Full premium theme for CMS
ঢাকার থিয়েটার, জানুয়ারি-জুন ২০০৫ : সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি কলাকুশলীগণ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৫, শুক্রবার সকাল ০৯:১৫ মিনিটে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা’র এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে আয়োজন করা হয় এক মুখোমুখি অনুষ্ঠানের। উন্মুক্ত এই আলাপনের শিরোনাম ছিল ‘ঢাকার থিয়েটার, জানুয়ারি-জুন ২০০৫ : সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি কলাকুশলীগণ’। অনুষ্ঠানে সরাসরি দর্শকদের মুখোমুখি হন জানুয়ারি-জুন ’০৫-এ ঢাকার মঞ্চের নতুন নাটক চে’র সাইকেল, বিনোদিনী, শ্যামাপ্রেম, মানগুলা ও মেটামরফোসিস-এর নাট্যকার-নির্দেশক ও ডিজাইনারগণ। তাঁরা হলেন- মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, কামালউদ্দিন নীলু, কামালউদ্দিন কবির, ফয়েজ জহির, গোলাম শফিক, আমিনুর রহমান মুকুল, অনন্ত হিরা, ইশরাত নিশাত ও এস এম রিয়াদ তুষার। অনুষ্ঠানটি একটানা চলে দুপুর পৌনে ২ টা পর্যন্ত। থিয়েটারওয়ালা আয়োজিত এই উন্মুক্ত আলাপনটি অনুলিখন করে ছাপা হলো এই সংখ্যায়। অনুলিখন করেছেন থিয়েটারওয়ালার সহকারী সম্পাদক সাইফ সুমন]
হাসান শাহরিয়ার
সুধি দর্শকবৃন্দ, শুভসকাল। থিয়েটারওয়ালার আয়োজনে ‘ঢাকার থিয়েটার, জানুয়ারি-জুন’০৫ : সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি কলাকুশলীগণ’ বিষয়ক উন্মক্ত আলাপনে আপনাদের স্বাগত জানাই। আমরা ঠিক ৯:১৫ মিনিটে আমাদের নির্ধারিত অনুষ্ঠান শুরু করছি। আজকের নির্দিষ্ট নাটকগুলোর নাট্যকার, নির্দেশক ও অন্যান্য ডিজাইনারদের মঞ্চে উঠে আসবার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।
আজকের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাটা আমি সংক্ষেপে বলে দিচ্ছি। পাঁচটি নাটকের প্রত্যেকটির জন্য আমরা একঘন্টা করে বরাদ্দ রেখেছি। এই একঘন্টায় মঞ্চে উপস্থিত শিল্পীদেরকে তাদের নির্দিষ্ট নাটকের কাজের ব্যাপারে যেকোনো ধরনের প্রশ্ন করতে পারবেন। তবে এই বরাদ্দকৃত একঘন্টা একটানা হবে না। প্রথমে আধঘন্টা করে প্রত্যেকে পাবে, তারপর আবার ফিরে এসে বিশ মিনিট করে প্রত্যেক নাটক সময় পাবে। এবং সবশেষের পঞ্চাশ মিনিট বরাদ্দ রাখছি উন্মুক্ত আলোচনার জন্য। যে কেউ যেকোনো নাটকের উপর প্রশ্ন করতে পারবেন। তাহলে আমরা মূল অনুষ্ঠানে চলে যাই। প্রথমেই আমরা প্রশ্ন চাচ্ছি চে’র সাইকেল নাটকের উপর। এখানে উপস্থিত আছেন চে’র সাইকেল-র নাট্যকার মামুনুর রশীদ এবং নির্দেশক, সেট-লাইট-কস্টিউম ডিজাইনার ফয়েজ জহির।
বিপ্লব বালা
(নাট্যজন, নাট্যশিক্ষক, সদস্য- জিয়নকাঠি)
চে’র সাইকেল সম্পর্কে প্রথমেই জানতে ইচ্ছা করে যে হঠাৎ চে’র সাইকেল কেন? কারণ আমরা জানি যে, সত্তর দশক পর্যন্ত গোটা পৃথিবীর হিরো ছিলেন তিনি। এখন তো দিন দুনিয়া পাল্টে গেছে ... এখন আবার চে কেন? প্রশ্নটা আমি নাট্যকারকে করছি।
মামুনুর রশীদ
(নাট্যজন, নাট্যকার- চে’র সাইকেল)
খুবই জরুরি এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। তো এটার খুব সাধারণ উত্তর হতে পারে এরকম যে, চে-কে বহু বছর আমাদের চেতনায় ধারণ করে আছি এবং মনে হয়েছে যে, এসময় আবার সামনে নিয়ে আসা দরকার। আজকে সারাবিশ্বে গ্লোবালাইজেশন শুরু হয়েছে। গ্লোবালাইজেশনের প্রধান বিষয়টাই হচ্ছে মার্কেট ... সারা পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ তার মার্কেটটা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এবং এই মার্কেট ছড়িয়ে দিতে গিয়ে যেটা হয়েছে যে, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের চেতনা, আমাদের যে সংগ্রামী চেতনা, এগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। কতগুলো বিপর্যয়, বিশেষ করে আশির দশকে বা নব্বুয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে যে বিপর্যয়গুলো হয়েছে সে বিপর্যয়ের পর মানুষ এত ব্যক্তিগত হয়ে গেছে ... মানে সামাজিক মানুষকে এত বেশি ব্যক্তিগত মানুষে পরিণত করার চেষ্টা চলছে যেটা ওয়েস্টে বহু বছর চেষ্টা করে এক ধরনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বের মানুষ ছিল ভীষণভাবে সামাজিক মানুষ। ... আজকে বাংলাদেশের একজন মানুষ বলিভিয়ার কথা ভাববে, কিউবার একজন নাগরিক বাংলাদেশের কথা ভাববে, ভারতের একজন মানুষ বাংলাদেশের কথা ভাববে ... এই যে চে, চে’কে কেন আমরা মনে করি, স্মরণ করি? এই চে নিজেকে বিশ্বের নাগরিক মনে করতেন ... আমার নাটকেই চে যখন মারা যাচ্ছে তখন একটা সংলাপ আছে ... তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো যে- আপনি কি আর্জেন্টিনবাসী? তখন জবাব দিচ্ছেন- না, আমি শুধু আর্জেন্টিনার না, আমি কিউবার, আমি মেক্সিকোর, আমি আফ্রিকার, আমি সকল এশিয়ার, সকল দেশের নাগরিক। সকল দেশের প্রতি আমার নাগরিক দায় সমান। তো এই যে ইন্টারন্যাশনালিজম, এই জায়গাটা ব্যর্থ হয়েছে পরবর্তী সময়ে। তাই এই পরিস্থিতিতে চে’কে খুব মনে পড়তে বাধ্য। এই লোকটি সারা বিশ্বকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন ... হয়ত বা তার চিন্তায় কিছুটা এ্যাডভেঞ্চারিজম থেকে থাকবে, যে কারণে জন্য উনি মারাও গেলেন ... কিন্তু এই লোকটাকে যে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা গেলেন, এটাকে কি আমরা মারা গেলেন বলবো? না, মারা যাননি বরং সারা বিশ্বে উনি নায়ক হয়ে দাঁড়ালেন। আমরা যখন নাটকটি মঞ্চে আনার পরিকল্পনা করি, তখন একটু বেশ দ্বিধান্বিতই ছিলাম যে আমরা যারা ষাটের দশকে ছাত্র ছিলাম বা রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম, তাদের কাছে চে রেলিভেন্ট, কিন্তু এখনকার দর্শকদের কাছে রেলিভেন্ট হবে কিনা। কিন্তু আমি খুব অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি যে, এই নাটকের অধিকাংশ দর্শক তরুণ প্রজন্মের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত মঞ্চে যখন অভিনয় করলাম বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রদের অনুষ্ঠানে যখন নাটকটি করলাম, তখন দেখেছি যে, তরুণরাই বেশি আগ্রহী, কৌতুহলী। মহিলা সমিতি মঞ্চে অভিনয়ের পর ক্লাশ নাইনে পড়–য়া এক মেয়ে আমাকে চে’র সম্পর্কে তার ভাবনাটা বলেছে। তো এ সব কিছু মিলিয়েই আমার কাছে চে’কে উপস্থিত করার বাসনা জাগে এবং এই নাটকটি করার উদ্যোগ নিই।
জুবায়ের
আচ্ছ আমরা যারা নাটকটি দেখিনি, তারা কি নাটকটা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে পারি?
হাসান শাহরিয়ার
আমি অনুরোধ করবো, যারা নাটকটগুলো দেখেছেন তারাই প্রথমে যেন প্রশ্ন করেন, ধন্যবাদ।
জাহিদ রিপন
(নাট্যজন, সদস্য- স্বপ্নদল)
চে’র সাইকেল নাটকে অভিনেতা অভিনেত্রী কম, এবং আপনারা বিভিন্ন মঞ্চে এই নাটকটি করে থাকেন- মহিলা সমিতি, নাটমণ্ডল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ের মুক্তমঞ্চ এবং আবার এই এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে-ও করেন। তো এই একেক জায়গায় করতে গিয়ে দর্শকের অনুভূতির ভিন্নতা পান কিনা বা আপনারা অভিনয় করার সময় নিজেদের অনুভূতির ভিন্নতা পান কিনা?
মামুনুর রশীদ
মঞ্চ পরিবর্তন হলে অনুভূতিরও পরিবর্তন হয়, স্পেস একটা ইম্পোর্টেন্ট বিষয় নাটকে। এক্সপেরিমেন্টাল হলের মঞ্চের ডেপথ-টা কম, কিন্তু এখানে একুয়াস্টিক সিস্টেমটা খুবই ভালো। প্রপার লাইট করা যায়, ফলে অভিনয় করার সময় এখানে এসব টেকনিক্যাল ভাবনাগুলো কাজ করে না, ফলে অভিনয়টা বেশ খোলে। আবার মহিলা সমিতিতে করার সময় বেশ আস্থা পাওয়া যায়। এটা আমাদের অনেক পুরোনো জায়গা, আবার ওখানে কম্পোজিশনটাও ভালো দাঁড়ায়। ওখানে অনুভূতিও অন্যরকম। আর নাটমণ্ডলে একটু সমস্যা আছে, মূল স্টেজটার স্পেস সমস্যা, তবে সেখানে ইন্টিমেট থিয়েটারের একটা এ্যাটমোসফেয়ার পাওয়া যায়। আর আরেক ধরনের চমৎকার অনুভূতি মেলে হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে। এক সাথে এতো দর্শক, এতো ভালো দর্শকের সামনে অভিনয় করার মজাই আলাদা।
হাসান শাহরিয়ার
মঞ্চে অন্যান্য নাটকের যারা ডিজাইনার আছেন তারাও প্রশ্ন করতে পারেন। আমি এ পর্যায়ে চে’র সাইকেল- নাটকের ব্যাপারে ফয়েজ জহিরকে প্রশ্ন করবার জন্য অনুরোধ করছি।
ফয়সাল রাজিব
(নাট্যজন, সদস্য- নাট্যকেন্দ্র)
ফয়েজ জহিরভাইকে প্রথমেই ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি নাটক মঞ্চে আনার জন্য। ... আপনার নাটকে তিনজন পারফরমার, এদের মধ্যে মামুনস্যার এবং চঞ্চলভাই ভালো করলেও নারী চরিত্রটিকে একটু ধীর গতির মনে হয়েছে। এটা কি আপনারও মনে হয়েছে, যদি হয়ে থাকে কেন হলো?
ফয়েজ জহির
(নাট্যজন, নির্দেশক-সেট-লাইট ও কস্টিউম ডিজাইনার- চে’র সাইকেল)
প্রশ্নটা অভিনয় নিয়ে, আমি মনে করেছিলাম মঞ্চ বা পোশাক নিয়ে প্রশ্ন আসবে ... যাক্, অভিনেতাদের ব্যাপারেও আমার দায় থেকেই যায়। সেখান থেকেই জবাব দিচ্ছি। এখানে নারী চরিত্রের যে ধীর লয়ের কথা বলা হলো, সেটা কিন্তু ঐ চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ডই ঐরকম। তবে একই অভিনেত্রী যখন আরেকটি চরিত্রে অভিনয় করেন তখন ভিন্নতা আসে কিনা? প্রসঙ্গত আপনারা জানেন যে, এই নাটকে পারফরমার তিনজন হলেও চরিত্র কিন্তু তিনটি না, প্রত্যেকেই একাধিক চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন। তো আমি আপনার সাথে একমত হচ্ছি এক জায়গায়, সেটা হলো সোহেলী চরিত্রটি (যেটি আসলেই ধীর গতির) করার পর সে যখন আলেইদা’র চরিত্রে চলে যায়, যেটি কিনা একটু চঞ্চলমতী হওয়ার কথা, সেখানে ধীর থেকে চঞ্চল হতে সে অনেক বেশি সময় নিয়ে নেয়। এতো সময় নেয়াটা আমি চাইনি। তো সেখানে সে এখনো চেষ্টা করছে, আরেকটু দ্রুত অন্য চরিত্রের স্পীডটা ধরতে। আপনাকে ধন্যবাদ।
শামীম সাগর
(নাট্যজন, সদস্য- পালাকার)
চে’র সাইকেল দেখতে গিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে একটু উচ্চ গ্রামে সংলাপ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এবং দুজন চরিত্র যখন কথা বলছে তখন মনে হয়নি, তাদের মধ্যে যোগাযোগটা সেভাবে আছে। এ ধরনের কেন?
ফয়েজ জহির
আমি জানি না আপনি কবে দেখেছেন ... নাটকের শুরুতেই চরিত্রগুলো কিন্তু ইনডিভিজুয়ালই থাকে, আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠে। তো এই সম্পর্কগুলো গড়ে উঠতে একটু সময় নেয়। এই সময়টুকু আমরা ইচ্ছাকৃতভাবেই নিই। তারপর চরিত্রগুলোর মধ্যে যখন ইন্টারেকশন শুরু হয়, তখন এই অসংলগ্নতাগুলো বোধহয় আর থাকে না। আর যদি থাকে তাহলে আমার মনে হয় আপনি প্রথম দিকের শো দেখেছেন। এখন আমার মনে হয় না, এ ব্যাপারটা আছে।
হাসান শাহরিয়ার
এখন আমি প্রশ্ন চাইবো ঢাকা থিয়েটারের বিনোদিনী নাটকের উপর।
গোলাম শফিক
(নাট্যজন, সদস্য- পালাকার, নাট্যকার-মানগুলা)
বিনোদিনী দেখবার পর, এর অভিনয় দেখবার পর একটা মুগ্ধতা আসে আমার মধ্যে কিন্তু যে বেদনাবোধ বা বিষণ্নতা নিয়ে বের হওয়ার কথা ছিল, সেটা আমার মনে হয়নি। কিন্তু আমার একটি পূর্ব ধারণা ছিল যে, একটি নাগরিক আবহ পাবো ... তো সেটি পেলেও বেদনাবোধ সেভাবে পাইনি। এ ব্যাপারে বাচ্চুভাইকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
(নাট্যজন, নির্দেশক- বিনোদিনী)
নাগরিক আবহটা কিন্তু স্বাভাবিক, কারণ, বিনোদিনী কিন্তু শহরের থিয়েটারটা করেছে। বিনোদিনী-র মেলামেশা ছিল উচ্চবিত্তের মানুষের সাথে। এটি তার পেশার কারণে ঘটেছে। ন্যাশনাল থিয়েটার, গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার, বেঙ্গল থিয়েটারসহ যেখানেই সে কাজ করেছে, পুরো পরিবেশটাই কিন্তু আধুনিক কোলকাতার। সুতরাং এটা মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে আমরা একটা নিউট্রাল স্পেস দেখতে চেয়েছিলাম যেটা আধুনিক থিয়েটারের প্রারম্ভিক সময়ের। আর বেদনাবোধটা ম্যান টু ম্যান ভেরি করে। এই থিয়েটারটা করার সময় সবসময়ই ভেবেছি যে এটা বিনোদিনীকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্যই করছি। আর এটাকে আমি সবসময়ই ‘পরিবেশনা’ বলেছি ... বিনোদিনীর আত্মজীবনীর পরিবেশনা- এর মাঝখানে যা আছে সেটা একজন আধুনিক থিযেটার নির্মাতা হিসেবে কিছু করার চেষ্টা। সুতরাং সর্বত্র একধরনের উজ্জ্বলতা, চাকচিক্য কাজ করেছে, কোথাও মলিনতা স্পর্শ করেনি। আমি খুব সচেতনভাবেই এটা করেছি, কারণ, আমি বিনোদিনীকে মলিন দেখতে চাইনি।
অনন্ত হিরা
(নাট্যজন, নির্দেশক-শ্যামাপ্রেম)
বাচ্চুভাইয়ের কাছে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই যে, এই কাজটি করতে গিয়ে আপনি বিনোদিনীর কোন দিকটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন ... মানে বিনোদিনীকে নিয়ে কাজ করার মতো অনেক এলিমেন্টস ছিল ... তার উপর নাটক হয়েছে, লেখালেখিও হয়েছে, তো এর মধ্য থেকে এই ডায়েরিটিকে কেন নির্বাচন করলেন?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আসলে যখন ঠিক করলাম যে বিনোদিনীকে শ্রদ্ধা জানাতে একটা কাজ করবো, তখন এটা নিয়ে নানাজনের সাথে কথা বলেছি। তার উপর বের হওয়া লেখাগুলো পড়েছি, সিডিটা শুনেছি কিন্তু কোনোটাতেই আমার মন ভরেনি বা আমাকে স্পর্শ করেনি। লেখাগুলো আমার কাছে ফিকশন মনে হয়েছে। যে যার মতো করে লিখে গেছেন। কিন্তু যদি আমি একজন মানুষকে সম্মান জানাতে চাই তাহলে সেই মানুষটি সম্পর্কে সত্য মিথ্যায় যে ফিকশন লেখা হয়েছে সেটা নিয়ে আসবো, নাকি তার নিজের কথাগুলো, সেগুলোকে নিয়ে আসবো? তখন আমরা বিনোদিনীর দুটি আত্মজীবনীর আশ্রয় নিলাম এবং তার শিল্প সংগ্রামের জায়গাটার উপর আমি বেশি জোর দিতে চেয়েছি। ধন্যবাদ।
ফয়েজ জহির
বাচ্চুভাই বললেন যে, আপনি বিনোদিনীর সৃজনশীল জায়গাটাই উজ্জলতর করতে চেয়েছেন। কিন্তু ওনার জীবন সংগ্রামের জায়গাটা যদি তুলে ধরা যেত, তাহলে ওনার জীবনের যে স্ট্রাগল বা আজকের সময়েও তো আমাদের স্ট্রাগলগুলো আছে ... তো সেই জায়গাটা পেলে কি ভালো হতো না?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, এটার জন্য আমাকে তাহলে এ যুগের একজন লেখককে দিয়ে লেখাতে হতো নতুনভাবে। আর জীবন সংগ্রামটাকে আমি একটু অন্যভাবে দেখি। আমি মনে করি আমাদের আধুনিক থিয়েটারে দৈন্য এবং দুর্বলতা হচ্ছে পূরাণের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা। মধ্যবিত্তের ... আমাদের এই জীবন তত গভীর নয়, সংকটগুলো যত গভীরই হোক না কেন এই বিশ্বায়নের কালে আমাদের জীবন বোধগুলো, জীবন সংঘাতগুলো এত গভীরতা অর্জন করতে পারেনি, যেখান থেকে কাব্য উঠে আসতে পারে। আমার কাছে মনে হয়েছে যে পূরাণ আশ্রিত চরিত্রগুলোই সবসময় বড় চরিত্র হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য আমরা অনেক ভেবে চিন্তে তিনটা নারী চরিত্র রেখেছি- এরা হলো প্রমীলা, চিত্রাঙ্গদা এবং সীতা। এই তিনটি চরিত্র এই জন্যই বেছে নিয়েছি যে এদের মধ্য দিয়ে জীবন সংগ্রাম গভীরভাবে উপস্থাপন করা যায়। যেহেতু একটু ভেতরে গিয়ে কাজটা করতে চেয়েছি সেজন্য এই আশ্রয়টা নিয়েছি। আর জীবন সংগ্রামের ব্যাপারটা তো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মোটামোটি পরিষ্কার আছে। আর স্ট্রাগলের ব্যাপারটা ওনার লেখায় যতটুকু ছিল, ততটুকুই রাখার চেষ্টা করেছি।
ফয়েজ জহির
আমার কবিরভাইয়ের কাছে একটা প্রশ্ন আছে। বিনোদিনী-র সেটে উনি একটা কার্ব লাইন নিয়ে এসেছেন এবং কিছু হিউম্যান ফিগার নিয়ে এসেছেন, এই হিউম্যান ফিগারহুলো আপনি কেন নিয়ে এসেছেন?
কামালউদ্দিন কবির
(নাট্যজন, সেট ডিজাইনার- বিনোদিনী)
এই নাটকটির মূল বিষয় হচ্ছে আমাদের আধুনিক মঞ্চনাটকের বা শহুরে নাট্যচর্চার সূচনালগ্নের অন্যতম অভিনয়শিল্পীর জীবন, জীবন সংগ্রাম, শিল্পসংগ্রাম। তো একটি নাটক যখন আমরা মঞ্চে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি তখন আমরা ভেবেছি যে, নাট্যঘটনাটি কোথায় ঘটছে, কখন ঘটছে এবং কীভাবে ঘটছে। এই নাটকের ক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি যেটি তৈরি হয়েছে সেখানে এরকম কোনো সুনির্দিষ্ট ইংগিত বা বিবরণ ছিল না। সেটি একদিকে যেমন অসুবিধা আবার অন্যদিকে সুবিধাও আছে। এখানে স্পেস তৈরির স্বাধীনতা পাওয়া গেছে বেশি। আর যেহেতু অভিনয় শিল্পীর জীবন সংগ্রাম, শিল্প সংগ্রাম ... তার এই স্বল্পকালীন জীবনে ৯০টির মতো চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তো আমি কল্পনা করেছি বিনোদিনীকে, তার অনেক ছায়া, যে ছায়াগুলোর রেখাগুলো দেখার। যেহেতু একক একজন শিল্পী এটা উপস্থাপন করছেন, তো এই স্পেসে তার ছায়াগুলো বা তার সেই প্রতিরূপগুলো যেন উঠে আসে। ঐ কাপড়গুলো নানান চরিত্রকে প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে আর এই কাপড়গুলো দিয়ে ঐ ফিগারগুলোতে কোথাও একটু ঢাকা, কোথাও একটু খোলা ... যাতে পুরোপুরি একদম তার অভিনয়কে মূর্ত করে দেখাচ্ছি তা না হয়- এটা তার নানা প্রতিরূপ যেন হয়, এই চিন্তা থেকেই মূলত এই ফিগারগুলো দাড় করানো হয়েছে। ধন্যবাদ।
রতন দেব
(নাট্যজন, সদস্য-উদীচী)
বিনোদিনী বিষয়ে নির্দেশকের কাছে আমার একটু জানার আছে। বিনোদিনী যখন মঞ্চে এলো, তখন আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খুবই অস্থির ... ক্রসফায়ারে লোক মারা যাচ্ছে, শহীদমিনারে প্রবেশ বন্ধ করে দিচ্ছে, এরকম একটা অবস্থা। তো আমরা জানি যে, যখন কোনো একটা নাটক নির্বাচন করা হয়, তখন ঐ নাটকটাতে সমসাময়িক অনেক বিষয়ের বা ঘটনার ... মানে দর্শক হিসেবে ঐগুলো দেখতে চাই। তো বিনোদিনী-কে এই সময়ে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে নির্দেশক আসলে কীভাবে বা কতটুকু সমসাময়িকতা খুঁজে পান?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমার এই নাটকের মূল টার্গেট অডিয়েন্স হচ্ছে নাট্যকর্মীরা। বাইরের দর্শক যদি দেখে সেটা বাড়তি পাওনা। তো নাট্যকর্মীদের জন্য এই নাটক অনিবার্য ছিল কিনা, এটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। আমার কাছে মনে হয়েছে বিনোদিনীকে জানা বা সেই সময়টাকে জানা, সেই সময়ের থিয়েটারের সংগ্রামকে জানার একটা মিথষ্ক্রিয়া তৈরি করে। আর সমসাময়িকতার যে ব্যাপারটা ... সেটা হচ্ছে যে, ২০০ বছর আগের কোনো ঘটনাও যদি এখন নিয়ে আসা যায় এবং সেই ঘটনা যদি একজন দর্শকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, তাহলেও সেটি এখনকার থিয়েটারই হয়ে যায়। আর প্রতিটি নাটকেই রাজনৈতিক থিয়েটার হতে হবে সেটা আমার মনে হয় না।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। আমরা আপাতত আর বিনোদিনী-র উপর কোনো প্রশ্ন নিচ্ছি না। আমরা এখন প্রশ্ন চাইবো শ্যামাপ্রেম নাটকের উপর।
বিপ্লব বালা
রবীন্দ্রনাথ শ্যামা লিখেছেন জাতকের কাহিনী থেকে কাঠামো নিয়ে। কিন্তু আপনাদের শ্যামাপ্রেম কিন্তু ঠিক রবীন্দ্রনাথের শ্যামা না। তারপরও এটাকে রবীন্দ্রনাথের শ্যামাপ্রেম বলাটা কি ঠিক হচ্ছে? আমার প্রশ্নটা অনন্ত হিরার প্রতি।
অনন্ত হিরা
ধন্যবাদ দাদাকে, একটি সুন্দর প্রশ্ন করবার জন্য। গল্পের ছায়াটা যেহেতু রবীন্দ্রনাথের এবং চরিত্রগুলো ঠিক আছে, নামগুলোও ঠিক আছে ... তাছাড়া শ্যামা-র মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে কথাগুলো বলতে চেয়েছেন, সেই কথাগুলোই চিত্তরঞ্জন ঘোষ নাট্যরূপে বলতে চেয়েছেন, সে কারণে এবং যেহেতু নাট্যরূপেও রবীন্দ্রনাথের নাম লেখা আছে, তাই তাঁর নামটি ব্যবহার করাটা যৌক্তিক বলে আমার কাছে মনে হযেছে।
বিপ্লব বালা
নাট্যকার কি বলেছেন যে এটা রবীন্দ্রনাথের শ্যামা অবলম্বনে?
অনন্ত হিরা
হ্যাঁ, বলেছেন। উনি এটি বহুরূপী পত্রিকায় ছেপেছিলেন এবং সেখানে উনি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নৃত্যনাট্য অবলম্বনে।
বিপ্লব বালা
কিন্তু শ্যামাপ্রেম-এ তো রবীন্দ্রনাথের বিষয়টা একেবারেই পাল্টে গেছে ... শুধু কাহিনীর কাঠামো ছাড়া তো কিছুই নেই। সেজন্য রবীন্দ্রনাথের শ্যামাপ্রেম বলাটা একটু বোধহয় কেমন হয় না?
অনন্ত হিরা
এই দায়টা বোধহয় আমার আগে চিত্তরঞ্জন ঘোষের হাঃ হাঃ।
গোলাম শফিক
শ্যামাপ্রেম-এর নাট্যায়নটা যখন লক্ষ্য করছিলাম, নাটকটা দেখার সময়, তখন আমার কাছে মনে হয়েছে এটি একটি উঁচুমানের কাজ এবং মনে হচ্ছিল এটি রবীন্দ্রনাধিক ... এই শব্দটিই আমি বলতে চাই। কিন্তু দাদা (বিপ্লব বালা) যে প্রশ্নটি তুলেছেন, তাতে অনন্ত হিরার কাছে আমার প্রশ্ন, আপনার কী মনে হচ্ছে, এতে রবীন্দ্রবিচ্যুতি আছে কিনা?
অনন্ত হিরা
আমার সেরকম মনে হয়নি, আমার মনে হলে এ কাজটি করতাম না। আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানাভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা হতে পারে। সারা পৃথিবীতে শেক্সপীয়ারকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা হয়, তাহলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হতে দোষ কী? সেখানে রবীন্দ্রবিচ্যুতির বিষয়টি বোধহয় থাকে না। ধন্যবাদ।
জাহিদ রিপন
হিরাভাই, আপনারা যখন নাট্যদল গঠন করেছিলেন, তখন ঘোষণা ছিল যে, আপনারা রবীন্দ্রনাথের নাটক করবেন। তো আপনারা যে প্রযোজনাটি করেছেন এবং যেটি করতে যাচ্ছেন (স্বদেশী) সেটি তো ঠিক রবীন্দ্র নাটক হচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথের ৫১টি নাটক আছে। সেই নাটকগুলো যদি আপনাকে তৃপ্ত করতে না পারে তখন আপনি যাবেন নাট্যরূপে। আমরা তো মনে করি রবীন্দ্রনাথের মৌলিক নাটকগুলোই অনেক মান সম্মত, সেগুলোতে কি আপনি তৃপ্ত নন?
অনন্ত হিরা
আমাদের দলের ঘোষণাটায় একটু বোধহয় কনফিউশন আছে- সেটা হলো, আমরা বলেছি রবীন্দ্র নাট্যচর্চাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিব, পাশাপাশি অন্য নাটকও করবো। আর আপনি যে প্রশ্নটি করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথের মৌলিক নাটক দিয়েই কেন শুরু করলাম না- সেটা কিন্তু আমারও প্রথমে মনে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমার দলের সবাই নতুন। তো কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে যে, আজকে আমি বেশি এ্যাম্বিসাস হয়ে রাজা, বিসর্জন বা রক্তকরবী ধরলাম কিন্তু সেটাতে ব্যর্থ হলাম, সেটা ঠিক হবে কিনা। আসলে সব নির্দেশকেরই এই জিনিসটা মাথায় থাকে যে দলের রিসোর্সটা কী? আমরা আসলে তৈরি হওয়ার চেষ্টা করছি, রবীন্দ্রনাথে বিখ্যাত সব নাটকগুলো করার জন্য। ধন্যবাদ।
ফরিদা আকতার লিমা
(নাট্যজন, প্রাক্তন শিক্ষার্থী-নাটক ও সংগীত বিভাগ, ঢা.বি)
শ্যামাপ্রেম আমার ভালো লেগেছে, কিন্তু অভিনেতৃদের অভিনয় মেলোড্রামাটিক মনে হয়েছে। আর কস্টিউমটার মধ্যে কেমন যেন ইউনিটি নেই মনে হয়েছে ... মানে শ্যামার যে সখি, তার কস্টিউমটা কেমন যেন নাটকের সাথে যায়নি বলে মনে হয়েছে। একটু ব্যাখ্যা করবেন?
ফয়েজ জহির
(নাট্যজন, সেট-লাইট ও কস্টিউম ডিজাইনার- শ্যামাপ্রেম)
সহচরীদের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে যে শ্যামা যে ভূমিকায় অবতীর্ন এই নাটকে, সহচরীরা তা নয়। সহচরী বলতে তিনি যে কাজটি করেন, তিনি কি সেই পেশার সাথে যুক্ত নাকি যুক্ত নন? এখানে ইউনিটির কথা যেটা বলছেন সেখানে হয়তো এ জায়গাটাতেই এটা তৈরি করে। আর আরেকটা বিষয় আছে যে, টাইম এন্ড স্পেসের ব্যাপারটা ... সেটা কখনো কখনো এখানে ধরা দেয় আবার কখনো কখনো দেয় না, এমন একটা জায়গা এখানে আছে বা এরকম মনে হতে পারে। ধন্যবাদ।
অনন্ত হিরা
বাচিক অভিনয়ের কথা লিমা যেটা বলেছেন এটা সত্য। এটা আমিও মনে করি। একজন দর্শক হিসেবে আপনার মনে হয়েছে অভিনয়টা যথাযথ হয়নি- আমরা সেটা বিবেচনায় রাখছি। আর এই নাটকটি যখন শুরু করি তখন আমার সহকর্মীদের বলেছি বারবার যে শ্যামা বা উত্তীয় চরিত্রটি অভিনয় করার জন্য অনেক অভিজ্ঞতা দরকার ... ন্যূনতম দশ বছরের মঞ্চের অভিজ্ঞতা দরকার। তো যে মেয়েটি শ্যামা চরিত্রটি করেছে, সে এই চরিত্র দিয়েই প্রথম মঞ্চে দাঁড়িয়েছে। এখানে আমারও ব্যর্থতা থাকতে পারে, আমি হয়তো যথাযথভাবে ওদের কাছ থেকে আদায় করতে পারিনি। ধন্যবাদ।
নাহিদা সুলতানা স্বাতী
(নাট্যজন, প্রাক্তন শিক্ষার্থী-নাটক ও সংগীত বিভাগ, ঢা.বি)
আপনি বলছিলেন যে, থিয়েটারে একটি চরিত্র করতে গেলে অভিজ্ঞতা দরকার আবার বলছেন শ্যামা চরিত্রের অভিনেত্রীর পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। সেক্ষেত্রে আমি জানতে চাচ্ছি আপনি যখন কাজটা করেছেন তখন শ্যামা চরিত্রটি যিনি করছেন, তাকে কীভাবে মটিভেট করেছেন?
অনন্ত হিরা
ধন্যবাদ, সুন্দর প্রশ্ন। আমি তো আমার চাওয়াটা সহকর্মীর সঙ্গে বিনিময় করছি যে-এটা আমার ডিমান্ড, কিন্তু থিয়েটারটা একটা নিয়মিত চর্চিত শিল্প মাধ্যম, যেখানে অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই। এখন ধরুন, আমি একটা দৃশ্যে একটা ইমোশন ডিমান্ড করছি, সে-ও বুঝতে পারছে বিষয়টি, কিন্তু নিয়মিত চর্চা না থাকায় সে প্রডিউস করতে পারছে না। আমার কাছে মনে হয় থিযেটারে চর্চার জায়গাটা না থাকলে ডিরেক্টর চাইলেই কোনো ইমোশন কেউ দিতে পারবে না ... অভিজ্ঞতা এখানেই কাজে লাগে। মটিভেট যদ্দুর করতে পেরেছি, তাই দিযেই কিন্তু সে চরিত্রটি এতোদূর করতে পেরেছে। এটার অভিজ্ঞতা দিয়ে হয়তো আগামীতে আরো ভালো করবে। ধন্যবাদ।
কামালউদ্দিন কবির
আমার প্রশ্নটা সেট ডিজাইন নিয়ে। প্রশ্নটা আমি দুভাবে করতে চাই- প্রথমত হচ্ছে, নির্দেশকের ডিজাইন ভাবনাটা কীরকম ছিল বা আদৌ ছিল কিনা, আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে, শ্যামাপ্রেম-র সেট ডিজাইনে দেখতে পাই যে গতানুগতিক দৃশ্যান্তর প্রক্রিয়া ... অর্থাৎ আলো নিভিয়ে সেট পরিবর্তন করা হচ্ছে, এটা না করে ডিজাইন করা যেত কিনা?... এখানে একটু ব্যাখ্যা চাই।
ফয়েজ জহির
প্রশ্নটির দুটো ভাগ আছে। উত্তর দিচ্ছি ... আমাকে নির্দেশক যখন বললেন যে এই নাটকটির মঞ্চ পরিকল্পনা করতে হবে, তখন নাটকের রিহার্সেল অনেকদূর এগিয়ে গেছে। স্ক্রীপ্ট পড়ে বললাম যে আমাকে তো মহড়া দেখতে হবে। আপনার স্পেস ইউটিলাইজেশন, মুভমেন্ট, ব্লকিং এসব মিলিয়ে দেখে একটা জিনিস ভিজ্যুয়ালাইজ করবো এবং এর অর্ন্তনিহিত ভাবটা বুঝতে চেষ্টা করবো। তো মহড়া দেখতে গিয়ে দেখি উনি কিছু কিছু জায়গায় ব্লকিং করে ফেলেছেন এবং ওনার একটা চাহিদা আছে যে, এই এই জিনিসগুলো চাই। তখন আমাকে ভাবতে হলো যে উনি যেহেতু স্পেসটাকে ভাগ করে ফেলেছেন, এখন এটাকে কীভাবে কাজে লাগাতে পারি। একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি যে, যখন কোনো কিছুর পরিবর্তন হয় বা একটা সময় থেকে আরেকটা সময়ে যায় তখন তার পরিবর্তন হয় ভেতরে। একটা মানুষ যখন বদলে যেতে থাকে তার চিন্তার জগতে সেটার সূচনা হয় ভেতরে ... বাহির থেকে একটা প্রবাহ আসে শুধু। এই ভাঙনের জায়গাটা তৈরি করার চেষ্টা করেছি ভেতর থেকে- জানি না সেটা কতটুকু তুলে ধরতে পেরেছি। তবে নির্দেশক মেনে নিযেছেন আমার ভাবনাটা। আর নাটকের সূচনা যেটা দিযে হয় নাচের মূদ্রা দিয়ে সেখানে স্পেসটা এত ছোট হয়ে যায় যার জন্য নাটকের মূল জায়গায় প্রবেশের আগে মঞ্চ স্থাপনাগুলো নিয়ে আসতে হয়। শুধু ঐ জায়গাতেই, এমনিতে আর পরিবর্তন হয় না। ধন্যবাদ।
দিলীপ চক্রবর্তী
(নাট্যজন, সদস্য- দেশনাটক)
হিরাভাইয়ের কাছে আমার একটু জানার আছে, আপনি বলেছেন রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য নাটক করেননি দলীয় সীমাবদ্ধতার কারণে। তো শ্যামাপ্রেম করার পেছনে আপনার নাট্যভাবনা কী ছিল?
অনন্ত হিরা
এই নাটকে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার অনেকগুলো দিক আমাকে টেনেছে ... প্রথমত চিরন্তন মানবপ্রেম, নর-নারীর প্রেমকে ছাপিয়ে গিয়ে মানবের যে চিরন্তন প্রেমের আবেদন সেই আবেদনটা এই নাটকে সাংঘাতিকভাবে আছে বলে আমার মনে হয়েছে। আরেকটা দিক মনে হয়েছে যে, এই নাটকে উত্তীয় একটি চরিত্র, যে চরিত্রটি একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একা রুখে দাঁড়ায়। তো আমার মনে হয়েছে যে, আজকে আমাদের সোসাইটির অনেক ক্রাইসিসের মধ্যেও উত্তীয়দের জেগে ওঠা দরকার। এই নাটকটি নির্বাচন করতে আমার এই ভাবনাগুলোই আকৃষ্ট করেছে।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। আমরা আপাতত শ্যামাপ্রেম-র উপর আর কোনো প্রশ্ন নিচ্ছি না। এবার আমি আবেদন জানাচ্ছি মানগুলা নাটকের উপর প্রশ্ন করার জন্য। আমরা দেখছি যে এই নাটকের নির্দেশক-নাট্যকার-ডিজাইনাররা নড়ে চড়ে বসেছেন। আবার দর্শকদের সারি থেকে জাহিদ রিপনের হাত উঠেছে। রিপন প্রশ্ন করুন।
জাহিদ রিপন
মুকুল আমাদের জেনারেশনের উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি এবং মানগুলা-য় সে তার সৃষ্টিশীলতা আমাদের সামনে প্রবলভাবইে তুলে ধরেছে। আমি তার বন্ধু হিসেবে একটা সমালোচনা আজকে বলবো, সেটা হলো মুকুল একটা চেষ্টা করেছিল যে দর্শককে সে স্টুডিওতে নিয়ে যাবে এবং প্রতি শুক্রবারে তারা তাদের শো’গুলো করবে। এখন মুকুলের কাছে প্রশ্ন আপনারা এখন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে ফিরে এলে কেন? এটা কোনো বিচ্যুতি বা পরাজয় কিনা? আরেকটি প্রশ্ন হলো- আপনি যে প্রযোজনাটি করলেন এটা এক্সপেরিমেন্টাল হল ছাড়া কোথাও করা সম্ভব না বা করবেন না। তো এটা থিয়েটারকে একরকম বন্দী করেছেন কিনা? মানে প্রতি দুইমাস অন্তর হল পাবেন এবং দুইমাস অন্তর শো করবেন, এটা মাথায় রেখেই আপনি মানগুলা নিয়ে নামলেন কিনা? আর একটা প্রশ্ন করতে চাই নাট্যকারকে। সেটা হলো আপনি যে টেনশনটা তৈরি করতে চেয়েছেন সেটা ক্ষুণ্ন হয় কিনা ... মানে, আমার কাছে মনে হয়েছে অনেক আগেই নাটকটি শেষ হতে পারতো বা অনেক জায়গাই আছে যেখানে দর্শক মনে করে এখানেই নাটকটি শেষ হবে, কিন্তু দেখা যায় নাটকটি আবারও এগিয়ে যাচ্ছে ... তো আপনার এমন মনে হয়েছে কিনা? যেমন- হাতির পায়ের নিচে একজনকে মারা হলো, সেখানেই নাটকটা শেষ হয়ে গেলে কোনো ক্ষতি ছিল কিনা?
আমিনুর রহমান মুকুল
(নাট্যজন, সদস্য- পালাকার। নির্দের্শক- মানগুলা)
প্রথম প্রশ্নটার উত্তর আমি একজন সংগঠক হিসেবেই বলবো যে, স্টুডিও থেকে বের হয়ে এসে কেন এই প্রযোজনাটি করছি এবং সেখানে আমাদের পরাজয় বা বিচ্যুতি হচ্ছে কিনা ... আমি মনে করি না, পরাজয় বা বিচ্যুতি কোনোটাই ঘটেনি। আমরা এমন একটি জায়গায় স্টুডিওটি করেছি যেটি একটি আবাসিক এলাকার ভেতরে ... দিলু রোডে। এই ব্যাপারটা আমরা সাধারণ দর্শকের কাছে যতটুকু প্রচারণার মাধ্যমে পৌঁছানো দরকার, সেটা আমরা করতে পারিনি। আর স্টুডিওটা আমরা করেছি দলীয় সদস্যদের নিযমিত চর্চা করে নিজেদেরকে তৈরি করার জন্য। তো সব দর্শককে আমরা জানাতে চাই যে, আমরা এরকম একটি কাজ করি স্টুডিওতে। সে কারণে আমরা একটি বড় প্রযোজনায় গিয়েছি। আমাদের অভিনেতৃদের স্কিল কতটুকু উন্নত হলো সেটিকে যেমন যাচাই করা, পাশাপাশি দর্শককে জানানো যে, আমরা এই থিয়েটারের বাইরেও ওখানে (দিলু রোডে) ছোট ঘরে, ঐ থিয়েটারটাও করি ... এবং আপনারা সেখানে আসেন। এটা বলার যেন সুযোগটা হয়, সেজন্যই আমরা এখানে এসেছি। এটি অনেক দর্শকের কাছাকাছি আসার একটি পদক্ষেপ। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলবো যে- না বন্দী করছি না। কারণ আমরা নিয়মিত করি স্টুডিও থিয়েটার, তার বাইরে যদি দুমাসে একটিও শো পাই তাহলেও আমরা এখানে করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজটি করেছি। আর নাটকের এমন ডিজাইন থাকতেই পারে যে, সেটি সব মঞ্চে হবে না, কোনো না কোনো নির্দিষ্ট মঞ্চেই হবে। ধন্যবাদ।
হাসান শাহরিয়ার
নাট্যকারের কাছেও রিপনের একটি প্রশ্ন ছিল।
গোলাম শফিক
হ্যাঁ, আমি উত্তর দিচ্ছি। অনেকেই আমাকে এই নাটকের রচনা নিয়ে বলেছেন যে, সাধারণত একটি নাটকে একটি চরিত্র যেভাবে ডেভেলপ করে, বেড়ে ওঠে বা গড়ে ওঠে এবং পরিণতিতে যায়, সেভাবে আমি করিনি। আমি তখন বলি যে, হ্যাঁ, আমি সেই নিয়মটি ফলো করিনি, কারণ, হাজংদের যে জাতি সত্তা ... এই হাজং জাতিকেই আমি একটি চরিত্র হিসেবে দেখেছি। এই জন্যই একেকবার একেকটি চরিত্র এসেছে স্রোতের মত এবং জাতি সত্তাও একটি চরিত্র। আপনি বললেন যে, মনা সর্দারকে যেখানে হাতির পায়ে পিষ্ট করে হত্যা করা হলো সেখানেই নাটকটি শেষ হতে পারতো। হ্যাঁ, শেষ করা যেত যদি আমি ঐতিহাসিকভাবে ঘটনাগুলো ক্রমলজিক্যালি না আনতাম। এখন মনা সর্দার হত্যার পরও অনেক ঘটনা থেকে গিয়েছিল, সে জন্যই শেষ করা যায়নি। এখন এমনও হতে পারে- মনা সর্দারের মৃত্যুটা এমন ভয়ানকভাবে দেখানো হয়েছে যে, দর্শক হিসেবে ভাবছেন এখানেই নাটক শেষ হবে ... সেক্ষেত্রে এটা নির্দেশকের দায়। কারণ আমি লেখার সময় এমনভাবে লিখিনি যে মনা সর্দারের মৃত্যুটা এমন উচ্চগ্রামে চলে যাবে।
এবার আমি মুকুলের কথার সাথে একটু যোগ করতে চাই ... আপনার প্রথম প্রশ্নটির উত্তরে যে- আমরা কিন্তু কখনোই বলিনি যে আমরা কেবল স্টুডিও থিয়েটারে কাজ করবো, এখানে কাজ করবো না। এই নাটক এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে করতে গিয়ে কিন্তু আমরা বলেছি যে- দিস ইজ আওয়ার ফার্স্ট মেইন স্ট্রীম প্লে।
অনন্ত হিরা
আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই। প্রথমেই বলে নিই, মুকুলভাইদের কাজ বা ওনাদের প্রক্রিয়াটা আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখি। মুকুলভাইকে বলছি যে- আমরা যারা ঢাকায় গত ১০/১২বছর ধরে মঞ্চনাটক দেখছি, তারা এই ধরনের বা এই রীতির অনেক ফিনিসড ওয়ার্ক দেখেছি। বাচ্চুভাইয়ের হাতে বা জামিলভাইয়ের হাতে। তো ঐ একই প্রযোজনারীতির উপর কাজ করার পেছনে আপনার ভাবনা কী ছিল?
আমিনুর রহমান মুকুল
আমি বাচ্চুভাইয়ের কাজের একজন ভক্ত, ওনার অনেক কাজ আমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছি ... বনপাংশুল আমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। জামিল আহমেদের বিষাদসিন্ধু-ও দেখেছি, আমার প্রযোজনা এসবের ধারেকাছেও যেতে পারেনি এবং সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারি। আমি কোনো রীতি তৈরিরও চেষ্টা করিনি। আমি শুধু দলের ম্যাক্সিমাম এফোর্টটা দেয়ার চেষ্টা করেছি। হাজং সম্প্রদায়ের এই টেক্সটটা কত সহজে দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটার চেষ্টা করেছি। ধন্যবাদ।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
এখানে আমি একটু বলতে চাই। সেটা হলো আমি মানগুলা দেখেছি ... অনেক কাজ এবং অসম্ভব এফোর্টফুল প্রডাকশন এটা। হিরাসহ আর যারা অনুজপ্রতিম বন্ধুরা আছেন তাদের বলি, প্রতিদিন থিযেটারটা হয় না। শচীন তেন্ডুলকর প্রতিদিন শত রান করেন না, শূন্য রানেও আউট হন। তবুও তার উপস্থিতি, তার শারীরিক ভঙ্গি থেকে শুরু করে তার বুদ্ধির প্রয়োগ- এটা কিন্তু দেখার বিষয়। তেমনি করে থিয়েটারে যে অভিনেতারা অভিনয় করেন তাদের উপস্থিতি, বুদ্ধি প্রয়োগ, শিল্পবোধের প্রয়োগগুলো একসাথে সন্নিবেশিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছে কিনা সেটি দেখবার বিষয় আছে। কিন্তু আমি মনে করি যে মানগুলা -য় এটা ছিল। তবে মানগুলা-র বিষয়ে আমার যে জায়গায় আলোচনার অবকাশ আছে সেটা হলো আলটিমেটলি এটা কোথাও ক্যারি করে কিনা পুরো দর্শককে? থিয়েটার তো একটা চলমান শিল্প, জীবন্তু একটা শিল্প। এটা কখনো হোঁচট খায় কখনো দাঁড়ায়, তবে উড়াল দেয়ার যে আকাঙ্খা, প্রান্তর পেরিয়ে যাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা এটি কিন্তু আছে মানগুলা-য় এবং পালাকারদের। এটিই বিরাট প্রশংসার দাবীদার। ধন্যবাদ।
কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন
(নাট্যজন, সদস্য- প্রাচ্যনাট)
নাট্যকারের কাছে আমার জিজ্ঞাসা যে- হাজং সম্প্রদায়ের এত বিশাল একটা বিষয়কে উপস্থাপন না করে কোনো একটা বিষয়কে কি ফোকাস করা যেতো না? যেহেতু আপনি আপনার দলের জন্যই নাটকটি লিখছেন, তাহলে আপনি তো আপনার দলের সীমাবদ্ধতার কথা, রিসোর্সের সীমাবদ্ধতার কথা জানেন। দল ভালোভাবে, সফলভাবে যেন নাটকটি দর্শকদের সামনে আনতে পারে সেদিকটা তো দেখতে পারতেন। মুকুলভাইকে প্রশ্ন করছি যে- যেহেতু আমরা নাটকটিতে অনেক চেষ্টা দেখেছি কিন্তু খুব ফিনিসড ওয়ার্ক মনে হয়নি, সেহেতু আপনি কি আরো অপেক্ষা করতে পারতেন না? দলের কর্মীদের আরো তৈরি হতে সময় দিতে পারতেন না, ভালোভাবে নাটকটি করার জন্য?
হাসান শাহরিয়ার
আগে নাট্যকার উত্তর দিন, প্লিজ।
গোলাম শফিক
আমার উত্তর আগের একটি কথাতে প্রায় এসে গেছে। সেটা হলো এখানে তো মূলত হাজংদের দেখানো হয়েছে। এখন হাজংদের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা, অনেক ব্যক্তির সমাবেশ ছিল। আমি লিখতে গিয়ে মনে হয়েছে, ওদের পুরো বিষয়টাকেই আনবো। ধন্যবাদ।
কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন
না, আমি বলতে চাচ্ছি যে- আপনি কি এটাকে হাজংদের ডকুড্রামা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, না কোনো একটি বিষয়কে হাইলাইট করতে চেয়েছেন? মানে দর্শক হিসেবে এই নাটকটি দেখার সময় আমার অস্থির লাগে ... এতো ইলিমেন্টস!
আমিনুর রহমান মুকুল
আমি একটু কথা বললে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। এখানে দুটো বিষয় আছে। প্রথমত- আমি কিন্তু বলিনি যে আমাদের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ব্যর্থ হয়েছে, আমি বলেছি তারা সর্বোচ্চ এফোর্ট দিয়েছে এবং আরো এফোর্ট দেয়া উচিত সেটাও আমি মনে করি। আরেকটি যেটা বলেছেন যে, এতো বড় প্রেক্ষাপটকে কেন এক জায়গায় আনা হলো ... তো এই জায়গাটা আমি একটু পরিষ্কার করতে চাই। আসলে হাজং জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে আমাদের নাগরিক লোকদের তেমন করে ধারণা নেই, তাই তাদের হিস্ট্রিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। শৈল্পীক ক্রিয়ার মাধ্যমে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াটাই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। ধন্যবাদ।
সাইদুর রহমান লিপন
(নাট্যজন, সদস্য- ঢাকা থিয়েটার)
মুকুল আমাদের একজন প্রতিভাবান তরুণ নির্দেশক। তার মানগুলা নাটকটিও একটি বড়মাপের কাজ। আমার একটু ব্যাখ্যা চাওয়ার আছে, সেটা ডিরেক্টরিয়াল ভিউ থেকে ... সেটা হলো আমরা জানি থিয়েটারটা আসলে রিয়েল স্পেস এবং টাইম, ভার্চুয়াল স্পেস এবং টাইম এই দুয়ের মাঝামাঝি খেলা করে। সেই জায়গাটা মুশকিল হয়ে যায় যখন রিয়েল স্পেসে কোনো রিয়েলিটিকে হুবহু রিপ্রেজেন্ট করার চেষ্টা করা হয়। তখন কিন্তু এটা বিশ্বাসের জায়গাটায় আঘাত আনে। তো আমার কাছে মনে হয়েছে বেশ কিছু এলিমেন্টস এখানে এসেছে যে এলিমেন্টগুলো ওভাবে না আনলেই ভালো হতো। এবং এখানে ডিফারেন্ট ডিফারেন্ট অনেক কম্পোজিশন আছে যে কম্পোজিশনগুলো একটার সাথে আরেকটার ইন্টাররিলেশনশীপটা অতো স্ট্রং না বরং কিছুটা দুর্বলই মনে হয়েছে। মানে কম্পোজিশনগুলো এস্টাবলিস্টড হওয়ার আগেই কেমন যেন ভেঙে যায়। আমার এই ভাবনাগুলোর ব্যাপারে মুকুলের কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই।
আমিনুর রহমান মুকুল
এই নাটকে রিয়েলিটি থেকে যে এলিমেন্টগুলো এসেছে সেগুলোকে আমরা অনেক কালার দেয়ার চেষ্টা করেছি এবং আপনার সাথে এই বিষয়ে আমিও একমত যে একটি কম্পোজিশনের স্থায়িত্ব যতক্ষণ হলে দর্শকের দেখতে ভালো লাগতো তারচেয়ে কম সময় স্থায়িত্ব পেয়েছে। এবং এই সময়টা নেয়া হয়নি বলেই ইমনের কাছে তাড়াহুড়ো বা অস্থির অস্থির লেগেছে। আমরা বিষয়টি ভেবে দেখবো। ধন্যবাদ।
অনন্ত হিরা
আমি একটু বলতে চাই ... ইমন বলছিল যে- ক্ষমতা না থাকলে সেই চেষ্টাটা কেন করবো? এই প্রসঙ্গে বাচ্চুভাইয়ের কথা দিয়েই বলি যে- আকাশ ভেদ করে উড়াল দেবার চেষ্টাটা কিন্তু ওদের প্রযোজনায় আছে। আমার মনে হয় এই উড়াল দেবার ইচ্ছাটা থিয়েটারে বেশ জরুরি। ব্যর্থ হতে পারি কিন্তু চেষ্টাটা জরুরি, আর সব কাজ সমানভাবে সফল হয়ও না।
এরশাদ কমল
(নাট্যদর্শক, সাংবাদিক- ডেইলী স্টার)
নাট্যকারের কাছে একটা বিষয় জানতে চাই, সেটা হলো আপনি হাজং সম্প্রদায়ের স্ট্রাগলের একটা ক্রমলজিক্যাল হিস্ট্রি টেনেছেন। এটা টানতে গিয়ে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঐ কমিউনিটি থেকেই কোনো একজন হিরোকে দেখাচ্ছেন। মনি সিং এর হয়তো অবদান আছে এই সম্প্রদায়ের সংগ্রামে কিন্তু এই সময়টাতে এসে আপনি কেন ঐ কমিউনিটি থেকে কাউকে হিরো না করে মনি সিং কে এত বেশি ফোকাস করলেন?
গোলাম শফিক
আমি নাটক লেখার সময়ই মনি সিং কে ঐ স্রোতের মধ্যেই এনেছিলাম। মনি সিং কে কিন্তু আমরা আনিনি, বিভিন্ন কথায় বা রেফারেন্সে এসেছে। তো ওরকম রেফারেন্সে এসে এসে যে জাগায় গেছে, সেখানে মনি সিং হিরো হয়নি বলেই আমার মনে হয়।
আমিনুর রহমান মুকুল
আমিও একটু বলি ... আসলে হাজং সম্প্রদায়ের কথা বলতে গেলে মনি সিং আসবেই, তবে একটু বড় আকারে আমাদের নাটকে এসেছে, সেটাকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। ধন্যবাদ।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। আমরা এবার প্রশ্ন চাইবো মেটামরফোসিস নাটকের উপর। হ্যাঁ, স্বাতী বলুন।
নাহিদা সুলতানা স্বাতী
নীলু স্যারের কাছে আমার একটু জানার আছে ... একজন অভিনেত্রী হিসেবে জানতে চাই যে- আপনি তো নতুন এবং পুরাতন উভয় শিল্পী নিয়েই কাজ করেন, তো যখন নতুনদের নিয়ে কাজ করেন তখন কীভাবে করেন এবং পুরোনোদের নিয়ে কাজ করার সময় তাদের অভিজ্ঞতাকে কীভাবে কাজে লাগান?
কামালউদ্দিন নীলু
(নাট্যজন, নির্দেশক- সেট-লাইট ডিজাইনার- মেটামরফোসিস)
প্রথম কথা হচ্ছে যে এ্যাক্টিংটা হচ্ছে একটা অর্গানিক এ্যাকশন। অর্গানিক মানে হচ্ছে ইনার এবং আউটার এ্যাকশনগুলোকে যখন এক জায়গায় আনি তখনই এটা ঘটে। এটা যখন না ঘটে তখনই কিন্তু এ্যাক্টিং-এ এক্সপ্রেশনটা ভিন্ন হয়ে যায়। এবং ডিরেক্টরের দায়িত্বই হচ্ছে এই দুটো লাইনকে এক জায়গায় আনা। দ্বিতীয়ত আমার মাথায় কাজ করে যে, থিয়েটারে কোনো কিছু ঘটে না, পৃথিবীতে যা ঘটে সেটা ঘটিয়ে দেখাতে হয়। থিয়েটারের সব কিছুই তো আমরা কাল্পনিকভাবে ধরে নিই। আর থিযেটারের এ্যাক্টিংটা একটা কনটিন্যূয়াস প্র্যাকটিসের জায়গায় ... এখানে নির্দেশকের দায়িত্বটা হচ্ছে ঐ প্র্যাকসিটের জায়গাটাকে ধরা এবং আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ডিরেক্টরের কাজ হচ্ছে শুধু ব্যাখ্যা করা, অভিনয় দেখিয়ে দেয়া নয়। নাট্যকার একটা বিষয় ক্রিয়েট করে নাটক লিখে আর ডিরেক্টর সেটা রিক্রিয়েট করে। যেমন বাচ্চুভাই বলেছেন উনি বিনোদিনী পরিবেশন করেছেন ... পরিবেশন তো সব কিছুই। আমি ক্রিয়েট করছি, না রিক্রিয়েট করছি দ্যাট ইজ ইম্পোর্টেন্ট।
কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন
নির্দেশক হিসেবে মেটামরফোসিস-র মতো একটি জটিল উপন্যাসকে উপস্থাপন করার জন্য আপনার ভাবনাটা কী ছিল একটু জানতে চাই।
কামালউদ্দিন নীলু
মেটামরফোসিস যারা পড়েছেন বা কাফকা সম্পর্কে জানেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে এটা কিন্তু কাফকারই জীবন। এই ফিকশনটা হচ্ছে একজিস্টেনশিয়ালিজমের ফিকশন এবং এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট, মডার্ন থিয়েটারের। কাহিনীটা পড়লে দেখবেন এটাতে ড্রিম তো আছেই, তার পাশাপাশি খুব রিয়েলিস্টিক একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু আমি ঐ রিয়েলিজমের মধ্যে না গিয়ে একজিস্টেনশিয়ালিজমের দিকে বা এ্যাবসার্ডিটির মধ্যে থাকার চেষ্টা করেছি। এটা আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল যে, আমি কীভাবে ঐ ইমাজিনারী ওয়ার্ল্ডটাকে টাচ করতে পারি। একজন মানুষ হঠাৎ করে স্বপ্নে পোকা হয়ে যাচ্ছে ... এই পোকাটাকে আমি কীভাবে নিয়ে আসবো, এবং সেটা কত সিম্পলভাবে নিয়ে আসা যায়, সেটা ভাবতে হয়েছে। আরেকটি নিরীক্ষা করেছি যে, ব্রেখট বলেছেন দর্শক অবজারভার হিসেবে থাকবে কিন্তু আমি এই জায়গায় অভিনেতাকে কখনো কখনো অবজারভারে নিয়ে গেছি, আবার দর্শককে কখনো কখনো অভিনয়ের মধ্যে নিয়ে এসেছি। এবং সেজন্য আমি শেষে এসে কিন্তু মেটামরফোসিস-র সংলাপ ব্যবহার করিনি, আমি কাফকার নিজের ডায়েরি থেকে একটা সংলাপ নিয়েছি- আই এ্যাম দ্যা স্পেকটেটর ইন দ্য অর্কেস্ট্রা’। শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই কিন্তু এই পৃথিবীর একজন দর্শক। এই এ্যাঙ্গেল থেকেই আমি দেখার চেষ্টা করেছি।
মোহম্মদ বারী
(নাট্যজন, সদস্য- থিয়েটার আর্ট ইউনিট)
আমার দুটি প্রশ্ন। একটি হলো- বলা হচ্ছে যে, মেটামরফোসিস একটি নিরীক্ষাধর্মী প্রডাকশন ... তো এটা কি সত্য যে আপনি এটাকে নিরীক্ষাধর্মী হিসেবে এস্টাবলিশ করতে চান?
কামালউদ্দিন নীলু
আমি এস্টাবলিশ করতে চাই না, অলরেডি করেছি।
মোহাম্মদ বারী
নিরীক্ষার মধ্যে তো একটা হাইপোথিসিস থাকে। সেদিক থেকে আপনার প্রযোজনার হাইপোথিসিস কী ছিল?
কামালউদ্দিন নীলু
এখানে কোনো থিসিসও নেই, হাইপোথিসিসও নেই। নিরীক্ষা থাকে এক্সপ্রেশনের মধ্যে ... আমি বিষয়টিকে কীভাবে এক্সপ্রেস করছি তার মধ্যে।
মোহাম্মদ বারী
অভিনেতা কিছুক্ষণ বাংলা আবার কিছুক্ষণ ইংরেজিতে সংলাপ দিল। এটা কেন?
কামালউদ্দিন নীলু
এটা একেবারেই ইচ্ছাকৃত। আমি এই নাটকটি সাধারণ দর্শকদের জন্য করিনি। আমি করেছি বাংলিশদের জন্য। এই নাটকটি আমি নিয়ে যেতে চেয়েছি যারা আপার ক্লাশটা বিলং করছে ... যারা সব সময়ই ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে কথা বলে এবং তারাই কিন্তু আমাদের দেশের পুঁজিটা কন্ট্রোল করছে। এই নাটকের বিষয়টাই তো হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কী করে মানুষকে, মানুষের জীবনী শক্তিকে হত্যা করছে এবং ভেতরের একটি মানুষ কীভাবে পোকায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এই ম্যাসেজটা আমি নিয়ে যেতে চেয়েছি ঐ মানুষদের কাছে, ঐ দর্শকদের কাছে, যার কারণে আমি দুটো ভাষা ব্যবহার করেছি। তা ছাড়া আজকাল ভাষা নিয়েও এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। যেমন আমি দিল্লী গিয়ে যখন বাবরনামা দেখলাম, সেখানে তারা ৩/৪টি ভাষা ব্যবহার করেছে এবং শেষ পর্যন্ত এগুলো আর ভাষা থাকে না, তখন এটা একটা থিয়েট্রিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজে পরিণত হয়।
দিলীপ চক্রবর্তী
আমার একটু জানার আছে, সেটা হলো আমরা যখন জার্মান কালচারাল সেন্টারে নাটকটি দেখি, তখন অডিয়েন্সের বাঁ-দিকে একেবারে মঞ্চঘেঁষা দুটো ছবি লাগানো থাকতে দেখি, যেগুলো ঐ নাটকের ছবি নয়। ঐ ছবি দুটোর মাথায় হ্যাট পড়া এবং নাটকের চরিত্রটিরও হ্যাট পড়া। তো এ দুটোকে আমি মেলাতে পারি না আবার মাঝে মাঝে মেলাতে চাই। আমার প্রশ্ন এই ছবি দুটোকে রাখলেন কেন?
কামালউদ্দিন নীলু
ঐ ছবি দুটো পারমানেন্টলি লাগানো। তারপরও ঐ ছবি দুটো আমি ইচ্ছাকৃতভাবে রেখেছি। কারণ এর রিফ্লেকশনটা আছে এবং এরকম একটা ছবির রেফারেন্সও একটি সংলাপে আছে ... মিলে যায়।
দিলীপ চক্রবর্তী
আরেকটা প্রশ্ন হলো আপনি কোন ভাবনা থেকে অভিনেতাকে দর্শকদের মুখোমুখি করালেন, ইন্টারেকশনে গেলেন?
কামালউদ্দিন নীলু
ঐ যে বললাম কাফকার ডায়েরির একটি সংলাপ আছে- আই এ্যাম দ্য স্পেকটেটর ইন দ্য অর্কেস্ট্রা ... শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই কিন্তু দর্শক।
হাসান শাহরিয়ার
সুধি দর্শক, এবার আবার আমরা প্রথম নাটক থেকে প্রশ্নত্তোর চালিয়ে আসবো। যদিও শুরু করেছিলাম চে’র সাইকেল দিয়ে, কিন্তু বাচ্চুভাই আমাকে আস্তে আস্তে জানান দিলেন ওনার জরুরি একটা কাজ আছে, তাই বিনোদিনী-র প্রশ্নগুলো যেন আগে আগে নিয়ে নিই। কিন্তু এব্যাপারে আমাকে মামুনুর রশীদভাইয়ের স্মরণাপন্ন হতে হচ্ছে। কারণ, এখন সময়টা ওনার নাটকের জন্য বরাদ্দ, তাই উনি যদি অনুমতি দেন তো বিনোদিনী-র প্রশ্নগুলো নিতে পারি।
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, তাতো দিতেই হবে। বাচ্চু এসেছে দেরিতে, তাড়াতাড়ি গিয়ে ওটাকে ব্যালেন্স করতে হবে না! হাঃ হাঃ ...
হাসান শাহরিয়ার
হাঃ হাঃ, ঠিক আছে অনুমতি বোধহয় পাওয়া গেল। আমি বিনোদিনী-র উপর প্রশ্ন চাইছি। হ্যাঁ, নীলুভাই কিছু বলবেন।
কামালউদ্দিন নীলু
আমার মনে হয় একটা বিষয় জানা খুব প্রয়োজন, বিনোদিনী-র সেট ডিজাইনের ক্ষেত্রে, সেটা হলো- পেছনে একটা সার্কুলার লাইন আছে ... তো এগুলো কিন্তু হয় যে বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করা হয়। তার সবগুলোই কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না। কারণ, ডিজাইনারের ব্যাখ্যা জানার কিন্তু কোনো সুযোগ থাকে না। তাই আজকের এই অনুষ্ঠানে সেই সুযোগটা নিতে চাই ... জানাতে চাই পেছনের ঐ সার্কুলার লাইনটির ব্যাখ্যা।
কামালউদ্দিন কবির
প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমি একটু অন্য কথা বলতে চাই, সেটা হলো, একটা পাণ্ডুলিপি যখন নাট্য হয়ে ওঠে তখন কিন্তু এর পেছনে অনেক সৃষ্টিশীল লোক থাকে। তো একটা বিষয় আজকাল একেবারেই হয়ে ওঠে না, সেটা হচ্ছে নাট্য সমালোচনা। যা-ও কিছু কিছু হয়, সেখানে আবার একটা বিষয় একেবারেই উপেক্ষা করা হয়, সেটা হলো ডিজাইনারদের ব্যাপারে কিছু বলা। তো আজকের এই অনুষ্ঠানে থিয়েটারওয়ালা এই কাজটি করলো যে- আমাদের ডিজাইনারদেরও স্বীকৃতি দিল এবং পুরো নাটকে আমাদের সৃজনশীলতার ব্যাপারটিকে সবার সামনে নিয়ে এলো। সে কারণে আমি থিয়েটারওয়ালা’কে ধন্যবাদ জানাই। এবার প্রসঙ্গে আসি ... বিনোদিনী-র সেট ডিজাইন আমি যখন করতে যাই তখন নির্দেশক এবং অন্যান্য ডিজাইনারদের সাথে বসে অনবরত কথা বলেছি এবং সেখানে একটি বিষয় মুখ্য ছিল যে, বাচ্চুভাই তার কল্পনায় বিনোদিনীকে দেখতে পাচ্ছিলেন একটি বৃত্তের মধ্যে। তো এই একটি কিউ আমি পেয়েছিলাম। তারপর এই বৃত্ত নিয়ে নানা আলোচনা হয়, এই বৃত্ত যে কেবলই বৃত্ত না, এ যে নানা মাত্রা তৈরি করে, নানা অর্থ তৈরি করে জীবন স্পেসে ... সেগুলো নিয়ে কথা হলো, আলোচনা হলো। অনেকে বলেন একটি অসম্পূর্ণ বৃত্ত ... না, আমি কোনোভাবেই এটিকে অসম্পূর্ণ বৃত্ত বলি না বরং এটি লক্ষ্য করা যাবে যে, এটি ছুটছে, যেটা কিনা আমরা বিনোদিনীর জীবন সংগ্রামকে লক্ষ্য করলেও দেখি।
বিপ্লব বালা
বিনোদিনীর জীবনে ছোটাটা কিন্তু ফ্যাক্ট হিসেবে রিয়েল নয়। তার জীবনের ঘটনার মধ্যে কিন্তু ছোটাটা নেই। বিনোদিনী কিন্তু শেষ পর্যন্ত হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ট্য্যাজিডি কিন্তু ওখানে। সে ক্ষেত্রে বৃত্তের ছোটার কনসেপ্টটা কি মেলে?
কামালউদ্দিন নীলু
বিনোদিনী কিন্তু বারবার জন্মগ্রহণ করছে। পুরো নাটকটাই কিন্তু একটা লাইফ সাইকেল। যার ফলে ঐ বৃত্তটা রিলেট করেছে বলে আমার মনে হয়েছে।
বিপ্লব বালা
কিন্তু বাস্তবে কিন্তু শেষ হচ্ছে যে, সে ভেঙে গেছে। তো সেই ভাঙনটা কি কোথাও থাকবে না?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি একটু বলি ... এখানেই বিনোদিনীর শেষ সংলাপটা কিন্তু জরুরি, সেটা হচ্ছে- আমার শেষও নাই, আরম্ভও নাই, এ-ই আমার পরিচয়। আমার মনে হয় to be or not to be-র সমকক্ষ একটি সংলাপ, যেটি কিনা বিনোদিনী নিজেই লিখে গেছেন। মামুনুর রশীদ একটি কাজ করবেন, তারপর উনি মারা গেলে আরেকজন আসবেন ... তাই বলে তাঁর তো শেষ নেই। তাঁর এক্সটেনশন হবে আরেকজন। সুতরাং এই সার্কেলটাই কিন্তু ঘটছে।
মামুনুর রশীদ
আমাদের ‘সঙক্রান্তি’ নিয়ে ‘থিয়েটারওয়ালা’ একটা আড্ডা করেছিল ... সেখানে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেছিল এবং পরে আমরা সেটা নিয়ে ভেবেছি যে- সেট-টা যাই হোক না কেন, সেটা ওয়ার্ক করছে কিনা, সেটা জরুরি। তো বিনোদিনী-তে সার্কুলার লাইন বা আরো যা যা আছে সেগুলো ইনডিভিজ্যুয়ালী বেশ চমৎকার, কিন্তু ইজ ইট প্রপারলি ইউটিলাইজড? আমার কাছে কিন্তু মাঝে মাঝে ওগুলোকে বেশ রিজিড মনে হয়েছে। বিনোদিনী যখন ওখান থেকে প্রপস্ নিয়ে ব্যবহার করছে, সেগুলো কিন্তু আমাকে চমৎকৃত করছে কিন্তু সেট-টা আমার মনে হয় কখনো কখনো কম ব্যবহৃত ... এটা মনে হয় কিনা?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
না, আমার মনে হয় না। কিছু জিনিস আছে যেগুলো সরাসরি স্পর্শ করে ব্যবহার করবেন। আর কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলো দৃষ্টি দিয়ে আপনি স্পর্শ করবেন। বিনোদিনীর কোনো সংলাপের সাথে যদি পেছনের সার্কেলটা কোনো ইমেজ তৈরি করে ... দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে সেটাও একধরনের ব্যবহার বলা যায়।
মামুনুর রশীদ
যেখানে অভিনেত্রী বিনোদিনীর নানা মুভমেন্ট মঞ্চে তৈরি হচ্ছে এবং সেই মুভমেন্টগুলো তৈরি করার সময় যদি অন্য কোনো একটা ইমেজ দ্বারা ডেস্ট্রাকটেড হয়ে যাই, তাহলে সেটা কেমন হয়?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, ডেস্ট্রাকটেড হয়ে গেলে সমস্যা, আর যদি ডেস্ট্রাকটেড না হয়ে কিছু এ্যাড করে, যোগ করে সেটা নিশ্চয়ই ভালো ... আমি বলতে চাইছি একটি ভার্টিক্যাল লাইন যদি সরাসরি মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকে, তার বিপরীতে একজন দর্শক ঐ ভার্টিক্যাল লাইনের সাথে এই সংলাপের যদি কোনো সাজুজ্জ খুঁজে পায় তাহলে তো অসুবিধা নেই।
মামুনুর রশীদ
সেটা তো পেতেই হবে, মাস্ট। যেমন ধরো আমাদের জয়জয়ন্তী নাটকের সেট ডিজাইনে কোনো ভার্টিক্যাল লাইন ইউজ করা হয়নি। ... সেদিন বিনোদিনী দেখার পর আমার কাছে মনে হয়েছে, ভার্টিক্যাল লাইন না থাকলে শিমূলের অভিনয় আরো ইফেক্টিভ হতো কিনা ... ঐ রকম কমপ্লেক্সে ভার্টিক্যাল লাইন না থাকলে অসুবিধা হতো কিনা?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি আসলে ভিজ্যুয়াল তাড়িত মানুষ, আমি ভিজ্যুয়ালি দেখার চেষ্টা করি। পুরো নাটকটা দেখার পর দর্শক কি পুরো নাটকটা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরে? না, নিশ্চয়ই না। একটা ইমেজ নিয়ে বাড়ি ফেরে। আমি ইমেজ তাড়িত মানুষ বলেই আমার মনে হয়েছে বিনোদিনীর একটি ইমেজ নিয়েই মানুষ বাড়ি ফিরে যাবে ... ঐ সার্কেলটা আর বিনোদিনীর ফিগার, আর অন্য কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। ঐ সার্কেলটা আমার থিয়েটারটায় খুব সহযোগিতা করেছে বলে আমার মনে হয়েছে।
বিপ্লব বালা
আমি সেট ডিজাইনারকে প্রশ্ন করছি, সেটের ইলিমেন্টগুলো মেটাল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কেন?
কামালউদ্দিন কবির
ডিজাইন শেষ করে ভাবছিলাম, এই রেখাগুলো কী দিয়ে করা যায় ... তো প্রথমে বেতের কথা ভেবেছিলাম এবং অনেকেই হয়তো মনে করবেন বেতটাই হয়তো বেশি রিলেট করতো এখানে। সেটা দুটো কারণে হয়নি, এক হচ্ছে ঐ রেখাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে বেতের মাধ্যমে আনতে গেলে যে খরচ ও শ্রম দরকার, সেরকম বাজেট ও শিল্পী পাওয়া মুশকিল হতো। আমি খুব সহজে খুঁজে পাচ্ছিলাম এই মেটালের জাযগাটা এবং মেটালটা কেবল সহজলভ্য বলেই ব্যবহার করেছি তা না, বিনোদিনীকে আমরা ২০০৫ সালে উপস্থাপন করছি এবং এই সময়ের একটি এলিমেন্ট হচ্ছে মেটাল ... আমরা বিষয়টাকে এভাবেই দেখছিলাম। ধন্যবাদ।
কামালউদ্দিন নীলু
ডিজাইনে আরেকটা বিষয় ছিল কাপড়ের ব্যবহার- তো কাপড়গুলো ঐভাবে ছুঁড়ে না দিয়ে যদি রঙগুলো মঞ্চে এসে এক জায়গায় দানা বাঁধতো, তাহলে কিছু একটা হতে পারতো ... কারণ ওভাবে ছুঁড়ে ফেলার কারণে আমার কাছে মনে হয়েছে রঙগুলোও হারিয়ে গেল। এটা অবশ্য আমি নির্দেশনার ব্যাপারে বলছি।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
ছুঁড়ে ফেলার ব্যাপারটা আমার লেটো থেকে নেয়া। এটা আমাদের থিয়েটার ফর্মের একটা জায়গা। সেটা অনেক সময় ওয়ার্ক করে, অনেক সময় করে না।
এরশাদ কমল
আমি একটা বিষয় জানতে চাই, নাটকটার মধ্যে প্লে উইদিন দ্য প্লে দেখানোর জন্য সাজেস্টিভ প্রসেনিয়াম আর্চটা ফেলা হচ্ছিল, এবং দেখতেও ভালোই লাগছিল, কিন্তু এটার সাথে রিলেট করে লাইট ডিজাইনে কোনো ইলিউশন কিন্তু ক্রিয়েট করা হয়নি ... সেটা কেন একটু জানতে চাই। আর বাচ্চুভাইয়ের কাছে আমার প্রশ্ন, আমরা জানি যে, আপনি আমাদের বিভিন্ন ট্র্যাডিশনাল থিয়েটার আছে তার রিপ্রেজেন্ট করেন। বিনোদিনী নাটকে কিছু জায়গায় দেখা গেছে যে কাবুকি বা ওডিসি ডেন্সের কিছু কিছু প্রয়োগ আছে ... তো এখন আপনি নতুন কিছু ভাবছেন, না শুধু এই নাটকের ক্ষেত্রেই আপনার চিন্তাটা একটু অন্যরকম করে দেখাচ্ছেন?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি তো পৃথিবীর মানুষ, সে হিসেবে সব কিছুই আমার নাটকে আসতে পারে। তবে আমার নতুন ভাবনা নেই। একেকটি নাটক, চরিত্র, উপস্থাপনা একেক রকম হতেই পারে। নাটকের রঙের সাথে সব কিছু ডিজাইন করতে হয়। বিনোদিনী যখন প্রেজেন্ট করতে গেছি একটা ক্লাসিক্যাল ভাবনা থেকে প্রেজেন্ট করতে গেছি। সে কারণে দেখবেন যে ওডিসি বা কথাকলি নাচের প্রভাব আছে। এটা এই নাটকের ভাবনা ... অন্য নাটকে এটা না-ও থাকতে পারে। আর লাইটের কথাটা নিশাত বলবে।
ইশরাত নিশাত
(নাট্যজন, লাইট ডিজাইনার- বিনোদিনী)
লাইট দিয়ে ইলিউশন ক্রিয়েট করাটা ইন্টেনশনালী এ্যাভয়েড করা হয়েছে। বিনোদিনী নাটকের লাইটের থিমে একটা বড় ব্যাপার আছে, সেটা হচ্ছে যে কোনো কালার লাইট সামনে থেকে ব্যবহার করা হয়নি। সব কালার লাইটগুলো পেছনে এবং শুধুমাত্র একটি কালার লাইট সামনে থেকে আনা হয়েছে, সেটা হলো যখন প্রসেনিয়াম আর্চটা নেমে আসে। আমি সব সময়ই চেয়েছি বিনোদিনীর সাদামাটা উপস্থাপনাটা লাইটে আনতে।
এরশাদ কমল
আমি যেটা জানতে চাচ্ছি সেটা হলো, সেট ডিজাইনে যখন একটি সাজেস্টিভ প্রসেনিয়াম আর্চ ফেলছেন, উপর থেকে, তখন আপনি কেন ইলিউশন ক্রিয়েট করছেন না? এখানে দুটো ডিজাইনকে কো-অর্ডিনেট করতে হবে না?
ইশরাত নিশাত
আমি তো বললাম যে আর্চটা যখন নেমে আসে তখন একটা কালার লাইট পড়ে, আর্চের উপর।
এরশাদ কমল
যখন থিয়েটারের মধ্যে আরেকটা থিয়েটার শুরু হলো, তখন তো মঞ্চের মধ্যে আরেকটি মঞ্চ তৈরি হয়, কিন্তু আপনার মঞ্চের আলো প্রক্ষপণ কিন্তু আগেরটাই থাকে। আমি সেটার কথা বলেছি।
ইশরাত নিশাত
সেটা আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছি।
কামালউদ্দিন নীলু
কেন? সব ইচ্ছার তো একটা কারণ থাকবে, সেই কারণটা জানতে চাচ্ছে।
ইশরাত নিশাত
আমি আর্চের উপর লাইট ফেলেই এই কাজটা করতে চেয়েছি, পুরো মঞ্চে নতুন লাইট দেয়ার আসলে প্রয়োজন হয়নি।
মোহাম্মদ বারী
নিশাতের কাছে জানতে চাই, আপনি বাচ্চুভাইয়ের সাথে কাজ করতে গিয়ে ডিজাইনার হিসেবে কতটুকু স্বাধীন থাকতে পারেন?
ইশরাত নিশাত
শুধু আমি না, এখানে ডিজাইনার আরো আছেন, বাচ্চুভাইয়ের সাথে কাজ করেছেন যারা সবাই বলতে পারবেন যে, ডিজাইনার এবং পারফরমার সবাইকেই তিনি খুব স্বাধীনতা দেন। এই নাটকে এবং প্রাচ্য-তে আমি বাচ্চুভাইকে এ্যাসিস্ট করেছি, সেজন্য শেয়ারিংটা প্রথম থেকেই ছিল। চিন্তার স্বাধীনতাটা প্রচণ্ড দেন। প্রয়োগটা যখন হচ্ছে তখন হয়তো উনি বলেন যে- অমুক জায়গাটা তুই আরেকটু অন্যভাবে কর, বা আমি এইভাবে চেয়েছিলাম, তুই সেটা মাথায় রাখ ইত্যাদি। কিন্তু আমার কাজটা উনি আমাকে দিয়ে বের করেন।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। এবার চে’র সাইকেল-এর উপর প্রশ্ন চাচ্ছি।
অনন্ত হিরা
মামুনভাইয়ের কাছে আমি জানতে চাই, আপনি তো চে’ কে নিয়ে নাটক লিখতে গিয়ে চে’র জীবনীটা লিখলেন না, তাঁর অন্য জায়গা থেকে বিষয়টাকে দেখার চেষ্টা করলেন, কেন?
মামুনুর রশীদ
এটার একটা পটভূমি আছে। একবার হংকং এ একটা ফেস্টিভালে আমাকে ডেকেছিল। ওখানে একজন লোক আছে সবাই তাকে চে’ বলে জানে। এবং সেই লোকটাকে মঞ্চে উপস্থিত করা হয়েছে। এবং সেখানে তাকে নানা প্রশ্ন করা হচ্ছে ... পুরো থিয়েটারটাই ছিল প্রশ্ন দিয়ে করা ... দর্শক প্রশ্ন করছে আর সে উত্তর দিচ্ছে। সে দেখতে চে’র মতো ... লম্বা চুল, দাড়ি ... সে ওখানে শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত। সম্প্রতি শুনলাম সে পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছে। তো সেখানে পরপর সাতদিন শো হলো এবং আমি সাতদিনই দেখতে বাধ্য হযেছি। আমি ঐ ভাষা বুঝি না, সাতদিন দেখলাম সাতরকম দর্শক আসলো আর নানা রকম প্রশ্ন হচ্ছে। টোটাল বিষয়টাই ফোরাম থিয়েটারের মতো ... আমি তখন ভাবলাম যে চে’কে নিয়ে তো আমাদেরও দায় আছে। তখনই চিন্তা করলাম যে একটা নাটক তাঁর উপর লিখবো। কিন্তু কী নিয়ে করবো, তাঁর জীবনী নিয়ে না অন্য কোনো বিষয় নিয়ে? তখন আমার অনুসন্ধানের কথা মাথায় এলো এবং মনে হলো চে’কে অনুসন্ধান করতে হবে। এবং সে থেকেই আমার নাটকে শুরুতে তিন চরিত্র আসে যারা কিছু একটা খুঁজছে এবং খুঁজতে খুঁজতে চে-কে পেয়ে গেল। এবং চে’র জীবন ... যে বর্ণাঢ্য জীবন ...
অনন্ত হিরা
সেই বর্ণাঢ্য জীবনটাতে কেন গেলেন না?
মামুনুর রশীদ
সেই বর্ণাঢ্য জীবনটাতে যাওয়া রিস্কি। এই অর্থে রিস্কি যে এতো কালারফুল লাইফের কোথা থেকে শুরু করবো আর কোথায় শেষ করবো? আবার যাই করি না কেন, তাকে তো সমসাময়িক হতে হবে। কারণ আমি মনে করি থিয়েটার একেবারেই সমসাময়িককালের জন্য। অনেকে হয়তো এটা মনে করেন না, সেটা তাদের ব্যাপার ... তো আমি খুঁজে পেলাম যে- চে-কে কিন্তু বিপ্লবীরা পছন্দ করে আবার আমেরিকা বা পুঁজিবাদীরাও পছন্দ করে। বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য সৎ, কিন্তু পুঁজিবাদ চে-কে ফ্যাশানের সিম্বল হিসেবে নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে এসেছে। ফলে চে-কে সারা বিশ্বই এখন চেনে, কিন্তু চেনাটার মধ্যে অনেক গরমিল আছে। আমি মনে করলাম যে চে-র ইন্টারন্যাশালিজমের জায়গাটা ধরতে হবে। এবং তাকে এই ফ্যাশনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
এরশাদ কমল
মামুনভাই, এদেশে আমরা সবাই যখন গ্লোবালাইজেশনের বিপক্ষে কথা বলছি, সেখানে আপনি কেন চে-র ইন্টারন্যাশনালিজমকে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন? চিন্তার ভিন্নতা থাকতে পারে ... একটা পুঁজিবাদী আরেকটা কমিউনিস্ট ... কিন্তু দুটোই যদি ইন্ডিভিজ্যুয়ালকে শেষ করে দেয়, তাহলে তো দুটোই এ্যাভয়েড করা উচিত ...
মামুনুর রশীদ
খুব ভালো প্রশ্ন ... গ্লোবালাইজেশন ফর মার্কেট ইকোনোমি। আজকের বিশ্বের দিকে তাকালে কী মনে হয় ... আজকে ইরাকের তেল লাগবে, বাংলাদেশের গ্যাস লাগবে, এটা গ্লোবালাইজেশন। কিন্তু ইন্টারন্যাশনালিজমের দিকে তাকাও ... আজকে চীনে বিপ্লব হতো যদি সোভিয়েট ইউনিয়ন না থাকতো? কিউবাতে বিপ্লব হতো রাশিয়া না থাকলে? বাংলাদেশের বুক্তিযুদ্ধ সফল হতো যদি সেভেন ফ্লিট যখন বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবিত হলো তখন ক্রেমলিন থেকে যদি ধমক না দেয়া হতো? আজকের পৃথিবীটা ইউনিপুলার হয়ে গেছে ... এক প্রভূত্ব, একজন পাগলা ঘোড়া দিযে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। সেখানে আমরা যদি ইন্টারন্যাশনালিজম ডেভেলপ করতে না পারি, তাহলে পেরে ওঠা যাবে আমেরিকার সাথে? বর্তমানে আমরা কিন্তু একটা পোস্ট ন্যাশানালিস্ট পিরিয়ডে বসবাস করছি, সেই জায়গা থেকে কিন্তু আমাদের ইন্টারন্যাশনালিজমের জায়গায যেতে হবে। তা না হলে কিন্তু আমাদের মত ছোট ছোট দেশগুলো নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না।
ইস্রাফিল বাবু
(নাট্যজন, সদস্য- পালাকার)
মামুনভাই, নাটকের নাম চে’র সাইকেল কেন?
মামুনুর রশীদ
চে’র একটা মোটর সাইকেল ছিল, যেটা দিয়ে সে সারা ল্যাটিন আমেরিকা ঘুরে বেরিযেছে। তার উপর একটা ছবিও আছে মোটর সাইকেল ডায়েরি নামে। ব্যাপারটা হচ্ছে চে’র সাইকেল বলেছি, আমরা চে’র সাইকেল দিয়ে চে’র মতোই বিশ্ব ভ্রমণ করতে চেয়েছি। এই আর কি!
গোলাম মোস্তফা
(নাট্যজন, সদস্য- ঢাকা পদাতিক)
ফয়েজ জহিরের কাছে জানতে চাই, মামুনভাই নিজে যেহেতু নাট্যকার এবং নির্দেশক, কিন্তু এই কাজটিতে উনি আপনার নির্দেশনায় কাজ করেছেন ... তো কোনো প্রভাব ফেলেন কিনা? আরেকটা প্রশ্ন হলো সেট ডিজাইনের ক্ষেত্রে আপনি খড়ের ব্যবহার এবং গাছের ডালের ব্যবহার করেছেন- সেটার একটু ব্যাখ্যা করবেন।
ফয়েজ জহির
প্রথম প্রশ্নটার উত্তরে বলি, মামুনভাই হচ্ছেন নাট্যকার, নির্দেশক এবং অভিনেতা ... সংকটটা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই হাঃ হাঃ ... তো মামুনভাই যখন অভিনেতার সত্ত্বা নিয়ে কাজ করেন তখন কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু যখন নির্দেশকের সত্ত্বা নিয়ে উপস্থিত হন তখন কিন্তু কনফ্লিক্ট তৈরি হয়। উনি হয়তো ভাবছেন এভাবে কাজটা করলে ভালো হয়, আমি ভাবছি না অন্যভাবে করবো। কিন্তু যেহেতু বহু বছর একসাথে কাজ করছি সেধরনের কোনো সমস্যা আসলে হয়নি। প্রভাব পড়ে, সেটা ইতিবাচক প্রভাবই বলবো আমি। আর দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরে বলছি যে- খড়ের ব্যবহার করেছি কারণ আমাদের উৎপাদনের সাথে এটার সম্পর্কটা খুব গভীর, যেটা আমাদের জীবন ধারণের জন্যও জরুরী। অনেকে বলেছে যে খড় দেয়াতে বাংলাদেশের পটভূমির মতো লাগে ... আসলে তা না, ওখানেও একই জিনিস চাষ হয় এবং ওখানে এই খড় বা গমের খড় বেশ প্রসিদ্ধ। ওখানকার আবহ আনার চেষ্টাতেই আমি এটা করেছি।
বিপ্লব বালা
ডিজাইনটায় সব মিলিয়ে একটা বিরাণভূমির মত লাগে। কিছু জায়গায় খড় দেয়ায় ঐ ইমেজটা আবার চলে যায়। তো ডিজাইনের ইমেজটা কী ভাবছিলেন?
ফয়েজ জহির
আমাদের যেটা হয় সেটা হলো, একটা শূন্য জায়গা থেকে শুরু হয় ... সেখান থেকে ভরাট একটা জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
কামালউদ্দিন নীলু
চে’র সাইকেল-র ডিজাইনের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে ফর্ম এবং কন্টেন্টের ক্ষেত্রে পরিষ্কার ছিল যেকারণেই মামুনভাই কখনো ন্যারেটর হয়ে যাচ্ছে, কখনো এ্যাক্টর হয়ে যাচ্ছে ... এই যে ট্রান্সফরমেশনটা, এটা চমৎকার! এই ট্রান্সফরমেশনের জায়গাতেই কিন্তু বিনোদিনী-কে আমার দুর্বল মনে হয়েছে। ট্রান্সফরমেশনটা হয় না। আমি বারবার শিমূলকে দেখছি ... বিনোদিনী আমার কাছে শিমূল ইউসুফ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখন চে’র সাইকেল দেখছি যে, ন্যারেটর কথা বলছে আবার সে-ই ক্যারেক্টরে ঢুকে যাচ্ছে। খুব সিম্পলের মধ্যে ... এখানেই কিন্তু এটার মজাটা।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। আমি এবার শ্যামাপ্রেম নাটকের উপর প্রশ্ন চাচ্ছি।
পবন চক্রবর্তী
(নাট্যজন, সদস্য- পালাকার)
হিরাভাইয়ের কাছে আমার প্রশ্ন শ্যামাপ্রেম নাটকটি যখন শুরু হয়, তখন একটি গান দিয়ে শুরু হয়, ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি ...’ এবং সেটা অডিও-তে বাজানো হয়। আমরা শ্যামা সম্পর্কে যতটুকু জানি, সে নৃত্য-গীত পটীয়সী। তো আপনি গানটি শ্যামার কণ্ঠে না দিয়ে অডিও-তে দিলেন কেন? পাশাপাশি সঞ্চালককে একটি প্রশ্ন করতে চাই ... যেহেতু সঞ্চালক নিজেই আয়োজক তাই তার কাছেই জানতে চাই যে, আপনি নাটকের সাথে জড়িত সব ডিজাইনারকে মঞ্চে তুলেছেন, কিন্তু মিউজিক ডিজাইনের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে অনুপস্থিত রেখেছেন কেন?
অনন্ত হিরা
আমাদের শ্যামাপ্রেম নাটকে শ্যামার চরিত্রে যে অভিনয় করেছে সে গান জানে কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে, নাচের সাথে ও গানটা যদি গায় তাহলে নাটকের প্রথম সংলাপটা যখন বলবে, তখন সেটা ওয়ার্ক করবে না। যে কারণে ও গান জানা সত্ত্বেও আমি অডিও-তে দিয়েছি।
হাসান শাহরিয়ার
এবার সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি সঞ্চালক হাঃ হাঃ ... আসলে আমি সব ডিজাইনারকেই আনতে চেয়েছি, কিন্তু মুখোমুখি হবার মতো পরিবেশ সেভাবে তৈরি হয়েছে কিনা, সেটা আমি নিশ্চিত ছিলাম না। যেমন ধরুন, আজকে যে ডিজাইনারগণ আছেন, সবাইকে কিন্তু এখনো প্রশ্ন-ও করা হয়নি, অনেকে বসে আছেন দু-একটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে। তো আসলে যদি আপনাদের মধ্যে ডিজাইন সম্বন্ধে প্রচুর প্রশ্ন থাকে সেক্ষেত্রে তাদেরকে উপস্থিত করতে আমার কোনো সমস্যা হবার কথা না। আগামীতে অবশ্যই এই চেষ্টাটা থাকবে। ধন্যবাদ।
এবার এরশাদ কমল প্রশ্ন করবেন ... অনেকে ভাবতে পারেন যে এরশাদ কমলকে আমি হায়ার করে এনেছি, প্রশ্নকর্তা হিসেবে। আসলে আমি এমন জিজ্ঞাসু নাট্যজনই চেয়েছিলাম। ... এদিকে মামুনুর রশীদভাই আবার আস্তে আস্তে বলছেন যে, এরশাদ কমলকে সর্বাধিক প্রশ্ন করার জন্য পুরস্কৃত করতে হাঃ হাঃ ... যাক্ প্রশ্ন করুন।
এরশাদ কমল
আলোচনার শুরুতে রিপনভাই যখন বলছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের ৫১টি মৌলিক নাটক থাকা সত্ত্বেও কেন করলেন না, তখন আপনি (অনন্ত হিরা) বলেছিলেন যে আপনাদের রিসোর্স নেই বলে করছেন না। আবার ইমনভাইয়ের কথা ধরে বলছিলেন যে, আপনারা আকাশটা ছুঁয়ে দেখতে চান, ব্যর্থ হলেও ... তো এই দুটো কমেন্ট কি কন্ট্রাডিক্ট করে না?
অনন্ত হিরা
হ্যাঁ, দুটো কমেন্ট কিছুটা কন্ট্রাডিক্ট করে। আমি তো আগেই বলেছি যে, আমরা এখন প্রস্তুতি পর্যায়ে ... দলের রিসোর্স তৈরির কাজ করছি। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নের গতিটা বাড়িয়ে আমরা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের মৌলিক নাটকগুলোও ছুঁতে চাই।
জুয়েল
(নাট্যজন, সদস্য- পালাকার)
আমার একটু জানার আছে ডিজাইন নিয়ে। সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলো কেন সেই একইভাবে করছি ... একই জমিদারী ব্যাপার, একই কস্টিউম। রবীন্দ্রনাথর নাটকগুলো মর্ডানাইজ করে এখনকার সময়োপযোগী করে করা যায় কিনা? যেমন শ্যামাপ্রেম-র মালাকে আমি এইভাবে দেখতে চাই না, আমি এখনকার মালাকে দেখতে চাই ... কীভাবে দেখবো?
ফয়েজ জহির
ডিজাইনটি আসলে নির্ভর করে নির্দেশকের সার্বিক ডিজাইনের উপর। নির্দেশক যখন একটি নাটক নির্মাণ করতে মনস্থ করেন, তখন কিন্তু একটি ছক কেটে নেন, যে উনি কীভাবে দেখতে চাচ্ছেন। ঐ ভাবনার প্রতিফলনটি আনতে গেলে নির্দেশকের ভাবনার সাথে অন্যান্য ডিজাইনারদের সাদৃশ্য থাকতেই হবে। আর রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে যেটা করতে বলছেন, সেটাকে আধুনিক করা না বলে নিরীক্ষা করা বলতে পারেন। তাঁর নাটক আধুনিক না বা সমসায়িক প্রেক্ষিত তৈরি করে না, সেটা বোধহয় ঠিক না। আমরা উপস্থাপন রীতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি।
জুয়েল
হ্যাঁ, আমার ভুল হয়েছে, আমি আসলে আধুনিক শব্দটি বলতে চাইনি, নিরীক্ষাই বলতে চেয়েছিলাম।
অনন্ত হিরা
আমি এবার আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলি, যেমন ধরো, স্বদেশী নাটকটি রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায় উপন্যাস নিয়ে লেখা। এটা উনি লিখেছেন ভারতবর্ষে যখন স্বদেশী আন্দোলনটা হয়েছিল, সেময়ে। এটি একটি প্রেমের উপন্যাস ... তো সেটা এই সময়ে করতে গেলে, সেই সময়, তাদের পোষাক, তাদের আচরণ এগুলো থাকতেই হবে। আমি কিন্তু সেই স্বদেশীকে দেখছি আজকের মনষ্কতায়। আপনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাঙচুরের কথা বলছেন সেটাও করা দরকার। আমিও স্বপ্ন দেখি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাঙচুর করার, কিন্তু বিষয় থেকে কতদূরে যাওয়া যাবে বা যাওয়টা ঠিক হবে কিনা বা দর্শক কীভাবে নেবে ব্যাপারটা এটাও হয়তো ভাবছি।
ফরিদা আকতার লিমা
হিরাভাই, আপনি তো শ্যামাপ্রেম-এ নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অভিনয়ও করেছেন ... তো আপনি যখন অভিনয়ের জায়গাটায় দাঁড়ান তখন আপনাকে ডিরেক্ট করেন কে? মানে বিষয়টা কীভাবে ম্যানেজ করেন?
অনন্ত হিরা
সেটা হচ্ছে যে, করতে করতেই একভাবে দেখে নেয়া আর কি। প্রথম দিকে ডিজাইনটা যখন ডেভেলপ করি, তখন বেশিরভাগ সময় আমার বিকল্প অভিনেতা করতো আমি দেখতাম ... এরকম একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছি।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। এবার মানগুলা নাটক নিয়ে আলোচনায় যাই।
এরশাদ কমল
আমি মানগুলা নাটকের সেট এবং লাইট নিয়ে একটু বলতে চাই। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে মানগুলা-র সেট ডিজাইনটা বনপাংশুল নাটকের সেট ডিজাইন দ্বারা খুব প্রভাবিত। ভার্টিক্যাল লাইন যেটা ক্রিয়েট করা হয়েছে, পুরো মঞ্চ জুড়ে, সেটা অলমোস্ট বনপাংশল-র মতোই। মুকুলভাইকে বলছি যে, আপনি আগেই বলেছেন যে আপনি বনপাংশুল দেখে মুগ্ধ ... তো ঐ মুগ্ধতা থেকেই এটা করা কিনা?
হাসান শাহরিয়ার
আমি প্রথমে উত্তর দিতে বলছি সেট ডিজাইনারকে, পরে যদি বলার থাকে তো মুকুলভাই বলবেন।
এস এম রিয়াদ তুষার
(নাট্যজন, সেটা ডিজাইনার- মানগুলা)
এই নাটকের গল্পটা যখন আমি জানলাম এবং পড়লাম, তারপর নির্দেশকের সাথে বসলাম, তিনি তার কিছু রিকোয়্যারমেন্ট-এর কথা বললেন এবং উনি যেভাবে প্রেজেন্ট করতে চাচ্ছেন ... সেটাকে আমি মাথায় রেখে এগুলাম। উনি যতটুকু স্পেস যেখানে চেয়েছেন, আমি সেগুলোও মাথায় রেখেছি। আমি যখন সুসং দূর্গাপুর গেলাম, গিয়ে দেখি সেখানকার পাহাড়, পাহাড়ের ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতা, কালার সবই আমি মাথায় নিয়েছি। আমি তারপর আমার মতো করেই ডিজাইনটা দাড় করিয়েছি। এখন অন্য কোনো ডিজাইনের সাথে মিলে গেছে কিনা, সেটার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না।
আমিনুর রহমান মুকুল
আমি জানি না, আপনার (এরশাদ কমল) বনপাংশুল ভালোভাবে মনে আছে কিনা ...
এরমাদ কমল
বনপাংশুলে-ও কিন্তু উপরে ওঠার জন্য একটা সিঁড়ি, যেটি দিয়ে বানর উপরে উঠে যায় ...
আমিনুর রহমান মুকুল
ওটা ছিল মই, আর আমাদের ডিজাইনে স্পষ্টতই একটা স্লোপ নেমে এসেছে ...
সাইদুর রহমান লিপন
বনপাংশুল নাটকের সেট থেকে এটা ফার ফার ডিফারেন্ট। এটাতে স্পষ্টতই তিনটি লেয়ার ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি বনপাংশুল-এ ছিল না। আমার মনে হয় এধরনের প্রশ্ন মিসগাইড করে দর্শককে, এধরনের প্রশ্ন না করাই ভালো।
গোলাম নবী
(নাট্যদর্শক)
দুই ঘন্টার মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের যে কাহিনী দেখানো হয়েছে, আমার কাছে সেটা খুবই ভালো লেগেছে ... বিশেষ করে সঙ্গীত, এটা দুমাস পরে পরেই হোক আর একবছর পরেই হোক যেন নিয়মিত যেন হয় সেটাই চাই। আমি নাট্যবোদ্ধা নই। আপনাদের কাজ আমার ভালো লেগেছে, সেটাই জানালাম। ধন্যবাদ।
মামুনুর রশীদ
আমি মানগুলা দেখিনি, তাই কোনো মন্তব্য করছিলাম না। তবুও একটা কথা বলি যে, নাট্যকার ও নির্দেশক বলছিলেন যে- একটা সম্প্রদায়কে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন এই নাটকের মাধ্যমে ... আমার কথা হচ্ছে এই দায় কিন্তু আমাদের না, পরিচয় করে দিতে হয় না, পরিচয় হয়ে যায়। নাটকটি যদি দর্শক গ্রহণ করে এবং সেটা যদি নাটক হয়ে ওঠে তাহলে ডেফিনিটলি পরিচয়টা হয়ে যায়। আমাদের প্রধান টার্গেট থাকবে সেই সম্প্রদায়ের ইতিহাসে কোনো নাট্যউপাদান আছে কিনা, সেটা বের করা। আমিও কিন্তু সাঁওতালদের নিয়ে একটা নাটক করেছি রাঢ়াঙ, তো সেখানে কিন্তু আমি ঐ সম্প্রদায়কে পরিচয় করিয়ে দেবার দায় থেকে করিনি, তাদের জীবনের কোনো না কোনো অংশ বা ইতিহাস আমার কাছে থিয়েট্রিক্যালি ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে, তাই করেছি। চে-কে থিয়েট্রিক্যালি ইন্টারেস্টিং চরিত্র মনে হয়েছে বলে করেছি। এটা শুনতে নিষ্ঠুর মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে কেবল পরিচয় করিয়ে দেবার দায় আমার মনে হয় থিয়েটারকর্মীদের নেই।
আলী মাহমুদ
(নাট্যজন, সদস্য- দৃশ্যপট)
মামুনভাইয়ের কাছে জানতে চাই আপনি এইমাত্র বললেন যে কোনো জনগোষ্ঠীকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়টা আমাদের নেই, তাহলে চে’র সাইকেল আর রাঢ়াঙ করেছেন কোন দায় থেকে?
মামুনুর রশীদ
না না, দায় তো শিল্পের প্রতি বা আমার নিজের কাছে নিজের দায় তো আছেই। আমি একটা জাতিগোষ্ঠীর সংগ্রামটাকে তুলে ধরতে পারি কিন্তু তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাচ্ছি- এই সাউন্ডটা ভালো না, সেটা বলছি। আমার অবশ্যই দায় আছে হাজংদের সংগ্রামী জীবন মঞ্চে নিয়ে আসার, আমার অবশ্যই দায় আছে আলফ্রেড সরেনের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড দর্শকদের সামনে তুলে ধরার কিন্তু একটি জাতিগোষ্ঠীর কত ধরনের জীবন সংগ্রাম আছে, আমি কি পারবো সেটা তুলে ধরতে?
আলী মাহমুদ
মামুনভাই, আমি চে’র সাইকেল নিয়ে বলতে চাই, সেটা হলো চমৎকার একটি নাটক, আমার খুব ভালো লেগেছে ... কিন্তু চে-কে মাঝে মাঝে ‘মামুনুর রশীদ’ ডিস্টার্ব করেছে। চে’র যে পোর্ট্রেটটা আসা উচিত ছিল মঞ্চে, সেখানে ডিস্টর্ব ফিল করেছি ...
হাসান শাহরিয়ার
চে’র সাইকেল-র জন্য বরাদ্দকৃত সময়ে প্রশ্ন না করে এখন করা হচ্ছে কেনো, এতো পিছিয়ে থাকলে হয়? যাক্ , মামুনভাই মন্তব্য করুন।
মামুনুর রশীদ
হতে পারে, তাহলে এটাকে আমার অতিক্রম করা উচিত, আমি চেষ্টা করবো।
কামালউদ্দিন নীলু
মামুনভাই, নাটকটার ধরনই কিন্তু গল্প বলার। মামুনুর রশীদকে আমি চে’ হিসেবে দেখতে চাইনি ... মামুনুর রশীদ যদি চে’ হয়ে যেতেন, তাহলে আমি কিন্তু মেনে নিতে পারতাম না। মামুনুর রশীদ এখানে চে’র অভিনয় করছেন- এই এ্যাঙ্গেল থেকে দেখা উচিত বলে মনে হয়।
পিকলু বকশী
(নাট্যজন, সদস্য- দৃশ্যপট)
আমি চে’র সাইকেল- নাটক নিয়ে একটু বলতে চাই, যদি না সঞ্চালক ভাবেন যে আমি নিয়ম ভঙ্গ করছি-
হাসান শাহরিয়ার
না, অলরেডি ভেঙে দেয়া নিয়মের আর নিয়ম ভঙ্গ হবে না হাঃ হাঃ ...
পিকলু বকশী
আমি চে’র সাইকেল দেখে ভেবেছিলাম, এটা চে’র জীবন চক্র, মানে ‘সাইকেল’ বলতে আমি ‘চক্র’ বুঝেছিলাম, এখন মামুনভাই বলছেন, এটা চে’র ঘুরে বেড়ানোর বাই-সাইকেল। তো আমি কি তাহলে ভুল বুঝলাম?
মামুনুর রশীদ
না না, তুমি ঠিকই আছ। একই কথা, আমরা চে’র জীবন চক্রের মধ্য দিয়েই ঘুরতে চাই।
হাসান শাহরিয়ার
এবার আমরা মেটামরফোসিস নিয়ে আবার প্রশ্ন চাইছি। আমার মনে হয় দিলীপ চক্রবর্তীর একটি পেন্ডিং প্রশ্ন ছিল, প্লিজ, আপনি করুন।
দিলীপ চক্রবর্তী
নীলুভাইয়ের কাছে আমার জানার আছে, সেটা হলো- আপনি মঞ্চে দুজন শিল্পীকে ব্যবহার করেছেন, যারা পেছনে বসে মিউজিকের কাজটি করেন। তাদেরকে আমরা বেশিরভাগ সময়ই দেখি ধ্যানী অবস্থায় ... নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট যন্ত্রটি প্লে করে আবার চুপচাপ ধ্যানী অবস্থায় চলে যান ... তো এই ভাবনাটা কেন? দ্বিতীয়ত- একজন অভিনেতা বাবা, মা, বোন, অফিসের কেরানী ... সবার সংলাপই দিচ্ছেন। কিন্তু যখন কেরানী বা বাবার সংলাপ দিচ্ছেন, তখন কস্টিউম চেঞ্জ করে একেবারে ঐ চরিত্রের হয়ে যাচ্ছেন, আর মা-বোনের বেলায় হচ্ছেন না ... কেন?
কামালউদ্দিন নীলু
এই কাজটা খেয়াল করেছেন হয়তো যে, আমি জাপানীজ নো থিয়েটার ব্যবহার করেছি। এবং অন্য থিয়েটার দিয়ে প্রভাবিত হওয়ার ব্যাপারে আমি মোটেও কৃপন নই। রবীন্দ্রনাথও ইবসেন, লালন বা আইরিশ মিউজিক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আমার কাছে মেটামরফোসিস যে ধরনের নাটক মনে হয়েছে, তাতে করে আমি চিন্তা করেছি নো থিযেটারের আশ্রয় নেয়ার। সেখানে মিউজিক যেন কোথাও ডিস্টার্ব না করে, গল্পটাকে। দুজন মিউজিশিয়ান যদি নড়াচড়া করতো তাহলে দর্শকের চোখ ওদিকে চলে যেত। আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই যে- মিউজিশিয়ান দুজন কিন্তু এক্সপ্রেশনলেস। নো থিয়েটারের মূল জায়গাটাই কিন্তু এক্সপ্রেশনলেস। দ্বিতীয়ত- অভিনয়ের কথা যেটা বললেন সেটা হলো, এই চরিত্রটা কাফকারই রিফ্লেকশন। কাফকা নিজে কথাগুলো বলছে, তার মনের কথাগুলো বলছে, মনের সাথে বলছে। এবং সেখানে সে কখনো গল্পকার হয়ে যাচ্ছে ... কাহিনীটা বলে যাচ্ছে, আবার কখনো সে ক্যারেক্টরে চলে যাচ্ছে। সেকারণে আমি ইচ্ছা করেই অতিরিক্ত কস্টিউম ব্যবহার করিনি। এবং এখানেই নিরীক্ষার ব্যাপারটা চলে আসে ... কীকরে মুহূর্তের মধ্যে ইলিউশনটা তৈরি হয় এবং মুহূর্তের মধ্যে তা ভেঙে যায়। এবং একটা চরিত্র কিছু ছাড়াই তার ভঙ্গি, তার এক্সপ্রেশন কীকরে আপনাকে মেক-বিলিভ ঘটাতে পারে। থিয়েটারের মূল জায়গাটাই হচ্ছে ভেরাইটি এন্ড ভেরিয়েশন ... লাইনটা ভাঙতে হবে ... এজন্যই এভাবে করা।
বিপ্লব বালা
আচ্ছা হিউম্যান রিলেশনের ক্রাইসিসের জায়গাটা বাদ দিলেন কেন? মূল গল্পের আসল ব্যাপার তো হলো তার পারিবারিক ক্রাইসিসের জায়গাটা, পুঁজিবাদ যে অফিসের বসের সাথে এধরনের সম্পর্ক তৈরি করে সেটা আমরা বুঝি, কিন্তু তার বাবা-মা-বোন-ও যে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সেটা ছিল পরের অংশে ... তো সেগুলো বাদ দিয়ে কি মেটামরফোসিস সম্পূর্ণ হলো?
কামালউদ্দিন নীলু
আমি সে জায়গাটায় যেতে চাইনি, আসলে আমি ছোট্ট একটা জায়গা থেকে ধরতে চেয়েছি ... পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় একটা মানুষ কীভাবে একেবারে ইন্ডিভিজ্যুয়াল হয়ে যায়, সে জায়গাটা।
বিপ্লব বালা
হ্যাঁ, কিন্তু সেখানে হিউম্যান রিলেশনের ক্রাইসিসের জায়গাটা ধরতে পারলে আরো বেশি সমগ্রতা পেত না?
কামালউদ্দিন নীলু
ঐ ক্রাইসিসটা কিন্তু কোনো না কোনোভাবে চলে এসেছে। আর আমি মেটামরফোসিস-এর সবটা করিনি। কেবল ট্রান্সফরমেশনের অংশটা করেছি। আসলে আমি আগেই বলেছি এটা এক্সপেরিমেন্ট ... আমার অভিনেতাদের জন্য এবং আমার নিজের জন্য ... তারপর এটা হচ্ছে একটা ক্লাশ অব অডিয়েন্সের জন্য করা।
হাসান শাহরিয়ার
আমরা একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শেষ প্রশ্নটি করবেন রতন দেব। নীলুভাইকে অনুরোধ করবো সংক্ষিপ্ত উত্তর দেবার জন্য।
রতন দেব
নীলুভাইয়ের শেষ কথা দিয়েই শুরু করি ... আপনি যে নির্দিষ্ট ক্লাশ অব অডিয়েন্সের কথা বললেন, আমি কিন্তু সেই ক্লাশ বিলং করি না। তবুও নাটকটা আমি বুঝতে পেরেছি এবং ভালো লেগেছে। আপনি অডিয়েন্সের সাথে ইন্টারেকশনের ডিজাইনের কথা বলেছেন, কিন্তু অডিয়েন্সে সেই পরিমান লাইট আপনি দেননি। এটা কেন?
কামালউদ্দিন নীলু
না, অডিয়েন্স যখন অভিনয়ে ঢুকে যায়, তখন কিন্তু লাইট পায়। আর একটা সমস্যা হলো আমরা যে অডিটোরিয়ামে এই কাজটি করি, সেটি কিন্তু ফরমাল অডিটোরিয়াম না, ফলে লাইটের এ্যাঙ্গেল কিন্তু ঠিক মতো ফেলতে পারি না। ধন্যবাদ।
হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। আমরা অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। নাটকের ডিজাইনারদের নিযে এই প্রথমবারের মতো এধরনের অনুষ্ঠান করলাম, ফলে কিছু ভুল-ত্রুটি থেকে গেছে ... যেমন আমরা উপলব্ধি করলাম যে, পাঁচটি নাটক নিয়ে আলোচনা করায় একেক নাটকের পেছনে সময় দিতে পেরেছি কম। তাই আরো কম নাটক নিয়ে অনুষ্ঠানটি করা যেতে পারে। আমরা মার্চ ২০০৬ মাসে জুলাই-ডিসেম্বর ২০০৫ এর মধ্যে যে সমস্ত নতুন নাটক ঢাকার মঞ্চে আসবে সেগুলোকে নিয়ে এধরনের আলাপনের ইচ্ছা রাখি। সেক্ষেত্রে যদি বেশি নাটক হয় চেষ্টা করবো দুদিনে মুখোমুখি হওয়ার। সব কিছুই নির্ভর করছে নাট্যদর্শক যারা আছেন, আপনাদের সহযোগিতার উপর। তবে এ কথা কৃতজ্ঞচিত্তে বলতে পারি যে থিয়েটারওয়ালা যখনই এধরনের মুখোমুখির উদ্যোগ নিয়েছে, তখনই আপনারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ... আশা করি ভবিষ্যতেও দেবেন। শিল্পকলা একাডেমীর সাথে জড়িত সবাইকে, বিশেষ করে আজকের এই সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও যারা আমাদের অনুষ্ঠানকে সার্থক করবার জন্য সহযোগিতা করেছেন তাদেরকে সকল থিয়েটারকর্মীদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। সবাইকে ধন্যবাদ।