Full premium theme for CMS
‘মণিপুরি থিয়েটার’: হৃৎপারানির ঘাটে কুড়ি বছরের পারাপার
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
Love art in yourself, and not yourself in art. -Konstantin Stantislavski
আমরা যে ঠিক খোয়াবের মধ্যে ছিলাম, তা নয়। অথবা বাস্তবকে খুব ভালোমতো বুঝতে পেরেছিলাম, তাও বলা যাবে না। আমরা আসলে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম, একটা আনন্দ আর উত্তেজনার মধ্যে ছিলাম। কারণ গ্রামের খেলার মাঠ, তার উচ্ছ্বাস, প্রতিযোগিতা, পলিকাদামাখা পথ, আল বেয়ে বেয়ে চলা, পাখির ডাক শুনে শুনে শিস বাজানো, হৈ-হুল্লোড় সবকিছুর থেকে একটু আলাদা হয়ে গিয়েছিল সেই অভিজ্ঞতা- মানুষ আমাদের দেখতে আসছে, আমাদের কথা শুনতে আসছে, আমরা কী করি তা-ই মনোযোগ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে এবং শেষ কথা হলো, মানুষ আমাদের বিশ্বাস করছে।
এই বিশ্বাস করাতে পারার অভিজ্ঞতা, অনুভূতি সত্যিই তো অন্যরকম। এতটুকু ছেলে আমরা, কতই-বা বয়স, আঠারো-ঊনিশ, কেউ কেউ সর্বোচ্চ বিশ। কিন্তু সেই চাদোয়া দিয়ে মোড়ানো ছোট্ট মঞ্চটিতে আমরা যখন হাসলাম, কাঁদলাম, ভালো কিছু করলাম, খারাপ কিছু ঘটালাম- মানুষ সাথে সাথে তার প্রতিক্রিয়া দেখালো হাততালিতে, হাসিতে, চোখ-তীক্ষ্ণ মনোযোগে, নানান মন্তব্যে।
আমরা বুঝে নিলাম, নাটকের মজাটা ঠিক এই জায়গায়। তখনো আমরা জানি না, থিয়েটার কী বস্তু। শব্দটাই হয়তো আমাদের অচেনা। দু’একবার শুনে থাকলেও ভাবিনি আসলে কী সেটা। আমরা বুঝে নিলাম, সরলভাবে- নাটক। আমরা একটা নাটক করতে পেরেছি। মানুষ আমাদের ফুৎকারে উড়িয়ে দেয় নি। ‘এটা কি কিছু হলো’ বলে নাক সিঁটকিয়ে চলে যায় নি। বরং দেখলাম, কমলগঞ্জের ঘোড়ামারা গ্রামের মণ্ডপটি উপচে পড়া মানুষে থৈ থৈ করে উঠল নাটক শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত। কেনো এত মানুষ (দর্শক) হয়েছিল, আমরা জানি না। আমাদের কোনো নাম-ডাক ছিল না, পাড়ার ‘বনের মোষ-তাড়ানো’ দুষ্টু ছেলেদের কাজকারবার দেখতে শিশু থেকে বয়স্ক সবাই এমন ভিড় জমাবে কেনো!
উত্তর একটা নয়, অনেক। একটা হলো, নাটকের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, আগ্রহ বলা যায় মিথিক্যাল। নাটক মানেই চমকানোর পালা, গা শিউরে ওঠা, নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা, নতুন নতুন জীবন-কাহিনির মুখোমুখি দাঁড়ানো। শেক্সপীয়র তো গোটা বিশ্বকেই একটা রঙ্গশালা বলেছিলেন, মানুষ তার অভিনেতা। এটা একটা ব্যাপার। আরেকটা ব্যাপার ছিল, আমরা যখন গ্রাম্য আঙিনায় মহড়া করি, প্রায় মাসব্যাপি, তখনই গ্রামে গ্রামে এই বার্তা খানিকটা পৌঁছে যায় যে, এবার একটু নতুন কিছু হতে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, আমাদের যে গ্রাম, ঘোড়ামারা, আগে থেকেই তার একটু সুনাম (মতান্তরে বদনাম) ছিল- এ গ্রামে কিছু পাগলাটে তরুণ আছে। তারা খানিকটা উদ্ভট কাজকারবার করে থাকে। যেগুলো অন্য গ্রাম থেকে আলাদা। এবারও নিশ্চয় কিছু একটা হবে, সেরকমই।
‘মেঘ-বৃষ্টি-রোদ’ নামের সেই নাটক কিন্তু আলাদা কিছু ছিল না। কিন্তু এই অঞ্চলের ঐতিহাসিকতার বিচারে বলা যায়- আলাদা কিছু ছিলও। আমাদের গ্রামগুলোতে একেবারে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন সংকট সমস্যা নিয়ে নাটক হয় নি। ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, বা যাত্রার পরিভাষায় ‘সামাজিক’ নাটকও হয়েছে, পূজার সময়, কিন্তু আমাদের নাটকটার বেশভূষা, কাহিনির ধরন, অভিনয়ভঙ্গি সেগুলোর মতো কোনোভাবেই ছিল না। লোকের চোখে, এটা ছিল একদমই ‘বাস্তব’ (ন্যাচারাল) একটা উপস্থাপনা। এভাবে, এত স্বাভাবিকভাবে নাটক হতে পারে, তা এখানকার লোকদের কাছে তখন বিরল অভিজ্ঞতাই ছিল বলা যায়। সেই অভিজ্ঞতা আমরা তাদের দিতে পারলাম। জেনে দিয়েছি, তাও না। গ্রামের বড় রাস্তায় একটা ব্রিজের ওপর বসে কয়েকজন বন্ধু মিলে আড্ডার সময় আয়েসি ভঙ্গিতেই প্রস্তাবটা তোলা হয়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাও শেষ, হাতে অবসর আছে, কিছু একটা করি। যদিও তখন, ইতোমধ্যেই, আমরা ‘অনেক কিছু’ই করে ফেলেছি। সেই বয়সে যা যা করা যায়, গ্রামের বাস্তবতায়। খেলাধুলা, পিকনিক, নানান প্রতিযোগিতা বাদ যায় নি কিছুই। তখন নাটকটাই ছিল তালিকা-বিযুক্ত বিষয়। তো করি একটা নাটক। তবে কথা হলো আমরা আমাদের মতো করে করব। যাত্রার মতো নয়, লীলা-পালার মতো করে নয়। মণিপুরি জনজীবনে রাসলীলা, নটপালা-সহ অসংখ্য আঙ্গিকের কৃত্যমূলক পরিবেশনা ছিল একপ্রকার নৈমিত্তিকই। বুঝে না-বুঝে আমরাও সেসব দেখার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই বড় হয়েছি।
তো সেই রাতে ফাঁকা মাথায় লিখতে বসে লিখে ফেললাম সাত-আট পাতার সংলাপ। কী উত্তেজনা! নিজেদের মাতৃভাষায় নাটক লেখা যেতে পারে, তা ছিল তখন কল্পনারও বাইরে, তাই বাংলাতেই লিখেছিলাম। পরের দিন বিকালবেলা সেই সাত-আট পাতা-সহ, মনে কেমন এক রোমাঞ্চ নিয়ে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেলাম। সবাই মত দিল, এত সাদামাটাভাবে পড়া হবে না। খানিকটা কৃত্য টৃত্য বা আনুষ্ঠানিকতা না থাকলে জমবে না। দোকান থেকে মোমবাতি কিনলাম। লক্ষ্মীনারায়ণ নামের এক বন্ধুর বাড়িতে, তার নিজের রুমে সবাই গোল হয়ে বসলাম। মোমবাতি জ্বালিয়ে পরস্পরের মুখে বিস্কুট তুলে দিয়ে কৃত্য সেরে শুরু করলাম নাটকের পাঠ। নাটক নয়, কিছু অংশ। সবাই আগ্রহ ভরে শুনল। মনে ধরল সবারই। ‘জমজমাট কাহিনি’ যাকে বলে। রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, গ্রাম্য রাজনীতি, প্রেম সবকিছুই থাকবে এ নাটকে, লিখতে লিখতে আমি ওদের ধারণা দিলাম। সবাই এক বাক্যে মত দিল, এ নাটকই করব আমরা। আমি যেন দ্রুত লিখে শেষ করে ফেলি।
এখন ভাবলে মজা লাগে, পুরো নাটক শেষ হবার আগেই আমরা মহড়া শুরু করেছিলাম। যা লেখা হয় তা-ই নিয়ে। উত্তেজনা যে লেখার গতির চেয়ে তীব্র! অভিনেত্রী যোগাড় করতে কী যে অবস্থা! অনেক ভালো কথা বলে, আদর্শের বাণী প্রচার করে, ‘আমাদেরকে সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে হবে, মণিপুরি হয়েছি বলে নাচ নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না, আমাদেরকে নতুন অনেক কিছু করে দেখাতে হবে’- এসব কথার ফুলঝুরি। মনে আছে, অনেক ফিল্ড-ওয়ার্ক করে ক্যাম্পেইন করে দীর্ঘ কাউন্সেলিংয়ের পরে পেয়েছিলাম চারজন অভিনেত্রী। তারা আমাদের পরিচিত, সমবয়সীই। ঝর্ণা, অঞ্জনা, প্রণতি, নির্মলা- সেই প্রথম নাট্যমঞ্চে ওঠা তাদের জীবনের। মন্দ করে নি। পরবর্তীকালে ঝর্ণা আর অঞ্জনা একাধিক নাটকে যুক্ত হলেও বাকি দুজন পরিবারের নানান সমস্যায় আর সক্রিয় হতে পারে নি। সেই নাটকে জ্যোতিরও (বর্তমান অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা) অভিনয়ের কথা ছিল। মহড়ায় যোগ দেবে, সব প্রায় চূড়ান্ত, হঠাৎ ওর দাদু মারা গেল। পারিবারিক আবেগ, তার-উপর নানান রীতিনীতি কৃত্যপ্রথা, সব মিলিয়ে ওর আর করা হলো না।
দুর্গাপূজার মণ্ডপে মঞ্চ বানিয়ে অভিনীত ‘মেঘ-বৃষ্টি-রোদ’-এর কথা এখনও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আমি নিজেও অভিনয় করেছিলাম। আমার নাম ছিল পটল। গ্রামের জমিদার টাইপের এক দুষ্কৃতিকারীর চামচা। এখন ভাবলে হাসি পায়। আমার অভিনয়সত্তা অবশ্য সে নাটকেই পটল তোলে নি, পটল তুলতে হয়তো খামাখাই আরও কিছুটা সময় নিয়েছিল।
‘মেঘ-বৃষ্টি-রোদ’-এর মহড়া শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। প্রায় এক মাস পর ১৯ অক্টোবর হয় প্রথম মঞ্চায়ন। সেই দিনটি আমাদের জীবনে ভিন্নমাত্রার একটি দিন। আমরা শত শত মানুষের সামনে অভিনয় করেছি। কিছু চরিত্রকে হাজির করেছি। সমাজের ভালো-মন্দকে চেনাতে চেষ্টা করেছি। মানুষ তা নিয়েছে। এরচেয়ে আনন্দের আর কী থাকতে পারে, ওই বয়সে! এই পাওয়া, এই আনন্দকে একবারেই নিভিয়ে ফেলার মতো উদাসীন হতে পারা এক অর্থে অবাস্তবই। আমরা তখন ভাবলাম, এত কষ্ট করে যে নাটকটা করলাম তার একটা দলগত পরিচয় থাকুক। খুব একটা না ভেবেই, দলের একটা নাম দিয়ে দিলাম- ‘আধুনিক নাট্যগোষ্ঠী’। এখন অনেকের কাছে নামটা হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের তরুণ-মনে নামটার অন্যরকম একটা তাৎপর্য অবশ্যই ছিল। আমরা নিজেদেরকে তখন ‘আধুনিক’ ভাবতে শুরু করেছিলাম। সংস্কৃতি কিংবা ঐতিহ্য-পরম্পরা, এসবের চাইতে আমাদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল অনেক কিছুকে অস্বীকার করা। আমরা তখন মুক্তবুদ্ধির বা বিজ্ঞান-চেতনার বই পড়তাম। পাড়াতুতো প্রগতিশীল বড়ভাইদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে পড়া এসব বই আমাদেরকে অনেক কিছু ভাবতে শিখিয়েছিল। অনেক পরে বুঝতে পেরেছি, সেই বইগুলোর মালমসলার মধ্যেও গলদ আছে। কিন্তু প্রচলিত একটা সমাজকাঠামোর ভেতর আমাদেরকে নতুনভাবে কিছু করার জন্য সেসবের অবশ্যই গুরুত্ব ছিল।
তো আমরা আধুনিক হয়ে গেলাম। আমরা ধর্মকর্ম, রীতিনীতির বাইরে কিছু একটা অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। মণ্ডপের গণ্ডি থেকে বের করে তাই নানান পালাধর্মি পরিবেশনাগুলোকে জনসম্মুখে একটা সর্বজনীন আবেদনের জায়গা থেকে পেশ করানোর চেষ্টা করতে শুরু করলাম। সেই নাটকের পর এসব বিষয় নিয়ে আমরা ভাবতে শুরু করি। কয়েক দফা একত্র হয়ে কথা বলি, সভা ডাকি। আমরা একটা ব্যাপারে একমত হয়ে উঠি, তা হলো, একটা নাটক দিয়েই আমাদের এই ভাবচিন্তার মিলন ফুরিয়ে যাবে না। আমাদেরকে এর ধারাবাহিকতা রাখতে হবে। মানুষ আমাদেরকে সেরকম একটা আগ্রহের জায়গাতেই ফেলে দিয়েছে। আর আমরাও হয়তো অনুভব করছিলাম, থিয়েটারই সেই শিল্প, যা মানুষের পূর্ণ অস্তিত্বের রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলতে পারে।- The theatre can play an enormous part in the transformation of the whole of existence. - Vsevolod Meyerhold.
মণিপুরিদের সমাজ-জীবন কৃত্যকর্মময়। জন্ম থেকে মৃত্যু- প্রায় প্রতিটি পর্বেই মৃদঙ্গ বাদন, দেহতত্ত্ব বা মনশিক্ষার গান, মন্দিরার তাল এসব আবশ্যিক বলা যায়। এ সমাজে বিয়ের কনেকেও বিবাহ-মণ্ডপে সাতপাক দিতে হয় মৃদঙ্গের তালে। সেখানে একটু তালের হেরফের হলে লোকজনের সমালোচনা লেগে যায়। এরকম একটা সমাজে সাংস্কৃতিক চর্চার দিক থেকে কোনো অভাববোধ করার কথা নয়। কিন্তু আমরা তখন করেছি. সেই বোধ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এক নাটকে, বা কেবল এক একটা নাটক মঞ্চায়নে, পর্বপার্বণভিত্তিক বিনোদনের আয়োজন করে, আমাদেরকে সীমাবদ্ধ করে ফেললে চলবে না। সেই বোধ আমাদের জানান দিল, এত এত সমারোহের পরও কিছু একটা আছে যা সমাজে নেই। আমরা তাকে খুঁজে পেলাম সেই কাঁচা মাথাতেই! সেটা হলো ধর্ম, কৃত্য বা মঙ্গল-বাসনার সাথে যুক্ত অনুষ্ঠানগুলোর বাইরে সমকালীন জীবনের নানান ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কোনো তৎপরতা। ধর্মের সীমার থেকে বাইরে গিয়ে মণ্ডপভিত্তিক জনমিলনের বাইরে আমরা কোনো একটা প্লাটফর্ম তৈরি করতে পারি কিনা। সেই ভাবনা থেকে আমাদের মাথায় এলো বর্ষবরণ আয়োজনের চিন্তা। মণিপুরিরাও বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বছর গণনা করে থাকে। যদিও সাপ্তাহিক বার-গুলোর নাম সব নিজস্ব, এমনকি কয়েকটি মাসের নামও উচ্চারণে ধরনে খানিকটা স্বতন্ত্র। বাঙালির বর্ষবরণের দিন মণিপুরিদের বর্ষবিদায় হয় পঞ্জিকার তারতম্য অনুসারে, মণিপুরিরা দিনটিকে বলে থাকে বিষু। বিষু ঘরে ঘরে নিজেদের মতো করে উদ্যাপন হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের সম্মিলন নেই। আমরা ভাবলাম উৎসবটিকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি।
১৯৯৭ সাল। ঘোড়ামারা গ্রামের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রথম প্যান্ডেল বেঁধে আমরা আয়োজন করলাম ‘বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠান। প্রথমে নাম এমনই ছিল। কত কষ্ট করেছি। ঘরে ঘরে গিয়ে জানানো, শিল্পী আমন্ত্রণ করা, নাটক মঞ্চে আনা আরও কতকিছু। প্রচুর মানুষের সমাবেশ ছিল। যে র্যালী দিয়েছি, তা এলাকার মানুষ এখনো ভোলে নি। আমরা শুধু চেয়েছি ধর্ম বা কৃত্যবিষয়ক সংস্কৃতিচর্চার ধারা থেকে বের হয়ে এসে নতুন কিছু করা। আমরা তা পেরেছি। একটি নাটক করলাম। ‘আজবপুরের বর্ষবরণ’। এক প্রতিক্রিয়াশীল রাজার কাহিনী। তার প্রবল বাধার মুখে বর্ষবরণ হয়। সে রাজ্যের প্রজারা তাকে বাধ্য করে বর্ষবরণ উৎসব পালন করতে।
আঙ্গিক নিয়েও আমরা নিরীক্ষা শুরু করি। আর রচনায়ও ছিল তার ছাপ। সম্পূর্ণ স্বরবৃত্ত ছন্দে নাটকটি লিখি। মজা হয়েছিল বেশ। সে-নাটকে জ্যোতি সিনহা প্রথম দলের সাথে যুক্ত হলো। রাজকুমারীর ভূমিকায় জ্যোতির অভিনয় প্রথমবারেই দর্শকের মন জয় করে। সে উৎসবে সে নিজে নির্দেশনা দিয়ে কিশোরদের এক মজার নাটিকাও উপস্থাপন করে। সেটাও বেশ উপভোগ্য ছিল।
পরবর্তীকালে বর্ষবরণ উৎসবে বিষু শব্দটি আগে সংযুক্ত হয়- ‘বিষু ও বর্ষবরণ’। নিজ জাতিসত্তার পরিচয়ের দিকটি ক্রমশ আমাদের মধ্যে বেগ পেতে থাকে।
সেই বিষু উৎসব এখন প্রতিবছর দুইদিন ধরে হয়। কত বিশাল আয়োজন। এ উৎসবে যোগ দেয় নি এমন বিশিষ্টজন নেই বললেই চলে। শিল্প-সংস্কৃতির নানান শাখার গুণীজনেরা তাঁদের পদধূলি দিয়ে, তাদের মধুর বচন দিয়ে, চিন্তা ও জ্ঞানের বিভায় আলোকিত করেছেন আমাদের প্রাঙ্গণ। মণিপুরি থিয়েটারের বিষু উৎসব এখন কমলগঞ্জের শুধু মণিপুরিদেরই নয়, সবার কাছেই এক প্রিয় উৎসব হয়ে উঠেছে।
‘নাই রাজার রাজদরবার’ নাটকে ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই আমরা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম রূপকের মাধ্যমে। একটা কল্পিত রাজার দরবারে অন্ধ লোকদের আজব আজব কাণ্ড যত। সে রাজা আসলে ‘নাই রাজা’। এ নিয়ে কঠিন সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। তখন আর আমাদের বয়স কত, ১৮/১৯। ১৯৯৭ সালের কথা। ‘সিক্রেট তথ্য’ হলো, সেই ‘নাই রাজা’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম নির্দেশক স্বয়ং।
পরিবার-স্বজন সবাইকে চমকে দিয়ে, ১৯৯৮ সালে, আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হই। আমার মাসতুতো বড় ভাই অসীমকুমার সিংহ (অনলাইন এক্টিভিস্ট, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি উইকিপিডিয়ার অন্যতম কারিগর এবং আমার আকৈশোরের অন্যতম প্রেরণা) আমাকে প্রণোদিত করেন এ বিভাগে ভর্তি হবার জন্য। তবে বাবা-মা-ভাই-বোন সবার অকুণ্ঠ সমর্থনও পেয়েছিলাম তখন। আমার যেকোনো কাজে তারা পাশেই থেকেছে আজ-অবধি। যাই হোক, সেলিম আল দীনের সান্নিধ্য, বিভাগীয় পড়াশোনা, দেখা-বোঝা আমাকে নাটক নিয়ে ভাবতে বেশ সাহায্য করে। নাটক বিষয়টাকে একটু অন্যভাবে দেখার একটা ইচ্ছা শুরু থেকেই মাথায় কাজ করেছে; বিভাগীয় পড়াশোনা ঐতিহ্যকে আধুনিকতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মোকাবেলা আর বোঝাপড়ার চেষ্টা আমাকে নাড়া দিল, বিশেষত সেলিম স্যারের ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’। ভাবলাম তাহলে আমাদের (মণিপুরিদের) নটপালা, লীলা, নৃত্য এসব নিয়ে আমারও তো অনেক কিছু করার আছে। সেই ভাবনা থেকে একটা নাটক করার কথা ভাবি। নাটকের মতো নয়। এটা হবে পালাগানের মতো। গল্প গাইতে গাইতে নাটক হয়ে যাবে। যারা গাইবে তারাই চরিত্র হয়ে অভিনয় করবে। নাটকটার নাম ছিল ’তারালেইমার পালা’। রচয়িতা মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ভাষার প্রধান কবি আসামের ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ। এ নাটক দিয়েই আমরা ভিন্ন ধারার নাটক করার তৎপরতা শুরু করি। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই চলে আসতাম গ্রামে। এসে নাটকের নির্দেশনা দিয়েছি, দল পরিচালনার কাজ করেছি, সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে রেখেছি। নিজস্ব আঙ্গিকের ধরন খোঁজার পর্ব শুরু হয় এ নাটকের মধ্য দিয়ে। নারী মনস্তত্ত্বের গহন-সন্ধান করা হয়েছে এ নাটকে। দজ্জাল তারালেইমার স্বভাবকে শ্রেণির প্রশ্নের সাথে শর্তায়িত করা হয়েছে। তবে তখনো আমরা ঠিক আমাদের নিজেদের স্বতন্ত্র নাটকের অবয়বটাকে খুঁজে পাই নি। তার আত্মাটাকেও ঠিক মতো অনুভব করতে পারি নি। যা পারলাম ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ছিল আমাদের নিজেদেরকে খুঁজে ফেরার প্রথম নাট্য। মনে পড়ে জাহাঙ্গীরনগরে যখন ক্লাস করছি, তখনই পোকাটা মাথায় ঢোকে। বড়– চণ্ডীদাসের পালাটিকে বেশি মনে ধরে এজন্য, আমি যে সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি, সেখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা সবগুলোতেই প্রায় বৈষ্ণবীয় ভাবে-ধরনে উপস্থিত। শান্তরসের আধিক্যই থাকে সেখানে। প্রেম আর ভক্তির অপূর্ব সমন্বয়। কিন্তু বড়– চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ তা নেই। এখানে শৃঙ্গার রসের আধিক্য নিয়েই একেবারে গ্রামীণ একটা পটভূমিতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে দেখানো হয়েছে; ধর্মের দার্শনিক জায়গা সেখানে নেই বললেই চলে। আমাদের জন্য এই কাজটা সত্যি ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং। একেতো ভক্তিরসে আপ্লুত মণিপুরি ভাবুক সম্প্রদায়কে রুষ্ট করার ভয়, তার উপর পাঠটাকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করার তাগিদ। সব মিলিয়ে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ খুব কষ্টকর একটা কাজ ছিল। কিছু না ভেবে আমি পালাটির ঈষৎ সংক্ষেপিত রূপ সম্পাদনা করে সেখান থেকে অনুবাদ করে ফেলি। নানা ছন্দে নানা মাত্রায়, কখনো পয়ারে কখনো ত্রিপদীতে ছন্দ বৈচিত্র্য রক্ষা করে অনুবাদ শেষ করি। তারপর গ্রামের মণ্ডপে সবাই মিলে পড়তে বসি। নাটকটির শুরুতে সময় দাঁড়ায় পৌনে তিন ঘন্টা। অভিনেতার সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধশত। নাটকের প্রয়োজনে আমাকে প্রায় ৬৫ টি গানে সুর করতে হয়েছে। সহযোগিতা নিলাম দিদি শর্মিলা আর বন্ধু মনোজের। সুরগুলো প্রায়ই মণিপুরি নটপালা আর রাসলীলার গান থেকে অভিযোজন করা। তার সাথে হিন্দুস্থানি সংগীতের মিশেল। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ বলা যায়। তিন রাধা তিন কৃষ্ণ আর তিন বড়াই পালাক্রমে নাটকে আবির্ভূত হয়, অভিনয়-বৈচিত্র্যের প্রয়োজনে। অবশ্য টাইম লেপ্স বা সময-উত্তরণ বোঝাতেও বিষয়টা সাহায্য করে।
২০০০ সালে আমরা দলের নাম পরিবর্তন করি। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। চিন্তায় অনেক পরিবর্তন। নিজের শেকড়ের দিকে তাকানোর অভিব্যক্তি রীতি সব পাল্টে যাচ্ছে। পড়াশোনা করছি নানা বিষয়ে। ভাবলাম, নাহ্ দলের এ-নাম বিচ্ছিরি। নাম বদলিয়ে রাখলাম ‘মণিপুরি থিয়েটার’। মণিপুরি জাতিসত্তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকবে আমাদের থিয়েটার। একটা প্রতীকী ব্যাপার। শুধু আমাদের জন্য নয়, এরকমই যারা অস্তিত্ববিপন্ন হয়ে আছে, তাদের সবার পক্ষে যেন দাঁড়াতে চাইলাম। এক সন্ধ্যায়, ৪র্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজনের প্রস্তুতিসভায়, আমি উপস্থাপন করলাম আমার ব্যাখ্যা। সবাই মেনে নিল। ঐ অনুষ্ঠানে আমরা নতুন নাম ঘোষণা করলাম। তখন থেকে আমরা বাংলা ছেড়ে সম্পূর্ণ নিজেদের ভাষাতেই (মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া) নাটক মঞ্চায়ন করতে শুরু করি, যদিও মাঝেমধ্যে বাংলা নাটক করেছি, তবে তা সংখ্যায় খুব গৌণ।
আমার তখন কাজের নেশা। শুধু কাজের না, দলের নেশা। থিয়েটারের বন্ধুদের সাথে একত্র হতে না পারলে হাঁসফাঁস করে উঠতাম। গ্রামে ছুটে আসতাম ক্লাস ফাঁকি দিয়ে। মনকে প্রবোধ দিতাম, সেখানে (মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমার বিভাগে) কত শত ছেলেমেয়ে আছে, যারা বাংলা নাটক নিয়ে ভাবছে, নাটকের উৎকর্ষ নিয়ে কাজ করছে- আমাকেও আমার নিজস্ব জাতিসত্তার মধ্যে গড়ে ওঠা থিয়েটার নিয়ে কাজ করতে হবে। তাই ছুটে আসতাম গ্রামে। কত সব চেষ্টা যে চলেছে, গানের আসর, আড্ডা, পাঠচক্র, থিয়েটার নিয়ে নানান প্র্যাকটিস... এভাবেই চলেছে।
আমরা ভাবতে লাগলাম, ঢাকার সাথে এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবীদের সাথে আমাদের এই এলাকার সংস্কৃতিকর্মীদের একটা জানাশোনা তৈরি হওয়া দরকার। সেই চিন্তায় আমাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এলাম নানান শাখার ব্যক্তিত্বদের। লোকজনও তাদের উপস্থিতি দারুণভাবে উপভোগ করল, একটা মিথস্ক্রিয়া গড়ে উঠল।
২০০১ সাল। ঠিক করলাম শুধু মণিপুরি নাটক নিয়ে একটি নাট্যোৎসব হবে। বাংলাদেশে এই প্রথম। কীভাবে কী হবে কিছুই ঠিক নেই। কিন্তু করবো তো করবই। ঢাকায় কত আশা নিয়ে বিজ্ঞাপন যোগাড়ে নামলাম। কিছু হলো না। সারা যাকের (তখন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান) সাহায্যের হাত বাড়ালেন। এশিয়াটিক থেকে দশ হাজার টাকার একটা বিজ্ঞাপন পেলাম। আর গায়ক সেলিম চৌধুরী, আমাদের এলাকার সন্তান, দু’হাজার টাকার একটা বিজ্ঞাপন দিলেন। কিছু ‘চাঁদাবাজী’ করলাম। আমার দাদা (ডা. দেবাশিস সিনহা) নিজেই দিলেন বেশ কিছু টাকা। নেমে পড়লাম। প্রধান অতিথি ছিলেন আলী যাকের ও সারা যাকের। আরও অতিথি ছিলেন অকালপ্রয়াত অভিনেতা খালেদ খান।
তিনটি নাটক ছিল উৎসবে। তিন দিনের উৎসব। নাট্যমূলক ঐতিহ্যবাহী পালাও ছিল। ছিল রাস। সব মিলিয়ে একটি পরিপূর্ণ ‘মণিপুরি নাট্যোৎসব’। এরকম জমজমাট অনুষ্ঠান, এরকম আলোড়ন আর কোথাও মেলে নি। মনে আছে তখন শ্রীমঙ্গলের তাপমাত্রা বোধহয় নিকট-অতীতের মধ্যে সর্বনিম্ন রেকর্ড করা হয়েছিল। সেই হাড়কাঁপানো শীতের রাতে হাজার হাজার মানুষ নাটক দেখেছে। নাট্যোৎসবের জন্য মণিপুরি পোশাকে সেজে তরুণ তরুণীরা যে র্যালী বের করেছিল, সেটাও ছিল দেখার মতো। নাচে গানে সকাল থেকে বিকাল মাতিয়ে রেখেছিল সারা রাস্তা।
এই নাট্যোৎসব আমাদের দলকে সারাদেশে একটা পরিচিতি এনে দেয়। পত্রপত্রিকাগুলো আমাদের উৎসবের খবর প্রকাশ করে। বোধহয় তেরো চোদ্দটি জাতীয় পত্রিকায় নাট্যোৎসবের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। আমরা বুঝে নিয়েছিলাম, অভ্যন্তরীণ এবং মাঠ পর্যায়ের কাজ ছাড়াও মাঝেমধ্যে এমন কিছু একটা আয়োজন রাখতে হবে যা দলটাকে নাগরিক সংস্কৃতির লোকদের কাছেও পৌঁছে দেয়।
মনে আছে, সেই নাট্যোৎসবের টাকা যোগাড় করতে আমরা নিজেদের এক পোয়া জমি ধান ফলানোর জন্য লিজ দেই, বিনিময়ে পাই পাঁচ হাজার টাকা। সেই পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আমরা আর্থিক ঘাটতি পূরণ করি। এখন ভাবলে সত্যি চোখ ভিজে ওঠে।
একে একে আমরা মঞ্চে আনতে থাকি নতুন নতুন নাটক। কোনো বছরেই আমরা থেমে থাকি নি। আমার পরীক্ষা, কর্মীদের সমস্যা কোনোকিছুই থামিয়ে রাখতে পারে নি আমাদের নাট্যযাত্রাকে। যেসব সংকট তৈরি হত, আমরা নিমেষে সেখান থেকে উত্তরণে মরিয়া লড়াই করেছি। পেরেছিও।
একে একে মঞ্চ আনলাম ‘চন্দ্রকলা’ আর ‘ধ্বজো মেস্তরীর মরণ’। হতদরিদ্র এক নারী চন্দ্রকলার জীবন-সংগ্রামের কাহিনি ‘চন্দ্রকলা’। ভারতের শক্তিমান মণিপুরি গল্পকার অনুকূর সিংহের গল্প থেকে নাটকটা নাট্যরূপ দিয়েছিলাম। জ্যোতি অভিনয় করেছিল চন্দ্রকলা ভূমিকায়। ওর স্বামীর ভূমিকায় অর্থাৎ নায়ক চরিত্রে এক প্রতিভাবান তরুণ রূপেন অভিনয় করলেও, পরে বেশিদিন তাকে থিয়েটারে পাই নি। জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াতে আর সে থাকতে পারে নি নাট্যজগতে।
মণিপুরি গল্পকার স্মৃতিকুমার সিংহের গল্প থেকে ‘ধ্বজো মেস্তরীর মরণ’ নাটকে এক বৃদ্ধ মিস্ত্রী ধ্বজোর আবেগকে একটা জাতিসত্তার ঐতিহ্যের লুপ্ত হওয়ার প্রতীকে বেদনায়িত করা হয়েছিল। ধ্বজো একজন নামকরা মিস্ত্রী। গ্রামের প্রায় সব বাড়িই তার হাতে বানানো। সেই ধ্বজোর দিন ফুরিয়ে এসেছে। এখন আর তার ডাক পড়ে না। এমন কী তার নিজের বাড়িটাই ছেলেমেয়েরা ভেঙে দিয়ে নতুন মডেলে বানানোর পরিকল্পনা করে। ধ্বজোর চোখের সামনে ভেঙে ফেলে তার বাড়িটি। হতবিহ্বল ধ্বজো দেখে বাড়িটির জায়গায় তার নিজের লাশ। বৃদ্ধ ধ্বজোর ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন দলের প্রতিষ্ঠাতাসদস্য লক্ষ্মীনারায়ণ সিংহ। আর তরুণ ধ্বজোর ভূমিকায় সুনীল সিংহের অভিনয় দেখে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এ-নাটকে প্রথম আমরা প্রসেনিয়াম ভাঙলাম। সালটা বোধহয় ২০০৫। মণ্ডপের মাঝখানে চুনের গুঁড়ো দিয়ে মণিপুরি মোটিফে নকশা করে বৃত্ত বানিয়ে কোনো মঞ্চ-উপাদান ছাড়াই নাটকটি উপস্থাপন করি। ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল নাটকটি।
আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাটকের প্রচারণা করতাম, সদস্য সংগ্রহ করতাম, নাটকের আমন্ত্রণপত্র বিলি করতাম বাইসাইকেলে করে। প্রথম কয়েক বছর আমি আর কয়েকজন বন্ধু মিলেই কাজটা করতাম।
শিশু-কিশোরদের নিয়ে বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করি আমরা। প্রথম প্রযোজনা ছিল ‘আমি আহিলেই’ (আমরা হাসলেই)। এক রাজার রাজ্যে হাসি বন্ধ হয়ে গেছে। রাজা শত চেষ্টা করেও তার কারণ বের করতে পারেন না। এ নিয়েই গল্প। আমার নিজেরই লেখা ছিল সেটি। গোটা বিশেক শিশু-অভিনেতা তৈরি হয়েছিল নাটকটির মধ্য দিয়ে। এছাড়াও ‘ডিম্ব রাজা’, ‘জুতা আবিষ্কার’-সহ অনেক শিশুতোষ প্রযোজনা মঞ্চসফল হয়।
মামুনুর রশীদ বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান থাকাকালে, ২০০৬ সালে ফেডারেশান থেকে একবার প্রযোজনা-শর্তে পঁচিশ হাজার টাকার অনুদান পেয়েছিলাম আমরা। একটা প্রযোজনার জন্য সেই টাকা নিতান্তই অপ্রতুল হলেও উৎসাহের জন্য বিস্তর। নিজেদের বাড়তি অর্থ-সংযোগে মঞ্চায়নের কাজ শেষ করেছিলাম। বৃটিশ উপনিবেশকালে কমলগঞ্জের ভানুবিল পরগনার মণিপুরি কৃষ্কপ্রজাদের আন্দালনের কাহিনি নিয়ে তখন ‘ভানুবিল’ নামের নাটকটি মঞ্চে আনা হয়। ঢাকায়ও দুটো প্রদর্শনী হয়েছিল নাটকটির। বাংলার জাতীয় ইতিহাসের অংশ অথচ প্রায় আড়ালে থাকা এক সংগ্রামের গল্প মানুষকে আন্দোলিত করেছিল।
২০০৮ সালে ঢাকার ‘সুবচন নাট্য সংসদ’ প্রবর্তিত ‘আরজু স্মৃতি পদক’ পায় ‘মণিপুরি থিয়েটার’। ঢাকার বাইরের সেরা নাট্যদল হিসেবে সেটি ছিল আমাদের জন্য প্রথম কোনো জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতি। ঐ পদক গ্রহণ ছিল আমাদের জন্য উত্তেজনাকর। কারণ, সেরা তিনটি নাট্যদলের প্যানেল থেকে বেছে নেয়া হয়েছিল আমাদের। উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা নিয়ে আমরা কয়েকজন উপস্থিত হয়েছিলাম ঢাকায়। যখন আমাদের দলের নাম ঘোষণা করা হলো, আবেগে কণ্ঠরুদ্ধ অবস্থা। সে-ই ছিল আমাদের প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল পঁচিশ হাজার টাকা। সেই টাকার ওপর নির্ভর করেই মঞ্চে আনার উদ্যোগ নেয়া হয় নতুন নাটক ‘ইঙাল আধার পালা’।
‘ইঙাল আধার পালা’ এখন পর্যন্ত আমাদের একমাত্র দ্বিভাষিক নাটক। কথক বা সূত্রধারের বর্ণনা ছিল বাংলায় আর পাত্র-পাত্রীদের সংলাপ মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ভাষায়। একজন মণিপুরি মৃদঙ্গবাদকের চুরি যাওয়াকে নিয়ে মূল গল্প আবর্তিত হলেও, সাংস্কৃতিক সংকটের রূপক স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাটকে। জ্যোতি অভিনয় করেছিল কথকের ভূমিকায়। মূল নায়ক মৃদঙ্গবাদকের ভূমিকায় ছিল প্রেমসিং লক্ষণ সিংহ। মা-মেয়ের ভূমিকায় যথাক্রমে শুক্লা আর স্মৃতি। আর নন্দর ভূমিকায় সুশান্ত। সবাই দারুণ অভিনয় করেছিল। এটিও এরেনা মঞ্চে ডিজাইন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আবারও ‘মণিপুরি থিয়েটার’-এর জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি মেলে ২০১৩ সালে ‘এস এম সোলায়মান প্রণোদনা বৃত্তি’ পাওয়ার মধ্য দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা অবলম্বনে একেবারেই মণিপুরি একটা গল্প ফেঁদে করলাম ‘দেবতার গ্রাস’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত বর্ষ উদ্যাপনের ধারায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় নাটকটি মঞ্চায়ন করা হয়। এক ঝাঁক নতুন অভিনেতা দলে আসে নাটকটির মধ্য দিয়ে। সুনন্দা, বীথি, পাপড়ি-সহ অনেকেই। নাটকটিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক ধরনের উৎকণ্ঠা জাগিয়ে রাখার নিজস্ব রীতির নিরীক্ষা ফলপ্রসূ হয়েছিল।
সর্বশেষ ‘লেইমা’। অচর্চিত বা স্বল্পচর্চিত নাট্যকারদের রচনা নিয়ে কাজ করার একটা ইচ্ছা বা জেদ সবসময় কাজ করে। স্পেনের ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার নাটক বাংলায় হয়েছে খুবই কম। অনেক খোঁজখবর করে গুগল ঘেটে তাঁর কাব্যনাট্য ‘ইয়ের্মা’র সন্ধান পাই। অনুবাদ করে ফেলি। যেন আমাদেরই জনপদের গল্প। এর কাব্যিকতা, আবেগ, তীব্র আকর্ষণ করে। এবার অভিনয় আর সংলাপে জোর দিয়ে নাটকটির ডিজাইন করি। বিশুদ্ধ মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ভাষা এবং সম্পূর্ণ সংলাপ-অভিনয়-নির্ভর বলে বাঙালি দর্শকরা কতটুকু নিতে পেরেছে ঠিক জানি না, তবে মণিপুরিদের মধ্যে এর আবেদন ছিল বাধভাঙা।
আনন্দ আর গর্বের সাথে মনে পড়ে ২০১১ সালের ‘থিয়েটারওয়ালা’র সেই নাট্যযজ্ঞ। ফয়েজ জহির, আজাদ আবুল কালামের মতো উঁচুমানের নাট্যনির্দেশকের পাশে ছিল আমার নাম। ‘ফয়েজ জহির-আজাদ আবুল কালাম-শুভাশিস সিনহা নাট্যযজ্ঞ’ ছিল এই তিনজনের নির্দেশিত নাটক নিয়ে উৎসব। সেই ঘটনা এখনও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে উদ্দীপ্ত করে ভীষণভাবে।
২০১২ সালে ভারতের মণিপুরি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে নাট্যমঞ্চায়নে আমাদের প্রাণের আনন্দ ছিল। আর ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে আগরতলা, শিলচরে নাটক করাটাও গর্বের ছিল নিঃসন্দেহে।
শুধু নাটক নয়, মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী নানান আঙ্গিক নিয়ে আমরা ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছি এখানকার পালাকার, ইশালপা বা গায়েন, রাসধারী, সূত্রধারীদের সঙ্গে। তারা আমাদেরকে ভালোবেসেছেন, সাহচর্য দিয়েছেন।
যে-রাসলীলা মানতের উছিলায় কেবল মণ্ডপে মন্দিরে হতো, তাকে আমরা বিষু উৎসবের সর্বজননীন মঞ্চে নিয়ে আসি। মূল প্রসেনিয়াম মঞ্চে অন্যান্য অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে গভীর রাতে খোলা মাঠে বানানো রাসের বৃত্তাকার মণ্ডলি বা মঞ্চে শুরু হতো সম্পাদিত রাসলীলা। সেখানে থিয়েটারের মেয়েরাই অংশ নিতো। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি নিয়ে সে পরিবেশনা সম্পন্ন করা হতো।
এছাড়াও উদুখল রাস, রাখাল রাস, হোলি, ধ্রুমেল-সহ অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনাকে নতুন নতুন বিন্যাসে পরিবেশনের নিরীক্ষা করে গেছি আমরা।
আমরা পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছি প্রাচীন গ্রামীণ ক্রীড়াকেও। নিকন খেলা বা পাশা খেলা মণিপুরিদের পুরনো ঐতিহ্য। বিষুর সময় পাঁচ দিন ধরে এই খেলা হত। এখন যা ম্রিয়মাণ। খেলাটিকে আবার জাগিয়ে তোলার জন্য আমরা গত বছর পাঁচেক ধরে এই খেলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছি। খেলার সাথে পড়ার আন্দোলনেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রকাশ করে চলেছি বাৎসরিক ‘মণিপুরি থিয়েটারর পত্রিকা’। প্রতি বছর রাসপূর্ণিমার উৎসবে বসে আমাদের বুকস্টল। বই ছাড়া কি সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্ভব!
একবার সপ্তাহব্যাপী নাট্যভ্রমণ করেছিলাম। একটা পিক-আপ ভ্যান ভাড়া করে প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাটকের মঞ্চায়ন। সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে। এক একটা গ্রামে চলে গিয়ে একটা মণ্ডপ বেছে নিয়ে সেখানে গিয়ে ব্যবস্থা করে ফেলতাম নাটক। মঞ্চ তো মণ্ডপের ভূমিতেই। মাইকিং করে লোকজন জড়ো করতাম। এনজিওরাও এভাবে নাটক মঞ্চায়ন করে। কিন্তু ভিন্নতা হলো, আমাদের নাটকগুলো কোনোরূপ প্রপাগা-ামূলক ছিল না। দলের মূল প্রযোজনাগুলো, যেমন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, ‘চন্দ্রকলা’, ‘ধ্বজো মেস্তরীর মরণ’, ‘ইঙাল আধার পালা’, ‘ভানুবিল’ এই নাটকগুলোই আমরা পপুলার থিয়েটারের ধারায় গ্রামে গ্রামে মঞ্চায়ন করেছি। প্রতিদিন দুটো করে গ্রামে নাটক মঞ্চস্থ হত। ঝড়-বৃষ্টি কোনোকিছুই থামাতে পারে নি আমাদের।
একদিন কথায় কথায় দলের সদস্য গল্পকার সত্যজিৎকে আমার অন্যরকম স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম আমি এই পলি-কাদা-ধুলো-মাটির জমিনে দাঁড়িয়ে নাটক করব, কিন্তু আমার নাটক নিয়ে যাবো নগরের মানুষের কাছে। সুযোগ পেলে দেশের বাইরেও নিয়ে যাবো আমাদের নাটক। তাদের মন জয় করে ফিরব আবার নিজের গৃহকোলে। হয়তো জোনাকজ্বলা রাতের অন্ধকারে। হতে পারে আবেগের বশবর্তী হয়েও ওসব কথা বলেছিলাম। সেই স্বপ্ন হয়তো খানিকটা পূরণও হয়েছে। একটা নাটক আমরা গ্রামের সবুজ ছায়ায় বাতাসের ভালোবাসার শিসে শিসে গুঞ্জরিত পরিবেশে মঞ্চায়নের কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করি। প্রথমে গ্রামের লোকদের সামনে উপস্থাপন করি, তাদের ভালোলাগার মন্দ-লাগার দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করি। তারপর খানিকটা ঘষামাজা করে শহরে এবং ঢাকায় নিয়ে যাই। নাটক শেষে যেন অস্কার ওয়াইল্ডের মতো বলতে না হয়- The play was a great success, but the audience was a disaster, অর্থাৎ নাটকটা তো বেশ সফল ছিল, কিন্তু দর্শকরাই তার কিছু বুঝতে পারল না!
‘কহে বীরাঙ্গনা’ বাংলা নাটক বা বাংলার নাটকের জন্য কতটুকু জানি না, সে হিসাব করবেন নাট্যগবেষক বা সমালোচকেরা, আমাদের এই প্রান্তবর্তী দলের জন্য এটি হচ্ছে সত্যিই একটা মাইলফলক। যে ফলক আমাদের দলের পরিচয়কে একরেখায় ছেয়ে ফেলে নি। বরং অগ্রবর্তী বাতি হয়ে সব আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে।
কোনো একদিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, আমি তখন মাস্টার্সে, জ্যোতি মাত্র ভর্তি হয়েছে। কিছুদিন ক্লাসও হয়েছে, আমরা গ্রামের সীমানার বাইরে সুদূর জাহাঙ্গীরনগরে গিয়ে ফের মিলতে পেরেছি এক বছরের জন্য। আমাদের ওই এক বছরে যে কত সময় কাটিয়েছি শুধু থিয়েটার-ভাবনায়, পরিকল্পনায়- তা বলে শেষ করা যাবে না। জাহাঙ্গীরনগরের সবুজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে ঘুরতে আমরা রচনা করেছি যোজন যোজন দূরের মণিপুরি থিয়েটারের আগামী সোনালি স্বপ্ন। আমরা তখন কেবল মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ভাষায় নাটক করছিলাম। ‘ইঙাল আধার পালা’ নাটকে কথকের বর্ণনায় বাংলা ভাষা নিয়েছিলাম। কিন্তু ভাবছিলাম, নিজেদের জাতিসত্তার সংকটাপন্ন একটা ভাষাকে শিল্পনন্দনের চর্চার মধ্য দিয়ে সমুজ্জ্বল করে বাঁচিয়ে রাখার যে ব্রত আমরা নিয়েছি, থিয়েটারের আঙিনায়, সে ব্রতর বাইরেও আর কিছু করার থাকতে পারে কিনা, যাকে বলে শিল্পের স্বাধীনতা। শিল্পী তো চাইতেই পারে হাত-পা ছুঁড়তে। ভাষার খাঁচা ভেঙেচুরে কিছু বলে উঠতে। আর বাংলা তো বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষা, আমাদেরও সে আত্মীয়-ভাষা। আর সাহিত্যের চর্চায় বলা যায় মাতৃভাষার মতোই।
তাই ভাবছিলাম আমরা এমন কিছু একটা করব যা একটু অভিনব হয়ে ওঠে। আমি কবিতা লিখি। বলতে গেলে নাটকের পরিচয়ের আগে কবি হিসেবেই পরিচিতি ছিল আমার, আমার জনপদে এবং হয়তো কিছুটা অন্যত্রও। জ্যোতিও কবিতা ভালোবাসে ভীষণ। ভাবলাম, কত ধরনের নাটকই তো হয়। নাটককে আরেক প্রিয় শিল্প-আঙ্গিকের কাছে নিয়ে যাই। কাব্যনাট্য না, একদম কবিতাই। ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ আসলে নিখাদ কবিতাই। নাট্যগুণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। ঘটনা সেভাবে ঘটে না। আর মধুসূদনের আঁটোসাটো অক্ষরবৃত্ত! দর্শক শুনবে? দেখবে? না শুনুক, না দেখুক, আমার মন আচ্ছন্ন হয়েছিল। জ্যোতিকে বললাম- পড়ো। পড়তে থাকো। তোমার মনে যদি ভালো-লাগা জন্ম নেয়, তাকে লালন করার স্বপ্ন দেখো।
পড়ার পর জ্যোতি বেশ উচ্ছ্বসিত। কিন্তু আমরা তখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি। আমি শুধু বলেছি একদম গভীরে যেতে হবে। পাঠের আরও ভেতরে। যেখানে গেলে শব্দের আপাত দেয়ালগুলোকে ভেঙে ফেলা যায়, স্বর আর শরীরের রসায়নে জারিত করে ফেলা যায় কবিতার ছদ্মপ্রস্তর। জ্যোতি তা করেছে। কতদিন যে কথা চলেছে, আলাপ করেছি, শুধু বলেছি এখানে মুন্সিয়ানা ফলানোর চেষ্টা করা হবে না। কেবল আমরা টেক্সটের কাছে নিজেদেরকে ছেড়ে দেব। যেমন ধর্মগ্রন্থের সামনে নতজানু ধার্মিক। শিল্প তো এক অর্থে শিল্পীর ধর্মই। আমার দিদি শর্মিলার সাথে বসে সুর আর রাগ-রাগিনীগুলো ঠিক করলাম। সংগীতের সাথে বাদ্য। বিধান (মণিপুরি থিয়েটারের প্রধান বাদ্যশিল্পী বিধানচন্দ্র সিংহ) বাদ্যকে নাটকীয় করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে গেল। এভাবেই মঞ্চের জন্য প্রস্তুত হলো ‘কহে বীরাঙ্গনা’।
যখন চূড়ান্ত রান থ্রু হলো, দলের কর্মীরা আবেগে উচ্ছ্বসিত। অন্যতম দৃশ্যসজ্জাকারী সজল আবেগে বলে উঠল, এবার আমরা দেশ জয় করব।
আমি বলেছি, দেখা যাক।
গ্রামের সেই ছোট্ট স্টুডিও (তখন আরও ছোট ছিল এর মাপ) নটমণ্ডপে টানা দু’দিন চারটা প্রদর্শনী হলো, দর্শনীর বিনিময়ে। লোকে ভরপুর। এক বৃদ্ধাকে চোখ মুছতে দেখা গেল। দর্শক পিনপতন নীরব। একাধিকবার দেখল অনেকেই। বাংলা ভাষায় মধুসূদনের নাটক, তথাকথিত ‘গ্রামে’! বুঝলাম শিল্পরুচির ঐতিহ্য-পরম্পরা কী জিনিস! যে-সমাজের লোকজন রাসলীলা নটপালার মতো অসামান্য উচ্চ শিল্পস্বাদ নিয়ে অভ্যস্ত, তারা ‘কহে বীরাঙ্গনা’ কেনো নেবে না। অবশ্য নাটকে জ্যোতির অসাধারণ একক অভিনয় তাদের কাছে নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার করেছে এবং তা নাটকটির জনপ্রিয়তায় অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। সঙ্গে দিদি শর্মিলার নেপথ্য সংগীতের মূর্চ্ছনা, বিধানের বাদ্যের ম্যাজিক, কোরিওগ্রাফি দলের অভিব্যক্তিময় মুদ্রা।
কলকাতায় ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র আমন্ত্রণে নাটকটি যখন মঞ্চস্থ হলো, সেখানে নাটক শেষেই মঞ্চে প্রায় এক ঘন্টার একটা অনানুষ্ঠানিক সেশন হয়ে গেল। দর্শক-সমালোচক আর নির্দেশক মুখোমুখি। পত্রিকাটির ক্রিটিকস, লেখকরাই বেশি আলোচনা করেছিলেন। আমার মনে আছে, একজন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, পুরো নাটকটা মনে হয়েছে একটা সুতোর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, এত ঝুঁকিপূর্ণ, এত চ্যালেঞ্জিং! এই ঝুঁকি আমরা কিভাবে নিতে পারলাম, কিভাবেই বা আদ্যোপান্ত সফল হলাম?
আরও একটা অবাক হবার ঘটনা, বিটিভিতে মঞ্চনাটক স্লটে ‘কহে বীরাঙ্গনা’ প্রচার করার পর (বিটিভির স্টুডিওতে ধারণ করেই) বিভিন্ন পর্যায়ে নাটকটির ১৭ বার পুনঃপ্রচার করা হয়। বিটিভিতে কোনো নাটকের এটাই নাকি সর্বোচ্চ পুনঃপ্রচার। এমনকি বিশেষ বিশেষ দিনে পিক আওয়ারেও নাটকটি প্রচার করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
ষাট হাজার টাকা খরচ হয়েছিল প্রযোজনাটিতে। টেলিভিশনের জন্য দুটি নাটক লিখে বিশ হাজার টাকা যোগাড় করেছিলাম। জমানো টাকা থেকে আরও হাজার বিশেক। বাকি টাকা দলের দু-তিনজনের কাছ থেকে নেয়া হয়েছিল। তখন জ্যোতিও কপর্দকশূন্য বলা যায়। ও খুবই ক্রাইসিসে ছিল। পিতৃহীন সংসারে ছোট বোন স্মৃতি (কহে বীরাঙ্গনা’র অন্যতম শিল্পী) তখন মাত্র কলেজে পড়াশোনা করছে। জ্যোতি একটা এনজিওতে ঢুকেছিল। নাটকটির জন্য তাও ছেড়ে দিল।
যা হোক ‘কহে বীরাঙ্গনা’র পঞ্চাশ প্রদর্শনী হলো। এই নাটক নিয়ে এত রিভিউ, এত আলোচনা, এত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, আমরা নিজেরাই কখনো কখনো বিব্রত হয়েছি। কিন্তু আমরা এই খ্যাতিতে পথ হারিয়ে বসে নেই। গ্রামের সবুজ ঘাসের পথে ধূলিমাখা পায়ে হেঁটেছি শিল্পের ভালোবাসাকে বুকে নিয়ে, সেই আগের মতোই, পথ খুঁজেছি নতুন প্রকরণের।
আমাদের থিয়েটারচর্চা সেই অর্থে একাডেমিক থিয়েটারের মতো তো নয়। এত তত্ত্ব-গবেষণা নিয়ে আমরা থিয়েটার করি না, গ্রুপ থিয়েটারের মতো এত সাংগঠনিক রীতিনীতি বজায় রেখেও চলে না আমাদের গ্রুপ, আমাদের থিয়েটার আনন্দ আর ভালোবাসার থিয়েটার।
আমরা থিয়েটারটিকে এখনো টিকিয়ে রেখেছি স্বপ্ন আর ভালোবাসার জোরে। এই স্বপ্ন কোনো প্রতিষ্ঠার বা প্রতিষ্ঠানের চূড়ায় ওঠার নয়। কিন্তু শিল্পের আর সাধের আকাশে উড়বার। আমরা জীবন আর থিয়েটারকে খুব কাছাকাছি করে নিয়েছি। এখন আর আলাদা করে নাটক-থিয়েটার নিয়ে আমাদের ভাবতে হয় না। জীবনের নিতান্ত তাগিদের বাইরে থিয়েটার-প্রাঙ্গণ আমাদের মহড়ার ছোট্ট জায়গাটি অথবা স্টুডিওর সামনের বাঁশের বেঞ্চিখানাই আমাদের থিয়েটার ভাবনার জায়গা। এখানে বসে আমরা ভাব-বিনিময় করি। সেই ভাব-বিনিময়ের ভেতর থাকে শিল্প আর নাট্যের স্বপ্নসুধা।
কিন্তু পথ আমাদের বড়োই সংকটের। সেই শুরু থেকে আমাদের লড়াই করে যেতে হয়েছে নিদারুণ বাস্তবতার সাথে। বরাবরই আমরা শুনেছি, একটা গ্রামে, একেবারে প্রান্তিক অঞ্চলে, জীবন যেখানে টেকে না, সেখানে থিয়েটার টিকবে কিভাবে?
কথা সত্য। এখানে পর্ব-পার্বণ, হাসি-আনন্দ, নাটক-গান-বাজনা সবই হয়, একটা হলো ধর্মের সাথে যুক্ত আরেকটা বাৎসরিক- শখের সাথে। কিন্তু একটা কিছু করব, যা না যুক্ত ধর্মের সাথে, না যুক্ত মঙ্গলকামনার সাথে, না যুক্ত আর্থিক কোনো ব্যাপারের সাথে। আমরা একটা দল টিকিয়ে রাখব, যে দলের কাজের মধ্য দিয়ে আর্থিক মুনাফার কোনো ব্যাপারই নেই, বরং ক্ষতিই হবে, যেটা কৌম জীবনের ধর্মীয় কোনো কৃত্যের সাথে যুক্ত হবে না, যেখানে ত্যাগই হয়ে উঠবে মূল মন্ত্র; তাহলে কেনো তা টিকে থাকবে, এই যুগে?
সত্যি তো কেনো টিকে রইলাম? একটা বড় প্রশ্ন। কম ঝড় তো আসে নি। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রচণ্ড আর্থিক টানাপোড়েন তো আছেই। প্রথম প্রথম সমাজের লোকেরাই সন্দেহের চোখে দেখেছে, যখন আমরা থিয়েটারকে সিরিয়াসলি নিতে শুরু করলাম। তারা মেলাতে পারত না, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে। অনেক খাটাখাটনি করে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হয়েছে। এক একজন সদস্য বা অভিনয়কর্মী পাওয়ার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। অভিভাবকদের সাথে রীতিমতো একটা সম্পর্ক তৈরি করতে হয়েছে। কত কর্মী অভিনেতা আছে, যাদেরকে নদী পার হয়ে আসতে হয় মহড়ায়, রাতের বেলা ফিরতে হয় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। তাদেরকে থিয়েটারে ধরে রাখা কষ্টসাধ্য বৈকি! এর সাথে আছে অভিনেতা হারাবার ভয়। এক একজন অভিনেতাকে অনেক কষ্টেসৃষ্টে একটা জায়গায় দাঁড় করানোর পর, মাঝখানে জীবনের প্রয়োজনেই তাকে হারাতে হয়। চাকরির সন্ধানে তাকে চলে যেতে হয় দূরে কোথাও। তবে এ-ও সত্য, অন্য কোনো হাতছানিতে, উচ্চাকাঙ্ক্ষায় বিভোর হয়ে তারা বিচ্যুত হয় না। নাটক করার প্রবল ইচ্ছা আর প্রাণের টান থাকার পরও তাদেরকে মেনে নিতে হয় অন্যরকম জীবন। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা বিয়ে। বিয়ে হয়ে গেলেই তার অভিনয়জীবন শেষ। গ্রামের বাস্তবতায় এটাই নির্মম সত্য। অভিনয়ে পূর্ণতা আসার আগেই ক্যারিয়ার থমকে গেল। এভাবে ঝরে গেছে কত প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পী- লক্ষ্মীনারায়ণ, নীলমণি, আপন, রূপেন, বিশ্বজিৎ, ঝর্ণা, অঞ্জনা, সূচন্দা, প্রণতি, নির্মলা আরও অনেকজন। নতুন করে আবার অভিনেতা তৈরি করে নিতে হয়।
তারপর ছিল প্রকৃতির বিরূপ আচরণ। অনেক কষ্ট করে মুক্তপ্রাঙ্গণে মঞ্চ বানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে যাবো, ধেয়ে এলো কালবৈশাখী। অনুষ্ঠান পণ্ড। একবার এরকমই একটা অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে এসেছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। ঝড়ে পণ্ড হওয়া অনুষ্ঠানের রাত্রিতে আমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে তাঁর সাথে আমাদের দীর্ঘ আড্ডা হলো। আমাদের জন্য দাদার কী যে মন খারাপ। সেদিনের পর থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের একজন আত্মীয়। এই দলটিকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছেন, সহযোগিতাও করেছেন।
আমাদের আর্থিক সমস্যাটি চরম। এখন অবধি আমরা কোনো দাতা সংস্থা বা কোনো অনুষ্ঠানে কোনোরূপ বিজ্ঞাপন বা স্পন্সরশিপ নেই নি বললেই চলে। মোটা দাগে কোনো দান অনুদানও না। যুক্ত হই নি কোনো এনজিওর সাথে। একটা আদর্শিক অহংবোধ কাজ করত শুরু থেকেই। তারপরও ত্রিশটি নাটক আমরা মঞ্চে এনেছি। নিজেদের উদ্যোগেই সব মিলিয়ে হয়তো তিন শতাধিক মঞ্চায়ন হয়েছে নাটকগুলোর। বিষু উৎসব করেছি। একমাত্র এই উৎসবেই পাড়ায় খানিকটা চাঁদা তোলা হয়। তাও নিতান্ত অপ্রতুল। কিন্তু বছর জুড়ে নানা ধরনের কর্মকা- লেগেই আছে। আমাদের দু’একজনের ব্যক্তিগত আর্থিক সহায়তা দিয়ে কিভাবে সম্ভব এত কর্মকা- পরিচালনা?
আমার পরিবারটির কথা না বললেই নয়। সামান্য বেতনের স্কুলশিক্ষক বাবা, আমাদের তিন ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ যোগাতেই হিমসিম খাচ্ছিলেন। তার উপর যোগ হয়েছিল আমাদের সব ‘আহ্লাদ’, ‘আদিখ্যেতা’। এটার কারণ, বাবা যে নিজেও একজন অভিনেতা আর নাট্যসংগঠক ছিলেন। বাবার অভিনীত ‘তাসের ঘর’, ‘বন্দীর ছেলে’ ইত্যাদি নাটকের কথা এখনও লোকের মুখে মুখে শুনি। শিল্পসাহিত্যের প্রতি তাঁর অগাধ দরদ। পুরো একটা বাড়িই তো ছেড়ে দেয়া হয়েছিল আমাদের জন্য। উঠানে করতাম মহড়া। শিশিরে কুয়াশায় ভিজে ভিজে। বৃষ্টি-কাদায় একাকার, রোদে পুড়ে ছারখার। অগত্যা দখল করতাম বারান্দা, তাতেও সমস্যা হলে ঢুকে যেতাম বাড়ির ভেতর। সেখানেই হৈ-হুল্লোড়, নাচ-গান, মহড়া...
আমার মা। শুধু আমার নয়, আমাদের এই থিয়েটারেরই মাতৃমূর্তি তিনি। শীর্ণ শরীরে সকল ধকল, হট্টগোল, ‘অত্যাচার’ সয়ে নিয়েছেন, সয়ে নেন। অনিচ্ছায় নয়! ইচ্ছার মায়াভরা হাসিতে, যত্নে, আদরে, ভালোবাসায়। মা যে আমায় ছোটবেলায় ‘সোনার তরী’ পড়ে শোনাতেন, জানতেন, জীবনের ‘সোনার তরী’তে শস্য বোঝাই করে দিতে হলে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়।
আমার দাদার নাম দেবাশিস সিনহা। ডাক নাম শিশির। ডাক্তার হলেও তার মন শিল্পপ্রিয়। ছবি আঁকতেন। হয়তো চিত্রশিল্পীও হতে পারতেন। না হলেও বা কী, আমাদের দলের ডিজাইনার হয়ে গেলেন। প্রথম এক যুগের প্রায় সব ডিজাইন, আঁকিবুকি তারই করা। মঞ্চসজ্জাও তারই।
দিদি (শর্মিলা সিনহা) তো আমার নিত্যসঙ্গী, আজ অবধি। নাটকে সংগীতের অগ্রভাগে সে-ই। মণিপুরি নাট্যোৎসবে উন্মুক্ত মঞ্চে পরিবেশিত প্রথম পর্যায়ের পৌনে তিন ঘন্টার ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নাটকে কুয়াশাভেজা রাতে সে একাই নেপথ্যে ৬৫টি গান গেয়েছিল! এছাড়াও ‘কঠিন-পড়ুয়া’ এই মেয়ে আমার কাজের দারুণ বিশ্লেষক।
পরিবার, শুভাকাঙ্ক্ষীদের এই সাহচর্য, তাতেই কি সব? না। এ লড়াইয়ে টিকে থাকার প্রশ্নে প্রধান উত্তর, কর্মীদের স্বেচ্ছাশ্রম। যে শ্রমের দাম টাকায় গুনে শেষ করা যাবে না। লক্ষ্মীকে দূরে সরিয়ে রেখে সরস্বতীর আশীর্বাদ নিয়ে চলার নীতি। নিজেদেরকে উজাড় করে দেবার প্রত্যয়। একটা উদার অগাধ ভালোবাসা, দলটির প্রতি, এবং যে কাজটি করছি তার প্রতি।
আমরা থিয়েটার করি সমাজ বদলানোর মহান ব্রত নিয়ে নয়, এত বড় লড়াই করার শক্তি, ইচ্ছা, কোনোটাই আমাদের নেই। থিয়েটার করে সমাজ বদলানো যায় কিনা সন্দেহ আছে। আমরা একটা বড় জনপদে সাংস্কৃতিক রুচি তৈরি করতে চেয়েছি, নানান ভাবনা চিন্তার মানুষের শিল্পীর সৃজনের বৈচিত্র্যের স্বাদে শক্তিতে, আমরা একটা সুস্থ চিন্তাশীল আবহ বজায় রাখতে চেয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা একটি সংকটাপন্ন জাতিসত্তার ভাষাকে গতিশীল, সক্রিয়, সমুন্নত করতে চেয়েছি নাটকের মধ্য দিয়ে। যে জাতিসত্তার মধ্যে বহু আগেই বাংলার চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাসেরা প্রবেশ করেছেন তাদের অধ্যাত্মপ্রেমের রসদ নিয়ে, হয়েছেন তাদের নিজেদের শক্তিতে আত্তীকৃত। সে-জাতিসত্তার সমকালীন সাংস্কৃতিক ক্যানভাসে আমরা খচিত করেছি বড়ু চণ্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন ও হেনরী, লোরকা-সহ আরও অনেক বৈশ্বিক পরিচয়ের মনীষী। খচিত হয়েছে আপন ভাষারই ব্রজেন্দ্রকুমার, স্মৃতিকুমার, বিমল অনুকূল-সহ অসংখ্য সমকালীন কথাশিল্পীর নাম। সব রচনাকেই আমরা পরিবেশন করেছি আমাদের নিজস্ব আঙ্গিকে।
মণিপুরি সংস্কৃতির নানান আঙ্গিকের পরিমিত প্রয়োগ এবং সৃজনশীল আধুনিকায়ন, থিয়েটারের চিরায়ত মুদ্রা-মোটিফ, সুন্দরকে ক্ষুণ্ন না-করা শরীরী অভিব্যক্তি আর নিখাদ ভক্তি-প্রেম- এসবের মধ্য দিয়েই রূপ পায় আমাদের নাট্যকর্ম। জীবনকে নানান দিক থেকে বোঝার একটা শিল্পযজ্ঞে আমরা পৌরোহিত্য করেছি, অন্তত একটি প্রান্ত-সমাজের মধ্যে। এ-আনন্দ কম কথা নয়!
এমন কোনো দিন যায় না আমরা এই থিয়েটারের কথা বলি না, সংশয়ে থাকি না, উচ্ছ্বসিত হই না, হতাশায় ভুগি না, নতুন স্বপ্ন দেখি না। প্রাত্যহিক কাজ করতে করতে, জীবনের অন্য দায়িত্ব পালন করতে করতে, পথ চলতে চলতে, ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে, একটু বিরাম নিতে নিতে আমাদের সাথে লেগে আছে মণিপুরি থিয়েটার। মজার ব্যাপার, আমরা ঠিক নির্দিষ্ট করে বলতে পারি না, আমাদের সদস্যসংখ্যা কত। কারা কারা এ দলে আছে। কখনো মনে হয়, দশ, পনেরো বিশ, পঁচিশ... কারা যায় কারা আসে সে খবরও ঠিক বুঝতে পারি না। যারা চলে গেছে তারাও ফিরে আসে, যারা আসে, তারাও কেউ কেউ চলে যায়। আবার এমনও দেখা যায় কোনো অনুষ্ঠানে মূল সদস্যদের অনেকেই হয়তো অনুপস্থিত, কিন্তু যারা দলের কেউই নয়, তারাই এসে নেমে পড়েছে কাজে। অদ্ভুত এক লীলা আমাদের! ভাবলে অবাক লাগে! গ্রামীণ জনপদে একটি নাট্যদল যেন এভাবেই সজীবতা পায়। এভাবেই তার গায়ে লাগে মুক্ত হাওয়ার দোলা।
অবশেষে এলো ২০১০ খ্রীস্টাব্দ। আমরা একটা স্থায়ী ঠিকানা পেলাম। নিজেদের একটা ছোট্ট মিলনস্থল। নটমণ্ডপ। আমাদের ভিটার ভেতরেই, বাড়ির উত্তর-পূর্বদিকে তোলা হলো নটমণ্ডপ। বাবা অতি উৎসাহে এই জায়গাটুকু আমাদের থিয়েটারের নামে দিয়ে দিলেন। অধিকাংশ কাঠের ব্যবস্থাও করে দিলেন তিনি। নির্মাণকালীন তত্ত্বাবধানটাও তাঁরই। প্রথমে খুবই ছোট্ট কুটির ছিল, কেবল মহড়াকক্ষ হিসেবে। বাঁশ-টিন দিয়ে বানানো। পরে দ্বিতীয় দফায় আরেকটু বাড়ানো হলো। ভেঙেটেঙে। তখন পঞ্চাশ-ষাট জন লোক বসতে পারত। ‘কহে বীরাঙ্গনা’ আর ‘দেবতার গ্রাস’-এর মঞ্চায়ন সেখানেই হয়েছিল।
২০১৩ সালে আজকের পূর্ণরূপটি পেয়েছে। আগের ঘরটির সাথে বড় একটি ঘর যুক্ত করা হলো অদ্ভুত গ্রামীণ আর্কিটেক্চারাল মুন্সিয়ানায়। যে এই কাজটি করেন, তার নাম জয়সিংহ। তিনটি আলাদা অংশ একত্রে যুক্ত হয়েই আজকের ‘নটমণ্ডপ’। এখন ’শ দেড়েক দর্শক অনায়াসে বসতে পারে। নটমণ্ডপ আধুনিক কোনো মঞ্চগৃহ নয়, বাঁশ-বেত-মাটির একেবারেই গ্রামীণ নাট্যকুটির। এই নাট্যকুটিরের সামনেই বাবার ভাস্কর্য। এই নাট্যকুটির আজকের পূর্ণরূপ পাওয়ার চার মাসের মাথায় বাবা আকস্মিক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বাবার সেই স্মারকমূর্তিতে লেখা আছে ‘হে মোর চিত্ত পুণ্যতীর্থে জাগো’। আমি, আমরা, সবাই জানি, বাবার সেই তীর্থ শিল্পের আনন্দে মুখর। বাবা সেখানে আবার জেগে উঠছেন। আমাদের অবিরল আনন্দের গহনপটে।
জানি এই ‘পথে পথে পাথর ছড়ানো’ তবু যে ‘অলৌকিক আনন্দের ভার’ আমরা কাঁধে তুলে নিয়েছি, তাকে আর অবমোচনের উপায় তো নেই। তাই পথ চলব। একদিন ধলাই নামের এক ছোট্ট নদীর তীরের ছোট্ট এক গ্রামে নাটকের একটা দল গড়ে তুলেছিলাম আমরা। আজ সেই দলের কথা দেশের মানুষ জানে। দেশ আজ আমাদেরও নাট্যসত্তার ভেতর জাগ্রত চেতনা। ক্ষুদ্র একটি সমাজকে নাটকের মধ্য দিয়েই আমরা মেলাতে পেরেছি বৃহৎ ও অপরাপর সমাজের সাথে।
কাজ তো মাত্র শুরু। এখনই কেনো বন্ধ করবো পাখা!
শুভাশিস সিনহা: নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক। প্রতিষ্ঠাতাসদস্য- মণিপুরি থিয়েটার, মণিপুরি, সিলেট। ফোন- ০০৮৮-০১৭১৬৫৭৮৩০৩, ই-মেইল- This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.