Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

নাটকের ওয়াহিদুল হক

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

ওয়াহিদুল হক গানের মানুষ, একেবারেই গানপাগল, সঙ্গীত, বিশেষভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর ধ্যানজ্ঞান, নাটকের তিনি কী করে হন সেটা এক জিজ্ঞাসা বটে। এটা ঠিক নাটক ও গানের একটি মিলনক্ষেত্র রয়েছে যেখানে একে অপরকে বরণ করে নেয় স্ব-স্ব পরিসরে। ওয়াহিদুল ভাই অবশ্য সেই মিলনক্ষেত্রের মানুষ নন। ভারতীয় রসশাস্ত্রে নাটক, নৃত্য ও গানের মধ্যে বিশেষ ফারাক রাখা হয় নি, ওয়াহিদুল ভাই নাট্যশাস্ত্রের সেই মিলনতত্ত্বেরও রূপায়ণকারী নন। তবু তাঁকে আমরা নাটকের একজন হিসেবে ফিরে ফিরে পাই এবং বিশেষভাবে পাই আরো এক মিলনক্ষেত্রে, যে পরিসরটি তাঁর নিজেরই রচনা এবং এখানেই রয়েছে নাটকের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্তির অনন্যতা ও সার্থকতা।

ওয়াহিদুল হক সঙ্গীতকে দেখেছিলেন মানব-অস্তিত্বের সমস্ত চরাচর জুড়ে, নিখিলের সর্বভূতে। তাঁর জন্য আদিতে ছিল যে শব্দ, শব্দই ব্রহ্ম, সেই উচ্চারণে বেজে উঠেছিল সুরের অনুরণন, আদি সেই শব্দ তাই হয়ে উঠেছিল সঙ্গীত। ছায়ানট ভবনে কিংবা শহীদ মিনারের উন্মুক্ত চত্বরে সবাই মিলে যখন তাঁকে গানে গানে মুখরিত হয়ে বিদায় জানায়, তাঁরই হাতে-গড়া ছাত্রছাত্রীরা একের পর এক আকুল গানে গোটা পরিবেশ সঙ্গীতময় করে তুলেছিল, দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এলেও সম্মিলিত সুরছন্দে গায়ক-গায়িকারা কেউ শুদ্ধতার বিচ্যুতি ঘটতে দিচ্ছিলো না, তখন সেই তুলনারহিত গীতিমূর্চ্ছনায় আপ্লুত হতে হতে মনে হচ্ছিল সুরের গুরুকে এই তো যথার্থ বিদায়দান। শুরুতে ছিল যে সুর, বিদায়কালেও সেই সুরেরই দোলায় তাঁকে আমরা ভাসিয়ে দিলাম।

সঙ্গীতকে অনেক বড়ভাবে দেখতে পেরেছিলেন ওয়াহিদুল হক এবং সঙ্গীত থেকে যাত্রা করে তিনি পৌঁছেছিলেন জীবনের আর সব ক্ষেত্রে। তাঁর সঙ্গে যারা চলেছেন-ফিরেছেন তারা জানেন তিনি সর্বদা সর্বসময় গানময় হয়ে আছেন, পথ চলতে চলতে, রিকশায় বসে, কোথাও কোনো কিছুর অপেক্ষায় থেকে সর্বদা তিনি গুণগুণিয়ে উঠেছেন কোনো রাগরাগিনীর সুর কিংবা ফিরে ফিরে গাইছেন গানের এক কলি। কী পেয়েছিলেন তিনি গানে? এককথায় এর জবাবে বলা যায়, খুঁজে পেয়েছিলেন জীবন এবং খুঁজে ফিরছিলেন মহাজীবন।

গান বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর জন্য ছিল এই মহাজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অবলম্বন। সুর ও বাণীর যুগল খেলায় এই যে রসায়ন ঘটে তা নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারতেন বলে সঙ্গীত তাঁর কাছে প্রতিভাত হয়েছে বিপুলা পৃথ্বির অচ্ছেদ্য অংশী হিসেবে, যেন তা সমুদ্র বা পর্বতের মতোই কোনো মহিমান্বিত প্রাকৃতিক ঘটনা। আর তাই সঙ্গীতবিন্দু থেকে জীবনসিন্ধুর পানে তাঁর যাত্রা সবসময়ে অব্যাহত রয়েছে এবং এই যাত্রাপথের আনন্দগান তিনি সবসময়ে সবাইকে শুনিয়ে বেরিয়েছেন, এই আনন্দ-অভিযানে সকলকে শরিক করতে চেয়েছেন। সঙ্গীত যদি হয় জীবনকে তার সমগ্রতায় অনুভবের প্রয়াস তবে শিল্পের-সংস্কৃতির যে ছোট ছোট ক্ষেত্র আমরা রচনা করেছি সেই ভেদরেখা তো লুপ্ত হয়ে যায়, সাধনা হয়তো চলছে একটি মাত্র মাধ্যমে তবে সেখানে তো চলে রূপ ও রসের পূর্ণতার খেলা। এই খেলাতেই মেতেছিলেন ওয়াহিদুল হক এবং মাতিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন আর সবাইকে।

আর তাইতো নানা দিকে ছড়িয়ে থাকা নানা কাজে সম্পৃক্ত ওয়াহিদুল হককে যে খণ্ডরূপে দেখা যায় তা আসলে এক অখণ্ড অবিচ্ছিন্ন শিল্পসাধনারই বিষয়। সেই কারণে তিনিও অমন স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন নানা ক্ষেত্রে, নাটকের মানুষদের সঙ্গে তাঁর যে-সম্পর্ক সেসব হয়ে উঠতে পেরেছে স্বাভাবিক ও নিবিড়। নাটকের অনেকজনার সঙ্গে তাঁর সহৃদয় সম্পর্ক তাঁদেরকে শিল্পপথের যাত্রী করে তুলতে সহায়ক হয়েছে। আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, খালেদ খান অথবা আতাউর রহমান, মামুনুর রশীদ এঁরা সবাই ওয়াহিদুল ভাইয়ের বৃত্তের মানুষ। পরবর্তী প্রজন্মের সদস্য বিপ্লব বালা ও আরো কারো কারো সঙ্গেও ছিল পরম্পরাসুলভ ব্যক্তিগত যোগ। আর স্বরসাধন, উচ্চারণ ও বাচনিক উৎকর্ষের প্রতি ওয়াহিদুল হকের যে আগ্রহ সেটা তো নাট্যশিল্পেরও অন্তর্গত। এক্ষেত্রে ওয়াহিদুল হক অনেকভাবে দিশা যুগিয়েছেন, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উচ্চারণ অভিধান প্রণয়নে তাঁর ছিল মুখ্য ভূমিকা, ‘কণ্ঠশীলন’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক্ষেত্রে একটি উচ্চ মান তিনি স্থাপন করেছেন। একক বা বৃন্দ আবৃত্তির প্রতি উৎসাহ থেকে ‘কণ্ঠশীলন’ তো নাটকের দিকেও হাত বাড়িয়েছে, একান্ত স্বাভাবিকভাবে।

নাটকের সঙ্গে ওয়াহিদুল হকের সরাসরি যোগ দু-একবার ঘটেছিল। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় প্রযোজিত ব্রেশটের মোহনগরী নাটকের সঙ্গীতে সুর দিয়েছিলেন তিনি। তবে তার চেয়েও বড় কথা তিনি সঙ্গীতকে যে সমগ্রতা নিয়ে বিচার করেছিলেন সেই বোধ নাটকের ক্ষেত্রে তো আরো বেশি করে প্রযোজ্য। তিনি বুঝেছিলেন যে যেই শিল্পমাধ্যমে কাজ করেন সেই ভূমিতে দাঁড়িয়ে যদি বিশ্বকে আলিঙ্গন করতে পারেন তবেই শিল্প প্রয়াস পেতে পারে সার্থকতা। সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে এই কাজ করেছেন ওয়াহিদুল হক জীবনভর, নিজেকে বহুমুখিতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন, শিল্প-সাহিত্য-জ্ঞান-বিজ্ঞান-সমাজ-ইতিহাস কিছুই তাঁর অধীতব্য বিষয়ের বাইরে ছিল না, একই সঙ্গে সমাজের ও দেশের প্রতিটি সঙ্কটে তিনি আলোড়িত হয়েছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন দেশবাসীর, বিশেষভাবে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন গভীর মমত্ববোধ নিয়ে, এইসব মিলিয়ে যে ওয়াহিদুল হক, তিনি সকল শিল্পরূপসন্ধানীর জন্য রেখে গেছেন মহৎ আদর্শ, নাটকের জন্য তো বটেই।

মফিদুল হক ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ) : নাট্যজন, প্রকাশক