Full premium theme for CMS
রক্তকরবী ও নাট্যত্রয়ী : নির্দেশকের কথা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
আমাদের বাঙালি সমাজের কতগুলো অদ্ভুত অভ্যাস আছে এবং আমি নিজেও এর বাইরে নই। এই অদ্ভুত অভ্যাসের মধ্যে অতিশয়োক্তি একটি এবং আরেকটি হল অতি আবেগপ্রবণতা। আমাদের বিনয় প্রকাশ ও ভব্যতারও কিছু স্তর আছে যা অন্য কোথাও দেখা যায় না। পাশ্চাত্যে তো নয়ই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এশিয়ার এই চারিত্র্যকে সার্বিকভাবে Inarticulate Asia (অস্পষ্ট এশিয়া) বলেছেন। আমরা আধো আধো কথা বলি। কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে চা-নাস্তা খেতে বললে আমরা সাধারণত বলি, না থাক। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এই ‘না’ বলাটা অতিথি এবং অতিথিসেবক কেউ বিশ্বাস করে না। ফলে, চা-নাস্তা ঠিকই পরিবেশিত হয় এবং অতিথিও ‘এসবের কী দরকার ছিল’- জাতীয় সামান্য কিছু ওজর আপত্তি করে খাদ্য গ্রহণ করে।
প্রকারান্তে, পাশ্চাত্যে কেউ যদি আপনাকে চা-নাস্তা খেতে বলেন এবং আপনি যদি ‘না’ বলেন; উনি না’কে ‘না’-ই ধরে নেন এবং আপনি চা-নাস্তার টিকিটিও দেখেন না। যা বলা হল, তা বাঙালির দোষের মধ্যে পড়ে না, এ শুধু তার মানসিকতার সামান্য পরিচয়বহ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙলা সাহিত্যের সিংহভাগ দখল করে আছেন। অথচ বেশীরভাগ বাঙালি তাঁর লেখার সাথে তেমন পরিচিত নন, কিন্তু তাঁর লেখা বা গানের প্রসঙ্গ উঠলে গদগদ হয়ে ওঠেন। আবার এমনও মুসলমান বাঙালি আছেন যারা রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু কবি মনে করেন এবং পাশাপাশি এ-ও মনে করেন যে উনি একজন অত্যাচারী হিন্দু জমিদার ছিলেন, যাঁর লেখায় মুসলমানদের হেয় করা হয়েছে এবং জমিদার হিসেবে উনি নিপীড়ক ছিলেন ইত্যাদি। এ সবই অজ্ঞতাপ্রসূত মতাভিমত। প্রথমত- রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, তাঁর পরিবার ছিল একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত যারা মূর্তি পুজা করেন না। রবীন্দ্রনাথের বিপুল লেখনী সম্ভারে এবং দীর্ঘ জীবনাচরণে কোথাও সাম্প্রদায়িকতার কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। বাংলাদেশের একটি অঞ্চলে শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একদল বালক-বালিকা মনে করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি নজরুল ইসলামের লেখা চুরি করে নোবেল কমিটিতে পাঠান এবং সেই লেখার সুবাদে তিনি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এটা আমার বানানো কথা নয়। আমাদের দেশের নাম করা একজন সঙ্গীতজ্ঞের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আমি এই ঘটনা জেনেছি। এখানেও সেই অজ্ঞতা কাজ করেছে। এ ক্ষেত্রে বালক-বালিকার কোনো দোষ নেই, তাদের বাবা-মা’রা তাদের যা বলেছে, তারা তাই বিশ্বাস করেছে। এখানেও বিচার্য বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথ হিন্দু কবি এবং নজরুল মুসলমান কবি; অথচ এঁদের দু’জনের সাহিত্যকর্মের সাথে কারো বিশেষ পরিচয় নেই, সবাই শোনা কথা বলে বেড়ায়। তা নাহলে নজরুল ইসলামের মত এতবড় অসাম্প্রদায়িক কবি কীভাবে আমাদের দেশে শুধুমাত্র মুসলমানদের কবি বনে যান। কীকরে তাঁর ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’, ‘সজীব করিব গোরস্থানে’ পর্যবসিত হয়! এই ভূমিকা করা হলো রবীন্দ্রনাথের নাটকের বিষয়টি উত্থাপন করার জন্যে।
রক্তকরবী রবীন্দ্রনাথের খুব পরিচিত একটি নাটক কিন্তু আম-জনতার বেশীরভাগ মানুষই নাটকটি পড়েননি অথবা এর মূল ভাবের সাথে তাদের পরিচয় নেই। তবুও রক্তকরবী নাম শুনলে সবাই ভাবের মধ্যে পড়ে যায়, বলে ওঠে- আহা! রক্তকরবী রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁর পারিবারিক বৃত্তে একবার অভিনীত হয়েছিল এবং সেটাও বলার মত তেমন কিছু ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ১৩ বছর পরে বিখ্যাত নাট্যকার ও নির্দেশক শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় কোলকাতার ‘বহুরূপী’ নাট্যদল রক্তকরবী’র সার্থক প্রযোজনা উপস্থাপন করে। শোনা যায়, নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী মন্তব্য করেছিলেন যে, রক্তকরবী’ ঠিক অভিনয়যোগ্য নাটক নয়। শিশির কুমার ভাদুড়ী ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের মানুষ ছিলেন এবং তিনি রবীন্দ্রনাথের একাধিক নাটক সাফল্যের সাথে কোলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ে মঞ্চায়ন করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের স্বনামধন্য নাট্যকার ও নির্দেশক বাদল সরকার রক্তকরবী’কে ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন তবে সে উপস্থাপনা সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সাধারণ দর্শকের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য হয়নি। বাংলাদেশে স্বাধীনতা পূর্বকালে ড্রামা সার্কেল রক্তকরবী’র কয়েকটি প্রদর্শনী করেছিল যা রসোত্তীর্ণ হয়েছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশ সংস্কৃতি সংসদ বাংলা একাডেমীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে রক্তকরবী’র একটি প্রদর্শনী করেছিল যা সুখ্যাতি পেয়েছিল। তখন আজকের মত দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চা শুরু হয়নি, সুতরাং কোনো নাটকের প্রদর্শনী দু’তিনটির বেশি হতো না। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিশাল সেটের সামনে, বিশেষ যতেœর সাথে বহুগুণের অধিকারী মুস্তাফা মনোয়ার নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে রক্তকরবী প্রযোজনা করেছিলেন, যা টিভি প্রযোজনার ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক হয়ে আছে। বলা প্রয়োজন, এই প্রযোজনা সাদা-কালোতে ধারণ করা হয়েছিল, কারণ তখনও বিটিভি রঙ্গিন হয়নি। চট্টগ্রামের তির্যক নাট্যদল গত কয়েক বছর ধরে রক্তকরবী নাটকের নিয়মিত প্রদর্শনী করে আসছে, এ পর্যন্ত কয়টি প্রদর্শনী হয়েছে তা আমার জানা নেই। এই প্রযোজনাও সফল, তা না হলে নিয়মিত প্রদর্শনী সম্ভব হতো না। এখানে বলা প্রয়োজন যে, নাট্য প্রযোজনার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থাকে, একই নাটক ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয় বিভিন্ন নির্দেশক ও নাট্যদল দ্বারা। সমালোচকের গ্রহণযোগ্যতা ও সাধারণ দর্শকের গ্রহণযোগ্যতা এক নয়। তবে মৌলিক যেকোনো নাটকের পরিবর্তনের নামে ন্যূনতম বিকৃতি ঘটানো বৈধ নয়। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় প্রযোজিত ও বর্তমান লেখক নির্দেশিত রক্তকরবী’ এক নাগাড়ে ৬৪ প্রদর্শনী সম্পন্ন করেছে। এই প্রযোজনাটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে এবং পত্র-পত্রিকায় বহুল আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। এই প্রযোজনাটি বেশ প্রশংসাই পেয়েছে, তবে নিন্দিত যে একেবারেই হয়নি, এমন নয়। নির্দেশকের এই প্রযোজনাকে কেন্দ্র করে এতটুকুই কৈফিয়ৎ দেবার আছে যে, তিনি নাটকটির সামান্য সম্পাদনা ছাড়া কোনো পরিবর্তন করেননি। সম্পাদনা করা হয়েছে, অভিনয়ের সময়সীমার কথা ভেবে। রবীন্দ্রনাথের নাটক ও গান নিয়ে কোনো প্রকার নিরীক্ষা চালানো অনুচিত বলে মনে হয়। তাঁর কাজ নিয়ে নব ব্যাখ্যা হতে পারে। তাঁর গানের সুর পাল্টানো অবৈধ, তবে বৈচিত্র্য আনার জন্যে গায়কীর হের-ফের নিশ্চয় হবে। তাঁর নাটকের সংলাপ পাল্টানো অনুচিত কারণ রবীন্দ্রনাথের মত ভালো সংলাপ রচনা বিশ্ব নাট্যসাহিত্যে বিরল। আসলে রবীন্দ্রনাথের মত মেধাবী ও সৃজনশীল মানুষ শুধু উপমহাদেশে কেন সারা বিশ্বে বিরল। তাঁর কাজ নিয়ে নিরীক্ষা যিনি চালাবেন তাঁকে আরো মেধাবী হওয়া প্রযোজন, যা অসম্ভব বলে মনে হয়। সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রাথের নষ্টনীড়’কে চারুলতা চলচ্চিত্র বানাবার বেলায় বেশ কিছু স্বাধীনতা নিয়েছেন, কারণ লেখনী ও চলচ্চিত্র, মাধ্যম হিসেবে ভিন্ন এবং সর্বোপরি কাজটি করেছেন অনন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় যিনি বড় বড় লেখকদের কাজের সাহিত্য মূল্য অক্ষুণ্ন রেখে চলচ্চিত্র নির্মাণে সক্ষম ছিলেন।
বর্তমান লেখকের সম্প্রতি নির্দেশিত ও নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় প্রযোজিত কর্ণকুন্তুী সংবাদ, বিদায় অভিশাপ ও গান্ধারীর আবেদন নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি থাকতে পারে এবং তেমনটি আঁচ করা গেছে। এই তিনটি নাটক নাট্যত্রয়ী নামে একসাথে প্রদর্শিত হচ্ছে। নাট্যত্রয়ী’র তিনটি নাটক রবীন্দ্রনাথের কাব্য-নাটক ছাড়া অন্য কিছু নয়। তিনটি নাটকই কলেবরে ছোট, যাকে বাংলা ভাষায় নাটিকা বলে। বর্তমান লেখকের এটা দ্বিতীয় কৈফিয়ৎ যে নাট্যত্রয়ী’র তিনটি নাটক সম্পূর্ণত নাটকই, কোনো কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নৃত্য বা গীতি নাটকের নাট্যরূপ নয়। তিনটি নাটকই মহাভারতের আখ্যানভাগ নির্ভর, তিনটি নাটকের কেন্দ্রে আছেন তিনজন নারী এবং তিনটি নাটকই বর্তমানের সমাজ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অর্থবহ। আশাকরি, নাগরিক-এর রক্তকরবী প্রযোজনা সম্পর্কে এই বিভ্রান্তি থাকবে না যে, নাটকটি পরিবর্তিতভাবে মঞ্চায়ন করা হয়েছে। আরেকটি বিভ্রান্তি দূর হোক যে, নাট্যত্রয়ী রবীন্দ্রনাথের ‘কাব্য নাটক’,- অন্য কিছু নয়।
আতাউর রহমান- অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক। সদস্য- নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়