Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় শামসুর রাহমান

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

মৃত্যুর আগে গত কয়েক বছরে শামসুর রাহমানের কবিতায় কি একটু বেশি হতাশার সুর ছিল? কিংবা ছিল কি চারপাশের জগতে বীভৎস নিষ্ঠুরের উল্লাস দেখার ক্লান্তি? কবিতায় কি পরাজিতের বেদনা কিংবা হুতাশ ছাপিয়ে ওঠেছিল? না হবার কি কারণ আছে কোনো? যে জগতে আমরা বসবাস করি সেখানে কোনো সংবেদনশীল মানুষের সৃষ্টিতে এসব কি করে অনুপস্থিত থাকবে? এসব কি শামসুর রাহমানের একান্তই ব্যক্তিগত বোধ, না তাঁর মধ্যে আমরা আমাদের আরও অনেকের শ্বাসের শব্দ পাই? একান্ত ব্যক্তিগত বলে আসলে কি কিছু আছে?

শামসুর রাহমানের এই কবিতার সঙ্গে অনেকের মতো আমার পরিচয়ও তো দীর্ঘদিনের। কৈশোরে নিজের কবিতা লেখার চেষ্টা ব্যর্থ হলেও কাব্যজগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরিতে তা কোনো বাধা হয় নি। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগ তো পাঠ্যবইতেই হয়েছে, তাছাড়া রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, কোথাও কোথাও রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী দেখেছি কৈশোর থেকেই। এসবের সূত্রে তাঁদের সঙ্গে কার না টুকরো টাকরা পরিচয় ঘটে? আমার যে সেখানেই শেষ হয় নি সেটাই স্বস্তির কথা।

এক পর্যায়ে জীবনানন্দ দাশই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আমার কবিতা পাঠ, উপলব্ধি আর কবিতার লৌকিক-অলৌকিক জগতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল নন, কবিতার প্রতি আমার আকর্ষণ দানা বাঁধে বস্তুত জীবনানন্দের কারণেই। সেটা স্কুল উত্তর এবং তারপর কলেজজীবনে। এসময়েই ক্রমে পরিচয় হতে থাকে নবীনতর কবিদের সাথে। দু’জন তখন বিশেষ- একজন আল মাহমুদ অন্যজন শামসুর রাহমান। সে-সময় বাংলাদেশে তোলপাড় সময়। এই দেশের কবি নাট্যকর্মী শিল্পীরা তখন অনেক উচ্চকন্ঠ। ক্ষোভ, ক্রোধ, আশাভঙ্গের বেদনা, ভালোবাসার তীব্রতা, নতুন নতুন ভাবনা সক্রিয়তায় মাতাল সবাই। এই টানে আমাদের মতো অনেকেই তখন ছোটাছুটি করি।

কবি শামসুর রাহমানকে সতর্ক সম্পাদক হিসেবে আবিষ্কার করি এর কিছুদিন পরে। ৭৩/৭৪ থেকেই আমি তৎকালীন সাপ্তাহিক পত্রিকা বিচিত্রায় নিয়মিত লিখি। সেখানেই এক পর্যায়ে শামসুর রাহমান দায়িত্ব নেন সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির। তিনি তখন গদ্যও লেখা শুরু করেছিলেন। কবির গদ্য অন্যরকম এক আনন্দের খোরাক ছিল। আরও পরে তিনি যখন রাজনীতি সমাজ নিয়ে লিখতে থাকেন, সেটা অবশ্য ধরিয়ে দেয় অনুভুতির তীব্রতা, সমাজ রাষ্ট্র নিয়ে উপলব্ধির জন্য যথেষ্ট নয়।

শামসুর রাহমানের কবিতায় আমরা পেয়েছি নানা স্ববিরোধিতা আর জটিলতার নগর, পেয়েছি ব্যক্তির অন্তর্গত বোধ দুঃখ আনন্দ বেদনা ক্ষোভ ভয়, আর পেয়েছি প্রবল ভালোবাসার টান। কিন্তু এগুলোর বাইরে যেখানে তিনি বিশিষ্ট সেটি হল কবিতার রূপকল্পে, তার মায়াময়তা আর ছন্দময়তার মধ্যে সমষ্টির আবেগ ক্রোধ ভালোবাসা আর রক্তের ডাক; যা তিনি শৈল্পিক শক্তিমত্তা দিয়ে ঠিকই ধারণ করতে পেরেছিলেন।

শামসুর রাহমানের গুরুত্ব তো শুধু কবি হিসেবে নয়, আবার সেই কবি হিসেবেও যিনি নিজেকে অতিক্রম করতে সক্ষম তাঁর কবিতায়। শামসুর রাহমানের সঙ্গে যারা মিশেছেন তারা বোধকরি এমন একজন মানুষকেই দেখেছেন যিনি সরল, দ্বিধাগ্রস্ত, বিনয়ী, সংশয়ী এবং নিশ্চিতভাবে দুঃসাহসী নন। কিন্তু এই দেশের প্রতিটি উথাল পাথাল সময়ে, যখন মানুষ আক্রান্ত কিংবা মানুষ যখন কঠিন দুঃসাহসে প্রতিরোধে শামিল, আমরা তার স্বাক্ষর তাঁর কবিতায় ঠিকই পেয়েছি। আসাদের শার্ট কবিতা বাদ দিয়ে কি এখন আমরা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এর প্রাণ খোঁজার চিন্তা করতে পারি? ’৭১-এ তিনি তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত ছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে দেশের ভেতরে মৃত্যুর মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষের রক্তক্ষরণের শব্দাবলী আমরা পাই তাঁর বন্দী শিবির থেকে-তেই। এরপর দুর্ভিক্ষ, সামরিক শাসন প্রতিটি পর্বেই শামসুর রাহমান আছেন। সেজন্য বাংলা সাহিত্যে তিনি যে বাংলাদেশকে প্রবলভাবে উপস্থিত করেছেন সেখানে আছে এই অঞ্চলের বিশিষ্টতা, শব্দে প্রতীকে আর লড়াইয়ে।

শুধু কবিতাতেই নয় দুর্বল একটি আপাত চেহারা থাকলেও যখন সবচাইতে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেবার দরকার ঠিকই নিয়েছেন তিনি। ’৭৫-এ সব দল বাতিল করে বাকশাল হল, দলে দলে সবাই বাকশালের সদস্যপদ নেবার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো, রাজনৈতিক একাত্মতা থেকে নয়, ভয়ে আর সুবিধাবাদিতায়। তখন অনেক ‘বিপ্লবী’ও একই কারণে সেই স্রোতে শামিল হয়েছিলেন। হাতে গোণা যে কয়জন নিজের মত ও পথকে এক করে রেখেছিলেন তাদের মধ্যে শামসুর রাহমান একজন। শাহাদৎ ভাই এর কাছে শুনেছি, শামসুর রাহমান শূন্য পকেটের কাপড় বের করে তখন বলেছিলেন- ‘কী আছে আমাদের, এক আত্মমর্যাদা ছাড়া? সেটাও যদি ভয়ে সমর্পণ করি তাহলে আর অবশিষ্ট কী থাকে?’ এই আত্মমর্যাদার বোধ তাঁর কবিতাকেও ঋজু রেখেছে সারাপথ।

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যতক্ষণ শরীর অনুমোদন করেছে ততক্ষণ তিনি সক্রিয় থেকেছেন চিন্তায়, লেখায় এমনকি সামষ্টিক উদ্যোগে। তাঁর সঙ্গে সর্বশেষ যে অনুষ্ঠান একসঙ্গে করেছি সেটা ছিল হুমায়ুন আজাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর। তখনও তাঁর শরীর কাজ করছে না ভালো। কিন্তু তিনি ঠিকই এসেছিলেন, দীর্ঘসময় অনুষ্ঠানে ছিলেন। এরকম আরও অনেক সমাবেশ তাঁকে ঠিকই পেয়েছে।

কবির বিশাল হৃদয় ক’জন কবির থাকে? তাঁর ছিল। বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য, নিপীড়ন আর আধিপত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে তাঁর সংশয় দেখি নি কখনো। এই কারণেই সব হতাশা আর ক্লান্তির বোধের মধ্যে তাঁর কবিতায় সেই মানুষকে পাওয়া যায়, যে স্বপ্ন দেখে এবং দেখে মানুষেরই সবলতাকে।

২১ আগষ্ট ২০০৬        

আনু মুহাম্মদ : লেখক, অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়