Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

বাংলাদেশের কাব্যনাটক : বিষয়-বৈচিত্র্য ও প্রকরণশৈলী [তৃতীয় ও শেষ কিস্তি]

Written by অনুপম হাসান.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

বাংলাদেশের সাহিত্য : কাব্যনাট্য-ধারার উন্মেষ-পর্ব (১৯৪৭-’৭১)

ক.
বাংলা সাহিত্যে মূলত ষাটের দশকে আধুনিক কাব্যনাটকের বিকাশ ঘটে; এ সময় পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকগণ ‘কাব্যনাট্য চর্চা’কে একটি আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলা কাব্যনাট্য চর্চার এই আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকগণ যতখানি সাফল্য অর্জন করেছিলেন তা বাংলাদেশের সাহিত্যিকগণের ক্ষেত্রে ঘটে নি। বাংলাদেশের সাহিত্যিকগণের মনেও পশ্চিমবঙ্গের ‘কাব্যনাট্য চর্চা’ আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল। তাঁরাও সাহিত্যের এই অভিনব আঙ্গিক-কৌশল আয়ত্ত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এঁদের মধ্যে শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), জসীম উদদীন (১৯০৩-’৭৬), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৮-’৭৯), নূরুল মোমেন (১৯০৮-’৮৯), আ.ন.ম. বজলুর রশীদ (১৯১১-’৮৬), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-’৭৪), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) এবং আলাউদ্দিন আল আজাদ (জ.১৯৩২)-এর নাম উল্লেখযোগ্য।

খ.
বাংলা নাট্যসাহিত্যে নূরুল মোমেন (১৯০৮-’৮৯) বিশিষ্ট চিন্তাধারা ও আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যে অনন্য। তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যের সংলাপে চরিত্রের সংঘাত সৃষ্টিতে অনন্য পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। নূরুল মোমেন নাটক ছাড়াও প্রবন্ধ ও রস-রচনায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। তবে নাট্যকার হিসেবেই তিনি অধিকতর খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে ‘আনন্দ বাজার’ পত্রিকায় তাঁর রচিত রূপান্তর নাটিকা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি বাংলা নাট্যজগতে প্রবেশ করেন। নেমেসিস (১৯৪৮) রচনার মধ্যদিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে অভিনব আঙ্গিকের ব্যবহার করে খ্যাতি ও প্রশংসা লাভ করেন। নূরুল মোমেন নেমেসিস ছাড়াও যদি এমন হোত (১৯৬০), নয়া খান্দান (১৯৬২), আলোছায়া (১৯৬২), আইনের অন্তরালে (১৯৬৭), শতকরা আশি (১৯৬৯), যেমন ইচ্ছা তেমন (১৯৭০), হিংটিং ছট (১৯৭১) প্রভৃতি নাটক রচনা করে বাংলা নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। নূরুল মোমেন নাটকে আধুনিক সমাজের নানামুখি সমস্যা উপস্থাপনে সচেষ্ট হয়েছেন। তিনি নাট্যরচনায় মূলত উদ্দেশ্যবাদী। তিনি পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক সমস্যাকে নাটকের বিষয়-উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নাট্য-রচনার মাধ্যমে তিনি এসব সমস্যা-সংকট থেকে উত্তরণে প্রয়াস চালিয়েছেন।

নূরুল মোমেনের প্রায় সব নাটকই উদ্দেশ্যমূলক। এই প্রতিভাধর নাট্যকার পরিশীলিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন। তাঁর রচিত প্রায় সব নাটকে আদর্শবাদী ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। তাঁর নাটকের মূল বিষয় সামাজিক জীবন এবং সেই যাপিত জীবনের সমস্যা, সংকট, সংঘাত। এধরনের সামাজিক সমস্যা নাটকে উপস্থাপন করতে গিয়ে তাঁর আদর্শবাদী ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিকভাবেই সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে, ফলে অনেক সময়ই তাঁর নাটকের বক্তব্যবিষয় কৃত্রিম হয়ে পড়েছে; কিংবা কখনো কখনো তা অশৈল্পিকও মনে হতে পারে।

শিল্প বিচারের মানদণ্ডে নূরুল মোমেনের নাটকের ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, এ কথা সত্য। তবে তাঁর  নেমেসিস নিঃসন্দেহে বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে অভিনব সংযোজন। কেননা নূরুল  মোমেনের পূর্বে বাংলা নাট্যসাহিত্যে একক চরিত্রের নাটক রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ-ই রচনা করেন নি। এছাড়া বিশ্বসাহিত্যে আরো চারজন বিখ্যাত নাট্যকার একক চরিত্রের নাটক লিখেছেন। এগুলো হচ্ছে ক্রিস্টোফার মার্লো (১৫৬৪-’৯৩)-এর দ্যা ট্র্যাজিক্যাল হিস্টরি অফ ডক্টর ফস্টাস (১৬০৪), অগাস্ট স্ট্রীণ্ডবার্গের (১৮৪৯-১৯১২) দ্যা স্ট্রংগার (১৮৮৯), ইউজিন ও’নীল (১৮৮৮-১৯৫৩)-এর বাউণ্ড ইস্ট ফর কারডিফ (১৯১৮), জ্যা কক্তু (১৮৮৯-১৯৬৩)-এর দ্যা হিউম্যান ভয়েস (১৯৬০)। তবে একক চরিত্রবিশিষ্ট এ নাটকগুলো সংক্ষিপ্ত; কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে নি। এই অর্থে নূরুল মোমেন-ই প্রথম একক চরিত্রের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ নাট্য রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন। নেমেসিস সম্পর্কে নাট্যকারের নিজের বক্তব্য হচ্ছে-

এই নাটকটিতে গ্রীক ট্রাজেডির চিরাচরিত সময়, স্থান ও ক্রিয়া- এই ঐক্যত্রয়ের আঙ্গিক ঠিক রেখে চতুর্থ ঐক্য অর্থাৎ চারিত্রের একত্ব (unity of person) সংযোগ করে একটা পরীক্ষা করা হয়েছে। এবং এই এক অংকের নাটকটিতে এক-চরিত্র সর্বস্ব করা সত্ত্বেও ক্লাসিক্যাল নাটকের পাঁচ অংকের ক্রমপরিণতির ছকে ফেলে লেখার আঙ্গিক এটাতে হয়তো কঠিন হবে না।

নাট্যকার নূরুল মোমেন নাটক রচনায় সবসময়ই নিরীক্ষাধর্মী। নিঃসন্দেহে নেমেসিস-ও তাঁর সেই নিরীক্ষা প্রবণতার ধারাবাহিকতার ফসল। তাছাড়া আরো একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হয় যে, নূরুল মোমেন উদ্দেশ্যমূলক নাটক রচনা করেন। এই নিরিখে নেমেসিস নাটকেও নূরুল মোমেনের সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল; যার ফলশ্রুতিতে নেমেসিস দেবী সুরজিত নন্দীর অসততার ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে সুরজিত নন্দী সাধারণ মানুষের জীবনে যে দুঃখ-দুর্দশা বয়ে এনেছে- তার প্রতিশোধ হিসেবে নায়ক সুরজিত নন্দীকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। স্পষ্টতই নাট্যকার তাঁর নায়ককে দিয়ে নীতি-বিগর্হিত কর্মের শাস্তি প্রতিবিধান করেছেন।

নূরুল মোমেনের নেমেসিস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। নাট্যকাহিনী মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে চোরাকারবারীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে। এখানে চিত্রিত হয়েছে- এক সময়ের দরিদ্র সুরজিত নন্দী যুদ্ধকালীন সময়ে কালোবাজারী (অবৈধভাবে অর্থোপার্জন) করে অল্প-সময়ের মধ্যে কীভাবে হাজার হাজার টাকার মালিক হয়েছে; দরিদ্র সুরজিত নন্দী যা কোনোদিন কল্পনাও করে নি। দরিদ্র স্কুল মাস্টার সুরজিত নন্দী বিত্তবান হওয়ার চুক্তি করে হবু শ্বশুর নৃপেন বোসের কাছে, শুধুমাত্র প্রিয়তমা সুলতাকে পাওয়ার জন্য। স্বার্থবুদ্ধি সম্পন্ন নৃপেন বোসের শর্ত ছিল- তাকে (সুরজিত নন্দীকে) যুদ্ধের সময় কালোবাজারীর মাধ্যমে অঢেল টাকা-পয়সা রোজগার করতে হবে। এই শর্তের অধীনে সুলতা এবং সুরজিতের গোপনে বিয়ে হয়। তবে এই শর্তে নৃপেন বোস অমানবিক যে বিষয়টি যোগ করে তা হলো- সুরজিত যদি শর্তানুযায়ী অর্থ রোজগারে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে এই বিয়েরও কোনো মূল্য নেই। নৃপেন বোস এক চিঠিতে মেয়ে-জামাইকে লিখেছে-

সুলতার সঙ্গে তোমার গোপনে বিবাহ দিয়েছি বিশেষ কোনরূপ অনুষ্ঠান না করেই। কারণ যদি তুমি তিন মাসের মধ্যে লক্ষ টাকা না করতে পারে তবে তোমার এ-বিবাহ অস্বীকৃত হবে। আমাদের সমাজে এরূপ ব্যাপার চালু। এবং সুলতাতে যখন আমারই রক্ত বইছে তখন তারও অমত হবে না জেনো। অল্পদিন সংসার করেছ বলে মনে করো না তার মনের উপর তুমি অধিকার বিস্তার করেছ। তোমার মত তাকে দিয়েও প্রতিজ্ঞা করিয়েছি, তিন মাস তোমার সঙ্গে তার সংশ্রব না রাখতে। ঝুনরমল ও অসীমের সাহায্য পেলে এই সময়ের মধ্যে পাঁচ লক্ষ টাকা করা কোন অসম্ভব প্রস্তাব নয়। বিবেকটাকে সাপের খোলসের মত ত্যাগ করে নতুন হয়ে বেরিয়ে এসো। সময়ে আবার খোলস পড়বে। এ বর্ণচোরা দেশে মহারথীদের সামিল হওয়ার ঐ একই পন্থা।

ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া অর্থাৎ প্রিয়তমা সুলতাকে পাওয়ার জন্যই মূলত দরিদ্র মাস্টার সুরজিত নন্দী দেশজাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত হয়। অবৈধপথে অর্থোপার্জনের জন্য সুরজিতকে সহায়তা করে তারই সহপাঠী অসীম। সুলতাকে পাওয়ার প্রবল ইচ্ছায় সুরজিত এগিয়ে গেছে- নৃপেন-অসীমের দেখানো অন্ধকার পথে গমন অনেকটা যান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়েছে। দ্রুতগতির কোনো অশ্বের খুড়ের সাথে সুরজিত তার ভাগ্যের রথ জুড়ে দিয়ে ছুটে চলেছে- নৃপেন বোসের শর্তপূরণের জন্য নির্ধারিত টাকার অংকের আর মাত্র এক লক্ষ টাকা বাকি আছে সুরজিতের। এমতবস্থায় সুরজিতের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়-

লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বাংলাদেশ আজ নিরন্ন! বিশ্বের দোষ দেব না। আমাদের নালিশ আজ বাংলাদেশের লোকের বিরুদ্ধে, যারা দেশবাসীর উদ্যত-হাঁ’র সুমুখ থেকে অন্ন সরিয়ে নিচ্ছে চারগুণ লাভের আশায়। অনাহার ও ক্ষুধা দেশটাকে পিষ্ট করছে। মা’র স্তনে দুগ্ধ নাই। চুষে চুষে দুধ না পেয়ে সন্তানগুলি কুকুরছানার মত কেঁই কেঁই করছে মার বুকে। সরীসৃপের মত, কেন্নোর মত, শহরের রাস্তা ঘাটে কিলবিল করছে নরনারী, খাদ্যের অন্বেষণে। অসূর্য্যস্পশ্যা যুবতী দেহ বিকিয়ে দিচ্ছে অবহেলায়, একমুঠো অন্নের জন্যে।

দেশ-জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে করতে সুরজিতের মনে ভয়ানক ক্লান্তি নেমেছে; সে বিবেকের দংশনে পর্যুদস্তু। সমাজে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে কালোবাজারী করে অর্থ রোজগারে তার ঘৃণা জন্মেছে- এই ঘৃণা তার জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। অথচ অর্থপিশাচ নৃপেন বোস অর্থোপার্জনের এই পদ্ধতিকে ‘যুগধর্ম’ হিসেবে আখ্যায়িত করে চূড়ান্তভাবে নীচতার পরিচয় দেয়। বিশেষত সে সুরজিতকে প্রতিনিয়তই প্ররোচিত করতে থাকে। সুলতাকে পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে সত্ত্বেও এই অমানবিক তথা অনৈতিক কাজে সুরজিতের মন আর সায় দেয় না। সে কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় ভুগতে শুরু করে; এই অনুশোচনা থেকেই সুরজিত নন্দী তার মৃত্যুর পর অবৈধভাবে উপার্জিত তার সকল সম্পত্তির মালিক দরিদ্র মানুষ হতে পারে এই লক্ষ্যে সে উইল করে-

আমি শ্রীসুরজিত নন্দী, পিতা ইন্দ্রজিত নন্দী, বাড়ী ১০১০ বালিগঞ্জ প্লেস, কলিকাতা, এই মর্মে উইল করিতেছি যে আমার মৃত্যুর পর আমার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি ও ব্যাঙ্কের যাবতীয় টাকা দরিদ্র সেবায় ব্যয় করিবার নিমিত্ত নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ লইয়া একটি ট্রাস্ট গঠন করিয়া তাঁহাদের হস্তে এতদ্বারা সমুদয় ন্যস্ত করিলাম। আমার মৃত্যু-অন্তে তাঁহারা ইচ্ছামত উহার সদ্ব্যয় করিতে পারিবেন। আমি সুস্থ শরীরে সজ্ঞানে এবং দুইজন সাক্ষীর সম্মুখে ইহা সহি করিলাম।
 
অর্থাৎ দরিদ্র স্কুল মাস্টার নিজের বিবেকের কাছে পরাজিত হয়েই এই উইল করেছে। সুরজিত মৃত্যুর ঠিক আগ-মুহূর্তে উইলে স্বাক্ষর করে যায়- যাতে করে তার উত্তরসূরী এই অভিশাপের অর্থ ভোগ না করে। আর আত্মদহনে বিপর্যস্ত সুরজিত নন্দী নিজের সন্তানকে অভিশাপগ্রস্ত অর্থের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করতে পেরেছে- এই শেষ ভরসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। তবে তার এই পরাজয়ে প্রকৃতপক্ষে মানবতার জয় ঘোষিত হয়েছে। যে গরীবদেরকে বঞ্চিত করে সুরজিত অর্থ সঞ্চয় করেছিল; বিবেকের দংশনে সুরজিত নন্দী শেষ-পর্যন্ত সেই সম্পত্তি তাদের কল্যাণে খরচের জন্য উইল করে পুনর্জন্ম লাভ করেছে। এরপরই নাট্যঘটনায় নতুন টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়, সুরজিতকে টেলিফোনে মৃত্যুর হুমকি দেওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু বিবেকের দংশনাহত টেলিফোনে মৃত্যুর হুমকি পাওয়া সত্ত্বেও সুরজিত তার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে নি। বরং নৃপেন বোসের লোকজনের কাছে থেকে টেলিফোনে মৃত্যুর হুমকি পাওয়ার পর সুরজিতের বিবেক তাকে বলে-

মানুষের উপর রকমারি অত্যাচার করেছো। মৃত্যুদূতের দু’হাত কাজে ভরে দিয়েছো। তাকে সব্যসাচী করে তুলেছো- তুমি! অন্ন থেকে বঞ্চিত করে, মরার পথে মানুষকে শুধু বসিয়ে দাও নাই, ঔষধ থেকে বঞ্চিত করে বেঁচে ওঠার লড়াইয়ের হাতিয়ার সরিয়ে নিয়েছো- এই তুমি! ঘৃণিত উপায়ে সরিয়ে নিয়েছ লঙ্গরখানা থেকে চাল! তোমার দেয়া ভুঁয়ো ঔষধের উপর নির্ভর করে কত বিধবার একমাত্র পুত্র সামান্য অসুখ নিয়ে মারা গেছে। শতাব্দি থেকে যে প্রতিনিধিত্ব রক্তে রক্তে অব্যাহত হয়ে আসছিল, তার ঘটিয়েছ পূর্ণচ্ছেদ। চালের বস্তা ছেঁড়া জুতো দিয়ে, আটার বস্তা রাবিশ দিয়ে ভারী করেছো। নুনে মিশিয়েছো বালু। তেলে নানা জিনিষের কলতানি- মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছো। মানুষের রক্তে তিন পুরুষ পর্যন্ত বিষিয়ে মরার সামগ্রী মিশিয়ে দিয়েছো! আরও শুনবে?
 
অতএব যুদ্ধের বাজারে কীভাবে সুরজিত নন্দী লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেছে তা উপরের বক্তব্যে স্পষ্ট বোঝা যায়। যে এরকম অবৈধভাবে অর্থ আয় করেছে, তাকে একদিন অবৈধ উপায়েই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে- এটাই যেন স্বাভাবিক নিয়ম। এজন্যই নিজের অজান্তেই সুরজিতের বিবেক তাকে শোনায়- ‘তোমার উপায় নেই। প্রতিহিংসা নেবে যে দেবী, সেই নেমেসিস তার হিসাব খতাচ্ছে।’

অবৈধভাবে অর্থোপার্জন করে সুরজিত নন্দীর আত্মদহন ঘটে এবং মনুষ্যত্ববোধের উন্মেষে যে নতুন সুরজিতের জন্ম হয় তার বিবেকবোধ তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এই সুরজিত অনেকটাই যেন স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নিতে চায়। সুরজিত যখন নিজের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত এমতবস্থায় তার স্ত্রী সুলতার চিঠি পেয়ে সে জানতে পারে, তার গর্ভে সন্তান এসেছে। এ সময় নাট্যকার নূরুল মোমেন অত্যন্ত সার্থকতার সাথে সুরজিত নন্দীর মানসিক দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন তুলে ধরেছেন। সুরজিতের একদিকে নিজের ওপর নিজের বিতৃষ্ণা, ঘৃণা এবং প্রতারণাজাত আত্মগ্লানির দহন, অন্যদিকে পিতৃত্বের আনন্দে তার হৃদয় রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এই যন্ত্রণায় কাতর সুরজিতের জন্য বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। সম্ভবত এজন্যই নাট্যকার এ সময় সুরজিতকে মুক্তি দিতেই- টেলিফোনের হুমকিকে বাস্তবতা দিয়েছেন। এক সময়কার বন্ধু অসীম, যে তাকে হাত ধরে অন্ধকার পথে নামিয়েছিল সে-ই তার বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়ে হত্যা করে। এই হত্যার মাধ্যমে নিঃসন্দেহে অসীম অপরাধ করে তবে তার কৃত অপরাধের চেয়ে নাট্যঘটনায় সুরজিতের মৃত্যুই যেন অধিকতর জরুরি ছিল। কেননা তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই নাট্যঘটনায় মুক্তির সুবাতাস প্রবাহিত হয়।

সুরজিত নন্দী তার অনৈতিকতা, অমানবিকতার এবং মনসিক বৈকল্যের পরিচয় দিতে গিয়ে- এক সময়ের প্রেমিকা স্নেহলতার একটি পত্র পাঠ করে। এই চিঠির সূত্রে নাট্যকার সুরজিতে চূড়ান্ত সামাজিক অবক্ষয়ের মর্মান্তিক দৃশ্য নাট্যঘটনায় উপস্থাপন করেছেন। স্নেহলতা ভালোবেসেছিল সুরজিতকে; কিন্তু সেই ভালোবাসার মূল্য সেদিন সুরজিত দেয় নি। অবশ্য সেজন্য পরবর্তী সময়ে আত্মদহনে পুড়েছে সুরজিত। স্নেহলতা তার পত্রে অভিযোগ করে লিখেছিল- জানতাম আমার মত প্রথম শ্রেণীর প্রতিভার সংস্পর্শে তৈরি করলেন যে মন, তাই দিয়ে জয় করলেন বুর্জোয়া ছাত্রী সুলতাকে। বেয়ে উঠে মইটাকে লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন।

সুরজিত কর্তৃক প্রেমিকা স্নেহলতার প্রেমের মূল্য দেওয়া না-দেওয়া নাট্যঘটনায় বড় কোনো বিষয় নয়। কিন্তু এর মাধ্যমে যে কাহিনীর সূচনা হয়েছে, তা করুণ। সুরজিতের কাছে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে স্নেহলাতার ‘কুমারীত্ব সরকারীভাবে অক্ষুণ্ন রইল।’ এ কথার মধ্য দিয়ে নাট্যঘটনা ভিন্ন এক প্রচ্ছদপট চিত্রিত হয়েছে। সুরজিতের প্রেম-প্রত্যাখ্যাতা স্নেহলতার জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনীবৃত্তে যুদ্ধের বাজারের নিষ্ঠুরতা, ভয়াবহতা উঠে এসেছে। স্নেহলতার এই কুমারীত্বের ধরন কতটা নির্মম, তা ভাবা যায় না। সুরজিত তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এটা হয়তো মামুলি ঘটনা হিসেবে দেখা যেত; কিন্তু সেই প্রেমিক সুরজিতেরই কালোবাজারির ফলে দেশ জুড়ে যে মহামারি আর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে- তার ফলাফল গিয়ে পড়েছে, তারই প্রাক্তন প্রেমিকা স্নেহলতার ওপর। স্নেহলতার চিঠিতে তার প্রমাণ মেলে। সে সুরজিতকে লিখেছিল- ‘আমি হলাম দাসীর মেয়ে; সুতরাং লালসার লিকলিকে জিহ্বার অবলেহন দুর্ব্বার হয়ে উঠল চারদিক থেকে। রোধ করতে গিয়ে মার চাকুরী গেল কয়েক জায়গায়। শেষ পর্যন্ত বিষে বিষক্ষয় করতে হলো। জান্তব ক্ষুুধা, পেটেরটা মেটাতে গিয়ে দেহেরটাও মেটাতে হলো। গালভরা যে নোশনটা প্রাণপণে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম, প্রাণ রক্ষার জন্যে সেটাকেই পণ দিলাম।’

স্নেহলতার এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী কে? এককভাবে হয়তো শুধু সুরজিতকে দায়ী করা যায়। স্নেহলতার এই চিঠি পাঠ করে সুরজিত মূলত নিজের ভেতরের পশুত্বটাকে বাইরে বের করে এনেছে এবং সে উপলব্ধি করেছে, 'I shall turn you down, you idiotic spirit in man.' কিন্তু দেশশুদ্ধ এরকম হাজার হাজার স্নেহলতার জন্য দায়ী একা সুরজিত নয়। নৃপেন বোস, অসীমদের মতো কালোবাজারীরাই দায়ী। কেননা এই কালোবাজারীদের কারণে যুদ্ধের বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়; এর ফলে অসংখ্য মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুবতীরা শরীর বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হয়। তবে এক স্নেহলতার মর্মান্তিক পরিণতির জন্য যে সুরজিত প্রত্যক্ষভাবে দায়ী- তা বলার অবকাশ থাকে না। স্নেহলাতার ‘কুমারীত্ব সরকারীভাবে অক্ষুণ্ন’। কিন্তু সামাজিক বিবেচনায় এই কুমারীত্ব কতটা নির্মম ও যন্ত্রণাদায়ক তা ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। সুরজিত কর্তৃক স্নেহলতার প্রেম প্রত্যাখ্যান করার ঘটনা সাধারণ হয়েও অসাধারণ। কেননা ঘটনাটিই একটি মেয়েকে দেহ-ব্যবসায় নামতে বাধ্য করেছে। আর এর কারণ সুরজিতের অবৈধ অর্থোপার্জনের মধ্যে নিহিত। সুরজিতদের কালোবাজারির ফলে দেশ জুড়ে যে মহামারি আর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে- তার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল ভোগ করেছে স্নেহলতার মতো এদেশের অসংখ্য নারী। সুরজিতের অর্থোপার্জন এবং তার প্রাক্তন প্রেমিকা স্নেহলতার নারীত্ব বির্জন ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।

নূরুল মোমেনের একক চরিত্র বিশিষ্ট নেমেসিস নাটকটি এতদিন সমালোচগণ সামাজিক নাটক হিসেবেই বিচার করেছেন। নাটকের প্রেক্ষাপট অবশ্যই সামাজিক, এজন্য এটিকে সামাজিক নাটক বলতে বাধা নেই। তবে একই সাথে নায়ক সুরজিত নন্দীর চরিত্র বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয় যে, এটি কাব্যনাটকও বটে। এ কারণেই নাটকে সুরজিতের অন্তর্রহস্য আবিষ্কারে নাট্যকারের প্রাণান্ত প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। উপরন্তু এ নাটকের  গদ্য সংলাপ প্রায়শই কাব্যময় হয়ে উঠেছে। যেমন-

‘স্নেহলতা, কী সোনালী ছিল মন তোমার! আর কি তীক্ষ্ন ছিল তোমার অনুভূতি! নিজে ছিলে দরিদ্র; মর্ম্মে মর্ম্মে অনুভব করেছিলে মনের হীনতাই গরীবদের ছোট করে রাখে। তাই এই ভাটিয়ালি গানটায় তাদের মনকে সমৃদ্ধ করার অপূর্ব্ব আবেদন জানিয়েছিলে। আর আমাকে দিয়ে কতবার গাওয়াতে এই গানটা।’

অথবা স্নেহলতার চিঠি থেকে সুরজিতের উদ্ধৃত সংলাপ- ‘আপনার আর দেখা পেলাম না, দেখা হল দুর্ভিক্ষ রাক্ষসীর সঙ্গে। ইনটেলেক্টের মূল্য তার কাছে কয়েক টুকরো হাড়ের বেষ্টনীতে ছটাক খানেক মগজ মাত্র। তার নড়বড়ে দাঁতের প্রথম কামড়েই বাবা প্রাণ দিলেন। ফোঁকলার মাঝে পড়ে অর্দ্ধ-চিবানো অবস্থায় মা আর আমি রইলাম বেঁচে। ঘটনার ঘূর্ণাবর্ত্তে দেখতে না দেখতে অতীত আমাদের তলিয়ে গেল। মা’র জীবিকা হয়ে দাঁড়াল দাসীবৃত্তি। আমি হলাম দাসীর মেয়ে।’- এ ধরনের অনেক সংলাপই আছে নেমেসিস-এ যা কাব্যগন্ধী সংলাপের তুল্য। তাছাড়া এর সংলাপে আছে বৌদ্ধিক দার্শনিক সংলাপ। কথায় কথায় সুরজিত অনেক কবির কবিতা এবং গান তার সংলাপে ব্যক্ত করেছে; যা নাট্যঘটনায় কবিতার সুর, ছন্দ এবং রূপক-চিত্রকল্পের আবহ সৃষ্টি করেছে।

নূরুল মোমেন নেমেসিস নাটকের নামকরণ করেছেন গ্রীক পুরাণের প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের নামানুসারে। এ নাটকের নায়ক সুরজিত যুদ্ধের বাজারে কালোবাজারী করে যেভাবে অবৈধ অর্থোপার্জন করে, অসংখ্য মানুষের অভিশাপ কুড়িয়েছে; তাতে তার শাস্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে। উপরন্তু এই অন্যায় কৃতকর্মের জন্য সুরজিত নন্দী নিজেও অন্তর্দহনে পুড়তে থাকে। তার আত্মগত উপলব্ধিই তাকে মনে করিয়ে দেয়, তার কৃত অপরাধের শাস্তি অবশ্যই প্রতিশোধের দেবী গ্রহণ করবেন। এই আশঙ্কা থেকেই সে মৃত্যুর আগে, অবৈধভাবে উপার্জিত সকল সম্পত্তি সুরজিত গরীবদের উদ্দেশ্যে উইল করে দেয়- যাতে দেবী নেমেসিসের প্রতিশোধের আগুনে তার সন্তানকে পুড়তে না হয়। সুরজিতের উদ্দেশ্য নাট্যঘটনায় সার্থক হয়ে ওঠে যখন অসীম তাকে খুন করে। এই খুনের ঘটনা যদিও তার বন্ধু কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে, তথাপি নাট্যকার সুরজিতের কৃত অপরাধের শাস্তিস্বরূপ দেবী নেমেসিসের প্রতিশোধ-ই প্রমাণ করেছেন নাট্যঘটনায়। অর্থাৎ নাট্যঘটনায় সুরজিতের মৃত্যুকে অনিবার্য করে তুলেছেন নাট্যকার। অতএব দেবী নেমেসিসের নামানুকরণে নাটকের নাম নেমেসিস সার্থক হয়েছে একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হয়, সুরজিতের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই।

নূরুল মোমেনের নেমেসিস নাটকের সাথে ক্রিস্টোফার মার্লোর দ্যা ট্র্যাজিক্যাল হিস্টরি অফ ডক্টর ফস্টাস নাটকের সাদৃশ্য রয়েছে। এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফস্টাস তার আত্মা শয়তানের কাছে বিক্রি করেছিল; আর নূরুল মোমেনের নেমেসিস-এর সুরজিত নন্দী নিজেকে (সত্তা) কিংবা নিজের ব্যক্তিত্বকে বিকিয়ে দিয়েছিল, সুলতার বাবা নৃপেন বোসের কাছে। এ বিষয়ে সুরজিতের স্বীকারোক্তি- ‘Faustus তার আত্মা শয়তানকে বিক্রি করেছিল একইভারে আর আমি আমার আত্মাকে কিস্তিবন্দী করে নৃপেন বোস আর অসীমের কাছে বিক্রি করছি স্যার। এর যে কি দুঃখ।’
 
নূরুল মোমেন তার সৃষ্ট চরিত্র সুরজিত নন্দীর সংলাপেই ক্রিস্টোফার মার্লোর ‘ফস্টাস’ চরিত্রের তুলনা করা হয়েছে। সম্ভবত নাট্যকার নেমেসিস রচনার সময় দ্যা ট্র্যাজিক্যাল হিস্টরি অফ ডক্টর ফস্টাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। উপরন্তু তাঁর সৃষ্ট সুরজিতের মুখে ফস্টাসের সাথে সাদৃশ্যের কথা ব্যক্ত হওয়ায়, এই প্রভাব অনেকটাই স্বীকৃত ও বিশ্বাস্য হয়ে উঠেছে। তাছাড়া উভয় নাটকের তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায়, নেমেসিস-এ সুরজিত নন্দী যেভাবে আত্মগ্লানি, আত্মদহনে দগ্ধীভূত হয়েছে; একই রকম আত্মদহন-গ্লানি মার্লোর ফস্টাসের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। অসীমের ছুরির আঘাতে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে যন্ত্রণাকাতর সুরজিতের সংলাপের সাথে ফস্টাসের সংলাপের হুবহু মিলও পরিলক্ষিত হয়। সুরজিত বলে, ‘উহ্ আয়ু বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে- নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।’  অনুরূপ আর্তনাদ ফস্টাসের মুখেও শোনা যায়-

Ah, Faustus
Now hast thou but one bare hour to live
And then thou must be damned perpetually!

সুরজিত নন্দীর মৃত্যুকালীন উচ্চারণের সাথে ফস্টাসের উচ্চারিত বাক্যের পার্থক্য নেই বললেই চলে। তবে এটাকে অনুবাদ বলা যায় না। এছাড়া ফস্টাসের স্বগতোক্তির সাথে সুরজিত নন্দীর বক্তব্যের মিল আছে। উভয় চরিত্রের উচ্চারিত সংলাপের সাদৃশ্য এবং তাদের উভয়ের অন্তরে ব্যক্তিগত ব্যথা-ব্যর্থতা, অনুশোচনা একই সুরে গ্রথিত।  ব্যক্তি সুরজিত নন্দীর হৃদয়ের হাহাকার এবং আত্মদহন উন্মোচনে নাট্যকার নূরুল মোমেন সার্থকতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। ফলত এটাকে কাব্যনাটক বলতে বাধা থাকে না। গরীব স্কুল শিক্ষক সুরজিত নন্দী- অর্থ ও প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য শয়তানরূপী নৃপেন বোসের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেয়। এই পাপের অনুশোচনায় সুরজিত দেবী নেমেসিসের ক্রোধানলে ভস্মীভূত হবে; নাট্যকারের নিকট এটাই যেন স্বাভাবিক ঘটনা। এজন্যই নূরুল মোমেন নাটকের যবনিকাপতনে নেমেসিস দেবীর অভিশাপেই সুরজিতের মৃত্যু চিত্রিত করেছেন। তবে দেবীর কার্যক্রমকে বাস্তাবায়িত করতে তিনি সুরজিতের বন্ধু অসীমের সহায়তা গ্রহণ করেছেন। তবে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের রাহু থেকে সুরজিত নন্দী নিজের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরবর্তী বংশধরকে দেবীর (নেমেসিস) অভিশাপ থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে গেছে- 'I paid the penalty with my life and saved my generations.' অর্থাৎ  সুরজিত তার সমস্ত উইল করে দিয়েছে, গরবীদের কল্যাণে।

নূরুল মোমেন যে উদ্দেশ্য নিয়ে নেমেসিস রচনা করেছেন, তাঁর সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে সুরজিতের অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ-সম্পত্তি গরীবদেরকে উইল করে দেওয়ার মাধ্যমে। উপরন্তু নাট্যঘটনার যবনিকা টানতেই তিনি সুরজিতের বন্ধুকে দিয়ে তাকে হত্যা করিয়ে তা নেমেসিস দেবীর প্রতিশোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। নাটকের এই সমাপ্তিও সম্পূর্ণ নাট্যকাহিনীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। একক চরিত্রের নাট্যকাহিনীর মধ্যে দর্শকদের প্রবেশ করানো ক্ষেত্রে বিশেষত নূরুল মোমেন অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নেমেসিস-এর শুরু থেকে শেষপর্যন্ত দর্শক টানটান উত্তেজনার মধ্যে অবস্থান করে। অতএব নাট্য-ঘটনার বিকাশ এবং গতিময়তা যেমন নাট্যকার ধরে রেখেছেন; তেমনি নায়ক সুরজিত চরিত্রের মধ্যে নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে এসে তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে এর সার্থক ট্র্যাজিক পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন।

নাট্যকার নূরুল মোমেনের নেমেসিস নাটকের সংলাপ, ভাষাশৈলী এবং নাট্য-কৌশল মননশীল-বুদ্ধিবৃত্তিক; তবে অভিনয়ের জন্য মঞ্চনাটক হিসেবে নেমেসিস সম্পূর্ণ সার্থক তা বলা যায় না। কেননা একক চরিত্রের মানস বিশ্লেষণের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া দর্শকের কাছে একঘেয়ে মনে হতে পারে। তবে নাট্যকার চরিত্রের অন্তর্গত রহস্য উন্মোচনে সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন বলেই এটি সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত হওয়া সত্ত্বেও সার্থক কাব্যনাটক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

গ.
আ.ন.ম. বজলুর রশীদ (১৯১১-’৮৬) কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও কাব্য, নাটক, জীবনীগ্রন্থ, উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনী রচনা করেছেন তিনি। সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করলেও নাট্যসাহিত্যে তাঁর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর নাটকে মানব জীবনের সমস্যা, সামাজিক বাস্তবতা ও জটিলতা রূপায়িত হয়েছে। কবি-নাট্যকার বজলুর রশীদের নাটকে আদর্শের সঙ্গে বাস্তবতার সংঘাত, মানসিকতার সাথে জীবনের চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি ঝড়ের পাখি (১৯৬৬), যা হতে পারে (১৯৬২), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৭১), সংযুক্তা (১৯৭২), শিলা ও শৈলী (১৯৭৩), সুর ও ছন্দা (১৯৭৩), একে একে এক (১৯৭৬), ধানকমল (১৯৭৬) প্রভৃতি নাটক রচনা করেছেন। তাঁর নাটকগুলোর শিল্পসাফল্য নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এগুলোর পরিমিতিবোধ এবং সংলাপের কাব্যমাধুর্য বিশেষত্বপূর্ণ। তবে এসব নাটকে শিক্ষণীয় বিষয় বা আদর্শ প্রচার করাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। তাঁর নাট্য-প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনায় মিহর-উন-নিসা খোন্দকার বলেছেন-

পূর্ব পাকিস্তানী নাট্যকার ও পরিচালক হিসাবে আমরা যে কয়জনের নাম করতে পারি তাদের মধ্যে নূরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, আসকার ইবনে শাইখ, আ.ন.ম বজলুর রশীদ প্রভৃতি। এঁদের মধ্যে রশীদ সাহেব- শুধু নাট্যকারই নন তিনি উঁচু দরের মঞ্চ পরিচালক এবং কলেজ রঙ্গমঞ্চকে কেন্দ্র করেই তাঁর নাট্যপ্রতিভার উন্মেষ, বিকাশ এবং পরিণতি।

বাংলা কাব্যনাট্য সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে আর খুব বেশি নাট্যকারের সন্ধান পাওয়া যায় না যিনি রবীন্দ্রনাথের মতো সার্থক কাব্যনাট্য রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন। তথাপি মুসলমান কবি-সাহিত্যিকগণের মধ্যে ফররূখ আহমদ এবং আ.ন.ম. বজলুর রশীদ কাব্যনাট্য রচনায় যথেষ্ট শক্তিমত্তার পরিচয় দেন। বিশেষত বজলুর রশীদের কবিত্বের সাথে নাট্যগুণের অপূর্ব মিলন ঘটেছে। তিনি ১৯৬৬ সালে ‘ত্রিমাত্রিক’ শীর্ষক একটি কাব্যনাট্য সংকলন প্রকাশ করেন। এই সংকলনে তাঁর ধনুয়া গাঙের তীরে, মেহের তোমার নাম ও কোন এক দীপক সন্ধ্যায় শীর্ষক তিনটি কাব্যনাট্য পর্যায়ের রচনা স্থান পেয়েছে। এ রচনাগুলোতে কাব্য-সুষমা রয়েছে। তাঁর কাব্যনাট্যধর্মী রচনায় মূলত লোকায়ত জীবনের উদ্ভাসন পরিলক্ষিত হয়। ময়মনসিংহ গীতিকার দেওয়ান-ই মদিনা পালার কাহিনী অবলম্বনে তাঁর ধনুয়া গাঙের তীরে কাব্যনাটক রচিত। তাঁর স্বকীয়তা, কাব্য-কল্পনা এবং উপস্থাপন রীতি এই লোকজ কাহিনীকে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রা দান করেছে। ফলে ধনুয়া গাঙের তীরে অতিপরিচিত কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও একটি আলাদা শিল্পমাধ্যম হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

নাট্যকার বজলুর রশীদ ত্রিমাত্রিক কাব্যনাট্য সংকলনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লোককাহিনীর সার্থক রূপায়ণে যত্নশীল হয়েছেন। কোনো কোনো সমালোচক ত্রিমাত্রিক সংকলনে গানের প্রাধান্য লক্ষ্য করে একে গীতিনাট্য হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছেন। প্রকৃতার্থে এগুলো গীতিনাট্য নয়, সার্থক আধুনিক কাব্যনাটক না হলেও কাব্যনাট্য পর্যায়ের রচনা হিসেবেই বিবেচ্য। বজলুর রশীদের এই কাব্যনাট্য সংকলনে তাঁর কবি-মননের আবেগ-উচ্ছ্বাস, আনন্দ-বেদনা অপরূপ কাব্যসুষমামণ্ডিত হয়ে শিল্পিতরূপে প্রকাশ লাভ করেছে।  সমালোচক বলেছেন-

এখানে লেখক একদিকে যেমন তাঁর কাব্যরীতির পরীক্ষা করেছেন, তেমনি নতুন রসের সংযোজন ও নতুন আঙ্গিক নাটকীয় সন্ধিসূত্রের মধ্যদিয়ে জ্ঞাত কাহিনীতে বৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রয়াসী হয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে মনস্তাত্ত্বিক সংবেদন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রসময় গানের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। মূলত সংলাপাংশেই লেখকের কাব্যরীতির পরীক্ষা মুখ্য হয়েছে।

আ.ন.ম. বজলুর রশীদ তাঁর কাব্যনাট্যধর্মী রচনায় কবিতার বহুল ব্যবহার করেছেন। বিশেষত তাঁর এসব রচনায় কাব্যভাষা সাংগীতিক মাধুর্যে পরিপূর্ণ। তবে তাঁর কাব্যভাষায় পুরনো বিষয়বস্তুতে নবতর প্রাণের উন্মেষ ঘটেছে সন্দেহাতীত। বজলুর রশীদ আধুনিক-অর্থে সার্থক কাব্যনাটক রচনা করতে না পারলেও তিনি কবিতা মাধ্যমে নাট্য-রচনার যে প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন, তার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যে সার্থক কাব্যনাটক রচনার পথ সুগম হয়েছিল।

ত্রিমাত্রিক কাব্যনাট্য সংকলনের প্রথম রচনা ধনুয়া গাঙের তীরে। এটি ময়মনসিংহ গীতিকার পরিচিত পালা দিওয়ানা মদীনার অনুরচনাও বলা যেতে পারে। এর কাহিনীতে আমরা প্রত্যক্ষ করি, দেওয়ান সোনাফরের দুই ছেলে আলাল এবং দুলাল পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীর অত্যাচার ও ষড়যন্ত্রে ঘর ছাড়া হয় এবং তারা পালিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামের হীরাধর বণিকের গৃহে আশ্রয় নেয়। এখানেও তারা অনেক কষ্ট করে জীবন-যাপনের চেষ্টা চালায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলাল ব্যর্থ হয়ে হীরাধরের বাড়িও ত্যাগ করে। আলাল পালিয়ে গেলেও দুলাল হীরাধরের বাড়িতে থেকে যায় এবং কাজল কান্দার হাওরের চারণ ভূমিতে বণিকের গরু চরায় আর মনের ব্যর্থতায় বেদনার সুর সাধে। তার গানে মদীনা সুন্দরীর মনে প্রেমবোধ জাগ্রত হয় এবং তাদের সাক্ষাত হয় হাওরের নির্জন তীরে। দুলাল প্রেম-বিহ্বলা সুন্দরী মদীনাকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করে কিন্তু লজ্জাশীলা নারী মদীনা দুলালের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে না দেখে দুলাল বলে-

    তবু যেন মনে হয়, অনামিকা সোনার বরণ
    অমরার কন্যা তুমি, কেন এই মর্ত্যের মাটিতে
    এতরূপ সুষমায় পূর্ণপাত্রে ঝলোমলো
    এলে দেখা দিতে
    অজানা কুমারে ...

এবারে মদীনা তার লজ্জা ভুলে দুলালের কথার জবাবে বলে-

    তুমি নও অজানা আমার
    কতদিন সন্ধ্যা বেলা বার দুয়ারের ঘরে বাতায়নে শুধু বারবার
    তোমাকে দেখেছি বসে বার বার অনিমেষ। রূপে মুগ্ধ আমি
    কম্পিত কামনায় তুমি হবে জীবনের প্রিয়তমে স্বামী।

উপরে উল্লেখিত মদীনা এবং দুলালের কথপোকথনে তাদের প্রেম ও হৃদয় আদান-প্রদানের চমৎকার ছবি ভেসে উঠেছে। প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়ে যত ধরনের আবেগ-অনুভূতির সঞ্চার হয় তা এই নব পরিচিত দু’জনের হৃদয়ে ঝড় তুলছে। তাদের আলাপচারিতায় বোঝা যায়, দুলালের হৃদয়ের অনেক দিনের বন্ধ দরজা হঠাৎ খুলে গিয়েছে এবং সেখানে মুক্ত আলোর উদ্ভাসন ঘটেছে। তার আনন্দের যেন অন্ত নেই; অনুরূপ অবস্থা মদীনারও। সে-ও অবচেতনে দুলালের প্রেমময় স্পর্শ লাভের জন্য শিহরণ অনুভব করেছে। তারপর মদীনা পিতা-মাতার অনুমতিক্রমে দুলালকে বিয়ে করে-

    তোমার আমার মিল এই যোগ যুগান্তর হবে
    তথাপি অক্ষয় রবে। কথা রাখ ডান হাতে
    উপরে নাও
    কবচ, করবে রক্ষা সর্বক্ষণ, হাতখানি দাও
    ফকীর বাবার দান, তার দান যায় না বিফলে।

মদীনার এই আশঙ্কার মধ্যে গ্রামীণ নারীদের চিরায়ত আশংকার চিত্র বিদ্যমান। স্বামীরূপে দুলালকে পাওয়ার পরও মদীনার মনে আশংকা ছিল কেননা দুলাল বিদেশী। দুলাল তাকে ফেলে হয়তো হঠাৎ কোনোদিন পালিয়ে যাবে। মদীনা এ ধরনের অমূলক দুঃশ্চিন্তায় পড়ে স্বামীর হাতে সে ‘ফকীর বাবার’ দেয়া ‘কবচ’ বেঁধে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। অবশ্য ফকীর বাবা মদীনাকে স্বামীর সেবা-যত্ন করার পাশাপাশি তাকে মনে-প্রাণে ভালোবেসে যাওয়ার জন্য উপদেশ দিয়েছে। মদীনা তার অন্যথা করে নি। এভাবে দিন-সপ্তাহ বছর গড়িয়ে মদীনার ঘরে চাঁদের মতো ফুটফুটে সুরত ও জামালের জন্ম হয়েছে।

নাট্যকাহিনীর অন্যদিকে আলাল; সেও বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। আলাল আশ্রয় গ্রহণ করে সিকান্দার দেওয়ানের এবং সেখানে তার মেয়েকে বিয়ের করার প্রতিজ্ঞা করে। পরবর্তী সময়ে সিকান্দার দেওয়ানের সহায়তায় আলাল বিমাতার হাত থেকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। আলাল দেওয়ানের এক মেয়েকে নিজে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আর অন্য মেয়ে আমিনার সাথে তার ভাই দুলালের বিয়ে দেবে বলে কথা দেয়। এমতবস্থায় আলাল অনেক খোজাখুঁজির পর একদিন দীনহীন অবস্থায় দুলালের দেখা পায়। আলাল তার ভাই দুলালকে এই দীন-দরিদ্র অবস্থা ত্যাগ করে, মদীনাকে ত্যাগ করে আমিনাকে বিয়ে করে নতুনভাবে জীবন শুরু করার পরামর্শ দেয় এবং রীতিমতো প্ররোচিত করে। দুলালের মনেও সম্পদের মোহ ছিল, তাই সে দীন দুঃখিনী মদীনাকে তালাক দিয়ে গোপনে ভাইয়ের সাথে চলে যায়। দুঃখিনী মদীনা ধনুয়া গাঙের তীরে প্রিয়তম দুলালের জন্য কেঁদে কেঁদে অকালে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ইতোমধ্যেই দুলাল তার ভুল বুঝতে পারে যে, এই আরাম-আয়েশের জীবনে সে আসলে সুখি হতে পারে নি। দুলাল তার ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য মদীনার কাছে ছুটে আসে কিন্তু ততদিনে মদীনা পরলোকগত। দুলাল তার সন্তান সুরতের কাছ থেকে মায়ের এই করুণ মৃত্যুর কথা জানতে পেরে ভীষণ অত্যন্ত আঘাত পায় এবং প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে দুলাল মদীনার সমাধির শিয়রে বসে বিলাপ করতে থাকে-

    কোথা অভিমানিনী গো। গোলাপের কুড়ি গেছে ঝরে,
    তুহিন শীতের ঘায়ে অকালেই, আমি যে পাষাণ,
    এখন বিরলে কাঁদি- গলে যাই। কোথায় মদীনা?
    দিওয়ানা আশেক আজ বড় শান্ত দূর অন্তহীনা
    অমর্ত আনন্দলোকে।

দুলাল এখন মদীনার জন্য যতই চোখের জল ফেলুক না কেন সে আর তার মর্ত্যলোকের আবেগ-বিহ্বল আহ্বানে সাড়া দেবে না। মদীনা প্রেমে ছিল সৎ, একনিষ্ঠ এবং কুণ্ঠাহীন। সে অন্য পুরুষের প্রলোভনে কখন সাড়া দেয় নি, যখন তার ছিল মহাবিপদ সে অনাদরে-অবহেলায় বনের কুসুমের মতো ঝরে পড়েছে তবু কুপ্রস্তাবে রাজি হয় নি। মৈয়মনসিংহ-গীতিকার এই নারী (মদীনা) চরিত্রটি সম্পর্কে ফরাসি সাহিত্যিক রোঁমা রোঁলা মন্তব্য করেছেন-

I was specially delighted with the touching story of Modina which although only two centuries old, is and antique beauty and purity of centiment which art has rendered faithfully.

পৃথিবীতে প্রেমের ইতিহাস সবচেয়ে পুরনো কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এবং ভিন্ন ভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের হাতে এর বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। ত্রিমাত্রিক সংকলনের ধনুয়া গাঙের তীরে কবিতানাট্যেও নাট্যকার চিরায়ত প্রেমের কাহিনীই উপস্থাপন করেছেন তবে তা ভিন্নমাত্রায় ও আঙ্গিকে; নাট্যকার বজলুর রশীদের সার্থকতা এই স্বকীয়তায়। লোকগাথা থেকে কাহিনী সংগ্রহ করলেও এর ভাষা প্রয়োগ এবং ছন্দের প্রয়োগ কৌশলে ধনুয়া গাঙের তীরে অভিনব অনুসৃষ্টি।

ধনুয়া গাঙের তীরে কাব্যনাটকের নায়ক দুলালের হৃদয়ে প্রেম ছিল না- এমন বলা যায় না, তবে তার চরিত্রের জাগতিক প্রলোভন সেই প্রেমের কবর রচনা করেছে। অন্যদিকে মদীনার প্রেমে বাঙালি নারীর পতিনিষ্ঠার প্রতিমূর্তি চিত্রিত হয়েছে। কাব্যনাটকের অন্য চরিত্র ফকির বাবা সংসারত্যাগী মানুষ, যার জাগতিক কোনো মোহ-মায়া নেই কিন্তু সেও মদীনার একপাক্ষিক প্রেমের গভীর নিষ্ঠা লক্ষ্য করে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে-

    তাঁকে সঁপে দাও
    যে তোমার চিরন্তন, তাঁর মধু স্মরণে ডুবাও
    আমি চেতনাকে তবে হাল্কা হবে চিন্তা ভাবনার
    সকল দুঃসহ বোঝা।

ফকীর বাবার এই সান্ত্বনাবাক্যের মধ্যে দার্শনিক তত্ত্বের প্রকাশ পরিলক্ষিত। কেননা জাগতিক জীবনের দুঃখ-বেদনা, ব্যথা-ব্যর্থতা সবই যন্ত্রণাময়, এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় অদ্যাবধি আবিষ্কার করা যায় নি। তবে ফকীর বাবার কথা মতো যদি আমরা আমাদের সকল ব্যর্থতার দায়ভার এবং অহংচেতনার বোঝা ঈশ্বরের উপর ন্যস্ত করি তাহলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। আস্তিক মানুষের অহংচেতনা ঈশ্বরের ধ্যানে নিমগ্ন রাখলে তার দুঃখ-বেদনা কিছুটা উপশম হয়। আস্তিক মানুষ যদি নিজেকে সম্পূর্ণ নির্ভরতায় ঈশ্বরের নামে সমর্পণ করতে পারে তাহলে সব ব্যথা-বেদনা, শোক-সন্তাপ থেকে মুক্তি পায় এবং তার কাছে পৃথিবী হয়ে ওঠে সুন্দর- তখন তার ভিতরে বাইরে আনন্দের অনন্ত নির্ঝর বইতে থাকে।

ধনুয়া গাঙের তীরে কাব্যনাটকের কাহিনীর ধারাবাহিক গতিশীল বিন্যাস থাকলেও এতে নাটকীয়তা এবং নাট্য-মুহূর্ত সৃষ্টিতে নাট্যকার দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর ভাষা ও ছন্দ কাব্যনাটকের উপযোগী; গতিশীলতার অভাবে এটি সার্থক কাব্যনাট্য হতে পারে নি। এ কাব্যনাটকের কাহিনীর অভ্যন্তরে যথেষ্ট নাটকীয়তার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নাট্যকার তার সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আ.ন.ম. বজলুর রশীদের কাব্যনাটকগুলোতে যতটা কাব্যোৎকর্ষ পরিলক্ষিত হয়, ততটা নাট্যোৎকর্ষ পাওয়া যায় না। এর কাব্যগুণ পাঠক-দর্শকদের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে- ছন্দ এবং সুরের মূর্ছনায়। কেননা বজলুর রশীদের রোমান্টিক কবি-মানস জুড়ে জীবনের আবেগী সুরের অনুরণন ছিল। তাছাড়া বজলুর রশীদের কাব্যনাটকের কাহিনী অনেকাংশেই বৈচিত্র্যহীন; প্রায় সবগুলো নাট্য-কাহিনী প্রেম-নির্ভর। নাট্য-কাহিনী ছাড়া এসব রচনার সংলাপ রচনার ছন্দে কিংবা শব্দ-বিন্যাসে অভিনবত্ব নেই। তবে তাঁর প্রকাশভঙ্গিতে নিবিড় রসবোধ এবং মাধুর্যপূর্ণ কাব্যিকতা আছে। বাংলা কাব্যনাটকের ইতিহাসে আ.ন.ম.বজলুর রশীদের প্রয়াস- আধুনিকার্থে ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশের সাহিত্যে তিনি আধুনিক কাব্যনাটকের প্রকরণ-শৈলী নির্মাণের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ।

ঘ.
বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশক বাংলা কাব্যনাটকের বিকশিত যুগ হিসেবে খ্যাত। কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) বাংলা সাহিত্যে চল্লিশের দশকের খ্যাতিমান কবি হিসেবে সমধিক পরিচিতি। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে ফররুখ আহমদ চিরদিনই দুঃসাহসী, নতুন পথের অভিযাত্রী এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রত থেকেছেন। তিনি দরিয়ায় শেষ রাত্রি (১৩৫০) শীর্ষক কবিতানাট্য রচনা করে তিনি কাব্যনাটক রচনার পরীক্ষা করেছেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন- ‘তাঁর প্রিয় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো কিংবা অগ্রজ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো তাঁর লক্ষ্য শব্দ ও কাব্যের ধ্বনিময়তা। নাট্যগুণ, আবৃত্তিযোগ্যতা তাঁরও অন্বিষ্ট। কিন্তু ঐ দুই কবির মতো তিনিও মর্মে-মর্মে রোমান্টিক। তাঁর নাটকীয়তার ভিতরে-ভিতরে তাই গাঁথা হ’য়ে যায় উধাও কল্পনা, অবাধ কল্পনা। তাই ফররুখের কবিতার শুধুমাত্র নাট্যগুণের দিকে তাকালে তাঁর কাব্যগুণ বঞ্চিত হতে হবে। যে-ক’টি কবিতায় ফররুখ এই দুই আপাতপ্রতীপ গুণকে মিলিয়েছেন, দরিয়ায় শেষ রাত্রি তার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।’  তিনি কাব্যনাট্য ধারার মূল প্রবাহের বাইরে থেকেও এ সময় নৌফেল ও হাতেম নামক একটি পূর্ণাঙ্গ সার্থক কাব্যনাটক রচনা করেন। কবি হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক যুগের আনবিক সাহিত্য-শাখা কাব্যনাটক সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। এজন্যই তাঁর দীর্ঘ কবিতাগুলোতেও নাটকীয়তা লক্ষ করা যায়। এ পর্যায়ের রচনার মধ্যে দরিয়ায় শেষ রাত্রি এবং নয়া জিন্দেগী (১৯৫২) কবিতানাট্য দুটি উল্লেখযোগ্য।

ফররুখ আহমদ ১৯৬৯ সালে নয়া জিন্দেগী  খানিকটা পরিমার্জন করে ইবলিস ও বনি আদম শীর্ষক নামকরণ করে প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর এই রচনাটি ১৯৮০ সালে ‘কাফেলা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। মানুষ আর শয়তানের মধ্যে চিরকালীন যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিদ্যমান তা ইবলিস ও বনি আদম-এর বিষয়বস্তু। এক রাতের এই কাহিনীতে শেষপর্যন্ত মানুষকেই নাট্যকার জয়ী করেছেন। কাহিনীর আরম্ভ গভীর রাতে এবং ‘ভোরের আজানের’ আওয়াজের মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটেছে। নাট্য-কাহিনীর এই শুরু এবং সমাপ্তিতে সমগ্র মানব জাতির বিজয় দেখিয়েছেন নাট্যকার। ইবলিস ও বনি আদম কবিতানাট্যে রোমান্টিক কবি-মানসের নাটকীয় প্রকাশ ঘটেছে। এখানে কবির প্রবল আশাবাদিতার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। বর্তমান সভ্যতার যে বিকৃতি ঘটেছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মানুষ একদিন জয়ী হবেই এ আশাবাদ ফররুখের রোমান্টিক কবি-মানসে জাগ্রত ছিল। দরিয়ায় শেষ রাত্রি রচনার সময় ফররুখ আহমদ যতখানি স্বপ্নাক্রান্ত ছিলেন, নৌফেল ও হাতেম রচনার সময় তা ছিলেন না। এ সময় ফররুখ আদর্শবাদী হয়ে ওঠেন এবং তা প্রকাশ করাই তাঁর সাহিত্যের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে পরিগনিত হয়।

কবি ফররুখ আহমদ কবিতার ছন্দ-আঙ্গিক নিয়ে সর্বদাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বিশেষত কাব্যকলায় নাটকীয়তা সৃষ্টিতে তাঁর আগ্রহ বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি কবিতায় নাট্য-কৌশল প্রয়োগে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন। তাঁর ইবলিস ও বনি আদম কবিতানাট্যেও কবিতাকে সংলাপাত্মক কুশলতায় নির্মাণ করেছেন। ফররুখ আহমদের ইবলিস ও বনি আদম কবিতানাট্যে যেমন মানুষের জয় দেখিয়েছেন অনুরূপ তাঁর নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটকেও তিনি শেষপর্যন্ত মানবতাবাদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তি-মানুষের সাথে অভ্যন্তরে বাস করা ‘নফস্’ বা আত্মার সাথে ব্যক্তির যে বিরামহীন ভালো ও মন্দের দ্বন্দ্ব চলছে; নিজেকে নিজের সাথে বোঝাপড়া এবং চেতনার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে মানুষ অস্তিত্বকে ভালো অথবা মন্দ কাজে নিয়োজিত করে। ফররুখের আদর্শিক বিবেচনায় তিনি শেষাবধি মন্দের বা শয়তানের বিরুদ্ধে মানব কল্যাণকর চেতনাকে জয়ী করেছেন। তাঁর ইবলিস ও বনি আদম কবিতানাট্যেও তিনি দেখিয়েছেন- ‘ ... মাটির বুকে সর্বশেষ জয় মানুষেরি।’ এই শাশ্বত সত্যকে কবি ফররুখ আহমদ তাঁর দরিয়ায় শেষরাত্রি, ইবলিস ও বনি আদম কবিতানাট্যে বলিষ্ঠ ও দৃঢ় সাহসের সঙ্গে চিত্রিত করেছেন।

ফররুখ আহমদের নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটকের কাহিনী সরল ও একরৈখিক। এখানে সরলরৈখিক পর¤পরায় তিনি মানব-চরিত্রের সহজাত প্রবৃত্তি- যশ-খ্যাতি লাভের প্রত্যাশাকে তুলে ধরেছেন। এ কাব্যনাটকে কিংবদন্তীর চরিত্র দাতা হাতেম তা’য়ী সাথে মরুভূমির দুর্ধর্ষ রাজা নৌফেলের সংঘাত-সংঘর্ষের কারণ অনুসন্ধান করে মানব-প্রবৃত্তির এই রহস্যকে উন্মোচন করেছেন। তিনি নৌফেল ও হাতেম-এ কাব্যাঙ্গিক ব্যবহার করে অসাধারণ দক্ষতায় নাট্য-সংলাপ রচনা করেছেন। নৌফেল রাজা হওয়া সত্ত্বেও ইয়ামেনের শাহাজাদা হাতেমের মতো মানুষের ভালোবাসা এবং যশ-খ্যাতি লাভ করতে পারে নি। নৌফেল খ্যাতির নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে এবং অর্থের বিনিময়ে যশ-খ্যাতি অর্জন করতে চায়। কাহিনীর শুরুতে নৌফেলের রাজ্যে একটি মেলার আয়োজন দেখা যায়। সেই মেলায় আগন্তুক সকল গরীব-দুঃখীদের জন্য নৌফেল অবারিত দানছত্র খুলে দেয় খ্যাতি লাভের প্রত্যাশায়-

        ... দূর দূরান্তের যারা মুসাফির
    হাজার আশ্রফি পেয়ে পরিতৃপ্ত- জানাবে সকলে
    সে দান, ত্যাগের কথা। ইরান, তুরান, হিন্দুস্থান,
    মাশ্রেক, মাগরেব দেশ জেনে যাবে অত্যন্ত সহজে
    সে কাহিনী গৌরবের; পাব আমি বিপুল সম্মান
    পেয়েছে হাতেম তা’য়ী এতদিনে কূট-কৌশলে।
    দুশ্মনের কব্জা থেকে নেব আমি ইজ্জৎ ছিনিয়ে
    শাহীন শিকার তার তুলে নেয় যেমন হিকমতে।

এভাবে নৌফেলের দানছত্র খুলে দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে- মান-মর্যাদা, সম্মান-খ্যাতি অর্জন করা। নৌফেল বস্তুত অর্থের বিনিময়ে হাতেম তা’য়ীর মতো জনগণের হৃদয় জয় করতে চেয়েছে। কিন্তু নৌফেলের ঐ মেলায় আসে ইয়ামেনের এক মুসাফির; আগন্তুক নৌফেলের দান করা আশরফি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলে নাট্য-কাহিনীতে কাইমেক্স সৃষ্টি হয়। নৌফেল আগন্তুকের এ ধরনের আচরণে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে; আগন্তুকের আচরণে প্রতীয়মান হয়েছে যে নৌফেল অর্থবিত্তের বিনিময়ে যে খ্যাতি অর্জনের প্রত্যশা করছেন, তা সম্পূর্ণ বৃথা চেষ্টা মাত্র। এর ফলে হাতেমে’র সকল খ্যাতি ধুলোয় মিশিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় নৌফেল-

        ... দেশে দেশে
    পায় সে বিপুল মান অপ্রয়াসে। প্রয়াসী আমার
    মেলেনা সে খ্যাতি যশ সর্বস্ব বিলিয়ে; ঘৃণা আমি
    পাই প্রতিদানে। কুড়াই কুখ্যাতি শুধু। তাই আমি
    এ কথা ভেবেছি শেষ,- নেব লুটে তার শাহী তখ্ত্।
    রাজ্য, রাজধানী তার লুটবো ধুলায়, দেখে যাব
    কত সে দিলারী, দাতা, কত সে উদার।

এভাবে নৌফেলের দানছত্র খুলে দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে- মান-মর্যাদা, সম্মান-খ্যাতি অর্জন করা। নৌফেল বস্তুত অর্থের বিনিময়ে হাতেম তা’য়ীর মতো জনগণের হৃদয় জয় করতে চেয়েছে। কিন্তু নৌফেলের ঐ মেলায় আসে ইয়ামেনের এক মুসাফির; আগন্তুক নৌফেলের দান করা আশরফি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলে নাট্য-কাহিনীতে ক্লাইমেক্স সৃষ্টি হয়। নৌফেল আগন্তুকের এ ধরনের আচরণে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে; আগন্তুকের আচরণে প্রতীয়মান হয়েছে যে নৌফেল অর্থবিত্তের বিনিময়ে যে খ্যাতি অর্জনের প্রত্যশা করছেন, তা সম্পূর্ণ বৃথা চেষ্টা মাত্র। এর ফলে হাতেমে’র সকল খ্যাতি ধুলোয় মিশিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় নৌফেল-

        ... দেশে দেশে
    পায় সে বিপুল মান অপ্রয়াসে। প্রয়াসী আমার
    মেলেনা সে খ্যাতি যশ সর্বস্ব বিলিয়ে; ঘৃণা আমি
    পাই প্রতিদানে। কুড়াই কুখ্যাতি শুধু। তাই আমি
    এ কথা ভেবেছি শেষ,- নেব লুটে তার শাহী তখ্ত্।
    রাজ্য, রাজধানী তার লুটবো ধুলায়, দেখে যাব
    কত সে দিলারী, দাতা, কত সে উদার।

নৌফেল তাৎক্ষণিকভাবে সিপাহশালারকে ইয়ামেন আক্রমণের নির্দেশ দেয়। এই সংবাদ গুপ্তচরের নিকট থেকে পায় ইয়ামেনের যুবরাজ হাতেম। নৌফেলের রাজ্য আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য খ্যাতি লাভ করা এবং তাঁর (হাতেমের) খ্যাতিকে ভূলুণ্ঠিত করা। আর তাই হাতেম যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়- যাতে অকারণে রক্তপাত না ঘটে। কেননা হাতেম মনে করেন, যশ-খ্যাতি অর্জনের জন্য সংঘর্ষ সম্পূর্ণরূপে কাপুরুষোচিত। হাতেম বিশ্বাস করে- ‘স্বার্থান্বেষী যে-হৃদয় কলুষিত/ সে-ই শুধু খ্যাতি চায় দুনিয়া জাহানে, রিয়াকার/ প্রতিটি কর্মের মূলে আছে যার নামের বাসনা।’ শুধুমাত্র যশ-খ্যাতির জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে মানুষ হত্যার বিপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে ইয়ামেনের শাহজাদা হাতেমে-

    ইনসানের তাজা খুন অকারণে, কি দেব জবাব
    আমি, বিবেকের কাছে? হাশরে আল্লার আদালতে
    দাঁড়াবো কি-ভাবে আমি,-অভিযুক্ত খোদপরস্তীর
    অপরাধে? নৌফেল চায়না রাজ্য, লোভ নাই তার
    সিংহাসনে। যশঃপ্রার্থী প্রাণ তার খ্যাতি চায় শুধু।
    আমাকে না পায় যদি ফিরে যাবে, খুন খারাবীর
    বীভৎস অশান্তি থেকে মুক্তি পাবে তামাম দুনিয়া।

ফলে নৌফেল বিনা যুদ্ধেই ইয়ামেন অধিকার করে নেয়। তারপরও ইয়ামেনের প্রজারা হাতেমের-ই গুণগান করতে থাকে। এতে নৌফেল যুদ্ধে জয়ী হয়েও তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ না হওয়ায় প্রকৃত-প্রস্তাবে পরাজিত হয়েছে। আর তাই নৌফেল এবারে মরিয়া হয়ে ওঠে; হাতেমের নাম পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে ইয়ামেনের পলাতক যুবরাজ হাতেমের মাথার বিনিময়ে দশ সহস্র আশরফি পুরস্কার ঘোষণা করে। হাতেমকে ধরিয়ে দিয়ে সহস্র আশরফি লাভের জন্য কেউ-ই এগিয়ে আসে না। কেননা ইয়ামেনের প্রজারা যুবরাজ হাতেমকে তাদের প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসে। নাট্য-ঘটনার শেষ-পর্যায়ে এক হত দরিদ্র কাঠুরিয়া পরিবারের সদস্যদের দুঃখ-কষ্টের কাহিনী শ্রুত হয়ে হাতেম নিজেই তাদের হাতে ধরা দিয়ে তার জীবনের বিনিময়ে ঘোষিত পুরস্কারের অর্থ পাইয়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। এবারে নৌফেলের দরবারে হাতেমকে কাঠুরিয়া বৃদ্ধের নিকট বন্দী অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। কিন্তু নৌফেল একথা বিশ্বাস করতে চায় না যে বৃদ্ধ তাকে বন্দী করেছে; বরং সে বলে-

    কাঠুরিয়া এই বৃদ্ধ! এ জয়ীফ, অস্থি-চর্মসার
    তোমাকে করেছে বন্দী! একি পরিহাস?
 
পরিশেষে বৃদ্ধের মুখে হাতেমের মহানুভবতার কথা শুনে নৌফেলের অহংকার ধূলোয় মিশে যায়। কেননা নৌফেল তখন উপলব্ধি করে- যে-ব্যক্তি নিজের জীবনের বিনিময়ে অন্যের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে এগিয়ে আসে; সেই তো গরীবের হৃদয় জয় করবে এবং যশ-খ্যাতি লাভে সমর্থ হবেন। নৌফেলের মিথ্যা অহংকার ভেঙে যায় এবং সে হাতেম তা’য়ীকে বুকে জড়িয়ে ধরে তাঁর বন্ধুত্ব কামনা করে। নৌফেলের মধ্যে মানবিকতার উন্মেষের মধ্য দিয়ে নাট্য-কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে।

নাট্যকার নৌফেল ও হাতেম-এ সচেতনভাবে ইসলামী-মিথ বা কিংবদন্তীর চরিত্র হাতেম তা’য়ী’কে নাটকের নায়ক রূপে উপস্থাপন করেছেন। ফররুখ আহমদের এ কাব্যনাটকে ইসলামী-মিথ ব্যবহার প্রসঙ্গে সমালোচক বলেন-

বাংলা কাব্যে যেসব মহাকাব্য ও কাব্যনাটক রচিত হয়েছে তার বেশির ভাগেরই কাহিনী ও চরিত্র হিন্দু-পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদি এবং কিংবদন্তি ও লোককাহিনী থেকে আহৃত, কবিরা কল্পনার রং মিশিয়ে কাহিনী ও ঘটনা বিধৃত করেছেন, চরিত্র চিত্রণ করেছেন, প্রতীক ও রূপক ব্যবহার ও চরিত্র-সৃজনের মাধ্যমে শুভ ও কল্যাণের বাণী এবং মানবতাবাদী আদর্শ তুলে ধরেছেন।

কাব্যনাটকে হাতেমের মহত্বকে প্রকাশ করতে গিয়ে নাট্যকার নৌফেলকে দুরাচার শাসক হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। কিন্তু নাট্য-পরিণতিতে ইয়ামেরন যুবরাজ হাতের দিকে যে-ভ্রাতৃত্বে-বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে নৌফেলও মহৎ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ নৌফেল খল চরিত্রের আসন থেকে সরে এসেছে। নাট্যকার চেয়েছেন মনে-প্রাণে হাতেম তা’য়ীকে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করতে কিন্তু কাহিনীর বিন্যাস কাঠামোর কারণে নৌফেল-ই নাট্য-কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ নাট্য-কাহিনীর প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে নৌফেল চিত্রিত হয়েছে। নৌফেলের খ্যাতির লাভের আকাঙ্ক্ষা ছাড়া অন্যকোনো দোষ-ত্রুটির কথাও নাট্য-ঘটনায় ব্যক্ত হয় নি। হাতের যশ-খ্যাতি দৃষ্টে নৌফেলের মনোজগতে যে ঈর্ষার আগুন জ্বলেছে মানবীয় এবং মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হলে ভুল হবে না। হাতেমের কল্পনাতীত খ্যাতিতে ঈর্ষান্বিত হয়েছে মাত্র নৌফেল; শুধু এ কারণেই নৌফেল চরিত্রটিকে আমরা খল চরিত্র হিসেবে প্রতিপন্ন করতে পারি না। উপরন্তু নৌফেল যখন হাতেমের মহত্ব দেখেছে তখন সে অবলীলায় তাঁর (হাতেমের) বন্ধুত্ব কামনা করেছে-

    বুঝেছি খ্যাতির মূল্য এতদিনে, বুঝেছি এখন
    যে মানুষ প্রাণ দিয়ে করে যায় বিশ্বের কল্যাণ
    কুল মখলুকের বুকে স্থান তার; দুনিয়া জাহানে
    পায় সে বিপুল মান জীবনে অথবা মৃত্যুপারে।
    ’য়েমনের শাহজাদা! মা করো শত্রুতা আমার।

নাট্যকার ফররুখ আহমদ নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটক রচনা করেছেন- ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য। তা’য়ী পুত্র হাতেমের মহত্ব প্রকাশ করার মধ্য দিযে নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটকে ফররুখ আহমদ ইসলাম ধর্মের মহত্বকে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর এই উদ্দেশ্যবাদি প্রণোদনা যেকোনো শিল্পের মান ক্ষুণ্ন করে; অতএব এক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় হয় নি। তবে নাট্যকারের সাফল্য, তিনি দক্ষতার সাথে নৌফেল-চরিত্রে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে ফররুখ আহমদ চেয়েছেন- হাতেম চরিত্রটিকে প্রধান হিসেবে তুলে ধরতে, অথচ অবচেতনে নৌফেল চরিত্রের মানবিকতা তাকে মহৎ চরিত্রের মর্যাদায় আসীন করেছে।

নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটকের অন্যতম চরিত্র হাতেম তা’য়ী সামাজিক বিচারের মানদণ্ডেও কাপুরুষ। কেননা শত্রু কর্তৃক রাজ্য আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও যে রাজা পালিয়ে যায় নিঃসন্দেহে সে ভীরু এবং কাপুরুষ। শত্রু কর্তৃক রাজ্য আক্রান্ত হওয়ার পরও হাতেম তাঁর প্রজাদেরকে রক্ষা করার পরিবর্তে পালিয়ে গেছেন- রক্তপাত এড়ানোর বুলি আওরিয়ে; যা রাজনীতিতে অবিবেচনাপ্রসূত। রাজ-কার্য পরিচালনায় রক্তপাত এড়ানোর মতো মানবিকতা দেখানোর মধ্যে আদৌ রাজনৈতিক যৌক্তিকতা নেই। স্বদেশভূমি রক্ষার জন্য যত রক্তপাতই ঘটুকনা কেনো সেই রক্তপাতে অংশগ্রহণ করা দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব এবং কর্তব্য হিসেবে দেখা হয়। অন্যথায় হাতেমের পলায়ন কাপৌরুষর পরিচায়ক। তবে নাট্য-কাহিনীতে হাতেম চরিত্রের মহত্ব তখন প্রতীয়মান হয়- যখন তিনি তাঁর-ই রাজ্যের এক গরীব প্রজার সংসারে সুখ-সাচ্ছন্দ এবং স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।

নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটকে নারী চরিত্র মাত্র দু’টি। নাট্য-কাহিনীতে নৌফেলের বেগম একবারের জন্য উপস্থিত হলেও চরিত্রটির জীবন স¤পর্কে যৌক্তিক বোধ পাঠককে আকৃষ্ট করেছে। যদিও নৌফেলের স্ত্রী হিসেবে তার এই মানবিকতা প্রদর্শন নৌফেলের মনে বিরক্তি উৎপাদন করেছে তথাপি বেগমের যৌক্তিক এবং মানবিক জীবনবোধ অহংকারী নৌফেলকে কিছুটা বিব্রত করেছে। অন্য নারী চরিত্রটি হচ্ছে- বৃদ্ধ কাঠুরিয়ার স্ত্রী। যে নারী দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে করতে জীবন সম্বন্ধে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছে; এই নারী চরিত্রে রয়েছে ভিন্ন এক জীবনতৃষ্ণা। যেখানে দারিদ্র্যের কষাঘাতে সেই নারী আজ লোভী হতে বাধ্য হয়েছে। আর তাই এই বৃদ্ধা পাপের পথে হলেও অর্থোপার্জনের চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে। সুতরাং নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাট্যে চিত্রিত দুই নারী চরিত্র একেবারেই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। অন্যভাবে বলা যায়, একজন অপরজনের বিপরীতধর্মী।

নৌফেল ও হাতেম তিন অঙ্কের কাব্যনাটক। এর প্রত্যেকটি অঙ্কের দৃশ্য বিভাজন আছে। নাট্যকার ফররুখ আহমদ নাট্যঘটনায় দৃশ্য বোঝাতে ‘অধ্যায়’ ব্যবহার করেছেন। নাট্য-ঘটনার প্রথম অঙ্কের পাঁচটি, দ্বিতীয় অঙ্কের চারটি এবং তৃতীয় অঙ্কের পাঁচটি অধ্যায় বা দৃশ্য-বিন্যাস রয়েছে। নাট্যকার প্রত্যেক অধ্যায়ের শুরুতে ঘটনার স্থান ও পরিবেশের উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া নাটকের সূচনাতেও কাহিনীর সারসংক্ষেপ একটি কবিতার মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে। নাটকের পাত্র-পাত্রী যে সংলাপ ব্যবহার করেছে, তার অধিকাংশই আঠারোমাত্রার পংক্তি।  তাছাড়া কবি ফররুখ আহমদের কাব্য-বৈশিষ্ট্যের রীতি অনুযায়ী আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার তো আছেই। উল্লেখ্য নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটকে ‘ওয়েসিস’ শীর্ষক একটি মাত্র ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন ফররুখ আহমদ। কাব্যনাটকের সংলাপ দীর্ঘ নয়; তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় অধ্যায়ে বেগমের এবং নৌফেলের সংলাপ খানিকটা দীর্ঘ। নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটক আঠারোমাত্রার অন্তমিলহীন অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত; তারপরও কোনো কোনো সংলাপে অন্তমিল লক্ষ করা যায়। যেমন নাট্য-কাহিনীর শেষে শায়েরের উক্তিটি আঠারোমাত্রার চরণে রচিত হলেও এখানে চরণান্তে মিল রয়েছে-

    কাব্য নয়, গান নয়, শিল্প নয়,- শুধু সে মানুষ
    নিঃস্বার্থ, ত্যাগী ও কর্মী, সেবাব্রতী- পারে যে জাগাতে
    সমস্ত ঘুমন্ত প্রাণ,- ঘুমঘোরে যখন বেঁহুশ
    জ্বালাতে পারে যে আলো ঝড়-ক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতে;
    যার সাথে শুরু হয় পথ চলা জাগ্রত যাত্রীর
    দিল সে ইশারা আজ আত্মত্যাগ হাতেম তা’য়ীর॥

এখানে কবি সংলাপের অন্তমিল বিন্যস্ত করেছেন- কখ কখ গগ রীতিতে। উপমা উৎপ্রেক্ষা-রূপকের খুব একটা ব্যবহার করেন নি কবি। ফররুখ আহমদের কবি স্বভাবে যতটা উপমা তৈরীতে সক্ষম, ততটা নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটকে প্রতিফলিত হয় নি। তবে ফররুখের কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের ঢঙে দীর্ঘ উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার লক্ষণীয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের অনুকরণে উপমা প্রয়োগ করলেও ফররুখ আহমদ তাঁর কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপক-চিত্রকল্প নির্মাণে ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্যের ওপর নির্ভর করেছেন। স্বল্প সংখ্যক সংলাপে কিছু আরবি-ফারসি শব্দ ছাড়া প্রায় সকল শব্দই সাধারণের বোধগম্য হওয়ার মতো। এ কাব্যনাটকে ফররুখ আহমদ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, নাট্য-সংলাপ রচনায়। তিনি সংলাপ রচনার সময় কাব্যিকতাকে পরিমিত সীমার মধ্যে রেখেছেন।

নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটকের আলোচিত হওয়ার মতো অন্যান্য চরিত্র হচ্ছে- কাঠুরিয়ার স্ত্রী এবং তার সন্তানেরা। কেননা দেশবাসীর সকলেই যখন হাতেমকে ধরিয়ে দেয়ার বিপক্ষে, তখন কাঠুরিয়ার স্ত্রী তার স্বামীর নিষেধ উপেক্ষা করে হাতেমকে ধরিয়ে দিয়ে তাদের সাংসারিক অভাব ঘোচাতে চেয়েছে। বৃদ্ধা যখন তার সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে হাতেমকে খোঁজ করতে থাকে তখন বৃদ্ধ স্বামীর পরকালের সুখ-শান্তির উপদেশ শুনে বৃদ্ধা বলে-

        অসহ্য এ
    নসীহত। তার চেয়ে এসো খুঁজি সতর্ক সজাগ
    হাতেম তা’য়ীকে। যদি খুঁজে পাই তাকে ভাগ্যক্রমে
    ঘুচে যাবে সব দুঃখ, পাব বিশ সহস্র দিনার

বৃদ্ধার চরিত্রের মধ্য দিয়ে আরো একবার কাব্যনাটে প্রমাণিত হয়েছে- মানুষ লোভ-লালসা বিবর্জিত হতে পারে না। উপরন্তু তার যদি অভাব-অনটন থাকে তাহলে সে ধর্ম-ভয় পর্যন্ত ভুলে গিয়ে পাপ কার্য করতে দ্বিধা করে না। কেননা কাঠুরিয়া বার-বার ধর্মের দোহাই দিয়েছে তার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে, কিন্তু তারা শোনে নি। এছাড়া নৌফেল ও হাতেম কাব্যনাটকে অন্যান্য চরিত্রগুলো মূল কাহিনীর গতিশীলতার অনুষঙ্গী হিসেবে এসেছে।

ফররুখ আহমদের নৌফেল ও হাতেম বাংলাদেশের সাহিত্যে সার্থক কাব্যনাটক হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। নাট্যকার এখানে ইতিহাস চেতনাকে আদর্শ ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে একসূত্রে গ্রথিত করেছেন সচেতনভাবে। নৌফেল ও হাতেম-এর কাব্যগুণ যেমন পরিমিত তেমনি এর নাট্যগুণও যথেষ্ট শক্তিশালী। এ কাব্যনাট্যে চরিত্রের সংলাপে যথাযথ প্রাসঙ্গিক বাক্বিনিময় হওয়ায় পাঠক-দর্শক কবিতার অস্তিত্ব সম্পর্কে কখন অতি সচেতন হয়ে ওঠে না। নাট্যঘটনার বাস্তবতার সাথে সংলাপের বাস্তবতা রক্ষিত হয়েছে বলে তা কাব্যভারাক্রান্ত হয় নি। এ কাব্যনাটকে শাহ্জাদা হাতেম তা’য়ীর বিপুল খ্যাতিতে নৌফেলের ঈর্ষাজনিত মানস-সংকট এবং হাতেমের মহত্ত্বের নিকট তার পরাজয় সম্পূর্ণ আধুনিক কাব্যনাটকের বৈশিষ্ট্যানুগ। হাতেম খ্যাতির প্রত্যাশী নয়, কিন্তু নৌফেল খ্যাতি অর্জনের সকল উপায় অবলম্বন করেও তা অর্জন করতে পারে নি। উভয় চরিত্রের এই মানসিক দ্বন্দ্বের ফলে নাট্যঘটনায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু মানবতাবাদী হাতেম রক্তপাত এড়াতে বিনা যুদ্ধে তার রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যায়। অথচ সে-ই নিজের জীবনের বিনিময়ে একটি অভাবগ্রস্ত কাঠুরিয়া পরিবারে নিকট ধরা দিয়ে নৌফেলের ঘোষিত পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতে চেয়েছে। হাতেমের এই মহত্ত্বের নিকট মূলত নৌফেলের খ্যাতি অর্জনের উচ্চাকাক্সক্ষার পরাজয় ঘটে। নৌফেলের পরাজয়ে নাট্য-কাহিনীতে নাট্যকার মানবতার বিজয় দেখিয়েছেন। অতএব সামগ্রিক মূল্যায়নে বলা যায়, এলিয়টের কাব্যনাট্যের তত্ত্ব মেনে নিয়েই ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যে রচিত নৌফেল ও হাতেম সার্থক আধুনিক কাব্যনাটক।

ঙ.
কবি হিসেবে শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই শ্রেষ্ঠদের একজন। বাংলাদেশের সাহিত্যে বিশেষত কবিতায় এককভাবে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রনেমকর সংখ্যা সর্বাধিক। তাঁর কবি জীবনের সূচনা হয়েছিল প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৫৯) কাব্যগ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে। এরপরে তিনি আর পিছনে ফিরে তাকান নি। একের পর এক রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩) বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৭), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮), নিজবাসভূমে (১৯৭০), বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচনা করে বাংলাদেশের কবিতার একটি স্বতন্ত্র ঘরাণা নির্মাণ করেছেন জীবনানন্দ পরবর্তী সময়ে। শামসুর রাহমানের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের দীর্ঘ তালিকার সব রচনাই সার্থক বা শিল্পোত্তীর্ণ তা বলা যায় না। তবে তিনি বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্বতন্ত্রমাত্রায় উদ্ভাসিত। তাছাড়া স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশের কবিতায় তিনি জীবনানন্দ দাশের বলয় অতিক্রম করে একটি নবতর গতিপ্রবাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, তিনিও প্রাথমিক পর্যায়ে শক্তিমান কবি জীবনানন্দ দাশ কর্তৃক যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছেন। একথা তিনি অকপটে স্বীকারও করেছেন। তবে স্বীয় প্রতিভাবলে তিনি পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশের বলয় যথেষ্ট পারদর্শিতার সাথে অতিক্রম করেছেন।

শামসুর রাহমান মূলত কবিতা লিখতেন এবং কবি হিসেবেই তাঁর সমধিক পরিচিতি ও খ্যাতি। তবে স্বাধীনতা-পূর্বকালে তিনটি গোলাপ (১৯৬৫) শীর্ষক একটি কাব্যনাটক রচনা করেছিলেন। এর কাহিনী সহজ-সরল; নাট্য-কাহিনীতে উপস্থাপিত চরিত্রগুলোর সংলাপেও দৃঢ়তা পরিলক্ষিত হয় না। তবে তিনি নাট্যকাহিনীর সহজ-সরল উপস্থাপন কৌশল এবং সমাপ্তিতে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।

তিনটি গোলাপ কাব্যনাটকের কাহিনী- অবিভক্ত পাকিস্তানের (পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান) সাথে ভারতের ১৯৬৫ সালের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এ সময় ভারতের একদল সৈন্য পাকিস্তানের হুদায়রা নামক প্রত্যন্ত এক গ্রামে প্রবেশ করে এবং তারা শত্র“সৈন্যের অনুসন্ধান করতে করতে ঐ গ্রামের এক মসজিদে গিয়ে হাজির হয়।

হুদায়রা গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব কাব্যনাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ইমাম সাহেব তাঁর দেশকে (পাকিস্তান) ভালোবাসেন, সর্বোপরি আল্লাহর ঘর মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছে। তিনি সেই ঘরটিকেও প্রচণ্ড ভালোবাসেন। উল্লেখ্য মসজিদের ইমাম সাহেবের আপনজন বলতে পৃথিবীতে কেউ-ই নেই। শত্রু-সেনাদের আগমনের কথা ইমাম সহেব গ্রামবাসীর নিকট থেকে পূর্বেই জেনেছিলেন। গ্রামবাসীদের একজন ইমাম সাহেবকেও অন্যদের মতোই পালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু গ্রামবাসীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা মিশ্রিত শত কাকুতি-মিনতি-অনুরোধ সত্ত্বেও ইমাম সাহেব হুদায়রা ছেড়ে পালিয়ে যেতে চান নি। বিশেষত তাঁর মাতৃভূমি, চারপাশের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়াটকে তিনি কাপুরুষোচিত মনে করেছেন। উপরন্তু ইমাম সাহেব মাতৃভূমির সঙ্গে তাঁর নাড়ীর দৃঢ় বন্ধন অনুভব করেন। তবে তিনি গ্রামবাসী লোকটিকে অন্যান্যদের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ইমাম সাহেবের এই দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা অবলোকন করে আগন্তুক গ্রামবাসীও তাঁর সাথে গ্রামেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়। এরকম পরিস্থিতিতে গ্রামবাসীর মেয়ে তার বাবার খোঁজ করতে করতে মসজিদে এসে উপস্থিত হয় এবং সে-ও ইমাম সাহেবকে একই অনুরোধ করে। কিন্তু ইমাম সাহেব তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। উপরন্তু ইমাম সাহেব গ্রামবাসী লোকটিকে তার মেয়ে মরিয়মকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কেননা সে-ও তাঁর সঙ্গে হুদায়রাতে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; কিন্তু ইমাম সাহেব তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, নিজের জন্য না হলেও মেয়ে মরিয়মের জন্য তার উচিত শত্রু আসার পূর্বেই হুদায়রা ছেড়ে অন্যদের সাথে চলে যাওয়া।

ইমাম সাহেব গ্রামবাসী লোকটিকে তার মেয়ের কথা তুলে তার হুদায়রায় অবস্থান নিরাপদ নয় বোঝাতে সক্ষম হন; তখন আগন্তক গ্রামবাসী তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে প্রস্থান করে। এ সময় ঐ গ্রামের শিক্ষক ইমাম সাহেবের নিকট আসেন। শিক্ষক সাধুবাদ জ্ঞাপন করেন ইমাম সাহেবের গ্রামে অবস্থানের সিদ্ধান্তকে। তিনি নিজেও ইমাম সাহেবের মতো বিদ্যালয় আঁকড়ে হুদায়রা গ্রামেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। অতএব নাট্য-কাহিনীর যে সরল গতিপ্রবাহ তা থেকে প্রতীয়মান হয়- মসজিদের ইমাম সাহেব এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া হুদায়রা গ্রামের অন্যান্যরা হুদায়রা ত্যাগ করে অন্যত্র পালিয়ে গেছে।

এরপর নাট্য-কাহিনী দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। গ্রামে প্রবেশ করে শত্রু সৈন্য। সৈনিকের পোশাক পরিহিত দু’জন হুদায়রা গ্রামের মসজিদে প্রবেশ করে- ইমাম সাহেবের পাকিস্তানী সৈন্যদের সন্ধান জানতে চায়। কিন্তু ইমাম সাহেব ভারতীয় শত্রু-সৈন্যদের জিজ্ঞাস্য বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে সৈন্যরা উত্তেজিত হয়ে তাঁকে (ইমাম সাহেব) গুলি করে হত্যা করে। ইমাম সাহেবের বুকে পরপর তিনটি গুলি করে সৈন্যরা। এই তিনটি গুলিকে নাট্যকার প্রতীকার্থে ‘তিনটি গোলাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কেননা ইমাম সাহেব যেদিন শত্রুদের গুলিতে নিহত হন, তার আগের রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন- তিনটি টকটকে লাল গোলাপ তাঁর বুকে ফুটেছে। আর তাই মৃত্যুর সময় ইমাম সাহেব উচ্চারণ করেন-

    আমাকে গ্রহণ করো হে পাক পরওয়ার দিগার-
    কাল রাতে স্বপ্নে আমি দেখেছি তো তিনটি গোলাপ,
    আমার হৃদয়ে ফুটেছিলো তিনটি গোলাপ
    স্বর্গীয় বিভায় জানি, তিনটি গোলাপ।
 
তিনটি গোলাপ কাব্যনাটকের নাট্যগুণ নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। এখানে শামসুর রাহমান শুধুমাত্র একটি সরল কাহিনী তুলে ধরেছেন- কাব্য-সংলাপের মাধ্যমে। তিনটি গোলাপ-এর কাহিনীতে নাটকীয়তা-নাট্যদ্বন্দ্ব-নাট্যমুহূর্ত প্রভৃতি নাট্য-বৈশিষ্ট্যকে শামসুর রাহমান ফুটিয়ে তুলতে পারেন নি। তাছাড়া নাট্য-ঘটনায় চরিত্রের সংঘাত-সংঘর্ষ এবং ঘাত-প্রতিঘাতের মতো আবশ্যিক নাট্যগুণাবলীও এতে অনুপস্থিত।

তিনটি গোলাপ কাব্যনাটকের প্রধান চরিত্র ইমাম সাহেব ধর্মভীরু, বয়োবৃদ্ধ এবং দেশপ্রেমিক। অবশ্য তাঁর এই দেশ-প্রেম সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠতে পারে। আর এই কারণগুলো নিম্নরূপে বিন্যস্ত করা যেতে পারে- প্রথমত ইমাম সাহেব বয়োবৃদ্ধ; দ্বিতীয়ত তাঁর ইহজগতে আত্মীয়-স্বজন বলতে কেউ নেই। মানুষ বার্ধক্যে উপনীত হলে জাগতিক বন্ধন অনেকটা কমে যায়। উপরন্তু সেই বার্ধক্যপীড়িত মানুষটির আপনজন বলেও যদি পৃথিবীতে কেউ না থাকে, তার জাগতিক মায়া কতটুকু থাকতে পারে তা সহজেই অনুমান করা সম্ভব। সুতরাং বৃদ্ধ ইমাম সাহেবের শত্রু সৈন্যের আক্রমণের মুখে হুদায়রায় অবস্থান করা কতখানি দেশপ্রেমের পরিচয়বাহী তা নির্ধারণ অনেকাংশেই কঠিন। সুতরাং জগত-জীবনের প্রতি যার কোনো টান নেই- এই দৃষ্টিতে তিনটি গোলাপ-এর ইমাম চরিত্রটির দেশপ্রেমের বিচার করতে গিয়ে বলা যেতে পারে, তিনি বয়সের ভারে ন্যূব্জ দেহকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে বেড়াতে চান। তিনি যে মসজিদে ইমামতী করতেন, সেই মসজিদের প্রতিটি ইট-পাথরের সঙ্গে তাঁর নিবিড় একটি মমতার বন্ধন গড়ে উঠেছিল, সেই মায়া তিনি ত্যাগ করতে পারেন নি। আর এজন্যই হয়তো গ্রামবাসী লোকটি অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি গ্রাম ছাড়তে চান নি। গ্রামবাসীর মেয়ে মরিয়মের অনুরোধের প্রতি-উত্তরে ইমাম সাহেব বলেছিলেন-

    আমাদের দু’জনের পথ ভিন্ন, দু’দিকে বিস্তৃতঃ
    আমার নেই ক কোনো পিছুটান, নিঃসঙ্গ এখানে
    নিঃসন্তান পড়ে আছি এক কোণে, মহাপৃথিবীতে
    নয়ন পুত্তুলি কেউ নেই যে আমার।
 
ইমাম সাহেবের জাগতিক মায়া-মমতার বন্ধন নেই; যদি থাকতো তাহলে তিনি গ্রামবাসীদের সাথে পালিয়ে যেতেন কিনা তা বিবেচনার দাবি রাখে। আর তাই ইমাম সাহেবকে প্রকৃত কিংবা নির্ভীক-দুঃসাহসী দেশপ্রেমিক বলা যায় না।

তিনটি গোলাপ কাব্যনাটকে গ্রামবাসী এবং তার মেয়ে মরিয়ম ভিন্ন দুটো চরিত্র। কিন্তু মেয়ে মরিয়ম তার পিতার সহায়ক হিসেবে নাট্য-কাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে। মরিয়মও তার বাবার মতো ইমাম সাহেবকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে এবং তাঁর মঙ্গল চায়। মরিয়মও ইমাম সাহেবকে তাদের সাথে পালিয়ে জীবন রক্ষা করার অনুরোধ করেছে। সুতরাং নাট্য-ঘটনায় মরিয়ম স্বীয় স্বাতন্ত্র্যে-বৈশিষ্ট্যে বিকশিত চরিত্র নয়। তবে এ কাব্যনাটকের শিক্ষক চরিত্রটি নাট্য-কাহিনীতে স্বল্প সময়ের জন্য উপস্থিত হয়েও নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছে। ইমাম সাহেবকে তাঁর সমর্থন এবং নিজের বিদ্যালয়কে আঁকড়ে ধরে শত্রুসেনার বুলেটের ভয়ের মুখেও হুদায়রা গ্রামে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। এছাড়া কাব্যনাটকে উপস্থাপিত অন্য দুটো চরিত্র হলো- প্রথম ও দ্বিতীয় সৈনিক। এ চরিত্র দুটি একেবারেই টাইপ চরিত্র। সৈনিকদ্বয়ের আগমন শুধু যেন নাট্য-ঘটনার সমাপ্তি ঘটানোর জন্যই। কেননা ইমাম আগের রাতেই স্বপ্নে তাঁর বুক জুড়ে তিনটি গোলাপ ফুল ফুটতে দেখেছিলেন। সেই তিনটি গোলাপ ফোটাতেই সৈনিকদ্বয় হাজির হয় এবং ইমাম সাহেবের বুকে তিনটি বুলেট ছুঁড়ে দেয়। তারা ইমাম সাহেবের কাছে পাকিস্তানী সৈন্যদের সন্ধান জানতে চাইলে তাদেরকে সে-তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এখানে একটা বিষয় আমাদের বিবেচনায় আসে- ইমাম সাহেব আদৌ পাকিস্তানী সৈন্যদের তথ্য জানেন কিনা তা নাট্য-ঘটনায় নাট্যকার আভাসে-ইঙ্গিতেও প্রকাশ করেন নি। তবে সৈনিকদ্বয়ের জেরার মুখে ইমাম সাহেব বলেন-

    তোমাদের খুশী করবার মতো মনোহরী উত্তর আমার
    জানা নেই। কষ্ট করে নিজেরাই খুঁজে নাও, দ্যাখো
    কোন্ সে চুলোয় হাত পা সেঁকছে বসে পরম আরামে।
 
পাকিস্তানী সৈন্যদের সম্পর্কে সত্যিকার অর্থে ইমাম সাহেব কোনো তথ্য জানেন কিনা তার সমাধান এ বক্তব্যে মেলে না। তবে ইমাম সাহেবের নিকট পাকিস্তানী সৈনিকদের তথ্য থাকলে তিনি কি করতেন- তাও অস্পষ্টতায় ঢেকে গিয়েছে। কেননা শত্রুসেনা ইমাম সাহেবকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও তিনি নির্বিকার থেকেছেন। যে মানুষ মৃত্যু ভয়ে ভীত নয়, তার কাছ থেকে অন্তত জোর করে কথা বের করা যায় না, একথা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এরপর যথারীতি সৈন্যরা তাদের কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন করে; অর্থাৎ পরপর তিন রাউণ্ড গুলি করে ইমাম সাহেবকে হত্যা করেছে। এই তিনটি বুলেটকে-ই আগের রাতে স্বপ্নে গোলাপ প্রতীকে দেখেছিলেন ইমাম সাহেব। নাট্য-ঘটনায় এ ধরনের প্রতীকায়ন অতিনাটকীয়তার শামিল এবং তা অনেকটা যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা পাঠক-দর্শকের বুঝতে অসুবিধা হয় না।

আর তাই কাব্যনাটকের অন্তিম দৃশ্যে বুলেটবিদ্ধ ইমাম সাহেবের মৃত্যু- পাঠক-দর্শকের মনে করুণরসের সঞ্চার করতে পারে না। কেননা ইমামের স্বপ্নতত্ত্বের মধ্য দিয়ে পাঠক-দর্শক আগেই জেনে গিয়েছিল যে নাট্যকার ইমাম চরিত্রটির পরিণতি কী হবে। ইমামের মৃত্যু নাট্য-কাহিনীতে নাট্যকারের পূর্ব-পরিকল্পিত। অর্থাৎ নাট্যকার ইমাম সাহেবের মৃত্যুর বিষয়টি আগে থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। উপরন্তু ইমাম সাহেবের এই আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে দেশ-জাতি, সমাজের এমন কোনো কল্যাণ হয় নি- যার জন্য পাঠক-দর্শকের হৃদয়ে করুণার উদ্রেক করতে পারে। নাট্য-পরিণতিতে কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্রটির মৃত্যুর মধ্য দিয়েও নাট্যকার পাঠক-দর্শকের হৃদয়ে কারুণ্য জাগিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। ইমাম সাহেব প্রকৃত-প্রস্তাবে নিরীহ চরিত্র; যুদ্ধকালীন তাঁর মৃত্যুও একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু নাট্যকার অনেকটা জোর করেই যেন ইমাম চরিত্রটিতে অসাধারণত্ব আরোপের অশৈল্পিক প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন।

স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করে সৈয়দ শামসুল হক রচিত পায়ের আওয়ার পাওয়া যায় কাব্যনাটকের নায়িকা মাতব্বরের মেয়ের মৃত্যুতে পাঠক-দর্শককে যেভাবে বিচলিত হয়েছেন এবং তাদের হৃদয়ে ব্যথার ঢেউ তোলে- শামসুর রাহমানের তিনটি গোলাপ কাব্যনাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইমাম সাহেবের মৃত্যুতে তদ্রুপ হয় না। সৈয়দ শামসুল হকের বিষয-প্রেক্ষাপট একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ; অন্যদিকে শামসুর রাহমানের বিষয়-উপাদানও যুদ্ধ- তবে তা ভারত এবং অবিভক্ত পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬৫ সালে সংঘটিত যুদ্ধ। শামসুর রাহমান যুদ্ধাক্রান্ত একটি গ্রামের (হুদায়রা) মানুষের পলায়নের কথা উল্লেখ করছেন, কিন্তু এই পলাতক জীবনের দুঃখ-কষ্ট-গ্লানি-নির্মমতা উপস্থাপনে সচেষ্ট হন নি। বরং তিনি তিনটি গোলাপ কাব্যনাটকে একরৈখিক কাহিনী নির্মাণ করে একজন বয়োবৃদ্ধ ইমাম সাহেবের মৃত্যুর ঘটনা উপস্থাপন করেছেন। এবং সেই চরিত্রটির অন্তর্গত বিশ্লেষণেও তিনি আন্তরিক হন নি। অতএব এই সার্বিক মূল্যায়ণে শামসুর রাহমানের তিনটি গোলাপ শীর্ষক রচনাটি কাব্যনাটক হিসেবে ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র।

চ.
বাংলাদেশের কাব্যনাট্য-পর্বে আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২) স্মরণীয় নাম। তিনি মাত্র একটি কাব্যনাটক রচনা করছেন। তথাপি বাংলাদেশের কাব্যনাটকের ইতিহাসে তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি মূলত বিভাগ-উত্তর বাংলা কথা-সাহিত্য তথা বাংলাদেশের সাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর লেখনিতে দেশীয় ও সামাজিক অবস্থা গভীর মমতায় চিত্রিত হয়েছে। বিশেষত তিনি বাংলা কথা-সাহিত্যে মনস্তত্বের রূপায়ণে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪), কর্ণফুলী (১৯৬২), তেইশ নম্বর তৈল চিত্র (১৯৬০), শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন (১৯৬২) প্রভৃতি। এছাড়া তিনি অনেক গল্প লিখেও বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর রচিত- জেগে আছি (১৯৫০), ধান কন্যা (১৯৫১), মৃগনাভি (১৯৫৪), অন্ধকার সিঁড়ি (১৯৫৮), উজান তরঙ্গ (১৯৬২), যখন সৈকত (১৯৬৭), আমার রক্ত আমার স্বপ্ন (১৯৭৫) প্রভৃতি গল্পগ্রন্থে তাঁর লেখক-সত্তার সংবেদনশীল মানসের পরিচয় পাওয়া যায়। আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর একক হাতে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ যেমন লিখেছেন তেমনি নাটক রচনায়ও আগ্রহী ছিলেন। তাঁর রচিত নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- মরক্কোর যাদুকর (১৯৫৯), ইহুদির মেয়ে (কাব্যনাটক, ১৯৬২), মায়াবী প্রহর (১৯৭২), ধন্যবাদ (১৯৭২), নিঃশব্দ যাত্রা (১৯৭২), জোয়ার থেকে বলছি (১৯৭৪), মেঠো ফুলের ঠিকানা (১৯৭৫) প্রভৃতি।

বাংলাদেশের সাহিত্যে কাব্যনাট্যের সূচনা-পর্বে আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত ইহুদির মেয়ে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। তিনি নাটক রচনার ক্ষেত্রে এর সাহিত্যগুণ ও মানের প্রতি যতটা যত্নশীল ছিলেন সম্ভবত ততটা এর মঞ্চায়ন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। ফলে তিনি নাট্যকার হিসেবে খুব একটা খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করতে পারেন নি। তাঁর নাট্য-রচনায় এক ধরনের নিরীক্ষা-প্রবণ মানসিকতার পরিচয় বিদ্যমান। আলাউদ্দিন আল আজাদ দাবী করেন মায়াবী প্রহর-এর মাধ্যমে তিনি কাব্যনাটক রচনার প্রাথমিক প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন এবং ইহুদির মেয়ে রচনার মাধ্যমে সেই প্রয়াসের পূর্ণাঙ্গতা দিয়েছেন।

নাট্যকারের দাবি অনুযায়ী তাঁর মায়াবী প্রহর আলোচনা-পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এতে কাব্যনাটকের কোনো বৈশিষ্ট্যই তিনি রক্ষা করতে পারেন নি। মূলত তিনি সচেতনভাবে মায়াবী প্রহর-কে কাব্যনাটক হিসেবে রচনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন; বস্তুত মায়াবী প্রহর একটি সামাজিক নাটক। এর আখ্যান রচিত হয়েছে সমাজ-বাস্তবতার নিরিখে; এখানে তিনি উপজীব্য করেছেন শ্রেণী সংঘর্ষ। এ নাটকের সংলাপ বলিষ্ঠ এবং চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে সমাজ-জীবনের প্রকৃত বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে। নাটকের সংলাপে কাব্যময়তার প্রতিফলন ঘটেনি বরং গদ্য-সংলাপাত্মক; মায়াবী প্রহর-এর সংলাপে আঞ্চলিক ভাষা প্রাধান্য লাভ করেছে। তারপরও আলাউদ্দিন আল আজাদ মায়াবী প্রহর-কে কেন কাব্যনাটকের প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কাব্যনাটকের বিষয় হিসেবে সামাজিক আখ্যান গ্রহণীয় হতে পারে না তা নয়, তবে সেক্ষেত্রে জরুরী বিষয় হচ্ছে নাট্যাঙ্গিকে অবশ্যই চরিত্রের অভ্যন্তরীণ সংকট, জটিলতা তুলে ধরতে হবে। কিন্তু সেগুলো আলাউদ্দিন আল আজাদের মায়াবী প্রহর নাটকে অনুপস্থিত। এই বিচারে আমরা মায়াবী প্রহর-কে তিন অঙ্কের একটি সামাজিক ট্র্যাজি-কমেডি নাটক হিসেবে অভিহিত করাই সমীচীন মনে করি।

আলাউদ্দিন আল আজাদের কাব্যনাটক রচনার প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে মায়াবী প্রহর সাফল্যের মুখ দেখে নি। তবে তিনি মায়াবী প্রহর-এ যে নিরীক্ষা করেছেন তার ওপর ভিত্তি করে ইহুদির মেয়ে-তে সার্থকতা লাভ করেছেন। ইহুদির মেয়ে রচনার প্রেক্ষাপট ও ভিত্তি প্রসঙ্গে নাট্যকারের নিজের বক্তব্য হচ্ছে-

ইহুদির মেয়ে বইটা আকস্মিকভাবে লেখা, এমনকি, কতকটা দৈব যোগাযোগ বলা যেতে পারে, যদিও ওসবে বিশ্বাস নেই। জেলখানায় মনটা থাকে খেয়ালী ও স্পর্শকাতর; এবং খবরের কাগজ উত্তেজনার প্রধান অবলম্বন। খবরের কাগজে আমেরিকার একটি বিদ্যালয়ে বর্ণ-বিদ্বেষের বর্ণনা পড়ে যখন বিষণ্ন, তখন ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি জরাজীর্ণ কপি আমার টেবিলে থাকত; মাঝে মাঝে অন্যমনস্কভাবে তার পাতা ওল্টাই। একবার জেনেসিসের একটি আখ্যানে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করলাম এ বিষয়ে শিল্পায়নের একমাত্র প্রকরণ কাব্যনাট্য।
 
ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকের মূল বিষয়বস্তু প্রেম; তবে এই প্রেম স্বাভাবিক গৎবাধা প্রেমের মতো নয়। কেননা এখানে ধর্মীয় ও সামাজিক সংঘাতের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছে। এই সামাজিক-পারিবারিক-সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মধ্যদিয়ে দুটো হৃদয়ের প্রেমের বন্ধন, মুগ্ধতা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হয় ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকে। দিনা-সেচেমের পরিচয় পর্বে দিনা প্রিয়তমের উদ্দেশ্যে বলেছে-

    যদি তাই হয় সেও সৌভাগ্য আমার! কিন্তু সে তো
    সামান্য আমি যা পেয়েছি সহসা তার তুলনায়।
    আহা, একি আশ্চর্য বিজ্ঞান! এক নিমেষেই যেন
    বিদ্রোহী উদ্দাম-ঝড়ে খুলে গেল সহস্র দরোজা
    অযুত নিযুত কিংবা লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি, হায়
    তাও নয়, সত্য শুধু সংখ্যার বিরতি! লুপ্ত হয়ে
    গেছে স্থান কাল। লুপ্ত দিন, লুপ্ত রাত্রি গ্রহচন্দ্র
    তার। আমার শরীরে কি আছে সে জানা ছিল না তো?
 
নাট্যকাহিনীতে দেখা যায়, সালেমের রাজপুত্র সেচেম ভালোবেসেছে দিনাকে। এই ভালোবাসা নিঃসন্দেহে একপাক্ষিক নয়, দিনাও ভালোবেসেছে রাজপুত্র সেচেমকে। তাদের ভালোবাসা যখন গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে তখন তারা একে অপরকে নিতান্ত আপন করে পাওয়ার প্রত্যাশায় সামাজিক বন্ধনের জন্য বিয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে তারা সচেতন- তাই তারা তাদের বিয়ের প্রস্তাব দিনার বাবা ইয়াকুবের নিকট পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়; তাদের বিয়েতে দিনার বাবা ইয়াকুব সম্মত হয়। অথচ বংশ মর্যাদার অহংকার এবং লোভ-লালসার কারণে ইয়াকুবের পুত্ররা দিনা-সেচেমের বিয়েতে সম্মতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বংশ মর্যাদা প্রসঙ্গে রুবেনের উক্তি স্মরণীয়-

        ... মানুষমাত্রই এক রক্তধারা:
    বর্ণে বর্ণে ইতর-বিশেষ, জাতি-জাতি গোত্রে-গোত্রে
    আকৃতি-অশেষ; তবু মানতেই হবে যদি যুক্তি
    মূল্যবান, এ কেবল বাইরের রূপ, তার মানে
    আমরা সবাই একই আদমের বীজ, সুনিশ্চিত
    একই অস্থির রুজ্জুতে আবদ্ধ স্বর্গভ্রষ্ট জীব;
    হয়তোবা কেউ ভাগ্যগুণে ইতিহাসে সংলগ্ন,
    অথবা হয়তো কেউ নয়; কিন্তু তাতে সামান্যই
    ক্ষতি, কারণ সকলে ঠিক একই সিঁড়ির যাত্রী
    অনাদিকালের বুকে শৃঙ্খলিত অশান্ত মিছিল।

এই বংশ ও জাত্যাভিমানের নিকট ভালোবাসা পরাজিত হওয়ায় সেচেমের পিতাকে দিনার পরিবারের নিকট থেকে লাঞ্ছিত হয়ে ফিরতে হয়। অন্যদিকে দিনা-সেচেমের প্রেম এতটাই প্রবল ও গভীর যে, তাদের নিকট জাত-পাৎ নেই; তারা একে অন্যকে ছাড়া জীবনের পথ চলার মতো সাহসী নয়। অথচ লোভ-বংশীয়রা তাদের বংশমর্যাদা ও আত্ম-অহংকারে উন্মত্ত হয়ে সেমিয়ন বংশীয় সেচেমদের রাজধানী আক্রমণ করে। উভয় বংশের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধে প্রাণ হারায় নিষ্পাপ প্রেমিক সেচেম। এই সংবাদ শুনে প্রেমিকা দিনাও আত্মহত্যা করে। এই নিষ্পাপ প্রেমিক জুটির প্রেমের, পরিণয়ের প্রধান অন্তরায় হিসেবে সমাজ-সংসারের মিথ্যা অহংকার দায়ী। ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর কাহিনী অবলম্বনে কাব্যনাটক রচনাকালেও নাট্যকার আলাউদ্দিন আল আজাদের নাট্যসংলাপে যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব নাটকের প্রথমাংশেই দিনার সংলাপে পাওয়া গেছে তেমনি মহাকবি কালিদাসের প্রভাবও রয়েছে। যেমন-

        কোনো
    অমঙ্গল আসছে না তো? তা নইলে কাঁপছে কেন ডান
    চোখ? দয়াময় রক্ষা কর, যুদ্ধ মৃত্যু অসম্মান
    থেকে, দাসের গোত্রকে রক্ষা কর।

আলাউদ্দিন আল আজাদ মূলত ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর কাহিনী অবলম্বনে মার্কিনী অভিজাত শ্রেণীর আত্মাভিমান, বংশগৌরব এবং অশ্বেতাঙ্গ তথা কালোদের প্রতি ঘৃণার বাহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবতার অপমান এবং বর্ণবাদী বৈষম্যমূলক আচরণের সংবাদ শুনেই মূলত নাট্যকার ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটক রচনা করেন। মার্কিনীরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও ওল্ড টেস্টামেন্ট-এর কাহিনী অবলম্বনে রচিত ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকে তাদের গণতন্ত্রের অসড়াত্ব প্রমাণিত হয়েছে। কেননা মানব সভ্যতার বিকাশের মাধ্যমে মানুষ জেনেছে- সব মানুষের জন্মের উৎস এক। তারপরও সাদা-কালো, অভিজাত-অনভিজাতের দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিংবা পার্থক্য ঘোচে নি।

নাট্যকার আলাউদ্দিন আল আজাদ ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকের নায়ক সেচেমের কণ্ঠে যেসব সংলাপ জুড়ে দিয়েছেন, তার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি-মানুষের তথা মানব প্রজাতির প্রত্নকথা ও সত্য বেরিয়ে এসেছে। মানব-প্রজাতি যে ক্রমশ বেড়ে চলেছে, তার অভ্যন্তর বিশ্লেষণ করে প্রেম ও শরীর সম্বন্ধে অনভিজ্ঞা দিনাকে সেচেম যে সত্য উদ্ঘাটন করে দেখিয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মূলত জীব-জগতের জৈবিক প্রবহমানতার প্রকাশ ঘটেছে। যেমন-

    তুমি যে আমার বাঞ্ছিতা,
    ক্ষেত্র, এখনই বুনেছি যে বীজ, শোনো, তার থেকে
    জন্ম নেবে শিশু: যে হবে একদা অন্য শিশুদের
    পিতা, এবং তারাও দেবে উত্তরাধিকারী শত
    শত, আর এইভাবে তোমারই জরায়ুর উৎস
    থেকে ছড়িয়ে পড়ব অনেক শাখাপ্রশাখায়, আমি
    হব সমুদ্রের মতো কম্পমান এক মহাজাতি।

সেচেমের এই বক্তব্যটিকে আমরা একটি প্রবাদের মধ্যে খুঁজে পাই- ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ এটা মূলত মানব-প্রজাতির প্রত্ন-অভিজ্ঞতা; এই প্রবাদ বাক্যে দিনা-সেচেমের প্রেমের শারীরিক মিলনের বৈধতা প্রদান করেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। নারী-শরীরের রহস্য সম্বন্ধে দিনা একেবারেই অনভিজ্ঞা; কিন্তু সেচেমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হয়ে যে স্বর্গীয় সুখানুভব করেছে- সেই শরীরী আকর্ষণই তাকে প্রেমের পথে টেনে নিয়ে গেছে। আর এক্ষেত্রে দিনা ভুলে গেছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদের কথা।

বলাবাহুল্য, শরীর সম্বন্ধে অনভিজ্ঞা দিনা সৃষ্টি প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার জ্ঞান অর্জন করেছে- সেচেমের নিকট থেকে। অন্যদিকে নারী-দেহের প্রতীকী বর্ণনার মধ্য দিয়ে নাট্যকার সেচেমকে দিয়ে নারী-দেহে সাতটি স্বর্গকে আবিষ্কার করেছেন। সেচেমের প্রতীকায়িত স্বর্গ নারী-দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। দৈহিক মিলনের পরে তাই সেচেম জানায়-

    তোমার দেহের মাঝে সপ্তস্বর্গ বিরাজিত, সে কি
    আমিও জানতাম? এক সখি সোনালি কুন্তল
    স্বর্গ দুই নয়নের পাতা, স্বর্গ তিন আরক্তিম
    অধর-যুগল, স্বর্গ চার গ্রীবাতল, স্বর্গ পাঁচ
    মায়াবিনী বক্ষোমাঝে প্রস্ফুটিত যুগল বসন্ত ঃ
    স্বর্গ ছয় উরু, স্বর্গ সাত যার মাঝে সম্মিলিত
    সকল সৃষ্টির ধারা, এবং শ্রেষ্ঠও বটে, তার
    নাম উচ্চারণ ম্রিয়মাণ, দীপ্ত গোপনে গোপনে।

ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকে নাট্যকার একই সাথে দুটি বিষয়ে মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। একদিকে দিনা-সেচেমের নিষ্কলুষ প্রেম এবং সেই প্রেমকে কেন্দ্র করে জাতীয়তা ও ধর্মের সংঘাত। অন্যদিকে একই সময়ে দিনা-সেচেমের প্রেম ও পরিণয়ের সূত্রে দিনার পিতার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতাকে একাকার করে দিয়েছেন। দিনার পিতা মহামতি ইয়াকুব চেয়েছেন- সালেমীর অধিকর্তা হামরের পুত্র সেচেমের সঙ্গে তাঁর মেয়ের পরিণয়ের সূত্রে তাঁদের সাময়িক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট ঘুচে যাবে। অর্থাৎ ইয়াকুবের মতো সেচেমের পিতা হামরও আত্মীয়তার সূত্রে রাজনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য এবং জাতিগত ঐক্যের প্রতি এক শ্রদ্ধাবনত মানসিকতার পরিচয় দিয়ে বলেছেন-

            ... হে মহামতি
    ইয়াকুব, পুত্র আমার সালেমের রাজকুমার
    আর দেবের কৃপায় হামরও দীন নয়, তার
    রাজ্য শান্তিঘেরা আপনার সুতা কখনো অসুখী
    হবে না, বরং বীজে বীজে হতে পারে বেগবান
    একটি জাতির মাতা। আমার কন্যারা আছে নিন
    আপনার পুত্রবধূ করে, আসুন দু’জনে এক
    হয়ে মিশে যাই: হোক আমাদের বহু মাঠ, কিন্তু
    এক যূথ, একই বাণিজ্য এক কানুন-সনদ!

সেচেমের পিতা হামরের দেওয়া এই প্রস্তাবনাকে ইয়াকুব অবশ্য স্বাগত জানালেও তাঁর পুত্ররা জাত্যাভিমান ছাড়তে পারি নি। প্রজ্ঞাবান ইয়াকুব তার সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন বিধায় হামরের প্রস্তাবনায় রাজি হয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে ইয়াকুব বার্ধক্যের অসহাত্ব প্রকাশ করে দিনা-সেচেমের পরিণয়ের প্রস্তাবনাকে তাঁর পুত্রদের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। যেহেতু এই প্রেম ও পরিণয়ের সূত্রে গ্রথিত রয়েছে জাতি-বিভেদ, সেহেতু বৃদ্ধ ইয়াকুব পুত্রদের সঙ্গে আলোচনা না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চান নি। যদিও তিনি পিতৃত্বের অধিকারে মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত একাই নিতে পারতেন তথাপি বার্ধক্যে উপনীত ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে ইয়কুবের এটি অবশ্যই শিষ্টাচার হিসেবে চিহ্নিত হয়; উপরন্তু একথাও সত্য যে, মানুষ বার্ধক্যে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে একথার দ্বারা সে-বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সালেমীর অধিকর্তা হামরও প্রজ্ঞাবান ইয়াকুবের এই পারিবারিক আলোচনার বিষয়টিকে সম্মান করে মানবজীবনের নিয়তি-নির্ধারিত চরম বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-

    হ্যাঁ জানি বয়স এগিয়ে গেলে মানুষ সমাজের
    পিছে পড়ে যায়;
 
একথা যথার্থ প্রমাণও মিলেছে কাব্যনাটকে; কেননা মহামতি ইয়াকুবের সিদ্ধান্তের সাথে তাঁর পুত্ররা ঐক্য পোষণ করে নি। লেভি, সেমিয়ন, রুবেন সকলেই সেচেমের সঙ্গে তাদের প্রিয় বোন দিনার প্রণয় এবং একজন বিধর্মীর সাথে সেই প্রণয় পরিণয়ে পরিণত হোক তা তারা চায় নি; বরং সালেমীর অধিকর্তা হামরের প্রস্তাবকে তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে কাব্যনাটকের নাটকীয়তা চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে। এখানে একই সাথে পিতার সাথে পুত্রের দ্বন্দ্ব, প্রণয়ের সাথে ধর্ম ও জাতিবিভেদ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সেমিয়ন অত্যন্ত ঘৃণাভরে উচ্চারণ করেছেন-

    কে এই হামর হিবাইতি
    তার পুত্র ইয়াকুব এর কন্যা নিয়ে শোবে, আর
    আমরা রইব নির্বিকার! তার চেয়ে নেকড়ের
    মুখে ছিন্নভিন্ন হয়ে মরে যাওয়া ভালো!

ইয়াকুবের পুত্ররা অবশ্য পিতার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যা শোনার পর লেভি, রুবেন পিতার সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করে সেচেম-দিনার সম্পর্ককে মেনে নিতে চায়। এমতাবস্থায় সেমিয়ন একা হয়ে পড়ে; কিন্তু এতে সে নিরস্ত হয় না। বরং সেমিয়ন এই সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সালেমীদের ধর্মচ্যুত হওয়ার শর্তারোপ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, সেমিয়ন যখন সালেমীদের ধর্মচ্যুতির মাধ্যমে দিনার সাথে সেচেমের বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলে, তখন মহামতি ইয়াকুবসহ অন্যরাও তার ঐক্য পোষণ করে। এ সময়ও ইয়াকুবের বড় পুত্র রুবেন মানুষে-মানুষে ধর্মীয় কারণে বিভেদ সৃষ্টির বিপক্ষে অভিমত প্রকাশ করে সেচেম-দিনার প্রণয়কে সর্বজনীন মানবতাবাদী দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছে। কিন্তু তার একার কথায় অন্যরা রাজি হয় নি এবং তার কথা অন্যরা গ্রাহ্যও করে নি। এজন্যই ক্রোধান্বিত সেমিয়নের উদ্দেশ্যে তাকে বলতে শোনা যায়-

    কিন্তু ভেবে দ্যাখ মানুষমাত্রই এক রক্তধারা:
    বর্ণে বর্ণে ইতর-বিশেষ, জাতি-জাতি গোত্রে-গোত্রে
    আকৃতি-অশেষ; তবু মানতেই হবে যদি যুক্তি
    মূল্যবান, এ কেবল বাইরের রূপ, তার মানে
    আমরা সবাই এক আদমের বীজ, সুনিশ্চিত
    একই অস্তির রজ্জুতে আবদ্ধ স্বর্গভ্রষ্ট জীব;
    হয়তোবা কেউ ভাগ্যগুণে ইতিহাসে সংলগ্ন,
    অথবা হয়তো কেউ নয়; কিন্তু তাতে সামান্যই
    ক্ষতি, কারণ সকলে ঠিক একই সিঁড়ির যাত্রী
    অনাদিকালের বুকে শৃঙ্খলিত অশান্ত মিছিল।

মানুষে-মানুষে জাতি-ধর্ম-বর্ণের বিভেদ ভুলে গিয়ে সকল মানুষের একাত্ম হওয়ার কথা ব্যক্ত হয়েছে রুবেনের প্রস্তাবনায়। অন্যদিকে জাতিবিভেদের বিষয়টি বিবেচনার পরিবর্তে ইয়াকুবের আরেক পুত্র জুদা তাদের বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সালেমীর অধিকর্তা হামরের প্রস্তাবনাকে বিনা শর্তে গ্রহণ করার পক্ষে মত প্রকাশ করে জুদা বলেছে-

    শোনো ভাই আমার একটি কথা, জানো
    বরাবর আমি শাদাসিধে, নিতান্ত সরল, বলি
    তাই যা বুঝি, সোজাসুজিঃ এ অস্বীকার করা সত্যি
    অসম্ভব আমরা এখনো যাযাবর, একস্থান
    থেকে অন্য স্থানের পথিক-পাদান-আরাম থেকে
    মহানিম, মহানিম থেকে সাককত, সাককত
    থেকে সালেম, এখনঃ আমাদের সামান্যই ভূমি
    আর পশুঃ সালেম সম্পদশালীঃ যদি তার সাথে
    কুটুম্বিতা করে হতে পারি আমরা সম্পন্ন, দোষ
    কি তাতে শুনি? প্রথম শর্ত জীবনেরঃ বেঁচে থাকা!

উপরন্তু জুদা তার ক্রুদ্ধ ভাই সেমিয়নকে উদ্দেশ্য করে আরো বলেছে-

    আর
    এক্ষেত্রে যখন আমাদের মাঝে ভগ্নিপরিণয়
    নিষিদ্ধ, এবং যখন যেতেই হবে ওকে কারো
    না কারুর কাছে, তখন সন্ধির মধ্যে আসা ভালো
    নয়?

জুদার এই সংলাপে তার সামাজিক-রাজনৈতিক দূরদর্শিতা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে- সর্বজনীন মানবতাবাদী মতাদর্শের প্রতিফলন। জুদার কথায় এটা স্পষ্ট যে বোন দিনাকে একদিন না-একদিন বিয়ে দিতেই হবে; সে যাবেই চলে অন্যের ঘরে। সুতরাং তার সুখ-শান্তির কথা বিবেচনা করে ভাইয়ের কর্তব্য তাকে উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দেওয়া। আর সেক্ষেত্রে যদি বোনের নিজস্ব কোনো পছন্দ থাকে, তা মেনে নেওয়াই কর্তব্য। প্রাসঙ্গিকভাবে স্মরণীয় যে জুদার সংলাপের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ আধুনিক মন-মানসিকতার পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কেননা নাট্যকার এখানে যে-সময়ের ঘটনাকে বিবৃত করেছেন, তা অবশ্যই মধ্যযুগের ঘটনা। বলাবাহুল্য, জুদার এই মানসিকতার মধ্য দিয়ে মূলত নাট্যকার প্রেমকে আধুনিক মানুষের মানসিকতা দ্বারা প্রদীপ্ত করেছেন।

পিতা হিসেবে দিনা-সেচেমের প্রণয় প্রসঙ্গে ইয়াকুবের সংলাপের মধ্যে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন। আর একথার প্রমাণ মেলে ইকয়াকুবের সংলাপে-

    রমণীর মন তুমি জান না পুত্র, তাদের পক্ষে
    কিছু নেই অসম্ভব। প্রেমের বেলায় সময়ের
    কিবা মূল্য? প্রথম দর্শনে হতে পারে তীব্রতম
    আকর্ষণ! তাছাড়া যে তাকে করতে পারে নিপীড়িত
    আন্দোলিত ঝটিকার সমুদ্রের মতো সে পুরুষ
    তার প্রিয়। তাই আমাদের অতিথির বিবরণ
    হয়তো বা অবিশ্বাস্য নয়।

সেমিয়ন ছাড়া ইয়াকুবের অন্য পুত্ররা আর্থ-রাজনৈতিক কথা বিবেচনা করে যখন সকল ভাই পিতার সাথে ঐক্যমত পোষণ করে হামরের প্রস্তাবনায় সম্মত হলে, সেমিয়নের ধর্মান্ধতার চরম প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। এ সময় সেমিয়ন বলেছে, যদি সালেমীরা (সালেম-এর অধিবাসীরা) ত্বকচ্ছেদ করে তাদের ধর্ম গ্রহণ করে তবেই সেচেম-দিনার প্রণয়কে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। ইয়াকুব এবং তাঁর পুত্রগণ যখন সেমিয়নে মতের সঙ্গে ঐক্য পোষণ করে তখন হামরের ওপর সিদ্ধান্তের প্রশ্ন আসে। কেননা সে শুধুমাত্র তাঁর পুত্রের প্রণয়ের কারণে জাতি-গোষ্ঠীর সকলের ওপর এই ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি চাপিয়ে দিতে পারেন না।

ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকের নাটকীয় দ্বন্দ্ব সেমিয়নের ক্রোধ ও ধর্মান্ধতায় পূর্ণ। কেননা সেচেম বিধর্মী; শুধু এই একটি কারণে সে তাদের প্রণয়কে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে চায় নি; এবং শেষ পর্যন্ত করে নি। যার ফলে রাতের অন্ধকারে অসুস্থ সালেমীদের ওপর হায়েনার মতো আক্রমণ করে তাদের হত্যা করেছে। ইয়াকুবের বংশের রক্ত নষ্ট করার অপরাধে সেচেমের বুকে নির্দ্ধিধায় তরবারি চালিয়ে দিয়েছে। প্রিয় সেচেমের মৃত্যুতে আত্মহত্যা করেছে দিনা। সুতরাং নাট্যিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটেছে বেদনাদায়ক করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তারপরও শেষ রক্ষা হয় নি; কেননা দিনার প্রতি সেচের গভীর প্রণয়ের মূল্য দিতে গিয়ে যে সালেম-অধিবাসীরা তাদের রাজকুমারকে অনুসরণ করে, ত্বকচ্ছেদ করলো তারপরও সেমিয়ন-লেভির ধর্মীয় উন্মাদনা ও প্রতিশোধ-পরায়ণতার নিকট প্রণয়ের পরাজয় ঘটেছে।

একদিকে ধর্মচ্যুতির শর্তারোপ, অন্যদিকে রাতের অন্ধকারে কাপুরুষের মতো সালেম-অধিবাসীর ওপর আক্রমণ- এই দ্বিমুখী টানাপোড়েনে নিষ্পাপ প্রেমের করুণ পরিণতি যেমন ঘটেছে, তেমনি পিতা ইয়াকুবের হৃদয় দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষত দিনার পিতা ইয়াকুব এবং সেচেমের পিতা হামরের যে, আত্মদ্বন্দ্ব তা এটিকে আধুনিক কাব্যনাটকের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তুলেছে। ইয়াকুবের অন্তর্দহনের উদাহরণ পাওয়া যায়, যখন দিনা-সেচেমের প্রেমের পরিণয় ঘটানোর ক্ষেত্রে ধর্মীয় শর্তারোপ করে তাঁর পুত্ররা। এ সময় তিনি নিজেকেই যেন প্রশ্ন করেন-

    না-না, শর্ত দেওয়া ঠিক হল নাক, যুবক-যুবতী
    যেখানে মিলেছে পরস্পর, সেখানে সমস্ত ভেদ
    অপসৃতঃ প্রত্যেকেই আপন সম্মানে সমাসীন।
    তবে যদি একজন ইচ্ছা করে মিশে যেতে চায়
    অন্যের মাঝারে, তাহলে আলাদা কথা; তাই বলি
    শর্ত দেওয়া ঠিক হল নাক, তোমরা যেমন ভাবো
    আপনার রক্তের মর্যাদা, তেমনি তাদেরো আছে
    নিজেদের সত্তা, হতে পারে বাজে তবু তো পৃথক!

অন্যদিকে হামর ফিরে গিয়ে সেচেমের নিকট ইয়াকুবের পুত্রদের শর্তের কথা জানিয়ে বলে, ‘আত্মস্বার্থ কর বিসর্জন, নিজের সুখের চেয়ে/ বড় স্ব-জাতির সুখ, নিজ দুঃখের আঘাত ভোলো/ সকলের দুঃখের আলোকে।’  হামর পুত্র সেচেমকে এই জাতিবিভেদের কথা এবং ধর্মীয় দ্বন্দ্বের কথা জানালেও সেচেম কোনো অবস্থাতেই দিনাকে পরিত্যাগ করতে চায় নি। এজন্য সে পিতার তিরস্কার সহ্য করেছে; এবং পিতা কর্তৃক অপমানের এক পর্যায়ে সেচেম পিতাকে জানিয়ে দিয়েছে যে, দিনার জন্য সে নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও পিছপা হবে না। এমনকি তার এই ভালোবাসার জন্য রাজ্য-সিংহাসন সবকিছুই তুচ্ছ হিসেবে গণ্য হয়েছে। কেননা সেচেম মনে করে- দিনাই পৃথিবীতে তার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। পিতা হামর অবশ্য পুত্রের এই গভীর প্রণয়ের নিকট অবনত হতে বাধ্য হয়েছেন এবং সেচেমের সিদ্ধান্তকেই সাধুবাদ জানিয়ে ধর্মকে মানবতা ও ভালোবাসার নিকট তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। সেচেমের সালেম অধিবাসীর নিকট ত্বকচ্ছেদের কথা জানায়, তার কথায়- সকলেই ত্বকচ্ছেদ করেছে; অর্থাৎ ধর্মান্তরিত হয়েছে। আর এই ত্বকচ্ছেদের ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে সেচেম যে, প্রেমের নিকট ধর্ম তুচ্ছ; বরং এখানে চিরন্তন মানবতাবাদের প্রতি তার চরম নিষ্ঠা প্রতীয়মান। মহামতি ইয়াকুব প্রজ্ঞাবান; সেচেম-দিনার প্রণয়কে তিনি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ামাধীন করে এবং মানবতার দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছেন; কিন্তু পুত্রদের ধর্মান্ধতা এবং জাত্যাভিমানের নিকট পরাজিত হয়ে বৃদ্ধ পিতার যে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ তা ইহুদির মেয়ে রচনাটিকে আধুনিক কাব্যনাটকের মর্যাদায় উন্নীত করেছে।

ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকে নাট্যকার আলাউদ্দিন আল আজাদ কাব্যনাটকের গঠনগত নৈপুণ্যে পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। নাট্যকার তাঁর ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকের নিবেদন অংশে বলেছেন-

কাব্যের আবেগ আর নাট্যের সংঘাত এ দুয়ের উচ্চকিত শিখাই কাব্যনাট্য। সে জন্য বাস্তবের উপরিতলের চিত্রণের চেয়ে অন্তস্থলের দিকেই এর অনিবার্য গতি এবং মানবাত্মার সেই অংশকে প্রতিফলন করাই তার লক্ষ্য যা কতকটা দুর্জ্ঞেয় রহস্যমণ্ডিত কিংবা মহত্তর মূল্যবোধের প্রেরণায় উচুঁ গ্রামে বাঁধা। একমাত্র একে আশ্রয় করেই মুখের ভাষা কাব্য-মঞ্চরিত হয়ে উঠতে পারে। এজন্য সাধারণ নাটকের যেখানে শেষ, কাব্যনাট্যের সেখানে শুরু। সাধারণ নাটকের আবেদন কাহিনী ও চরিত্রের গ্রন্থনে ধীরে ধীরে চরমাবস্থায় গিয়ে পৌঁছে অথচ সংকটেই কাব্যনাট্যের সূত্রপাত। সঙ্গীতের রীতির মতো তার চলার গতি আভোগে নামতে পারে না বরং সর্বদা অস্থায়ী ও অন্তরাতেই অবস্থান করে।

নাট্যকারের এই মতামতের সঙ্গে মতৈক্য পোষণ করতে বাধা নেই; ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটক পাঠ শেষে এর কাব্যমাধুর্য এবং নাট্য-সংঘাত উভয়ের চমৎকার সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। কেননা নাট্যকাহিনীতে যেমন দুটো নিষ্পাপ হৃদয়ের প্রেমের আবেগোচ্ছল কাব্যিকতার প্রকাশ ঘটেছে তেমনি ‘লোভ’ এবং ‘সেমিয়ন’ বংশের আত্মমর্যাদাজনিত যুদ্ধংদেহী মনোভাব, প্রতিশোধস্পৃহা, যুদ্ধ এবং নায়ক সেচেমকে হত্যার মধ্য দিয়ে এর নাট্য-সংঘাতও চমৎকার রূপে ফুটে উঠেছে। ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটক প্রসঙ্গে সমালোচক বলেন-

আলাউদ্দিন আল আজাদ সহজাত বাস্তবানুরাগী- শোষণ এবং বিকৃতির আলেখ্য নির্মাণ তাঁর গল্পে-উপন্যাসে সহজলভ্য। সম্ভবত এ কারণেই ইহুদির মেয়ে কাব্যনাট্যে দু’টি প্রসঙ্গ- একটি দিনা-দেহে সপ্তসর্গের বর্ণনা এবং দিনা-সেচেম পরিণয়ে ত্বকচ্ছেদ শর্তারোপ, সৌন্দর্য হানিকর বলে মনে হয়।

সমালোচকের এই মন্তব্য সর্বাংশে গ্রহণ করা সমীচীন নয়; তবে ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকের একটানা কাহিনী বর্ণনার মধ্যে এই ত্বকচ্ছেদের মধ্য দিয়ে মূলত মানবতাবাদের আলোকে প্রেমকে পরখ করে নিতে চেয়েছেন নাট্যকার। উপরন্তু ‘ত্বকচ্ছেদ’ তথা ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে নাট্যকার এর নাটকীয়তাকে অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেছেন। তবে এ ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকের কোথাও কোথাও নাট্য-গতিপ্রবাহকে বিঘ্নিত করেছে এর কাব্যময় সাঙ্গিতিক সুষমা। যেমন-

    দোহাই তোমার! আর অপরাধী করো না আমায়।
    হে রূপসী তিলোত্তমা লোকালয় থেকে বহুদূরে
    একান্ত নির্জনে, যেখানে কেবল প্রপাতের গাথা
    সাগর সঙ্গমে চলা কঙ্কাবতী নদীর সঙ্গীত
    হরিণ-হরিণী আসে ধীর পা’য়ে শ্যাওলার পাড়ে
    রুপালি পাখির গান সবুজিমা আর সন্ধ্যাতারাঃ
    এই খানে ঘাসের ওপর বসে শুধু কিছুক্ষণ
    তোমাকে দেখব চেয়ে, আর শুধু দুদণ্ড আলাপ,
    মনে হয়, এ যেন আমার কত জনমের সাধঃ
    আরো কাছে এসো সখি, দয়া করে, দাও অধিকার।

আলাউদ্দিন আল আজাদের ইহুদির মেয়ে কাব্যনাট্যটি সার্বিক বিচার বিশ্লেষণ করে বলা যায়, নাট্যকার এর কাহিনী, নাট্যপ্রবাহ এবং নাট্যগ্রন্থি মোচনের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাছাড়া কাহিনীর সাথে নাট্য-চরিত্রও সঙ্গতিপূর্ণ তবে এর সংলাপ নির্মাণে নাট্যকার সর্বত্র সমান উৎকর্ষ, দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন নি। প্রসঙ্গত সমালোচকের মন্তব্য স্মরণীয়-

ইহুদির মেয়ে’-র ন্যায় পৌরাণিক এবং দেওয়ানা-মদিনার ন্যায় লোকগাথার দ্বন্দ্বসংঘাতময় কাহিনী অবলম্বন ক’রেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাব্যনাটকগুলি বিরচিত। দৃশ্যকাব্য রচনার এরূপ বিষয়বস্তু আমাদের ঐতিহ্য-ভাণ্ডারে অপ্রতুল নয়; অথচ এক্ষেত্রে আমাদের সাধনা ও অবদান সীমিত ও অকিঞ্চিৎকর। তার মুখ্য কারণ যে রঙ্গমঞ্চের অভাব, তা বলার আবশ্যক করে না।
 
ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকের কাব্যিকতা উৎকর্ষমণ্ডিত হলেও কখনো কখনো এর নাট্যসংলাপে ছন্দের পতন পরিলক্ষিত হয়। নাট্যকার আলাউদ্দিন আল-আজাদ মূলত এর সংলাপ আঠারো মাত্রার দীর্ঘ অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে নাট্য-সংলাপে কখনো আঠারো মাত্রার কম এবং কখনো বেশি মাত্রারও প্রয়োগ লক্ষণীয়। ইহুদির মেয়ে কাব্যনাটকের সংলাপের ছন্দ বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়, নাট্যকার সংলাপের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ধরে রাখতে পারেন নি। তবে সংলাপে ছন্দের এই শিথিলতাকে নাট্যকার প্রশ্রয় দিয়েছেন মূলত কাব্যনাটকের- নাটকীয়তা অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে। ফলে সংলাপের এই ধরনের ছন্দ পতনে কাব্যনাটকের কাব্যগুণ ক্ষুণ্ন হলেও নটকীয়তা রক্ষিত হওয়ায় তা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।

ছ.
বাংলাদেশের সাহিত্যে ষাটের দশকে কাব্যনাটক রচনার প্রাথমিক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল; কিন্তু এ সময় দু’একটি ছাড়া আধুনিক-অর্থে সফল কাব্যনাটক রচিত হয় নি। বাংলাদেশের সাহিত্যিকগণের মধ্যে শাহাদাৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, জসীম উদ্দীন, বন্দে আলী মিয়া, ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ কবি-নাট্যকার কাব্যনাট্য রচনার করেন। এ সময়কালে আ.ন.ম. বজলুর রশীদ কাব্যনাট্য রচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রচনাগুলোয় নাট্যগুণের অভাব, কবিতার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া তাঁর কাব্যনাটকে আধুনিক মানুষের তথা ব্যক্তির অন্তর্সংকটের চিত্রায়ন ঘটে নি; ফলে এগুলো আধুনিক-অর্থে কাব্যনাট্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। তবে শাহাদাৎ হোসেন এবং আ.ন.ম. বজলুর রশীদ কবিতার বিষয়-উপাদান নিয়ে নাটক রচনার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন বলেই পরবর্তী সময়ে আলাউদ্দিন আল আজাদের ইহুদির মেয়ে এবং ফররুখ আহমদের নৌফেল ও হাতেম-এর মতো শিল্পোত্তীর্ণ কাব্যনাটক রচিত হয়েছিল। এ দু’টি ছাড়া একাত্তর পূর্ববর্তীকালে নূরল মোমেন রচিত নেমেসিস একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। নেমেসিস প্রচলিত অর্থে সামাজিক গদ্যনাটক হিসেবে বিবেচিত হলেও এর বিষয়-উপাদান, চরিত্রের অন্তর্বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় রচনাটি কাব্যনাট্যের বৈশিষ্ট্যানুগ। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের সাহিত্যে অন্যান্য শাখার মতো কাব্যনাট্য-শাখার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে নি; তবে এ সময় কাব্যনাটক রচনার প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন অনেকেই। যার ফল একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যে পাওয়া যায়।


বাংলাদেশের কাব্যনাটক : প্রসঙ্গ বিষয়-বিশ্লেষণ

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যে ষাট-সত্তরের দশকে যেভাবে কাব্যনাট্য-চর্চা আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল, বাংলাদেশের সাহিত্যে তদ্রুপ হয় নি। কেন হয় নি, তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সৈয়দ শামসুল হক বাংলা কাব্যনাটক রচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এসময় সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটক কেবল রচিতই হয় নি, নাটকগুলোর সফল মঞ্চায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাহিত্যে কাব্যনাট্য শাখা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে পরবর্তী কালে সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য-চর্চার পথ অনুসরণ করে এনামুল হক (জ.১৯৩৭), আবদুল মান্নান সৈয়দ (জ.১৯৪৩), কাশীনাথ রায় (জ. ১৯৪৬) আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫), আবিদ আজাদ (জ.১৯৫২), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১৯৫৬-১৯৯১), সাজেদুল আওয়াল (জ.১৯৫৮), প্রমুখ কাব্যনাটক রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। এঁদের সকলেই সৈয়দ শামসুল হকের ন্যায় সার্থক কাব্যনাট্য রচনা করতে না পারলেও তাঁদের প্রয়াস বাংলাদেশের কাব্যনাট্য শাখাকে ক্রম-সমৃদ্ধির পথে নিয়ে গেছে। তাই আমরা এ অধ্যায় রচনার সময়, বাংলাদেশের প্রায় সকল কাব্যনাটকের বিষয়-আঙ্গিক বিচারের দায়ভার গ্রহণ করেছি।

সৈয়দ শামসুল হক: বাংলাদেশের কাব্যনাটকে অনন্য

বাংলাদেশের সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক (জ. ১৯৩৫) বিরল প্রতিভাসম্পন্ন লেখক। তিনি একাধারে কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার হিসেবে খ্যাতিমান। এক কথায় বলা যায়, সৈয়দ শামসুল হক সব্যসাচী সাহিত্যিক। তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু গল্প রচনার মাধ্যমে কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি সাহিত্যের একাধিক মাধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে বিচরণ করেছেন। সৈয়দ শামসুল হক রচিত কাব্যনাটকগুলো হচ্ছে- পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৫), গণনায়ক (১৯৭৬), এখানে এখন (১৯৮১), নুরলদীনের সারা জীবন (১৯৮২), ঈর্ষা (১৯৯০)।

ক. মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে রচিত। বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে এ দেশের মুক্তিপাগল সাধারণ মানুষ যখন সংগ্রামে লিপ্ত, তখন এ দেশের মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে-গ্রামে ঘটেছে অসংখ্য মর্মান্তিক ঘটনা- সেসব ঘটনার মধ্যে সতেরো গ্রামের ঘটনা ভিন্ন ধরনের ও হৃদয়-বিদারক। সতেরো গ্রামের এক হতভাগ্য বাবার সহায়তায় মেয়ের ইজ্জত পাকবাহিনী লুট করে; সৈয়দ শামসুল হক এই মর্মন্তুদ কাহিনী পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাট্যরূপে স্বাধীনতা-উত্তরকালে পাঠক-দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন। সমালোচক বলেন- ‘তবে নাটকের শুরু থেকে ক্রমপরিণতির সাথে এগিয়ে শেষ দৃশ্যে পৌঁছুলে, আমরা বিষয় সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পাই। আসলে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এ নাটক, এটা আমরা বুঝতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের এ নাটক আমাদের মানসিক বোধ, নৈতিক প্রবণতা প্রভৃতির একটা আনুভূতিক দ্বন্দ্ব জাগরিত করে।’

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একদিন সতেরো গ্রামের সাধারণ মানুষ ঐ গ্রামের মাতব্বরের বাড়িতে দলে দলে এসে হাজির হয়। গ্রামবাসী মাতব্বরের কাছে জানতে চায়- দেশের বর্তমান অবস্থা, তাদের নিরাপত্তার কথা। সতেরো গ্রামের অধিবাসীরা মাতব্বরের কথামতো যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আজ দেখছে, গ্রাম রক্ষার দ্বায়িত্বে নিয়োজিত পাকিস্তানী বাহিনী নেই; গ্রামবাসী তাই মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় ভীত-সন্ত্রস্ত। এখন তারা মাতবরের নিকট আশ্বাস চায় এবং জানতে চায় পাকিস্তানী বাহিনী নেই কেন। তাদেরকে রক্ষা করার নাম করে, পাকিস্তানী বাহিনী তাদের ওপর যে অত্যাচার করেছে তা গ্রামবাসী মেনে নিয়েছে কিন্তু আজ তারা গ্রামবাসীকে বিপদের মুখে ফেলে কোথায় পালিয়ে গেল। এমতবস্থায় মাতবর গ্রামবাসীকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়। বলে- পাকবাহিনী ধারে-কাছেই আছে কিংবা তারা যুদ্ধের নয়া কৌশল গ্রহণ করেছে। কিন্তু মাতব্বরের কথায় গ্রামবাসী আশ্বস্ত হতে পারে নি। উপরন্তু তার মিথ্যাচার ফাঁস হয়ে যায়, তার মেয়ে মঞ্চে হাজির হওয়ায়। তার মেয়ে গ্রামবাসীকে জানিয়ে দেয় বাবা (মাতব্বর) কীভাবে পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেনের হাতে আল্লার নামে তার ইজ্জত সঁপে দিয়েছিল। বিয়ের নামে সৈনিক তার শরীর ভোগ করে পালিয়ে গেছে, অর্থাৎ তার ইজ্জত লুটের জন্যই যেন বিয়ে হয়েছিল। মাতব্বরের মেয়ে তার জীবনের এই করুণকাহিনী বলার পর, গ্রামবাসীর সামনে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে।

মাতব্বরের মেয়ের ইজ্জত হরণের অভিনব করুণকাহিনী শোনার পর সতেরো গ্রামের অধিবাসীরা উপলব্ধি করে, যে মাতব্বর নিজের মেয়ের ইজ্জত পাক-বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে নি; সে তাদেরও রক্ষা করতে পাববে না। এ সময় গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং তারা একযোগে মাতবরকে আক্রমণ করে; তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের পরিসমাপ্তি ঘটেছে তবে এর শেষ দৃশ্যে দেখা যায়- মাতব্বরের দেহরক্ষীর লাঠির ভেতর রক্ষিত গুপ্তি রক্তাক্ত এবং মাতব্বর মৃত অবস্থায় মঞ্চের ওপর পড়ে রয়েছে।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের কাহিনীতে পাক-বাহিনীর দোসর রাজাকার মাতব্বরের করুণ পরিণতি চিত্রিত হয়েছে। সাধারণ গ্রামবাসীর সামনে মাতব্বরের মেয়ে যখন পাক-বাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেন কর্তৃক বিয়ের নামে তার ইজ্জত অপহৃত হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করলে পাক-বাহিনীর সহায়ক পিতার রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হৃদয় পাঠক-দর্শক প্রত্যক্ষ করেছে। তাছাড়া পিতার সামনে কন্যার আত্মহননের ঘটনা নাট্যকাহিনীকে করুণতর করে তুলেছে। গ্রামবাসীর হাতে নিহত হওয়ার পূর্বে মাতব্বর গ্রামবাসীর নিকট গ্রামে তার কবর দেয়ার আকুতি জানিয়েছে। কিন্তু গ্রামবাসী তাকে বিশ্বাস ঘাতকতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে ঐ গ্রামে কবর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে পীর সাহেবের নেতৃত্বে মাতব্বরসহ অন্যান্য সকল মৃতের জানাজা সম্পন্ন করেছে।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের প্রধান তিনটি চরিত্রের মধ্যে অন্যতম পীর সাহেব। পীর সাহেব চরিত্রটি নাট্যকাহিনীতে এক রহস্যময় মানুষ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। সতেরো গ্রামের বাসিন্দারা যেমন মাতব্বরকে শ্রদ্ধা করে, একই রকম পীর সাহেবকেও সম্মান করে। তবে পীর সাহেব কোন দলের, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নাকি পাকিস্তানীদের পক্ষে তা নাট্যকাহিনীর শুরুতে খানিকটা অস্পষ্ট। পীর সাহেব সম্পর্কে মাতব্বর নিজেও অনুরূপ মন্তব্য করেছে- একবার মনে হয় পীর সাহেব তারই দলের লোক আবার মনে হয়, তিনি ছদ্মবেশধারী মুক্তিবাহিনীর পরে শক্তি। পীর সাহেব যে দলেরই হোক না কেন নাট্যকাহিনীতে তিনি ধর্মভীরু মানুষ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন। তাঁর ধর্ম বিশ্বাসের মূলে মাতবরের মেয়ে চরম আঘাত হানার পরও তিনি শুধু ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছেন। নাট্যকাহিনীতে ধর্মের প্রসঙ্গ নাট্যকার সচেতনভাবে তুলে এনেছেন, কেননা পাক-বাহিনী ধর্মের দোহাই দিয়েই এ দেশের নিরীহ মানুষের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিল। সেসময় এ দেশের কতিপয় ধর্মব্যবসায়ী তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক-বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী এই ধর্মের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠণ, নারী নির্যাতনের মতো পাশবিক ঘটনা ঘটিয়েছে। অতএব পীরের চরিত্র এবং ধর্মের প্রসঙ্গ কাব্যনাটকে সমান্তরাল ক্যানভাসে চিত্রিত। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- মাতব্বর ধর্মের দোহাই দিয়েও পাকিস্তানী সৈন্যের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজের মেয়ের ইজ্জত রক্ষা করতে পারে নি। অথচ সেই ধর্মের নামেই তার মেয়েকে বিয়ের প্রহসন করে ক্যাপ্টেনের হাতে ভোগের নিমিত্তে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের পিতা মাতব্বরের এই ব্যর্থতা, অসহায়ত্ব নাট্যকাহিনীর ট্র্যাজিক আবেদন ঘনীভূত করে তুলেছে।

সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লন্ডনের প্রবাস-জীবনে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটক রচনা করেন। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং দেশকে পাকিস্তানী শাসন-শোষণের কবল থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে নিজেদের স্থান করে নেয়। সৈয়দ শামসুল হক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় সংঘটিত যুদ্ধের পটভূমিতে অসংখ্য বেদনাদায়ক ঘটনার মধ্য থেকে একটি গ্রামের কতিপয় মানুষের যুদ্ধকালীন ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে যে নাট্যকাহিনী নির্মাণ করেছেন তার মধ্য দিয়ে দেশের সার্বিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে। এ কাব্যনাটকের কাহিনী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, তবে নাট্যকাহিনীর অভ্যন্তরে গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে বোঝা যায়, এতে চরিত্রসমূহের মনোবিশ্লেষণে নাট্যকার অধিকতর যত্নশীল। কাব্যনাট্যের তাত্ত্বিক বিষয় সম্বন্ধে নাট্যকারের মৌলিক ধারণা স্পষ্ট থাকায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও তাঁর পক্ষে কাব্যনাটক রচনা করা সম্ভব হয়েছে। কাব্যনাটকে দর্শক শুধুমাত্র নাট্যঘটনা দেখার প্রত্যাশা করে না, নাট্যকাহিনীর সাথে সাথে কাব্যনাটকের ক্ষেত্রে দর্শক-পাঠক আরো গভীর কিছু উপলব্ধি করতে, জানতে এবং শুনতে চায়; যা তাদের যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেকের গভীরতম প্রদেশে নাড়া দেবে। কবিতার মতোই কাব্যনাট্যও জীবনের সামগ্রিকতা স্পর্শ করতে উদ্যত বলেই পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকে মুক্তিযুদ্ধের মতো রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের নেপথ্যে পিতৃ-হৃদয়ের মর্মস্পর্শী যন্ত্রণা তুলে ধরেছেন। কাব্যনাটকে মুক্তিযুদ্ধকে এই নেপথ্যের বিষয় হিসেবে উপস্থাপন প্রসঙ্গে  সৈয়দ শামসুল হক মন্তব্য করেছেন, ‘এ দেশের আট কোটি লোক মুক্তিযুদ্ধ নেপথ্যেই দেখেছে।’

কাব্যনাটকে সাধারণত একটি গল্প থাকে, তবে সেই গল্পও কাহিনীবিহীন হতে পারে। কাব্যনাটকে মূলত জীবনের, আদর্শের, দর্শনের, যুক্তির মতো বিষয়াদির পারস্পারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মাধ্যমে কাহিনী গতি লাভ করে। এজন্যই সৈয়দ শামসুল হক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকে মুক্তিযুদ্ধের মূল ঘটনাসমূহ পটভূমিতে রেখে মুক্তিযুদ্ধের আবহে দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষ-বিপক্ষ মতামত এবং অবস্থানের প্রসঙ্গ নাট্যঘটনায় অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা না থাকলেও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য অথবা ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। নাট্যকার সৈয়দ হক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকে ব্যক্তির যুদ্ধকালীন এই অবস্থানকে সুচারুরূপে উপস্থাপন করেছেন, যার ফলে পরিণতিতে এটি একটি অন্তর্নাটক হয়ে উঠেছে। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাট্যকাহিনী ক্রমান্বয়ে পরিণতিতে পৌঁছালে পাঠক-দর্শকের উপলব্ধি করতে বাকি থাকে না যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া, নৈতিকতা, মানসিকতা প্রভৃতি অনুভূতির দ্বন্দ্ব-সংঘাতে নাট্যঘটনা মুখরিত। ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের মানুষের তথা বাংলাদেশের অধিবাসীদের স্বীয় সত্তার বিকাশে একান্ত কাম্য, তথাপি কিছু মানুষ এর বিরোধিতা করেছে এবং তাদের উত্তরসূরীরা স্বাধীনতার পরেও এ দেশে বহাল তবিয়তে রয়েছে। অনুরূপ ঘটনা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের অন্তিম দৃশ্যে পীর সাহেবের মন্তব্য থেকে পাওয়া যায়, ‘দাগ, একটা দাগ রাইখা যায়।’ নাট্যকার সৈয়দ হক মূলত পাঠক-দর্শকের দৃষ্টি যুদ্ধ পরবর্তী এই বাস্তবতার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের কাহিনী গ্রামের মাতব্বর, মাতব্বরের মেয়ে, পীর সাহেব, পাইক, গ্রামবাসীগণ, একদল তরুণ এবং মুক্তিযোদ্ধাগণ প্রভৃতি চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। নাট্যকাহিনীর শুরুতে গ্রামবাসীরা ’৭১-র যুদ্ধকালে সৃষ্ট পরিস্থিতি এবং অবস্থানগত সমস্যা নিয়ে মাতবরের নিকট পরামর্শ নেওয়ার জন্য আসে। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, গ্রামবাসীর এই সমস্যা শুধু তাদের একার সমস্যা নয়, ’৭১-র যুদ্ধকালে এই গ্রামবাসীর সমস্যার মধ্য দিয়ে নাট্যকার সৈয়দ হক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকে ব্যক্তির যুদ্ধকালীন অবস্থানকে সুচারুরূপে উপস্থাপন করেছেন; এতে সেই সময়ের বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের বৃহত্তর তথা সামগ্রিক প্রেক্ষাপট চিত্রিত। গ্রামের শংকিত অধিবাসীরা মাতবরের নিকট জানতে এসেছে- পাকিস্তানীদের পরাজয়ের এখন শুধু সময়ের ব্যাপার, এমতবস্থায় তাদের করণীয় সম্বন্ধে। সাধারণ গ্রামবাসী মেজাজী না হলেও তাদের সাথে রয়েছে একদল যুবক, যুবকদলের কণ্ঠে জোরাল প্রতিবাদের উষ্মা প্রকাশ পায়। গ্রামের সাধারণ মানুষ মূলত মাতব্বরের সাথে দেখা করতে এলেও পীর সাহেবের সাথে তাদের প্রথমে দেখা হয়। পীর সাহেব প্রথমে তাদের উদ্দেশ্যে বিরক্তির সুরে বলে, ‘এই কি চাস, কি চাস তোরা?’ প্রত্যুত্তরে গ্রামবাসী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়, তারা মাতব্বরের সাথে দেখা করতে চায়। কাব্যনাটকে গ্রামবাসীর এই আগমন এবং মাতব্বরের সাথে দেখা করতে চাওয়ার মধ্যে স্পষ্টভাবে সফোক্লিসের ইডিপাস নাটকের সাদৃশ্য রয়েছে। থীবির অধিবাসীরাও রাজা ইডিপাসের নিকট তাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষার আর্জি নিয়ে এসেছিল। একইভাবে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের গ্রামবাসীরাও ’৭১-র দৈশিক অবস্থায়, তাদের রক্ষাকর্তা গ্রামের মাতবরের নিকট এসেছে।  গ্রামবাসী মাতবরের নিকট তাদের উৎকণ্ঠার কথা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে এবং এই সমূহ বিপদ থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করে। গ্রামবাসীর উদ্বেগের কারণ এবং যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক ছিল তা নাট্যকারের বর্ণনায় নিম্নরূপ-

    আমগাছে আম নাই শিলে পড়ছে সব
    ফুলগাছে ফুল নাই গোটা ঝরছে সব
    সেই ফুল সেই ফল মানুষের মেলা
    সন্ধ্যার আগেই য্যান ভর সন্ধ্যাবেলা

এ রকম ভয়ানক পরিস্থিতিতে থীবির অধিবাসীরা রাজা ইডিপাসের নিকট প্রতিকারের উপায় খুঁজে বের করার অনুরোধ করেছিল। রাজা ইডিপাস তার রাজ্যের নাগরিকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেয় এবং তদনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের গ্রামবাসীর এই সংকটকালীন সময়ে মাতবর সহজে দেখা দেয় না, বরং পীর সাহেব তাদের সান্ত্বনার বাণী শোনায়- ‘আসবে আসবে সে, না আইসা কি পারে? ঝড়ের খবর আগে পায় বড় গাছের ডাল/ বানের খবর আগে পায় যমুনার বোয়াল।’  গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে আসা যুবক দল মেজাজী, তাদের প্রতিবাদের ভাষা জোরাল। ফলে পীর সাহেবের সান্ত্বনা-বাণী শুনে যুবক দল তীব্র প্রতিক্রিয়ার ব্যক্ত করে-

    দ্যাখা যদি তিনি নাই দিতে চান
    হাতে ধইরা না, পায়ে ধইরা না,
    ঘাড়ে ধইরাই আন।

এমতবস্থায় মাতব্বর গ্রামবাসীর সামনে আসার আগেই তার নিরপত্তারী পাইক লাঠির ভিতর গুপ্তি লুকিয়ে নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হয়। অতঃপর মাতব্বর এসে জনগণের সামনে দেখা দেয়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর গ্রামবাসী তাদের আশঙ্কার কথা তাকে অবহিত করে। গ্রামবাসী তাকে জানায়-

    অনেকে কইতাছে
    আসে ঐ মুক্তিবাহিনী পূব দিক দিয়া
    যমুনা সাঁতার দিয়া
    আইজ কিংবা কাইল বড়জোর
    সক্কলের বুকের ভিতর
    কানা এক জন্তুর লাহান খালি কি য্যান লাফায়
    আর নাড়ি ছিঁড়া খায়
    কোনোদিকে কোনো কিছু না দেইখা উপায়
    সতেরো গাঁয়ের সব ছেলে বুড়া বৌ গেরস্তরা
    আইলাম আপনের কাছে। এখন কি করা?

মাতব্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে, এজন্য সে দেশের দুশমন হিসেবে মুক্তিসেনাদের চিহ্নিত করে গ্রামবাসীদেরকে তাদের নিকট থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। মাতব্বর মনে করে, মুক্তিবাহিনী দেশের শত্রু। এজন্য গ্রামবাসীকে পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিবাহিনীর বিপক্ষে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিল। দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীকে হটিয়ে, মুক্তিবাহিনী যখন এলাকার পর এলাকা দখল করে সামনে এগিয়ে আসে- তখন সতেরো গ্রামবাসী তাদের সমূহ বিপদের আশঙ্কায় তাদের নিরাপত্তার আর্জি মাতব্বরের নিকট জানিয়েছে। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিপুল বিক্রমে পাকবাহিনীকে আক্রমণে পর্যুদস্তু করার বিষয়টি গ্রামবাসীর কথায় স্পষ্ট-

    একবার মনে হইল তামাম দুনিয়া
    গরীব গেরস্তঘরে য্যান এক নতুন পোয়াতি
    বিরাট আন্ধারে শোয়া, নিভা গেছে বাতি,
    তখন উঠলে ব্যথা যেরকম থরথর করে
    সারা রাইত গ্যাছে তাই সক্কলের বুকের ভিতরে।

এ গ্রামের অধিবাসীরা মাতবরের নির্দেশানুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার পরিবর্তে কাকের মতো তাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি কাউকে মুক্তিবাহিনীর লোক বলে সন্দেহ হলে, তাকে বিনা দ্বিধায় মাতবরের হাতে তুলে দিয়েছে। কেননা মাতবর সাহেব গ্রামবাসীকে ‘আল্লার রশির গোড়া শক্ত’ করে ধরে থাকলে কোনো প্রকার ভয়ের আশংকা নেই বলে জানিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনী যখন বিজয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে- এ কথা ছড়িয়ে পড়ায় সতেরো গ্রামবাসী দুঃশ্চিন্তায় পড়ে এবং বিপদের আশংকায় মাতবরের কাছে তাদেরকে রক্ষার দাবী উত্থাপন করে। এ সময় গ্রামবাসীর দাবীর মুখে মাতবর নিশ্চুপ থাকায়, যুবকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং তাকে উদ্দেশ্যে করে বলে-

    আপনার মুখে তো আগে দেখি নাই কথার অভাব?
    কি বাহার কথা য্যান বিয়ার মজলিশে
    বুড়া বর গাও ভইরা অলঙ্কার দিছে।
    বর্ষার কইমাছ কথা ফাল পাড়ে।
    বাক্য না আমের ঝোপা ডাল ভাইঙ্গা পড়ে।

যুবক দলের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ উপহাসে মাতব্বর রাগান্বিত হয়ে বলে-

    তরে আর জানে
    বাঁচাবো না। দাও দিয়া কোপায়া কাটব।
    জিহ্বা ছিঁড়া কুত্তারে খাওয়াবো।

যুবকদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে মাতব্বর ক্ষিপ্ত হয়ে হুকুম দেয়, একজন যুবককে বেঁধে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু কেউ তার নির্দেশ পালনে অগ্রসর হয় না। এর ফলে মাতব্বরে পাইক প্রস্তাব দেয়, মিলিটারী ডেকে আনার। মাতবর জীবনে প্রথমবারের মতো গ্রামবাসীর সামনে অপমানিত হয়ে উপলব্ধি করে-

    নিতান্ত আশ্চর্য হয়া শুনতাছি কত না সাফাই;
    অথচ স্মরণশক্তি একেবারে চরে ঠ্যাকে নাই-
    এই সেদিনও আমার
    এতটুকু অপমানে মনে করছো দুনিয়া আন্ধার।

মাতব্বরের স্বগতোক্তির পর, এ কাব্যনাটকের রহস্যময় চরিত্র পীর সাহেব বলেন, ‘সময়ে ফলের গাছে অতি মিষ্টি ফল/ না ধইরা ধরে কর্মফল।’ এই সূক্ষ্ম ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যে পীর সাহেব মূলত মাতবরের কর্মের পরিণতির কথা বুঝিয়েছেন। মাতব্বরকে উদ্দেশ্য করে পীর সাহেব আরো বলেন-

    ... মানুষের মুখের কথা এমনি তাজ্জব
    নিজের কথার পরে নিজ স্বত্ত্ব নাই।
    একবার তোলা গেলে রব, হয়া যায় জনরব
    কথার মতন কথা তার কোনো পাত্রভেদ নাই।
    আরো কই, যার পায়ে রশি বান্ধা থাকে
    টান দিলে তারি পায়ে আগে টান লাগে।

নিরীহ গ্রামবাসী তাকে স্পষ্ট ভাষায় দুর্বার গতিতে মুক্তিবাহিনীর চোরাগুপ্তা হামলার কথা জানালে, মাতব্বরের অন্তরে সংশয়-আতঙ্ক বাসা বাধে। তথাপি সে বাহ্যত সাহসীর ন্যায় গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বলে- ‘ডরাইন্যার মন থিকা ছোটে/ পাথারে ভূতের ঘোড়া।’ গ্রামবাসীর আতঙ্ক, মাতব্বরের কাছে তাদেরকে রক্ষার আর্জির মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, সাধারণ মানুষ উটকো কোনো বিপদে-আপদে জড়াতে চায় না, শান্তিতে বসবাস করতে চায়। নিরুপদ্রব জীবনযাপনের জন্য সতেরো গ্রামের অধিবাসীরা মাতব্বরের নির্দেশানুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। তাই তারা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী জয়ী হচ্ছে জেনে, তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়ে। এই সমূহ-বিপদের মুখেও গ্রামবাসীর ধর্মীয় অনুভূতি-বিশ্বাসের দুর্বলাতার সুযোগ নিয়ে মাতব্বর পুনরায় তাদের সংগঠিত করতে চায়-

    আল্লার তরফে আছি আমরা যখন
    ডর নাই, কোনো ডর নাই, দুষমন
    নিজেই নিজের থিকা শেষ হয়া যাবে।
    আল্লা ছাড়া গতি নাই যে পার করাবে।
    ঈমান রাখতে পারো যদি তার পর
    আবার সলোক হবে আন্ধার ঘর।
    বিপদ শিয়াল হয়া জংগলে পলাবে।

মাতব্বর এই বক্তব্যে শেষবারের মতো গ্রামবাসীকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করার ব্যর্থ প্রয়াস পেয়েছে। মাতব্বর গ্রামের মানুষের সরল ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সম্যক অবহিত; তাই সে এই কৌশল অবলম্বন করতে পেরেছে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামবাসীও মাতব্বরের বক্তব্যের বিপক্ষে জোরাল ধর্মীয় যুক্তি উপস্থাপন করেছে। তারা যুক্তি দেখায়- তিনি (আল্লাহ) বলেছেন, ‘তোমার ভাগ্য তোমার রচনা।’ এ প্রসঙ্গে তারা নবীর (সা.) কর্মমুখর জীবনের উদাহরণও তুলে ধরেছে এবং শুধুমাত্র আল্লাহর কুদরতে বিশ্বাস করতে বলায়, মাতব্বরকে অভিযুক্ত করেছে। যুদ্ধের মোড় ঘুরে যাওয়ায় ধর্মভীরু গ্রামবাসী, মাতব্বরের কৌশলী ধর্ম ব্যাখ্যা গ্রহণ করে নি। তাছাড়া স্বভাবত ধর্মভীরু কোনো মানুষ নিজ দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে না। মাতব্বর দীর্ঘদিন ধর্মের দোহাই দিয়ে গ্রামবাসীকে ভুলিয়ে রাখলেও একসময় গ্রামবাসীর সামনে সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়ে; প্রচণ্ড অভাবের দিনেও কেন মাতব্বরের ‘থরে থরে বাগিচায় বারোমাস্যা ফুলের বাহারের’ মতো সম্পদ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। তাই বিপদের দিনে স্বার্থান্বেষী মাতব্বরের ধর্মের মিষ্টি কথায় বিশ্বাস না করে, বরং প্রশ্ন করে-

    কুদরত কারে কয়, কারে কয় বিচার আচার।
    যাদের জীবন হইল জন্তুর লাহান
    তারে কিছু দ্যাও নাই, দিয়াছো ঈমান;
    আর যারে সকলি দিয়াছো, অধিকার
    তারেই দিয়াছো তুমি দুনিয়ার ঈমান মাপার।

পাইকের মিলিটারি (পাকিস্তানী সৈন্য) ডেকে আনার পরামর্শে মাতব্বরের আশঙ্কা বাড়ে; সে শুকনো নদীর জোয়ারের শব্দ এবং পার ভাঙার শব্দ শোনে। এই ভাঙনের শব্দ মূলত মাতব্বরের অভ্যন্তরে উঠেছে ফলে গ্রামবাসী নয়, মাতব্বর নিশ্চিত পরাজয়ের শব্দ শোনে। তথাপি প্রকাশ্যে মাতবর বলে, ‘আওয়াজ কোথায়? আর কোথায় ঘোড়ায়/ কিসের সোয়ার নিয়া কোন্ দিকে যায়’ মাতব্বরের মুখের উচ্চারণ এবং হৃদয়ের উপলব্ধির ভিন্নতা ও দ্বন্দ্বের মাধ্যমে কাব্যনাট্যে অন্তর্ঘাত সৃষ্টি হয়; শেষ-পর্যন্ত গ্রামবাসীর সঙ্গে মাতব্বরের মতের দ্বন্দ্ব-সংঘাত-বৈপরিত্য-টানাপোড়েন ঘনীভূত হয়ে ওঠে। নাট্যকার নাট্যিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সংকটে পীর সাহেবের সংলাপে গ্রামবাসী ও মাতবরের এই বিপরীত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দার্শনিক ব্যাখ্যা উপাস্থাপন করেন। যেমন-

    আসলে সত্যই কন, সত্যই শোনেন, আর এখানে এই যে
    এতগুলা লোক এরা, সত্যই কইছে-
    তারা কিছু শোনে নাই। ঘটনা একটা ঘটে, দুই রূপ তার,
    নির্ভর মোকামে হইল যেখানে যাহার।

পীর সাহেবে এই দার্শনিক ব্যাখ্যাকে কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ উল্লেখ করে, সে যমুনার পার ভাঙা এবং জোয়ারের শব্দকে ‘আসলে পাপের শেষ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পীর সাহেবের এই অশনি বক্তব্যে মাব্ববর যেন অবচেতন-জগৎ থেকে বাস্তবজগতে প্রত্যাবর্তন করে। অতঃপর সে গ্রামবাসীকে শুনিয়েছে, সে আর কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছে না। তাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া তার ভাষণে বলেছে-

    যে ডরের চাবুক দিয়া কাবু করতে চাইতাছে কেউ
    তারা হইল মুক্তিবাহিনীর ফেউ
    রাইতের আন্ধারের সুযোগে গেরামে
    নাইমা পড়ছে। তবে, বাপ দাদা ময়মুরুব্বির নামে
    এখনো মোমের বাতি যদি গোরস্থানে
    জ্বালাইয়া থাকি রোজ, ঠিক তবে নিজের সিথানে
    জ্বালায় রাখবো এক সাহসের দিয়া।
    তুফানের নদী দিয়া
    বদর বদর,
    ডর নাই, পার হয়া যাবোই সত্ত্বর।

মাতব্বর নিজে নিশ্চিত পরাজয়ের কথা উপলব্ধি করেও মুক্তিবাহিনীকে ভয় করার যৌক্তিকতা নেই বলে গ্রামবাসীকে মিথ্যে আশ্বস্ত করতে চেয়েছে। এমতবস্থায়ও মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রামবাসীকে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে। তার ভাষায়-

    আরো কথা পরিষ্কার পানির মতন, শোনো কই
    জঙ্গে জয়-পরাজয় আছে নিশ্চয়ই
    তয় শোনো সব
    ইয়া তখনি সম্ভব
    যখন কব্জির জোর সমান সমান।
    সৈন্যের সাথে কি পারে মাটির কিষাণ?

এ সময় মাতব্বরের অকাট্য এই যুক্তি পীর সাহেব কোরান শরীফ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে খণ্ডন করে বলেন, কখনো কখনো তুচ্ছ শক্তিও বিরাট শক্তিকে পরাজিত করতে পারে। তুচ্ছ হলেও মুক্তিবাহিনীর শক্তিকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে পীর সাহেব আবাবিল পাখি কর্তৃক বাদশাহ আবরাহার হাতির পালের ধ্বংসের কথা মাতব্বরকে স্মরণ করিয়ে দেন।

পীর সাহেবের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি মুক্তিবাহিনীর শক্তিকে ছোট করে দেখেন নি। পীর সাহেবের পাকিস্তান-বিরোধী বক্তব্যে, মাতব্বর তার ওপর বিরক্ত হয়। এজন্য মাতব্বর পুরুষানুক্রমে তাকে লালন-পালনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাছাড়াও এ সময় মাতব্বর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকবাহিনীর গৃহীত ব্যবস্থাদির কথাও পীর সাহেব ও গ্রামবাসীদেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। মাতব্বরের দৃঢ় বিশ্বাস যে, মুক্তিবাহিনীর এই প্রতিরোধ সুসংগঠিত পাকিস্তানী সৈন্যের সামনে খুব অসহায় হয়ে পড়বে, বা মোকাবিলা করতে পারবে না। এজন্য সে অনেকটা গর্বভরে গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বলে-

    আরো শোনো, উড়া জাহাজের ঝাঁক ১০/২০/২৫ হাজার
    চক্কর দিতাছে তারা, যদি বোমা মারে একবার
    পিঁপড়ার মতো মারা যাবে মুক্তিবাহিনী তোমার।

মাতব্বরের এই বক্তব্যের পর গ্রামবাসী কিছুটা আশ্বস্ত হয় এবং তারা গৃহে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। কিন্তু এ সময় তাদের মনে নতুন একটা সন্দেহ জেগে ওঠে। ফলে গ্রামবাসীর ফিরে যাওয়া স্থগিত হয়; ফলে নাট্যকাহিনী পুনরায় ঘটনার আবর্তে জমে ওঠে। গ্রামবাসী মতব্বরের কথায় আশ্বস্ত হয় বটে কিন্তু তারা জিজ্ঞেস করে-

    ... এই শুক্কুরে শুক্কুরে সাতদিন হয়া যায়,
    গেরামের তল্লাটে তিরসীমায়
    একটা মেলেটারির নামগন্ধ নাই।

গ্রামবাসীর এই সন্দেহের পরিপ্রেক্ষিতে মাতব্বর তাদেরকে আশ্বস্ত করার জন্য বলে, ‘এমনকি গতকাইলও ক্যাপ্টেন সাব ঘুইরা গেছে।’ মাতব্বরের এই কথা গ্রামবাসী অবিশ্বাস করে বলে, ‘মিছা কথা সব।’ যখন গ্রামবাসী-মাতব্বরের কথোপকথনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে নাট্যঘটনা ভারাক্রান্ত তখন মাতব্বরের মেয়ের উপস্থিতিতে নাট্যঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয় এবং চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। নাট্যকাহিনীর এই জায়গায় মাতব্বরের মেয়ের নাটকীয় উপস্থিতি, সমগ্র নাট্যঘটনায় অভিনব মাত্রা সংযোজন করেছে। নাট্যকাহিনীকে গতিশীল করতে এ ধরনের আকস্মিকতা ব্যবহার করেছেন নাট্যকার। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পক্ষে কাজ করার পরও তাদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে মাতব্বর নিজের মেয়েকে রক্ষা করতে পারে নি। তারই জীবন্ত প্রমাণ হিসেবে নাট্যঘটনায় মাতব্বরের ধর্ষিত মেয়ে মঞ্চে উপস্থিত হয়ে গ্রামবাসীকে সে-খবর অবহিত করেছে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, মাতব্বর নিজেই মেয়েকে ক্যাপ্টেনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে মাতব্বরের রাজনৈতিক জীবনের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। আত্মসম্মান ও ধর্ম রক্ষার তাগিদে মাতব্বর শুধু কালেমা পড়ে মেয়েকে পাক-ক্যাপ্টেনের হাতে তুলে দিয়েছিল। পাক-হানাদার বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনের সামনে গ্রামের প্রতাপশালী মাতব্বরের এই অসহায়ত্ব নাট্যঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। কেননা যে মাতব্বর সমস্ত গ্রামবাসীকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে, সে নিজেই তার মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। পাক-বাহিনীর সাহায্যকারী হওয়া সত্ত্বেও নিজের মেয়ের ইজ্জত রক্ষায় ব্যর্থ মাতব্বরের করুণ ঘটনার সাথে শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত দুই সৈনিক উপন্যাসের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এ উপন্যাসের মখদুম হাজীও আইয়ুব শাসনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে ’৭১-এ সরকারের সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করেন। তিনি উপযাচক হয়ে নিজের বাড়িতে পাক-সৈনিকদের চা’য়ের নিমন্ত্রণ করেন। হাজী-কন্যাদের হাতের রান্না খেয়ে মেজর হাকিম ও ক্যাপ্টেন ফৈয়াজ তৃপ্ত হয়। মখদুম হাজীর রাতের নিমন্ত্রণে দুই অফিসার বৈঠক ঘরে মদ্যপান করে মাতাল অবস্থায় হাজীর দুই মেয়ে সাহেলী-চামেলীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মখদুম ধর্মীয় ভিত্তিতে পাকিস্তান টিকে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করলেও আদরের মেয়েদেরকে অফিসারদ্বয়ের সাথে বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অতঃপর সাহেলী-চামেলীকে অফিসারদ্বয় জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে গেলে, মখদুম হাজী লজ্জায়-ঘৃণায়-ক্ষোভে আত্মহত্যা করে জীবনের যন্ত্রণা নিবারণ করেন। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের মাতব্বর সাহেব আত্মহত্যা করে নি, তাকে গ্রামবাসী হত্যা করেছে। তবে মাতব্বরের রাজনৈতিক-জীবনের অসহায়ত্বে পাঠক-দর্শকের মনে কিছুটা করুণা ও সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। বিশেষত তার মেয়ের ইজ্জত হারানোর ঘটনা চাপা দেওয়ার অপপ্রয়াসের মধ্য দিয়ে নাট্যঘটনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কেননা তার মেয়ে গ্রামবাসীর সামনে সশরীরে উপস্থিত হয়ে, পিতার বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং সবিস্তারে আড়ালের ঘটনা তাদেরকে অবহিত করেছে। নারীর জীবনের সমস্ত আবেগ মিশ্রিত সতীত্ব হারানোর বেদনায় রক্তাক্ত মেয়ের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়-

    আর সুখ নিজের মেয়ের? কন, কি হইলো তার?
    -জিগ্যাসা করেন তারে, এক রাত্রি পরে
    সাধের জামাই তার নাই ক্যান ঘরে?
    রাত্রি দুইফরে
    সে ক্যান ফালায়া গেল আমার জীবন
    হঠাৎ খাটাশে খাওয়া হাঁসের মতন?
    -করেন জিগ্যাসা।

মাতব্বর যে-ধর্মের বাঁধনে, ছলনায় গ্রামবাসীকে ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছে; সেই ধর্মের নামেই মেয়ে পিতার কৃতকর্মের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমনকি মেয়ে ধর্ম সম্পর্কে পিতার সম্যক অবহিত না হওয়ার অভিযোগও জনতার সামনে দায়ের করেছে। উপরন্তু মাতব্বরের মেয়ে তথাকথিত ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রুপাত্মক বাক্যবাণ ছুঁড়ে দিয়েছে। এমনকি মাতব্বরের মেয়ে তার জীবনের সকল ঐশ্বর্য, সম্পদ হারিয়ে ধর্ম সর্বোপরি আল্লাহর অস্তিত্বেও সন্দেহ পোষণ করেছে। মেয়ের এই অনলবর্ষী বক্তব্যের সামনে প্রতাপশালী পিতা মাতব্বর নীরব থাকতে বাধ্য হয়েছে তবে ধর্মের বিরুদ্ধে তার এ ধরনের সন্দেহ প্রকাশ করায় পীর সাহেব তাকে হুঁশিয়ার করেছে। মাতব্বরের মেয়ের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে কাহিনীর সমস্যা-সংকুল নাট্যগ্রন্থির মোচন ঘটেছে। ‘মেয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে তার পিতার সমস্ত কার্যকলাপের তীব্র প্রতিবাদ করে। না বুঝে, ধর্মকে ধারণ করার বিরুদ্ধে তীব্র বাক্যবাণ হানে। বিদেশী ভাষায় শেখা ধর্মীয় পাঠের অসারতা, আল্লার উপর সম্পূর্ণ অবাস্তব নির্ভরতার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করে। নিজের জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা, ঐশ্বর্য ধুলোয় মিশে যাবার পর তার বিদ্রোহ কাহিনীতে চরম উত্থান ঘটায়।’  মাতব্বরের মেয়ের করুণকাহিনী শোনার পর গ্রামবাসী মাতব্বরের বিচার দাবী করে। তাদের এই বিচারের দাবী শুনে, মেয়ে আরো ক্ষতবিক্ষত কণ্ঠে বলে-

    আপনেরা বিচার চান, কারণ সামনে আছে দিন, আরো দিন
    আরো শষ্য, আরো কত হালখাতা, তারাবাজি, আহ্লাদের দিন।
    আপনেদের দুঃখেরও দিন আছে, আরো কত কষ্টের দিন,
    বান, খরা, সাপের ছোবল, কত ব্যারাম অচিন,
    সুখের দুঃখের দিন।
    আমার কি আছে? গ্যাছে সুখ
    য্যান কেউ নিয়া গ্যাছে গাভীনের বাঁটে যতটুক
    দুধ আছে নিষ্ঠুর দোহন দিয়া। সুখ নাই এখন সংসারে
    দুঃখেরও শক্তি নাই দুঃখ দেয় আবার আমারে-
    যেমন বিষের লতা, তারও জন্ম নাই কোনো নুনের পাহাড়ে।

মাতব্ববরের মেয়ের এই হৃদয়বিদারক হাহাকার ধ্বনি যেন যুদ্ধকালের এ দেশের হাজার নারীর কথা। এসব বীরাঙ্গনারা মাতব্বরের মেয়ের মতো প্রতিবাদটুকু পর্যন্ত করতে পারে নি। তাদের অনেকেই পরিণতিতে হয়তো মাতবরের মেয়ের মতো ধুতুরার বিষ পান করে, আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে এ দেশের অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম পাকবাহিনীর বর্বর সৈনিক কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়েছে; এদের সকলের কথা হয়তো জানাও সম্ভব হয় নি। কিংবা এরা সকলেই প্রতিবাদ করে ধর্মের-দালালদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়ে যেতে পারে নি। তবে মাতব্বরের মেয়ে আত্মহত্যা করলেও গ্রামবাসীর মনে একটি আদর্শকে জাগিয়ে দেয়। সে গ্রামবাসীকে জানায়, ধর্মের নামে তাদেরকে শোষণ-নির্যাতন করা হয়। সেই নির্যাতনের হাত থেকে মাতবরের মেয়ে হয়েও সে রক্ষা পায় নি।

এরপর নাট্যকাহিনী দ্রুত ভিন্নখাতে মোড় নেয়। এতক্ষণ গ্রামবাসী মাতব্বরের বিরুদ্ধে চাপা একটা ক্ষোভ দেখিয়েছে কিন্তু সরাসরি কোনো মন্তব্য করার সাহস দেখায় নি। মাতব্বরের মেয়ের মৃত্যুর পর, তাদের সে-ভয় দূরীভূত হয়েছে। এবার তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেয়ের লাশ নিয়ে, তার মৃত্যুর জন্য দায়ী মাতব্বরের বিচার দাবী উত্থাপন করে। তারা আর মাতব্বরের কেনো অনুরোধ শুনতে নারাজ, তাদের এখন একটাই কথা-

    আছে দরকার। আছে জরুরী কারণ।
    যতটা না তুমি মন্দ বইলা দিবা তোমার জীবন
    তারো চেয়ে, তোমারে যে মন্দ হইতে দিছি সর্বজন
    তারই জন্যে চাই আইজ তোমার মরণ।
    যদি না তোমার রক্ত গেরামের সড়ক ভিজাবে
    তবে আবার কি ভাবে
    মানুষ সড়ক দিয়া মাথা তুইলা যাবে?

গ্রামবাসীর এই বক্তব্য থেকে মাতবর নিশ্চিত বুঝতে পারে, সে আর সাধারণ জনতার নিকট ক্ষমা পাবে না। কিংবা তার এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।  তাই সে গ্রামবাসীর নিকট একটা শেষ অনুরোধ করে, তার মৃত্যুর পর যেন এই গ্রামেই তাকে কবরস্থ করা হয়। কিন্তু গ্রামবাসী তার এই  প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তাদের মতে, শত্রুর শেষ রাখতে নেই, এমনকি তার চিহ্ন পর্যন্ত গ্রামবাসী রাখতে চায় নি। কিন্তু এ সময় এই কাব্যনাটকের রহস্যময় চরিত্র পীর সাহেব সেই স্মরণীয় উক্তিটি করে-

    উঠাইয়া নিলেই কি সব কি উঠান যায়
    দাগ, একটা দাগ রাইখা যায়
    মাটিতে সে দাগ সহজে কি যায়?

পীরসাহের এই উক্তির লক্ষ্য স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মন্তব্য, সন্দেহ নেই। সেই দাগ মুছতে না পারার কারণে, আজো এ দেশে পাকিস্তানী-দোসরদের দৌরাত্ম অব্যাহত রয়েছে। মাতব্বরের অনুরোধ রক্ষায় অপারগতা প্রকাশ পরপরই নাট্যমঞ্চ মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে যায়। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকে মুক্তিবাহিনীকে এই একবারই মঞ্চে দেখা যায়। অতঃপর মাতব্বরের দেহরক্ষী পাইকের হাতে রক্ষিত গুপ্তির আঘাতে মাতব্বরের মৃত্যু ঘটে এবং নাট্যকাহিনীর সমাপ্তি ঘটে।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকে কাহিনীর প্রচলিত-অর্থে দৃশ্য বিভাজন না থাকলেও সৈয়দ শামসুল হক অত্যন্ত কৌশলে ‘ফ্লাশ ব্যাকে’র মাধ্যমে পাঠক-দর্শককে নাট্যঘটনার অভ্যন্তরে দক্ষতার সঙ্গে প্রবিষ্ট করিয়েছেন। অবশেষে চরম নাটকীয়ভাবে মাতব্বরের মেয়ের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে নাট্যঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। পীর সাহেব সরলপ্রাণ ধার্মিক; অন্যদিকে মাতব্বর রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহাকারী মানুষ। তাই মাতব্বরের সঙ্গে পীর সাহেবের আদর্শিক দ্বন্দ্বের বিষয়টি নাট্যকাহিনীতে স্পষ্ট। পাকিস্তানীদের সাহায্যকারী মাতব্বর মুক্তিবাহিনীর বিপক্ষে গ্রামবাসীকে সংগঠিত করেছে। কিন্তু শেষ-পর্যন্ত বর্বর হানাদারবাহিনীর হাতেই তার মেয়ে সম্ভ্রম হারায়। এ ঘটনায় মাতব্বরের অদূরদর্শিতা, অসহায়ত্ব ও চারিত্রিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এই অপরিণত রাজনৈতিক জ্ঞানের কারণে মাতবর নিজের মেয়ের ইজ্জত রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে; উপরন্তু পিতৃহৃদয়ের মহাত্ম্যে কলংক লেপন করেছে।

পীর সাহেবের আচরণ রহস্যময়। সরল ধর্মপ্রাণ পীর সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে থাকলেও তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য তাঁকে রহস্যময় করে তুলেছে। তবে নাট্যকাহিনীর অন্তিম মুহূর্তে তাঁকে গ্রামবাসীর সঙ্গে একাত্ম হতে দেখা যায়, অর্থাৎ দৃশ্যতও তিনি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পীর সাহেবের ভাবনার সঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রাথমিক যে বিরোধ, তা মূলত ধর্মের সঙ্গে বস্তুজাগতিক জীবনের অসামঞ্জস্যের। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, ধর্মে যদি কারো নিষ্ঠা থাকে, শুধু সেজন্য তাকে আমরা নর্ঞ্থক চিন্তাচেতনার মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি না। প্রাথমিক বিচারে পীর সাহেবকে মাতব্বরের লোক বলে মনে হলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে গ্রামবাসীর তথা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। পীর সাহেবের অন্তিম অবস্থান স্পষ্ট করে নাট্যকার তাঁর চারিত্রিক রহস্যময়তা দূর করেছেন।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকটির আঙ্গিক খুব একটা বেশি আঁট-ঘাট বাঁধা নয়। এ কাব্যনাটকে প্রধান চরিত্র বেশি নয়, মাত্র তিনটি; তবে অভিনীত হওয়ার জন্য একদল গ্রামবাসীর দরকার হয়। এ কাব্যনাটকে মাত্র একটি দৃশ্য পরিকল্পিত হয়েছে। তবে নাট্যকার কাব্যনাটকে নিবেদনে মাতব্বরের মেয়ের মঞ্চে প্রবেশের অব্যবহিত পরে একটা বিরতির কথা উল্লেখ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক দিনের ঘটনাসজ্জায় এ কাব্যনাটকটি রচিত। নাট্যসংলাপে পূর্ব-বঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সংলাপ রচনার সময়, নাট্যকার নিজের মতো করে উপভাষার পরিমার্জন-পরিবর্তন করে নিয়েছেন। এ কাব্যনাটকের ভাষা প্রসঙ্গে নাট্যকারের নিজের মন্তব্য- ‘... আমাদের শ্রমজীবী মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতাই হচ্ছে এক ধরনের কবিতাশ্রয়ী উপমা, চিত্রকল্প, রূপকল্প উচ্চারণ করা- আমাদের রাজনৈতিক শ্লোগানগুলো তো সম্পূর্ণভাবে ছন্দ ও মিল নির্ভর;’- এ প্রেক্ষিতেই তিনি নাট্য-চরিত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সংলাপ রচনা করেছেন। আঞ্চলিক ভাষায় কত চমৎকার কবিতাধর্মী নাট্যসংলাপ রচিত হতে পারে তা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের সংলাপে প্রতীয়মান। তবে নাট্যকার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার স্বাভাবিক প্রবণতার প্রতি বিশেষ সতর্ক থেকেই নাট্যসংলাপ রচনায় প্রয়াসী ছিলেন। নাট্যকারের উপভাষা ব্যবহারের দক্ষতা অসাধারণ শিল্পিত সৌকর্যে প্রকাশ পেয়েছে এ কাব্যনাটকে। যেমন- তয়> তবে, হয়া> হইয়া বা হয়ে, শরীল> শরীর, কাইল> কাল, রাইত> রাত, আন্ধার> অন্ধকার, অরে> ওকে, বান> বাঁধ, সক্কলে> সবাই বা সকলে, দিতাছি> দিচ্ছি, তুইলা> তুলে, ছুইটা> ছুটে, আষ্টেপিষ্টে> আষ্টেপৃষ্ঠে, লাহান> মতো বা রকম, হইলো> হলো, জুয়ান> জোয়ান প্রভৃতি আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। ভাষাগত ও কাব্যসৌন্দর্য নির্মাণে নাট্যকার যেমন সচেতন ছিলেন তেমনি সংলাপে কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, প্রতীকের পর্যাপ্ত  উৎকৃষ্ট ব্যবহার করেছেন।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মঞ্চনাটক হিসেবেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। যদিও নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক মনে করেন, ‘কাব্যনাট্য লেখা হয় পাঠকের জন্য’  তথাপিও তাঁর রচিত প্রথম কাব্যনাট্য পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। বিদেশেও এই নাটকের মঞ্চায়ন সাফল্য অর্জন করেছে। আবদুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশনায় ‘থিয়েটার’ নাট্যগোষ্ঠী নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন করে। ‘থিয়েটার’ নাট্যগোষ্ঠী এই নাটকটি সম্বন্ধে এক মন্তব্যে বলেছে:

এক.    আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নিয়ে রচিত একটি স্বার্থক নাটক প্রযোজনা করার বাসনা আমাদের দীর্ঘদিনের। আমাদের কাছে দর্শকদের এ ধরনের একটা প্রত্যাশা ছিল।
দুই.    সত্যিকার অর্থে একটি কাব্যনাট্য মঞ্চস্থ করার ইচ্ছা আমাদের ছিল।
তিন.    আমরা চেয়েছি প্রযোজনায় দর্শকদের বৈচিত্র্যের স্বাদ উপহার দিতে। আমাদের অনেক শ্রমের ফসল পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এর প্রযোজনাকে নাট্যমোদীরা যেভাবে সাধুবাদ জানিয়েছেন তাতে আমরা অভিভূত হয়েছি।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাট্য বাংলাদেশের কাব্যনাটকের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। নাটকটির সফল মঞ্চয়ান পরবর্তীকালে কাব্যনাটকের অভিযাত্রাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। এই বিচারে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় বাংলাদেশের কাব্যনাটকের ইতিহাসে পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচ্য। এ কাব্যনাটকের আঞ্চলিক সংলাপ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য থাকলেও এর ভাষা দুর্বোধ্য নয়, উপরন্তু গণমানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি ভাষায় নাট্যসংলাপ রচনা করে সৈয়দ শামসুল হক সাধারণ মানুষের নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রান্তিক মানুষও সাহিত্যের রস গ্রহণের অধিকারী। জনমানুষের অধিকার বঞ্চিত সাহিত্য কেনোদিন যে তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না, তা বুঝতে পেরেই নাট্যকার তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন।  তিনি বাংলাদেশের সর্বাধিক গৌরবান্বিত ইতিহাসের কাহিনী ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নিয়ে এ দেশের সমাজ, সংস্কৃতি সর্বোপরি গণমানুষের জীবনবোধ এ কাব্যনাট্যে উপস্থাপন করেছেন। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটকের অনুপম নাট্যকাহিনীর অবিচ্ছেদ্যতার পাশাপাশি নাট্যকারের কাব্য-প্রতিভার চমৎকার সমন্বয় সাধিত হয়েছে। সামগ্রিক বিচারে সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় বাংলাদেশের প্রথম সার্থক ও উৎকৃষ্ট কাব্যনাটক। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কাব্যনাটক হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।

[লেখকের গবেষণা-অভিসন্দর্ভ ‘বাংলাদেশের কাব্যনাটক : আঙ্গিক ও বিষয়-বৈচিত্র্য’ এর পরিমার্জন ও পুনর্লিখিতরূপ পাঠকদের জন্য সংক্ষিপ্তাকারে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হলো]

অনুপম হাসান : পিএইচ.ডি. গবেষক ও প্রাবন্ধিক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়