Full premium theme for CMS
এক যে ছিল
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[মহান বাঙালির মত্যুতে তাঁর লেখা দিয়েই তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা-সম্পাদক]
এক যে ছিল রাজপুত্র।
সেই ছেলেবেলা থেকেই তার
মৃগয়াতে নেই মন
মন নেই দৌড়ঝাঁপ খেলাধুলোয়
বন্ধুদের সাথে নেই হাস্যোচ্ছল কালক্ষেপ
নেই নজর সাজপোশাকের দিকে
উদাসীন সে রাজসিক উৎসব অনুষ্ঠানে প্রমোদে-বিলাসে
আর বিমুখ সে পৃথিবীর যাবতীয় জাঁক থেকে।
কেন?
না, সে মনের ভিতর না জানি কোন রাজকন্যাকে দেখেছে। তাকে
ভালোবেসে সে আর সব বুঝি ভুলেছে-
সম্পদ আর প্রতিপত্তি, ক্ষমতা আর লোভ। সবই কত তুচ্ছ কত
অর্থহীন তার কাছে।
কেবল আর একটা জিনিস ছাড়া।
রাজপুত্রের ঐ এক খেলা- দল গড়া। কিছু মানুষ
একজোট হয়ে কিছু করছি এ তার বড় ভাল লাগে।
আর ভাল লাগে বাড়ী পালিয়ে ভারতবর্ষের
এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো।
রাজপুত্র হাঁটে, দিন নেই রাত নেই।
রাজপুত্র হাঁটে, চোখে তার সেই রাজকন্যার ধ্যান।
এই করতে করতে জানা গেল রাজপুত্র আর কাকে ভালোবাসে।
উত্তর বদ্রীনাথ বড় তীর্থ
বড় ঠাণ্ডা
সেখানে হিমালয়ের গায়ে দেখে এক দম্পতি
ছেঁড়া কাপড়ে শীতে কষ্ট পাচ্ছে। রাজপুত্র তো
পথে পথে সব বিলাতে বিলাতে এসেছে, এখন যে তার গায়ের
কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই। কি করে কি করে
হঠাৎ ভাবে, তাই তো
পরনে ধুতি তাতে এগার হাত কাপড়
নেই তো দরকার সবটুকু তার।
যেই ভাবা সেই কাজ, পটাপট ছিঁড়ে ফেলে সে ধুতি
আর আধখানা তার দেয় মা ডেকে সেই দুজনার একজনকে
আর ভাবে, ভেবে প্রতিজ্ঞা করে,
যতদিন দেশে থাকবে অভাব
কষ্ট পাবে মানুষ খাবার নেই কাপড় নেই বলে,
ততদিন সে এই আধখানা ধুতিই পরবে
আর বাধ্য না হলে পরবে না জামা।
এখন জানা গেল তার সেই আরেক ভালোবাসাকে-
মানুষ- সব মানুষ, বিশেষ করে যারা বঞ্চিত ক্ষুধিত দুর্বল।
ছিল এক রাজপুত্র
হল তার তিন ভালোবাসা
তার একটাকে তো চিনলাম অভাবী যত মানুষ
আরেকটাও জানি- সেই সব মানুষ দিয়ে দল গড়া।
সবাই মিলে একত্রে বাঁচা।
আরেকটা যেন কী?
যে থাকে তার চোখের মণিতে।
ঘোর হয়ে তাকে ঘোরায় পথে বিপথে
নগর থেকে নগরান্তরে
শেষে নিয়ে যায় তাকে তার নিজের রাজ্য থেকে রাজ্যান্তরে-
রাজপুত্রের ঘুর লেগেছে নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে
ঘুর লেগেছে।
এর নাম কি ভালোবাসা? রাজকন্যার জন্য?
কোথাকার সেই রাজকন্যা?
সুরপুরের।
সুরপুরের? সে কোথায়?
কোথায় নয় সে, সবখানে সে সবখানে।
সুর আছে সবখানে
মনের ভিতর
শরীরের ভিতর
নদীর ভিতর, বনের ভিতর
আকাশের ভিতর, আলোর ভিতর
পাখির ভিতর, চাঁদের ভিতর, ফুলের ভিতর
প্রান্তরে সমুদ্রে মেঘে গাছে পাথরে মাছে মানুষে মানুষে।
সুর আছে সবখানে।
কোথায় নয় তবে সুর বল দেখি?
আরে এ আবার কেমন কথা!
নেই সে কোথায় তাহলে
নেই সে কেবল স্পর্শে, নেই সে কেবল গন্ধে
নেই সে কেবল ছবিতে, নেই সে কেবল স্বাদে
নেই এমন কি কণ্ঠেও, সুর নেই গানেও।
আছে সে কেবল সব কিছুর প্রাণে।
প্রাণে আর মনে, মনে-প্রাণে।
এই তবে সেই রাজ্য সুরপুর?
কিন্তু তার সে রাজকন্যা
তাহলে সেই বা থাকে কোথায়,
আর পাওয়াই বা যায় তাকে কি করে?
কেন?
সুর আছে তো সবখানে, চাই কেবল তার প্রতি ভালোবাসা।
মন প্রাণ জোড়া ভালোবাসা।
যে সঁপেছে জীবনখানি তার সুরকে বড় আকুল ভালোবেসে
কোন কিছুর লোভ না করে, তার
চোখের ভিতর, মনের ভিতর
মাথার ভিতর, শরীরের ভিতর
অনুক্ষণ বাস করে সেই কন্যা।
তার সুরে সুর মেলায় আমাদের রাজপুত্র।
আমাদের রাজপুত্র সেই তাকে পেয়েছিল।
সুরপুরের রাজকন্যাকে পেয়েছিল
এমনিতেই সে রূপে কার্তিক ঠাকুর, কন্দর্প ঠাকুর, কেষ্ট ঠাকুর- দীর্ঘ
শালপ্রাংশু সুদেহ, সেই গৌরদেহের ওপর ঝাঁকড়া চুলো মাথায়
ঘনকালো চোখ। রাজকন্যাকে যখন সে
পেল সে চোখে দৃষ্টি তার হল দিগন্ত-বিস্তার
ঠাঁই নিল সেখানে সব ভালবাসা সব মমতা
সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জন্য
আর কী যেন এক লুটিয়ে-পড়া মগ্নতা।
রাজপুত্র এবার মেলাল তার তিন ভালোবাসাকে
অমৃতের পুত্র মানুষ। যাকে সে ভালোবাসে
তাদের নিয়ে গড়ল দল যা সে ভালোবাসে।
আর সেই দলকে দিল সে সুরপূজার ভার
যে সুরকে সে ভালোবাসে।
তৃপ্ত-তুষ্ট রাজকন্যা কত কত উপহার দিলেন তাদেরকে
রাজপুত্র দেখে তার সব তো ধরা যায় না পাত্রে তেমন পাত্রই বা কই।
বানাল সে তাই কত যে বিচিত্র মোহন নতুন আধার।
কত কত সব সুর আর সুরের যন্ত্র।
অবসান আছে তো সবকিছুর, সে যদি খুব ভাল হয় তবে যেন তত
তাড়াতাড়ি তা ফুরায়।
দিন ফুরাল ভালোবাসার আনন্দের, দিন এল ভালোবাসার পরীক্ষার,
ভালোবাসার মূল্য দেবার।
খবর এল দৈত্য এক কালো নেমেছে লক্ষ শকুনির ওপর ভর করে
রাজপুত্রের রাজ্যে,
যাচ্ছে মারা প্রতিকারহীন মানুষ অগণিত।
রাক্ষসে দেশ ছাইয়া গিয়াছে আর রক্ষা নাই।
একদিন সেই সুর সভায় রাজপুত্রকে আর পাওয়া গেল না।
সব ছেড়ে ছুটে এসে দৈত্যকে বলে সে পরাক্রম ভরে
আমি তোমাকে ভয় পাই না
আমি তো ক্ষণকালের মানুষ
আর তুমি তো আদিহীন কালের দৈত্য
অন্ধকারের বঞ্চনার প্রতারণা-শঠতার
মনুষ্যত্বহীনতার গ্লানির, ক্ষুধাজরামৃত্যুর
আমি তোমাকে হারাতে নাই পারি এখনই সম্পূর্ণ
আমাকেও তুমি পারবে না কখনই।
আর এই অপরাজেয় শক্তি নিয়ে মানুষও তো অন্তহীন কাল থাকবে
কেবল, কেবলই তোমাকে কেবল উৎসাদন করে করে তার
অবিরাম জয়যাত্রা চলতেই থাকবে।
শুরু হল যুদ্ধ, মন্বন্তরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ১৩৫০ এর মন্বন্তর।
রাজভাণ্ডার খুলে দিল রাজপুত্র। যত আহত আর্ত মানুষের কুটিরে সেবা নিয়ে গেল সে, দিন নেই, রাত নেই, ক্লান্তি নেই, নিদ্রা নেই। সেই ভালোবাসায় ঘন চোখ দুটাতে এখন ভর করেছে উৎকণ্ঠা- তার মানুষের জন্য। তবু সে বিরাম না মানে। আর এই করতে করতে রাজপুত্র যেই ভুলল নিজের শরীরের আত্মরক্ষার কথা দৈত্য প্রবেশ করল কালব্যাধি হয়ে সেই অনঙ্গমোহন দেহে। রাজপুত্র অবহেলা ভরে দেহ ত্যাগ করল, তার ভালোবাসাকে ত্যাগ করল না।
এই রাজপুত্রের নাম সুরেন্দ্রলাল দাস। চট্টগ্রামের কাট্টলী অঞ্চলের জমিদার প্রাণহরি দাসের পুত্র। পরম রূপবান এই মানুষ বাল্যাবধি ধনকে তুচ্ছ করে মনকে পূজা করেছেন, সুরের নেশায় মাতাল হয়ে ভারতবর্ষের নগরে প্রান্তরে বনে ঘুরে বেড়িয়েছেন। গড়েছেন আর্য সংগীত সমাজ, আকাশবাণীর যন্ত্রী সংঘ। ঐকতান রচনায় পেয়েছেন সর্বভারতের গুরুর মর্যাদা- সুরের বিশেষ বাঞ্ছিত রং আনার জন্যে উদ্ভাবন করেছেন অনেক অনেক যন্ত্র যা এখন সর্বত্র বহুল প্রচলিত, জনপ্রিয়। তেরশ পঞ্চাশের মন্বন্তরে তিনি সংগীতের আসর থেকে অন্তর্ধান করে নিজ গ্রামে আর্তের সেবায় জীবন বিসর্জন দেন।
কোন রূপকথাই কেবল রূপকথা নয়, কোন রূপকথায় মানুষের ত্যাগ আর শৌর্য, বিজয় আর সৌন্দর্যের চাইতে বেশি বিচিত্র বেশি সুন্দর নয়। বরং সব রূপকথাই সত্যিকার মানুষেরই ভালো, সত্যিকার মানুষেরই মন্দ দিকটা মনে রাখবার মত বিশেষ ভাষায় ধরে রাখে মাত্র।
[বিঃদ্রঃ- ওয়াহিদুল হক রচিত কবিতার এই রাজপুত্র কি কেবলি সুরেন্দ্রলাল দাস? এক্ষণে, এই বাংলাদেশে, আমাদের মনের ভেতর আরেক রাজপুত্রের উপস্থিতিও আমরা নিশ্চিতভাবেই টের পাই- সম্পাদক]
ওয়াহিদুল হক : সদ্য প্রয়াত বাঙালি