Full premium theme for CMS
না-মানুষি জমিন
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[আনিসুল হকের উপন্যাস অবলম্বনে]
মঞ্চ অন্ধকার হয়। স্ক্রিনে আসে অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রের ছবি। গ্রাফিক্সের মাধ্যমে একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা, সাথে অফ ভয়েজ-
‘১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস। দুশ বছর ইংরেজ শাসনের পর, বিশ্বের অন্যতম নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ পাকভারতকে বিভক্ত করা হলো। দিল্লির ভাইসরয়ের অফিসের টেবিলে ম্যাপ ফেলে একটি দেশকে দুভাগ করার দায়িত্ব দেয়া হলো লন্ডনের ম্যাপ বিশেষজ্ঞ র্যাডক্লিফকে। কোনোদিন ভারতে পা ফেলেননি র্যাডক্লিফ, তার কাছে ভারত মানে টেবিলের উপর ছড়ানো ঐ ম্যাপ। পেন্সিল দিয়ে দাগ কেটে কেটে ভাগ করা হলো একটি দেশকে।
দু’ভাগ হয়ে গেল হাজার বছরের এক ভাষা, এক কৃষ্টি, এক সংস্কৃতির উর্বরভূমি বাংলাও। কী অদ্ভুত!’
(দূর থেকে একজন আগন্তুক দৌড়ে আসছে। এক কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ আর অন্য কাঁধে একটা ক্যামেরা। হাতে তার একটা বাঁধানো খাতা। সে দৌড়াচ্ছে এবং ক্রমাগত দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে একটা জনপদে এসে থামে সে। সেখানে চলছিল ওদের স্থানীয় এক উৎসব)
আগন্তুক
এই এলাকার নাম কী?
লোক ১
এইটা হইল্ হলদিবাড়ি।
আগন্তুক
আর ওই পাড়ের নাম?
লোক ১
নলচেবাড়ি কয় বাহে।
(আগন্তুক খানিকটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে কাঁটাতারের বেড়া। সে আরো এগিয়ে যায় সামনের দিকে)
লোক ২
আর সামনত্ যাইয়েন না বাহে। কাটাতারের বেড়ার বগলত্ গেলে ওমরা ফির গুলি করি দিবার পারে।
আগন্তুক
গুলি করতে পারে নাকি?
লোক
গুলি কেমন না করে। এটে কোনাই তো সীমুর মাও রানিকে গুলি করিয়া মারছে।
আগন্তুক
সীমু!
লোক ১
সীমুক চেনেন না বাহে? সীমু হইল সীমানা, বর্ডারত্ জন্ম তো তাই সীমানা।
আগন্তুক
আর রানি?
লোক ২
তাকও জানেন না?
আগন্তুক
ওই যে একটা বাঁদর-
লোক ১
বান্দর। হ, তোমরা কবার পারেন বান্দর। হামারা কই জিন। জিন না হইলে কাঁয়ো মানষের চায়া ভালা কাম করে। যে দুনিয়া পড়ছে, মানষে করে বান্দরের কাম, বান্দরে করে মানষের কাম।
আগন্তুক
আচ্ছা, ঠিক কোন জায়গায় সীমু থাকতো?
লোক ১
ওই ওটেকোনা।
লোক ২
কিসের ওটেকোনা। আল্লার কসম ওটো তো নোয়ায়। এইখান থাকি তিন মাইল দক্ষিণত্।
লোক ৩
আরে কিসের তিন মাইল দক্ষিণত্, মাইরি বলছি এই জায়গা তো হামার বাড়ির বগলত্ হয়।
লোক ১
আরে কী কন বাহে। ওটে তো নোয়ায়।
লোক ২
হয় হয়। উনার বয়স হইল্। তুমি যা কন বাহে ওটাই ঠিক।
আগন্তুক
আপনারা মনে করতে পারেন, সীমু কখন জন্ম নিয়েছিল? তার জন্মবৃত্তান্ত মনে আছে আপনাদের?
লোক ১
ওহ বাহে, সীমু জন্ম হইছিল্ যে বছর খুব ঠাণ্ডা পড়লো। কী হ্যাল পড়ছিল। এমন শীত পড়ছিল্ যে চারদিক সাদা হয়া গেছিল বাহে। এক হাত কী আধা হাত দূরতও কোনো কিছু দেখা যায় না। খালি সাদা আর সাদা। আন্ধার যে সাদা হইতে পারে বাহে, ওই দিন হামারা বুঝিছিনো। শীতে বাঁশঝাড়ত বাঁশের পাতা ঝরে পড়ার মতো শালিক পাখি মরিয়া একেবারে মনে করেন বাঁশঝাড়ের তলটা ঢাকিয়া ফেলছিল; হাগামোতার জায়গা থোয় নাই পর্যন্ত। সেই শীতের দিনত্ কুয়াশার চাদরের তলত্ সীমুর জন্ম হইছিল্ ...
লোক ২
সীমুর জন্ম নিয়া দুইপারের মানুষই ম্যালা কথা বলাবলি করে।
লোক ৪
সীমুর জন্ম হইছিল ভোরবেলায়।
লোক ৫
সীমান্তে জন্ম হইছিল সেজন্যে তার নাম সীমানা। সেই থাকি সীমা, তারপরত্ সীমু।
লোক ৬
সীমানা নামটা বর্ডারে ফ্লাগ মিটিং করি রাখা হয়। কাঁয়ো কাঁয়ো চাইছিল নাম রাখা হোক মৈত্রী, কিন্তুক সেইটা কইতে অসুবিধা বলি বাতিল হয়া যায়।
লোক ৩
তার কোনো পদ-পদবি নাই।
লোক ৫
সীমুর জন্ম হইছিল না মানুষি জমিনত্। খোলা আসমানের তলত্। সে ওই জন্মস্থানেই বড় হইছিল একা একা।
লোক ৪
সে আছিল একটা ছইয়ের নিচত্।
লোক ৫
সীমু নামের ছাওয়াকে রানি লালনপালন করতো।
লোক ৬
রানি একটা বান্দরের নাম।
লোক ৭
একটা ছোট ছাওয়া একটা বান্দরক্ লালনপালন করছিল এই না মানুষি জমিনত্।
লোক ৬
এই এটা কী কলু, না না আসল কথা হইল রানি নামের একটা বান্দর ছোট একটা ছাওয়াক্ লালন-পালন করতো এই না মানুষি জমিনত্।
লোক ১
জন্মের বেলায় সীমুর মাও মরি গেছিল।
লোক ২
সীমুর মায়ের নাম আছিল্ পল্টুর মাও।
আগন্তুক
পল্টুর মা থেকে সীমুর মা হয়ে ওঠা নারীটির সেই দিনগুলোর বর্ণনা পাওয়া যায় নলচেপাড়ার গ্রামপঞ্চায়েত ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হরিহর মজুমদারের এই বাঁধানো খাতায়।
সবাই
কোনঠে বাহে দেকি দেকি।
(ওরা একে একে পড়তে থাকে)
লোক ১
পল্টুর বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছে বছর দশেক আগে।
লোক ২
ওরা থাকতো রাজধানী শহরে। যে শহর নলচেপাড়া থেকে বহু মাইল দূরে।
লোক ৩
পল্টুর মা কাজ করে ওই রাজধানী শহরের বিখ্যাত দরগা এলাকার গলিতে মিঠাইয়ের দোকানে।
লোক ১
পল্টুর বাবা একটা এমব্রয়ডারির ফ্যাক্টরিতে কাজ করে।
লোক ২
পল্টুর মা অন্যদিনের মতোই মিঠাইয়ের দোকানের রান্নাঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যায়।
লোক ৩
তার পেটে সাড়ে আট মাসের বাচ্চা, যেকোনো সময়ই বিয়োতে পারে।
লোক ৪
পল্টুর মার ইদানিং বড্ড খিদে পায়। কারিগরের চোখ এড়িয়ে সে একটা লাড্ডু মুখে পুরতে যায়, কিন্তু না, তখন তার পল্টুর কথা মনে পড়ে।
আগন্তুক
পল্টুর বয়স ৮ বছর। সে দরগায় কাওয়ালি গায়। ওর কাওয়ালি গাওয়া শুনে সবাই তাজ্জব বনে যায়। কী তার গলার জোর, কী তার টান...
(দরবারে পল্টু কাওয়ালি শুরু করে, ‘তোরি সুরাত কে বালহারি নিজাম.... অ্যায় খুদা....’)
(সাইরেন দিয়ে পুলিশের গাড়ি এসে থামে। হোটেলের সবাই এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। পুলিশ পল্টুর মাকে ধরে ফেলে)
পুলিশ ১
বলচি, দোকান তো ভালই সাজিয়েচো, দু-একখানা হাঁড়ি তো মাঝে মাঝে পাঠাতেও পারো, নাকি?
দোকানদার
কী বলচেন দারোগা বাবু, গত পরসুই না এক হাড়ি দিয়ে এলুম।
পুলিশ ১
ওই হলো। সেটা কি মনে আচে নাকি। তা তোমার এখানে নাকি কিসব ইল্লিগ্যাকে কাজ দিয়েচ, খবর পেলুম।
দোকানদার
সেকি বাবু, বলচেন কী?
পুলিশ ২
স্যার পেয়েচি।
পুলিশ ১
নিয়ে আয়। সালি ইল্লিগ্যাল মাইগ্রান্ট। পেয়েচি তোকে, চল।
পল্টুর মা
না না আমি ইল্লিগাল না। আমার রেশন কার্ড আচে স্যার। ভোটার লিস্টে নামও আচে।
পুলিশ ১
ওরে বাবা... ঠিক আচে, তবে দেখা কার্ড।
দোকানদার
দারগা বাবু, আমি বলচি কী, কোতাও কোনো ভুল হচ্চেনা না তো? মানে আমি ওকে চিনি...
পল্টুর মা
স্যার, কার্ড সাথে নেই। আমার কার্ড আমার ঘরে স্যার।
পুলিশ ১
চুপ সালি। মিথ্যে বলা হচ্চে? অবৈধভাবে রয়েচ তার আবার কার্ড, চল সালি চল।
পল্টুর মা
না, আমার স্বামী- আমার পল্টুকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। ও চাচা আপনি তো জানেন... আমি যাবো না...
পুলিশ ২
যাবি না। চল সালি চল।
পল্টুর মা
তোমরা যদি নিতেই চাও তালিপরে আমার স্বামী-সন্তান সমেতই নাও।
(পুলিশ তার কথা পাত্তাও দেয় না। পল্টুর মা চিৎকার করতে থাকে তারস্বরে। পুলিশ তার কোমড়ে দড়ি পরাতে এসে দেখে তার কোমড়ে দড়ি লাগবে ডাবল, তখন পল্টুর মাকে হাতকড়া পরিয়ে সেই কড়ার ভেতর দিয়ে দড়ি টেনে নিয়ে গিয়ে অন্য বন্দির কোমড়ে পেঁচানো হয়। এদের মধ্যে নানা বয়সের নারী, শিশু, পুরুষ মানুষ আছে। দড়ি বাঁধা অবস্থায় একপাল ভেড়ার মতো তারা একজনের পেছনে একজন হাঁটে। পল্টুর মার উঁচু পেট এই কাফেলার গতি শ্লথ করে দেয়)
(পুলিশের গাড়ি এসে সীমান্ত ফাঁড়িতে থামে। ধরে আনা সবাইকে ফাঁড়ির ভেতর আনা হয়। পুলিশ এদের বুঝিয়ে দেয় সীমান্তরক্ষীদের কাছে)
অসীম
ঘোষ বাবু লেট করে ফেললেন, সেই ককন থেকে অপেক্ষা করচি বলুন।
পুলিশ
সরি, বুঝেনই তো পথে কতো হ্যাপা। নিন চালানটা বুঝে নিন।
অসীম
এই হরেণ, এদিকে আয় রসিকলালকে নিয়ে চালানটা বুঝেনে। আপনি বসুন ঘোষ বাবু।
হরেন
রসিকলাল।
রসিকলাল
যাই দাদা।
হরেন
জলদি এসো। হুম নাও চল মালগুলোকে সাইড করি।
(সীমান্তের ফাঁড়ির হেড বাবুর্চি রসিকলাল। রসিকলাল মুখে টর্চ মেরে মেরে মাথা গোনে। মেয়েদের মুখশ্রী পরিমাপ করে, শিশুদের দেখে মায়া বোধ করে। কিন্তু টর্চের আলো পল্টুর মায়ের মুখ থেকে বুক হয়ে পেটে নামতেই রসিকলাল যেন সাপের কামড় খায়)
রসিকলাল
এরা করেচে কী! এই রকম একটা পুওয়াতিক কাঁয়ো ধরি-পাকড়ি আনে? এই, তোমার সাথে কাঁয়ো আছে?
(পল্টুর মা কোনো জবাব দেয় না। শুধু হাঁপাতে থাকে)
রসিকলাল
এই অমল, এটে খানা নিয়ায়। মা, খাবারটা খায়া নাও। তোমার নিজের জন্য না হোক, পেটের বাচ্চার জন্য একনা তো খাও মা।
(‘একটু জল’ ‘মরে গেলাম’ ‘হায় ভগবান দয়া কর’ সহ নানা আর্তি কাফেলার মুখে। বালতি থেকে ঘটি করে সবার মুখে জল ঢেলে দিতে থাকে অমল। আরেকজন শালপাতার ঠোঙায় খাবার বিলি করছিল। পুলিশ রক্ষীদের কাছে ওদের বুঝিয়ে দেয়। ফাঁড়ি কমান্ডার ঢুকলে সবাই এটেনশান হয়)
কমান্ডার
সব ঠিক হ্যায়?
অসীম
ইয়েস স্যার।
পুলিশ
স্যার, সব প্রসেস শেষ, এখানে একটা সই দিয়ে দিন প্লিজ।
কমান্ডার
হুম। হামাদের উপারহি চপালেন?
পুলিশ
স্যার সরকার চায় না বিষয়টা জানাজানি হোক। আপনার বর্ডারটা তো ঝামেলাহীন নির্ঝঞ্জাট। সেজন্যই...
কমান্ডার
আচ্ছা, জামেলাহীন (চোখ পরে ফাঁড়ির বাইরে ঘুরঘুর করা স্থানীয় সাংবাদিক পরিমল মজুমদারের দিকে) অসীম বাবু, এ আফাদ কাঁহাসে আয়া, দিস বাসটার্ড হ্যাজ ডগ’স নোজ।
অসীম
স্যার এর আগের পুশব্যাক- ইন-আউট নিয়ে মেলা জল ঘোলা হয়েচে।
পুলিশ
এবার কিন্তু কেয়ারফুলি হ্যান্ডল করতে হবে স্যার। আমি চলি স্যার।
পরিমল
ক্যাপ্টেন সাব, এনি নিউজ হ্যায়?
কমান্ডার
নো। নো নিউজ।
পরিমল
এই আদমিদের ধরে এনেচেন কেনো?
অসীম
আমি ধরে আনিনি তো...ইয়ে .... আমার ঠিক জানা নেই... আমাকে বলা হয়েচে এরা রাতে এখানে থাকবে। এদের আশ্রয় দাও। আমি আশ্রয় দিচ্চি। খানা দিতে বলেচে- রসিকলাল খানা দিচ্চে।
পরিমল
তারপর কাল এদের কী হবে?
অসীম
আমার জানা নাই মজুমদার সাব। তবে একটা কথা বলি, কোনো কিছুই রিপোর্ট করবেন না প্লিজ।
পরিমল
আমি কী রিপোর্ট করবো না করবো সেটা আমার ওপরই ছেড়ে দিন না।
কমান্ডার
আচ্ছা ছোড় দিয়া, লেকিন আপনি ইস ফাঁড়িসে আয়া নেহি, কুচ দেখা নেহি, অর আপকে সাথ হামারি কই বাতভি নেহি হোয়ি। (একটা সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দেয়) বুজলেন?
পরিমল
না ঠিক বুঝতে পারলাম না।
কমান্ডার
নিন, ফরেন হ্যায়। আই রিকোয়েস্ট ইউ নট টু রাইট অ্যাবাউট দিস।
পরিমল
কিছু না লেখলে আমার চাকরি যে থাকে না ক্যাপ্টেন সাব।
কমান্ডার
তো র্ফি লিখিয়ে না, ওরেঞ্জ- কম্লা নিয়ে লিখিয়ে। ইতনা সারা কম্লা উস্পার যা রাহা হ্যায়, ওহাসে উইন্টার ক্লথস আ রাহা হ্যায়, মোটে মোটে জ্যাকেট আ রাহা হ্যায়, ওসব নিয়ে লিকুন না।
পরিমল
আপনার চৌকি এলাকা দিয়ে তো কমলা-শীতবস্ত্র বিনিময় হচ্ছে না, না কি বলেন? আমাকে মিসলিড করার চেষ্টা কেন করছেন ক্যাপ্টেন সাব। এমন একটা এলাকায় থাকি, কোনো খবরই এখানে জন্মায় না। একটা-দুটো এক্সক্লুসিভ খবর দিতে না পারলে তো চাকরি থাকে না। (সিগারেটের প্যাকেটটা ফেরত দেয়)
কমান্ডার
আরে রাখ্লি জিয়ে, টেস্ট ভাল লাগেনি?
পরিমল
না, দারুণ।
(চলে যায়)
কমান্ডার
এ কোই ইনডিসিপ্লিন কি বাথ নেহি হোনে চাহিয়ে।
অসীম
ওকে স্যার। (কমান্ডার চলে যায়) এই , রাতে ঘুমালে চলবে না। চোখে চোখে রাখতে হবে যেন কেউ পালিয়ে যেতে না পারে। আমি একটু ব্যারাক থেকে আসচি।
রক্ষী ১
হুম, ডিসিপ্লিন। কিসের ডিসিপ্লিন? কে মানচে ডিসিপ্লিন? খালি অর্ডার।
রক্ষী ২
আরে ইয়ার, গোসসা মাৎ করো।
রক্ষী ১
মাইরি বলচি, মাঝে মাঝে ইচ্চে হয় ডিসিপ্লিনটা শিখাই ওদের। সালা তো পাছা খুলে ঘুমুতে গেলো।
রক্ষী ২
ছোড়্না ইয়ার, চাল্ (কাফেলার দিকে ইঙ্গিত) শিখাতেহে ডিসিপ্লিনটা।
রক্ষী ১
দেখ সালা, তুই বহুবার এই কাজ করে ঝামেলা পাকিয়েছিস। মাথা চক্কর দিলে পাড়ায় যা না।
রক্ষী ৩
এই, আমার কিন্তু ওকে দেখে সন্দেহ হচ্ছে। সালির পেট আবার ফলস্ না তো?
রক্ষী ৪
আরে রাখ তোর ফলস্। এ্যাহ্, কত সুন্দর একটা প্ল্যান করলাম, আজ নাইট শো মেরে- হাফ ঢেলে দেবো। সব ওলট-পালট করে দিলো।
রক্ষী ৩
এখন ভালোয় ভালোয় বিদেয় করতে পারলে হয়।
রক্ষী ২
সব সালা ব্যানচোদ কো নাঙ্গা কারকে ছোড়দে। সালা ইল্লিগাল কো খিলা-পিলা কেয়া কারলে কা হে?
রক্ষী ৩
না না রসিক দা, তুমি তোমার কাজ করো। (কাফেলার সবচেয়ে প্রবীণ লোক, লস্কর মৃধার কাছে যায়) কাকা আপনার বাড়ি কোথায়?
লস্কর
হুম? বাড়ি, বাড়ি যে কোথায় তা তো বলা কঠিন বাবা।
রসিকলাল
ঐপাড় না এইপাড়?
লস্কর
ও পাড়েই ছিল একসময়।
রক্ষী ৩
তাহলে এপাড়ে এসেচিলেন কেন?
লস্কর
ভয়ে। সব থোয়ার জায়গা আছে বাবা, ভয় থোয়ার জায়গা নাই। ৪৭এর পর আমাদের গ্রামের অনেকেই চইলে এলো এপাড়ে। কিন্তু বাবা-চাচারা আসলো না। বলতো নিজের জন্মভূমি ছেইড়ে যাওয়া তো পাপ- থেকে গেলাম। কিন্তু সংগ্রামের সময় চারদিকে যা শুরু হলো- তা দেখে আমি মনের দিক থেইকা খুব ভেঙ্গে হয়ে পইড়েছিলাম। একটু কিছুতেই মনে হতো ওইটা মুসলমানদের দেশ। পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ কেউ বুঝাতেও চাইতো তাই।
রসিকলাল
এ্যাই তো, ঘটনা তো এখানেই। তুমি হিন্দু না মুসলমান এটা তো গায়ে লেখা নেই। তুমি বাঙলায় কথা বলো, তুমি বাঙালি- এটাই বড় কথা। ওর ধর্ম মসজিদে, আমার ধর্ম মন্দিরে। তার বাইরে আমরা তো বাঙালি। ধর্মের নামে একটা জাতিরে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিলো বাহে।
লস্কর
কিসের টানে যে সবকিছু এমনভাবে পায়ে দলে চলে এলাম, আজ ভাবলেও অবাক লাগে। হিন্দুস্থানকে নিজের দেশ মনে কইরে এসে কী পেলাম! এখানে এসেও নতুন সংকট- আমরা রিফিউজি। কেউ কোনো কাজ দিতি চাইতো না, মিশবার চাইতো না। জীবনটা খুব মূল্যহীন মনে হয়।
রক্ষী ৩
আমার দাদার বাড়িও কিন্তু ঐপাড়ে- ময়মনসিং।
রক্ষী ২
আরে ইয়ে সালাভি বাঙাল হ্যায়। ইসকোভি নাঙ্গা কারগে ছোড়দে।
রক্ষী ১
এই সালাটা আসলেই হারামী খচ্চর একটা। এর ভেতরে কলকব্জায় ঝামেলা আছে।
রক্ষী ৪
রসিকলাল, স্পেসাল কিছু ছাড়না, দেখবে সব সালা ঠা-া হয়ে যাবে।
রসিকলাল
আজ কিছু নাই দাদা।
(মদ খেয়ে নেচে-গেয়ে কথা বলতে বলতে ওরা ঘুমিয়ে যায় একসময়)
(প্রহরী ১, ২, ৩ টহল দিচ্ছে সীমান্তে। সবার কাঁধে রাইফেল। তারা হাঁটতে হাঁটতে এসে একটা সীমান্ত চৌকিতে বসে)
প্রহরী ১
কালাম মিয়া আসো, একটু বইসা লই।
প্রহরী ২
হ জালাল ভাই, বসি। জিরাইয়া লই।
প্রহরী ১
কালাম মিয়া, এই যে দিনের পর দিন সীমান্তে থাকি, কেমন জানি লাগে, না?
প্রহরী ২
কেমন লাগে জালাল ভাই?
প্রহরী ১
কেমুন জানি একলা একলা লাগে, মনের মধ্যে অবশ অবশ লাগে, তোমার লাগে না?
প্রহরী ২
সীমান্ত পাহারা- বিষয়ডাই জানি কেমুন। সীমানা ধইরা হাঁটতে থাকো হাঁটতে থাকো, আবার ফিইরা আসো আগের জাগায়...
প্রহরী ৩
এ্যাহ্, যে শীত আর কুয়াশা পরছে- চাইরদিক তো সাদা হয়া গেল জালাল ভাই। কিছুই দেখা যায় না।
প্রহরী ১
হ, সীমান্তের খুঁটিও না।
প্রহরী ২
সীমান্তের খুঁটি না দেখা গেলেই তো বালা, কী কন জালাল ভাই?
প্রহরী ৩
কী কও মিয়া এইডা? সীমান্তের খুঁটি-কাঁটাতার এইগুলাই তো আসল জিনিস। এগুলান বুক দিয়া আগলাইয়া রাখনের জন্যই তো আমরা।
প্রহরী ৪
আচ্ছা, সীমান্ত না থাকলে কী ক্ষতি হইতো?
প্রহরী ৩
কী কয় বেকুবডা, তাইলে তো দ্যাশ থাকতো না।
প্রহরী ৪
দ্যাশ না থাকলে?
প্রহরী ২
হা হা হা ... তাইলে দ্যাশ-দুনিয়া সব একাকার হইয়া যাইতো। কেমন সমান সমান- একটা বেতাইল্যা ব্যাপার।
প্রহরী ১
তাতে মন্দ কী?
প্রহরী ২,৩
হা হা হা...
প্রহরী ১
(গান)
ওরে মন্দ কী, যদি
সীমানা নাহি থাকে
সবাই আমরা বন্ধুজন
সামনে পামু যাকে।
কুশল জিজ্ঞাসিব তারে
জড়াইয়া ধরুম তারে
মন আমার চাইবে যহন
যামু এপার ওপারে।
আরে হয় না সেজন বন্ধুজন
মাঝে বেড়া থাকিলে
দুই কখনো এক হয় না
মাঝে পাচিল তুলিলে
আরে দশ কখনো এক হয় না
মাঝে সীমানা রাখিলে।।
(হঠাৎ সেখানে হাবিলদার মিজান এসে উপস্থিত হয়। সবাই দাঁড়িয়ে যায়। মিজানের সাথে কথা হলে সবাই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।)
(রাতের নিস্তব্ধতা নেমে আসে। অসীম বাবু দৌড়ে প্রবেশ করে)
অসীম
এ্যাহ, সবকটা ঘুমুচ্চে দেকো। (কমান্ড দেয়। সবাই ঘুম থেকে হুরমুরিয়ে উঠে। রক্ষীরা এসে কাফেলার কোমরের দড়ি খুলে দেয়) যাও, তোমরা মুক্ত। সোজা ওই পারে চলে যাও।
রক্ষী ৪
সামনের জলাটা পার হলেই রাস্তা পাবে। পায়ে চলার রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে সোজা হাঁটতে থাকবে।
রক্ষী ৩
কিছুদূর হাঁটলেই পেয়ে যাবে হলদিবাড়ি হাট। সেখান থেকে রিক্সা-ভ্যান, টেম্পো, যা খুশি ধরে তোমরা চলে যেতে পারবে যেখানে খুশি।
অসীম
তোমরা চিন্তা করো না। ওই পারে তোমাদের কেউ আটকাবে না।
(ওরা দাঁড়িয়ে থাকে, ওদের কেউই নড়ে না। রক্ষীরা তখন বন্দুক তোলে তাক করে)
রক্ষী ২
যা সালা, আগে চল।
(রক্ষীরা ওদের সীমানার খুঁটি ঠেলে পার করে দেয়। ওরা হাঁটতে থাকে। সবার পেছনে পল্টুর মা)
(আস্তে আস্তে সকালের রোদে জ্বলজ্বল করে ওঠে। রসিকলাল রুটির খাঁচাটা নিয়ে ঢুকে দেখে কেউ নেই)
(হলদিবাড়ির সীমানা প্রহরীরা আগে থেকেই খবর পেয়েছিল আজ পুশইন হতে পারে। তারাও দূরবিন হাতে নালার ভেতরে অবস্থান নেয়। কাফেলাটা নো ম্যান’স ল্যান্ড দিয়ে প্রবেশের সময়ই তারা মাথা বের করে। আস্তে আস্তে তারা সীমানার ভেতরে বুক উঁচিয়ে অবস্থান নেয়। কাউকেই তারা হলদিবাড়ি পা রাখতে দেবে না। কাফেলাটা কাছাকাছি আসতে দেখে হ্যান্ডমাইকে চিৎকার করে ওঠে)
প্রহরী ১
তোমরা অবৈধভাবে বর্ডার ক্রস করার চেষ্টা করিতেছ। আর আগানোর চেষ্টাও করিবে না। আর এক পাপ আগাইলে আমরা গুলি করিতে বাধ্য হইবো।
(কাফেলার পেছনে বড়রা থমকে দাঁড়ায়। সামনের বাচ্চা দুটো হাঁটতে থাকে। লস্কর মৃধা সবাইকে সামাল দেয়)
লস্কর
ওই, থাম না কেন। মানা করছে না?
(তারা কী করবে বুঝতে পারে না। তারা দল পাকায়। নিজেদের মধ্যে কথা বলে)
লস্কর
বুকে হিম্মত রাখো। কেউ পিছপা হবে না। ওরা আমাদের মারতে পারবে না। গুলি করতে পারবে না। মেরে ফেলার ইচ্চা থাকলে তালি আগেই মেইরে ফেলতো। আর এই বর্ডারে এনে আমাদের মারলি দুনিয়াজোড়া খবর হইয়ে যাবে।
কাফেলা১
চলো দাদা, আমরা ওই পারেই ফিরে যাই।
পল্টুর মা
হ্যাঁ, ওপারে ফিরে যেতেই হবে। আমাকে অবশ্যই ফিরতে হবি। আমার পল্টু না খেইয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। পল্টুর বাবা আমাকে না পেয়ে হয়তো পাগল হয়ে গেছে। আমাকে অবশ্যই ফিরতে হবে।
কাফেলা ২
তাহলে আমরা কোন দিকে হাঁটবো?
লস্কর
শোন, আমরা ডানদিকে গিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটবো, কিন্তু খুব সাবধানে- যেন ওরা টের না পায়। চলো সবাই।
(তারা মরিয়া ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় নলচেপাড়ার দিকে। নলচেপাড়ার সীমান্ত রক্ষীদের ধারণাও ছিল না যে হলদিবাড়ির প্রহরীরা টের পেয়ে যাবে। দূরবিন লাগিয়ে ওরাও ফলো করে। মাইক উচিয়ে ওরাও ঘোষণা দেয়)
রক্ষী ১
হট যাও। দূর হও।
রক্ষী ২
এপারে আসার চেষ্টা মাত করো। আর এক কদম আগে বাড়ো তো গুলি হবে।
(কাফেলা চলে আসে নলচেপাড়ার কাছাকাছি। না, তারা সীমানার খুঁটি পার হতে পারে না। রক্ষীরা তাদের ধাক্কা মারে। লস্কর মাটিতে পড়ে যায়। সবাই লস্করকে ধরে উঠায়)
লস্কর
এ কী করছো তোমরা আমাদের সাথে? তোমরা থাকতে দেবে না, ওরাও ঢুকতে দেবে না। তাহলে আমরা কী করবো?
কাফেলা ২
আমরা তো যেখানে ছিলাম ভালোই ছিলাম। কেন তোমরা আমাদের সেখান থেকে তুলে আনতে গেলে?
রক্ষী ২
তোদের পেয়ার-সুহাগ করতে। যা ভাগ সালি।
লস্কর
সবার খিদে পেয়েছে। মহিলারা নড়তে পারছে না। বাচ্চারা মরো মরো। তোমরা না রক্ষী। তোমাদের কাজ না রক্ষা করা? কী রক্ষা করো তোমরা? এই খুঁটিগুলোকে? মানুষ মেরে তোমরা খুঁটি বাঁচাও?
রক্ষী ১
হ্যাঁ হ্যাঁ খুঁটি বাঁচাই, খুঁটি পাহারা দেয়াই আমাদের কাজ। এতো কথা বলচো কেন? তোমরা ওই পারে যাও।
কাফেলা ১
চলো। আমরা তা হলে ওই পারেই যাই।
পল্টুর মা
না। ওই পারে আমার কে আছে? এই পারে আমার পল্টু, পল্টুর বাবা।
কাফেলা ২
চলো বহিন, চলো। এতো কষ্ট করেচ আরেকটু করো। চলো, ঢুকতে না পারি, যদি একটু খাবার পাই।
কাফেলা ৩
ভাই, আমার ছেলেটার খিদে পেয়েছে।
কাফেলা ৪
আমার মেয়েটা খিদায় কাঁদছে। তোমাদের ঘরেও তো ছেলেমেয়ে আছে। একটু পানি অন্তত দাও।
রক্ষী ১
পানি খাবি? দাঁড়া তোর পানি খাবার ব্যাবস্থা করি সালি মাগি...
(রক্ষীদের মধ্যে একজনের বুঝি দয়া হয়। বাকিরা চলে গেলে সে তার পিঠের বোঝা থেকে পানির ফ্লাস্ক বের করে বাচ্চাটাকে ডাকে। ‘ইধার আও।’ বাচ্চাটা আকাশের দিকে মুখ হাঁ করে তাকায়। রক্ষী তার মুখে জল ঢালে। তখন সবাই ‘আমাদেরও পিয়াস পেয়েছে’ বলে ফ্লাস্কের নিচে মুখ লাগাতে চায়)
(নলচেপাড়া ফাঁড়ির পাশেই বাসুদেব ধরের হোমিওপ্যাথির দোকান। বেশ একটা জটলা পেকেছে এখানে)
লোক ১
ও ডাক্তার বাবু, কোমরটা বুঝি মোক আর বাঁইচবার দিবে না।
বাসুদেব
কী কন বাহে। শুনিছেন কখনও কোমরের ব্যথায় মানুষ মরিয়া যায়। আইসেন, দুফোটা খেয়ে যান।
পরিমল
কে, মারা যায় কে?
বাসুদেব
লক্ষণ দাস নাকি কোমরের ব্যথায় মারা যাইবে।
পরিমল
আরে কী কন কাকা, ফির দৌড়াদৌড়ি শুরু হইল্ বলে। কোমর খাড়া রাখেন বাহে।
(পেপার হাতে নেয়)
বাসুদেব
বুঝলেন মজুমদার বাবু, এই বর্ডারে কত কী দেখলাম। এই তো মনে হয় সেদিনও হামরা বিদেশি কাপড় কিনিবার বাবদ হলদিবাড়ির হাটে চলিয়া গেছি। আর ওমরাও পাতার বিড়ির লাগিয়া এ পাড়ে আসছে। ফির গোলাগুলি হইছে, সেটাও দেখিছি। কিন্তুক তাই বলিয়া মানুষ ধরিয়া জোর করিয়া এই পারত্ থাকিয়া ওই পার, ওই পার থাকিয়া এই পার, এইটা তো দেখোম নাই।
পরিমল
এইটারে কয় পুশব্যাক। ইল্লিগ্যালগুলাক ধরিয়া ফেরত পাঠায়া দেওয়া হয়।
বাসুদেব
তা আপনারা বাহে সাংবাদিক মানুষ। কত কিছু জানেন। কিন্তুক মোক কিন্তু ভালো ঠেকে না। একটা সাগরের মধ্যে এক বালতি পানি তুলিলেই কী, ঢালিলেই কী? শুনিলাম জনাকয়েক ধরিয়া আনিছে। কুড়িটা মানুষক্ কি হামারাও খিলাবার পারি না, ওমরাও পারে না?
পরিমল
তা কি আর না পারে বাহে। পারে। কিন্তুক ইয়ারে নাম তো ডিপ্লোম্যাসি। ইয়ারে কয় পলিটিক্স। খিলাইতে পারে কিন্তু খিলাইবে না। মারিবারেও পারে কিন্তু মারিবে না।
লোক ১
পেপারত্ কিছু লিখছেন আইজ?
পরিমল
না, লেখি নাই। কাইলকা বেশি রাইতের ঘটনা। আইজকা দেখি সারাদিন কী হয়। তারপরে না হয় লেখা যাইবে।
লোক ২
কমান্ডার সাব কয় কিছু?
পরিমল
কমান্ডার বাবু তো মানা করে বাহে। কয়, না লেখেন।
লোক ১
তা তো কবেই। লিখলে তো ওমরার ব্যবসা শেষ হয়। গতবার গরু নিয়া কী কা-টাই না করিলো। ফির শেষে গোলাগুলিও হইল্।
লোক ২
যেইবার বর্ডারত্ গোলাগুলি হইল্ , তার আগত্ কিন্তু হামাক কয়া দিছিল, মানুষজন দূরে সরি থাকেন। হামরা ম্যালা দূর চলিয়া গেলাম। এইবার কমান্ডার সাব কয় কিছু?
বাসুদেব
গ-গোল পাকায়া ফির গোলাগুলি না শুরু করি দেয়। দোকানটা একেবারে ফাঁড়ির বগলত্ , মোর অসুবিধা হইছে একখান।
পরিমল
না। সেই কথা তো কয় নাই। কিন্তুক আমার মনে হয় প্লান ফেইল করছে।
লোক ৩
খারাপ কিছু আন্দাজ করিবার পারলে একনা হুঁশিয়ার করি দেবেন বাহে। সাবধানের মাইর নাই।
পরিমল
তা করা যাইবে। যাই, দেখিয়া আইসি কোটেকোনায় কী হয়।
(অসীম বাবু, কমান্ডার ফাঁড়িতে বসে কথা বলছে)
কমান্ডার
অসীম বাবু, ইস ক্যাসকোভি হ্যান্ডল নেহি কারপায়ে ! আর তো পারা যায় না আপনাকে নিয়ে।
অসীম
সরি স্যার
(পরিমল মজুমদার এসে কমান্ডারকে পেপার দেখিয়ে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে শুরু করে)
পরিমল
দেখুন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলচে, আর যাই হোক মানুষকে দুই পারের রাজনীতির বলি করা যাবে না। ক্যাপ্টেন সাব এরা কি মানুষ নয়? এদের কি মানবাধিকার নেই? এদের কি অধিকার নেই বিচার পাওয়ার? এদের কি অধিকার নেই আত্মপক্ষ সর্মথনের? এদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হচ্চে কোন আইন বলে? মানবতা কি কেঁদে উঠছে না? মানবাধিকার কি লঙ্ঘিত হচ্চে না?
কমান্ডার
(চিৎকার করে) রসিকলাল, দু চা লাও। দো কাপ চায়ে।
পরিমল
ক্যাপ্টেন সাব, আপনি আমাকে অন দ্যা রেকর্ড একটা প্রশ্নের জবাব দেন। আমরা দেখেচি গত রাতে বেশকজন মানুষকে এখানে আনা হয়। সকালে তাদের হলদিবাড়ির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এখন হলদিবাড়িওয়ালারাও তাদের ঢুকতে দিচ্চে না। তারা নো-ম্যান’স ল্যান্ডে আটকা পড়ে আচে। মানুষগুলোর খাওয়া নাই, পেশাব-পায়খানা নাই? তারা যদি মারা যায় তাহলে দায়িত্ব কে নেবে?
কমান্ডার
ওয়েল, মজুমদার বাবু, হাম আপকো অন দ্যা রেকর্ড কুচ্ভি নেহি বোলেঙ্গে। আপ হামকো কোট কারকে কুচভি নেহি লিখেঙ্গে। হামনে আপকো কুচ্ নেহি বোলা।
পরিমল
আচ্ছা ঠিক আছে। অন দ্যা রেকর্ড বলতে হবে না। আমি আপনার সাথে দেখাও করি নাই, কথাও বলি নাই। মানলাম। এখন বলেন, ঘটনাটা এই রকম কেন ঘটল। এতগুলো মানুষ কষ্ট পাচ্চে...
অসীম
আপনাকে সাচ বলি। কিন্তু আমাকেও কোট করবেন না। সীমান্তের ওপারে তো রাস্তা-ঘাট নেই। আর সকাল বেলা তো কুয়াশা থাকার কথা। কুয়াশার ভেতর দিয়ে ওরা বর্ডার পার হয়ে ওই পারে চলে যাবে। তা হলেই তো আমাদের দায়দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। আমরা সেভাবেই প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু আজ সকালে রোদ উঠায় সমস্যাটা হয়ে গেল। আমরা ভাবি নাই যে হলদিবাড়ির প্রহরীরা টের পেয়ে যাবে যে আজ আমরা অপারেশনটা করতে যাচ্চি। টের পেয়ে ওরাও প্রটেকশানটা নিয়ে নিলো।
পরিমল
এখন কী হবে?
কমান্ডার
একবার জো বাহার করদিয়া, ওন্ট লেট দেম ব্যাকইন।
অসীম
রাইট স্যার রাইট।
পরিমল
আপনারা এই মানুষগুলোকে আর ঢুকতে দেবেন না?
কমান্ডার
নো, নেভার।
পরিমল
আর ওরা হলদিবাড়িতে এদের ঢুকতে দেবে না?
কমান্ডার
দ্যাটস নান অফ মাই বিজনেস।
(চা নিয়ে রসিকলাল ঢুকে)
অসীম
নিন মোষের দুধের চা। দেখুন না সর ভাসছে।
রসিকলাল
স্যার, হুকুম দিলে ওদের জন্য কিছু খাবার পাঠাতে পারতাম।
(কমান্ডার শোনেইনি এমন ভাব করে)
পরিমল
আমি উঠি। স্পটটা একটু ঘুরে আসি। গোলাগুলি হবে নাতো আবার?
কমান্ডার
নো, হামারে তারফসে এ্যাইসি কোই চান্স নেহি হ্যায়। বাট ইউ নেভার নো এ্যানিথিং মাইট হ্যাপেন।
অসীম
আমাদের সবরকমের প্রস্তুতি আছে স্যার।
কমান্ডার
লেকিন হাম লোক কোই টেনশান ক্রিয়েট নেহি কারনা চাহতে হ্যায়। উপার কা অর্ডার হ্যায়।
(পরিমল চলে যায়)
রসিকলাল
স্যার।
(কমান্ডার কটমট করে তাকিয়ে চলে যায়)
অসীম
রসিকলাল, তুমি না একেবারে একটা ইয়ে... আমি একটু ব্যারাকে গেলাম।
(পরিমল মজুমদার হাঁটতে হাঁটতে সীমান্তের কাছে চলে আসে। এসে শোনে হ্যান্ডমাইকে একজন রক্ষী ওদের হুঁশিয়ার করছে। কাফেলা চলে এসেছে নলচেপাড়ার বর্ডারের কাছে। সাথে সাথে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে থাকে পরিমল)
রক্ষী ১
তোমরা ফিরে যাও। এইদিকে এসে লাভ নেই। তোমাদের আর সীমানার খঁটি পার হতে দেবো না।
রক্ষী ২
এ্যাহ, ফটো কাহে কো খিচতাহে ? ক্যামেরা লা। ফটো লেনা মানা হ্যায়, মালুম নেহি ক্যা।
পরিমল
আমি তোমার কমান্ডারের সাথে কথা বলবো, তোমার সাথে না।
(রক্ষী ৩ ক্যামেরাটা কেড়ে নিয়ে ফিল্মটা খুলে ফেলে)
পরিমল
আরে ফিল্ম খুলে রাখলে আমি ফিল্ম পাবো কোথায়। আর এই রিলে আমার অনেক জরুরি ছবি আছে।
রক্ষী ২
এ ক্যামেরা মেরে পাস রাহেগা। উখারলো যবি উখার না হ্যায়।
পরিমল
তুমি জানো, তোমার কমান্ডারের সাথে আমার কী সম্পর্ক?
(ওদের হট্টগোলে অসীম আসে)
অসীম
এই কী হয়েছেরে? এত হল্লা কিসের?
রক্ষী ১
দেখুন না মজুমদার বাবু না বলে ছবি তুলছে।
অসীম
মজুমদার বাবু, আপনি শিক্ষিত লোক- এটা বোঝেন না যে এখানে ছবি তোলা নিষেধ। ক্যামেরাটা কমান্ডার স্যারকেই জমা দেবো। তারপর উনি যা সিদ্ধান্ত নেয়ার নেবেন।
পরিমল
আমি যাচ্ছি কমান্ডার সাবের কাছে। আই উইল কমপ্লেইন এগেইনস্ট ইউ। আই উইল রাইট ইন মাই নিউজপেপার।
রক্ষী ২
যাইয়ে যাইয়ে, হাম আপনা ডিউটি কার রাহা হ্যায়, আপ আপনা কাম কি জিয়ে।
অসীম
আহ্ থামো না। মজুমদার বাবু, আমরা তো হুকুমের বাইরে যেতে পারি না। এখনই যদি হুকুম আসে ক্যামেরা দিয়ে দাও, আমি দিয়ে দেবো।
পরিমল
হ্যাঁ কর, হুকুম পালন কর। তোমরা তো লেফট-রাইট করা রোবট। মানুষ না। তাই না? কর, হুকুম পালন কর।
রক্ষী ১
হুকুমই তো পালন কচ্চি, ভোজপুরি তো খাচ্চি না।
অসীম
এই তোরা থামবি?
(পরিমল কথা বাড়ায় না। যেতে যেতে পেছন ফিরে দেখে কাফেলার মানুষগুলো কাঁটাতারের কাছাকাছি আছে। কী অবমাননাকর পরিস্থিতি। পরিমল এগিয়ে যায়। দেখে ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই পরিমল হাত উচিয়ে ডাকে)
পরিমল
এদিকে আসো। নাম কি তোমার?
মায়া
মায়া।
পরিমল
দুপুরে কী খেয়েছ?
মায়া
কিছু খাই নাই।
পরিমল
সকালে?
(মায়া ‘না’ সূচক মাথা নাড়ে)
পরিমল
আচ্ছা, তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি। (গলা উঁচিয়ে রক্ষীদের) তোমরা মানুষ না।
(কমান্ডার ফাঁড়িতে বসে পেপার পড়ছে। দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পাশে দাঁড়ায় রসিকলাল)
রসিকলাল
স্যার, মানুষগুলা সারাদিন না খাওয়া। বাচ্চা আছে, বুড়া আছে, প্রেগনান্ট মহিলা আছে। স্যার হামার স্টকে যে খাবার আছে তাতে এক মাসের খাবারে এমন কিছু টানাটানি হবার নয়। আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো। স্যার...
কমান্ডার
হলদিবাড়ি কো খিলানে দো।
রসিকলাল
মজুমদার সাব কইছে ওরা নলচেপাড়ার লাইনেই আছে।
কমান্ডার
উন লোগোকো খিলানে কা মাৎলব, উসকে জিম্মাদারি হামারে উপার হ্যায়, ইসকা মাৎলাব সামাজতে হো ? একেক কো ইয়াহা তাক্ লানেকে লিয়ে গভমেন্টের বহুৎ পয়সা খারচা হয়েচে। ওদের ফিরতে দেওয়া যাবে না।
রসিকলাল
হামরা তো আর ওদের বর্ডার ক্রস কইরবার দিতুছিনা না। খালি দুইটা শুকনা রুটি আর একনা গুড় ধরায়া দেই স্যার।
কমান্ডার
রসিকলাল ক্যায়া লারকিওকি তারহা কার রাহেহো। তুম মরদ হো, সোলজার। তোমহারা দিল পাথ্বারকে য্যায়সে হোনা মানতা হ্যায়।
(রসিকলাল কথা বলে না, আবার কমান্ডারের সামনে থেকে সরেও না, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে)
(পরিমল একটা টিনের বাক্স, হাতে মোয়ার প্যাকেট নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। পথে দেখা হয় ভবেশ পাগলার সাথে)
পরিমল
এই ভবেশ, একটা কাজ করিবার পারবি?
ভবেশ
কী কাজ?
পরিমল
একটা বালতিত্ করিয়া জল ভরিয়া ওই উত্তরের দিকত বর্ডারত্ ধরি যাবার পারবি?
ভবেশ
পারবো। মোক দুইটা মোয়া দেওয়া নাগবে।
পরিমল
আচ্ছা নিস।
ভবেশ
জল দিয়া কী করিবেন?
পরিমল
পুণ্যের কাজ করবিরে পুণ্যের কাজ। তৃষ্ণার্তকে জল দিবি। ভগবান হামাক পুণ্য দিবে। হামরা স্বর্গে যামো।
ভবেশ
স্বর্গত্ যামো হামরা!
পরিমল
হ্যাঁ, যা নিয়ে আয়।
(ভবেশ পাগলা বালতিতে মগ বাড়ি দিয়ে ঢোল বাজাতে বাজাতে দৌড়ে ফাঁড়ির ভেতর কলতলায় গেলে রসিকলাল পথ আটকায়)
রসিকলাল
ওই ভবেশ, জল নিয়া কুনঠে যাবি?
ভবেশ
স্বর্গত্-
রসিকলাল
মানে কী?
ভবেশ
কতকগুলা মানুষ বর্ডারত্ মাটিত পড়িয়া আছে। ওমাক জল খিলাইলে স্বর্গ পামো। তোমরাও যদি স্বর্গ পাবার চান, মোয়া ধরি, জল ধরি অটেকোনায় যান।
রসিকলাল
আমি নিজেই দোকান থাকি আটা কিনে আনি রুটি বানামো। চল।
(রাতের অন্ধকারে রসিকলাল তার সহযোগী অমলকে নিয়ে চলে নো-ম্যান’স ল্যান্ডের দিকে। তার দুহাতে দুই বালতি এবং কোমরে একটা দড়ি দিয়ে টর্চ বাঁধা। বর্ডারে পৌঁছে দেখে রক্ষীরা ওদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে)
অসীম
শোন, তোমাদের খানা দেওয়া হবে এক শর্তে। যদি তোমরা খানা খেয়ে এই রাতেই নলচেপাড়া বর্ডার ছেড়ে চলে যাও।
রক্ষী ১
একটু পরেই কুয়াশা ঘন হয়ে আসবে। এই সুযোগে তোমরা হলদিবাড়ি চলে যাবে। কী রাজি?
লস্কর
জী আচ্ছা। আমরা চলে যাবো। আমাদের খানা দাও, পানি দাও।
(রসিকলাল সবার হাতে রুটি তুলে দেয়। অমল মগ দিয়ে পানি খাওয়ায়। রুটি আর পানিটুকু পল্টুর মার শরীরটাকে যেন আরো ধসিয়ে দেয়। সে শুয়ে পড়ে। আর শোয়ামাত্রই তার দুচোখ বন্ধ হয়ে আসে। ধূলিশয্যায় শুয়ে স্বপ্ন দেখে পল্টুর মা। পল্টু কাওয়াল দলের হেড কাওয়াল হয়েছে। একটা সোনালি টুপি ওর মাথায়, গায়ে টকটকে লাল পাঞ্জাবি আর পাঞ্জাবির ওপর নীল ভেলভেটের কটি, পরনে চোশত পায়জামা, পল্টু বসে কাওয়ালি গাইছে। তার সামনে হারমোনিয়াম। পল্টু এক হাতে হারমোনিয়ামের বোতাম টিপছে, আর মুখের কাছে আরেক হাত তুলে ধরে কাওয়ালির সুরে সুরে নাড়ছে। পাশে এসে দাঁড়ায় ওর বাবা)
পল্টুর বাবা
জানো, এই কটিটা আমি নিজে সেলাই করেছি। এর গায়ে একটা একটা করে পুঁতি আমি বসিয়েছি। আমাদের ছেলেকে কেমন মানিয়েছে দেখো।
মা
ওমা, আপনি তো দেখি বড় কারিগর হয়ে গেছেন।
বাবা
তোমার ব্লাউজটাও দিও আমি তাতে চুমকি বসিয়ে দেবো। তোমার গলাটাও কিন্তু ভাল। একটা গান গাও না।
পল্টু
হ্যাঁ মা গাও।
মা
না না... কী বল তুমি...
বাবা
গাও না
(পল্টুর মা একটি গান গায়)
পল্টু
মা তুমি মিঠাইয়ের দোকানে কাজ করো বলে তোমার গলা এত মিষ্টি। চলো তোমার দোকানে চলো, আমাকে মিঠাই দাও। চলো মা চলো...
মা
চল বাপ চল...
লস্কর
ও মা উঠো, চলো মা চলো, ওঠো।
মা
( ঘোর শেষ হয়) আমার পল্টু। পল্টুর বাবা কই?
কাফেলা ১
আরে আগে প্রাণে বাঁচো। নইলে পল্টুকেও পাবে না, পল্টুর বাবাকেও পাবে না।
লস্কর
আমরা ওই পারে গিয়ে একটা আশ্রয় পাই। তারপর তুমি পল্টুর বাপকে চিঠি দিও। তোমাকে এসে নিয়ে যাবে। তাই না? শোন, কেউ কোনো কথা বলবে না। কোনো বাচ্চা যেন না কাঁদে। আমরা এখন হলদিবাড়ির দিকে পা বাড়াবো। হাঁটতে হাঁটতে যতদূর যাওয়া যায় আমরা যাবো।
কাফেলা ২
ঠিক আচে, ভাগ্য আমাদের যেখানে থামায় সেখানেই আমরা থামবো।
(তারা হাঁটে। কুকুর ডেকে চলেছে ক্রমাগত। শিয়ালের হুক্কাহুয়া দীর্ঘ বিলম্বিত লয়ের মতো বাজে। চাঁদটা আকাশের এককোণায় সামান্য একটা সান্তনা চিহ্নের মতো দেখায়। মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে তার মায়ের কাঁধে। একজন কেঁদে ওঠে, ‘মা আমার পায়ে কাঁটা বিধেছে।’ লস্কর ধমক দেয়। পল্টুর মা সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না। তার হাতে কুড়িয়ে পাওয়া একটা গাছের মরা ডাল। তারা হলদিবাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। একসময় সীমানার খুঁটি দেখতে পেয়ে নিশ্চিত হয় যে তারা ঠিক জায়গায়ই আছে। এবার তারা ঢুকে পড়বে হলদিবাড়িতে। ঠিক সেই সময় কে একজন ‘ও বাবাগো’ বলে দেয় চিৎকার। অজান্তেই আরো কয়েকজন চিৎকার দিয়ে উঠে। সাথে সাথেই টর্চের আলো এসে পড়ে তাদের উপর। চোখ ধাঁধিয়ে যায় ওদের। কর্তব্যনিষ্ঠ প্রহরীরা লাঠি হাতে বাঁশি বাজাতে বাজাতে মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়ে এই নর-নারী-শিশুদের ওপর। তারা নির্বিচারে পিটিয়ে চলে। আহত, রক্তাক্ত, ভীত মানুষগুলো আবার ফিরে আসে না-মানুষি জমিনে। তারা ক্লান্ত, হতাশ, চলৎশক্তিহীন। তারা মাটিতে বসে, কেউবা শুয়ে পড়ে। কুয়াশা ঘন হয়ে আসে। এমন কুয়াশা যে দুই হাত দূরে কী আছে দেখা যায় না)
লস্কর
এই সুযোগ। চলো আমরা চলে যাই। আমি থাকবো সবার আগে। আমার পিঠ ধরো একজন। তার পিঠ ধরো একজন। রেলগাড়ির মতো চলো সবাই। ওঠো সবাই।
(কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়াশা এত ঘন হয় যে কেউ কাউকে দেখতে পারছেনা। তবুও তারা হাঁটে। একসময় পল্টুর মার হাত তার সামনের জন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবুও সে মানুষের গন্ধে গন্ধে হাঁটে। বেশ খানিকক্ষণ চক্কর খাওয়ার পর সে কথা বলে)
পল্টুর মা
কেউ কি আছো তোমরা? কেউ কি তোমরা আমার কথা শুনতে পারছো?
(পল্টুর মা’র পা আর চলে না। সে ধপ করে বসে যায় মাটিতে। তখনই তার পেটের ভেতরের পানি ফেটে যায়। রক্তপাত হতে থাকে। তার প্রচণ্ড ব্যথা ওঠে। সে দু পা ফাঁক করে শুয়ে থাকে। উঠে বসে। হাত দুটো পেছনের মাটিতে আঁচড়ে থাবলা ঘাসমাটি তুলে ফেলে। সর্বশক্তি দিয়ে চাপ দেয় সে। রক্তপাত। আর্তনাদ। যন্ত্রণা। সে চিৎকার দেয়-)
পল্টুর মা
ইয়া খুদা... পল্টু, বাপ আমার, তুই যে এতো আউলিয়া আউলিয়া বলে কাওয়ালি গাস, তোর আউলিয়ার দোয়ায় খুদা কি একটু রহম করবে না।
(অবশেষে একটা মানবসন্তানকে সে জন্ম দিতে পেরেছে। এরপর পল্টুর মা জাগরণহীন ঘুমে তলিয়ে যায়। সদ্য জন্মানো মানবশিশু তারস্বরে তার জন্মবার্তা জানান দিতে থাকে)
(সমস্ত মঞ্চ অন্ধকার )
ভবেশ
ভগবান স্বর্গ থাকিয়া বাচ্চা পাঠাইছে, নো-ম্যান’স ল্যান্ডত। কাঁয় কোটে আছেন বাহে, শোনেন ক্যানে জরুরি খবর। স্বর্গ থাকিয়া নিষ্পাপ বাচ্চা আসি গেছে। কাঁয় কোটে আছেন বাহে... নো ম্যান্স ল্যান্ডত্ দেবশিশু আসিয়া গেছে... কাঁয় কোটে আছেন...
(নলচেপাড়ার লোকজন সীমান্তে দাঁড়িয়ে নানা পরামর্শ করতে থাকে)
রসিকলাল
ডাক্তার বাবু, বাচ্চাটার নাড়ি কাটা যাইবে কী করি?
বাসুদেব
নাড়ি তো আমি কম কাটি নাই এই জীবনে। কিন্তুক সমস্যা হইল্ নো ম্যান্স ল্যান্ডত কাঁয় যাইবে। এক পা বাড়াইলেই না গুলি করিয়া দেয়।
লোক ১
হ, ঠিকই কইছেন বাহে। গুলি এপার থাকিয়াও হবার পারে, ওপার থাকিয়াও হবার পারে।
বাসুদেব
ওরে বাপরে.... মোর প্রাণটা না অপঘাতে যায় ফির।
লোক ২
এক কাজ যদি করিবার পারেন তাইলে হয়। বাচ্চাটাকে কোনোমতে নো-ম্যান্স ল্যান্ড থাকিয়া যদি এই পারে আনিয়া থুবার পারেন-
বাসুদেব
তাইলে মনে করেন আর কিছু না লাগিবে। আমি ঘচাৎ করিয়া নাড়ি কাটিয়া দিবার পারিম।
রসিকলাল
তা তো আপনি পারবেনই, কিন্তুক এখন কী করিবার পারেন তাই কন বাহে।
বাসুদেব
কিছুই করিবার না পারিমো।
পরিমল
এই ফটোকটা যদি মোক তুলিবার দিত, দেখবার পারতেন মুই কত বড় পুরস্কার জিতি যাইতাম। মরা মায়ের পাশে জাস্ট বর্ণ বেবি। এইটা কী যা তা ছবি!
(হলদিবাড়ির বর্ডার। প্রহরীরা দূরবিন দিয়ে দেখছে। তাদের পেছনে নানা বয়সী উৎসুক জনতার ভিড়। নিজামুদ্দিন বাবুর্চি ও তার স্ত্রী মর্জিনাও আছে সেখানে)
প্রহরী ১
বড় তাজ্জব কথা। বাকি লোকগুলা গেলো কই?
প্রহরী ২
ইল্লিগ্যাল মাইগ্রেন্ট জাস্ট ভ্যানিশড। হেইয়া কেমবে?
লোক ১
এই, বাচ্চাটার হাত-পা নড়ে তো।
লোক ২
আর মা’ডার কী অবস্থা?
লোক ৩
মা মনে হয় মইরাই গেছে।
লোক ১
আহহারে, অতটুকুন বাচ্চা মাটিত্ পড়িয়া আছে।
লোক ২
মনে কয় এইডা জিনের ছাওল হইবে।
লোক ১
ওরে বাবা জিন!
(মাথা ঘুরে পরে যায়)
লোক ৩
আরে কী কন বাহে, দেখেন না মানষের মতো একেবারে।
লোক ৪
আহারে, বাচ্চাটা একফোটা দুধও পায় নাই।
লোক ৩
আগত তো নাড়ি কাটা লাগিবে।
প্রহরী ২
এই আমনেগো কাজ-কাম নাই, যান বাড়ি যান।
মর্জিনা
মুই বাচ্চাটাকে এক নজর দেখিম।
নাজিমুদ্দি
আগে দেখি, কী হয় না হয়।
প্রহরী ৩
নাজিমুদ্দিন ভাই, হাবিলদার সাব মিটিং দিছে, আহো।
নাজিমুদ্দিন
আমি বাবুর্চি মানুষ মিটিং-এ গিয়া কী করুম?
প্রহরী ৩
আরে তুমি চাকরি করো না। আহো বহুত জরুরি মিটিং।
মর্জিনা
তোমরা যাও। মুই এলায় যাবার পারমো।
(হাবিলদার মিজান মিটিং বসায় হলদিপাড়া ছাউনিতে। মিজান একটা চেয়ারে বসা। আর সবাই মাটিতে বসা)
মিজান
বর্ডারে প্রহরা বাড়ানোর অর্ডার হইছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিরও প্রস্তুতি নিতে হবে। অতিরিক্ত ফোর্স আসতাছে। সেসব নিয়া সমস্যা নাই। আসল সমস্যা হইলো, একটা ছোট্ট শিশু। এই বাচ্চাটাকে আমরা কী করবো?
নাজিমুদ্দি
আপনারা যদি পারমিশন দেন। বাচ্চাটারে আমিই নিয়া আসতে পারি।
মিজান
ঘটনাটা অতো সরল হইলে তো হইয়াই গেছিল। নলচেপাড়া পুশআউট করছে। আমরা অদের পুশইন হইতে দেই নাই। কেন দেই নাই? ওরা কয় মানুষগুলা এই পারের। আমরা কী কই, আমরা কই মানুষগুলা ওই পারের। এইটা তো অহনও সেটল হয় নাই। অহন যদি আমরা এই বাচ্চাকে নিয়া আহি, তাইলে অরা বলবে, তোমাগো বাচ্চা তোমরা তো লইবাই। কাজেই বাচ্চার মা, খালা, চাচা, ফুপা সবাইরে তোমাগোই লইতে হইবো। তখন তারা সারা দুনিয়া নাইচা নাইচা বইলা বেড়াইবো হ্যাগো দাবী ন্যায্য। কী বুঝলা?
প্রহরী ১
হ তাই তো।
প্রহরী ২
আমরা তো অতো আগপাস ভাইবা দেখি নাই।
প্রহরী ৩
এই জন্যই লিডার হইলো লিডার।
নাজিমুদ্দি
তাইলে বাচ্চাটা কি ওইখানেই মরবো?
মিজান
শোন, অহন যদি তোমরা ওই ডেডবডি কিংবা ওই বেবির দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নাও, তার একটাই মানে। কী সেইটা? তোমাদের সিটিজেনরে তোমরা বাইর করে দিছো। সে ক্ষেত্রে খালি হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশনের প্রশ্ন আসে না, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন দেখা দেয়, একটা প্রেগনেন্ট মহিলাকে এই জুলুম কেন। এটা একটা মার্ডার কেস। এত বড় অপবাদ তোমরা কেন নিতে যাবা?
প্রহরী ৩
ওস্তাদ, পতাকা মিটিং কল করেন জলদি।
নাজিমুদ্দি
একটা মানুষের বাচ্চা ওইখানে মইরা পইড়া থাকবো, এইটা তো একটা অমানুবিক কাজ হয়। বাচ্চারে মুই নিয়া আসোম।
প্রহরী ১
আগে হাবিলদার সাব অর্ডার দিক, তারপর।
প্রহরী ২
তার আগে আমরা কাউরেই নো-ম্যান’স ল্যান্ডে পা রাখতে দিতে পারি না।
প্রহরী ৩
তুমি পা রাখলা আর ওরা যদি ফায়ার করে, তাইলে আমাগোও ফায়ার ওপেন করতে হবে। তাইলে পরিস্থিতি আর কন্ট্রোলে থাকবো? আশপাশে বাড়িঘর আছে, সব রাইফেলের গুলির রেঞ্জের মইধ্যে।
মিজান
ওরে বোঝাও, বোঝাও তোমরা।
(রসিকলালের সামনে একটা হাঁড়ি। কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে আছে অনেকক্ষণ। সে খানিকটা মদ্যপান করেছে। পাশে বসে আছে তার সহকারি অমল)
অমল
দাদা, রাত অনেক হইল। খাইবেন না? এলা ওঠেন।
রসিকলাল
মাইনষের জীবনের কোনো দাম নাইরে অমল...
অমল
এইগলা নিয়া তোমরা ভাবেন ক্যান, দাদা। এপারে ওপারে বড় বড় অপিসার আছে, তারা ভাবুক ...
রসিকলাল
কি কইস, অমল। হামরা ভাবিবো না? হামরা মানুষ না? মানুষ হয়া মানুষের জন্যি যদি না ভাবি, তাইলে কি জানোয়ার পশুরা ভাবিবে? এই অমল, তুই কাঁয়, মুই কাঁয়? হামরা কাঁয়, কোথা থাকি আসচি, কোনঠে যামো ... কও? কাঁয়ো কবার পারে? পারবু তুই?
অমল
কেমন করি কই? মূর্খ মানুষ ...
রসিকলাল
কাঁয় মূর্খ? মূর্খ তুই না, মুঁইও না। মূর্খ তারায়, যারা মানুষে মানুষে ভাগ করে...হেন্দু , মুছলমান ...। ভাগ করে ভগবানের জমিন। এই জমিন কার রে অমল? কার? আমি পাইচি আমার বাপের থাকি, তাঁয় পাইচে তার বাপ থাকি, তারও পরে তার বাপ, তার বাপ ...। তাইলে আসল মালিক কাঁয় এ জমির? এই জমিনের আসল মালিক হইল্ ভগবান। এই জমিন ভাগ করার তুই কে, হামি কে? ভগবানের জমিনে বসিয়া ওমরা সগাই করে বাহাদুরি ... আরে, মাইনষের জীবনই যদি না থাকে, তাইলে সে বাহাদুরির মূল্য কী? ঐ যে দেখ, এই আন্ধারেও মুঁই দেকোচি, মরা মায়ের লাশ, বগলতে কান্দে সদ্য জন্ম নেওয়া দুধের ছওয়া। ঐ ছওয়ার কান্দনের শব্দ কি তোমার কাছে যায় নারে, ভগবান? তুমি কি না শোনেন কিছু? তাইলে ক্যান তার মুখে দুই ফোটা দুধের ব্যবস্থা না করেন? এ ভগবান, তুমি কি দ্যাখো না কিছুই। তুমি কি অন্ধ হলেন বাহে? তুমি যদি ওই বাচ্চার মুখে দুধ দিবার না পারো, তাইলে হামি কেন অন্যের মুখে খাবার দিবার জন্য রাঁধবো? হামি আর রাঁধবো না। এই রসিকলাল আর কারো খাবারের জইন্যে কোনোদিন পাকাবে না।
অমল
দাদা, মাথা ঠাণ্ডা করেন...
রসিকলাল
আহারে- দুই পা আউগালেই ছাওয়াটা বাঁচে, মাওটারও সৎকার করা যায়। কিন্তুক হামরা ওইটে যাবার পাবার নাই, ওইটে যাবার অধিকার হামার নাই...
অমল
দাদা, খালি খালি মন খারাপ না করেন। এগলা তো আইন-কানুন নিয়মনীতির ব্যাপার। কমান্ডার স্যার কইছিল যে, এগুলা নাকি রাজনীতির ব্যাপার ...
রসিকলাল
(ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রসিকলাল) কার রাজনীতি? কীসের রাজনীতি? যে রাজনীতি মাইনষের জীবন বাঁচাবার পারে না, দুধের ছওয়াক দুধ দিবার পারে না, সেই রাজনীতি হামি চ্যাট দিয়াও পুচিনা...
অমল
দাদা, চলেন, ক্যাম্পে চলেন। কমান্ডার, স্যার তোমাক খোঁজ করবে ...
রসিক
কোন্ শালা কমান্ডার? তোমার কমান্ডারকে বলো, বাচ্চার কোনো গতি না হইলে, লাশটার কোনো সৎকার না হইলে হামি সবাইকে খুন করে ফেলিমো, কোনো শুয়োরের বাচ্চা হামাক থামাবার পারিবে না... বাসুদেব ডাক্তারের কাছে হামি নাড়ি কাটার ক্ষুর নিয়া রাখচি, ঐ ক্ষুর দিয়া হামি সবাইকে খুন করে ফেলিমো...
(ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে সীমান্তের খুঁটি ধরে দঁড়িয়ে আছে মর্জিনা। হাতে দুধের একটা ফিডার। পেছনে নাজিমুদ্দি দাঁড়ানো। প্রহরীরা টহল দিচ্ছে।)
প্রহরী
ভাবি, কী আনছেন, দুধ? আনাই সার। এই দুধ লইয়া বাচ্চার কাছে যাওয়া যাইবে না তো। এর ভিতরে গেছেন তো মনে করেন গুলি শুরু হয়া যাইবো ওপার থন।
নাজিমুদ্দি
এতক্ষণ খাড়ায়া কী দ্যাহো, চল বাড়ি চল।
মর্জিনা
না, মুই যাবার নাও। মোক বাচ্চাটাক আনি দাও। আমি ওক নিজের বেটার মতন মানুষ করমো।
নাজিমুদ্দি
বেটা না বেটি তুমি জানলা কেমনে?
মর্জিনা
বেটা না হইলে বেটি হইবে, মানষের বাচ্চা তো?
নাজিমুদ্দি
হইল মানুষের বাচ্চা, হেন্দু না মুসলমান, এই পারের না ওই পারের, সেইটা তো কেউ জানে না।
মর্জিনা
বাচ্চার ফির হেন্দু মুসলমান কী গো? আর বাচ্চা জন্মাইছে নো-ম্যান’স ল্যান্ডত, তার আবার এপার-ওপার কী?
(শীতে, কান্নায় কাঁপতে কাঁপতে দাঁতে দাঁত খটমট শব্দ তুলে সে। নাজিমুদ্দি জড়িয়ে ধরে মর্জিনাকে)
নাজিমুদ্দি
দেইখো, তোমার কোলে বাচ্চা আইবো। ফুটফুটে বাচ্চা। কাইনদো না। চল।
(হলদিবাড়ি ছাউনিতে পতাকা বৈঠকের আয়োজন চলছে। দুই প্রান্তেই ওড়ে পতাকা। পতাকা বৈঠকে বসে দু পক্ষ)
কমান্ডার
তোমহারা এক আদমি নো ম্যান’স ল্যান্ড মে মারা পারা হ্যায়। আউর...
মিজান
যে মরে পড়ে আছে সে আমাদের নাগরিক নয়।
কমান্ডার
আউর উসকে পাস জো বাচ্চে পারা হ্যায়?
মিজান
ওটা তোমাদের নাগরিকের বেবি। কাজেই তোমরা ওকে নিয়ে যেতে পারো। আমাদের কোনো আপত্তি নাই। নাজিমদ্দিন খাবার-দাবার কী করছ নিয়া অসনা কেন?
কমান্ডার
নেহি নেহি হো টো তোমহারে আদমি হি। ইল্লিগাল্লি ইধার এ গায়া থা। উই আর কাইন্ড ইনাফ টু সেন্ড হার ব্যাক উইদাউট পানিশম্যান্ট।
মিজান
না না, ও তোমাদের নাগরিক, তোমাদের ভাষা বলে, তোমাদের ওখান থেকে এসেছে। তোমরা ওর দায়িত্ব নাও। তোমরা ওর সৎকার করো।
কমান্ডার
নো নো ইউ ক্যান প্রসিড উইথ দ্যা বডি।
মিজান
বাচ্চাটার কী হবে?
কমান্ডার
তুম লে যাও। বাচ্চেকো তাকলিফ হো রাহা হ্যায়। ডোন্ট টেক টু মাচ টাইম।
মিজান
আমরাও তাই বলি, দেরি করো না। শেষে না মরে-টরে যায়। শিশুহত্যা সব রীতিতেই নিষেধ।
কমান্ডার
জো কারনে হ্যায় তুমকোহি কারনা হ্যায়।
মিজান
আসলে আমরা বন্ধুপ্রতীম। আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক। কাজেই সেটার অংশ হিসাবে তোমরা ওই মৃতা ও তার বাচ্চার দায়িত্ব নাও।
কমান্ডার
তোম হামারে বহুৎ আচ্ছে দোস্ত হো। হামারা দোস্তি হার কাসুটি পে খারা উতরা। উস্ বাচ্চে আউর উসকো মা কা রেসপন্সিবিলিটি তুমহারে উপার হি তো হ্যায়।
মিজান
না না, এর আগে তোমরা গরুর চালানটা নিয়ে কী কা-টাই না করলে, ভুলে যাইনি... স্যরি খান।
কমান্ডার
আগার হামারা বাৎ সুনতে তো ও দো গাই হাম নেহি রাখতে। ফরগেট ইট। আগে বহুৎদিন পারে হ্যায়।
(নেপথ্যে : ‘এইটা কোন ধরনের অবিচার বাহে, আল্লার আরশ ভাঙি পড়িবে।’ ‘আল্লার গজব পড়িব।’ ‘তোমরা কেমন মানুষ- লাশ ফেলায়া থোন, মাসুম বাচ্চাটাকে বাঁচাইবার না দেন বাহে।’- ইত্যাদি)
কমান্ডার
আই থিংক সিচুয়েশান ইজ নট আন্ডার কন্ট্রোল।
মিজান
কিছুই তো খাওয়া হলো না। তাহলে মিটিং ক্লোজ করি।
কমান্ডার
ওকে লেটস গো অসীম বাবু।
আগন্তুক
বল এক পক্ষ থেকে অন্য পক্ষের কোটে ঠেলে দেয়া হচ্ছে শুধু। পল্টুর মার দেহখানি ওই নো-ম্যান’স ল্যান্ডেই পড়ে থাকে কয়েকদিন। প্রচণ্ড শীতে দেহখানি অবিকৃতই থাকে।
লোক ১
রোদ ওঠে পরেরদিন বিকালে। তখন সবকিছু আবার পরিষ্কার। তখন দেখা যায় পল্টুর মার দেহখান আর ওই জায়গায় নাই। কে তাকে নিয়ে কোথায় গিয়েছে- কেউ তা জানে না। শেয়াল, কুকুর টেনে নিয়ে গেছে, নাকি কোনো মানুষ, নাকি এ এক জিন-ভূতের কাণ্ড। কেউ সেই রহস্য উদ্ধার করতে পারেনি। অবশ্য উদ্ধারের চেষ্টা যে খুব হয়েছে, তাও নয়। সাংবাদিক পরিমল মজুমদার অবশ্য খবরটা সংবাদপত্রে ছাপার জন্য পত্রিকা অফিসে পাঠিয়েছিল কিন্তু কেন যেনো ছাপা হয়নি।
লোক ২
সীমু কিংবা রানির খবরটা যাতে ছাপা না হয় সে ব্যাপারে দুই ফাঁড়ির কমান্ডারই সতর্ক ছিল। তারা চায় নাই এই খবর ছাপা হোক। কারণ যত দেরি হচ্ছে ততই খবরটা তাদের ভাবমূর্তির জন্য হুমকি হয়ে যাচ্ছিল। একটা মানবশিশু না-মানুষি জমিনে থাকে, একটা বাঁদর তার দেখাশোনা করে, আর কোনো পক্ষই এই মানবশিশুটিকে তাদের পারে ঢুকতে দেয় নাই।
লোক ৩
অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে যেন নামছে শীত। রানি বাচ্চাটাকে তার রোমশ বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখে। বাচ্চাটার দায়িত্ব একজন যথার্থ মায়ের মতোই পালন করে চলে রানি। রোজ সকালে আর বিকেলে মর্জিনা সীমুর জন্য ফিডার নিয়ে আসে, রানি দৌড়ে সেই ফিডার সংগ্রহ করে সীমুকে কোলে করে খাইয়ে দেয় পুরো দুধটাই।
আগন্তুক
রসিকলাল, অমল, বাসুদেব, পরিমল রানির জন্য খাবার পাঠায় পালা করে। তিনদিনের মাথায় খুব কুয়াশা পড়ে। এমন কুয়াশা যে কিছুই আর দেখা যায় না। না রানিকে, না বাচ্চাকে। কুয়াশায় পথ চিরে চিরে লাল শাড়ি পরা মর্জিনা এসে দাঁড়ায় নো-ম্যান’স ল্যান্ডের কিনারে।
(দুধের ফিডার হাতে দাঁড়িয়ে থাকে মর্জিনা। একটু দূরে দাঁড়ানো নাজিমুদ্দি। মর্জিনা খানিকক্ষণ কুয়াশায় দাঁড়িয়ে ডাকতে থাকে- )
মর্জিনা
রানি, রানি... আহারে, বাচ্চাটা কষ্ট পাওছে। সারা রাইত এক ফোঁটা দুধও পাও নাই, মা বেঁচে থাকলে সারা রাইত সে থাকতো মায়ের ওমত্, বুকের সঙ্গে লেপ্টে। তার মায়ের কোল নাই, ময়ের দুধ নাই, মাথার উপরত্ ছাদ নাই, দেশ নাই, কোনো পরিচয় নাই... এই তোমরা কোনঠে?
নাজিমুদ্দি
এই যে এইখানে।
মর্জিনা
কী করেন?
নাজিমুদ্দি
মুতি। নো ম্যান’স ল্যান্ডত মুতি।
(মর্জিনার বুকের ভেতরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়, তার দুচোখ গলে আসতে চায়। সে দুধের ফিডার নিয়ে নো-ম্যান’স ল্যান্ড ধরে হাঁটতে থাকে। ঘন কুয়াশার মধ্যে পথহারা হয়ে ঘোরে সে। তখন তার কানে আসে শিশুর কান্নার আওয়াজ। মর্জিনা বুঝে উঠতে পারে না কী করবে সে। মুহূর্তেই উঠে যেতে থাকে কাঁটতার বেয়ে। তখনই নলচেপাড়া-হলদিবাড়ি সীমান্তে একটা ‘গুড়ুম’ শব্দ হয়। মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়)
সাইফ সুমন : সদস্য- থিয়েটার আর্ট ইউনিট। সহযোগী সম্পাদক, থিয়েটারওয়ালা