই বিগলিত ও কৃতার্থ বোধ করে।৮
রাজা ও রানী-তে ইলা চরিত্র কবির মানস-পরিকল্পনার পরিচায়ক।৯ সামগ্রিক বিচারে ইলা চরিত্রটি নাট্যঘটনায় সার্থক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে কাব্যনাটক হিসেবে রাজা ও রানী-র সার্থকতা সর্বাংশে সফল নয়। কেননা এর সাদামাটা বিষয়বস্তু গদ্যনাটকের অনুরূপ। তাই বলা যায়, এ বিষয় রবীন্দ্রনাথ গদ্যনাটক রচনা করলে অধিকতর সার্থকতা লাভ করতেন।
খ. ৩
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্যনাট্য রচনার ক্ষেত্রে বিসর্জন (১৮৯০)-এর মাধ্যমে অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করেছেন। বিসর্জন-র কাহিনী তাঁর রাজর্ষি (১৮৮৭) উপন্যাস থেকে সংগৃহীত। তৎকালীন হিন্দু সমাজে ধর্মের নামে যে পশু হত্যার প্রথা প্রচলিত ছিল রবীন্দ্রনাথ তা মেনে নিতে পারেন নি।১০ তাঁর যুক্তিবাদী মন জগন্মাতার সন্তুষ্টির জন্য রক্তপাতে সায় দেয় নি। রক্তপাত-হিংসা-দ্বেষের পথে যে ধর্মের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না এই নাট্যকাহিনীতে রবীন্দ্রনাথ তাই তুলে ধরেছেন। ‘শান্তি ও কল্যাণ ছিল রবীন্দ্র মানসের কাম্য অনুভূতি। প্রেম ছিল তাঁর উপাস্য মন্ত্র, মানব কল্যাণের উপর ধর্মের ভিত্তি স্থাপিত। ধর্ম ধারণ ক’রে, ধ্বংস করে না।’১১ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ও প্রেমচেতনাজাত জীবে দয়া ও প্রেমের অমোঘ বাণীই বিসর্জন নাটকের মূল লক্ষ্য। একদিকে করুণ রসের ঘনপিনদ্ধ কাব্যিক বুনোন, অন্যদিকে ঘটনার চমৎকার নাটকীয় বিন্যাসে বিসর্জন শিল্পসফল কাব্যনাট্য হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। তবে বিসর্জন-র সবেচেয়ে বড় সার্থকতা, নাট্যসংলাপে চরিত্রগুলোর মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত যথাযর্থরূপে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বিসর্জন-র চরিত্রগুলোর অন্তর্রহস্য উন্মোচনে সচেষ্ট ছিলেন। এ নাটকের চরিত্রগুলো প্রসঙ্গে সমালোচকের মন্তব্য স্মরণীয়-
কি মনের, কি বাহিরের, এতখানি দ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথের আর কোন নাট্যেই এমন জীবন্তভাবে ফুটিয়া উঠে নাই, এই হিসাবে বিসর্জন অতুলনীয়। জয়সিংহের মনের মধ্যে যে সংশয়ের নিষ্করুণ দ্বন্দ্ব, তাহার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে অপূর্ব চরিত্র-বিশ্লেষণের ক্ষমতা দেখাইয়াছেন, খুব কম নাট্যেই তাহার তুলনা আছে। আর, কি জয়সিংহ, কি রঘুপতি, কি গোবিন্দমাণিক্য, কি অপর্ণা, ইহাদের মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম তাহা মনের মধ্যেই শুধু লীলায়িত হয় নাই, বাহিরের কথার গতিভঙ্গি ও কর্মের মধ্যেও তাহা অভিব্যক্ত হইয়াছে। চিত্তের ও কর্মের দ্বন্দ্বগতির এমন অপূর্ব সমন্বয় রবীন্দ্রনাথের আর কোনও নাটকেই এতটা সম্ভব হয় নাই। বিসর্জন যে অভিনয়-সাফল্য লাভ করিয়াছে, ইহাই তাহার অন্যতম প্রধান কারণ।১২
নাট্যকাহিনীতে নায়ক গোবিন্দমাণিক্য এবং খলনায়ক রঘুপতির মধ্যে প্রেম ও ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মাধ্যমে নাট্যকাহিনী গতিপ্রাপ্ত হয়েছে। বাহ্যিকভাবে বিচার করলে দেখা যায়, একদিকে রাজার ক্ষমতা অন্যদিকে ব্রাহ্মণের শক্তির দ্বন্দ্বে নাট্যকাহিনী আবর্তিত। এই উভয় শক্তির অনমনীয় অবস্থান নাট্যঘটনাকে চরম নাটকীয় করে তুলতে সহায়তা করেছে। গোবিন্দমাণিক্যের চরিত্রে বাহ্যদ্বন্দ্ব দৃষ্ট হলেও তার অন্তরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত রহিত ফল্গুধারার ন্যায় অপর্ণার প্রেমপূর্ণ সত্যের ঝর্ণা ধারা প্রবাহিত। অর্থাৎ গোবিন্দমাণিক্য প্রেমপূর্ণ বাণী পরম সত্য হিসেবে সংশয়হীনভাবে গ্রহণ করেছেন। অন্তরে এ বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র দ্বন্দ্ব নেই, তবে নাট্যঘটনায় রঘুপতি বাহ্যিক সংঘাত অনিবার্য করে তুলেছে। বিসর্জন-র সাথে রাজা ও রাণী-র প্রাসঙ্গিক তুলনা করতে গিয়ে সমালোচক নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন-
ভাব-কল্পনার প্রসারে ও গভীরতায়, নাটকীয় আঙ্গিকের দৃঢ় স্থাপত্য-মহিমায়, জটিল মানব-সম্বন্ধের সুনিপুণ বিশ্লেষণে, হৃদয়াবেগের সংযমে ও স্বচ্ছন্দতায়, এবং অনুভূত সত্যের প্রতি নিষ্ঠায় বিসর্জন এত সমৃদ্ধতর যে মনে হয়, এই দুই নাটকের মধ্যে একটা সুদীর্ঘ অথচ অজ্ঞাত অভিজ্ঞতার ইতিহাস কোথাও আত্মগোপন করিয়া আছে।১৩
রঘুপতি আত্মপ্রত্যয়ী ও দৃঢ়চেতা ক্ষমতায় বিশ্বাসী চরিত্র। দেবীর প্রতি নিষ্ঠার চেয়ে তার এই আত্মপ্রত্যয়ে অধিকতর ক্রিয়াশীল নিজ ক্ষমতার দম্ভ। ফলে আজন্ম লালিত তার ব্রাহ্মণ্য সংস্কারকে যেকোনো উপায়েই শ্রেষ্ঠ করে তুলতে বদ্ধপরিকর। তার কুটিল মনোবাসনা ও ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করার জন্য সে গোপনে রাণী গুণবতী এবং নক্ষত্র রায়কে প্রলুব্ধ করে, তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছেন। রঘুপতির এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দম্ভ এবং বিশ্বাসের মধ্যেই তার অন্তর্দ্বন্দ্ব নিহিত। কেননা সত্যিকার অর্থে পাথরে গড়া দেবীমূর্তিতে রঘুপতির আস্থা সম্বন্ধে নাট্যঘটনায় সন্দেহের-সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কেননা রঘুপতি নিজের ক্ষমতা রক্ষার জন্য জয়সিংহের কাছে অবলীলায় মিথ্যাচার করেছেন। গোবিন্দ মাণিক্যের বিরুদ্ধে প্রজাদের ক্ষেপিয়ে তুলতে রঘুপতি দেবীর মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ‘মা বিমুখ হয়েছেন’ বলে ফলাও করে প্রচার করেছেন। ‘দেবীকে নিয়ে এখানে রঘুপতি যে ছলনা করেছেন তা কোনো শাক্ত ভক্তর উপযুক্ত আচরণ নয়। ক্ষমতাদম্ভী দানব ছাড়া অথবা বিশ্বাসহীন নাস্তিক ব্যতীত আরাধ্যা দেবীকে নিয়ে এ ধরণের আচরণ সম্ভব নয়। সুতরাং দেবী তাঁর কাছে আরাধ্য সত্য নয়।’ ১৪ তার মূল লক্ষ্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কার রা করে নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা। রঘুপতির এই অন্তর্চেতনার উদ্ভাসন এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যে দ্বন্দ্ব তা বিসর্জন নাটকটিকে আধুনিক কাব্যনাটকের সমপর্যায়ভুক্ত করে তোলে। নাটকে রঘুপতির এই দ্বান্দ্বিকতার প্রকাশ ঘটেছে এভাবে-
পাপ পুণ্য কিছু নাই। কে বা ভ্রাতা, কে বা
আত্মপর! কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ!
এ জগৎ মহা হত্যাশালা। জানো না কি
প্রত্যেক পলকপাতে লক্ষকোটি প্রাণী
চির আঁখি মুদিতেছে! সে কাহার খেলা?
হত্যায় খচিত এই ধরণীর ধূলি।
প্রতিপদে চরণে দলিত শত কীট-
তাহারা কি জীব নহে? রক্তের অক্ষরে
অবিশ্রাম লিখিতেছে বৃদ্ধ মহাকাল
বিশ্বপত্রে জীবের ক্ষণিক ইতহাস।
হত্যা অরণ্যের মাঝে, হত্যা লোকালয়ে,
হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে, কীটের গহ্বরে,
অগাধ সাগর-জলে, নির্মল আকাশে,
হত্যা জীবিকার তরে, হত্যা খেলাচ্ছলে,
হত্যা অকারণে, হত্যা অনিচ্ছার বশে-
চলেছে নিখিল বিশ্ব হত্যার তাড়নে
ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণপণে, ব্যাঘ্রের আক্রমণে
মৃগসম, মুহূর্ত দাঁড়াতে নাহি পারে।১৫
শাক্ত ধর্মাবলম্বী রঘুপতির মুখ-নিঃসৃত এই সংলাপ থেকে বোঝা যায় না- তার অন্তর্গত প্রকৃত উদ্দেশ্য। তবে নাট্যকাহিনীর ক্রমাগ্রসরমানতায় পাঠক জেনে যায়- গোবিন্দমাণিক্যের পরাজয়ই রঘুপতির একমাত্র লক্ষ্য। একদিকে জয়সিংহের প্রতি রঘুপতির হৃদয়-বিগলিত স্নেহ-ভালোবাসা অন্যদিকে মা’য়ের (দেবীর) চরণে বলী দিয়ে জীবহত্যার দৃঢ় সংকল্প; তাঁর এই অন্তর্দ্বন্দ্ব নাট্যকাহিনীকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছে। রঘুপতি হিংসায়-ক্রোধে এবং ক্ষমতার দম্ভে রাজরক্ত দিয়ে দেবীকে তুষ্ট করতে চেয়েছেন; অথচ সেই প্রবল ক্ষমতালিপ্সু পাষাণ-সম রঘুপতির মুখে শোনা যায়-
সত্য করে বলি, বৎস, তবে। তোরে আমি
ভালবাসি প্রাণের অধিক- পালিয়াছি
শিশুকাল হতে তোরে, মা’য়ের অধিক
স্নেহ- তোরে আমি নারিব হারাতে।১৬
জয়সিংহের প্রতি রঘুপতির স্নেহাতিশয্য যে ছিল তার প্রমাণ নাটকের পরিণতিতে পাওয়া যায়। কেননা জয়সিংহের মৃত্যুতে রঘুপতির মনোবল ভেঙে যাওয়ার পাশাপাশি তার জীবন শূন্য হয়ে গেছে। জয়সিংহের মৃত্যুতে রঘুপতি নিশ্চিতভাবে পরাজিত হয়েছেন। কেননা জয়সিংহের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তার শক্তি-আকাঙ্ক্ষা-বাসনা সবকিছুই নস্যাৎ হয়ে গেছে। স্নেহ-প্রেম-প্রতিহিংসার এই দ্বন্দ্বই রঘুপতি চরিত্রকে নাট্যকাহিনীতে ট্র্যাজেডির নায়ক করে তুলেছে। জয়সিংহ স্নেহ-প্রেম-করুণায়, বিশ্বাসে-সংশয়ে কোমলমতি। তার নিষ্পাপ কোমলতা সবলে সবাইকে আকর্ষণ করে। সে অপর্ণার প্রেমে পূর্ণ এবং দর্শক-শ্রোতার সহানুভূতিতে ধন্য। জয়সিংহ একদিকে রঘুপতির শিষ্য হিসেবে গুরুর কথা অবিশ্বাস করতে পারে নি, অন্যদিকে গোবিন্দমাণিক্যের প্রেমের বাণীও উপেক্ষা করতে পারে নি। অবশেষে মানবিক দুর্বলতায় জীবনের এই জটিলতার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে জয়সিংহ নিজেকেই উৎসর্গ করে সকল দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছে।
বিসর্জন নাটকে অপর্ণা প্রেমের প্রতীকরূপে চিত্রিত। রানী গুণবতীর চরিত্রটি নির্দ্বন্দ্ব, তবে তার দুর্বলতার সুযোগে রঘুপতি তাকে স্বামীদ্রোহী করে তুলতে পেরেছে। অবশ্য এর পেছনে নারীর চিরন্তন মাতৃত্বের দুর্বলতা ক্রিয়াশীল। বিসর্জন-র মতো ‘সিরিয়াস’ নাট্যঘটনায় প্রজাদের লঘু হাস্যপরিহাস সামঞ্জস্যহীন। তাছাড়া চাঁদপালের সৈন্যাধ্যরে পদ এবং নয়ন রায়ের দেওয়ানের পদে আসীন হওয়ার বিষয়টিও বিবেচনাশূন্য মনে হয়; ফলে এই চরিত্র দুটি নাট্যকাহিনীতে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠে নি। গোবিন্দমাণিক্য টাইপ চরিত্র। নাট্যঘটনায় তার বিশেষ কোনো উত্থান-পতন নেই। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি ব্যতিরেকে রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন কাব্যনাটক রচনার সার্থক প্রয়াস হিসেবে গণ্য করা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত প্রায় সবগুলো নাটকেই কাব্য ও নাটকের সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়। তারপরও সবগুলো রচনাই কাব্যনাটকের সমপর্যায়ে উন্নীত নয়। তাছাড়া আধুনিক-অর্থে তাঁর কোনো নাটকই সার্থক কাব্যনাটক হিসেবে বিবেচ্য নয়। তবে কাব্যনাটক রচনায় রবীন্দ্রনাথের প্রয়াস ছিল সুচিন্তিত ও সচেতন। কিন্তু ‘লিরিক’-এর স্রোতে ভেসে গিয়ে তিনি চরিত্রের অন্তর্গত সত্য উদ্ঘাটনে মনোযোগী হতে পারেন নি। সার্থক কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে এটাই তাঁর ব্যর্থতার কারণ।
খ. ৪
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাহিনী কাব্যগ্রন্থের নাট্যকবিতাগুলো রচনার পূর্বে কাব্য-সংলাপাত্মক চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২), বিদায় অভিশাপ (১৮৯৪) প্রভৃতি রচনা করেছিলেন। এই রচনা দুটোকে কেউ বলেছেন ‘নাট্যকাব্য’; আবার কেউ বলেছেন ‘কাব্যনাট্য’। অধিকাংশ সমালোচকের মতে তাঁর এই রচনা দুটোতে কাব্যের প্রবল প্রাধান্য থাকায় নাট্যগুণ স্বীয় বৈশিষ্ট্য-মর্যাদায় টিকে থাকে নি। কিন্তু বাংলা কাব্যনাটকের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা এবং বিদায় অভিশাপ-এর গুরুত্ব-অবদান অনস্বীকার্য। তাছাড়া পরবর্তীকালে তিনি কথা ও কাহিনী কাব্যেও বেশ কিছু নাট্যগুণ সমৃদ্ধ আখ্যান-কবিতা রচনা করেছিলেন। কথা ও কাহিনীর আখ্যানমূলক নাট্যধর্মী কবিতাগুলো এবং চিত্রাঙ্গদা, বিদায় অভিশাপ প্রভৃতি রবীন্দ্র-মানসে নাট্য-নিরীক্ষায় এক অভিনব জোয়ার সৃষ্টি করেছিল।১৭
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাটক এবং নিরীক্ষামূলকভাবে কাব্যনাট্য রচনার পূর্বে কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন; যে কবিতাগুলোর মধ্যেও নাটকীয়তা রয়েছে। বিশেষত এসব কবিতায় চরিত্রের বিকাশ লক্ষণীয়। তাঁর কাহিনী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত গান্ধারীর আবেদন (১৮৯৭), সতী (১৮৯৭), নরকবাস (১৮৯৭), কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ (১৯০০) প্রভৃতি কবিতায় এই নাট্যক্রিয়া বর্তমান।১৮ এগুলো প্রকৃত-প্রস্তাবে নাট্যকবিতা (Dramatic Poetry)। এসব কবিতার বিষয়-উপাদান তিনি পুরাণ এবং ইতিহাস থেকে গ্রহণ করেছিলেন; অথচ চরিত্রগুলোকে আধুনিক জীবনদৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। এসব কবিতার বহিরাঙ্গ অর্ধ-নাট্যের এবং আভ্যন্তর-প্রকৃতি কাব্যাঙ্গিকের। তবে এ রচনাগুলোতে কাব্যময়তার আধিপত্য লক্ষণীয়। কাব্যগুণের প্রাধান্য থাকা সত্বেও এসব রচনায় নাট্যগুণ বিদ্যমান। রবীন্দ্রনাথের এ ধরনের নাট্যগুণসমৃদ্ধ কবিতাগুলো নাট্যকবিতা (Dramatic Poetry) হিসেবে খ্যাত।১৯ উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ নাট্যকবিতা রচনার ক্ষেত্রে কাব্যময়তাকে অসাধারণ দক্ষতায় ব্যবহার করেছিলেন। ফলে এগুলোর প্রবণতা কাব্যে দিকে অধিক ঝুঁকে পড়েছে; যা কাব্যনাট্যের ভাষার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের এসব নাট্যকবিতায় ইয়েটস-এর কাব্যনাট্যাঙ্গিকের তত্ত্বগত সাদৃশ্য থাকলেও তা ইয়েট্স প্রভাবিত নয়। রবীন্দ্রনাথের নাট্যকবিতার সাথে ইয়েটস-এর কাব্যনাটক বিষয়ক তাত্ত্বিক ধারণার সাযুজ্য আছে তবে তা রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তাজাত। কেননা তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে স্বভাবগতভাবেই বৈচিত্র্যের পিয়াসী ছিলেন; আর তাই তিনি নাটক ও কবিতার সংমিশ্রণে বাংলা সাহিত্যে নতুন শিল্পাঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন।২০
রবীন্দ্রনাথের কবিতানাট্যগুলো সাধারণত পুরাণ ও ইতিহাসাশ্রয়ী। তিনি তাঁর এসব রচনায় পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক ঘটনার ছায়ায় দ্বি-ঘাতবিশিষ্ট ভাবের দ্বান্দ্বিক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে নাট্য-মুহূর্তকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা বিশেষত চরিত্রের আন্তর-প্রবণতা প্রকাশে তিনি গীতিকবিতাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের গীতিকবিতার সফল ব্যবহার করে কাব্য-ভাষায় নাট্যকাহিনী নির্মাণ প্রসঙ্গে সমালোচক বলেন-
ইহার বহিরঙ্গ হইয়াছে নাটকের- অন্তরঙ্গ গীতিকবিতার রসধারায় উচ্ছ্বল। অব্যর্থ ও সুললিত শব্দযোজনায়, নিপূণ অলংকার প্রয়োগে, ভাব-কল্পনার সাবলীল ও স্বতঃ-উৎসারিত প্রবাহে, ব্যঞ্জনাশক্তির চরমোৎকর্ষে এগুলি রবীন্দ্র কাব্যশিল্পের চরম নিদর্শন এবং বাংলা সাহিত্যের মহামূল্য রত্ন।২১
চিত্রাঙ্গদা-য় রবীন্দ্রনাথের মূল উদ্দেশ্য চিত্রাঙ্গদা-অর্জুনের মানসলোকের ভিতর-বাহির তুলে ধরা। এই মানসলোকের উপস্থাপন প্রক্রিয়ায় অতীন্দ্রিয় ভাবকল্পনা থাকা সত্ত্বেও এখানে মানব-মানবীর পারস্পরিক যৌনাকাঙ্ক্ষার চিরন্তন সত্যও উন্মোচিত হয়েছে। দৈহিকভাবে নর-নারীর মিলনের আকাঙ্ক্ষা আদিম তাড়নাজাত হলেও তা সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় অনিবার্য সত্য। নর-নারীর দৈহিক মিলনের মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত আবেগ-উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ও সুখ-উপলব্ধি ঘটে তবে শুধুমাত্র দৈহিক ভোগেই মানুষের হৃদয় পূর্ণতৃপ্তি লাভ করতে পারে না। কেননা দেহের ক্ষণস্থায়ী রূপ-সৌন্দর্য একদিন থাকে না, তখন যৌবনের তীব্র যৌনাকাঙ্ক্ষায় অনিবার্যভাবে অবসাদ নেমে আসে। আর তাই হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগসূত্র স্থাপন নর-নারীর প্রেমের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নাট্যঘটনায় মণিপুরের পুত্রহীন রাজার কন্যা চিত্রাঙ্গদা পুরুষবেশে পিতৃ-ইচ্ছায় ধনুর্বিদ্যা শিক্ষাসহ রাজকার্য পরিচালনায় দক্ষ হয়ে ওঠে এবং রাজকার্যে আত্মনিয়োগ করে। একদিন মৃগয়ায় চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে সন্ন্যাসীবেশী অর্জুনের দেখা হয়। এরপর থেকেই রাজকুমারীর অন্তরে নারীত্ব জাগ্রত হয়। অথচ একদিন পুরুষের ছদ্মবেশ ধারণ করে অর্জুনের ন্যায় বীরের সঙ্গে লড়াইয়ের সাধ ছিল তার। কিন্তু অর্জুনের সৌম্য-শান্ত পুরুষকান্তি-দর্শন করে চিত্রাঙ্গদার মনে হল-
... পুরুষের সাথে থেকে, এতদিন
ভুলে ছিনু যাহা, সেই মুখ চেয়ে, সেই
আপনাতে-আপনি-অটলমূর্তি হেরি
সেই মুহূর্তেই জানিলাম মনে, নারী
আমি।২২
নারী-হৃদয় যথার্থ পুরুষের সম্মুখে তার নারীত্বকে উপেক্ষা করতে পারে না। তাই পৌরুষের নিকট আত্মসমর্পণ করতে চিত্রাঙ্গদা পুরুষবেশ ত্যাগ করে অর্জুনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিল। কিন্তু অর্জুন সেই সময় দ্বাদশ বৎসরের ব্রাহ্মাচর্য পালনে একনিষ্ঠ থাকায় তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। অর্জুনের এই প্রত্যাখ্যানের ঘটনায় চিত্রাঙ্গদা নিজেকে রূপহীনা ভেবে নেয়। বাহ্যিক রূপে পুরুষকে আকৃষ্ট করা অপেক্ষা, হৃদয়ের রূপে-সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করা সময় সাপেক্ষ ভেবে চিত্রাঙ্গদা অর্জুনকে পাওয়ার জন্য মদন ও বসন্তের তপস্যায় মগ্ন হয়। দেবতার বরে চিত্রাঙ্গদা এক বছরের জন্য অনন্য বাহ্যরূপাবয়ব লাভ করে। যে রূপকে একদিন চিত্রাঙ্গদা উপেক্ষা করেছিল, আজ তার মনস্কামনা পূরণ করতে সেই রূপকেই ব্যবহার করল। এদিকে অর্জুনও তার বাহ্যরূপের মোহে ব্রাহ্মাচর্য ভুলে গিয়ে চিত্রাঙ্গদাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। নারীর বাহ্যরূপে মোহিত অর্জুন অবলীলায় ব্রাহ্মাচর্য সাধন ত্যাগ করল এবং চিত্রাঙ্গদার রূপের অনলে দগ্ধ হয়ে অর্জুন উপলব্ধি করে-
... খ্যাতি মিথ্যা,
বীর্য মিথ্যা, আজ বুঝিয়াছি। আজ মোরে
সপ্তলোক স্বপ্ন মনে হয়। শুধু একা
পূর্ণ তুমি, সর্ব তুমি, বিশ্বের ঐশ্বর্য
তুমি- এক নারী সকল দৈন্যের তুমি
মহা অবসান, সকল কর্মের তুমি
বিশ্রামরূপিণী।২৩
অর্জুনের এই উপলব্ধির সাথে চিত্রাঙ্গদার বিশ্বাসের বিরোধ স্পষ্ট, কেননা সে সাধারণ নারী-মননের কোমলতায় গঠিত নয়। তার হৃদয় শুধুমাত্র নারীবুদ্ধি দ্বারা আবিষ্ট না হওয়ায় অর্জুনের এই নিবেদনকে সে গ্রহণ করতে পারল না। কেননা অর্জুন তার হৃদয়ের রূপ-সৌন্দর্যের বদলে বাহ্যিক রূপের মোহে আকৃষ্ট হয়েছিল। অথচ চিত্রাঙ্গদার যখন বাহ্যিক রূপ-সৌন্দর্য ছিল না, তখন অর্জুন ব্রাহ্মাচর্য সত্য-পালনের কপটতায় তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অথচ সে চিত্রাঙ্গদার বাহ্যরূপে মুগ্ধ হয়ে তার নিকট প্রেম-প্রার্থনা করেছে। তার বাহ্যিক রূপে অর্জুন মুগ্ধ হয়ে প্রেম-নিবেদন করায়, চিত্রাঙ্গদার অন্তরে অব্যক্ত এক বেদনাবোধ ও ঘৃণার জন্ম হয়েছে। চিত্রাঙ্গদার স্বগোতক্তিতে সেই ঘৃণার প্রকাশ স্পষ্ট-
এই দুটি
নীলোৎপল নয়নের তরে; এই দুটি
নবনীনিন্দিত বাহুপাশে সব্যসাচী
অর্জুন দিয়াছে আসি ধরা, দুই হস্তে
ছিন্ন করি সত্যের বন্ধন। কোথা গেল
প্রেমের মর্যাদা? কোথায় রহিল পড়ে
নারীর সম্মান? হায়, আমারে করিল
অতিক্রম আমার এ তুচ্ছ দেহখানা,
মৃত্যুহীন অন্তরের এই ছদ্মবেশ
ক্ষণস্থায়ী।২৪
একদিকে অর্জুনের প্রেমপূর্ণ সোহাগ-আদর, অন্যদিকে চিত্রাঙ্গদার একান্ত বিশ্বাসবোধের দ্বন্দ্বে তার অন্তর জর্জরিত। এই দ্বি-ঘাত আন্তর-প্রতিক্রিয়ায় চিত্রাঙ্গদার জীবন বিষিয়ে ওঠে। অতঃপর সে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য দেবতার কাছে ‘বর’ ফিরিয়ে নেয়ার প্রার্থনা জানায়; এ সময় মদন তাকে অর্জুনের প্রত্যাখ্যানের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে চিত্রাঙ্গদা ক্ষোভে-দুঃখে-অভিমানে বলে-
সেও ভাল। এই ছদ্মরূপিণীর চেয়ে
শ্রেষ্ঠ আমি শতগুণে। সেই আপনারে
করিব প্রকাশ; ভাল যদি নাই লাগে
ঘৃণাভরে চলে যান যদি, বুক ফেটে
মরি যদি আমি, তবু আমি- আমি রব।২৫
বারবার চিত্রাঙ্গদা ভয় পেয়েছে, যদি অর্জুন তাকে ছেড়ে চলে যায়। ইতোমধ্যে দস্যুদল কর্তৃক চিত্রাঙ্গদার রাজ্য আক্রান্ত হলে, অর্জুন বীর্যবতী এই নারীর পরিচয় পাওয়ার জন্য ঔৎসুক্য প্রকাশ করে। তখনো চিত্রাঙ্গদার ভয় কাটে নি; ফলে স্বরূপে স্বামীর সামনে হাজির হতে পারছিল না। একদিকে প্রেমের স্নেহবন্ধন অন্যদিকে হৃদয়ের সত্য প্রকাশ করার মানসিক যন্ত্রণা চিত্রাঙ্গদার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত করেছে। তবে অর্জুনও ধীরে ধীরে বাহ্যরূপের মোহ কাটিয়ে উঠে হৃদয়ের সৌন্দর্য উপলব্ধিতে প্রস্তুত হয়েছে। এদিকে বৎসরকাল সমাপ্ত হয়ে এলে, চিত্রাঙ্গদা স্বরূপে প্রিয়তমের নিকট উপস্থাপন করল- ‘আমি চিত্রাঙ্গদা।/ দেবী নহি, নহি আমি সামান্য রমণী।’২৬
রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা কবিতানাট্যের নায়িকা চরিত্রটি শুধু নারী নয়, সর্বান্তকরণে মানুষ হিসেবে স্বীয় মর্যাদায় আত্মপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। মৃতবৎ নারী-হৃদয় একদিন অর্জুনকে দেখে জেগে ওঠে এবং নাটকের পরিবেশ তৈরি করে দেয়। দেবতা কর্তৃক প্রদত্ত কুৎসিৎ দেহে সৌন্দর্যের যে বিকাশ, তা বাস্তবিক-ই একান্ত চিত্রাঙ্গদার। অর্জুনের সঙ্গে মিলনের মধ্যদিয়ে তার যে অসহ্য পুলক উপলব্ধি তা-ও চিত্রাঙ্গদার নিজস্ব। অথচ চিত্রাঙ্গদা নাট্যকারের উদ্দেশ্যপূরণের ক্রীড়ানক মাত্র। কেননা কবি তাকে দিয়ে বাহ্যিক রূপের পরিবর্তে অন্তরের সৌন্দর্যকে জয়ী করতে চেয়েছেন। প্রসঙ্গত সমালোচক বলেন-
... অর্জুনের চুম্বন, আলিঙ্গন, আদর-সোহাগ, সে-সব তো প্রকৃতপক্ষে চিত্রাঙ্গদার দেহের সঙ্গেই জড়িত- তাহারই দেহে অর্পিত। প্রথম মিলনে যে ‘জীবন-মরণ’ বিস্মরণকারী ‘অসহ্যপুলক’, তাহা তো চিত্রাঙ্গদারই। অথচ মিলনের নানা বিচিত্র আনন্দানুভূতি সে নিজে অনুভব করিয়া, পূর্ণ আত্মসচেতন হইয়া, গভীর ও সূক্ষ্ম মননশীলতার দ্বারা দেহের মধ্যে রূপের একটা পৃথক অস্তিত্ব কল্পনা করিয়া, তাহার উদ্দিষ্ট চুম্বন-আলিঙ্গন তাহাকে ফাঁকি দিয়া সে-ই গ্রহণ করিতেছে এইরূপ অনুভব করা মনোবিজ্ঞানসম্মত ও স্বাভাবিক বলিয়া মনে হয় না।২৭
চিত্রাঙ্গদা কবিতানাট্যের চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব অসাধারণ কাব্য সুষমায় বিকশিত হয়েছে। তার বহিরঙ্গের দ্বন্দ্ব এতে নেই বললেই চলে, তাছাড়া দীর্ঘ কাব্য-সংলাপও এর নাট্যগতিকে অনেকাংশে ক্ষুণ্ন করেছে। সংলাপের কাব্যগুণ যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও তা নাট্যপরিস্থিতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। ‘... ‘চিত্রাঙ্গদা’ যথার্থ নাট্যধর্মী রচনা হয়ে ওঠে নি, কাব্যধর্মী রচনা-রূপেই এর বিশিষ্টতা। তাই একে নাট্যকাব্য অর্থাৎ নাট্যাঙ্গিকাশ্রয়ী কাব্যের শ্রেণীভুক্ত করাই সমীচীন মনে হয়।’২৮
চিত্রাঙ্গদা-র অনেক সংলাপেই চরিত্রের বিকাশ বা অন্তর্ঘাত-বহির্ঘাত প্রকাশের পরিবর্তে লেখকের নিজস্ব অন্তর্চেতনা প্রকাশিত হয়েছে। ফলে এর নাট্যগুণ ব্যাহত হয়েছে। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের আধুনিক কাব্যনাটকের শিল্পাঙ্গিক অনুসরণ করে এসব নাটক রচনা করেন নি, সেহেতু আধুনিক কাব্যনাটকের বিচারে চিত্রাঙ্গদা-র শৈথিল্য ধরা পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু এদেশীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করা হলে দেখা যায়, সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের এই শিল্প মাধ্যমে রাবীন্দ্রিক নিরীক্ষাকে মূল্যায়ন না করে উপায় থাকে না। কেননা এই সকল ‘কাব্য’ প্রধান নাট্যপ্রয়াসের ওপর ভিত্তি করে বাংলা আধুনিক কাব্যনাটকের সৌধ নির্মিত হয়েছে।
খ. ৫
রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ নাট্যধর্মী আরেকটি বিশিষ্ট কবিতা। এই কবিতানাট্যের বিষয়বস্তু তিনি মহাভারতের কচ-দেবযানী অংশ থেকে নির্বাচন করেছেন। মহাভারত হতে চয়নকৃত অংশের কাহিনী রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব কাব্যপ্রতিভায় পরিবর্তন করে নিয়ে এ কবিতানাট্যে প্রকাশ করেছেন। মূল মহাভারতে স্বামী কচের অভিশাপের প্রত্যুত্তরে স্ত্রীও তাকে পাল্টা অভিশাপ দিয়েছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিদায় অভিশাপ-র কাহিনীতে কচ অভিশাপের পরিবর্তে প্রিয়তমা দেবযানীকে আশীর্বাদ করেছে। এ কবিতানাট্যের মূল দ্বন্দ্ব কর্তব্যের সঙ্গে প্রেমের। এই কর্তব্য এবং প্রেমের দ্বন্দ্ব দেবযানী ও কচ উভয় চরিত্রের মধ্যে প্রকাশিত। প্রেমের একরৈখিক প্রবল আকর্ষণে দেবযানী মর্ত্যভূমিতে কচকে নিয়ে শান্তি-সুখের নীড়ের স্বপ্ন দেখেছে। অন্যদিকে কচ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে, স্বর্গে প্রত্যাবর্তনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কর্তব্যের খাতিরে সে প্রিয়তমাকে এবং তার নিজের প্রেমকেও উপেক্ষা করেছে। তবে কচ নিজেও মনে-প্রাণে দেবযানীর সঙ্গ এবং ভালোবাসা কামনা করে। কিন্তু কর্তব্যের টানে প্রেমের স্নেহপাশকে সে ছিন্ন করেছে। অন্যদিকে দেবযানী প্রেমকেই সর্বস্বজ্ঞান করে প্রেমেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে নিয়েছে।
কচ কর্তব্যসচেতন হলেও দেবযানী অনেক বেশি আধুনিক এবং মানবীয় গুণসম্পন্ন। কচ কর্তব্যের কাছে প্রেমের স্বতঃস্ফূর্ত গতি রুদ্ধ করে অন্তরের বেদনাবোধকে লুকিয়ে দেবলোকে যাওয়ার সময় বিরহতাপে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। উভয় চরিত্রের এই অন্তর্গত দ্বন্দ্ব কাব্যভাষায় আত্মস্থ করে নাট্যরূপে প্রকাশ করাই রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায় ছিল। দেবযানী প্রেমে নিবেদিতা জীবনপিয়াসী নারী চরিত্র। নারী-হৃদয়ের স্বাভাবিক সংকীর্ণতা, অনুদারতা, স্বার্থপরতা দিয়েই দেবযানী চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করেছেন। সে বাস্তব সাংসারিক সংকীর্ণ গণ্ডীর ভেতরই প্রিয়তমের প্রেম-প্রত্যাশী। অথচ প্রিয়তম কচের জীবনের লক্ষ্য মৃত্যু সঞ্জীবনী জ্ঞানার্জন করা। দীর্ঘকাল এক সাথে বসবাস করেও কচের নিকট থেকে এই প্রাপ্তিতে দেবযানীর হৃদয় রক্তাক্ত হয়েছে। তারপরও প্রিয়তমের অমঙ্গল কামনা না করে হাসিমুখে তাকে বিদায় জানায়- ‘কৃতজ্ঞতা! ভুলে যেয়ো, কোন দুঃখ নাই।/ উপকার যা করেছি হয়ে যাক ছাই-/ নাহি চাই দান-প্রতিদান।’২৯ অথচ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট কচ প্রিয়তমাকে পরিত্যাগ করে, আনন্দিত চিত্তে ফিরে গিয়েছে তা নয়, বরং তার হৃদয়েও প্রিয়তমার বিচ্ছেদ-ভাবনায় রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কর্তব্যের টানে ভবিষ্যতের সুখ বিসর্জন দিয়ে তাকে স্বর্গে ফিরে যেতে হবে তারপরও কচ ফিরে যাওয়ার সময় হৃদয়ের দুর্বলতা প্রকাশ করবে না বলে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিল- কিন্তু অভিমানী, কোমলপ্রাণা, স্নেহময়ী, প্রেমপরায়ণা দেবযানীর সামনে স্বীয় হৃদয়ের হাহাকার ও সত্য গোপন করতে পারেনি- ‘... ভালবাসি কি না আজ/ সে তর্কে কী ফল? ... সে আমি সাধিব। স্বর্গ আর স্বর্গ বলে/ যদি মনে নাহি লাগে, দূর বনতলে/ যদি ঘুরে মরে চিত্ত বিদ্ধ মৃগসম,/ চিরতৃষ্ণা লেগে থাকে দগ্ধ প্রাণে মম/ সর্বকার্য-মাঝে- তবু চলে যেতে হবে/ সুখশূন্য সেই স্বর্গধামে।’৩০ প্রিয়তম কচের মুখ থেকে এই নিষ্ঠুর সত্য জানার পর দেবযানীর সমগ্র জীবন চরম শূন্যতায় একাকার হয়ে যায়। একথা সত্য, যে-নারী তার প্রিয়তমকে হারিয়ে বিরহী, সেই নারী হৃদয়কে প্রবোধ দেয়ার ভাষা কচের জানা নেই। উপরন্তু বিরহী দেবযানী পরম ব্যাকুলতায় কচকে বলেছে-
হে ব্রাহ্মণ। তুমি চলে যাবে স্বর্গলোকে
সগৌরবে, আপনার কর্তব্যপুলকে
সর্ব দুঃখশোক করি দূরপরাহত;
আমার কী আছে কাজ, কী আমার ব্রত।
আমার এ প্রতিহত নিষ্ফল জীবনে
কী রহিল, কিসের গৌরব? এই বনে
বসে রব নতশিরে নিঃসঙ্গ একাকী
লক্ষ্যহীনা। যে দিকেই ফিরাইব আঁখি
সহস্র স্মৃতির কাঁটা বিঁধিবে নিষ্ঠুর;
লুকায়ে বক্ষের তলে লজ্জা অতি ক্রূর
বারম্বার করিবে দংশন।৩১
রবীন্দ্রনাথ বাস্তবজীবনের রঙে-রূপে-রসে-গন্ধে জীবনপিয়াসী দেবযানীকে সৃষ্টি করেছেন। দেবযানী চরিত্র শুধু আদর্শিক জীবনচেতনার অনুগ চিত্রাঙ্গদার মতো নয়। তার জীবন আধুনিক মানুষের জীবনচেতনার সমান্তরাল। উপরন্তু দেবযানী লৌকিক জীবনসুখের প্রত্যাশী মানবী। তবে সামগ্রিকার্থে ‘বিদায় অভিশাপ’ রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্ম চিন্তাচেতনার আদর্শে উদ্ভাসিত। কেননা তিনি লৌকিক জীবনের বদলে অতীন্দ্রিয় বা পারলৌকিক জীবনচেতনার জয় ঘোষণা করে নায়ক কচকে স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়েছেন। কচ মহাপুরুষের মর্যাদায় মহিমান্বিত হয়েছে; তবে তার লৌকিক জীবনের ট্র্যাজেডি কাব্যিক নাটকীয়তায় পাঠকের হৃদয়-মন করুণরসে বিগলিত হয়ে ওঠে। কেননা কর্তব্য পালনার্থে স্বর্গধামে কচ ফিরে যাচ্ছে বটে, কিন্তু মর্ত্যলোকে ছেড়ে যাওয়া প্রিয়তমা দেবযানীর জন্য তার হৃদয়ের হাহাকার কারুণ্যে ও মর্মযাতনায় পূর্ণ। কচ অন্তর দিয়ে দেবযানীর বিরহ-যাতনা উপলব্ধি করেছে। আর এজন্য পৌরাণিক সত্যের বদলে আধুনিক জীবনচেতনার অনুগামী কচ অভিশাপের পরিবর্তে প্রিয়তমা দেবযানীকে বর দিয়েছে। নাট্যঘটনায় কর্তব্য প্রধান হয়ে উঠলেও সার্বিক বিচারে বিদায় অভিশাপ ইহজাগতিক তথা বাস্তবজীবনের প্রেমের জয় হয়েছে।
খ. ৬
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান্ধারীর আবেদন কবিতানাট্যের কাহিনীও মহাভারতের কাহিনী থেকে সংগ্রহ করেছেন। পুরাণের কাহিনী গ্রহণ করলেও কবি তাঁর নিজস্ব সৃজনী-প্রতিভায় সেই কাহিনীকে স্বতন্ত্র আঙ্গিক-কৌশলে উপস্থাপন করেছেন। এই নাট্যকাহিনীতে মানবধর্মের জয় ঘোষিত হয়েছে। পরিকল্পিত পাশাখেলায় পাণ্ডবেরা হেরেছে, রাজসভায় তাদের স্ত্রী দ্রৌপদীর শ্লীলতাহানি ঘটেছে এবং জুয়ার শর্তানুযায়ী পাণ্ডবগণ যখন বনবাসে যাত্রা করেছে, তখন রাজমাতা গান্ধারী-পুত্র দুর্যোধনের কুকীর্তির জন্য তাকে পরিত্যাগের জন্য রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যে আবেদন জানিয়েছে তা-ই এই নাট্যকবিতার বিষয়বস্তু। নিত্য মানবধর্মের পূজারিণী গান্ধারী পুত্র দুর্যোধনের অন্যায়-কুকর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে সত্যিকার মানবধর্মের মহিমা ঘোষণা করেছেন। অবশ্য রাজমাতা গান্ধারীর আশংকাও ছিল, হয়তো পুত্রের এই অপকর্মের কারণে কুরুবংশের পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। তবে ধৃতরাষ্ট্রের নিকট গান্ধারী তার পুত্রকে ত্যাগ করার যে আবেদন জানিয়েছে তা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার পরিচায়ক।
গান্ধারীর আবেদন কবিতানাট্যে ধৃতরাষ্ট্র পুত্রস্নেহান্ধ এক ট্র্যাজেডির নায়ক। তার হৃদয় ত্রি-ধারায় বিভক্ত। একদিকে মানবধর্মের প্রতি নিষ্ঠা, অন্যদিকে পুত্রের প্রতি অগাধ স্নেহ-ভালবাসা, সর্বোপরি ব্যক্তিত্বের দৌর্বল্যে ধৃতরাষ্ট্র ত্রিধাবিভক্ত হয়েছেন। তার এই অন্তর-রহস্যের উন্মোচনে নাট্যঘটনা নাটকীয়তা বিবর্তিত হয়েছে। একদিকে পুত্রস্নেহ অন্যদিকে মানবধর্মের টানাপড়েনে ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত-
-ওরে, তোরা জয়বাদ্য বাজা।
জয়ধ্বজা তোল্ শূন্যে। আজি জয়োৎসবে
ন্যায় ধর্ম বন্ধু ভ্রাতা কেহ নাহি রবে-
না রবে বিদুর ভীষ্ম, না রবে সঞ্জয়,
নাহি রবে লোকনিন্দা লোকলজ্জা-ভয়,
কুরুবংশরাজলক্ষ্মী নাহি রবে আর-
শুধু রবে অন্ধ পিতা, অন্ধ পুত্র তার,
আর কালান্তক যম- শুধু পিতৃস্নেহ
আর বিধাতার শাপ, আর নহে কেহ।৩২
ধৃতরাষ্ট্রের এই অন্ধ পিতৃস্নেহের মর্মমূলে চরম আঘাত হেনে গান্ধারী দুর্যোধনকে ত্যাগ করে ধর্মরক্ষার আকুল আবেদন সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্রের মোহভঙ্গ হয়নি। তিনি পিতৃস্নেহের বশে ধর্মকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন এবং বিবেকের পরাজয়েও তার পৌরুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। নিজের ব্যর্থতার গ্লানিতে মূহ্যমান ধৃতরাষ্ট্র প্রিয়তমার সামনে মর্মবেদনায় উচ্চারণ করে,- ‘... ছিঁড়িতে পারি নে মোহডোর,/ ধর্মকথা শুধু আসি হানে সুকঠোর/ ব্যর্থ ব্যথা। পাপী পুত্র ত্যাজ্য বিধাতার,/ তাই তারে ত্যজিতে না পারি-/ ... তারি সাথে এক পাপে ঝাঁপ দিয়া পড়ি,/ এক বিনাশের তলে তলাইয়া মরি/ অকাতরে- অংশ লই তার দুর্গতির,/ অর্ধ ফল ভোগ করি তার দুর্মতির,/ সেই তো সান্ত্বনা মোর-।’৩৩ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের এ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তার ধর্মচেতনার পরিবর্তে মানবীয়তা প্রবলভাবে ধরা পড়েছে। কিন্তু গান্ধারী চরিত্রে মাতৃস্নেহ থাকলেও চরিত্রটি ধর্মে সমর্পিতা; এজন্য নাট্যকাহিনীতে ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষতবিক্ষত-রক্তাক্ত হৃদয়ের ইতিহাসই নাট্য-দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট রচনা করে। গান্ধারী শ্রদ্ধারপাত্র হলেও ধৃতরাষ্ট্রের পিতৃত্ব মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়।
গান্ধারীর আবেদন কবিতানাট্যে গান্ধারীর চরিত্র একদিকে সন্তানের প্রতি স্নেহ-করুণায় বিগলিত, স্বামীর প্রতি আনুগত্যধর্মে নিষ্ঠ, অপরদিকে শাশ্বত মানবধর্মের সংকটে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। গান্ধারীর মতো রাজা ধৃতরাষ্ট্রের অন্তরেও সন্তানের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা-মমতা এবং মানবধর্মের সংকট নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছে। তবে পুত্রস্নেহে অন্ধ পিতা ধৃতরাষ্ট্রের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব নাট্যঘটনায় পরিপূর্ণ প্রকাশ পায় নি। শুধুমাত্র গান্ধারীর মুখোমুখি হলেই ধৃতরাষ্ট্র পুত্রস্নেহ এবং ধর্মরক্ষার উভয় সংকটে নিপতিত হয়েছে। এর ফলে রাজা ধৃতরাষ্ট্র একবার পুত্রস্নেহে অধর্মাচারী দুর্যোধনের নিকট আর একবার নিত্যধর্মের জীবন্ত প্রতিমূর্তি গান্ধারীর নিকট পরাজয় বরণ করেছে। অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধন অথবা গান্ধারী কারো সামনেই দৃঢ়তায় দাঁড়াতে পারেন নি। গান্ধারীর হৃদয়েও পুত্রস্নেহ আছে, তবে সে অধর্মাচারী পুত্রের ওপর থেকে স্নেহের বাহুপাশ সরিয়ে নেয়, ধর্মরক্ষার তাগিদে। তার একদিকে মাতৃহৃদয়ের স্বভাবজাত স্নেহ-ভালোবাসা পুত্রের প্রতি উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, অন্যপক্ষে ধর্ম নস্যাৎকারী পুত্র দুর্যোধনের প্রতি ব্যক্তিসত্তা নিরপেক্ষ ঘৃণা। গান্ধারীর অন্তরের একপাশে লজ্জা, অন্যপাশে সীমাহীন দুঃখ; গান্ধারী এই উভয় সংকটে নিপতিত হয়েও শেষ-পর্যন্ত দৃপ্ত কণ্ঠে ধর্মরক্ষার কথাই ঘোষণা করেছে। কিন্তু গান্ধারীর মতো ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের শত্রু দুর্যোধন-বৈরী পাণ্ডবদের প্রতি আশীর্বাণী উচ্চারণ করতে পারেন নি। ফলে তার পরিণতি গান্ধারীর দৃপ্ত দ্বান্দ্বিকতার চেয়ে অধিকতর নাটকীয় হয়ে উঠেছে।
খ. ৭
সতী রবীন্দ্রনাথের সংহত শিল্পাঙ্গিকে রচিত কবিতানাট্য। এই কবিতানাট্যে তিনি নাট্যগুণকে অনেক বেশি সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন। এর কাহিনী রবীন্দ্রনাথ মারাঠীয় লোককাহিনী থেকে সংগ্রহ করেছেন।৩৪ এ নাট্যঘটনায় সমাজ এবং ব্যক্তিহৃদয়ের দ্বান্দ্বিক ঘাত-প্রতিঘাত, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নাটকীয়তায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। ‘সতী’তে বিনায়ক রাও’র মেয়ে অমাবাই’র সঙ্গে জীবাজির বিয়ের সম্বন্ধ হয়; জীবাজি বিয়ের জন্য যাত্রা করে এবং পথের মধ্যে বিজাপুর রাজ্যের মুসলিম সভাসদ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে বন্দী হয়। তারপর সেই মুসলিম সভাসদ বর সেজে বিনায়ক রাওয়ের মেয়ে অমাবাইকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে যায়। এদিকে বন্দী জীবাজি পরবর্তীতে ছাড়া পেয়ে ফিরে আসে। অতঃপর তারা মুসলিম দস্যুর এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। অথচ যার জন্য তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়, সেই অমাবাই ইতোমধ্যে অপহরণকারী মুসলমান দস্যুকে ভালোবেসে তার সন্তানের জননী হয়েছে।
হিন্দু পক্ষের সঙ্গে ঘোরতর এক যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হল এবং জীবাজি প্রাণ হারায়। এরপর অমাবাইকে মুসলমানদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়। মুসলমান-ঘরে থাকার অপরাধে শাস্ত্র-সম্মত তার পাপের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করা হয়; নদীর তীরে বসবাস এবং নিত্যদিন গঙ্গাস্নান করে শিবনাম জপ করা। এমতাবস্থায় বিনায়ক রাওয়ের প্রচলিত সমাজ-সংস্কারাচ্ছন্ন স্ত্রী রমাবাই নাট্যকাহিনীতে প্রবেশ করে সামাজিক সংস্কার ও অমাবাই’র সতীত্ব রক্ষার জন্য নিজের মেয়ের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তাকে বাগদত্তা স্বামী জীবাজির চিতায় পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করে। মেয়ের প্রতি মা’য়ের এই অমানবিক অন্যায় আদেশ পিতা বিনায়ক রাও সমর্থন না করায়, তাকে বন্দী করে রমাবাই এবং মেয়ে অমাবাইকে নিষ্ঠুরভাবে জীবাজির চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।
নাট্যকাহিনীতে বিনায়ক রাও চরিত্রের অন্তর্ঘাত এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব সুস্পষ্ট। কন্যার অপহরণকারী মুসলিম দস্যুকে ধর্ম রক্ষার খাতিরে তথা প্রতিশোধস্পৃহায় হত্যা করেছে, কিন্তু কন্যাকে চিতার আগুনে জ্বলতে দিতে তার মন সায় দেয় নি। একদিকে ধর্মরক্ষার্থে কন্যার স্বামীকে হত্যা, অন্যদিকে পিতৃস্নেহের দ্বন্দ্বে বিনায়ক চরিত্রে মূলত মানবিক সত্যধর্মের জয় প্রকাশ পেয়েছে। উপরন্তু কন্যাকে তার মা কর্তৃক হত্যা পরিকল্পনা দেখে বিনায়ক রাও মেয়েকে উদ্দেশ্যে বলেছে, ‘যাও বৎসে, যাও ফিরে/ তব পুত্র-কাছে, তব শোকতপ্ত নীড়ে।/ দারুণ কর্তব্য মোর নিঃশেষ করিয়া/ করেছি পালন- যাও তুমি। ... অন্তরের যোগসূত্র ছিঁড়েছে যখন/ ... যাও, বৎসে, চলে/ যাও তব গৃহকর্মে ফিরে- যাও তব/ স্নেহপ্রীতিজড়িত সংসারে, অভিনব/ ধর্মক্ষেত্রমাঝে।৩৫ এতো কিছুর পরে প্রিয়তমা কন্যার জীবন বিনায়ক রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। রমাবাই সংকল্পে অবিচল। সে ধর্ম এবং সামজ-সংস্কার রক্ষার তাগিদে স্বামীকেও বন্দী করেছে। রমাবাই চরিত্রটিও অনমনীয় এবং দৃঢ়চেতা। সে তার সংকল্প থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হয় নি। ধর্মের খাতিরে সে কন্যাকেও ছাড় দেয় না। গান্ধারী যেখানে মানবধর্মের কাছে পুত্রস্নেহ বিসর্জন দেয়, রমাবাই সেখানে সমাজধর্ম তথা প্রথাগত ধর্মের নিকট সত্যধর্মের প্রতীক কন্যা অমাবাইকে বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না।
অমাবাই-এর চরিত্র সরল, একরৈখিক। সে অপহৃত হওয়া সত্ত্বেও যবন স্বামীকে ভালোবেসে পতিসেবা করেছে, মনেপ্রাণে তাকেই স্বামীরূপে গ্রহণ করেছে। অপহরণের দায়ে সে যবন স্বামীকে অভিযুক্ত করে নি কিংবা তার প্রতি কোনোরূপ ঘৃণা প্রকাশ করে নি। বরং প্রায়শ্চিত্তের প্রশ্নে অমাবাই পিতা-মাতা তথা সমাজকে প্রকৃত মানবধর্ম বোঝাতে চেয়েছে। সমাজধর্মের যূপকাষ্ঠে বলি হওয়া অমাবাই জীবাজির চিতাকে পরপুরুষের চিতা হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিধাতার নিকট সত্যের উদ্বোধন কামনা করেছে। মা’য়ের দৃঢ় সমাজ-সংস্কারের মুখে অমাবাই’য়ের দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে- ‘উচ্চ বিপ্রকুলে জন্মি তবুও যবনে/ ঘৃণা করি নাই আমি, কায়বাক্যে মনে/ পুজিয়াছি পতি বলি; মোরে করে ঘৃণা/ এমন কে সতী আছে? নহি আমি হীনা/ জননী তোমার চেয়ে- হবে মোর গতি/ সতীস্বর্গলোকে।’৩৬ অমাবাই’য়ের এই বলিষ্ঠ উচ্চারণে মানবধর্মের জয় ঘোষিত হয়েছে এবং তার জীবনচেতনা আধুনিক মানুষের জীবনচেতনার সমার্থক হয়ে উঠেছে। অমাবাই প্রকৃত মানবধর্মের অনুগ বলে, নিজের কৃতকর্মের জন্য বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করে নি; বরং তার নিষ্পাপ দৃঢ়চেতা অনমনীয় মনোভঙ্গি তাকে মানবিক দীপ্তিতে উজ্জ্বল করে তুলেছে।
সতী রচনাটিতে নাটকীয় সম্ভাবনা পিতা বিনায়ক রাও’য়ের চরিত্রের অন্তর্গত দ্বন্দ্বের মধ্যে বিকশিত হয়েছে। তার একদিকে সমাজধর্ম ও চিরায়ত ধর্ম-সংস্কার, অন্যদিকে পিতৃহৃদয়ের স্বভাবগত দৌর্বল্য; এই দুইয়ের ঘাত-প্রতিঘাতে বিনায়ক রাও’য়ের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। চির-সংস্কারান্ধ রমাবাই অবশেষে বিনায়ক রাও’য়ের এই অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছে। মা হয়েও রমাবাই লোক-দেখান সমাজধর্মের খাতিরে নিজের কন্যাকে পরপুরুষের চিতায় পুড়িয়ে হত্যা করে মেয়ের সতীত্ব এবং প্রচলিত ধর্মের ধ্বজা উড়িয়েছে। সতীতে একদিকে পিতার রক্তাক্ত হৃদয়, অন্যদিকে মা’য়ের ধর্মরক্ষার কঠিন পণ নাট্যঘটনায় টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
খ. ৮
রবীন্দ্রনাথের নরকবাস কবিতানাট্যও পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত। মহাভারতের কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে রচিত নরকবাস আধুনিক জীবনচেতনায় বিকশিত হয়েছে। এর কাহিনী সরলরৈখিক। সোমক রাজার পুত্রলাভের ঘটনা এর মূল বিষয়বস্তু। শতপুত্র লাভের আশায় শিশুপুত্রকে যাজকের কথায় হত্যাজনিত যে পাপ সংঘটিত হয়েছে, তজ্জনিত যাজক এবং রাজার যে নরকযন্ত্রণা তা নাট্যঘটনায় ব্যক্ত হয়েছে। সোমক রাজা শত পুত্রলাভের আশায় যজ্ঞানুষ্ঠানে নিষ্পাপ অবুঝ শিশুপুত্রকে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে নিক্ষেপ করে রাজধর্ম-পিতৃধর্ম বিসর্জন দিয়ে সারাজীবন বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়েছেন। কেননা রাজার ধর্ম প্রজাদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান, শিশুদের রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ক্ষাত্র-অহংকারে সোমক রাজা মানবধর্ম উপেক্ষা করে পরবর্তীতে যে মর্মদাহবোধ করেছেন তা তার নরকযন্ত্রণা ভোগের সমার্থক। রাজার ক্ষত্রিয়ধর্মের অহংকার চূর্ণ হওয়ার পর তার উপলব্ধিজ্জ ‘রথ যাও লয়ে/ দেবদূত! নাহি যাব বৈকুণ্ঠ-আলয়ে।/ তব সাথে মোর গতি নরকমাঝারে/ হে ব্রাহ্মণ! মত্ত হয়ে ক্ষাত্র-অহংকারে/ নিজ কর্তব্যের ত্র“টি করিতে ক্ষালন/ নিষ্পাপ শিশুরে মোর করেছি অর্পণ/ হুতাশনে, পিতা হয়ে। ... এখনো সে তাপ/ অন্তরে দিতেছে দাগি নিত্য অভিশাপ।’৩৭ সোমক তার অপরাধের শাস্তিস্বরূপ শাস্ত্রধর্মের একান্ত অনুগত ঋত্বিকের সঙ্গে নরকবাস করতে প্রস্তুত হয়েছেন। শিশু হত্যাজনিত অপরাধের জন্য নরকবাসেও ঋত্বিকের মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। কেননা সে যান্ত্রিক নিয়মে শুধু ধর্মাচার পালন করে। নরকবাস-এর ঋত্বিকের সঙ্গে বিসর্জন-এর রঘুপতি চরিত্রের সাদৃশ্য আছে। তবে রঘুপতি ধর্মাচার ছাড়াও ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তা করে; কিন্তু ঋত্বিক নৈর্ব্যক্তিকভাবে শুধু ধর্মাচার পালন করেছে। এ কবিতানাট্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই, সোমকের ক্ষাত্রধর্মের অহংকার চূর্ণ হয়ে, পিতৃস্নেহের স্ফূরণ আছে মাত্র। তাছাড়া সর্বত্রই ধর্মানুভূতির একান্ত তাগাদায় নাট্যকাহিনী বিকশিত হয়েছে।
খ. ৯
কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ কবিতানাট্যটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উচ্চাঙ্গের কাব্যগুণ সমৃদ্ধ রচনা। এর কাহিনী পৌরাণিক, তবে কবি স্বীকরণের মাধ্যমে উচ্চমাত্রার কাব্যাদর্শে নাট্যকাহিনী নিজের করে তুলেছেন। কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ-এ চরিত্র সৃষ্টিতে এবং কাব্যনাট্যের বৈশিষ্ট্যানুসরণে চরিত্রের মানসচিত্র উপস্থাপনে কবি মনোযোগী হয়েছেন। এর প্রধান চরিত্র নিয়তির নিষ্ঠুরতায় নিমজ্জিত রক্তেমাংসে গড়া মানুষ কর্ণ। তার জীবন যেন ‘দৈবায়ত্তং কূলে জন্ম, মদায়ত্তম্ হি পৌরুষম্’। কর্ণ যেন প্রতিনিয়ত জীবনের প্রতিকূল অবস্থায় দাঁড়িয়ে নিয়তি নির্ধারিত অভিশাপের পাপ মোচন করে চলেছে। সে পাণ্ডবগণের পাশা খেলার সভায় দ্রৌপদী সম্পর্কে কটূক্তি করেছিল, কিন্তু পরমুহূর্তে নিজের কৃত-অপরাধের জন্য অনুতাপও করেছে। তবে তার অভিশপ্ত জীবনের একমাত্র সাথী দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করতে পারে নি। দুর্যোধনের পথ পাপের জেনেও সেই অন্যায়ের স্রোতেই অনিবার্য পরিণতির অপেক্ষায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সে জেনেছে, দুর্যোধনের অন্যায়ের পরিণাম ভয়ানক এবং ভবিষ্যতে ধ্বংস অনিবার্য। কর্ণের দূরদর্শী এই জ্ঞান এবং দুর্যোধনের পক্ষ ত্যাগ করতে না পারার মানসিক যন্ত্রণায় তার হৃদয় রক্তাক্ত হয়েছে। নাট্যকাহিনীতে চরিত্রের অন্তর্দহন জটিলতম হয়ে উঠেছে। নিয়তির নির্ধারিত পরিণামের কথা জেনেও কর্ণকে কর্তব্যকর্মে নিষ্ঠ থেকেছে।
কর্ণের জীবনের করুণ কাহিনী মূলত কুন্তীর মাতৃস্নেহ এবং নিজের কর্তব্যবোধের মধ্যে নিহিত। কর্ণ ছোটবেলায় পরমুখে মাতৃ-পরিত্যক্ত হওয়ার কথা শ্রুত হয়েছিল; অথচ সেই মাতৃমূর্তি কল্পনায় এঁকে মাতৃস্নেহ লাভের প্রত্যাশায় কর্ণ উন্মুখ থেকেছে। কর্ণ যখন মা’য়ের পরিচয় জেনেছে; তখন সে মা’য়ের স্নেহ পাওয়ার আকাক্সক্ষায় জগৎ-সংসার ভুলে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার ভাবকল্পনার জগৎ এবং বাস্তবতার নিষ্ঠুর বৈপরীত্য তাকে আহত করেছে। সে কর্তব্যকর্ম উপেক্ষা করতে পারে না বলেই মাতৃস্নেহ লাভের লোভ সংবরণ করতে বাধ্য হয়েছে। এজন্যই বেদনাহত কর্ণের উচ্চারণ- ‘মাতঃ, সূতপুত্র আমি, রাধা মোর মাতা,/ তার চেয়ে নাহি মোর অধিক গৌরব।/ পাণ্ডব পাণ্ডব থাক্, কৌরব কৌরব-/ ঈর্ষা নাহি করি কারে।’৩৮
জন্ম-পরিচয় জানার পর, কর্ণের জীবন সম্বন্ধে বিতৃষ্ণা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। কর্ণের জন্মরহস্য উদ্ঘাটিত হওয়ার পর, সে জীবনকে আরো চরমভাবে নর্ঞ্থক ও ব্যর্থ মনে করেছে। তাকে নৈরাশ্য, কান্তি, বিমর্ষতা গ্রাস করে ফেলেছে। এজন্য কর্ণ বলে, ‘সিংহাসন! যে ফিরালো মাতৃস্নেহপাশ-/ তাহারে দিতেছ, মাতঃ, রাজ্যের আশ্বাস।/ একদিন যে সম্পদে করেছ বঞ্চিত/ সে আর ফিরায়ে দেওয়া তব সাধ্যাতীত।’৩৯ অতএব কর্ণ সগৌরবে নিয়তির নিষ্ঠুর ট্র্যাজিক পরিণতিকেই সাদরে গ্রহণ করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে মাতা কুন্তীর উদ্দেশ্যে বলে-
যে পক্ষের পরাজয়
সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান।
জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান-
আমি রব নিষ্ফলের, হতাশের দলে।
জন্মরাত্রে ফেলে গেছ মোরে ধরাতলে
নামহীন, গৃহহীন- আজিও তেমনি
আমারে নির্মমচিত্তে তেয়াগো জননী
দীপ্তিহীন কীর্তিহীন পরাভব-’পরে।
শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে
জয়লোভে যশোলোভে রাজ্যলোভে, অয়ি,
বীরের সদ্গতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।৪০
রবীন্দ্রনাথ এ নাট্যকাহিনীতে কর্ণ-কুন্তীর সাক্ষাৎ পর্বটি অত্যন্ত নাট্যঘন পরিবেশে উপস্থান করতে সক্ষম হয়েছেন। যুদ্ধের পূর্বরাতে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-প্রস্তুতিতে কর্ণ যখন চিন্তামগ্ন, এমন সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে কুন্তী তাকে আত্ম-পরিচয় দিয়ে যুদ্ধে বিরত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কুন্তীর এই পরামর্শ নাট্যকাহিনীতে ঈষরসধী সৃষ্টি করেছে। তবে মহাভারতের কর্ণের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের কর্ণ চরিত্র নাট্যঘটনার চরম সংকটময় পরিস্থিতিতেও স্থিরচিত্ত, শান্ত ও উদার। মহাভারতের কাহিনীতে কুন্তী পাণ্ডবদের রক্ষায় অধিক মনোযোগী, কিন্তু এখানে কর্ণের প্রতি তার মাতৃস্নেহাতিশয্য পরিলক্ষিত। এখানেও কুন্তীর ধর্ম-কর্তব্য আছে, তবে মাতৃহৃদয়ের হাহাকারই অধিকতর প্রাধান্য লাভ করেছে। সন্তানস্নেহে উদ্বেলিত কুন্তীর কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়,- ‘পুত্র মোর, ওরে/ বিধাতার অধিকার লয়ে এই ক্রোড়ে/ এসেছিলি এক দিন- সেই অধিকারে/ আয় ফিরে সগৌরবে, আয় নির্বিচারে-/ সকল ভ্রাতার মাঝে মাতৃ-অঙ্কে মম/ লহ আপনার স্থান।’৪১ অতীতের ঘটনা মাতৃরূপী কুন্তীর মর্মযন্ত্রণাকে আরো করুণ এবং দারুণ নাটকীয় করে তুলেছে। এই মমতাময়ী স্নেহময়ী মাতার যন্ত্রণাবিদ্ধ হৃদয়ের আর্তি-
হে বৎস, ভর্ৎসনা তোর শতবজ্রসম
বিদীর্ণ করিয়া দিক এ হৃদয় মম
শত খণ্ড করি। ত্যাগ করেছিনু তোরে
সেই অভিশাপে পঞ্চপুত্র বক্ষে ক’রে
তবু মোর চিত্ত পুত্রহীন- তবু হায়,
তোরি লাগি বিশ্বমাঝে বাহু মোর ধায়,
খুঁজিয়া বেড়ায় তোরে। বঞ্চিত যে ছেলে
তারি তরে চিত্ত মোর দীপ্ত দীপ জ্বেলে
আপনারে দগ্ধ করি করিছে আরতি
বিশ্বদেবতার।৪২
কুন্তী একদিন সামাজিক লোক-লজ্জার ভয়ে যে সন্তানকে ত্যাগ করেছিল, সে আজ তারই অন্য সন্তানদের বিরুদ্ধে ঘোরতর সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ায় তাদেরকে রক্ষার জন্য এবং ধর্ম রক্ষার জন্য কর্ণের কাছে আত্ম-পরিচয় ব্যক্ত করে মাতৃস্নেহের বাহু প্রসারিত করেছে; কিন্তু কর্তব্য সচেতন ও প্রকৃত বীরধর্মে দীক্ষিত কর্ণ স্বপক্ষ ত্যাগ করতে পারে নি। সে কাপুরুষের মতো আশ্রয়দাতার কৃতজ্ঞতা ভুলে যায় নি, বরং দৃঢ় মনোবলে নিয়তির নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হয়ে মানবধর্মকে উচ্চকিত করে তুলেছে। নাট্যঘটনায় কর্ণের যে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মানস-দ্বন্দ্ব তা চরিত্রটিকে মহিমান্বিত করেছে। একদিকে তার কর্তব্য-কর্ম এবং অন্যদিকে মাতৃস্নেহ লাভের প্রত্যাশা; এই দ্বি-ঘাত দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণে কর্ণের অন্তর্লোক উন্মোচিত হয়। রবীন্দ্রনাথের কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ কবিতানাট্যে গীতিকবিতার আতিশয্য বর্জিত হলে এটি সার্থক কাব্যনাটকের মর্যাদায় উন্নীত হতে পারত। নাট্যকাহিনী গীতিকবিতার প্রবল উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ায় কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ’র নাট্যগুণ খর্ব হয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও এই কবিতানাট্যটি রবীন্দ্রনাথের অধিকতর সার্থক কাব্যনাট্য রচনার প্রয়াস হিসেবে গণ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই নাট্যকবিতাগুলোর মধ্যে নাটক হিসেবে কর্ণ-কুন্তী সংবাদ-ই সর্বাধিক সফল। এর নাট্যকাহিনীতে কর্ণ-কুন্তী চরিত্রের মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত কাব্যময় ভাষায় ফুটে উঠেছে। কর্ণের হৃদয়ে একদিকে পালিতা মা রাধার প্রতি স্বাভাবিক মমত্ব ও কর্তব্যবোধ তথা আশ্রয়দাতা দুর্যোধনের প্রতি কর্ণের বীরত্ব ধর্মের আনুগত্য অন্যদিকে কিছুদিন আগে পরিচয় পাওয়া গর্ভধারিণী মা ও ভাইদের প্রতি একাত্মচেতনার দ্বন্দ্ব কাব্যনাট্যের বৈশিষ্ট্যানুগ। কর্ণের বীরধর্মে নিষ্ঠা এবং কুন্তীর মাতৃহৃদয়ের টানাপড়েনে কুরুক্ষেত্রের রণনীতির পটভূমিতে কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ-এর নাটকীয় দ্বন্দ্ব স্পষ্টভাবে প্রকাশিত। কুরুক্ষেত্রের ভয়ংকর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত পুত্র কর্ণের নিকট মাতা কুন্তীর আগমন সম্পর্কে সমালোচক যথার্থই বলেন-
কুন্তী যে কর্ণের কাছে আত্মপরিচয় দিয়া আপন প্রার্থনা জানাইতে গিয়াছিলেন তাহা যে শুধু মাতৃধর্মের প্রেরণায়ই নয়, পাণ্ডবদের বিজয় কামনার স্বার্থপ্রেরণাও তাহার মধ্যে ছিল এই ইঙ্গিতও নাট্যাভাস লাভ করিয়াছে কুন্তীর ভূমিকায়, এবং এই স্বার্থলোভের ইঙ্গিতই কর্ণের চিত্তকে বিমুখ করিয়া বীরধর্মে তাহাকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখিয়াছে।৪৩
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কাহিনী কাব্যগ্রন্থে ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ (১৩০৪) নামক আরো একটি কবিতানাট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এই কাবিতানাট্যের বিষয় হাস্যরস ও কৌতুকাবহ। জীবনের কোনো গভীর উপলব্ধির সন্ধান এখানে নেই। গান্ধারীর আবেদন এবং কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ নাটকের কাহিনী রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের নির্বাচিত অংশ থেকে গ্রহণ করেছেন; কিন্তু নরকবসে-এর কাহিনী পৌরাণিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সতী নাট্যকবিতার কাহিনী মারঠীয় গাথা কাহিনী থেকে চয়নকৃত। এই কবিতানাট্যগুলোতে রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।৪৪ গান্ধারীর আবেদন কবিতানাট্যে দুর্যোধনের রাজধর্মের পেশীবলে গান্ধারীর মানবধর্মের পরাজয় ঘটেছে। সতীতে অমাবাইকে তার সত্য, স্বামী-সন্তানকে সামাজিক ধর্মাচারের নিকট পরাজিত হতে হয়েছে। নরকবাস-এ সোমক রাজা পিতৃধর্মকে ক্ষাত্রধর্মের অহংকারে বিসর্জন দিয়ে নিত্য মর্মযাতনা ভোগ করেছে। কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ কবিতানাট্যে সমাজধর্মের ভয়ে মাতৃধর্ম বিসর্জন দিয়েছে। আর তাই পরবর্তীতে কর্ণের বীরধর্মের কাছে কুন্তীর মাতৃধর্মের আকুতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত। কিন্তু এসব পরাজয়, অবমাননার মধ্যদিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতপক্ষে মানবধর্মের বিজয় ঘোষণা করেছেন।৪৫ চিত্রাঙ্গদা, বিদায় অভিশাপ, গান্ধারীর আবেদন, সতী, নরকবাস, কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ রচনাকালে বাংলা সাহিত্যের কাব্যনাটকে আধুনিকতার স্পর্শ লাগে নি; এ সময় কাব্যনাটক নিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত ছিল মাত্র। তবে এ সকল কবিতায় লেখা নাটকের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতই আধুনিক জীবনকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন। তিনি পৌরাণিক ঘটনা অবলম্বনে এসব কবিতানাট্যে নতুন জীবনবোধের জয়গান করেছেন। উপরন্তু এসব রচনায় আধুনিক কাব্যনাটকেরও অনেক বৈশিষ্ট্য তিনি আত্মীকরণ করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে এসব রচনায় কবিতার উচ্ছ্বাস প্রবলতর বলে নাটক জমে ওঠে নি।
খ. ১০
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তীকালে গদ্য-সংলাপাত্মক যে নাটক লিখেছিলেন, তার অনেকগুলোই আধুনিক কাব্যনাট্যের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার যোগ্য। এগুলোর মধ্যে শারদোৎসব (১৯০৮), রাজা (১৯১০), ডাকঘর (১৯১২), মুক্তধারা (১৯২২), রক্তকরবী (১৯২৬) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এগুলো কাব্যনাট্যের লক্ষণাক্রান্ত সফল কাব্যময় গদ্য-সংলাপাত্মক নাটক। ‘সিঙ প্রমুখ নাট্যকারদের গদ্যনাটক যে-অর্থে কাব্যনাটক, ঠিক সেই অর্থে এসব নাটকে গদ্যভাষা কবিতার চরম সীমাকে স্পর্শ করে যথার্থ কাব্যধর্মী হয়ে উঠেছে, কারণটি শুধু সেখানেই নয়। এই কাব্যধর্মেই গড়ে উঠেছে নাটকের দেহও। অর্থাৎ, সমগ্র নাটকেই অনুস্যূত হয়ে আছে এই কাব্যময়তা।’৪৬ কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে নাট্যসংলাপে ছন্দময় কাব্যভাষা ব্যবহার করাই একমাত্র দিক নয়; বরং এটা বহুলাংশে নাট্যগঠন কৌশলের ওপর নির্ভরশীল। পাশ্চাত্য সাহিত্যে এলিয়টের গদ্য-সংলাপাত্মক Murder in the Cathedral প্রকাশিত হওয়ার আগেই প্রাচ্যের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ এসব গদ্যনাটকের গঠনকৌশলে সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় রচিত নাটকে নাট্যগুণের চেয়ে কাব্যের সুস্পষ্ট প্রধান্য ছিল, কবিতা সেখানে সংলাপের বাহন মাত্র। কিন্ত পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত গদ্যনাটকের বক্তব্য, পরিবেশ পরিকল্পনা, নাট্যঘটনার যথাযথ সংস্থান, সর্বোপরি গদ্যভঙ্গিতে কাব্যধর্মী-সংলাপ, রচনাগুলোকে আধুনিক কাব্যনাটকের সমগোত্রীয় করে তুলেছে। এসব নাটকের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ মঞ্চ পরিকল্পনার দায় সচেতনতার সঙ্গে পালন করেছেন। মুক্তধারা এবং রক্তকরবী নাটকে শ্রমিকশ্রেণী এবং সাধারণ মানুষের নবজাগৃতির যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় নাট্যপরিবেশ পরিকল্পিত হয়েছে তা পরিণতিতে কাব্যময় এই সমান্তরালে ডাকঘর, এবং রাজা নাটকের পরিণাম আধুনিক কাব্যনাটকের সমপর্যায়ভুক্ত। কাব্যাঙ্গিকে নাট্যকাহিনীকে বিন্যস্ত করে মানবজীবনে যে অন্তর-রহস্য উন্মোচনের প্রয়াস তা ডাকঘর ও রাজা নাটকে অধিক সাফল্য লাভ করেছে। কেননা ডাকঘর এবং রাজা নাটকে স্পষ্টভাবে অন্তর্চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
রাজা নাটকে রানী সুদর্শনার সাথে কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজার বাল্যকালে বিয়ে হয়েছিল। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে রানী সুদর্শনা কখনো রাজাকে দেখে নি; এই বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে নাট্যকাহিনী স্ফীত হয়েছে। বিয়ের পর রানী যেমন রাজাকে চোখে দেখে নি, তেমনি রাজাকে মঞ্চেও দেখা যায় না। অন্ধকার ঘরে রাজা-রানীর মিলন হয়েছে। সেই অন্ধকারে সুদর্শনা কখনোই রাজাকে দেখতে পায় নি, তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করেছে মাত্র। একদিন সুদর্শনার দাসী সুরঙ্গমা রাণীকে জিজ্ঞাসা করে, রাজা দেখতে কেমন? এরপর থেকেই রাজাকে দেখার প্রবল বাসনা সুদর্শনার হৃদয়ে জেগে ওঠে। শেষ-পর্যন্ত তার পীড়াপীড়িতে রাজা বসন্ত-উৎসবে তাকে দেখা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই উৎসবে কাঞ্চীরাজ সুবর্ণের রূপ দেখে রানী সুদর্শনা তাকেই রাজা ভেবে মহাবিভ্রম ঘটায়। সুবর্ণকে রাজা হিসেবে গ্রহণ করার মধ্যদিয়ে সুদর্শনার বাহ্যরূপের প্রতি প্রবল তৃষ্ণা ব্যক্ত হয়েছে। সুদর্শনার এই বাহ্যরূপের মোহ ঘুচে যায়, যখন সংকটের কালে রাজার ছদ্মবেশী সুবর্ণ রানীকে একা ফেলে পালিয়ে যায়। বিপদের মধ্যে রানীকে রক্ষা না করে সুবর্ণের পলায়নে সুদর্শনা তাকে রাজা ভেবে যে ভুল করেছিল, তা বুঝতে পারে এবং লজ্জায় নিজেকে ধিক্কার দেয়। তারপর প্রকৃত ও কুৎসিত রাজা রানীকে জ্বলন্ত আগুনের ভেতর থেকে রক্ষা করে। সেই আগুনের আভায় সুদর্শনা রাজার ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা দেখে ফেলে এবং সংজ্ঞা হারায়। এরপর সুদর্শনা রাজাকে ত্যাগ করে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে। পরিণতিতে সুদর্শনার রূপের মোহ ভঙ্গ হয় এবং রাজার প্রকৃত ভালোবাসার বা হৃদয়-সৌন্দর্যের জয় হয়। সুদর্শনা শেষ-পর্যন্ত ‘কালোতেই’ রানীর হৃদয়ের সৌন্দর্য পিপাসা মেটে এবং সে সত্যিকার ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। এ নাটকে জীবাত্মা এবং পরমাত্মার আধ্যাত্মবাদী চিন্তাচেতানার আরো একটি দিকও নিহিত। কেননা রাজা নাটক সম্বন্ধে এক মন্তব্যে রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন, Õthe 'inner drama' of 'human soul'.৪৭
শারদোৎসব নাটকটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির প্রতিশোধ কাব্যনাটকের প্রায় চব্বিশ বছর পরে শান্তিনিকেতনের ‘ঋতু-উৎসব’ অনুষ্ঠানের জন্য রচনা করেন। ঋতুর রূপ-রস ছাড়াও এই নাটকের মধ্যদিয়ে নাট্যকার একটি বিশেষ তত্ত্বের জাল বুনেছেন। তিনি নাটকে ‘ঋণশোধ’ তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানব অন্তরের সম্মিলনে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের পারস্পরিক ঋণ দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি উপস্থাপনে প্রয়াসী হয়েছেন। এই নাটকের চরিত্রগুলোর মধ্যে নাটকীয়তার বদলে তত্ত্ব প্রচার প্রাধান্য লাভ করেছে। শারদোৎসব নাট্যের উপনন্দ, বিজয়াদিত্য, সন্ন্যাসী, ঠাকুরদাদা সকলেই ঋণ পরিশোধ করছে। রাজা প্রেম-প্রীতি-প্রজাবাৎসল্যে এবং শেখর কাব্য প্রতিভায় এবং ঠাকুরদাদা সংসার ত্যাগ করে সবার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে ঋণ শোধ করেছে। নাটকে একমাত্র লক্ষেশ্বর স্বার্থবুদ্ধিতে নিপতিত, তার মতোই অবস্থা রাজা সোমপালের। সে ঈর্ষাজনিত কারণে রাজঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। লক্ষেশ্বর এই ‘ঋণশোধ’ তত্ত্বের বাইরের চরিত্র বলে, সে তার হৃদয়ের আনন্দধারা সকলের সাথে ভাগ করে নিতে পারে নি। মূলত সে সংসারজ্ঞান সম্পন্ন স্বার্থপর, অর্থলিপ্সু কুটিল চরিত্রের মানুষ।
শারদোৎসব নাটক প্রসঙ্গে একটা বিষয় স্মরণীয় যে, এই নাটকটির মাধ্যমে প্রথমে রবীন্দ্র-নাট্যের টাইপ চরিত্র ঠাকুরদাদা চরিত্রের প্রাথমিক পরিচয় মেলে। এই ঠাকুরদাদা চরিত্র রবীন্দ্রনাথের সব নাটকেই একই ভাবাদর্শের ধারক-বাহক। ঠাকুরদাদা সংসারত্যাগী পরোপকারী নিবেদিত মানুষ। মূলত সে-ই রবীন্দ্রনাথের ভাবজীবনের ও দার্শনিক চেতনার আদর্শ-চরিত্র। রাজা উপনন্দ শারদোৎসব নাটকে দুঃখ-বেদনা-আনন্দ ও মুক্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এই নাটকে ‘ঋণশোধ’ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, মানুষের জীবনে মুক্তির সুবাতাস দুঃখ-বেদনা ও নানা ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যদিয়ে আসে। বলা বাহুল্য কাব্যনাটক হিসেবে শারদোৎসব নাটকের সার্থকতা নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না; বরং রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য কাব্যনাট্য প্রয়াসের চেয়েও এর সার্থকতা নগণ্য। তবে ধারাবাহিক কাব্যনাট্য যাত্রায় ও রবীন্দ্র-নাট্যের উত্তরণের শারদোৎসব গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
ডাকঘর রবীন্দ্রনাথের অসচেতন গদ্য-সংলাপাত্মক কাব্যনাট্য সমপর্যায়ের রচনা। সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল নাটকীয় গুণ সম্পন্ন নাটক।৪৮ এর কাহিনী ছোট, তবে অসাধারণ নাট্যগুণে সমন্বিত এই স্বল্পায়তনের কাহিনী পাঠকের মনে স্থায়ী দাগ কেটে যায়। ‘এই গীতধর্মী নাট্যবস্তু আমাদের ভাবলোকে এক অনুভূতপূর্ব আলোড়ন তোলে, এই অনুভূতি ও কল্পনার আলোড়নে কবির সংকেত একটি রাগিণীর মতো আনন্দ বেদনায় আমাদের চেতনায় মুদ্রিত হয়।’৪৯ ডাকঘর নাটকের প্রধান চরিত্র রুগ্ন অসহায় বালক অমল। বাইরের প্রকৃতি-জগৎ সম্বন্ধে তার অদম্য কৌতূহল। অমলের প্রবল দেখার বাসনা এবং শেষে তার করুণ পরিণতি এ নাটকের এককেন্দ্রিক ক্ষুুদ্রায়তন ব্যাপ্তি। পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপে পিষ্ট হয়ে অমলের শিশু মনের যে করুণ পরিণতি ঘটেছে, তা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। সে অসীম আনন্দময়-সত্তা বিশ্বপ্রকৃতির সাথে মিলিত হওয়ার বাসনায় ব্যাকুল আকাক্সক্ষা পোষণ করেছে। কিন্তু তার দুরারোগ্য ব্যাধি সেই মিলনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শারীরিকভাবে দুর্বল অমলের মিলনাকাক্সক্ষা সফলতা পায় নি, শেষ-পর্যন্ত সে অসহায়ের মতো নিষ্ঠুর নিয়তির নিকট আত্মসমর্পণ করেছে।
একনিষ্ঠ সংসারী মাধব দত্ত সন্তানহীন, তাই সে অমলকে দত্তক নিয়েছিল। কিন্তু অমল অসুস্থ হওয়ায়, মাধব দত্ত দুর্ভাবনায় পড়ে এবং কবিরাজের পরামর্শে অমলকে ঘরে বদ্ধ করে রাখে। রুগ্ন-দুর্বল হলেও শিশু অমলের মনপ্রাণ দূরের পাহাড় পেরিয়ে নীল আকাশ এবং গ্রামের মানুষজন দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। অথচ তার বাইরে যাওয়া নিষেধ। তাই সে জানালার পাশে বসে দই-ওয়ালাকে ডেকে তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করে বন্ধুত্ব স্থাপন করে এমনকি বাইরের প্রহরীকে ডেকে নিয়ে তার সাথে গল্প করে। শশী মালিনীর মেয়ে সুধাকে ডেকে, তার কাছ থেকে ফুল নেয়ার গল্প করে। এদের সকলের সাথে বন্ধুত্বের সূত্রে অমল মূলত বাইরের পৃথিবীর খোঁজ-খবর শুনতে চায়।
রাজার চিঠির জন্য অমলের নিরন্তর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা এবং সহসা একদিন রাজার নিকট থেকে সেই কাক্সিক্ষত চিঠি আসার মধ্যে ডাকঘর-এ নাটকের নাটকীয়তা ফুটে উঠেছে। তাছাড়া মৃত্যুর পূর্ব-মুহূর্তে সত্যিসত্যি রাজার আগমনে সেই নাটকীয়তা চরম উৎকণ্ঠায় রূপ নিয়েছে। তবে দইওয়ালার পরিচিত কণ্ঠ শোনার জন্য অসুস্থ অমলের উৎকণ্ঠা নিয়ে দিনভর জানালার পাশে অপেক্ষা এবং সুধার আগমনের অপেক্ষা ডাকঘর’র নাটকীয়তাকে অধিকতর মহিমান্বিত করেছে।
অমলদের বাড়ির নিকটে রাজার ডাকঘর স্থাপিত হওয়ার খবর শুনে শিশু অমল রাজার চিঠি পাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। ঠাকুরদাদাকে সে চিঠির কথা জিজ্ঞেস করলে- সে বলে রাজার চিঠি রওয়ানা হয়েছে, শীঘ্রই অমলের কাছে এসে পৌঁছাবে। অমল রাজার চিঠি পাবে, এই খবর শুনে গ্রামের মোড়ল মাধব দত্তের বাড়িতে উপযাচক হয়ে উপস্থিত হয়। মোড়ল এক টুকরো কাগজ নিজে লিখে, অমলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাজার চিঠি বলে পরিহাস করে। মোড়লের এই পরিহাসে ঠাকুরদাদা অমলকে জানায় এ পরিহাস নয়, রাজা সত্যিই তাকে দেখতে আসবেন এবং সঙ্গে করে তার চিকিৎসার জন্য রাজ-কবিরাজ নিয়ে আসবেন। কিন্তু রাজা যখন রাত দুপুরে এলো, তখন অমল এ পৃথিবীর সকলকে বিদায় জানিয়ে, অসীম সত্তায় লীন হয়েছে। অমলের এই মৃত্যুতে পাঠকের হৃদয় অশ্রুবিগলিত, বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়। নিঃসন্তান সংসার জ্ঞানসম্পন্ন মাধব দত্তের অন্তরেও সন্তান হারাবার বেদনা জেগে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য নাটকের মতো ডাকঘর নাটকেও বিশেষ তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। ডাকঘর -এ সীমা-অসীমের মিলনতত্ত্ব অমল-রাজা প্রতীকে প্রকাশ পেয়েছে। তবে এই তাত্ত্বিক ঘটনা ছাড়াও এ নাটকের একটি বাহ্যাবয়ব পাওয়া যায়; যেখানে অমল, দইওয়ালা, মাধব দত্ত এবং সুধা চরিত্র নাটকীয়তায় বিকশিত হয়েছে। কাব্যনাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নাট্যঘটনায় চরিত্রের অন্তর্সত্যের প্রকাশ করা- ডাকঘর-এ কাব্যনাট্যের এই বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত; তা না-হলে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর গদ্য-সংলাপাত্মক সার্থক কাব্যনাটক হতে পারত। রবীন্দ্রনাথ ডাকঘরে নাট্যিক অন্তর্সত্য প্রকাশের পরিবর্তে রূপক-সাংকেতিক নাটকের বৈশিষ্ট্যানুসরণে চরিত্রগুলোর মধ্যদিয়ে পারলৌকিক নিগূঢ় জীবনসত্য প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
রক্তকরবী রবীন্দ্রনাথের পরিণত মানসের নাট্যপ্রয়াস। তাঁর এ নাটকের সংলাপও কাব্যময়-গদ্যে নির্মিত। নাটকের বিষয়বস্তুতে জড়বাদী যান্ত্রিক জীবনের যন্ত্রণা প্রকটিত হয়ে উঠেছে। তবে রক্তকরবী ও প্রকৃতির প্রতিশোধ নাট্যদ্বয় একই তত্ত্বচেতনায় উদ্বুদ্ধ।৫০ রক্তকরবী-র নাট্যকাহিনীতে পাওয়া যায়, যক্ষপুরীর মকররাজ পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ থেকে ধনরত্ন সংগ্রহে মত্ত। জাগতিক জীবনকে জয় করার প্রবল বাসনায় মকররাজ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ব্যবহার করে, তার সঞ্চয়ের পরিমাণ বড়িয়ে তুলছে। তার সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শক্তি, দম্ভও বৃদ্ধি পেয়েছে। মকররাজের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যে সকলই বস্তুবাদী জাগতিক সম্পদ আহরণের সাধনায় যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। সামগ্রিক অর্থে তার রাজ্যে মানবিকতার লোপ ঘটেছে। ফলে তার রাজ্যে মানবকল্যাণ, স্বতঃস্ফূর্ত প্রেমবোধ রহিত হয়েছে। অর্থাৎ মকররাজ এক দানবীয় এবং শোষক শক্তিরূপে মূর্তিমান ভয়ংকরতার নির্দেশকরূপে নাট্যঘটনায় উপস্থাপিত হয়েছে। বস্তুবাদী জীবনে বলীয়ান মকররাজ যেন মূর্তিমান দৈত্য-জীবনের নির্দেশক।৫১ তবে রাজা নিজেও জীবনের এই চরম নর্ঞ্থক পরিণতিতে সন্তুষ্ট নন, তার জীবনও মুক্তির-শান্তির পিপাসায় ব্যাগ্র-ব্যাকুল। তিনিও জীবনের প্রকৃত স্বরূপের অবিরল আনন্দ ধারায় অবগাহন করতে চান, জড়বাদী জীবনের নিরানন্দ ও ক্লান্তিকর কারাগার থেকে মুক্তি কামনা করেন। রাজার এই অবরুদ্ধ বস্তুবাদীবৃত্তে বন্দী জীবনে মুক্তির অবিরল স্রোতধারা নিয়ে নাট্যকাহিনীতে নন্দিনী প্রবেশ করে। নাট্যঘটনায় নন্দিনীর প্রবেশ প্রসঙ্গে সমালোচকের মন্তব্য স্মরণীয় :
রক্তকরবী নাটকের মধ্যে দুটো প্রতীক্ষা প্রথমাবধি ক্রিয়াশীল। কুশীলবদের মধ্যে নন্দিনী একটা প্রতীক্ষা প্রবলভাবে সঞ্চরিত করেছে : ‘আজ রঞ্জন আসবে।’ আর দর্শকমণ্ডলী আরেকটা প্রতীক্ষা করেছে এরই সঙ্গে, অন্ধকারের অন্তরালবর্তী রাজা বাইরে আসবে। দুটো প্রতীক্ষার দুই প্রতিক্রিয়া আশ্চর্য বন্ধনে সংবেশিত হয়েছে। রাজা অন্ধকারের আবরণ ভেঙে যখন আবির্ভূত হবেন তখন কী হবে তা আমরা কেউ জানি না। বরঞ্চ আশঙ্কিত উদ্বেগে এই ভেবে আমরা চঞ্চল যে বাঁধভাঙা বন্যাবারির ধ্বংসকে কী বেশে দেখব। এই অনির্দেশ্য ভবিতব্যতার কোলে একটি মাত্র মাধুর্যে আশ্বাস : রঞ্জন আসবে।৫২
এই একই প্রতীক্ষা রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর-এ রাজার চিঠির জন্য, সুধার প্রতিশ্র“তির জন্য অমলের প্রতীক্ষা নাট্যোৎসাহকে সজীব করে রেখেছে; অচলায়তন-এ গুরুর জন্য প্রতীক্ষা নাট্যকৌতূহল ধরে রাখে। রবীন্দ্রনাথের কবিমানসে পরম অনির্দেশ্যতার জন্য যে প্রতীক্ষা রয়েছে, তারই বহিঃপ্রকাশ ডাকঘর, অচলায়তন, রক্তকরবী নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে। ছকবাঁধা জীবনের অভ্যাসের বৃত্তাবদ্ধ আবহমণ্ডলের প্রতিক্রিয়ায় এই প্রতীক্ষার জন্ম এবং বৃত্তের বাইরে এসে মুক্তি। রাজার প্রত্যাশিত সকল কিছুর প্রকাশ ছিল নন্দিনীর মধ্যে। নন্দিনীর অপার সৌন্দর্য, প্রাণচাঞ্চল্য, সবই মকররাজ মনের গোপন গভীরে কামনা করেন, কিন্তু বাহ্যজীবনের জড়বাদী নিষ্ঠা এসবে সায় দেয় না। অর্থাৎ রাজার মধ্যে দ্বৈতসত্তা ক্রিয়াশীল; একটি বস্তুবাদী পশুসত্তা এবং এই পশুসত্তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী কোমল মানবসত্তা। এই দুই সত্তার প্রবল টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শেষ-পর্যন্ত তার মানবসত্তা জয়ী হয়েছে। রাজার এই জয়ে প্রকারন্তরে নন্দিনী-ই জয় লাভ করে। অবশেষে মকররাজ তার অস্বাভাবিক বন্দী-জীবন থেকে বাইরের আলো-বাতাসের স্বাভাবিক মানবীয় জীবনে বেরিয়ে এসেছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজস্ব প্রতিভাবলে বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্যে কাব্যনাট্যচর্চার অনেক আগেই কবিতা ও নাটকের সমন্বয়ে একধরনের নাট্য-নিরীক্ষা করেছিলেন, আধুনিক কাব্যনাটকের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যানুসরণে তাঁর এ রচনাগুলো কাব্যনাটকের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাঁর রচনাগুলোয় নাট্যধর্মিতার পরিবর্তে কাব্যের প্রাধান্য অধিকতর; ফলে তাঁর এ রচনাগুলো কাব্যনাট্যধর্মী বা নাট্যকবিতা হিসেবে গণ্য। তবে তাঁর এই নাট্যকবিতা রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে কাব্যনাট্যের ধারা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে আধুনিক কাব্যনাট্যের চর্চা হয়।
গ.
মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) কবি এবং সমালোচক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে সমধিক পরিচতি লাভ করেছিলেন। তিনি রাবীন্দ্রিক যুগে জন্মগ্রহণ করেও স্বীয় প্রতিভাবলে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। বাংলা কবিতার ইতিহাসে ‘তিরিশের যুগ’ নামে বিশেষভাবে চিহ্নিত কালের কবিগণও মোহিতলালের নিকট থেকে রবীন্দ্রবলয় ভাঙার প্রেরণা লাভ করেছিল।৫৩ সাহিত্যে নিবেদিত-প্রাণ মোহিতলাল মজুমদারের কবি হিসেবে কৃতিত্বের চেয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ-বিশ্লেষণধর্মী সাহিত্য-সমালোচনার কৃতিত্ব অনেক বেশি। তিনি ‘কল্লোল’, ‘কালি-কলম’ প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা লিখেছেন। এক সময় তিরিশের দশকের কবিদের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যের বিষয়-আঙ্গিক নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে; তবে তিনি তাঁর স্বাতন্ত্র্য কাব্য-বৈশিষ্ট্যেই দৃঢ় থেকেছেন। তাছাড়া তিরিশের যুগের আধুনিকতাকে তিনি মনেপ্রাণে গ্রহণও করতে পারেন নি।৫৪ তিনি জীবনের শেষ-পর্যায়ে সাহিত্য-সমালোচনায় অধিক মনোযোগী হয়েছিলেন। মোহিতলাল মজুমদারের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে- দেবেন্দ্র-মঙ্গল (১৯১২), স্বপন-পসারী (১৯২২), বিস্মরণী (১৯২৭), স্মর-গরল (১৯৩৬), হেমন্ত-গোধূলি (১৯৪১), রূপকথা (১৯৪৫), ছন্দ-চতুর্দশী (১৯৫১)। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, তিনি অনেক কবিতা রচনা করেলেও তাঁর সুনির্বাচিত কবিতাসমূহ মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপন-পসারী’, ‘বিস্মরণী’, ‘স্মর-গরল’ ও ‘হেমন্ত-গোধূলি’-তে প্রকাশ করেছিলেন।৫৫ ব্যক্তিজীবনে তিনি খানিকটা নৈরাশ্য-নৈঃসঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হলেও তাঁর কবিতায় এই নিঃসঙ্গতার প্রচ্ছায়া পড়ে নি; সাহিত্যাঙ্গনে তিনি অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী, বলিষ্ঠ, দৃঢ়চেতা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাজির হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী সময়ে মোহিতলাল মজুমদার বাংলা কাব্যনাটকের রাবীন্দ্রিক ধারাবাহিকতায় কয়েকটি কাব্যনাট্য-পর্যায়ের রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন, তবে সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি। বরং বলা অত্যুক্তি হয় না যে, তিনি রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাট্য-প্রয়াসের শিল্পগত মান অতিক্রম করতে কিংবা তাঁর সমপর্যায়ের শিল্পসুষমামণ্ডিত কাব্যনাটক রচনা করতেও ব্যর্থ হয়েছেন। তথাপি বাংলা কাব্যনাট্যের ধারাবাহিক আলোচনায় মোহিতলাল মজুমদারের অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁর রচিত কাব্যনাট্য-পর্যায়ের রচনাগুলো হচ্ছে- শেষ শয্যায় নূরজাহান (১৩২৮), নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর (১৩৩০), মৃত্যু ও নচিকেতা (১৩৩২) এবং দারার ছিন্ন মুণ্ডু ও আরংজীব।৫৬ তাঁর রচিত প্রথমোক্ত রচনা দুটি যথাক্রমে ‘স্বপন-পসারী’ এবং ‘বিস্মরণী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। শেষোক্ত দারার ছিন্ন মুণ্ডু ও আরংজীব তাঁর কাব্যসম্ভারের শেষে তিনি সংযুক্ত করেছেন, এটি কখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নি। মোহিতলালের কাব্যনাটক প্রসঙ্গে সমালোচক বলেন-
লিরিক প্রবণতার সঙ্গে মোহিতলালে মিশেছিলো নাট্যিক প্রবণতা। তাই তিনি একদিকে লিখেছেন ‘নাদির শাহের জাগরণ’, ‘নাদির শাহের শেষ’ (“স্বপন-পসারী”)-এর মতো তুলকালাম মনোনাট্য (dramatic monologue), আর-একদিকে শেষ শয্যায় নূরজাহান’, ‘নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর’, ‘মৃত্যু ও নচিকেতা’ (“বিস্মরণী”), দারার ছিন্নমুণ্ড ও আরংজীব (অগ্রন্থিত) প্রভৃতি কবিতানাট্য (Verse drama)। কোনো পূর্ণাঙ্গ কাব্যনাট্য লেখেন নি মোহিতলাল- এবং তাঁর চারটির মধ্যে তিনটি কবিতানাট্যই ইসলামের ইতিহাস থেকে সংকলিত। মনোনাট্য ও কবিতানাট্যে তিনি প্রয়োজনমতো আরবি-ফারসি শব্দ সুপ্রচুর ব্যবহার করেছেন।৫৭
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাব্যনাটক-পর্যায়ের রচনাগুলোর উৎস অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরাণভিত্তিক। মোহিতলালের কাব্যনাট্য-পর্যায়ের রচনাগুলোর উৎস মুসলিম ইতিহাস। তবে এর বাইরে মৃত্যু ও নচিকেতা শীর্ষক একটি কাব্যনাটক তিনি হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচনা করেছিলেন। তাঁর কাব্যনাট্য-প্রয়াসের অন্যতম প্রধান চরিত্র- মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান। শেষ শয্যায় নূরজাহান ও নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর রচনা দুটির কেন্দ্রীয় চরিত্র নূরজাহান। এছাড়া দারার ছিন্ন মুণ্ডু ও আরংজীব কাব্যনাটকের অন্যতম অবলম্বন আরংজীব চরিত্র।
কবি মোহিতলাল মজুমদার সর্বদা বিবৃতিধর্মী রচনায় উৎসাহী ছিলেন। তিনি ছোট কবিতা রচনা করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, দীর্ঘকবিতা রচনাতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে তিনি তত্ত্বকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন বলেই বিবৃতিধর্মী কবিতার প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কবিতায় এই তাত্ত্বিকতা প্রকাশ করতে মোহিতলাল নতুনতর আঙ্গিকের অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন; আর এই অনুসন্ধান প্রবণতা থেকেই তিনি বাংলায় কাব্যনাটক রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যনাটকের সংলাপ মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দে রচিত হওয়ায় এতে প্রচুর নাট্যগুণ বিদ্যমান। অথচ তিনি কাব্যনাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য চরিত্রের অন্তর্লোক প্রকাশের ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন উদাসীনতা, যে কারণে এগুলো কাব্যনাটক হিসেবে সার্থকতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। কেননা কাব্যনাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই চরিত্রের অন্তর্লোকের রহস্য উন্মোচন করা। এই বিবেচনায় তিনি কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অধিকতর ব্যর্থ হয়েছিলেন। ‘কাব্যনাট্যের সংক্ষিপ্ত পরিসরে অল্প সংখ্যক চরিত্রই যে স্বাভাবিক রবীন্দ্রনাথের মতো মোহিতলালও তা ঠিক বুঝেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি যথাযথ অনুধাবন করেছিলেন কাব্যনাট্য মূলত অন্তর্লোকের নাটক। আধুনিককালের কাব্যনাট্যের মতো লেখকের ব্যক্তিজীবনের আত্মানুসন্ধান বা আত্মোন্মোচন রবীন্দ্রনাথের মতো মোহিতলালেও ধরা পড়ে নি। দু’জনের দৃষ্টিই বহির্লোকে, অন্য চরিত্রের অন্তর্লোকই মাত্র নির্ধারিত। লেখক সেখানে দ্রষ্টা, নিজে সেই চরিত্রে বা ঘটনায় সংশ্লিষ্ট নন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বুঝেছিলেন কাব্যনাট্যে কবিতা ও নাটক একে অন্যের পরিপূরক কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সংলাপে শুধু কবিতা নয় কিংবা পদ্যরীতিতে রচিত নয় নাটক। মূলত কবিতা হলেও নাটকীয় তাৎপর্যগুলোকে নিপুণভাবে ব্যবহার এবং অন্তর্লোকবাহী করে তোলা কাব্যনাট্যের এই বৈশিষ্ট্য দাবী করে স্বাভাবিক সংলাপ। বিশুদ্ধ কবিতার ভাষা সে কারণে কাব্যনাটকে পঠন সীমার বাইরে বেরুতে দেয় না- অর্থাৎ মঞ্চে কোনো উপযোগিতা থাকে না তার। রবীন্দ্রনাথ অনেক কুশলী হয়েও এ ত্র“টির বাইরে বেরুতে পারেন নি, মোহিতলাল তো নয়ই।’৫৮
মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যনাট্য রচনার প্রাথমিক প্রয়াস দারার ছিন্ন মুণ্ডু ও আরংজীব। তাঁর এই রচনাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল আরংজীবের চরিত্র বিশ্লেষণ করা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩)-এর সাজাহান (১৯০৯) নাটকে আলমগীর চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা হয় নি এই অভিযোগ উত্থাপন করে তিনি নিজে সে-দায়ভার কাঁধে নিয়ে দারার ছিন্ন মুণ্ডু ও আরংজীব রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।৫৯ মোহিতলাল এখানে ভ্রাতৃঘাতক আরংজীবের চারিত্রের নিষ্ঠুরতাকে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করেছেন। আরংজীবের ধর্মের দোহাই যে নেহায়েৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকার একটা অজুহাত ছিল- তা তিনি স্পষ্টভাবে নাট্যঘটনায় তুলে ধরেছেন। আরংজীব তার নিষ্ঠুরতাকে খোদার আদেশ ও ধর্ম পালন হিসেবে বর্ণনা করলেও মূলত এই ঘটনার অন্তরালে তার চরিত্রের অপরিসীম ধূর্ততার পরিচয় তুলে ধরেছেন মোহিতলাল মজুমদার। তার আদেশে নাজির খাঁ দারাকে হত্যা করার পর, আরংজীব খোদার কাজে স্নেহ-ভালোবাসা ও জাগতিক মায়া-মমতা জয় করতে সক্ষম হয়েছে ভেবে যে তৃপ্তির শ্বাস ফেলেছে তা নিম্নরূপ-
... পিশাচের আছে মমতার প্রয়োজন।
সেই মমতায় করিয়াছি জয়। চাহি না দুনিয়াদারি-
কাফের-মুলুকে করিবারে চাই খোদার আদেশজারি!
স্নেহ-ভালবাসা- ফুলা-কলিজায় রক্তের কারখানা
চাহি নাই প্রভু! বান্দারে কভু করিও না মাস্তানা
তোমার নিমক-হারামী শরাবে; মাটির পেয়ালাখান
খোশবু’তে ভরি’ শয়তান যেন করে নাকো বেইমান।৬০
আরংজীব কাফের হত্যার যে আনন্দ প্রকাশ করে পরিতৃপ্তি লাভ করেছে, তার মধ্যে স্পষ্টতই রাষ্ট্রক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার ব্যাপারটি অন্তর্নিহিত ছিল, যা সহজেই অনুমিত হয়। আরংজীব ‘সত্যের তরে বাঁধিয়াছি বুক’, বলে ভ্রাতৃহত্যা শেষে যে ধর্মীয় পরহেজগারী প্রকাশ করেছে তার মাধ্যমে তার চরিত্রের কুটিলতা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান। নাজির খাঁকে শুধুমাত্র দারা-হত্যার আদেশ দিয়েই আরংজীব নিশ্চিন্ত নয়; হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হওয়ার পর নাজির খাঁকে দারার খণ্ডিত মস্তকের রক্ত ধুয়েমুছে সাফ করে তার সামনে নিয়ে আসতে বলেছে। তাকে আরো সতর্ক করে দেয়, যেন দারার খণ্ডিত মস্তকের দাঁড়িগোঁফ ঠিক থাকে কেননা সে চিরপরিচিত চিহ্নগুলো দেখে দারার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছে। দারার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর আরংজীব বলেছে, ‘আছে বটে, আছে। শাদার উপরে ছোট সেই কালো দাগ’। তার এই উক্তিতে অনুমিত হয়, দারা-হত্যা সম্বন্ধে তার উদ্বিগ্নতা বাহ্যিক এবং তা লোক-দেখানো ঘটনামাত্র। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও সাজাহান নাটকে আরংজীব চরিত্রটি নিষ্ঠুর, কূট-কুশলী হিসেবে নির্মাণ করেছেন। কিন্তু মোহিতলালের বিচারে সাজাহান নাটকে আরংজীব চরিত্রের প্রকৃত ধূর্ততা-শঠতা প্রকাশ পায় নি। এজন্যই তিনি আরংজীবকে আরো নিষ্ঠুর করে এই কবিতানাট্যে চিত্রায়িত করেছেন।
নূরজাহান চরিত্র সৃষ্টিতে দারার ছিন্ন মুণ্ডু ও আরংজীব কবিতানাট্যে মোহিতলালের কৃতিত্ব তাঁর পূর্বসূরীদের চেয়ে অধিকতর। ইতিহাসের চরিত্র সাহিত্যে যদি নতুনভাবে আবিষ্কৃত না হয়, তবে আর সাহিত্য কেন! আরংজীব চরিত্র সৃষ্টিতে মোহিতলাল সর্বাংশে সফল না হলেও নূরজাহান চরিত্র সৃষ্টিতে তিনি অনেক বেশি সফলতা দেখিয়েছেন। নাট্যঘটনায় এই নারী চরিত্রটির দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং এর সাথে ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে তার পতন সর্বোপরি তার নারীত্বের অসহায়ত্ব চিত্রায়নে মোহিতলালের সাহিত্যিক বিশেষত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
মোহিতলাল মজুমদারের নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর কবিতানাট্যের কাহিনী কাবুলের পথে বাদশাহী শিবিরে সংঘটিত হয়েছে। মহবৎ খাঁ সম্রাট জাহাঙ্গীরকে কাবুল যাত্রাপথে আক্রমণ করে এবং নূরজাহানসহ তাকে বন্দী করে। সম্রাটকে বন্দী করার পরও মহবৎ খাঁ নূরজাহানকে ভয় পেয়েছে, তাই সে কৌশলে সম্রাটকে দিয়ে পত্নীর (নূরজাহানের) প্রাণদণ্ডাদেশ স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। নূরজাহান তার প্রাণনাশের আদেশ পেয়েই জাহাঙ্গীরের নিকট ছুটে আসে। এখানে মনে রাখা দরকার, নূরজাহান বন্দী তথাপি মহবৎ খাঁ’র পক্ষে তার যথেচ্ছা গমনে বাধা কিংবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস হয় নি। এ ঘটনা থেকেই অনুমিত হয়, মোগল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্রাজ্ঞীর প্রভাব-প্রতিপত্তি-ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্ব কতটা দৃঢ় ছিল। নূরজাহানের বুদ্ধিমত্তা, দৃঢ়-মনোবল এবং কৌশলের কাছে অবশেষে মহবৎ খাঁ’র সব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর-এর নাট্যঘটনায় মোহিতলাল মজুমদার একদিকে দুর্বলচিত্তের সম্রাট জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিত্বের দৌর্বল্য, অন্যদিকে দৃঢ়চিত্তের অধিকারী নূরজাহানের ব্যক্তিত্বের সংঘাতকে নাট্যিক কৌশলে উপস্থাপন করেছেন।
মহবৎ খাঁ কৌশলে সম্রাট জাহাঙ্গীরকে নূরজাহানের রূপের মোহ ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধু করেছে। মহবৎ খাঁ একই সাথে নূরজাহানের হীনস্বার্থপরতার স্বরূপ সম্রাটের সামনে তুলে ধরে, তাকে দিয়ে নূরজাহানের প্রাণনাশের আদেশ জারি করিয়েছে। কেননা মহবৎ খাঁ তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, নূরজাহানের কারণেই সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও জাহাঙ্গীরকে জনমুখে অপবাদ শুনতে হয়। এজন্য সম্রাট নিজের অপবাদ ঘোচাতে মহবৎ খাঁ’র পরামর্শে নূরজাহানের প্রাণদণ্ডাদেশ-পত্রে স্বাক্ষর করেন। এখন সম্রাটের চোখে নূরজাহান হচ্ছে, সুন্দর শয়তান। অথচ নূরজাহান যখন সামনা-সামনি সম্রাটের নিকট তার প্রাণদণ্ডাদেশের কারণ জানতে আসে- তখন তাকে দেখামাত্র সম্রাট তার রূপে মোহিত হয়ে পড়েন এবং রূপের সেই অনলে ভস্মীভূত হয় এবং বলেন-
জোয়ানী সাবাস!- সেই কালো-চোখ কালো-জহরের ছুরী!
ছেঁড়া-কলিজার খুন-মাখা সেই ঠোঁটের গোলাব-কুঁড়ি!
এতকাল পরে এ-রূপ কোথায় ফিরে পেল আরবার?
আর, আর! - এই জান্খানা টেনে চিরদিন জেরবার!৬১
নূরজাহানের রূপের আগুনে অজ্ঞান এই পুরুষের পক্ষে তার প্রাণদণ্ডাজ্ঞা যে তুলে নিতেই হবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। সম্রাট জাহাঙ্গীর এমনিতেই নূরজাহানের রূপের অনলে পতঙ্গের ন্যায় পুড়ে মরছেন, তারপরও নারীর যত ছলাকলার অস্ত্র নূরজাহানের ভাণ্ডারে মজুত ছিল, তার সবই একে একে সম্রাটের ওপর প্রয়োগ করেছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর নূরজাহান সম্রাটের হৃদয়ে তার রূপের মোহময় মায়ার জাল বিস্তার করে সম্রাটকে জানায়-
ক. আজ এত দিনে একি পরিচয়!- বুকে এক, মুখে আর!
নূতন পীরের নূতন মুরিদ!- বাহবা, চমৎকার!৬২
খ. ঘরে নয়, আজ মশানে চলেছি!- কঙ্কণ-কিঙ্কিণী
খুলিয়াছি তাই,- জীবনে আব্র“", মরণে পর্দা নাই!-
দুনিয়ার শেষে কার কাছে লাজ?- ওড়্না পরিনি তাই।৬৩
গ. এত কাপুরুষ ছিল না সেলিম- মেহেরের মনোচোর!
হায় নারী, একি জীবনের ভ্রম!- এই কি পুরুষ তোর!৬৪
নূরজাহানের মান-অভিমান ও ছলাকলায় দুর্বল ও কোমল-হৃদয় জাহাঙ্গীরের মনে হয়েছে তিনি পরাজিত; লোক-মুখে প্রচারিত অপবাদ-ই তখন তাঁর কাছে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। দিল্লীর সম্রাট জাহাঙ্গীর তাই অসহায় আর্তনাদের সুরে উচ্চারণ করে-
ভয় করে, নারী, আজও ভয় করে! - চেয়ো না অমন করে’!
সেলিম মরেনি, মেহের মরিলে তবে ত যাইবে মরে’!
মেহের! তোমার মোহনী সুরত্!- পরীরাও ফিরে চায়!
আজও মনে হয়, সেই খুশ্রোজ ওই চোখে চমকায়!৬৫
সম্রাট জাহাঙ্গীরের এ সংলাপের মধ্য দিয়ে তাঁর হৃদয়ের দুর্বলতা বুদ্ধিমতী চতুরা নূরজাহান সহজেই অনুমান করে নেয়। নূরজাহানের অনুমান মিথ্যা নয়। সে স্পষ্ট অনুভব করে সে তার নারীত্বের অস্ত্র সফলভাবে জাহাঙ্গীরের রূপ-মোহগ্রস্ত হৃদয়ের ওপর ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। এ সময় নূরজাহান মানসিকভাবে সম্রাটকে আরো খানিকটা দুর্বল করে দেওয়ার জন্যই বলে-
মরিয়াও আমি মরিব কি সখা?- ঘুমাইতে পাব সুখে?
কবরে আমার ভাল করে’ দিও পাথর চাপায়ে বুকে!
যদি কোনদিন আবার কখনো নাম ধরে’ ডাক তায়-
মাটির মাঝারে মরা-দেহ উঠি’ বসিবে সে পুনরায়।৬৬
নূরজাহানের সঙ্গে এই দীর্ঘ আলাপচারিতায় জাহাঙ্গীরের মধ্যে উন্মাদ-প্রেমিক সেলিম-সত্তা পুনরায় জেগে উঠেছে, যে সেলিমের পক্ষে ভারতবর্ষের সম্রাটের সকল অহংকার-গৌরব মুহূর্তে ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। নূরজাহানের রূপের মোহে সেলিম করতে পারে না, এমন কোনো কাজ নেই পৃথিবীতে। রূপজ মোহে সম্রাট জাহাঙ্গীরের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। আর তাই দিল্লীশ্বর জাহাঙ্গীর নতজানু হয়ে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন মহবৎ খাঁর কাছে নূরজাহানের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য-
এত বে-দরদ!- কলিজায় দোল দেয় নাকি ওই বুকে?
এখনো দাঁড়ায়ে কি দেখিছ বীর? আরো কি বিচার চাও?
বলিও না কিছু- আর বলিও না!- ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও!
আদেশ নহে সে, মিনতি আমার!- কি ভাবিছ মহবৎ?৬৭
শেষ-পর্যন্ত নাট্যঘটনায় নূরজাহান তার মানস-কামনায় সাফল্য লাভ করেছে। এই বুদ্ধিমতী অথচ কূটকৌশলী রমণী এজন্যই স্বয়ং সম্রাটকে ছাপিয়ে ভারতবর্ষের একমাত্র কর্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে। এই প্রভাবশালী ক্ষমতাবান নারীও একদিন তার ক্ষমতার শীর্ষ হতে চ্যুত হয়েছে, আরেক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে। ঐতিহাসিক এই সত্যতাকে মোহিতলাল মজুমদার তাঁর পরবর্তী রচনা শেষ শয্যায় নূরজাহান কবিতানাট্যে ব্যক্ত করেছেন।
মোহিতলাল মজুমদার শেষ শয্যায় নূরজাহান কবিতানাট্যে যে নারীকে তুলে এনেছেন, সে রিক্ত-শূন্য এবং চরম অসহায়। এই নূরজাহান আত্মসমাহিত অবস্থায় তাঁর পূর্বের ক্ষমতা-গৌরবের স্মৃতিতে মগ্ন। এই স্মৃতিকাতর রমণীর মনে পড়েছে, তার প্রথম স্বামী-সন্তান এবং পরবর্তীকালে প্রথম স্বামীর হত্যা, স্বীয় সন্তানের মৃত্যু, প্রেমিক-সেলিম এবং সাম্রাজ্যের শাসন-ক্ষমতা, পরিশেষে সেলিমবিহীন এক রিক্তা, অসহায়া নারীর বাস্তবানুগ জীবনচিত্র এ নাট্যঘটনায় মোহিতলাল চিত্রিত করেছেন। শেষ শয্যায় নূরজাহান’র কাহিনী নূরজাহান ও তার সখি জোহরা দুটি চরিত্র মাধ্যমে নাট্যকার ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথম স্বামীর স্মৃতিতে মগ্ন, অসহায় এক রমণীর করুণচিত্র তার স্বগতোক্তির মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়-
আজ যে আমার সব ঘুচে গেছে- সব শোক-দুঃখ, সব বালাই!
এ-বিশ বছর যার ধ্যান করি, কাল তার দেখা পেয়েছি ভাই!
মাফ্ পেয়েছি যে-ছুটি আজ থেকে, হুকুম মিলেছে খোদা-তা’লার,
সকল যাতনা জুড়াইয়া গেছে, অবসান আজ সব জ্বালার!৬৮
নূরজাহান বিশ বছর পরেও প্রথম স্বামী শের আফগানকে ভুলতে পারে নি। সে একথাও জানে, তার কারণেই শের আফগানকে মরতে হয়েছে। এই পাপবোধ জীবনের অন্তিম মুহূর্তে তাকে আরো বেশি অসহায় করে তুলেছে। আজ বারবার তার চোখের সামনে প্রথম স্বামী শের আফগানের রক্তমাখা মুখ, নীরব চাউনি মনে কাঁটার মতো বেঁধে। কেননা এই নূরজাহান খুব ভালো করেই উপলব্ধি করেছে, সেদিনের মেহেরের (নূরজাহান) উচ্চাকাক্সক্ষাই শের আফগানের মৃত্যুর কারণ। নূরজাহানও অনেকটা শেক্সপীয়রের লেডি ম্যাকবেথের ন্যায় বারবার হাত থেকে রক্তের দাগ মোছার মতোই প্রথম স্বামীর হত্যা দৃশ্য ভুলতে চেয়েছে। নূরজাহানের এই মানসিক পরিণতির মূল উৎস হচ্ছে, পাপবোধ থেকে মুক্তির ব্যর্থ উপায়। যেমন-
তবু, দেহখান- যেখানে সে থাক্- তাঁর দেহ থেকে রবে না দূরে,
দেখিস্ তাঁহার কবরের ছায়া পড়িবে আমার বুকটি জুড়ে!’
ওরা যে বোঝে না, ভাবে- কত পাপ!- কত সে পিপাসা প্রেমের নামে!
শা’জাহান তাই বিচারে বসেছে, দিবে না আমারে শুইতে বামে!
আমি ত’ চাহি নি’ মর্মর-বাস-শাদা ধব্ধবে পাথরে গাঁথা!৬৯
নূরজাহানের এসব স্বগতোক্তির মাধ্যমে মোহিতলাল মজুমদার তার চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। একজন ক্ষমতাবান কূটকৌশলী রমণী জীবনের শেষপ্রান্তে যে অনুশোচনা ও পাপবোধে ভুগেছে তা সার্থকভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। নূরজাহান চরিত্রের অন্তর্গত যন্ত্রণা ও মর্মদাহ উপস্থাপন করাই শেষ শয্যায় নূরজাহান কবিতানাট্যের একমাত্র উদ্দেশ্য। এ কবিতানাট্যে মাত্র দুটি চরিত্র থাকলেও এর সংলাপ রচনায় মোহিতলাল মজুমদার কাব্যনাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য- অন্তর্গত সত্য উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন; ফলে শেষ শয্যায় নূরজাহান অনেকাংশে সার্থক কাব্যনাট্য হয়ে উঠেছে।
মোহিতলাল মজুমদারের অপর রচনা মৃত্যু ও নচিকেতা কবিতানাট্য পূরাণের কাহিনীনির্ভর। শেষ শয্যায় নূরজাহান’র মতো এ নাট্যকাহিনীও মাত্র দুটি চরিত্রের সাহায্যে তিনি বর্ণনায় প্রয়াসী। মৃত্যু ও নচিকেতা’য় নেপথ্যে পিতৃগণের মাত্র একটি গান সংযোজন করেছেন। তবে মোহিতলাল এ কবিতানাট্যের সংলাপ বিভাজন প্রক্রিয়া সুস্পষ্ট না করায়, নাট্যঘটনা বিকাশে বেশখানিকটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কেননা মৃত্যু ও নচিকেতা কবিতানাট্যের কোনটি কার সংলাপ, তা নির্দিষ্টকরণ অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।
এ নাট্যঘটনায় ঔদ্দালকি-পুত্র নচিকেতা বালক বয়সেই পিতৃসত্য পালনের জন্য যমালয়ে গমন করেছে। কিন্তু ঘটনাক্রমে নচিকেতা যে সময় যমালয়ে উপস্থিত হয়, ঐ সময় যম উপস্থিত না থাকায়- তাকে রাত্রে উপোস করতে হয়। যম প্রত্যাবর্তন করে যথারীতি অতিথির সৎকার করেন এবং নচিকেতাকে তার কাক্সিক্ষত বর প্রার্থনার অনুমতি প্রদান করেন। নচিকেতার মৃত্যু সম্পর্কিত প্রশ্ন মূলত মানব-মনের চিরন্তন রহস্যানুসন্ধানী প্রশ্ন। নচিকেতা মৃত্যু এবং যমের স্বরূপ জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। এই প্রশ্নে যম কিছুটা বিব্রত হয়ে নচিকেতাকে বলেন, মানুষের এ সম্পর্কে জানার অধিকার নেই। কিন্তু নচিকেতাও নাছোড়বান্দা; সে যমের নিকট অন্যকোন প্রার্থনাও করে না। তখন যম মানুষের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার সাথে মৃত্যুর তুলনা করে তার চেয়ে মৃত্যুর রূপ ভয়ংকর আখ্যা দেন; তবে নচিকেতা যমের এই তুলনামূলক বিচারে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। নচিকেতা তুলনা, সদৃশ্য, উপমা ইত্যাদি ব্যতিরেকে মৃত্যুর স্বরূপ জানতে চায় যমের নিকট। অথচ যম মানুষের মৃত্যুর প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করতে চান না। এর ফলে যম ও নচিকেতার মধ্যে এই বিষয়ে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। যম এজন্য নচিকেতার উদ্দেশে বলেন-
নচিকেতা! মৃত্যু নীল নহে, নাহি তার
বর্ণ-রূপ! জানো না কি, করে সে হরণ
নেত্র হ’তে সর্বশোভা?- সে যে অন্ধকার!৭০
নচিকেতা মৃত্যু সম্পর্কে যমের এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে-
এক নহে মৃত্যু আর মরণ-দেবতা।
মৃত্যু- সে যে সুনিশ্চিত দেহ পরিণাম,
তাহারি শাসনতরে দণ্ডধর তুমি,
মৃত্যু হয় কালে কালে, তুমি মহাকাল!
মনে তবু জাগে সদা সভয় ভাবনা,
তোমারেই স্মরে নর আয়ুঃশেষ-কালে।৭১
নচিকেতার উত্তর-প্রতিউত্তরে যম মুগ্ধ হয়ে তার স্বরূপ প্রকাশ করার সময় নচিকেতার অন্তরে দিব্যজ্ঞানরূপে যে আগুন অনুক্ষণ জ্বলছে, সেই অনলের প্রাণ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। যম স্বরূপে আত্ম-প্রকাশের পর নচিকেতার মৃত্যু সম্পর্কিত বিভ্রান্তির অবসান ঘটল। তাছাড়া এ নাট্যকাহিনী থেকে আরো জানা যায়, নচিকেতার মতো তত্ত্বজ্ঞানী সাধকের উপস্থিতিতে যমালয় ধন্য হয়েছে। তবে পাঠক যমের স্বরূপ প্রকাশের মধ্যদিয়ে মৃত্যু সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা লাভ করতে পারে না। বরং মৃত্যু সম্পর্কিত ধারণা যম-নচিকেতার কথোপকথনের মাধ্যমে উপস্থাপিত। তাত্ত্বিকতার জটাজাল থেকে মুক্তি পায় নি। অর্থাৎ মৃত্যু ও নচিকেতা রচনায় মোহিতলাল তাঁর ব্যক্তিগত দার্শনিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হলেও এর মাধ্যমে কাব্যনাটকের কোনো বৈশিষ্ট্যই আত্মস্থ করতে সক্ষম হন নি। ‘এমন গতিহীন, সংঘাতহীন ও উৎকণ্ঠাহীন রচনাকে কাব্যনাট্যের অন্তর্গত করাও কঠিন।’৭২ মোহিতলাল যথাসাধ্য চেষ্টা করেও মৃত্যু ও নচিকেতা রচনাটিকে কাব্যনাট্যের মর্যাদায় উন্নীত করতে পারেন নি। কাব্যনাটক হিসেবে এটি ব্যর্থ রচনা হলেও এটিও তাঁর একটি সার্থক কবিতানাট্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
মোহিতলাল মজুমদার তাঁর শেষ শয্যায় নূরজাহান, নূরজাহান ও জাহাঙ্গীর, মৃত্যু ও নচিকেতা এবং দারার ছিন্নমুণ্ডু ও আরংজীব প্রভৃতি রচনার মাধ্যমে কাব্যনাটক রচনার যে প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন তা সাফল্য লাভ না করলেও বাংলা কাব্যনাট্য রচনার ইতিহাসে কিছুটা ভিত্-নির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর দীর্ঘকবিতা রচনার মানস-প্রবণতা থেকে তিনি এই ধরনের কাব্যধর্মী নাট্য কিংবা কবিতানাট্য রচনায় আগ্রহী হয়েছিলেন। তিনি নতুন আঙ্গিককৌশল অনুসন্ধান করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর রচনায় কাব্যনাটকের অন্তর্গত সত্য উন্মোচনের ব্যাপারে তিনি সচেতন ছিলেন না। এজন্য তিনি সার্থক কাব্যনাটক রচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা কাব্যনাটকের যে-পথ নির্মাণ শুরু করেছিলেন, মোহিতলাল সেই ধারাবাহিকতাটুকু বজায় রেখেছেন মাত্র। সুতরাং মোহিতলালের রচনাগুলো বাংলা কাব্যনাটকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংযোজন নয়, তা সমালোচকের মন্তব্যে স্পষ্ট। সাহিত্যের ধারাবাহিক পরম্পরা রক্ষায় মোহিতলাল মজুমদারের এই কাব্যনাট্য প্রয়াসকে একেবারে ব্যর্থ হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। কেননা সাহিত্য সব-সময়ই ধারাবাহিক পরম্পরা রক্ষা করে চলে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মোহিতলাল মজুমদারের মতো আরো অনেক কবির ব্যর্থতার ওপর ভিত্তি করেই বাংলা সাহিত্যে প্রকৃত-অর্থে আধুনিক ও সার্থক কাব্যনাটকের জন্ম হয়েছে।
ঘ.
বাংলা কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে আধুনিককালের তিরিশের দশকের কবি জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) কাব্য-প্রতিভা সম্ভবত সর্বাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তাঁর কাব্য-প্রতিভাকে তিনি কাব্যনাটক রচনার কাজে ব্যয় করেন নি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বাংলা কাব্যনাটক সম্বন্ধে অমিত সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করলেও নিজে কাব্যনাটক রচনার ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করেছেন।৭৩ তিনি কাব্যনাটক সচেতনভাবে রচনা করেন নি ঠিক-ই কিন্তু তাঁর রচিত বেশকিছু দীর্ঘকবিতায় নাট্যগুণের সুসমন্বয় পরিলক্ষিত হয়। তাঁর এ ধরনের কবিতার মধ্যে ধূসর পাণ্ডলিপি (১৯৩৬) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘কয়েকটি লাইন’, ‘অনেক আকাশ’, ‘পরস্পর’, ‘অবসরের গান’, ‘জীবন’, ‘১৩৩৩’, ‘প্রেম’ ও ‘পিপাসার গান’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তাঁর শেষের দিকের রচনা ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘এইখানে সূর্যের’, ‘১৯৪৬-৪৭’ প্রভৃতি কবিতায়ও নাট্যগুণের লক্ষণ আভাসিত হয়েছে। তবে এসব কবিতা রচনার ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, কবির পক্ষ থেকে কাব্যনাট্য লেখার কোনো সচেতন প্রয়াস ছিল না।
জীবনানন্দ দাশের কনভেনশন৭৪ নামক কাব্যনাট্যধর্মী রচনাটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমকালে লিখেছিলেন। তাঁর এই রচনাটি ‘অনুক্ত’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। অবশ্য জীবনানন্দ দাশ পরবর্তীকালে এই রচনাটির পরিমার্জন-পরিবর্ধন করেছিলেন বটে তবে পৃথক গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন নি। কনভেনশন কবিতানাট্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মানবতার তথা মানব-সভ্যতার, সমাজের যে ভয়াবহ সংকটাপন্ন বাস্তবতা তা চিত্রিত হয়েছে। যেমন-
প্রথম বক্তা : এ যুগের- আমাদের এ যুগের
জন্ম হয়েছিল বটে শূকরের পেটে;
কলম ছেড়েছি তাই অসূয়ায়,
কেননা কড়্গের সাথে এঁটে
এখন কলম কাৎ র’বে ঢের দিন;৭৫
জীবনানন্দ দাশ কনভেনশন কবিতানাট্যে তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত প্রচলিত প্রকরণশৈলী অনুসরণ করেছেন। তাঁর কবিতায় যেমন শূকর-শূকরী সর্বাদাই জীবনের অশুভ-অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে; আবার অন্যদিকে হরিণ, বুনো হাঁস, শিশু প্রভৃতির জীবনের শুভ-মঙ্গল-কল্যাণের দ্যোতনাবাহী। কবি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখেছিলেন সেই প্রেক্ষাপটে কনভেনশন কবিতানাট্য রচনা করেছিলেন। এ কবিতানাট্যে তিনি তৎকালীন রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন- ‘খড়্গের সাথে এঁটে/ এখন কলম কাৎ র’বে ঢের দিন।’ সমকালীন রাষ্ট্রীয় বিশৃক্সক্ষল পরিস্থিতিতে অনুভূতিপ্রবণ কবিদের আত্মবোধের যে উন্মেষ ঘটেছিল সে-বিষয়ে কবি জীবনানন্দ দাশের এই মন্তব্য অনেকাংশেই ইয়েট্সের আদর্শের সমান্তরাল। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এই বিশৃক্সক্ষল পরিস্থিতিতে তিনি মনে করেন, কবিদের পক্ষে নীরবতাকেই শ্রেয়। তবে তিনি একথাও স্মরণ করিয়ে দেন- এই দীর্ঘ নিস্তব্ধতার পরে বেবুনদের হাতে চলে যাবে মনীষা। বলাবাহুল্য কনভেনশন-এ জীবনানন্দ দাশের এই ‘বেবুন’ নর্ঞ্থকতার দ্যোতক। কবিতানাট্যের প্রথম বক্তার সংলাপে এই নর্ঞ্থকতা ফুটে উঠেছে- ‘বেবুন ছাড়া কে উঠেছে মনীষীর জাতে?’ অর্থাৎ মানব-সভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে মেধাহীন তথাকথিত ‘মনীষা’র দল। একথা তৃতীয় বক্তার কথায় স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান-
তৃতীয় বক্তা : আমাদের চেয়ে ঢের হালুবালু ভাল জানে ব’লে
বেবুন চালাবে মাইক্রোফোন।৭৬
পঞ্চম বক্তা : যদিও পৃথিবী আজ (আমাদের) টেনে নেয় জঙ্গলের দিকে,
রেডিয়োও ব্যবহার ক’রে যায় বেবুনের ভাষা;৭৭
এসব বক্তব্যের মধ্যদিয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে, কবি এখানে ‘বেবুন’ শব্দটিকে তাঁর কবিতায় বহুল ব্যবহৃত অশুভ-অমঙ্গলের প্রতীক শূকর-শূকরীর সমার্থক হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। আর তাই চতুর্থ বক্তার সংলাপে আমরা শুনি,- ‘আজ তবু ভুল ক’রে দশজন নারী হত্যা ক’রে/ একজন দালালের ঋণ করে শোধ,/ যেন শুধু সরমাকে নগ্ন ক’রে সারমেয়দের/ চাঁদের আলোর নিচে সবচেয়ে বিখ্যাত আমোদ।’৭৮ আর এজন্যই সম্ভবত কবি এখানে মানব-সভ্যতার প্রাচীনকালের ইতিকথা স্মরণ করেন-
গরিলা বানাতে গিয়ে নিসর্গ যাদের
মানুষ বানাল প্রথমত-
কারণ, অনেক কাজে লিপ্ত থেকে ন্যুব্জ নিসর্গ
মাঝে মাঝে ভুলে যায় ইঞ্চি ইঞ্চি স্তর-
প্যারাসুট বেয়ে তারা নারী আর ধর্মযাজকের মতো নেমে
সূর্যের আলোর নিচে সবচেয়ে বিখ্যাত রগড়।৭৯
জীবনানন্দ দাশের এ বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে- সমকালের সভ্যতা মানুষকে ক্রমাগত নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যে মানুষ একদিন এই সভ্য-পৃথিবী গড়ে তুলেছিল তারাই পুনরায় অসভ্য হয়ে উঠছে। সমকালীন সভ্যতার এই ধ্বসে পড়া বাস্তবতায় কবি বিপন্ন-বিমর্ষ-বিপন্ন ও ক্লান্তিবোধ করেছেন কিন্তু জীবন সম্পর্কে কখনো সম্পূর্ণভাবে হতাশ হয়ে পড়েন নি। তিনি আশাবাদী, তবে তা নিজস্ব স্টাইলে এই আশাবাদিতার কথা শুনিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ মনের গোপন-গভীরে বিশ্বাসের যে চেরাগ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন তা থেকেই বিচ্ছুুরিত হয়েছে- এই ক্ষয়িষ্ণু সময়ের একদিন অবসান হবে এবং সুদিন ফিরে আসবেই।৮০
জীবনানন্দ দাশ কনভেনশন কবিতানাট্যে ছয়জন বক্তার সংলাপের মাধ্যমে সমকালীন সমাজ ও রাষ্টীয় সভ্যতাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ হেনেছেন। কনভেনশন-এ কাহিনী-বিস্তারের জন্য সংলাপ ব্যবহার করেছেন কবি। এবং সেই সংলাপের মধ্য দিয়ে চরিত্রের বিকাশও ঘটিয়েছেন, তবে এখানে কাব্যগুণের প্রাধান্য লক্ষণীয়। উপরন্তু কনভেনশন-এ নাট্যিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নেই বললেই চলে। কিন্তু নাটক বা কাব্যনাটকের ক্ষেত্রে নাট্যিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং নাটকীয়তা ছাড়া নিছক কোনো কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে তা নাটক কিংবা কাব্যনাটক কোনোটাই হতে পারে না। নাট্যিক সংঘাত না থাকলেও কনভেনশন-এর চরিত্রগুলোর অন্তর্লোকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয় ফুটিয়ে তোলার ওপরই জীবনানন্দ দাশ অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। কাব্যনাটকের এই অন্তর্গত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়টি থাকলেও এর কাহিনী বিকাশে কোনো ধারা-পরম্পরা বা চমৎকারিত্বও পরিলক্ষিত হয় না। সামগ্রিক বিচারে জীবনানন্দ দাশের কাব্যধর্মী কনভেনশন রচনাটিকে সার্থক কাব্যনাটক হিসেবে নয়; বরং এটিকে কাব্যনাট্য-পর্যায়ের সার্থক প্রয়াস বলা যায়। মূলত কনভেনশন-এ কাব্যময়তা অধিক, যা এর নাট্যগুণকে ছাপিয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে। অতএব জীবনানন্দ দাশের কনভেনশন শীর্ষক রচনাটিকে নাট্য-কবিতা বলাই শ্রেয়।
[চলবে]
তথ্যসূত্র ও টীকা :
১. মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন,
... কবিতা আর নাট্যকে মিলিয়েছিলেন তিনি ‘বীরাঙ্গনা’ নামক মনোনাট্যে। দেখে শুনে মনে হয়: মধুসূদনের হাতে প্রথম বাংলা আধুনিক কাব্যনাট্য অনিবার্য ছিলো। কিন্তু উন্মাতাল কবির হাতে সময় ছিল না আর। সেই সম্ভাবনা লীন হ’লো এক সদ্যসূচিত অসমাপ্ত কাব্যনাট্যে।
- আবদুল মান্নান সৈয়দ, দশদিগন্তের দ্রষ্টা, ১ম প্র, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৮০; পৃ. ১৬
২. নীলিমা ইব্রাহিম, বাংলা নাটক : উৎস ও ধারা, ১ম সং, ঢাকা : নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৭২; পৃ. ৩০১
৩. আবু সয়ীদ আইয়ুব, পথের শেষ কোথায়, ৪র্থ সং, কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯২; পৃ. ১০২
৪. মানবিক এই দুর্বলতা সম্পর্কে আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেন,
এইসব মানুষী দুর্বলতা কি তিনি ইতিপূর্বেই জয় ক’রে ফেলেননি? তাই তিনিও মেয়েটিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফিরে যেতে চান! কিন্তু কন্যাটি তাঁকে অনুসরণ করে, তাঁর সঙ্গ ছাড়তে চায় না। এইভাবেই সন্ন্যাসীর অন্তর্বিরোধের সূত্রপাত; উষ্ণ স্নেহ আর শীতল বৈরাগ্যে দুই বিপরীত বিন্দুর মধ্যে দোদুল্যমান হয় তাঁর চিত্ত। নাটকটির যা-কিছু নান্দনিক সৌন্দর্য তার উৎস এখানেই।
- আবু সয়ীদ আইয়ুব, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৪
৫. তদেব, পৃ. ১০৭
৬. প্রখ্যাত রবীন্দ্র-সাহিত্য বিশ্লেষক ও সমালোচক নীহাররঞ্জন রায় রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভূমিকা গ্রন্থে রাজা ও রাণী, বিসর্জন এবং মালিনী তিনটি রচনাকেই একত্রে ‘কাব্যনাট্য’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি রাজা ও রাণী-এর নাট্যগুণ অপেক্ষা গীতিকাব্য গুণের প্রাবল্যজনিত কারণে রচনাটির নাট্যসার্থকতা অনেকটাই দুর্বল মনে করেন।
- দ্রষ্টব্য: নীহাররঞ্জন রায়, রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভূমিকা, ৫ম সংস্করণ (পরিশোধিত), কলিকাতা : নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৬৯; পৃ. ২৫৯
৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড, রাজা ও রাণী), পুনর্মুদ্রণ, কলিকাতা : বিশ্বভারতী, ১৪০২; পৃ. ৫৯৬
৮. নীলিমা ইব্রাহিম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০৪
৯. ‘সমগ্র নাটকটিতে প্রায় সবগুলি চরিত্রই সুপরিস্ফুট, বিশেষ করিয়া বিক্রম ও সুমিত্রার, ইলা ও কুমারসেন, এবং বৃদ্ধ ভৃত্য শংকরের। ঐতিহাসিক আবেষ্টনটিও কোথাও অস্পষ্ট হইয়া পড়ে নাই। কিন্তু ইলা ও সুমিত্রার পরিচয় যতটা নিবিড় করিয়া আমরা পাই, এমন আর কাহারও নহে। একথা খুব সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের নাট্যে ও কাব্যে, গল্প ও উপন্যাসে নারী চরিত্র, নারী জীবনের রহস্য যেমন করিয়া ফুটিয়াছে, পুরুষচরিত্র তেমন করিয়া ফুটিবার অবসর পায় নাই।’
- নীহাররঞ্জন রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬৯
১০. আবু সয়ীদ আইয়ুব ‘বিসর্জন’ শব্দটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন,
‘বিসর্জন’ শব্দটিতে আত্ম-বিসর্জন এবং প্রতিমা-বিসর্জন দুই-ই বোঝায়। এ দুটি শব্দের যে তিনটি ভিন্ন-ভিন্ন অর্থ পাওয়া গেলো, ঐ-তিনটি অর্থই এই নাটকের তিনটি বিষয়। আমার বাংলা নামটিই বেশি পছন্দ। কারণ, যদিও পশুবলি নিয়ে এক বিরোধকে কেন্দ্র ক’রেই এই নাটকটি শুরু হয়, তবু অপ্রতিরোধ্য বেগে নাটক এগিয়ে চলে সেই বেদনাঘন পরিণতির দিকে যাতে ক’রে বিসর্জনের দ্বিতীয় অর্থটি পরিস্ফুট হ’য়ে ওঠে। প্রায় শেষ অংশে নাটকের নায়ক পুরোহিত রঘুপতি মন্দিরের কালীমূর্তিটি টেনে এনে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেন ক্রোধে ও ঘৃণায়। সাধারণত যে-শ্রদ্ধার সঙ্গে সুন্দরভাবে প্রতিমা-নিরঞ্জন হয় এই বিসর্জন সে-জাতীয় নয়।
- আবু সয়ীদ আইয়ুব, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৯
১১. নীলিমা ইব্রাহিম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০৪
১২. নীহাররঞ্জন রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৪
১৩. তদেব, পৃ. ২৫৯
১৪. নীলিমা ইব্রাহিম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০৬, ৩০৭
১৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড, বিসর্জন), পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৬০
১৬. তবেদ, পৃ. ৫৬২
১৭. ‘একদিন এল যখন আর একটা ধারা বন্যার মতো মনের মধ্যে নামল। কিছুদিন ধরে দিল তাকে প্লাবিত করে। ইংরেজি অলঙ্কারশাস্ত্রে এই শ্রেণীর ধারাকে বলে ন্যারেটিভ। অর্থাৎ কাহিনী। এর আনন্দবেগ থামতে চাইল না। আমার কাব্যভূগোলে আর একটা দ্বীপ তৈরি হয়ে উঠল। মনের সেই অবস্থায় কখনো কখনো কাহিনী বড়ো ধারায় উৎসারিত হয়ে নাট্যরূপ নিল। ... এই সময়ে আমার কাব্যে একটা মহল তৈরি হয়ে উঠেছে যার দৃশ্য জেগেছে ছবিতে, যার রস নেমেছে কাহিনীতে, যাতে রূপের আভাস দিয়েছে নাটকীয়তা।’
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড, কথা ও কাহিনী), পূর্বোক্ত, পৃ. সূচনা
১৮. নীহাররঞ্জন রায় কাহিনীর নাট্যকবিতাগুলো সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন,
... কাব্যমূল্য আছে বলিয়াই নাটকীয় গুণ ইহাদের নাই, একথা বলা চলে না বিশেষ ভাবে ‘গান্ধারীর আবেদন’ ও ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ সম্বন্ধে একথা কিছুতেই প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এই নাট্যকাব্যগুলি সম্বন্ধে সকলের চেয়ে বড় ও মূল্যবান কথা হইতেছে, নিত্য শাশ্বত মানবধর্মের অম্লান মহিমার প্রকাশ এবং দৃপ্ত নাটকীয় ভঙ্গিমায় এবং কাব্যের সুর-সুষমায় সেই মহিমার জয়গান। ...
এই ধরনের Reading drama রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যে প্রথম সৃষ্টি করিলেন। একথা সত্য যে “চিত্রাঙ্গদা” ও “বিদায় অভিশাপে”র মতন গীতিমাধুর্য এবং কাব্য-সুষমাই ইহাদের বৈশিষ্ট্য; কিন্তু তাহা হইলেও ‘গান্ধারীর আবেদন’, ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ এবং কতকাংশে ‘সতী’ নাট্যকাব্যটির মধ্যে নাটকীয় দ্বন্দ্ব এবং চরিত্র চিত্রণের নাটকীয় বৈশিষ্ট্য দৃপ্ত ভঙ্গিমায় আত্মপ্রকাশ করিয়াছে।
- নীহাররঞ্জন রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯৩, ২৯৪
১৯. ‘রবীন্দ্রনাথের সংলাপ-কাব্যের ছ’টি ‘চিত্রা’র- ‘বিদায় অভিশাপ’ ও ‘কাহিনী’র ‘গান্ধারীর আবেদন’, ‘সতী’, ‘নরকবাস’, ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ ও ‘কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ’-কে আমি কাব্যকলাকৃতির এই নতুন ফসল হিসাবে চিহ্নিত করতে চাই। নিশ্চিত ভাবেই কবির সাফল্য সর্বত্র তুল্যমূল্য নয়, কবিপ্রাণতার সঙ্গে আঙ্গিকগত নৈপুণ্য সর্বত্র জোড় মেলে নি কিন্তু উল্লিখিত ছ’টি রচনাই কবির নব উদ্ভাবিত কাব্য কলাকৃতির ফসল। সংলাপে কবিতা রচনা করতে কবির নব উদ্ভাবিত কাব্য কলাকৃতির ফসল। সংলাপে কবিতা রচনা করতে গিয়ে নাটকের অনিবার্যতা স্মরণ রেখেছিলেন কবি। কবিতাকে নাটকের মেলবন্ধনে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশনের স্পৃহা অন্তত কার্যকর হয়েছে এসব ক্ষেত্রে।’
- উত্তম দাশ, বাংলা কাব্যনাট্য, ১ম প্র, বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা : মহাদিগন্ত প্রকাশ সংস্থা, ১৯৮৯; পৃ. ২২
উত্তম দাশের মতো বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত ইতিহাস রচয়িতা ড. সুকুমার সেনও বিদায় অভিশাপ, গান্ধারীর আবেদন, সতী, নরকবাস, লক্ষ্মীর পরীক্ষা, কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ প্রভৃতি রচনাকে নাট্যকবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
- দ্রষ্টব্য : ড. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (তৃতীয় খণ্ড), ৭ম সং, ২য় মু, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৪০৩; পৃ. ১০৫
২০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাট্যকবিতা রচনার পূর্বে ইংরেজি সাহিত্যে রচিত কবি ইয়েট্সের কাব্যনাট্যের সঙ্গে পরিচিত হননি। সুতরাং একথা স্পষ্ট যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বীয় প্রতিভা-বলে বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিকগত বৈচিত্র্যানুসন্ধানে সদা তৎপর ছিলেন। তার-ই ধারাবাহিকতায় তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবিতানাট্যের জন্ম হয়েছে।
২১. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রবীন্দ্র-নাট্য-পরিক্রমা, পরিবর্ধিত ৪র্থ সং, কলিকাতা : ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৩৯৯; পৃ. ৪৬, ৪৭
২২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড, চিত্রাঙ্গদা), পূর্বোক্ত, পৃ. ২১৪, ২১৫
২৩. তদেব
২৪. তদেব
২৫. তদেব, পৃ. ২২৭, ২২৮
২৬. তদেব, পৃ. ২৪১
২৭. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬০
২৮. ড. কণিকা সাহা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৭
২৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড, বিদায় অভিশাপ), পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০৫
৩০. তদেব, পৃ. ৩০৮, ৩০৯
৩১. তদেব
৩২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড, গান্ধারীর আবেদন), পূর্বোক্ত, পৃ: ৮৩
৩৩. তদেব, পৃ. ৮৯
৩৪. সতী কবিতানাট্যের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন,
মিস ম্যানিং-সম্পাদিত ন্যশনাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পত্রিকায় মারাঠি গাথা সম্বন্ধে অ্যাকওঅর্থ সাহেব-রচিত প্রবন্ধবিশেষ হইতে বর্ণিত ঘটনা সংগৃহীত।’
- দ্রষ্টব্য : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড, সতী), পৃ. ১০৩
৩৫. তদেব, পৃ. ১০৭
৩৬. তদেব, পৃ. ১০৬
৩৭. তদেব, পৃ. ১১৪
৩৮. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড, কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ), পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৯
৩৯. তদেব, পৃ: ১৪৯, ১৫০
৪০. তদেব, পৃ. ১৫০
৪১. তদেব, পৃ. ১৪৭
৪২. তদেব, পৃ. ১৪৯
৪৩. নীহাররঞ্জন রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯৫
৪৪. রবীন্দ্রনাথের এই ধর্মচেতনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে নীহাররঞ্জন রায় বলেন,
এই চারটি নাট্যকাব্যেই রবীন্দ্রনাথের স্বকীয় ধর্মবোধ সবলে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। স্বকীয় ধর্মবোধই বা বলি কেন, ইহাই তদানীন্তন বাঙালী শিক্ষিত সমাজের সামাজিক ধর্মবোধ। এই সত্য শাশ্বত নিত্য ধর্মবোধই ঊনবিংশ শতাব্দীর মানস-প্রেরণা। ... এই মানবতার ধর্ম অতীতেও ছিল; য়ুরোপে ছিল, ভারতবর্ষেও ছিল, কিন্তু তাহার সম্বন্ধে সামাজিক চেতনা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের চিত্তে সামাজিক চেতনার জন্ম এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নিত্য শাশ্বত ধর্মবোধের জন্ম তাই কিছু আকস্মিক নয়। এই মানবতার ধর্ম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ এবং যুক্তিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত; এই যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ রবীন্দ্র-চিত্তকে গড়িয়াছে, রবীন্দ্র-কবিমানসকেও গড়িয়াছে। সেইজন্য রবীন্দ্র কবিমানসের অন্যতম বাণী হইতেছে যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সত্য শাশ্বত মানবধর্মের জয়গান। রাজধর্ম, ব্যবহারিক ধর্ম, সমাজধর্ম, লৌকিকধর্ম প্রভৃতি নানা কক্ষে মানুষ ধর্মকে ভাগ করিয়াছে; একধর্ম অন্য ধর্মকে স্বচ্ছন্দে অবমাননা করে, এবং তাহার ফলে মানবধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিমানস ক্ষুব্ধ, পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়। চেতনাবান কবি অথবা রূপকার, ধর্ম অথবা সমাজ-নায়ক সেই ক্ষোভ ও পরাজয়কেই এমন রূপে ও বর্ণে সমাজের সম্মুখে তুলিয়া ধরেন যে, তাহার বলে পরাজিত ও বিপর্যস্ত মানবধর্মই খণ্ডিত ধর্মবোধের উপর জয়ী হয়।
- নীহাররঞ্জন রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯৫, ২৯৬
৪৫. তদেব
৪৬. ড. কণিকা সাহা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬
৪৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩২ বঙ্গাব্দে ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকায় ‘রাজা নাটকের আলোচনা’ প্রসঙ্গে মন্তব্যটি করেছিলেন।
৪৮. ড. কণিকা সাহা ডাকঘর প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে, ডাকঘরে নাট্যদ্বন্দ্ব সৃষ্টির প্রচেষ্টা নেই বরং এতে কবির তীব্র হৃদয়াবেগ পরিচিত সংকীর্ণ পরিবেষ্টন থেকে মুক্তির পিপাসায় কাব্যের মোড়কে গদ্যভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। এর বাহ্যিক অবয়ব নাটকে’র হলেও তা কবিতার সূতোয় গেঁথে তোলা হয়েছে অর্থাৎ ভিতরের ‘ফ্রেম’টা কাব্যের আর তাকে ঘিরে রেখেছে নাট্যবেষ্টনী। ফলে ‘ডাকঘর’ নাট্যাঙ্গিকে রচিত ‘গদ্য-লিরিকে’ পরিণত হয়েছে।
- দ্রষ্টব্য : ড. কণিকা সাহা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৮
৪৯. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫১
৫০. সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় রক্তকরবী নাটকের তাত্বিক চেতনার সঙ্গে প্রকৃতির প্রতিশোধ-এর সাদৃশ্য উল্লেখ করে বলেছেন,
জগৎ-বিচ্ছিন্নতা ও তদুদ্ভূত দ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনে প্রথম প্রকাশ্যে দেখা দেয় তাঁর ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ কাব্যনাট্যে। অন্ধকার গুহায় অলৌকিক শক্তির সন্ধানী সন্ন্যাসীর স্বেচ্ছানির্বাসন এবং বালিকার সংস্পর্শে সেই জগৎ বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’-এর মূল বিষয়। বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণার বিষয়টি নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো বিচ্ছিন্নতার বোধ বা নৈঃসঙ্গ্যের বেদনা নায়কেরা অনুভব করেছে কোনো একটি চরিত্রের সংস্পর্শে এসে। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ ও ‘রক্তকরবী’তে এই নৈঃসঙ্গ্যবোধের উদ্দীপক চরিত্র দুটি হলো নারী। বালিকা এবং নন্দিনী। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’-এও দেখা যায় জগৎ-বিমুখ, গুহান্ধকারবাসী সন্ন্যাসীর নীরস নি®প্রাণতার পটভূমিতে কৃষকদের গোষ্ঠে যাবার গান ধ্বনিত হচ্ছে। ‘রক্তকরবী’তেও পৌষের ফসলকাটার গান যক্ষপুরীর অন্ধকার নি®প্রাণতায় মাঝে মাঝে শোনা গেছে। দুটি নাটকেই বিচ্ছিন্নতার মূল দেখানো হয়েছে একই জায়গায়। মানুষ আপনার প্রাপ্যের সীমাকে ছাড়িয়ে কোনো একটা বাসনাকে উদগ্র করে তোলে। সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে যেটা তত্ত্ববাসনা, কারো কারো কাছে সেটা ধনবাসনা, স্বর্ণবাসনা।
- সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘রক্তকরবীর পাঁপড়িগুলি’, প্রসঙ্গ : অনুষঙ্গ, ১ম প্র, কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ১৯৯০; পৃ. ৮৪
৫১. উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১৩
৫২. সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮৮
৫৩. তিরিশের যুগের কবিগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিগণ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ নামে খ্যাত। এই পঞ্চপাণ্ডব হচ্ছেন- কবি জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে এবং অমিয় চক্রবর্তী।
৫৪. আবদুল মান্নান সৈয়দ, বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা, ১ম প্র, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪; পৃ. ৫৩
৫৫. আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত, মোহিতলাল মজুমদারের নির্বাচিত কবিতা, ১ম প্র, ২য় মু, ঢাকা : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ১৯৯০; পৃ. ভূমিকা
৫৬. মোহিতলাল মজুমদার বঁড়িশায় বাস-কালে তাঁর কাছে শ্রীপ্রশান্তকুমার সরকার নামে একজন বি এ পরীক্ষার্থী পড়তে আসত। তিনি এ সময় তাকে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সাজাহান’ নাটকটি পড়াতেন। তাকে নাটকটি পড়াতে গিয়ে কবির মনে হয়েছিল এ নাটকে ‘আলমগীর-চরিত্র’ কিছুমাত্র ফুটে ওঠেনি। এর কিছুদিন পরে কবি হঠাৎ করেই ‘দারার ছিন্নমুণ্ড ও আরংজীব’ কবিতানাট্যটি রচনা করেন। ‘দারার ছিন্নমুণ্ড ও আরংজীব’ কবির মৃত্যুর কয়েক বছর পরে মাসিক ‘বসুমতী’তে ১৩৬০ সালে প্রকাশিত হয়।
- দ্রষ্টব্য : ভবতোষ দত্ত সম্পাদিত, ‘মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যসংগ্রহ’, ১ম প্র, কলকাতা : ভারবি, ১৯৯৭; পৃ. ৬০৮
৫৭. আবদুল মান্নান সৈয়দ, বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৭
৫৮. তদেব, পৃ: ৩৩
৫৯. মোহিতলাল মজুমদারের আরংজীব চরিত্রটি সম্বন্ধে উত্তম দাশ মন্তব্য করেছেন,
মোহিতলাল পারেন নি আরংজীব চরিত্রে নতূন মাত্রা যোজনা করতে, বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বসূত্র সামনে থাকা সত্ত্বেও। নূরজাহান চরিত্রটিকে কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের আদর্শ স্মরণে রেখে নতূন করে আবিষ্কার করলেন তিনি।
- উত্তম দাশ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫
৬০. ভবতোষ দত্ত সম্পাদিত, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬০৯
৬১. তদেব, পৃ.১৯৯
৬২. তদেব, পৃ. ২০০
৬৩. তদেব
৬৪. তদেব, পৃ. ২০১
৬৫. তদেব, পৃ.২০৩
৬৬. তদেব, পৃ ২০৫
৬৭. তদেব, পৃ. ২০৬
৬৮. তদেব, পৃ. ১২৭
৬৯. তদেব, পৃ. ১৩১
৭০. তদেব, পৃ. ২৩৪
৭১. তদেব, পৃ. ২৩৫
৭২. উত্তম দাশ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪০
৭৩. জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের কবিতা এবং কাব্যনাট্য প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন,
কাব্যের একটা বিশেষ যুগ বলে স্থির করা হবে- কবিতার আরো আয়ত্ত নিদর্শন সব ইতিমধ্যে রচিত না হলেও- আমাদের এই যুগ। এ-সময়টায় খুব দীর্ঘ কবিতা রচিত হয়নি, কাব্যনাট্যও নেই, শ্লেষও মহান কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি। আসছে দশ-পনেরো বছরে আমাদের দেশে আধুনিক কবিতা এ-সব পরিণতির দিকে কোথাও কোথাও মোড় ঘোরাবে কিনা ভাবছি। বাংলা কবিতা পরে- হয়তো অদূরেই- যা হবে, তার আলো এত দিনে কিছু-কিছু এসে পড়বার কথা আধুনিক কবিতাকে সপ্রতিভ ও সজাগ করে তোলবার জন্যে; এসেছে বলে মনে হচ্ছে না। একালের কবিতার কোনো-কোনো অভাব ও অস্পষ্টতার দিক এ-ভাবে টিকে থাকবে না; বাংলা কবিতার আধুনিক সময় যদি তা দান না করতে পারে ভবিষ্যত কালে (খুব দেরি না করেও) দীর্ঘ কবিতা ও শ্লেষে লিখিত মহা কবিতা আসতে পারে; এবং কবিতায় নাট্য।
- জীবনানন্দ দাশ, কবিতার কথা, ৮ম সং, কলকাতা : সিটনেট প্রেস, ১৪০৫; পৃ. ১২৭, ১২৮
৭৪. আবদুল মান্নান সৈয়দ সংকলিত ও সম্পাদিত, জীবনানন্দ দাশের কবিতা সমগ্র (প্রকাশিত-অপ্রকাশিত) গ্রন্থে তাঁর পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাবলির যে পরিচয় (পরিশেষ ৩) উল্লেখ করেছেন সেখান থেকে জানা যায় কনভেনশন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘অনুক্ত’ পত্রিকার শ্রাবণ-আশ্বিন ১৮৭৯ শকাব্দে।
অন্যদিকে ড. কণিকা সাহা বাংলা কাব্যনাট্য : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ গ্রন্থে জীবনানন্দের কনভেনশন-এর রচনাকাল ১৯৪০ সাল অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বলে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়ার কনভেনশন-এর বিষয়বস্তু ও প্রেক্ষাপটও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি। সেক্ষেত্রে কনভেনশন রচনার সময় ১৯৪০ সাল অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হিসেব গ্রহণ করাই অধিকতর প্রাসঙ্গিক।
৭৫. আবদুল মান্নান সৈয়দ সংকলিত ও সম্পাদিত, জীবনানন্দ দাশের কবিতা সমগ্র, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪১০
৭৬. তদেব, পৃ. ৪১০
৭৭. তদেব, পৃ. ৪১২
৭৮. তদেব, পৃ. ৪১২
৭৯. তদেব, পৃ. ৪১১
৮০. জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেন’ কাব্যের ‘সুচেতনা’ শীর্ষক কবিতায স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন- ‘এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা/ সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।/ কলকতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;’
- দ্রষ্টব্য : রণেশ দাশ গুপ্ত সম্পাদিত, জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার, পরিবর্ধিত সং, ঢাকা : খান ব্রাদার্স এ্যাণ্ড কোম্পানি, ১৪০০; পৃ. ১৭৬
[লেখকের গবেষণা-অভিসন্দর্ভ ‘বাংলাদেশের কাব্যনাটক : আঙ্গিক ও বিষয়-বৈচিত্র্য’ এর পরিমার্জন ও পুনর্লিখিতরূপ পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে]
অনুপম হাসান : পিএইচ.ডি. গবেষক ও প্রাবন্ধিক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়