Full premium theme for CMS
শিকড়ের হোক ডানা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
গত ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিট্যুট (আইটিআই), বাংলাদেশ কেন্দ্র আয়োজিত আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসব ও সেমিনার। উৎসবের স্লোগান ছিলো ‘শিকড়ের হোক ডানা’। দেশ বিদেশের বহু প্রতিনিধির অংশগ্রহণে আনন্দমুখর এই আয়োজন প্রশ্নাতীতভাবেই প্রশংসনীয়। বাংলাদেশে আয়োজিত নাট্যবিষয়ক যেকোনো উৎসবের এটা ছিলো কলেবর সমৃদ্ধ ও সফলতম আয়োজন। থিয়েটারওয়ালা’র পক্ষ থেকে আয়োজকদের জানাই অভিনন্দন।
সেমিনারে তিনটি বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। বিষয়গুলো ছিলো- ‘দেশজ নাটকের অস্তিত্বের সংকট’, ‘দেশজ নাটক: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ এবং ‘নতুন সহস্রাব্দে দেশজ নাটক’ (ইংরেজীতে বিষয়গুলো ছিলো যথাক্রমে- IndigenousTheatre: The Problem of Survivial, Indigenous Theatre: Uses & Abuses, The State of Indigenous Theatre in the New Millennim). দেশ বিদেশের নবীন ও প্রবীণ নাট্যজনেরা উপস্থাপন করেন এই প্রবন্ধগুলো। ইনডিজেনাস থিয়েটারের বাংলা অর্থ করা হয়েছে- ‘দেশজ নাটক’। কেউ কেউ দেশজ নাটককে লোকজ নাটক বলে উল্লেখ করলেও, মূলত তাঁরা বলতে চেয়েছেন দেশজ নাটক সম্পর্কেই। দেশজ নাটক বলতে আলোচকবৃন্দ ব্যাখ্যা করেছেন- কোনো দেশের জীবন জনপদ নিয়ে সে ভাষায় রচিত মৌলিক নাটক, তা সে শহর কিংবা গ্রামীণ যে জনপদেই হোক না কেনো। এই নাটকসমূহে প্রতিফলিত হয় বিচিত্র মানুষের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, মানবীয় বিশ্বাস ও দ্বন্দ্বসমূহ।
কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় ইনডিজেনাস থিয়েটারকে যদি ‘দেশজ নাটক’ বলি তবে স্পষ্টতই ফর্ম-এর পরিবর্তে কনটেন্ট-এর ধারণা আমাদের চোখে ভাসে। আমাদের কাছে ‘থিয়েটার’ শব্দটি যেভাবে ধরা দেয়, ‘নাটক’ শব্দটি সেভাবে ধরা দেয় না। ‘থিয়েটার’ বলতে যেখানে ত্রিমাত্রিক স্থান, অভিনেতৃ এবং দর্শকের সমন্বয় বুঝি, সেখানে ‘নাটক’ বলতে কেবল একটি টেক্সট এবং তার ভেতরকার দ্বন্দ্বকেই বুঝি। তো এই অস্পষ্টভাব থেকেই আলোচনাগণ একসময় দেশজ নাটকের ফর্ম নিয়ে আলোচনা করেছেন, আবার কখনো কখনো দেশজ নাটকের কনটেন্ট-এর কথা বলেছেন। সেদিক থেকে ‘ইনডিজেনাস থিয়েটার’-এর ভাবার্থ ‘দেশজ থিয়েটার’ করলে মনে হয় প্রকৃত বোধের অনেক কাছাকাছি যাওয়া যেত।
সেমিনারের বিষয় নির্বাচনে একথা স্পষ্ট, ‘দেশজ থিয়েটার’ আজ অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত। অনেকে এই সংকটকে তেমন গুরুত্ব দিতে অনিচ্ছুক। তাঁদের বিশ্বাস, দেশজ থিয়েটার তার ভেতরের নান্দনিক ও প্রায়োগিক শক্তির জোরেই এক সময় এই সংকট কাটিয়ে উঠবে। এই যে দেশজ থিয়েটারের সংকট, এখানে ‘দেশজ’ বলতে কি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অস্তিত্বের আলোকে কথা বলা হচ্ছে? অর্থাৎ একটি দেশের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে সৃষ্ট বা উৎপন্ন বা উৎসাহিত থিয়েটারের কথা বলা হচ্ছে? যদি তাই হয়, তবে আমাদের দেশের যে অসংখ্য ফর্ম- যাত্রাপালা, কবিগান, পাট, হাস্তর, কথকতা, আর কবির লড়াই, ঘাঁটু, পাঁচালী, জারীগান, ভাসান, আলকাপ কিংবা ঢপ, গম্ভীরা, লাাঠিখেলা, পুতুল নাচ ইত্যাদি গ্রামীণ জনপদের নাট্য-আঙ্গিক- এই ঐতিহ্য এক-দুই দশকের নয়, হাজার বছরের- এই হাজার বছরের বাংলা থিয়েটারের ঐতিহ্যের গর্বিত অংশীদার কেবল বাংলাদেশের বাঙালিরাই নন, ভারতবর্ষের সকল বাঙালি। সেই অর্থে বাংলাদেশিরা যাকে দেশজ থিয়েটার বলছেন, ঠিক সেই আঙ্গিকগুলোকে কি পশ্চিমবঙ্গ কিংবা আগরতলাবাসীরাও দেশজ থিয়েটার বলবেন? সেমিনারের প্রবন্ধের বিষয়ের কোথাও কিন্তু ‘বাংলাদেশের দেশজ থিয়েটার’-এর কথা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। বিষয়গুলো মূলত আর্ন্তজাতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার দেশিয় প্রেক্ষাপটের আলোকে সবাই সফল আলোচনা করেছেন বলেও বোধ হয়নি। নতুবা ভারতের (পশ্চিমবঙ্গের) প্রতিনিধিবৃন্দ সেদেশের নানা জাতির যে নানা সংস্কৃতি, এবং সেই সংস্কৃতি থেকে উৎপন্ন যে থিয়েটার তার বিশদ আলোচনায় না গিয়ে কেবল বাঙলা থিয়েটারের মধ্যে তাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখলেন কেন? তারমানে কি এই নয় যে, পন্ডিচেরী কিংবা মাদ্রাজ বা হায়দ্রাবাদের ঐতিহ্যগত- সেখানকার ভূমি থেকে সৃষ্ট থিয়েটার, পশ্চিমবঙ্গের নাড়ীর সাথে সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থ? সেদিক বিবেচনায় দেশজ থিয়েটার কি ‘দেশজ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে?
‘ফর্ম’ আসলে ভূমির টান, নাড়ীর টান আর ‘কনটেন্ট’ সর্বত্রগামী। সুতরাং স্পষ্টই বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ঐতিহ্যগত থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখবে সেই ভূখণ্ডের জনগণ। কিন্তু ‘ভূখণ্ডের’ আয়তনের ব্যাপারে আবেগের প্রশ্রয় সমীচীন নয়। আমাদের দেশের ভূখণ্ডের আয়তন এতো ছোট যে, আমরা সহজেই দেশের সকল ‘ফর্ম’কে ‘আমাদের ফর্ম’ বলে চালিয়ে দিতে পারি (কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায়- চাকমাদের থিয়েটারের ফর্ম কি গারোদের ফর্মের সাথে এক নাড়ীতে মিলবে?), কিন্তু পৃথিবীতে বহু বড় আয়তনের রাষ্ট্র আছে যেখানে শত শত ভিন্ন জাতিসত্তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। এবং এই ভিন্ন জাতিসত্তার, ভিন্ন ভিন্ন ভাষার যে ভিন্ন ভিন্ন থিয়েটার, তা এক নাড়ীর টানে সাড়া না-ও দিতে পারে। সে-ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সমস্ত থিয়েটারকে ‘দেশজ থিয়েটার’ কিংবা একই ঐতিহ্যগত নাট্য-আঙ্গিক বলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা ভেবে দেখার বিষয়। সেদিক বিবেচনায় ‘ইনডিজেনাস থিয়েটার’কে ‘স্থানীয় থিয়েটার’ বললে বোধহয় ভাবার্থে আর কোনো সমস্যা থাকে না।
এখন প্রশ্ন আসে এই স্থানীয় থিয়েটারের অস্তিত্বের সংকট নিরসন করবে কে? এর উত্তরে বলা যায়, নিরসন করবে একাধারে স্থানীয় জনগণ ও রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব তার ভূখণ্ডের সকল ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা। এই ঐতিহ্য টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করছে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা বসবেন তাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের তথা উদ্দেশ্যের উপর। সুতরাং এখানেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটাই বিবেচ্য বিষয় হয়ে রইলো।
হাসান শাহরিয়ার
জুন, ২০০১
সোবহানবাগ, ঢাকা।