Full premium theme for CMS
আবদুল্লাহ আল-মামুন: যোগসূত্রকার তিনি
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স্বাধীনতার আগে-পরের থিয়েটারে একটা ছেদ ঘটে। যেন তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্কের সূত্র-চিহ্ন নেই। সেটা বেশ ক্ষতিকর হয়েছে এখন বোঝা যায়। দর্শক-সাধারণের বড় বেশি ভেদ ঘটে গেছে তাতে। ‘আধুনিকতা’ বিষয়টি স্বভাবতই ঘটায় এমনতর বহুধা বিচ্ছেদ বিভেদ। যেন এতকালের সবকিছু রদ্দিমাল, পঁচা-গলা-বাসি। কেবল লোকসাধারণের উপভোগ্য। আর আধুনিক, রুচিশীল প্রগতিমানদের কাছে তাই তা ত্যজ্য অচ্ছুৎ। উপনিবেশ-মারফত আমরা এই সর্বনাশা আত্মঘাতী মন-মগজ-শিক্ষা পেয়েছি। সেই হয়েছে কাল। আতœনাশা এক উচ্চ-নিচ ভেদ-বিষের ছোবল দেশ-সমাজের সবকিছু ‘অপর’ করে ছেড়েছে। সেই বিরাণভূমেই আমাদের যত আধুনিকতার জয়ডঙ্কা-স্তম্ভ। সকলের, সাধারণের সেখানে প্রবেশ নিষেধ।
নাট্যকার হিসেবে আবদুল্লাহ আল-মামুনই বুঝি একটা সংযোগ-সূত্র খুঁজতে চেয়েছেন। স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকেই গণমাধ্যম টেলিভিশনে রচনা-পরিচালনার অভিজ্ঞতা তাঁকে পথ দেখিয়েছিল মনে হয়। সাধারণ এক দর্শক-ভোক্তার গ্রহণক্ষম হবার দায়পালন করতে হত তো সেখানে বাধ্যত। নির্দিষ্ট এই প্রাক-শর্ত যথা-পূরণ করেই যা-কিছু করার করতে হতো। আর এই নিয়ম মেনেই তিনি করেছিলেন- সংশপ্তক।
শিল্পরূপায়ণে এই দায় চিরকালই তো পালন করতে হয়েছে বিরাট বড় সব নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতৃর। গ্রিসে তো আম-জনতার দরবারে প্রতিযোগিতা করেই হতে হয়েছে কাউকে সফোক্লিস, ইউরিপিদিস। শেক্সপীয়রও অশ্লীল ইতর যত সাধারণের সামনে পাশমার্ক পেয়ে তবে হয়েছেন ‘শেক্সপীয়র’। আমাদের বেলা সবেতেই ঘটেছে বিপত্তি। রবীন্দ্রনাথকে জনতার সামনে মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারেন নি যে মহানট-নির্দেশক শিশিরকুমারও। হাস্যরসাত্মক রবীন্দ্রনাটক কিছু কেবল করেছেন তিনি। যদি তিনি আর একটু সাহস করতেন তাহলে রবীন্দ্রনাথও কি তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে বোঝাপড়ায় নামতে চাইতেন না জনসমাজের সঙ্গে? অবশ্য ততদিনে নগরেও ভেদ ঘটেছে দর্শকের আর নাট্যজনও সরল চোরাপথেই বাজিমাত করতে গিয়ে রুচি পতিত করেছিলেন তাদের।
আবদুল্লাহ আল-মামুন অবশ্য টেলিভিশনের পোক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই নতুন রূপরীতি ভাবনার নাটক মঞ্চে করেছেন। মধ্যবিত্ত দর্শককে একটি ভিন্ন রুচির আস্বাদ দিয়েছেন সুবচন নির্বাসনে নাটকেই। সাধারণের সংস্কার-বিশ্বাস-সংকটকে সরল বয়ানে হাজির করেছেন। প্রয়োগের যা কিছু অভিনবত্বও তাতে দর্শকগ্রাহ্য হয়েছিল। অভিনয়েও ছিল চেনা তবে ভিন্ন বাচন। মোহম্মদ জাকারিয়া নতুন-পুরনোর এই মেলবন্ধনে সহায়ক হয়েছিলেন নিশ্চয়। শম্ভূ মিত্রের দীক্ষায় তিনি আয়ত্ত করেছিলেন বাংলা মঞ্চাভিনয়ের ধারাবাহিক পূর্বাপরতায় অভিনয়ের সমকালীন বাকস্পন্দ। সেই সঙ্গে ফেরদৌসী মজুমদারও পরাধীনতার অর্গলমুক্ত তীব্র বাচনে দর্শককে একটি পাটাতনে সংহত করেছিলেন। ক্রমে আবদুল্লাহ আল-মামুন খানিকটা উৎপল দত্তের দৌত্যে অভিনয়ে গতির এক স্মার্টনেস আনেন- মূলত বাচনের খিপ্র ক্ষেপণে। তাতে কথার ধ্বনিবিন্যাস খাপি আটোসাটো হয়ে পড়ে। পূর্ববর্তী ভাবালু সুর স্বর থেকে নবীন বাকস্পন্দ এভাবে আয়ত্ত হয়। আর তাতে অভিনয় অধিক জীবন্ত বাস্তবানুগ লাগে। দুইবোন-এ রবীন্দ্রবাচনও সজীব কথ্য হয়ে ওঠে।
সুবচন নির্বাসনে বাংলাদেশের থিয়েটারে বড় একটি ঘটনা। একেবারে যেন নাগরিক সমাজ-মানস থেকে উঠে এসেছিল আখ্যান-বাচনটি। তাতে মঞ্চের সঙ্গে দর্শকের শুভ এক যোগ ঘটে। আগেকার নাটকের থেকে ভিন্ন এক নন্দন-সম্পর্ক সূচিত তাতে হয়। অথচ এই ধারাটির যথা-বিকাশ ঠিক ঘটে নি। দর্শক আর দেশ-সমাজ-সময়ের সঙ্গে মিলে, পারস্পরিক বিনিময়ের থিয়েটারটি গড়ে ওঠে নি। একদিকে রাজনীতি আর অন্যদিকে প্রয়োগ-রূপায়ণের নানা শিক্ষা-দীক্ষা স্বাভাবিক সেই বিকাশে বাদ সেধেছিল। এরই ফলে দর্শকসাধারণ টেলিভিশনে তার নাট্যরুচি খুঁজে নেয়। মঞ্চ ক্রমে স্বল্পজনের ভোক্তা হয়ে আত্মমুগ্ধ নন্দন-বিলাসে সৌখিন সাহেব হয়ে ওঠে।
দর্শকের শ্রবণে-দর্শনে এভাবে নবসৃজন-নাট্য চেনা অভ্যস্ত হতে থাকে। এখন দুঃসময়, সেনাপতি, এখনো ক্রীতদাস বা শেষের মেরাজ ফকিরের মা তাঁর নিজস্ব সৃজনসীমায় সমাজ-সময়-দর্শক সংলগ্নতা পেয়েছে। হঠাৎ স্মার্ট কোনো আধুনিকতার বাতিক তাঁর ছিল না। সৈয়দ শামসুল হকের নাটক তাঁকে দিয়ে করাতে নিশ্চয় বেগ পেতে হয়নি দলকে। কিংবা ওথেলো চরিত্র নাট্যশিক্ষিত তবে নবাগত তারিক আনামকে দিতে দ্বিধা করেন নি। তেমনি ফেরদৌসী মজুমদারকে অভিনয়ের আবশ্যকীয় জায়গা দিতে নাট্যকার নির্দেশক হিসেবে তিনি ছিলেন অনড় আপোষহীন। তাঁর জন্য নাটক লিখেছেন, তাঁকে নিয়ে ডকুমেন্টারি করেছেন। দলের ভাঙনও পরোয়া করেন নি। এভাবেই কি বিকশিত হয়নি একজন তৃপ্তি মিত্র, মায়া ঘোষ বা শিমূল ইউসুফও? লালন পরিচর্যার যথাক্ষেত্র বিনা প্রতিভা কী করেই বা ডানা মেলবে আর সকলকে ছাপিয়ে, ছাড়িয়ে। মধ্যমের হা-হুতাশ যতই কেন ব্যথিত করুক, আমাদের মানতে হবে সৃজনক্রিয়ায় নানা নিষ্ঠুর নির্মমতা থাকে- যেমন কিনা প্রকৃতিতেও। কতকিছু দ’লে চাপা দিয়ে তবেই না পুষ্প বিকাশে!
টেলিভিশন-সূত্রে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের তাবৎ অভিনেতৃর শিক্ষক, আচার্য। তাঁর দীক্ষা-সহায়তা বিনা একটি কোনো তারকাও বুঝি ফুটে ওঠেনি, জ্বলজ্বল করেনি অমোঘ ছোট পর্দায়। পরবর্তীকালে অনেকেই তারা অবজ্ঞা করেছেন তাঁকে মিডিওকার বলে। তবু এই মিডিওকারের হাত দিয়ে কত জিনিয়াসও যে পয়দা হয়েছে- চাইলে নাম ধরে ধরে বলা যায়।
সব মিলে বলা যায় তিনি নিজের মতো করে মেলাতে পেরেছিলেন মঞ্চ আর মিডিয়া। ওপরে ওপরে কোনো রাখঢাক তিনি করেন নি যে। মুখে মিডিয়াকে খিস্তি করে গোপনে তার সেবাদাস সাজেন নি। নাচতে নেমে কোনো ঘোমটা তিনি রাখেন নি। ক্রমে যখন সকলকেই খুলতে হয়েছে লজ্জা শরমের বালাই। এই দুই নম্বরী না করলে বুঝি, সাধারণ দর্শককে কিছুটা সম্মান দিলে দুটি মাধ্যমই যে-যার স্বাতন্ত্র্য স্বাধীকারে বিকশিত হতে পারতো। একটিকে রুচি-নিরীক্ষা-নন্দনের শুচিবায়ুগ্রস্ত করে জল-অচল ব্যবধানে রেখে বাস্তবে গাছেরও খাবো তলারও কুড়ানোর বাজারীরঙ্গে না মাতলে চলতো না কি? নীতি রুচি আদর্শের খোলস বা মুখোশটি না পড়েই আবদুল্লাহ আল-মামুন সংশপ্তকের মতো নাটক করেছেন টিভিতে। অবমাননার খিস্তিখেউর গ্রাহ্য না করেই তাঁর সাধ্যমতো দুটি মাধ্যমেই নাট্যরচনা নির্দেশনা অভিনয় করে গেছেন।
তাই তো সারা বাংলাদেশের দর্শকের মনে তাঁর এমন আচার্য পিতামহের আসন।
তবু শেষ পর্যন্ত তিনি কি একজন পরাজিত সেনাপতি? বহু রণজয়ের স্মৃতি তার ভুলে বসে আছি তাই কি আমরা?
এই তো চিরকালে জীবন-নাট্য-লীলা! সব দিয়েই তো একে একে কেড়ে নেয় সব তার গুণে গুণে কানাকড়ি পর্যন্ত। প্রবল এই সত্যের সামনে কেমন যেন বিহ্বল, ব্যথিত দেখাতো তাঁকে শেষের দিকে। সৃজনের সেই মনটা ক্রমে যেন নিভে আসছিল, ক্ষয়ে যাচ্ছিল। তবুও তিনি রণেভঙ্গ দেবার পাত্র ছিলেন না। যতক্ষণ জান ততক্ষণই ছিল যেন তাঁর গান। মুখে লেগে থাকতো তাঁর কেমন এক কৌতুকের মুচকি হাসি চারপাশের যত রঙ্গ দেখে শুনে। হাসিমুখে মেনে নিচ্ছিলেন তিনি সব।
এভাবেই বুঝি হয়ে উঠেছিলেন তিনি পিতামহ ভীষ্মেরই মতো! মনের যত যাতনা-বেদনা সয়েও হাসতে পারতেন তাই চির নায়কেরই মতো।
ধন্য নটবর, ধন্য তোমার নায়কোচিত নাট্যজীবন যাপন।
ড. বিপ্লব বালা: নাট্যশিক্ষক, নাট্য-সমালোচক