Full premium theme for CMS
পিটার বিকসেলকে যেভাবে পাঠ করলাম
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
গ্রন্থটি যেভাবে পেলাম
খুব নিকট বন্ধুরাও আমার সম্পর্কে এ কথা বলতে চাইবেন না যে, আমি খুব নিয়মিত পড়ুয়া গোছের মানুষ। তারপরও এক-আধজন অত্যুৎসাহী আছেন যাঁরা অন্যদের পড়তে পরামর্শ দেবার, মুখে মুখে সম্ভাব্য একটা পাঠ্যসূচি বানিয়ে দেবার ছোটখাট সুযোগগুলোও কখনোই হাতছাড়া করেন না। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিপদজ্জনক (জ্ঞানের দৃষ্টিকোণ হতে মহত্তম) হচ্ছেন যাঁরা পরামর্শের পর কেতাবখানা গছিয়ে দেন, এমনকি হাতে সময়-সুযোগ থাকলে পুস্তকটা/ লেখাটা কেনো গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাবার জন্য অংশবিশেষ পাঠ করেও শোনান- আপনার ভালো লাগবে এই ভেবে, কলাকাতায় আমার এই রকম একজন বন্ধু আছেন। পিটার বিকসেলকে আমি ওঁর কাছ থেকে জানি (শুনিও বটে)। বইটাও গছিয়ে দেন তিনি, বাংলায় অনুবাদ হওয়া গল্পসংগ্রহ’, চিরকারের জন্য গছিয়ে দেন, এবং নিঃশর্তে। বন্ধু যুগলের নিজস্ব মালিকানার সামগ্রী এরকম হাতে পেয়ে যাওয়াতে আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু মধ্যরাতে তাঁর কণ্ঠে এই পুস্তকের নিবিড় পাঠ সত্বেও, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, বিকসেলের সত্যকার মাজেজা টের পেয়েছিলাম কলকাতা হতে ফিরে আসার পর, ধীরে ধীরে এবং ক্রমাগত বেশি বেশি।
বিকসেলকে পাঠ
আমি সাহিত্যের শিক্ষার্থী নই। হয়ে উঠবার যে অপ্রাতিষ্ঠানিক সুযোগুলো ছিলো তা বাজে ছাত্রের মতা নষ্ট করেও ফেলেছি। কিন্তু পিটার বিকসেলকে পাঠ করবার দুর্দান্ত অনুভূতি এবং প্রয়োজনবোধ থেকেই এই লেখার তাগিদ। বিশেষ করে সেই সময়কালে, যখন পশ্চিমা সাহিত্য পাঠের মানে পরিসীমিত হয়েছে কতগুলো ‘নান্দনিক’ লেখালেখি পড়ে নিজেদেরকে বিলেতি বানাবার প্রক্রিয়ায় সামিল করে ফেলা। কিন্তু এই বিশেষ পরিসরে এটাও খেয়াল রাখতে হচ্ছে যে, নাট্য বিষয়ক একটা পত্রিকায় কোনো সাহিত্যিককে পরিচয় করিয়ে দেবার যুক্তিযুক্ত হেতু থাকা প্রয়োজন।
বিকসেলের পল্পগুলো বাস্তব নয়, কিন্তু প্রখর বাস্তাবতাবাদী। ফলে ওর গল্পের চরিত্রগুলো তীক্ষ্ণ ও জটিল, বহুমুখী মনোভঙ্গির আধার, পরস্পরের সঙ্গে তির্যক যোগাযোগ বজায় রেখে গভীরভাবে উদ্দেশ্যমুখীন। এই বৈশিষ্ট্যসমূহের মাঝে সংমিশ্রিত না হলে কিছুতেই বাস্তবতাকে উপস্থাপন সম্ভব হয় না, বিশেষভাবে গল্পরেখা যেহেতু বাস্তব নয় (সেটা এই অর্থে: গল্পের সূত্র আধুনিককালের যুক্তিশীলতা অনুশীলন করে না, বৈজ্ঞানিক নিমিত্ত বা scientific reason নির্ভর নয়)। কিসসা-কাহিনীর (অ)যুক্তিশীলতাকে, সেখানে, ছাপিয়ে যায় চরিত্রসমূহের তীক্ষ্মতা আর তির্যকতা। পষ্টাপষ্টি বাস্তব জীবনের ফাঁপাত্বকে তা বিদ্রপ করে, এস্টাব্লিশমেন্টকে আর তার উৎপাদিত জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে। আবার এই কর্মকা-গুলো চরিত্রসমূহের উপায় বা mean নয়, চূড়ান্ত বিচারে তা গল্পকারের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। এই মোকাবিলাকরণ খোদ গল্পের প্রাণ আর চরিত্রসমূহ নিবিড় টানাপোড়েনে ‘অবাস্তব’ কাহিনীসূত্রের মধ্য দিয়ে গভীর বাস্তবতাকে নাঙ্গা করছে। সেই প্রক্রিয়া গল্পগুলোকে, মানে বিক্সেলের গল্পের নাট্যময় জায়গা, সম্ভবত।
নাট্যকারীদের জন্য বিকসেলের গল্পের চরিত্রসমূহ একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই ভাবনাটাও বোধহয় একটা স্থূল পাঠ- অন্তত সে বিষয়ে সতর্ক থাকা আমার লক্ষ্য। গল্পের চরিত্রকে প্রেক্ষাপট বিযুক্ত করে ভাবার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু যে জিজ্ঞাসাটাতে আমার ধন্দ লেগেই থাকে তা হচ্ছে- এই প্রেক্ষাপটটা কিসের- সহজভাবে জিজ্ঞাসা খাড়া করলে- গল্পের না সমাজের? এখানে, আমার পর্যবেক্ষণ হ’ল গল্প আর সমাজকে পৃথক করে দেখার রেওয়াজ চালু আছে। এবং এধরনের কথা বলাও যথেষ্ট নয় যে ‘সাহিত্য সমাজর দর্পন’। খুবই ফাঁপা এবং মানেহীন বক্তব্য। কোনো একটা গল্পের প্রেক্ষাপটকে আসলে খোদ সমাজের প্রেক্ষাপট হিসেবেই অনুধাবন করা দরকার। খুবই সাদামাটা কথা এটা। কিন্তু এটাকেই জোর দিয়ে পুনরায় বলবার কারণ আছে যে, গল্পের প্রেক্ষাপট আসলে সামাজিক সম্পর্কের জালবিন্যাস আর সামাজিক অস্তিত্বের ঘোষণাদানকারী। বাস্তবতার মানেও বোঝা সম্ভব সেখানেই- ঐ সামাজিক সম্পর্কের আর অস্তিত্বের মধ্যে, যে দুটো আবার গভীরভাবে সম্পর্কিত। এভাবে বিকসেলকে পাঠ করা সাহিত্যের শিক্ষার্থী-পাঠকের কাছে অর্থবহ হয়েও ওঠে।
আমার মাস্টারী পেশা আর বাস্তবতাবাদের মুখোমুখি
মাস্টারীতে আমার অভিজ্ঞতা বেশিদিনের নয়- কয়েক বছরের। এই সময়কালে, কাগজে কলমে সামাজিক বিজ্ঞানের মাস্টার হলেও, কয়েক দফা সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হবার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। সেটাও কাগজে কলমে সামাজিক বিজ্ঞান পড়ানো। এই কাজটি করতে গিয়ে, খুব স্বাভাবিকভাবেই, একাধারে একটা দুর্দমনীয় জিজ্ঞাসায় এবং একটা দুরতিক্রম্য সমস্যায় পড়তে হয়েছে আমাকে। জিজ্ঞাসাটা হ’ল সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা সমাজকে দেখেন কিভাবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিসমূহের এবং পাঠপদ্ধতিসমূহের মধ্যে ভিন্নতা- পার্থক্যকে ভুলে গিয়ে প্রসঙ্গ সয়লাব করে না ফেলেও খেয়াল রাখা দরকার যে, আধুনিক সত্ত্বা গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়ের- সাধারণভাবে শিক্ষায়তনের- চর্চায় বিশেষ শাস্ত্রীয় পরিমণ্ডলের (ডিসিপ্লিনারি বাউন্ডারি) বিশেষ কিছু দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ ধরনের প্রভাব রাখে। উল্লেখ করা দুরতিক্রম্য সমস্যাটি কিছু জটিল প্রকৃতির। সেটি সম্পর্কিত হচ্ছে: প্রথমত, সাহিত্য পাঠের সামাজিক ওজনে ইংরেজি সাহিত্য এবং বাংলা সাহিত্যের বিস্তর ফারাকের সাথে, দ্বিতীয়ত, ইংরেজি সাহিত্য পাঠের অর্থ ইংরেজি ভাষার বিশ্বব্যাপী দাপটের সাথে ‘নিজ’কে গভীরভাবে সম্পর্কিত করতে পারায় পরিসীমিত হয়ে পড়বার সাথে, তৃতীয়ত, ঔপনিবেশিক দাসত্বের শিক্ষা কাঠামোর যা কিছু দৃশ্যমান ও অন্তর্নিহিত প্রকল্প পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাতেই বিদ্যমান আছে- ঐতিহাসিকভাবেই তার ধারক হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যের উচ্চকিত ভূমিকার সাথে। সারকথায় এটা একটা শক্ত মোকাবিলার পরিস্থিতি। কিন্তু এই পুরো মোকাবিলার পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা অভীধায়, ভিন্ন একটা সংকটের মধ্যে, ভিন্ন একটা দার্শনিক জিজ্ঞাসার মধ্যে দেখতে চাই আমি। সেটা হচ্ছে : বাস্তবতার সমূহ স্থূল পাঠ বা কপট বাস্তবতাবাদ।
সিউডো রিয়েলিজমের একটা সাদামাটা উদাহরণ ধরে এগোনো যেতে পারে। ধরা যাক, ‘কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার’। আমিরিকান ভূখণ্ডটি যে কলম্বাস আবিষ্কার করেছিলেন- এই আকর ইউরোমনস্ক জ্ঞানটি অন্যান্য জিজ্ঞাসার কিংবা যুক্তির নির্ধারক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে পাঠকক্ষে আমেরিকান ভূখণ্ডের ইতিহাস সংক্রান্ত কোনো জটিল জিজ্ঞাসা উপস্থাপন করা মাত্রই তা পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে ‘কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার’ করার প্রসঙ্গটি ‘সঠিক না বেঠিক’ তার মধ্যে। আর এটা কোনো জিজ্ঞাসু অনুশীলনে ভালোরকম ঝামেলা সৃষ্টিতে সক্ষম। আমি আরজ করতে চাই যে, ‘সঠিকত্ব’ নির্ভর বাস্তবতার চর্চা লেখাপড়াকে, বিশেষভাবে সাহিত্যের লেখাপড়ার কথাই হচ্ছে এখন, নাদুগোপাল বানিয়ে ছাড়ছে। ‘সঠিকত্ব’ বা ‘সত্যতা’গুলো চেনাজানা এবং বিশেষ দাপটের সাথে প্রতিষ্ঠিত। কোনোভাবে সেই প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া নিয়ে উপস্থাপন দুরূহ একটা ব্যাপার। এ কথা ভাবাই/ভাবানোই বিশেষ কঠিন হয়ে যায় যে ‘সঠিকত্ব’ বা ‘সত্যতা’ একটা গড়ে তোলা জ্ঞান, আর এই গড়ে তোলা জ্ঞানই জড়ো হয়ে সক্ষম-শক্তিশালী হয়ে ওঠে- এতটাই শক্তিশালী যে এর ভিত্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা তোলাই আর সহজ থাকে না। গড়ে তোলা ‘সত্যতা’র ওপর নিবিড় আস্থা শিক্ষাজগতে এক পোক্ত সমস্যা তৈরি করেছে। শিক্ষাজাগতিক মানুষজন (শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক) ইতিহাসের সাধারণ পাঠ করেছেন (এবং অন্যরা পাঠ দাঁড় করাচ্ছেন- কিতাবে কিংবা বক্তৃতায়) ঐ সত্যগুলোর ওপর ভর করে। তাঁরা, সাধারণত, যুক্তি সাজাচ্ছেন ঐ সত্যগুলোর ওপর আস্তর লাগিয়ে। সিধে কথায় আরোহী পদ্ধতির (ইনডাকটিভ মেথড) মহোৎসব- অনায়াস এবং সুবিধাজনক।
আমেরিকানিজমের বাস্তবতা আর ‘আমেরিকা ব’লে কোনো দেশ নেই’
উপরের আলোচনায় যে প্রেক্ষাপটটা বলা হ’ল সেটা বলে নেবার সুবিধে আছে কিছু। কারণ, এই অবস্থার মধ্যেই পিটার বিকসেল এবং ওর গল্প আমায় টানে। বাস্তবতার এই মোটাদাগী পঠনই কিন্তু আমাকে বিকসেল নিয়ে ভাবতে উৎসাহ যোগায়। এই সুবাদেই সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের কাছে এই গল্পকারের লেখা তুলে ধরি। অন্তত তিনটা গল্প পাঠ করি আর তা নিয়ে ভাবতে বসি আমারা। ‘আবিষ্কারক’, ‘টেবিল হ’লো টেবিল’ এবং ‘আমেরিকা ব’লে কোনো দেশ নেই’। বোঝাই যাচ্ছে: ‘কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার’ প্রসঙ্গটা তুলবার একটা সঙ্গত এবং পরিষ্কার অর্থ আছে। অর্থাৎ ‘আমেরিকা ব’লে কোনো দেশ নেই’ গল্পটাকে পাঠ করেছি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে।
বাস্তবতার একটা সংকটকাল নিয়ে গল্পরেখার মধ্যকার কালগুলো যুক্তিশীল কিনা এবং চরিত্রগুলো, ক্রিয়াগুলো যে সমস্ত কালব্যাপী চলাচল করছে সেগুলো যুক্তিসঙ্গত কিনা- এই হচ্ছে সার জিজ্ঞাসা। সোজাভাবে চিন্তা করলে বলা যায়, সাধারণ চিন্তাতে কালানুবর্তিক ঘটনা প্রবাহকে বাস্তব হিসেবে চেনা হয়। আর কাল অবশ্যই একরৈখিক। এই বিশেষ গল্পে কালের বাস্তবতাবাদী সংকটটি দেখা গিয়েছিল, আমাদের পাঠের সময়ে৩ অর্থাৎ সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাঠের সময়ে, গল্পের মধ্যকার ‘মিথ্যুক’ গল্পকারকে কলম্বাসের কালে প্রত্যক্ষণকারী হিসেবে না ভাবতে পারার মধ্য দিয়ে। প্রত্যক্ষণকারীর দাপট পুরো আধুনিক প্রত্যক্ষণবাদের (বা দৃষ্টবাদ) অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য৪। কিছু আগের আলোচনাতে ফিরে গেলে বলা যায়- এই একই পদ্ধতিতে ‘সত্যতার’র জিজ্ঞাসাটিও মীমাংসিত হবার রেওয়াজ আছে। বিক্সেল নিজে এই গল্পটিতে প্রথম ব্যক্তিস্বর হিসেবে আছেন এবং সেটার মধ্য দিয়েও এই বিশেষ প্রসঙ্গটিকে বোঝা যায়। তিনি নিজেই ‘কলম্বাসের গল্প বলিয়ে’কে অভিযুক্ত করেছেন ‘মিথ্যুক’ বলে, ‘গাঁজা দিচ্ছো’ বলে। গল্পের চরিত্র (ইগো) বিকসেল-এর মূল শক্তি কিন্তু প্রত্যক্ষণকৃত প্রমাণাদির অভাবের মধ্যে নিহিত। তিনি জানতেন কিসসাকারীর কোনো প্রমাণ নেই। কেবল তাই নয়, ইগো-বিকসেল কথা বলেছেন ইতোমধ্যেই তৈরি হওয়া সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে এবং সেটা সমূহ শক্তিশালী। সেই সত্যের সঙ্গে কিসসাকারীর কথাবার্তার এমন বিবাদ যে খোদ ‘জ্ঞান’কেই নাড়িয়ে দেয় তা, সেটা ইগো-বিকসেল বরদাশত করতে পারেন না। কিন্তু ইগো-বিকসেলের সেই অবস্থানটাই আবার বাস্তবতার ফাঁপা পাঠকেন্দ্রিক। ‘আমেরিক ব’লে কোনো দেশ নেই’ গল্পের লেখক বিকসেল সেটা জানতেন। তিনি নিজেই তাঁর ভূমিকা বেছে নিয়েছেন। এটা একটা নাট্যিক শক্তি যোগান দিয়েছে। এ কথা ঠিক যে, কিসসাকারী দমে গিয়েছিলেন গালমন্দ শুনে। তবে তিনিও ভালোমতোই জানতেন ঘায়েল করবার রাস্তা। তাঁর সেই তরিকাও কিন্তু প্রত্যক্ষণ। আমেরিকাতে যাঁরা যান তাঁরা সকলে একই গল্প বলেন- এই প্রত্যক্ষণ, তাঁরা (আমেরিকা হতে) ফিরে এসে সেই একই গল্প বলেন যাবার আগে থেকেই তাঁরা যা জানতেন: কাউবয় আর স্কাইস্ক্র্যাপারের, নায়াগ্রা আর মিসিসিপির, নিউ-ইয়র্ক আর সানফ্রানসিসকোর গল্প- এই প্রত্যক্ষণ হাজির করে তিনিও (কিসসাকারী) বাস্তবতার পাঠ দাঁড় করান।
কিসসাকারীর বাস্তবতা আসলে আমেরিকাবাদ বা আমেরিকানিজমের বাস্তবতা। এমন কী সমৃদ্ধ সুইট্জারল্যান্ডে, পিটার বিকসেল যে দেশের বাসিন্দা, এমন কী দাপুটে জার্মান ভাষাভাষীদের মধ্যে, বিকসেল যে ভাষায় লেখেন- সেখানেও আমেরিকানিজমের এই নাঙ্গা বাস্তবতা। এই বাস্তবতা নিয়ে, মানে এই বাস্তবতাকে নাঙ্গা করে, কিসসাকারী লড়েছেন: আর গল্পকার বিকসেল সেটাই দাঁড় করাতে চেয়েছেন। তৃতীয় বিশ্বের জন্য আমেরিকাবাদের, মানে, এর গড়ন কিংবা আমেরিকাবাদী চিন্তাধারার সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা- সবকিছুই সমূহ ভিন্ন ইয়োরোপ হতে। কিন্তু এর কেন্দ্রীয় উপলব্ধিটি ক্ষুণœ হয় না। মার্কিনমুখীন মোহগ্রস্থতাকে আধুনিক সত্ত্বার একটা আকর বৈশিষ্ট্য হিসেবে পাঠ করবার উপলব্ধি সেটা। আমেরিকাবাদী দাপটের বাস্তবতার সঙ্গে ইউরোকেন্দ্রিক ইতিহাসের এবং ইউরোমনস্ক জ্ঞান (কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন) হতে নির্মিত বাস্তবতার (‘বাস্তবতা’র বদলে এই জায়গাতে আরও প্রাসঙ্গিক পদ হচ্ছে ‘সত্যি’) সম্পর্ক জটিল, এবং একই সাথে টানাপোড়েনের। এইটা এখানে দুর্দান্ত নাট্য-পরিক্ষেত্র।
একটা নাটকের বেড়ে ওঠা
আমরা এই গল্পটিকে নিয়ে নাটক করতে মনস্থির করলাম। আমরা বলতে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীগণ এবং আমি। একটা গল্পকে নাট্যরূপ দেয়া এবং তা নিয়ে মহড়ায় নেমে পড়া- এই পদ্ধতিটা আমাদের পরিচিত ছিল। কিন্তু ঠিক এভাবেই কাজটা করার ব্যাপারে আপত্তি ছিল আমাদের- মানে চাইছিলাম না। আমরা বরং কিভাবে গল্পটার পাঠ দাঁড় করাব, এবং সেই সূত্রে সেটাকে অভিনয়ে রূপান্তর ঘটাব- তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। তাছাড়া এই বিশেষ গল্পটির নাট্যরূপ দেয়া, অন্তত আমাদের পক্ষে, একটা যেন-তেন ব্যাপার মনে হয়নি। এখানে একটা কিছু খোলাসা করে নেবার দাবী রাখে। প্রচলিত প্রবণতাগুলোকে সাধারণভাবে মনে রাখলে নাট্যরূপ দেয়ার প্রক্রিয়াকে ক্রমাগতভাবে অনুধাবন করা সম্ভব ‘গল্প বা কাহিনীর সংলাপকরণ’ হিসেবে। সেটাকে বিশেষ সুবিধের চর্চা বলে ভাবা মুশকিল৫। গল্পের নাট্যময়তাকে উদ্ঘাটন করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে নাট্যিক অভিঘাতগুলো কাহিনীসূত্রে আরোপ করা- এই দুই-ই নাট্যরূপ দেয়ার বিশেষ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। সেইমত নাট্যরূপ কেবলমাত্র একটা লেখা প্রক্রিয়া হতেই পারে না। আধুনিক থিয়েটারে নাট্যকার এবং নির্দেশক বিভাজনটা এখানে পুনর্পর্যালোচনা সাপেক্ষ।
সাদা চোখে এই গল্পটার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় জায়গা অনায়াসেই চিহ্নিত করা সম্ভব। সেটা হ’ল পাঁচশ বছর আগের স্পেনের রাজদরবার। এটার রূপায়ণ চট্ করেই মাথায় আসে, অন্তত মনে হয় যে ‘এটা করা যাবে’। কিন্তু একটা দুশ্চিন্তার জায়গা হ’ল পাঁচশ বছর পরে বর্তমানকালের ‘মিথ্যুক’ কিসসাকারী এবং ইগো-বিক্সেল চরিত্র দুটোকে কোথায় রাখব! ঠিক আছে, তার মানে সূত্রধর বা এ্যাংকার থাকতে হবে, গল্পসূত্রটা ধরিয়ে দেবেন তিনি- ফলে কালান্তরও সমস্যা নয়। আর ব্যাপারটা কিন্তু কেবল তাঁদের হাজির করার মতো সরল নয়। আগেই আলোচনা করেছি, দুই বাস্তবতার অভিঘাত ধরা পড়ে তাঁদের কথোপকথনে এবং এর সংলাপ-গুরুত্ব প্রবল। কিন্তু তাঁদের কথোপকথনের অন্তর্গত স্পৃহা বা স্পিরিট ভাবলে মিলনায়তন-থিয়েটার কিংবা খোলা-থিয়েটার নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অন্তত, সে রকম বিবেচনাবোধই কাজ করেছে আমাদের। উচ্চকিত স্বর-প্রক্ষেপণ-রীতি এড়িয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হ’ল তখন। এখানে এসে দুটো জরুরি পদ্ধতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হ’ল। এক, আমাদের নাট্য নির্মাণ মিলনায়তনের উপায়ে নয়, বরং গবেষণাগার উপায়ে হতে হবে। দুই, গল্পটাতে বিকসেল প্রথম স্বরে নিজেই একটা চরিত্র নেয়ার এবং তার গুরুত্ব ইতোমধ্যে স্বীকৃত হওয়ায় অনায়াসে প্রথম স্বর বা ইগোই সূত্রধর বা এ্যাংকর।
অন্তত তিনটা পদ্ধতিগত এবং প্রয়োগিক কারণে খোদ রাজদরবারও একটা সমস্যা বয়ে এনেছিল। প্রথমত, এর কিছু না হলেও, কেবল খর্চাপাতির কথা ভাবলেও ‘বাস্তবানুগ’ রাজদরবার বানানো সম্ভব নয়। দ্বিতীয়, ‘বাস্তবানুগ’ রাজদরবার আর কিছু না হলেও, কিসসাকারী এবং প্রথম স্বরের গল্পকারের (যাঁরা অন্য কালের ও অন্য পরিসরের) জন্য পরিসরের সংকট (স্পেস ক্রাইসিস) তৈরি করে, তাঁদের অস্তিত্বকে পাৎলা করে। তৃতীয়ত, একটা ‘বাস্তবানুগ’ রাজদরবার পরিসরের উপর একটা ঝলমলে ও উচ্চকিত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বসতে পারে যা নাটকটির প্রারম্ভিক মুখ্য কৌশলকে অর্থাৎ নি¤œকণ্ঠে প্রক্ষেপণকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা দেখা দেয়। এই ব্যাখ্যা এবং সম্ভাবনা যে অনিবার্য সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে তা হ’ল মঞ্চগড়ন বা সেট ডিজাইনে প্রচলিত ‘ফর্মাল’ ধারা গ্রহণ এবং সাজসজ্জাতেও ‘সাজেসটিভ’ ধারা গ্রহণ।
রাজদরবার নিয়ে দ্বিতীয় ধরনের বিপত্তি একটু জটিল। এখানে আপাত সাধারণ বুদ্ধিগ্রাহ্য ঠাট্টা-তামাশার উপস্থিতি ব্যাপক। এই ঠাট্টা-তামাশা ভাঁড়-ভিন্ন চরিত্রগুলো করছেন না, কিন্তু তাঁদের উপস্থিতি, বিচারবোধের অসারতা, দাম্ভিক-বোকাটে পরিকল্পনা এবং স্থূল আনুগত্য অনায়াসেই বিরাট হাস্যরস তৈরি করতে পারে। ভাঁড়রা ব্যতিক্রম, তাঁদের পেশাই এই গল্পে হাস্যযোগান দেয়া- দর্শকের জন্য প্রত্যক্ষভাবে নয়, কিন্তু রাজার জন্য তো বটেই। ভাঁড়গণ তো আছেনই, পারিষদের উপস্থিতি আর খোদ রাজাই একটা সম্ভাবনার আধার, আর হাস্যরসের উপস্থিতিটা নিশ্চয়ই এমন কিছু আপত্তির হতে পারে না। কিন্তু আমাদের আশঙ্কাটা ছিল পদ্ধতিগত প্রশ্নে। এই রকম জায়গা, রীতিমত বড় জায়গা, মূল চেতনাকে লঙ্ঘন করে যাবে কিনা! ওইটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে দলের প্রস্তুতির বিষয়টাও গুরুত্বের সাথে সামনে চলে আসে।
দলের সদস্যদের বড় অংশই কোনো না কোনোভাবে, গোড়া থেকেই, চিন্তিত ছিলেন নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে। সেটা অসঙ্গত ছিল না, অন্তত সবার নাট্যভিজ্ঞতার কথা বিবেচনায় রাখলে।
আমরা সমস্যাটিকে বোঝার চেষ্টা করলাম। আধুনিক ইয়োরোপীয় ধাঁচের যে থিয়েটার অনুশীলন আমরা চিনি তার প্রস্তুতি একাধারে বৌদ্ধিক এবং শারীরিক। এই দুইয়ের প্রস্তুতি এবং অনুশীলন একেবারে ভিন্ন কিন্তু ভেবে দেখলে বোঝা যায় এই দুইয়ের প্রতিক্রিয়া কোনোমতেই বিচ্ছিন্ন নয়। কোন জায়গাটাতে আমাদের দ্রুত প্রস্তুতি সম্ভব কিংবা আমাদের নিজেদের বিদ্যায় কুলায়- সেটা ভেবে নিয়ে কাজ শুরু করতে চাইলাম। বৌদ্ধিক প্রস্তুতি নেয়াটা এমনিতেই আবশ্যিক শর্ত হিসেবে দেখতে চাইছিলাম। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা খোলাসা করতে চাই। ধরা যাক, আমেরিকাবাদের প্রসঙ্গটি। বিশ্বজুড়ে, বিশেষভাবে সচ্ছল-সমৃদ্ধ শ্রেণীর মনোজগতে, আমেরিকা-মুখীনতা আর আমেরিকাকে হিংস্র বিস্তারে প্রশ্রয় দেয়াকে না বুঝে বিক্সেলের এই বিশেষ গল্পটা নিয়ে কাজ করবারই বা মানে থাকে কী! আরও ব্যাপক চিন্তা-পাটাতনে কথা পাড়লে বলা যায়, বিশেষভাবে একটা তৃতীয় বিশ্বের সমাজে অবস্থান করে, আমেরিকান ভূখ-টি ইয়োরোপের কাছে আবিষ্কৃৃত হবার মূল্য অ-ইয়োরোপীয় (চলতি ভাষায় রেড ইন্ডিয়ান) মানুষজনের কিভাবে চুকাতে হয়েছে- এই জিজ্ঞাসার কোনো চর্চা না থাকলেও এই গল্পটি নিয়ে কাজ করবার দরকার পড়ে না। আমরা আমাদের বৌদ্ধিক প্রস্তুতি নিতে পারব আর শারীরিক (অভিব্যক্তি ও নড়াচড়া) প্রস্তুতির জন্য বড়জোর চেষ্টা করব- এই ধরে নিয়েই এগোলাম।
যদিও কিসসাকারী এবং ইগো দুজনেই গল্পটি স্পিরিটের ক্ষেত্রে বিরাট গুরুত্ব বহন করেন, কিন্তু থিয়েটার বানানোর সবচেয়ে শক্ত জায়গা ছিলো ‘জনি’। ওই ভাঁড়টি, যিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ‘স্বাভাবিক ভাষায়’ কথা বলেছিলেন কেবল একবার, যখন কলুম্বিনে তাঁকে রাজার হত্যা-হুকুম থেকে মুক্ত করে দেবার চেষ্টায় জিতে গেছেন। খুবই চমকপ্রদ যে এখানে খুনী হচ্ছেন রাজা (স্বাভাবিকভাবেই), কলম্বাস হচ্ছেন শিশু এবং মুক্তিদাতা এবং চূড়ান্ত বিচারে রাজসভার বীরত্ব প্রথার সঙ্গে বেমানান, প্রতারকও। জনি হচ্ছেন সাধারণ চোখে ‘কদাকার’। ‘বিশ্রি’ তাঁর হেসে উঠবার ধরন, অথচ সারাক্ষণ হাসছেন। ওইটাই তিনি ভাঁড় হিসেবে তাঁর ‘জব টার্ম’ বানিয়েছেন। তার ওই হাসি রাজাকে খুশি করত কিভাবে সেটা একটা রহস্য, কিন্তু বোধহয় মূল ব্যাপার নয়। মূল ব্যাপারটা অন্য জায়গায়। জনির মুখ্য বৈশিষ্ট্য হ’ল গল্পের মধ্যকার গল্পটিতে। রাজসভায়, তিনি একমাত্র মানুষ, যিনি সম্ভবত, আমেরিকানাইজ্ড নন। আমেরিকাবাদকে আরো গভীরে অনুভব করলে বোঝা যায় এই বিষয়টা। আমেরিকাবাদী বাস্তবতাতে সেটাই, জনির অস্তিত্বটা, বিরাট একটা বিষয়।
টিকা
১. মাইকেল কাটনার এবং মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত পিটার বিকসেলের গল্পসংগ্রহ, প্যাপিরাস, কলকাতা, এপ্রিল ১৯৯৪। মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের দুর্দান্ত অনুবাদের সঙ্গে পাঠকরা পরিচিত। এই বিশেষ অনুবাদ গ্রন্থটি তাঁদের আগ্রহে বাড়তি মাত্রা যোগাবে।
২. পিটার বিকসেলের ‘আমেরিকা ব’লে কোনো দেশ নেই’- এর পুরো গল্পটি এখানে সংযোজিত হলো:
গল্প বলতো এমন একজনের গল্প আছে আমার কাছে। তার কোনো গল্পই যে আমার বিশ্বাস হয় না, এ-কথা তাকে যে কতবার পই-পই বলেছি।
‘মিথ্য কথা বলছো তুমি,’ আমি বলেছি, গাঁজা দিচ্ছো, সব বানিয়ে-বানিয়ে বলছো, মনগড়া, সৃষ্টিছাড়া, শুধু আমাকে বোকা বানাবার জন্য।’
তাতে তার ওপর কোনো ছাপ পড়েনি। কোনো ভাবান্তরই তার নেই, এমনভাবে সে তার গল্প বানিয়ে চলছিলো, কিন্তু শেষটায় আমি ব’লে উঠেছি,
‘ওহে মিথ্যুক, ওহে অনৃতভাষী, ওহে অলীকচঞ্চু, ওহে বাক্যবাগীশ। আর সে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে আমার দিকে; তারপর মাথা নেড়েছে; দুঃখীভাবে শুকনো হেসেছে; তারপর এত আস্তে নরম করে বলেছে যে, আমার নিজের উপর আমার ভারি রাগ আর লজ্জা হলো: সে বলেছে: ‘আমেরিকা ব’লে কোনো দেশ নেই।’
শুধু তাকে সান্ত¦না দেবার জন্যই আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি তার গল্পটা লিখে ফেলবো।
গল্পটার শুরু পাঁচ শতাব্দী আগে এক রাজার রাজসভায়-স্পেনের রাজার। তাতে আছে এক প্রাসাদ; রেশম আর মখমল; সোনা-রুপো; দাড়ি; রানীর মুকুট; মোমবাতি আর শামাদান; দাসদাসী, আছে পারিষদেরা; যারা ভোরবেলায় একে অন্যের ভুঁড়ো পেট ফাঁপিয়ে দেয় তলোয়ারের খোঁচায়, যারা আগের রাত্তিরে পরস্পরের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিয়েছে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের আহ্বান- তাদের দস্তানা। মিনারে প্রহর বাজায় পাহারোলা। আর আছে দূতেরা- যারা লাফিয়ে নামে ঘোড়া থেকে আর লফিয়ে ওঠে জিনপরানো ঘোড়ায়, আছে রাজার বন্ধুরা; আর ভ- বন্ধুরা; রূপসী আর বিপজ্জনক সব তরুণী; আর মদ; আর রাজপ্রাসাদের চারপাশে আছে এমন সব লোক যারা এইসব কিছুর জন্য দাম দেয়া ছাড়া ভালো কিছু করার কথা ভাবতেও পারে না।
কিন্তু রাজা নিজেও তাছাড়া অন্য কোনোরকমভাবে জীবন কাটাবার কথা ভাবতে পারতেন না, আর যেভাবেই কেউ বাঁচুক না কেনো- খুব জাঁকজমকেই হোক কিংবা দীণদরিদ্রভাবেই হোক- যেখানেই থাকুক না কেনো- কেউ মাদ্রিদে বা বারসেলোনায় বা অন্য কোনোখানে; শেষটায় কিন্তু সবই সেই একই রকম- দিনের পর দিন একই রকম; একঘেঁয়ে সব কাজের ক্রম; আর ক্রমে লোকের কাছে তা রিবক্তিকর আর অসহায় হয়ে ওঠে। যেমন; অন্য কোনোখানে যারা থকে তারা ভাবে বারসেলোনা বুঝি খুব আহামরি জায়গা; আর বারসোলোনায় যারা থাকে তারা অন্য যে কোনোখানে চলে যেতে পারলেই বুঝি বাঁচে।
গরিবরা ভাবতো বুঝি রাজার মতো বাঁচতে পালেই খুব মজা; আর তারা কষ্ট পায় এইজন্য যে রাজা ভাবেন যে গরিব হওয়াটাই গরিবদের পক্ষে সবচেয়ে ঠিক।
রাজা ঘুম থেকে ওঠেন সকালবেলা; ঘুমোতে যান রাতে; আর সারাদিন কাটে একঘেঁয়ে, দুঃসহ; বিরক্তিকর; আর কত যে দুশ্চিন্তা- দাসদাসী নিয়ে ভাবনা; সোনা রুপো নিয়ে ভাবনা; রেশম-মখমল নিয়ে ভাবনা; তার উপর মোমবাতিগুলোও তাঁর ভারি একঘেঁয়ে লাগে। চমৎকার তাঁর বিছানা; পরিপাটি; জমকালো; কিন্তু সেই বিছানায় এক ঘুমোনো ছাড়া বিশেষ কিছু করারও জো নেই।
দাসদাসীরা নুয়ে অভিবাদন করে তাকে সকালে- ততখানিই নোয় ঠিক তার পরদিন সকালবেলায়; রাজা তো এতেই অভ্যস্ত; তাঁর এটা আর চোখেই পড়ে না। কেউ তাঁকে দেয় ছুরি-কাঁটা; যারা তাঁর সঙ্গে কথা বলে তারা সম্ভাষণ করে জাঁহাপনা বলে- সঙ্গে আরো কত ভালো ভালো কথার টুকরো জুড়ে দেয়; আর ব্যস; এই-ই সব।
কেউ তাঁকে একবারও বলে না: আস্ত গাধা; মাথায় গোবর পোরা; আর আজ তাঁরা তাঁকে যা বলে তা তারা কখন গতকালই তাঁকে বলে দিয়েছে।
এই হলো গিয়ে অবস্থা।
আর এই জন্যেই রাজসভায় রাজারা ভাঁড় পোষেন।
ভাঁড়েরাই যা খুশি তাই করতে পারে; যা খুশি-তাই বলতে পারে;
কেবল রাজাকে হাসাবার জন্যেই অবিশ্যি; আর যখন তাদের কাণ্ডকীর্তি দেখে রাজার আর হাসি পায় না তখন তাদের কোতল করার হুকুম দেন রাজা- কিংবা ঐরকমই কিছু করতে বলেন।
সেইজন্যেই একবার তাঁর রাজসভায় এক ভাঁড় ছিলো যে সব কথাবার্তা গুলিয়ে ফেলতো। রাজার মনে হয়েছিলো সেটা খুব হাসির ব্যাপার। রাজামশাই না-বলে ভাঁড় বলতো শাজামরাই; প্রাসাদ না-বলে বলতো স্রাপাদ; সুপ্রভাত না বলে বলতো পুভ্রসাত।
আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা বোকা-বোকা; কিন্তু রাজা ভাবতেন ভারি মজা। বছরের অদ্ধেকটা ধরে; ৭ জুলাই অব্দি; তিনি ভেবেছিলেন ব্যাপারটা হাসির; তারপর আট তারিখে তাঁর ঘুম ভাঙামাত্র ভাঁড় যখন বললো; পুভ্রসাত; শাজামরাই; রাজা বললেন, এই ভাঁড়টার হাত থেকে কেউ আমাকে রেহাই দাও তো।
আরেক ভাঁড় বেঁটেখাটো; মোটাশোটা; তার নাম পেপে, রাজাকে কেবল চারদিন খুশি রেখেছিলো। রাজসভার নারীপুরুষ; রাজপুত্র; উজির-নাজিরের চেয়ারে মধু মাখিয়ে রাজার মুখে হাসি ফুটিয়েছিলো। চতুর্থ দিনে সে যখন রাজ-সিংহাসনে মধু মাখালো রাজার আর হাসি পেলো না; আর পেপেও ভাঁড় রইলো না।
এবার রাজা কিনে আনলেন জগতের সবচেয়ে ভয়ংকর ভাঁড়টিকে। কদাকার দেখতে সে; একসঙ্গে চিমশে আর নধর; ঢ্যাঙা আর কুঁজো আর তার বাঁ-পাটা বাঁকা। সে কথা বলতে পারে; না কি ইচ্ছে করে চুপ করে আছে নাকি বোবা; তা কেউই জানতো না। তার চোখে ছিলো বদমায়েশি ধুরন্দর ভাব; মুখটা বদরাগি; একমাত্র তার নামটাই ছিলো যৎকিঞ্চিৎ মধুর; তার নাম ছিলো জনি।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিলো তার হেসে ওঠবার ধরন। হাসিটা শুরু হতো আস্তে; বেশ ছোট চকচকে; তার পেটের ঠিক মাঝখানটায়; তারপর ফুলে ফেঁপে উঠতো সেটা; আস্তে আস্তে বদলে যেতো বিরাশি হিক্কায়; জনির মুখচোখ লাল হয়ে যেতো; প্রায় দম আটকে যেতো; তারপর সে ফেটে পড়তো; চেঁচিয়ে মেচিয়ে একাকার; তারপর সে পা ঠুকতো; নাচতো; হো-হো-হো-হো করতো আর রাজা আমোদ পেতেন; অন্যান্যরা কি-রকম বিবর্ণ হয়ে যেতো; কাঁপতে শুরু করতো; ভয় পেতো। আর রাজ প্রাসাদের সবখানে লোক যখন সেই হাসির দমকের সাড়া পেতো তারা দরজা-জানালা বন্ধ করে খড়খড়ি নামিয়ে দিতো; ছেলেপুলেকে শুইয়ে দিতো বিছানায়; আর কানে তুলো গুঁজে দিতো।
জনির হাসবার ধরনটাই ছিলো জগতের সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার। রাজা যাই বলেন না কেনো; জনি হাসবেই। রাজার কথায় কারু যে হাসি পেতে পারে এটাই তাজ্জব; কিন্তু জনি হাসতো। আর একদিন রাজা বললেন- জনি; তোকে আমি ফাঁসিতে ঝোলাবো।
আর জনি হেসে উঠলো; হি-হি জুহু হো-হো হো-হো; হেসেই চললো; এমন বেদম হাসি সে জীবনে হাসেনি।
তখন রাজা ঠিক করলেন জনিকে পরদিনই ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। ব্যবস্থা করলেন ফাঁসিকাঠ বানাবার; একবার মনস্থির করামাত্র বিষয়টিকে রাজা ঠাট্টা বলে ভাবেননি; ফাঁসিতে ঝুলতে ঝুলতে জনি কেমন করে হাসে শোনবার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো তার। তারপর তিনি সবাইকে হুকুম দিলেন ঐ জঘন্য দৃশ্যটা দেখতে আসবার জন্য। কিন্তু লোকজনেরা সব লুকিয়ে পড়েছিলো; দরজার খিল আটকে লুকিয়ে ছিলো; আর সকালবেলায় রাজা দেখলেন শুধু তিনি আর জল্লাদই আছেন; আর আছে জল্লাদের স্যাঙাৎরা; আর হো-হো- হাসতে থাকা জনি।
আর রাজা চেঁচিয়ে বলেছিলেন দাসদাসীদের- লোকজন সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো। দাসদাসী আস্ত শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে পেলো না; রাজা তো রেগে তেরিয়া; আর জনির মুখে হাসির রোল।
তারপর অনেক খুঁজে শেষটায় দাসদাসীরা পেয়েছিলো এক বাচ্চা ছেলেকে; তাকে তারা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছিলো রাজার কাছে। ছোট ছেলেটি; বিবর্ণ; লাজুক আর রাজা আঙুল তুলে দেখিয়ে ছিলেন ফাঁসিকাঠ; ছেলেটিকে হুকুম দিয়েছিলেন তাকিয়ে দেখবার জন্য।
ছেলেটি তাকিয়ে দেখলো ফাঁসিকাঠ; মৃদু হাসলো; হাততালি দিয়ে উঠলো; আর ভারি অবাক হয়ে গেলো; বললো, আপনি নিশ্চয়ই খুব ভালো রাজা; পায়রাদের বসবার জন্য দাঁড় বানিয়ে দিয়েছেন; দেখুন দেখুন; এর মধ্যেই দুটি এসে বসেছে।
‘তুই দেখছি আস্ত হাবা একটা; রাজা বললেন; তোর নাম কী রে?’
‘আমি হাবাগোবাই; রাজামশাই। আমার নাম কোলোম্বো মা আমাকে ডাকেন কোলুম্বিনে।’
ওরে হাবা; বললেন রাজা; এখানে একজনকে ফাঁসিতে ঝোলাতে হবে।
‘ওর নাম কী তাহলে শুনি; জিগেশ করলো কোলুম্বিনে; আর নামটা যখন শুনলো; বলে উঠলো, চমৎকার নাম; তা ওর নাম তাহলে জনি। অমন সুন্দর যার নাম তাকে কেউ ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারে কী করে?
‘তার কারণ ওর হাসিটা বেজায় বিদঘুটে; বললেন রাজা। জনিকে তিনি হুকুম দিলেন হাসতে; আর জনি আগের দিনের চেয়েও দ্বিগুণ বিচ্ছিরি আর বিদঘুটেভাবে হেসে উঠলো।
কোলুম্বিনে একেবারে তাজ্জব; পরে সে বললো, রাজামশাই সত্যি আপনার কাছে হাসিটা ভয়ানক ঠেকছে? রাজা অবাক হয়ে গেলেন; তাঁর মাথায় কোনো উত্তরই জোগালো না; আর কোলুম্বিনে বলে চললো, ওর হাসির ধরনটা অবশ্যি আমার তেমন ভালো ঠেকছে না; কিন্তু; দেখুন; পায়রারা এখনও বসে আছে ফাঁসিকাঠে; ওরা তো হাসি শুনে আঁৎকে ওঠেনি; ওদের তো সেই হাসিটা তেমন ভয়ানক ঠেকছে না। পায়রাদের কান বড্ড স্পর্শাতুর। জনিকে আপনার ছেড়ে দিতে হবে।
রাজা ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখলেন; বললেন, জনি; যাও; এখান থেকে কেটে পড়ো।
আর জনি; এই প্রথমবার; কেবল একটি কথা উচ্চারণ করলো। ধন্যবাদ; বলে সে কোলুম্বিনেকে। আর মানুষের মতো মৃদু হেসে; ভালো হেসে, চলে গেলো।
এখন আর রাজার কোনো ভাঁড় রইলো না।
আমার সঙ্গে আয়; কোলুম্বিনেকে তিনি বললেন।
রাজার যত দাসদাসী; উজির-নাজির; সেপাই-শাস্ত্রী সবাই কিন্তু ভাবলে যে কোলুম্বিনেই বুঝি রাজসভার নতুন ভাঁড়।
কোলুম্বিনে কিন্তু মোটেই আমোদ পেলে না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো; তাজ্জব ক্কচিৎ একটা কথা বলে কি বলে না; হো- হো করেও হাসে না; কেবল মৃদু হাসে; কারুক্কেই হাসাতে পারে না।
‘ও তো ভাঁড় নয়; ও হলো হাবার হদ্দ;’ লোকে বললে; আর কোলুম্বিনে বললে, ‘আমি তো ভাঁড় নই; আমি হচ্ছি হাবার হদ্দ।’
আর লোকে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলে।
রাজা যদি জানতেন যে তাকে নিয়ে লোকে হাসাহাসি করছে; তাহলে বেজায় চটে যেতেন; কিন্তু কোলুম্বিনে একবারও সেকথা তাঁর কানে তুললো না, কারণ, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলে তার মোটেই দুঃখ বা রাগ হয় না। রাজসভায় আছে পালোয়ান আর বুদ্ধিমান; রাজা তো রাজাই; মেয়েরা রূপসী আর বিপজ্জনক; পুরুষরা সাহসী আর ধূর্ত; রাজপুরোহিত অনুগত আর বশম্বদ; আর রান্নাঘরের দাসীরা ভারী পরিশ্রমী- কেবল কোলুম্বিনে- এই কোলুম্বিনেই কিচ্ছু না।
কেউ যদি বলে: আয়; কোলুম্বিনে; আমার সঙ্গে লড়বি; কোলুম্বিনে বলে, আমার গায়ে আপনার মতো জোর নেই।
কেউ যদি বলে: বল তো দেখি; সাত দুগুনে কত; কোলুম্বিনে বলে, আমি আপনার চেয়েও বোকা।
কেউ যদি বলে: ঝরনাটা লাফিয়ে পেরুতে পারবি? সাহস আছে তো? কোলুম্বিনে বলে, না; আমার মোটেই সাহস নেই।
আর রাজা যখন বললেন; আচ্ছা কোলুম্বিনে; তুই কী হতে চাস; বল তো? কোলুম্বিনে উত্তর দিলে, আমি কিচ্ছু হতে চাই না; আমি তো কিছু একটা হয়েই আছি; আমি কোলুম্বিনে।
রাজা বললেন, কিন্তু একটা কিছু তোকে হতে হবে। আর কোলুম্বিনে জিগেস করলে, কী কী হতে পারে লোকে?
রাজা তখন বললেন, ঐ যে দাঁড়িওয়ালা লোকটা; ঐ যার মুখ তামাটে; কুঁচকানো; ও হলো নাবিক; পথ খুঁজে বেড়ায় সমুদ্রে। ও নাবিক হতে চেয়েছিলো; নাবিকই হয়েছে; ও পাল-খাটানো জাহাজে সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায় আর রাজার জন্য নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করে।
‘আপনি যদি চান; রাজামশাই; বললে কোলুম্বিনে; আমিও তাহলে নাবিক হবো।
আস্ত রাজসভা তাতে হো-হো-হেসে উঠলো।
আর কোলুম্বিনে- সে ছুটে বেরিয়ে গেলো রাজসভা থেকে; চেঁচিয়ে বললো, আমি একটা দেশ আবিষ্কার করবো; আমি একটা দেশ আবিষ্কার করবো।
লোকে এ ওর মুখ চাওয়া চাউয়ি করলে আর মাথা নাড়লে; আর কোলুম্বিনে প্রাসাদ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো; ছুটে গেলো নগরের উপর দিয়ে; মাঠের উপর দিয়ে; আর মাঠে-ঘাটে যে সব চাষিরা চাষ করছিলো আর তাকে দৌঁড়ে যেতে দেখেছিলো; তাদের ডেকে সে চেঁচিয়ে বললে, আমি একটা দেশ আবিষ্কার করবো; আমি একটা দেশ আবিষ্কার করবো।
আর ছুটে ছুটে সে এসে পৌঁছালো এক জঙ্গলে; সেখানে ঝোপঝাড়ের মধ্যে সে লুকিয়ে কাটালো সপ্তাহের পর সপ্তাহ; আর সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেউই তার কোনো খোঁজ পেলো না; খবরও না; আর রাজা বেশ দুঃখ পেলেন মনে; নিজেকে একটু তিরস্কারও করলেন; আর কোলুম্বিনেকে নিয়ে হাসাহাসি করার জন্য লজ্জা পেয়ে সভাসদেরা ধিক বললে নিজেদের।
আর তাই মিনারের পাহারোলা যখন শিঙা ফুঁকলো একদিন, অনেক সপ্তাহ পরে; আর কোলুম্বিনেকে দেখা গেলো মাঠ পেরিয়ে, নগর পেরিয়ে; তোরণ পেরিয়ে রাজার কাছে আসতে; সভাসদেরা ভারি খুশি হয়ে উঠলো। কোলুম্বিনে এসেই বললে; রাজামশাই; আপনার কোলুম্বিনে এক দেশ আবিষ্কার করে এসেছে। আর সভাসদেরা যেহেতু কোলুম্বিনেকে নিয়ে আর হাসাহাসি করতে চাইছিলো না; ভারিক্কি মুখ করে জিগেশ করলে, নাম কী দেশটার? দেশটা কোথায়?
দেশটার কোনো নাম অবশ্যি এখনো নেই। কারণ আমি তো সদ্য আবিষ্কার করেছি দেশটা; দূরে; মহাসাগরের মধ্যে দেশটা; বললে কোলুম্বিনে।
তখন সেই দাঁড়িওয়ালা নাবিক উঠে দাঁড়ালো; বললে, বেশ কোলুম্বিনে; আমি আমেরিগো ভেসপুচ্চি; আমি গিয়ে ও-দেশ খুঁজে বার করবো। শুধু বল দেখি; কেমন করে সেখানে যাওয়া যায়?
পাল খাটিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় সমুদ্রে; তারপর সোজা সামনে নাক বরাবর যেতে হয়; যদ্দিন না দেশটা চোখে পড়ে তদ্দিন সোজা চলতে হবে। হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলে চলবে না; বললে কোলুম্বিনে; আর বলতেই ভারি ভয় পেয়ে গেলো; কারণ ও তো আস্ত মিথ্যুক এক; ভালো করেই জানে ও-রকম কেনো দেশ নেই; আর রাতে ভয়ে চোখে ঘুম আসে না।
কিন্তু আমেরিগো ভেসপুচ্চি বেরিয়ে পড়লো দেশটার খোঁজে।
কেউ জনে না কোথায় সে গিয়েছিলো পাল খাটিয়ে।
হয়তো সেও জঙ্গলে লুকিয়ে থেকেছিলো।
তারপর আবার বাজলো শিঙা আর কাড়ানাকাড়ি আর আমেরিগো ফিরে এলো।
কোলুম্বিনে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো; ঐ নামজাদা নাবিকের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পর্যন্ত তার হচ্ছিলো না। রাজার সামনে এসে দাঁড়ালো ভেসপুচ্চি; কোলুম্বিনের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ টিপলো; তারপর সবাই যাতে শুনতে পায় এমনিভাবে স্পষ্ট করে ভেসপুচ্চি; বললো, রাজামশাই; সত্যি ও-রকম একটা দেশ আছে।
ভেসপুচ্চি তার ধাপ্পা ফাঁস করে দেয়নি বলে কোলুম্বিনে এত খুশি হয়ে উঠলো যে দৌঁড়ে গেলো তার কাছে; জড়িয়ে ধরলো তাকে বুকে আর বলে উঠলো, আমেরিগো; আমার আমেরিগো।
আর লোকে ভাবলে এই বুঝি দেশটার নাম; আর তারা যে-দেশটা কোথাও নেই তার নাম দিলে আমেরিকা।
এবার তুই সত্যি বড়োমানুষ হয়েছিস; কোলুম্বিনকে বললেন রাজা; এখন থেকে তোর নাম হলো কোলুম্বুস।
আর কোলুম্বুস হয়ে উঠলো নামজাদা; বিখ্যাত; আর সব্বাই তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আর ফিশফিশ করে বলে, দেখেছো, ঐ উনি- উনিই আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন।
আর প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে বসলো যে আমেরিকা বলে একটা দেশ আছে; কেবল কোলুম্বুসই নিশ্চিত করে জানলো না; সারা জীবন তার কাটলো সন্দেহে আর বিশ্বাসে; আর নাবিকটিকে কখনো সত্যি কথা খুলে বলতে বলার অনুরোধ করার সাহস তার আর হলো না।
কিন্তু শিগগিরই অন্য লোকেরাও আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাল খাটিয়ে বেরিয়ে পড়তে লাগালো; তারপর অনেক, অনেক লোক; আর যারা ফিরে এলো; তারা দাবি করলো সত্যি; আমেরিকা বলে একটা দেশ আছে।
আমার কথা যদি ধরো; আমাকে যে এ-গল্পটা বলেছিলো সে বলল; আমি নিজে কখনো আমেরিকা যাইনি। আমি জানি না সত্যি আমেরিকা বলে কোনো দেশ আছে কিনা। এমনও হতে পারে যে লোকে শুধু ভান করে; যাতে কোলুম্বিনে মনে কষ্ট না পায়। আর যখনই দুজন লোক এক জায়গায় বসে আমেরিকার কথা পরস্পরের কাছে বলাবলি করে; তারা এখনও চোখ টেপে একে-আরেকের দিকে; আর তারা আমেরিকা কথাটা পারতপক্ষে উচ্চরণও করে না; বলে স্টেটস, কিংবা ইউ এস; কিংবা ও-দেশে বা এই রকম কিছু অস্পষ্ট; ধোঁয়াটে।
হতে পারে যে যারা আমেরিকা যেতে চায় তাদের কোলুম্বিনের গল্প শোনানো হয়- জাহাজে কিংবা বিমানে; আর তখন তারা গিয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকতো কিছুদিন; আর পরে ফিরে এসে সাতকাহন করে গল্প বলে কাউবয় আর স্কাইস্ক্র্যাপারের, গল্প করে বলে নায়াগ্রা আর মিসিসিপির কথা; বলে নিউ-ইয়র্ক আর সানফ্রানসিসকোর কথা।
সে যা-ই হোক, ঠিক যে তারা এক গল্পই বলে সবসময়; এমন সব জিনিসের কথা বলে, রওনা হবার আগেই যার কথা তারা জানতো; আর এটা তো তুমি মানবে যে একটা ভারি সন্দেহ জাগানো ব্যাপার।
কিন্তু লোকে এখনও তর্কাতর্কি করে কোলুম্বুস সত্যি কে ছিলো; এই নিয়ে।
আমি- জানি ও কে ছিলো।
৩. আমাদের পাঠের সময়কাল বলতে স্পষ্টভাবেই পাঠকক্ষের বাইরের সময়। যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার কাজের বিধিবদ্ধ সর্ম্পক ছিলো কেবল নৃবিজ্ঞান পড়ানোর, তাই এ সকল কাজের জন্য আমরা বিকেলবেলা বেছে নিয়েছিলাম।
৪. এই প্রসঙ্গের সবচেয়ে স্থূল, তাই গুরুত্বপূর্ণ, উদাহরণ হচ্ছে আধুনিক সত্ত্বার কণ্ঠস্বরে ‘আমি নিজে দেখেছি’-এর ঘোষণা। বোঝাই যাচ্ছে এই বচন বা প্রোপোজিশন স্পষ্টভাবেই বির্মূত বাস্তবকে চিনবার ক্ষেত্রে বিরাট আন্ধা উপর দাঁড়িয়ে, আর সেটা বিরাট এক দার্শনিক- বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা।
৫. অন্য একটা নগন্য লেখাতে আমার বক্তব্যকে এই প্রেক্ষিতে ভুলভাবে পাঠ করবার সম্ভাবনা দেখছি আমি। সেখানে আমি বলেছি ‘... আধুনিক সত্ত্বার... মৌলিক বৈশিষ্ট্য... বাক্সময়তা। ডিসকার্সিভ ক্ষেত্রকে ব্যবহার করতে চাইলে প্রয়োজনীয় থিয়েটাররীতির হয়ে উঠতে হবে মুখর। সংলাপ সেই থিয়েটারের একটা প্রাণ। সংলাপেই প্রবল পক্ষের ক্ষেত্র ছেদ করবার সম্ভাবনা তৈরি হবে, যেহেতু আধুনিক সত্ত্বার মানসিক ক্রিয়াদি বাস্তবতায় প্রকাশিত। এতে অভিনয়কারীর প্রয়োজনীয় শারীর- প্রস্তুতির গুরুত্ব হালকা হয়ে যায় না, কিংবা সেটা বলা আমার লক্ষ্যও নয়। আমি থিয়েটারকে কেবল অঙ্গ-সঞ্চালককেন্দ্রিক অনুধাবনের কথা বলছি মাত্র’। উদ্ধৃত বক্তব্যের শেষাংশেও এটা সহজেই বোঝা যায় অন্য একটা বাহাসের মধ্যে এই বক্তব্য প্রোথিত। অপাশ্চ্যত্যের অভিনয় তথা শিল্পরীতিকে কেবল শৈলী বা ফর্ম ধরে অনুধাবন সমস্যাজনক- সেটাই সেই বক্তব্যের মুখ্য জায়গা ছিল।*
*‘‘থিয়েটার নৃবিজ্ঞান; ইউজিনিও বারবার’র সাথে ছোট একটা বিতর্ক,” নৃবিজ্ঞান পত্রিকা, সংখ্যা ৫, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জুন ২০০০।
মানস চৌধুরী: নাট্যকার, অভিনেতা। শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়