Full premium theme for CMS
সময় থাকতেই সময়ের দাবির সলতেটি জ্বালানো দরকার
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে গিয়ে যদি তাড়া খেতে হয়, এরচেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি আর কী হতে পারে?
কিছুদিন আগে যে শিশুটি হামাগুড়ি দিত, স্বাভাবিক নিয়মেই আজ তার উঠে দাঁড়াবার কথা, কাল সে হাঁটবে, পরশুই দৌড়াবে-এমন স্বাভাবিক-প্রত্যাশাই তো আমরা করে থাকি। কিন্তু যদি আমাদের নজরে পড়ে, শিশুটি হামাগুড়ি-শেষে উঠে দাঁড়িয়ে কিছুদিন হাঁটার পর যখন দৌড়া-দৌড়ির সময় হলো, তখন সে আবারও হামাগুড়ি দেয়া শুরু করেছে, তখন বুঝে নিতে হবে শিশুটি মোটেই সুস্থ না, সে বেড়ে উঠছে বৈকল্য নিয়ে।
ঠিক তেমনি, আমাদের দেশে থিয়েটারচর্চা মোটেই সুস্থভাবে বেড়ে ওঠে নি, উঠছে না। আমাদের থিয়েটারে অনেক রোগের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে দিনের পর দিন।
স্বাধীনতার পর যখন দেশে নিয়মিত ও দর্শনীর বিনিময়ে থিয়েটারচর্চা চালু হয়, তখন সে ছিল একেবারেই শিশু। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলা ছিল তার স্বাভাবিক-আচরণ। এরপর সে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখল, তখন সদলবলে একটি ফেডারেশান তৈরি করল, নাম দিলো ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান-এক সাথে হাঁটার জন্য। ভালোই হাঁটছিল গত শতাব্দীর পুরো আশির দশকে। কিন্তু নব্বয়ের দশকে, স্বৈরাচারের পতনের পর, যখন দৌড়ানো শুরু করার কথা ছিল, তখন দেখা গেল, সে আবারও হামাগুড়ি দিচ্ছে।
এ শতাব্দীর শুরু থেকে থিয়েটারচর্চা হামাগুড়ি ছেড়ে আবারও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটি ছাপ রাখা শুরু করল। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আধুনিক দুটি মঞ্চ পেয়ে গেল (যাকে আমরা ‘জাতীয় নাট্যশালা’ও বলছি)। কিছুদিনের মধ্যে একটি স্টুডিও থিয়েটারও পাওয়া হলো। সবকটিই অত্যাধুনিক। এবার সে আবারও হাঁটা শুরু করল। কিছুদিন সুস্থ-সবল দেহে হাঁটার পর যখন আবারও দৌড় শুরু করার সময় এল, তখন দেখা গেল-যে লাউ সেই কদু। আবারও হামাগুড়ি দিতে থাকল আমাদের স্বপ্নের থিয়েটারচর্চা, আমাদের অভিভাবক ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’।
আমাদের থিয়েটারচর্চা কোনোভাবেই সাবালক হতে পারছে না, ‘দৌড়’ শিখতে পারছে না। মোল্লার দৌড় তা-ও মসজিদ পর্যন্ত, কিন্তু থিয়েটারচর্চা তথা ফেডারেশান তো দৌড়াতেই অক্ষম। সে উপাসনালয় পর্যন্ত পৌঁছারই অযোগ্য। কেননা, সে যে মূলত (বেসিক্যালি) অসুস্থ! তাকে অসুস্থ করে রাখা হয়েছে!
এসব নিয়ে কিছু লেখার অনুরোধ এল সুহৃদদের কাছ থেকে। লেখা হলো একটি লেখা। শিরোনাম যার-‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’।
লেখাটি প্রথমে পড়তে দেই ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’র বর্তমান প্রজন্মকে। স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়মিত-থিয়েটারচর্চার সৃষ্টিকারী শ্রদ্ধেয়জনেরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান নি। তাদের অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থানের মোটামুটি ব্যবস্থা ও নিশ্চয়তা আগে থেকেই ছিল। আরেক মৌলিক অধিকার ‘শিক্ষা’য়ও তারা আগে থেকেই শিক্ষিত, আধুনিক-অগ্রসরচিন্তক। কিন্তু তাদের দেখাদেখি, অথবা মূলত অনুপ্রাণিত হয়ে যারা থিয়েটারচর্চা শুরু করেছে, তারা প্রাধান্য দিয়েছে সর্বাগ্রে থিয়েটারচর্চাকে, তারপর বেছে নিয়েছে বা বেছে নেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে কীভাবে অন্ন-বস্ত্র ইত্যাদিরও যৎসামান্য সংস্থান করা যায়। তাদেরকেই আমরা বলি ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর দল’। তো সেই দলের বর্তমান-প্রজন্মের নিবেদিত কিছু তুুখোড় নাট্যজনকে পড়তে দেই আলোচ্য লেখা। তারা একটি আড্ডায় এই লেখা নিয়ে কথা বলে নিজেদের ভাবনার প্রকাশ ঘটায়। সেই প্রকাশ আছে বর্তমান সংখ্যায়। অপু শহীদ, বাকার বকুল, রাজীব দে, এ কে আজাদ সেতু, মাহবুব আলম, সাইদুর রহমান লিপন, প্রশান্ত হালদার, কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন, শামীম সাগর, রামিজ রাজু, সাইফ সুমন ও কাজী রোকসানা রুমা প্রকাশ করেছে থিয়েটারচর্চা ও ফেডারেশান নিয়ে তাদের বর্তমান ভাবনা।
এরপর লেখাটি পড়তে দেই তাদেরকে, যারা থিয়েটারচর্চা ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কর্মচঞ্চল সময়ে (গত শতাব্দীর আশির দশকে) ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে মাঠে নেমেছে। বিপ্লব বালা, ফয়েজ জহির, মোহাম্মদ বারী আর আজাদ আবুল কালাম লিখেছে তাদের কিছু ভাবনা-চিন্তা। এরপর পড়তে দিয়েছি স্বাধীন দেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরুর অন্যতম কয়েকজনকে। এদের মধ্যে মামুনুর রশীদ আর রামেন্দু মজুমদার সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে এই সংখ্যাটি প্রকাশের প্রয়োজনীয়তায়।
তাদের কাছে ‘থিয়েটারওয়ালা’ কৃতজ্ঞ। আশা করি থিয়েটারচর্চাও কৃতজ্ঞ থাকবে তাদের সবার প্রতি।
এখন কথা হলো, অনেক ভাবনা-চিন্তা-সম্বলিত কিছু লেখার হয়ত সন্নিবেশ ঘটল একমলাটের ভেতর, কিন্তু এতে কার কী এসে যায়!
ধরা যাক, লেখাগুলোয় বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের অনেক ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়েছে। উত্তরে ফেডারেশান যদি বলে, কাজ করতে নামলে কেবল সফলতাই মিলবে এমনটি ভাবা ঠিক না, কিছু কিছু ব্যর্থতা থাকতেই পারে। তখন আমাদের জবাব কী হবে? কিংবা, ধরা যাক, ফেডারেশান আমাদের এসব লেখাগুলোকে কোনো আমলেই নিল না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য নিয়ে যদি বলে, যে যা বলে বলুক, বলতে থাকুক, আমরা তো উড়ে এসে জুড়ে বসি নি, রীতিমতো ভোটে জিতে আসন গেড়েছি। আমাদের উপর সারাদেশের নাট্যদলগুলোর আস্থা আছে বলেই তো আমরা এই আসনে বসেছি। সুতরাং ‘নিন্দুকেরা’ কে কী বলল সেদিকে কান না দেয়াই ভালো। ফেডারেশান যদি মনে করে, মানুষের দুটো কান দেয়া হয়েছে এজন্য যে, এক কান দিয়ে শুনে, আরেক কান দিয়ে বের করে দিতে হয়। তাহলে আমরা যারা ‘নিন্দুক’, তাদের কী বলার থাকতে পারে? ‘ওরা’ যদি বলে ‘আমরা’ আসলে থিয়েটারচর্চা টিকে থাকুক, চালু থাকুক, সেটিই চাই না, সুতরাং থিয়েটারচর্চার স্বার্থে আমাদেরকে তাড়া করে খেদিয়ে দেয়া উচিত, তখন আমাদের কর্তব্য কী হবে?
এজন্যই শুরুতেই বললাম, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে গিয়ে যদি তাড়া খেতে হয়, এরচেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি আর কী হতে পারে?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী শিল্পমাধ্যম বলে প্রতিষ্ঠিত মঞ্চনাটককে গতিশীল করতে হলে এর নেতৃত্ব দিতে হবে সৃজনশীল মানুষকেই। যেকোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করা শিল্পী-নামধারীর হাতে থিয়েটারচর্চা একেবারেই নিরাপদ নয়।
কীভাবে কী করা যায়, কী করলে থিয়েটারচর্চা এগিয়ে নেয়া যায়, তা এখনি ভাবতে হবে ও তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আবারও বলছি, সময় থাকতেই সময়ের দাবির সলতেটি জ্বালানো দরকার। সলতেটি কেউ যদি ভিজিয়ে ফেলে, আর কোনোদিনও তাকে জ্বালানো যাবে না।
একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করি।
এক ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে, হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরে এল। মা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বাবা? ছেলে বলল, ভরা-হাটবাজারে বাবাকে সবাই জুতাপিটা করছে, তাই দেখে সম্মান বাঁচাতে আমি দৌড়ে পালিয়েছি।
আমাদের থিয়েটারচর্চার গালে যখন দর্শক জুতা মারছে, তখন তা দেখেও না দেখার ভান করে নিজ নিজ অবস্থান আঁকড়ে ধরে যেভাবে ফেডারেশানওয়ালারা নিজেদের সম্মান (!) বাঁচাচ্ছে, এতে আদতে কি থিয়েটারচর্চার সম্মান রক্ষা পাচ্ছে?
জানি না, এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ নাকি ‘না’!
ইতি
হাসান শাহরিয়ার
(
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
)
২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৯। ৫ জুন ২০২২।
মোহাম্মদপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।