Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সেলিম আল দীন: ব্যক্তিগত এবং ব্যক্তিগতকে ছাড়িয়ে

Written by অরুণ সেন.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

প্রকাশ্যে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বা আত্মপ্রসঙ্গের অবতারণা আমরা অনেকেই সাধারণত এড়িয়ে চলতাম। যে রুচিতে বা অভ্যাসে একদা বেড়ে উঠেছি, তাতে ‘আমি’ শব্দের উচ্চারণই প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। সেটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি। এখন মনে হয়, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তোলারও একটা নিজস্ব জায়গা আছে। আমরা যারা সেলিম আল দীন-কে কম-বেশি চিনতাম, তাঁর সম্পর্কে কোনো ভাষণে বা লেখালেখিতে ‘ব্যক্তিগত’ প্রবেশ না করে সে-বিষয়ে সতর্ক থাকতাম।
২০০৮-এর ১৪ জানুয়ারির পর থেকে সেই সতর্কতা যেন অবান্তর হয়ে গেল।

অবশ্য সেলিম আল দীনের সঙ্গে আমার পরিচিতি বেশি দিনের বলা যাবে না- এখানে উপস্থিত অনেকের চেয়েই বেশ কম। কিন্তু, অল্পকালের মধ্যেই সেই পরিচয় এমন একটা মাত্রা পেয়েছিল, এবং তার ফলে ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিকের মধ্যে একটা সমন্বয় তৈরি হয়েছিল, যা নিঃসন্দেহে আমাদের উভয়ের কাছেই ছিল মূল্যবান অভিজ্ঞতা। তার সূত্রপাত অবশ্যই একান্ত ব্যক্তিনিরপেক্ষ। কলকাতায় সেলিমের নাটকের মঞ্চরূপায়ণ প্রত্যক্ষ করার উত্তেজনা আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর নাটকের নিবিড় পাঠে, এবং দুটো মিলিয়েই যে নান্দনিক প্রাপ্তি তার হাওয়াতেই সেলিমের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জমি তৈরি হয়েছিল। কুণ্ঠার সঙ্গে জানাই, সেলিমের নাটক ও ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়ের ওই উদ্দীপনাময় দিনগুলোতেই কলকাতার একটি অতিপরিচিত সাময়িক পত্রিকায় যে দীর্ঘ, বোধহয় অতিদীর্ঘই, প্রবন্ধ লিখেছিলাম তা-ই কোনো একভাবে আমাদের মিলিয়ে দিয়েছিল, বলা চলে। এই রচনাটির খেই ধরেই আমার সম্পর্কে সেলিমের যা-কিছু আবেগ সঞ্চিত হয়েছিল, এবং তার কোনো ক্ষয় ছিল না। সেলিমের দিক থেকেও এই অভিজ্ঞতায় পৌঁছোনোর একটা পূর্ব-ইতিহাস আছে। কলকাতায় বেশ কয়েকবারই তাঁর নাটক ও ঢাকা থিয়েটারের অভিনয় প্রসঙ্গে সেখানে যথেষ্ট কথাবার্তা হয়েছিল ঠিকই, ঢাকা থিয়েটারের অনেক তারিফও জুটেছিল, কিন্তু তা নিয়ে, বিশেষত সেলিমের রচনা নিয়ে বক্রোক্তিও কম হয় নি। হয়তো কিত্তনখোলা থেকে। তবে আরো বেশি যৈবতী কন্যার মন ও হাত হদাই-এর সময়ে। সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিকর ছিল ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সমালোচনা। ওই ফিরিঙ্গি সমালোচনায় সেলিমের রচনার ঔপনিবেশিকতাবিরোধী শিকড়-সন্ধানী বাঙালিয়ানার ভেতরের জোরটা বোঝার কোনো চেষ্টাই ছিল না। আমার সৌভাগ্যই বলতে হবে, বিমর্ষ সেলিমকে ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায় সমালোচনাটি যে সজ্ঞীবিত করেছিল, তা শুধু প্রথম আলাপের দিনটিতেই নয়, পরেও বারবার তিনি উল্লেখ করতেন। সেলিম স্বভাববৈশিষ্ট্যে তাকে প্রায় লজ্জাকর অতিশয়োক্তিতেও নিয়ে যেতেন, থামানো যেত না।

আর আমার দিক থেকে বলতে পারি , সেলিমের সৃজন সম্পর্কে আমার আগ্রহ তখন এতটাই যে আমি তাঁর প্রত্যেকটি রচনা ধারাবাহিকভাবে পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম। ছাপা যা ছিল তা তো বটেই, আমার উৎসাহের কারণেই হয়তো সেলিম নিজে, তাঁর রচনার ভাণ্ডারী পারুল এবং আরো অনেক বন্ধুরা জুগিয়ে গেলেন যা সহজে পাওয়া যায় না তা-ও। সেলিমের ছোটো-বড়ো, আগের-পরের নাটক, কিংবা নাট্য বিষয়ে তাঁর গদ্যরচনা এবং বলা বাহুল্য ঢাকা থিয়েটার সেলিম-প্রযোজনার যা-কিছু নথি বা তথ্য সংগ্রহ করে প্রায় একটা আর্কাইভই বানিয়ে ফেললাম কলকাতায়, আমার বাসায়। এরই পরিণতি সেলিম বিষয়ে আমার বই, অকিঞ্চিৎকর কিন্তু দায়বদ্ধ, যা বেরিয়েছিল ‘দুই বাংলার থিয়েটার’ নামক বগুড়ার এক শৌখিন প্রকাশনী থেকে। পাছে মনে হয়, তাই জানাই, এ কিন্তু কোনোভাবেই ব্যক্তির বিনিময় নয়। সেলিমের লেখা সম্পর্কে আমার উদগ্র আগ্রহের জন্ম হয়েছির যখন, তখন আমি সেলিমকে চিনিই না, কখনো তাঁকে দেখিই নি। অর্থাৎ, প্রক্রিয়াটা ঠিক উলটো, যা স্বাভাবিক তা-ই, ঢাকা থিয়েটারের অভিনয় বা নাসির উদ্দীন ইউসুফের প্রযোজনা থেকেই আমি পৌঁছে যাই সেলিমের লেখায়। সেলিমের লেখার পাঠ থেকেই ব্যক্তি সেলিমের সান্নিধ্যে।

সেলিমকে যদি আগের এবং পরের দুই ভাগে ভাগ করে ভাবি, পরের সেলিম দিয়েই আমার শুরু। সেলিমের লেখালিখি ও তৎসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের অভিযানে এমনকি কিত্তনখোলা’র আগের লেখাগুলোও সংগৃহীত হল। বিখ্যাত কয়েকটি ছাড়া তার অনেকগুলোই ছিল পাণ্ডুলিপি অবস্থায়। তখনও, বলা বাহুল্য, নাট্যসমগ্র-র প্রথম খণ্ডটি বেরোয় নি। এইসব আদি লেখাগুলোতে হয়তো সেলিমকে চেনাই যাবে না, কিন্তু তাদের লিখননৈপুণ্য টের পেতে অসুবিধা হয় না আজকেও। বোঝা যায়, তার কোনো-কোনোটির অভিনয় কেন জনপ্রিয় হয়েছিল। জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন থেকে শুরু করে মুনতাসির, বাসন, এমনকি শকুন্তলা পর্যন্ত বেশ কিছু নাটকের কথা মনে করেই বলছি। সেলিম যে সাফল্যের এই জায়গাটা অনায়াসে ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন পথে চলা শুরু করলেন- সবাই জানি কিত্তনখোলা থেকে- তাতে তাঁর নান্দনিক দায়বোধ কতখানি গভীর এবং নিশ্চিত তা বোঝা যায়। পশ্চিমি আদলের নাটক রচনায় এরকম নিঃসংশয় ক্ষমতা অর্জন করেও ছেড়ে আসা যে যায় সেটাই জানা গেল। বোঝা গেল স্বদেশী নাট্যের যে ধরনে তিনি পৌঁছোতে চাইছেন, নিজের মধ্যেই কোথায় তার অনিবার্যতা বা অমোঘতা। আমি একদা সেলিম বিষয়ক আলোচনায় শিল্পী যামিনী রায়ের কথা স্মরণ করেছিলাম। এটা কোনো তুলনা নয়। যামিনী রায়ের যে-ছবি আমরা আজ চিনি, তার আবিষ্কারও কিন্তু ঘটেছিল পশ্চিমি প্রকরণে অসম্ভব কর্তৃত্ব ছেড়ে শিল্পী যখন স্বদেশের জমিতে পা ফেলেছিলেন।

সেলিমের সমগ্রতা বোঝার জন্য তাই তিনি কী ছেড়ে কী ধরলেন, কোনখান থেকে নতুন করে শুরু করলেন, তা জানাটাও খুব জরুরি মনে হল। সেলিমের সঙ্গে যখন আমার আলাপের শুরু, তখন স্বভাবতই অনেকটা সময় পার করে তিনি তার ওই নতুন অভিজ্ঞতায় ও নতুন ভাষায় পৌঁছেছেন। ফলে, তাঁর প্রথম যুগের লেখাগুলো সম্পর্কেও আমার আগ্রহ দেখে বিব্রতভাবেই আমাকে নিরস্ত করতে চাইতেন। কিন্তু ততদিনে আমার মধ্যে সেলিমের চেনার প্রকল্পটি তৈরি হয়ে গেছে।

কলকাতায় থেকে বা ঢাকায় গিয়ে আমি যখন সেলিমের নাটক মুগ্ধভাবে পড়ছি, নাসির উদ্দীন ইউসুফের প্রযোজনায় অভিভূত হচ্ছি, তখনও কলকাতায় সেলিম সম্পর্কে অজ্ঞতা যেমন আমাকে পীড়িত করত, তেমনি ঢাকায় গিয়ে দেখতাম, তাঁর নাটক সম্পর্কে অনেকেরই উদাসীনতা বা কখনো-কখনো প্রত্যাখ্যান বস্তুত তাঁর কোনো আচরণ বা ব্যবহারবিধির আতিশয্য থেকেই জন্ম নিয়েছে। এর সত্যমিথ্যে বা তাদের বিচারের ধরন নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কখনো বোধ করি নি। তার চেয়ে অত্যাবশ্যক মনে হয়েছে তাঁর লেখার অসামান্যতা বিষয়ে যে-অনুভব উঠে এসেছে তাকে আরো সজ্ঞান করে তোলা।

আর এটা কোনো নতুন ব্যাপারও নয়। দেশবিদেশে ব্যক্তিপরিচয় ও শিল্পীপরিচয়ের জটিল সম্পর্কের অনুধাবনে এরকম সংকট অনেক দেখছি। দৃষ্টান্ত অবশ্যই আছে, শিল্পীসাহিত্যিকদের ব্যক্তি-আচরণের অসমতা যেখানে হয়তো নি®প্রভ করে ফেলে তাঁদের প্রতিভার দীপ্তি- ব্যক্তিত্বের নানা ত্র“টি ব্যতিব্যস্ত করে রাখে সামাজিক সহ-নাগরিকের রুচিকে। কিন্তু সময়ের দূরত্বে কিংবা তাঁদের সৃজনের নিশ্চিত গরিমায় সমকালীন সহযাত্রীরও একসময় মনে হবেই, এসব ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়ার অন্য একটা মানদণ্ড বা প্রেক্ষিত থাকা সম্ভব। এই বিশ্বাসেই কলকাতায়, এমনকি ঢাকায়ও, টেনে নিয়ে যেতাম বিরূপ বন্ধুদের সেলিমের সৃজনশীলতার পরিবেশে, কিংবা অপেক্ষা করে থাকতাম কখন তারা নন্দনের তীব্র ধাক্কায় তাঁর লেখা পড়ার জন্য তাগিদ অনুভব করে, কখন ব্যক্তিগত কারণের অনীহাকে উজিয়ে শিল্পের নিশ্চিতিকে স্পর্শ করতে পারে। অবশ্য তখনও, এবং পরে, বিশেষত তাঁর তিরোধানের পরে, স্বল্প সময়ের মধ্যে এ-ও অনুভব করেছি, ব্যক্তিত্বের যে গড়ন বা আচরণের কেউ-কেউ সমালোচক, সেই ব্যক্তিত্বই কিন্তু অনেককে অন্তরঙ্গ করেছে, আলোড়িত বা অনুপ্রাণিত করেছে। শিল্পের টান ছাড়া অন্য কোনো তাৎক্ষণিক সুবিধার লোভে ঘটেছে এমনও বলা যায় না। ব্যক্তিত্বের বিচারে স্বতঃপ্রবৃত্ত জনপ্রিয়তার দিকটিকেও তাই উপেক্ষা করা যায় না। কতজন যে সেই প্রীতি ব্যক্ত করেছেন নানাভাবে তার খবর আমার চেয়ে আপনারা অনেক বেশি জানেন।

এই যে সহমর্মী হওয়া, তা শুধু ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতা থেকেই আসে তা নয়। সেলিমের রচনায় ও তাঁর প্রযোজনার ভেতর থেকেই এক ধরনের সাড়া না পেলে তা কি ঘটতে পারত? সবাই নিজের-নিজের মতো করেই হয়তো সেখানে পৌঁছোন। এবং তা প্রথম থেকেই। একসময় হয়তো পশ্চিমি প্রকরণের ধাক্কা ছিল, পরে তাকে ছেড়ে এসে সক্রিয় হল শিকড়সন্ধানী তত্ত্বের আয়োজন- কিন্তু সবসময়ই শিল্পসাহিত্য উপভোগের যে নিজস্ব জমি, সেখানকার মৌল আবেদন, দেশ-কাল-মানুষ, তাকে সামনে নিয়ে আসার কৃতিত্ব লেখকশিল্পীর এবং তাকে আত্মস্থ করে নিতে পারে সবাই। আর সেই আবেদনেই শিল্পীর খুব কাছে পৌঁছোনো যায়- ব্যক্তি ও শিল্পী তখন এক জায়গায় এসে দাঁড়ায়। ব্যক্তির যেটুকু খামতি তাকে তুচ্ছ মনে হয়।

সেলিমের প্রথম দিককার নাটক, যাকে তিনি সংগতকারণেই আর তেমন গণ্য করতেন না, সেগুলোর বেশকটির সেকালীন প্রযোজনা-সাফল্যই শুধু নয়, তাদের পঠনযোগ্যতা আজও স্বীকৃত হবে। কারণ, সমাজের উঁচুতলার মানুষ বা শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষ, এবং তার পরিবেশকে যে-তীক্ষèতায় ও তেরছা-ভঙ্গিতে তিনি একদা দেখিয়েছেন, সে-ও তো জীবনের একটি দিকেরই প্রকাশ। এরপর নিজের অভ্যস্ত গণ্ডিকে ছেড়ে এসে তিনি যখন ছড়িয়ে দেখতে চাইলেন, স্বদেশের গাঁ-গঞ্জ ও তার নানা শ্রেণীর মানুষকে নিয়ে এলেন একের পর এক রচনায়- তখনও তো তাদেরকে ঘিরে যে-সত্য ফুটে উঠল, তা খুব সাবলীলভাবেই পৌঁছোতে পারল সকলের কাছে।

আমরা জানি, সেলিমের এই যে ছেড়ে-আসা এবং নতুন করে ধরা- সেটা কোনো খেয়ালি পথচলা নয়। নিজের ভেতর থেকেই তিনি বুঝতে পারছিলেন, শহুরে বিদগ্ধ মানুষের অভিজ্ঞতা যতই দামি হোক, তার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। তার বাইরে পড়ে আছে বিরাট দেশ- বিষ্ণু  দে-র কবিতায় ভাষায় ‘গ্রাম্য মহাদেশ লক্ষ গ্রাম’। যে-প্রকরণে তিনি নাগরিক বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতাকে ধরতে পেরেছিলেন, পাশ্চাত্যের সেই ‘নামধামে’ স্বদেশের বড়ো সত্যকে পাওয়া যাবে না। সম্পূর্ণ স্বদেশকে পেতে হলে চাই ‘শিকড়ে শিকড়ে বেঁধে’ নিজের সত্তাকে প্রাণ দেওয়া।

স্বদেশকে খোঁজার জন্যই তাই সেলিম আল দীন স্বদেশীয় ভাষার দিকে মুখ ঘোরালেন। বিষয় ও লক্ষ্যের বদলের সঙ্গে-সঙ্গে প্রয়োজন হল নতুন কাঠামো ও প্রকরণেরও উদ্ভাবন। উদ্ভাবন ঠিক নয়, যা ছিল তাকেই ফিরিয়ে আনা। কী ছিল যাকে ফিরিয়ে আনতে হবে? ইংরেজের উপনিবেশ-পত্তনের আগে বাংলার যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল এবং আজও মুমূর্ষু অবস্থায় হলেও টিকে আছে, সেখানেই তাকে পাওয়া যাবে। বাংলার মধ্যযুগের সাহিত্য কিংবা লোক-আঙ্গিকে। এ একেবারে নতুন কথা তা-ও নয়। বহু অ্যাকাডেমিক আলোচনায় তার উল্লেখ আগেই হয়েছে। কিন্তু সেলিম আল দীন বা সৈয়দ জামিল আহমেদের আগে এত বিশদভাবে কেউ বলেন নি। দুজনেই দুটি বৃহদাকার বইতে তা হাজিরও করেছেন। বস্তুত সেলিমের সঙ্গে আমার যখন পরিচয়, তখন বা তার কিছু আগে থেকে তিনি মধ্যযুগের বাংলা নাট্য নিয়েই গবেষণায় ব্যাপৃত ছিলেন। ১৯৯৬-তে সেই বইটির প্রকাশনার-অনুষ্ঠানে হাজির থাকার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। সমান্তরালভাবে একই লক্ষ্যে ও ধারণায় বাংলাদেশের দেশজ থিয়েটার নিয়ে জামিল কাজ করেছেন দীর্ঘকাল এবং সেই সরেজমিনের কাজ চোখে পড়েছে ‘অচিন পাখি ইনফিনিটি’ নামের ইংরেজি বইতে। তবে, অনুসন্ধানের যে-কাজেই আগে বা সমকালে হোক না কেন, সেলিমের অনন্যতা এখানেই যে, তিনি এই গবেষণাকে তাঁর মৌলিক সৃজনকর্মে নিয়ে গেলেন এবং বাঙালির নিজস্ব নাট্যাঙ্গিক বলে যে কিছু হওয়া সম্ভব তা শুধু কথায় নয়, নিজের রচনার মধ্যেই প্রমাণ করলেন।

তাই একে নিছক তত্ত্বসন্ধান বললে ভুল হবে। দেশকালে স্বরূপকে প্রকাশ করার ভেতরকার তাগিদ থেকেই এই রূপের আবিষ্কার। এ থেকে যে-উপার্জন তিনি করলেন, তার জোরেই বাংলা নাটককে এই স্বতন্ত্র শরীর দিলেন। পাশ্চাত্য ধারার বহিরঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসে শুধু সংগীত ও বর্ণনা বা আখ্যানের একটা সমন্বয় ঘটালেন, বাঙালির শিল্পরূপেরই নিজস্ব গড়নের ঐতিহ্যে। কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই-তে তবু সংলাপের একটা বড়ো জায়গা ছিল- কিন্তু চাকা বা যৈবতী কন্যার মন বা বনপাংশুল বা প্রাচ্য-তে বিভিন্ন মাত্রায় আখ্যানকে স্বাধিকার দিতে চাইলেন তিনি। ফলে যত এগিয়েছেন ততই সেই গড়নও পালটে গেছে। ধারাবাহিকভাবে কখনো কথানাট্য, কখনো নাট্য-আখ্যান, কিংবা শুধুই আখ্যান বলে তাদের উল্লেখ করা হতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত নিমজ্জন বা স্বর্ণবোয়াল বা ধাবমান- এর অভিজ্ঞতায় উপন্যাস বললেও তিনি আপত্তি করেন না। শেষপর্ব আখ্যানের দৃশ্যরূপের সঙ্গে তত্ত্ববিনিময় বা বির্তকও অঙ্গাঙ্গী হতে থাকে, যেমন নিমজ্জন-এ। বাস্তবের আরো পর্দা সরিয়ে তিনি যেতে পারেন অতিবাস্তবের জগতে। বোঝা যায়, নিজেকে প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সেলিম ‘এক’ ধরনের নাটকেরই পক্ষপাতী, কিংবা ‘এক’ ধরনের নাটকের ভোক্তারই প্রত্যাশী, এমন অভিযোগ এতে অপ্রমাণিত হয়। অবশ্য, এর ফলে নাসির উদ্দীন সত্ত্বেও, সেলিমের রচনার নাট্যরূপ বঙ্গীয় নাট্য-ঐতিহ্যে কতদূর প্রশ্রয় পাবে জানি না। কিন্তু তাঁর রচনার একান্ত স্বরূপ- সব গোত্র-পরিচয়ের অবসানে- আরো অখণ্ড, আরো অদ্বিতীয় হয়ে ওঠে। সেই বিস্তারের আবেদনে সাড়া না দেওয়াটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এর ফলে একটা অদ্ভুত ব্যাপারও ঘটতে থাকে। আমরা জানি, লিখিত নাটক এবং প্রযোজিত নাটকের মধ্যে একটা ব্যবধান তো, সবসময়ই আছে। প্রযোজক বরাবরই লিখিত নাটককে নানাভাবে ব্যবহার করেন, পরিবর্তন বর্জন বর্ধন সবই চলে, মূল ভাব থেকে সরে গেছে কিনা সেটাই একমাত্র বিবেচ্য হয়। কিন্তু অদলবদলের এই অধিকারকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না- কেননা থিয়েটারের বাস্তবতার তাগিদেই তা করতে হয়। রক্তকরবী বা রাজা’র যে-অভিনয় শম্ভু মিত্র কিংবদন্তিতে নিয়ে গেছেন, তা-ও কি কখনো রবীন্দ্রনাথের ওই রচনার পাঠের বিকল্প? শেক্সপীয়রের বিভিন্ন যুগের মহৎ প্রযোজনায় কি শেক্সপীয়রের টেকস্ট পড়া হয়ে যায়? সেলিমের নাটকের সঙ্গেও তার প্রযোজনার সেই ব্যবধান থাকবেই- এমনকি নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রযোজনা করলেও। আমরা জানি, সেলিমের নাটক ও নাসির উদ্দীনের প্রযোজনার মধ্যে যে নৈকট্য তা শিল্পগত সামর্থ্যে ঐতিহাসিক। দুজনের ব্যক্তিগত ও নান্দনিক সহমর্মিতার ফলেই তা সম্ভব হতে পেরেছে। নাসির উদ্দীনের প্রযোজনা সেলিমের নান্দনিকতায় নির্মিত, আবার সেলিমের নন্দন গড়ে ওঠায় নাসির উদ্দীনের উপস্থিতি সন্দেহাতীত। সৃজনশীলতার এরকম য্ক্তুতা বিরল। তবু, সেলিমের লিখিত নাটক ও নাসির উদ্দীনের প্রযোজিত সেলিমের নাটক- এই দুটো পুরোপুরি এক নয়, হওয়ার কথাও নয়।

কিন্তু এই ব্যবধানটা অন্য একটা তাৎপর্য পায়, সেলিম যতই তাঁর রচনার বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে এগোতে থাকেন। প্রযোজনার দিক থেকে সেলিমের নাটকের প্রায়-অবাস্তব দৈর্ঘ্য, কিংবা ক্রমশই নাটকের আঙ্গিক থেকে আখ্যানের বিস্তারে চলে যাওয়ার যে শৈল্পিক অনিবার্যতা- তাতে নাসির উদ্দীনের প্রযোজনার আত্মনির্ভরতাকে আরো অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। অথচ নাসির উদ্দীনের প্রযোজনায় সেলিমের একশো ভাগ শিল্পগত সম্মতি থাকে শুধু তা-ই নয়, সেলিমের নন্দন বা অবলোকন থেকে প্রযোজক বন্ধু একচুল সরে আসেন না কখনোই। এমনকি এ-ও বলা যায়, সেলিমের নাট্যচেতনার বিবর্তনে যে-সব শিল্পগত টান ক্রমশই তাকে কিত্তনখোলা থেকে চাকা বা হরগজ বা নিমজ্জন-এর দিকে নিয়ে যায়, নাসির উদ্দীনের প্রযোজনার রূপরীতিতেও তার ছাপ পড়ে, বা বলা যায়, তাঁর প্রযোজনার প্রকৃতিতে প্রতিফলিত হয়। তবু, এই পারস্পরিক যোগ বা একাত্মতা সত্ত্বেও, দুটো আলাদা শিল্পকর্ম- লিখন ও প্রযোজনার এলাকার স্বাভাবিক দূরত্বের কারণেই শুধু নয়, সেলিম আল দীনের রচনার ক্রমিক রূপান্তরের ফলেও।

এতে কিছু করার নেই, বলারও নেই। এভাবেই চলবে নাসির উদ্দীনের নিজস্বতাতে সেলিমের প্রযোজনা- সেলিমের সঙ্গে সংযোগ-বিয়োগ, অন্বয়ে-অনন্বয়েই তাঁর শিল্পের এই গতি। ক্ষতিও নেই। একদা বলা হত, প্রথমপর্বের দু-একটি বা চাকা বাদ দিলে, নাসির উদ্দীন ছাড়া আর কেউ তো সেলিমের প্রযোজনার কথা ভাবেন না। কারণটা বোঝাই যায়, সেলিম তাঁর রচনার বেপরোয়া বিস্তারে যে খোলা বা আঢাকা জায়গাটা রেখে দেন (নাট্যপ্রযোজনার দিক থেকে), তাকে ব্যবহার করা বা ভরিয়ে তোলার প্রতিভা তো খুব সুলভ হতে পারে না। কিন্তু একেবারেই পারে না তা হয়তো নয়। সময়ের বদলের সঙ্গে-সঙ্গে তাই তো এমনকি কলকাতাতেও অনেকেই সেলিমের এই স্বতন্ত্র, জটিল, কিন্তু রূপকধৃত সত্যভাষণকে রূপ দেবার কথা ভাবেন, এখনও ভাবছেন। কৌশিক সেন প্রাচ্য বা হরগজ-এর মতো সেলিমের এই সাম্প্রতিকতর রচনাকেই প্রযোজিত করেন- সেলিমের রচনা সৃজনের যে-স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল নাসির উদ্দীনের হাতে, সেই স্বাধীনতাকেই স্বনির্ভরতায় ব্যবহার করে। অর্থাৎ, লেখক সেলিমের রচনা স্বতন্ত্র শিল্পসত্তায় যেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তেমনি সেই রচনা নাট্যকর্মীরাই নিয়োজিত করতে পারে নতুন-নতুন নাট্যসম্ভাবনায়। নাসির উদ্দীনের একক কীর্তি বা প্রয়াস সম্প্রসারিত হতে পারে আরো নানা দিকে, দেশবিদেশের অনুজদের বোধে ও সংকল্পনায়। একে সংস্কৃতির সম্মিলিত উপার্জন বলে গণ্য করতে পারাটাই ঠিক।

একদিক থেকে এও সত্যি, একজন লেখক (এমনকি নাট্যকারও) তাঁর লেখায় যতটা স্বাধীন, একজন প্রযোজক তো তা নন। তাঁকে সংগঠননির্ভর বা উপকরণনির্ভর হতেই হয়। মঞ্চের শত ওলোটপালোট সত্ত্বেও, মঞ্চকেই, মঞ্চপরিবেশকেই মেনে নিতে হয়। প্রাচ্যের ভাবনা ও আঙ্গিককে গড়ন দিতে হলেও তা করতে হয় একান্ত পাশ্চাত্য-প্রভাবিত জীবনচর্যার বাতাবরণেই।

সেলিম তাঁর রচনায় স্বাতন্ত্র্যে বা হাই-সিরিয়াসনেসে যে-তত্ত্ববিশ্বে বিচরণ করেন, এবং নাটক বা তার পরবর্তী রূপান্তরে তাকে চারিয়েও দেন, নিজেই তার ব্যাখ্যানে মেতে ওঠেন, এ সবই হয়তো তাঁর সৃজনশীলতায় অত্যাবশ্যক। যে আখ্যান-প্রাধান্যে সেলিম পৌঁছোন, তার উৎস যে বাঙালির মধ্যযুগীয় সাহিত্য ও লোক-আঙ্গিক তা তো আমরা দেখেছিই। এ নিয়ে তাঁর আত্মসচেতনতা একটা বড়ো ব্যাপার। এবং সেদিক থেকে তাঁর সৃজনকর্মের প্রয়োজনে স্বাধীনভাবেই তার চর্চার একটা গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু, দৃষ্টান্ত হিসেবেই বলা যায়, এই সূত্রে নিজের রচনায় প্রকৃতি বা আঙ্গিক বিচারে পাঁচালি’র অবয়বের কথা যখন বলেন, এবং লেখায় কিংবা আলোচনায় পাঁচালি-র নানা অঙ্গের উল্লেখ করেন, তা শুধু তত্ত্বের দিক থেকেই বিতর্কমূলক হয়ে ওঠে না, কিছুটা ছড়িয়ে পড়ে লেখারও বাইরে- লেখার উপভোগের দিক ততটা প্রয়োজনীয় মনে হয় না। তবে, শিল্পসাহিত্যে স্রষ্টার তত্ত্বকে ডিঙিয়েই তার সম্ভোগ যে সম্ভব, তাও তো আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি। সেলিমের ওই তত্ত্বপ্রাধান্য সেলিমের বা তাঁর তাত্ত্বিক সহকর্মীদের পক্ষে যত জরুরিই হোক, তত্ত্বনিরপেক্ষ দর্শক বা পাঠক হয়তো সেই তত্ত্ব থেকেই উৎসাহিত যে-শিল্প তার চিরন্তন ও প্রকাশ্য দৃশ্য বা অনুভবকে আহরণ করতে পারে।

সে দিক থেকে বলা যায়, দর্শক বা পাঠকও তো স্বাধীন, লেখকের মতোই (তবে কি প্রযোজকই শুধু পরাধীন, লেখক বা দর্শকের প্রতিতুলনায়?)। রুচির বিস্তারে দর্শক বা পাঠক নানারকম বাস্তবকে গ্রহণ করে- উপনিবেশ-পূর্ব দেশজ বাস্তবের সত্য যেমন, তেমনি উপনিবেশ বা উপনিবেশ-উত্তর সময়ের বাস্তবও তার কাছে সমান মাপের সত্য। দুইকেই সে গ্রহণ করতে চাইতে পারে। সেদিক থেকে সেলিম যে-বাস্তবতা এনেছেন, তা তার কাছে একটা মহৎ অভিজ্ঞতা। যেখানে গ্রামের মানুষ, নানা জীবিকার মানুষ, নিচুতলায় মানুষ, নিম্নবর্গের মানুষ, নারী ও পুরুষ, বিশেষত লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত নারী- এইসব চরিত্র ও পটভূমি নিয়ে বাস্তব কীভাবে প্রসারিত হয়, তা পাঠক বা দর্শকের কাছে চেনা, কিন্তু শিল্পের গুণে নতুন অভিজ্ঞতা। তাকে নিয়েই, তাকে ছাপিয়ে, ক্রমশই সেলিম মানবতার এমন একটা ব্যাপ্ত জমি তৈরি করেন, যাতে এমনকি তাঁর অতীন্দ্রিয় বা মিস্টিক চেতনার দার্শনিকতা গোটা বাস্তবেরই যেন রঙ পালটে দেয়। যেন টের পাই সারা নাটক জুড়ে কোনো বাউলের পদচারণা। বাংলার রোদজলের বাস্তব থেকে এভাবেই পৌঁছোই অতিবাস্তব বিশ্ব-অভিজ্ঞতায়, কিংবা আরো এগিয়ে অবিচ্ছিন্ন জীবজগতের বা প্রকৃতির অনুকম্পায়ী ও ক্ষমাপরায়ণ একাত্মতায়। সেলিমের শেষজীবনের সবকটি রচনা মনে রেখেই এই অনুভবে পৌঁছোনো যায়।

আর যে বাচন বা ভাষা উছলে ওঠে এইসব রচনায়, কখনো-কখনো বাক্যগঠনের ঈষৎ জড়তাকে ভেদ করে, তার শব্দের ইন্দ্রজাল, বাকপ্রতিমার বিস্ময়, আর গোটা কাঠামোর রূপকের ঐশ্বর্য- এই সমন্বয় পাঠককে আন্দোলিত করে। প্রতি পদে অতল গাম্ভীর্য, বিষাদ ও যন্ত্রণা, মানবরসের কৌতুক এবং কবিত্বের সজ্জায় তিনি শিল্পের অলৌকিকে পৌঁছে দেন তার সহৃদয় পাঠক বা দর্শককে। এ সবই মূর্ত হয় একটার পর একটা প্রতিমায় বা ইমেজে- আর প্রত্যেকটি প্রতিমাই যেন ‘পোয়েটিক ইমেজ’ বা কবিতার প্রতিমা। সেলিমের সেই কবিতাকেই মঞ্চ আনেন নাসির উদ্দীন।

শিল্পরীতির এই সম-আধুনিকতাতেই বুঝতে পারি, সেলিমের প্রাচ্যভাবনা বা বঙ্গভাবনা পাশ্চাত্যভাবনার বিরোধী সেভাবে কখনোই নয়। তাই তো নিজের স্বদেশী ভাবের নাটকে বা আখ্যানে তিনি বারবার বিদেশী শিল্পসাহিত্যের অনুষঙ্গ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায়শই নিয়ে আসেন। স্মরণ করেন ওভিদ বা দান্তেকে। আরো অনেককেই। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনে তাই তিনি রবীন্দ্রানুসারী এরকম বললেই ঠিক বলা হয়। আসলে দেশের মাটিতে পা রেখে, দেশের জমিতেই শিকড় নামিয়ে তিনি দেশ ও বিদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমকালীনকে ছুঁতে চান, তাদের মেলাতে চান। শেষজীবনে, বন্ধু নাসির উদ্দীন ও বন্ধুজায়া শিমূল ইউসুফের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে, ‘বিশ্বসাহিত্যসাংস্কৃতিক’ কেন্দ্র গড়ে তোলার কল্পনা যে তাঁকে অধীর করে তুলেছিল, সে কি এই কারণেই নয়?

[ঢাকা থিয়েটার আয়োজিত প্রয়াত সেলিম আল দীনের জন্ম উৎসবে (আগস্ট ২০০৮)বাঙলা নাটক : সেলিম আল দীন সৃষ্টিকথা শীর্ষক সেমিনারে পঠিত]

অরুন সেন: অধ্যাপক, শিল্প-সমালোচক। ভারত