Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সেলিম আল দীন-ডিসপ্লে ও একটি ভ্রমণ-বৃত্তান্তের সুখ-দুঃখ

Written by মামুন হুসাইন.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

‘যাঁরা থিয়েটারকে পেশাদারি করিয়া বহুসংখ্যক ভদ্রলোকের অন্ন-সংস্থানের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন, থিয়েটারকে জীবিকার উপায় করিয়া দিয়াছেন, তাঁহারা দেশের এক মহা-উপকার করিয়াছেন। এই দুঃখ দারিদ্রের দিনে যদি ১০০/২০০ ঘর লোকেও থিয়েটার করিয়া খাইতে পারে, সেটা কি মন্দ কথা?’ (এখনকার থিয়েটার : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ০২ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১)।

সেলিম আল দীন তাঁর থিয়েটারের কল্যাণে, আনন্দের সংবাদ এই যে, দেশের বহুসংখ্যক ভদ্রলোকের অন্নসংস্থান-প্রকল্পকে ইতোমধ্যেই বেগবান করেছেন। এমনকি মৃত্যুর পরেও, যাঁরা ওঁর নিয়মিত নট-নটী ছিলেন বা আছেন- বিবিধ বাণিজ্য-তরণী এবং কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির সেবাইত হিসেবে আশা করা যায়, এই আক্রার বাজারেও তাঁরা বিশেষ অন্ন-কষ্টে ভুগবেন না। আপাত-কৃতজ্ঞ ক্ষুধা-মুক্ত জনগোষ্ঠীর এখন প্রধান ধ্যান সেলিম আল দীন নামক একটি হেরিটেজ ইন্ডাস্ট্রি, একটি এক্সপ্লোরাটোরিয়াম, একটি মিউজিয়াম বা নিদেনপক্ষে একটি ডিসপ্লে শুরু করা যায় কিনা। ইতোমধ্যে ডিসপ্লে-পর্ষদে নানান সদস্যরা ভীড় জমাতে শুরু করেছেন; নিকট আত্মীয়-স্বজন, থিয়েটারের অপরাপর প্রাণ পুরুষ, তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ‘ডিসপ্লে’র রাজনীতি নিয়ে সদ্য সমাপ্তকারী ডক্টরেট, ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার, পত্রিকা অফিস, স্মৃতিরক্ষা কমিটি এবং তাঁর অগুনতি ছাত্র- যাদের কেউ অনুগত, কেউ খানিকটা দুর্বিনীত, কেউ ক্ষুব্ধ আবার কেউ একেবারে ন্যালাভোলা : ‘মাস্টার মশাই না থাকলে, আমাদের কান ধরে কে আর ক্লাসের বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে রাখবে!’- এরা সবাই যুক্ত হয়ে সেলিম আল দীন মিউজিয়ামের পত্তনি নিয়েছেন সম্প্রতি।

সেলিম আল দীন মিউজিয়ামের কিউরেটর, আমাদের যে পথের নির্দেশনা দিলেন আমরা এবার সেই পথে হাঁটতে শুরু করি ... ; (মিউজিয়াম আর ইনহেরেন্টলি ইন্টারএ্যাক্টিভ মাল্টিমিডিয়া)- ফেনী, ঢাকা, টাঙ্গাইল-করটিয়া হয়ে সুখ্যাত সৈয়দ আলি আহসানের প্রযতেœ কখন খ্যাতিমান অধ্যাপক-ভাবুক-নাট্যকার হলেন সেলিম, তার সংবাদ ঝুলে আছে প্রথম দেয়ালে। মিউজিয়ামের আলো, শব্দ, আর্টিফেক্ট এবং টেকস্ট ঠেলতে-ঠেলতে মানুষ হাঁটে, কথানাট্য দেখে অথবা এপিক রিয়েলিজমের অনুবাদ পড়ে: আমরা সৎসমাজ চাই, নাটকের মাধ্যমে আমরা সৎ সমাজের বক্তব্য রাখবো, নাটকে সুস্থ বক্তব্য থাকবে, শিল্প-সম্মত হবে, বাংলাদেশের লেখা নাটক করবো, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, টু ডিসকাভার দ্যা লস্ট হেরিটেজ এ্যান্ড দা মিসিং লিংক্স অফেন ওভারলুক্ড বাই হিস্টরিয়ান এ্যান্ড থিয়েটার গ্র“প ইন দা ইভুলুশন অফ বাংলা থিয়েটার। অথবা টু ইন্ট্রোডিউস কনটেম্পরারি থিমস্ এ্যান্ড কন্টেন্টস ইন দা ট্র্যাডিশান অব ফোক-থিয়েটার ফর্ম। ... ফাঁকে-ফাঁকে ঘন হলুদ-ফর্সা-নীল আলোর ভিতর সেলিম আল দীনের একদা লিব্রিয়াম, জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন, এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা, সংবাদ কার্টুন, অনিকেত অন্বেষণ, করিম বাওয়ালীর শত্র“ অথবা মূল মুখ দেখা, নীল শয়তান, মশারী ৭৩, সর্প বিষয়ক গল্প, চাবির দুঃখ, হরগজ, যৈবতী কন্যার মন, চাকা, তাহিতি ইত্যাদি-র পোস্টার বিবিধ বেলুন হয়ে নরম শীতাতপ-বাতাস দোল খায়, অথবা কতিপয় পোস্টার পেইন্টিংস-এর মতো আষ্টে-পিষ্ঠে দেয়ালের সঙ্গে মাউন্ট করা, অতিরিক্ত মনযোগ আদায়ের জন্য। লিব্রিয়াম এবং সর্প বিষয়ক গল্প-র পোস্টারে নাট্যকারকে না পেয়ে, আমরা পোস্টারের ছবিতে পেইন্টার খুঁজতে নামি- পেইন্টার একবার নিখোঁজ হয়ে যায়, আর একবার ভেসে এসে দর্শকের সারিতে দাঁড়ায়। অথবা দর্শক নিজেই একদা লিব্রিয়াম নামক মাইনর ট্রাংকুলাইজারের উত্তাপে লাশবাহী চাকার নিচে নাট্যকারের সংবাদ কার্টুন খোলাম কুচির মতো গুড়িয়ে যেতে দেখে অথবা তাঁর ধারাভাষ্যে ডুবে যেতে থাকে: দেখুন এই কথানাট্যের রচয়িতা এক বিবেচনায় প্রেতসিদ্ধ অথবা শিল্পসিদ্ধ- নয়তো তাঁর রচিত পংক্তির মন্ত্রমালায় কীভাবে তিনি ছায়াভুবন অর্থাৎ প্রেতলোক থেকে আকর্ষণ করেন তার উদ্দিষ্ট চরিত্রসকল? বর্ণে মেঘনীলিম হে ছায়ানারী, এই যন্ত্রধ্বনির সোনার সিঁড়িতে তোমার পা রাখো। তুমি দুই নামে দুই কায়া কিন্তু একই যৈবতী কন্যা। পরলোকের ধূম- অগ্নি যদি ভেদ কর- তবে আইস। ... আমি দুবার দুই জননীর উদর ছিঁড়ে রক্ত ও লালার স্রোতে নেমে এসেছিলাম। দুবারই যৌবনের উপান্তে এসে খুন করে ফেলি নিজেকে। প্রথম মৃত্যুর পর এক বিষণœ দেবদূত আমার আত্মাকে হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছিল। তাঁর কররেখার সুগন্ধ আমার মৃত্যুবিষকাষ্ঠের ওপর হিমের কুচি ছড়াল। টুনটুনীর ডিমের চেয়ে ছোট নয় আত্মা- নীল। ডানার বাতাসে নক্ষত্রের কুচিগুলো রাতের সমুদ্রে ফসফরাস ফেনা তরঙ্গে তরঙ্গে সরে যায়। তারপর ছায়াপথ দিয়ে মধ্য আকাশ থেকে পৃথিবীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ। যেতে যেতে টের পাই দেবদূতের চোখে জল। আমি ডিমের ভেতর থেকে ছোট্ট করে বলি, কাঁদো কেন, হে উজ্জ্বল দেবদূত! ভাইগণ, তোমাদের সামনে মুই ধরম কথা বুইলবো তাতে হামাকের পুণ্যি হবে, বুলবো? এ্যা? তবে বুলতেছি শুন। হে জিয়ো মুই হড় হোপনের গল্প বুইলবো। তখন তামাম পিরথিমী জলে ডুইবে আছে। শূন্য জল খল্খল্ করে তবে জিয়োর মন খারাপ। জলের ভিতরে তিনি ছেইড়ে দিলেন কাঁকড়া কাছিম। কিন্তুক তাতেও জিয়ো ভুগমানের মন ভরে না, বুলেন হামাকের বুকের পাঁজরখান শূন্যি লাগে কেন। ভুগমানের সঙ্গে-সঙ্গে নতুন এক হত্যা-রহস্য আমাদেরকেও বেদনার্ত করে ছাড়ে। পরিব্রাজকবৃন্দ মৃত্যু-উৎসব পর্যবেক্ষণের জন্য, উচ্চাঙ্গসঙ্গীত ডিপ্লোমাধারী কতিপয় সুকন্যা কর্তৃক দ্রুত সম্বোধিত হয়- শ্রোতৃমণ্ডলী এখন করুণা জাগে তাদের জন্য যারা তাকে হত্যা করেছে, যারা তাকে ভুল ঠিকানার দিকে প্রেরণ করেছে। করুণা জাগে তাদের জন্য যারা পেট চিরেছে, হত্যার কারণ গোপন করেছে যারা অন্যায়ভাবে। মানব কষ্টের সহস্র সহস্র বর্ষের সঙ্গী যুদ্ধজয়ী ষাঁড়কে অন্যায়ভাবে আঘাত করেছে। নয়ানপুর নবীনপুর জগতের মানুষের কান ও চোখ কর্দমে থুতুতে ভরুক। কেবল বৃদ্ধটি ছাড়া যে হয়তো আজ সন্ধ্যায় পর্যন্তও ভাবছে তারই সোনাফর। লালচে চাঁদ ওঠে পূর্বে। পনর রাতের চাঁদ। এবড়ো থেবড়ো গাঙের পাড় ধরে চলে লাশের সঙ্গে এরা। পূবের ছায়া পশ্চিমের চরে পড়ে। শান্ত জলে কীসের আভা? ভাঙা পাড় বেয়ে নেমে আসে ওরা বরফ গলে লাশ হালকা হয়ে এসেছে। গাড়িটি ও ষাঁড়দ্বয় উঁচু পাড়েই দাঁড়ানো থাকে। ... আজ শিল্পের অতিরিক্ত কোনো সুখ বহন করে চলেছে পরী। যে গঞ্জে যাবে নাম ছাতনপুর। শিল্পের অতিরিক্ত সুখ কি? নীল রৌদ্রে সতেজ সবুজের ভেতর দিয়ে অভিনয়ের উত্তাপ তৈরি হতো তখন তা মঞ্চদর্শক অতিক্রম করে নদীর স্রোতে স্রোতে দীর্ঘতর হয়। দর্শকের হৃদয়ে যা উপ্ত করা হলো তা চলে যায় জনের জনের যাতায়াতের দিকে- গন্তব্যে। আর যে বীজ বুনে দিল- ছাতনপুর কিমতিগঞ্জে আসার কোন ছড়ানো বীজের আনন্দ সকালের রৌদ্র, যান্ত্রিক শব্দ ও গতির সঙ্গে মিলে শিল্পেরও অতিরিক্ত একটি স্রোত তৈরি করে, হায় শ্রোতৃমণ্ডলী! সেই যে বিষখালী চরের নদীর বাঁকে নেচেছিল পূর্ণিমার নিচে- মৌরাবী গায় সোনাঝুরি ফুল-গাছদের পুতুল নাচিয়েছিল- সেই পরী এই লোকজ শিল্পের ভেতরে পতিত প্রাকৃত জীবনে অম্রনদীতে শেষমেষ জীবনশবের মান্দাস ভাসায় ... নিজেকে নিজের কাছে বড় বেশি ক্লান্তিকর ঠেকে। কিন্তু যখনি ভাবি আমি শীঘ্রই আত্মহত্যা করবো তখনই আকাশের নীল রৌদ্রচাঁদ নক্ষত্রমালাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করে। সেই যে আমার শাহামালের সঙ্গে যেতে যেতে সূর্যাস্ত দেখা। আশার চরে এ জীবনে আর পৌঁছানো হলো না। আসরের ফাঁকে ফাঁকে কোনো কোনো দিন নির্জন দুপুরে, সন্ধ্যায় কি চাঁদের রাতে নৌকায় ভাসা, হুলা বিড়াল, বাবার মুখ, সকিনা, অসহায় অন্ধদিদি, করুণ মীনাকুমারী, আমার উদর থেকে খসে যাওয়া নষ্ট ভ্রুণ, বুকের পাঁজর ছিঁড়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। সে শ্বাসে আমার প্রসাধনের আয়না ঘোলাটে হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি লোকলজ্জায় ভ্রুণহত্যা করিনি। আমার মনে হয়েছিল আসরের পথে পথে একজন পরীর কোনো স্বামী নাই, জনক জননী নাই, পুত্রকন্যা নাই। কিন্তু আজ শ্যামসোনাপুরে এসে ভাবি কী ক্ষতি হতো এই গজারী মহুয়া বনের পাতা ঝরানো হাওয়া লাগালে ওর বাড়ন্ত শরীরে! নাটকের প্রাচীন মাঠকর্মীবৃন্দ খানিকটা থেমে সেলিম আল দীনের কতিপয় কথানাট্য এবং কথাপুচ্ছ পাঠ করছিল ওঁর সুবিস্তৃত অমনিবাস থেকে। নাটকের মতো, পদ্যের মতো, গল্পের মতো- কেউ একজন অদৃশ্য অনর্গল আবৃত্তি করে চলেছে সুরেলা গলায়। মিউজিয়ামের আলো, নতুন রঙ, পুরোনো পোস্টারের গন্ধ এবং কতিপয় গানের ভেতর কে যেন অভিশাপ পাঠায়- কেরামতমঙ্গল পাঠে যে এ- কাব্য-দর্শনে আগ্রহী হয় না তার নিশুথ রাত্রির আকাশ হোক নক্ষত্রবিহীন! এই অভিশাপ মাথায় নিয়ে, আমরা জরুরি-সরকারের বিদ্যুৎ নিভে যেতে দেখি; খানিকটা হোঁচট খাওয়াÑ জরুরি আলোয়, নাটক থেকে এবার ঝুরঝুর কল্যাণবার্তা নেমে আসে: সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী এই নাটক দর্শনে সামাজিকগণের কল্যাণ হোক, পুণ্য হোক। যে এই নাটক দেখে- সামাজিক মঙ্গল সাধনে সে যেন তৎপর হয়। অন্যায় অবিচারের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। যে এই নাটক দেখে- সে যেন শমলার অপরিপুষ্ট ভ্রুণের নিরাপত্তা বিধান করে। পৃথিবীর সমস্ত ভ্রুণের জন্য যেন সে মমতার হাত বাড়ায়। মানব জনমকে সামাজিকগণ যেন স্বাগত জানায়। এই নাটক দর্শনে বন্ধ্যা নারী যেন ফলবতী হয়। ... এই নাটকের রচয়িতা কোরানের দোজখ বর্ণনাকে তার অতুলনীয় ভয়াবহ চিত্রকল্পের স্রষ্টাকে প্রণাম জানায়। এই নাটকের রচয়িতা আভূমি প্রণাম জানায় বাংলা কাব্যে মধ্যযুগের মহান কবিদের। এই নাটকের রচয়িতা মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কবিদের প্রণাম করে। এই নাটকের রচয়িতা সন্ত কবি দান্তেকে প্রণাম জানায়। এই নাটকের রচয়িতা লাঞ্ছিত যীশুর ক্রুশ কাঠকে প্রণাম জানায়। ... আর এই নাটক দর্শনে অবশ্যই বন্ধ্যা নারী ফলবতী হবে!

মন্ত্রপড়া মানুষেরা অভিভূতি নিয়ে এক-দু’জন ইনফার্টিলিটি আক্রান্ত নারী সামান্য আলোড়িত হয়Ñ নাটক তাহলে বন্ধ্যাত্ব দূর করার শক্তি রাখে? এদের কেউ সন্তান তৈরির টেকনোলজি নিয়ে তথ্য যোগাড় করছিল; ভাবছিল- পালক সন্তানের আনন্দ এবং বিভ্রম কীভাবে একটি এ্যাডপশন-ত্রিভূজ তৈরি করে, নাকি সন্তানহীনতার মধ্যেই আগামীতে নতুন এক মঙ্গলকাব্য খুঁজতে হবে আমাদের?

জবাব পাওয়ার আগেই সেলিম আল দীন মিউজিয়াম’এর দ্বারোদ্ঘাটন উপলক্ষে আয়োজিত বিপুল ডামাডোলে কতিপয় বন্ধ্যানারীর সম্ভাব্য আনন্দ-বেদনা দ্রুত ডুবে যেতে থাকে। সেলিমের নাট্যভাবনা অথবা তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা নিয়ে গভীর-গম্ভীর আলোচনা শুরু হয়েছে পাশের ফ্লোরে। সেলিমের বিবিধ বেলুন জণ্ডিস আলোয় কেঁপে কেঁপে করিম বাওয়ালীর শত্র“কে আদর করছে। দু’একটি শিশু গোপনে আঙ্গুল ছুঁয়ে বেলুন দেখে। কেউ মিউজিয়াম, জ্ঞান ও ক্ষমতা নিয়ে কথা বলে- পলিটিক্স কেবল রাজা-বাহাদুরের সিংহাসন জুড়েই থাকে না? এই মিউজিয়ামের আর্কিটেকচার, এই প্রদর্শনীতে আর্টিফেক্টগুলো যেভাবে জাক্সটাপোজড করছি, সেলিমের নানান ব্যবহার্য এই যে খানিকটা গ্লাস-কেসে ঢেকেছি, খানিকটা ঢাকা পড়ে নি, সেলিমের ওপর তৈরি ডকুমেন্টরিতে এই যে কোথাও কথা জুড়ে দেয়া হয়েছে, কোথাও রয়ে গেছে কেবল নীরবতা- এই আপাত অরাজনৈতিক আয়োজনের মধ্যেই ডিসপ্লে’র রাজনীতি আলো-অন্ধকার হয়ে লেগে থাকছে। হয়তো সেলিমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেকস্টের ওপর কিউরেটর এবং দলের হাই-কমান্ড পর্যাপ্ত আলো দিতে ইচ্ছুক নন। আলো সরে গিয়ে মেঝে এবং দরজার দিকে পিছলে গেছে। আমরা ভাবছি তাহলে এই প্রদর্শনীর মূল অথার কারা? পিচ্ছিল আলো সেলিমের পোট্রেট ছুঁয়ে বিশিষ্ট নাট্যজন এবং সিভিল সোসাইটির প্রিয়দর্শনী সদস্যের ইয়ার রিং চুইয়ে নামছে। তাহলে কী বলবো যারা আয়োজন করলেন তারাই এই সভার মূল অথার এবং আলোকিত মানবমণ্ডলী? শেষতক জানা সম্ভব হয় না, দর্শকদের এরা কীভাবে অনুধাবন করলেন আর কারা হিসেবের বাইরে রইলেন। মিউজিয়ামের ডিসপ্লে-পদ্ধতি নিয়ে যাদের অপার জ্ঞান-গম্যি তাদের কেউ আমাদেরকে অভয় দেন- আসলে এই প্রদর্শনী, এই মিউজিয়াম, দেখার আর এক চশমা বটে- এই চশমার গুণে সেলিমের ইতিহাস, ওঁর সংঘ-চেতনা, উন্নয়নকর্ম, সংস্কৃতিভাবনা ইত্যাদি মিলিয়ে ওঁর ব্যক্তিগত সাম্রাজ্যের একটি খতিয়ান বোঝা সম্ভব, অথবা এই আশ্চর্য চশমা দিয়ে এক লহমায় এই ছোট্ট ঘরের ভেতর একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব। সেলিমের বই-পুস্তক, ওঁর লেখার সরঞ্জাম, ওঁর নথিপত্র, ওঁর গানবাদ্য, নরওয়েজিয়ান বরফপাত নিয়ে ওঁর মুগ্ধতা, ওঁর বিবিধ ফটোগ্রাফÑপ্রতিমুহূর্তে সকল ভিজিটর পড়তে পারেন না; ফলে মিউজিয়ামের আলো-ছায়া এবং বিশিষ্টজনদের ডিওডরেন্ট মাড়িয়ে আমাদের চোখ-কান যে কথামালা তৈরি করে আমরা তা-ই নিজের মতো আত্মস্থ করতে শিখি। মিউজিয়ামকে কি তবে বলতে পারি, ... এ পার্ট অব দি লেইজার এ্যান্ড টুরিস্ট ইন্ডাস্ট্রিজ? আমরা যারা কালো-কোলো- ন্যালাভোলা-এ্যাসথেটিক্সশূন্য দর্শক, এখন সবাই বিভ্রমে পড়ি; এই আয়োজনের কোন অংশ পরিচালকের, কোন অংশ এঞ্জিনিয়ারের, কোন অংশ কবি’র, কোন অংশ উপন্যাসিকের, কোন অংশ ফটোগ্রাফারের, কোন অংশ পেইন্টারের সহজে আলাদা করতে পারি না! সেলিমের আত্মজীবনী এবং শিল্পকর্ম আলো এবং আয়নার কারসাজিতে বদলে যেতে থাকে। লক্ষ্য করি- সেলিম এবং ওঁর নিরুপায় ইলেক্ট্রনিক্স-জগত আমাদের ক্ষ্যাপাটে সরকার, বহুজাতিক কর্পোরেশন, সামরিক শক্তি, কল্যাণময় রাষ্ট্র, স্যাটেলাইট সিস্টেম, রাজনৈতিক গন্তব্য, কল্পনা প্রবণতা, কল্পনার বিস্তার, শ্রম নিয়ন্ত্রণ, অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট, প্রোসথেসিস, বাণিজ্যিক পর্ণোগ্রাফি, আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজন এবং ধর্ম-প্রণোদনা ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে।

কয়েকজন উৎসাহী দর্শক সেলিমের অভিজ্ঞান খুঁজতে যেয়ে জামশা গ্রামের হাকিম আলি গায়েনের পোট্রেট দেখছিল। রাখালের পিঠা গাছ এবং কাজল রেখার হাস্তর আয়োজন করেছে নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। স্টিভ ফ্রিডম্যান আর জামিল আহমেদ চাকা করার অভিজ্ঞতা বলছিলেন পরিশীলিত উচ্চারণে। দুই পাশে দুটি বালিশ নিয়ে মনসুর বয়াতীর ফটো সেলিমের সাথে। আমরা প্রদর্শনীর ফাঁকে সেলিমের উদ্দেশে নিবেদিত তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা শীর্ষক আলোচনা শুনতে শুনতে নাটকের তত্ত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে ভাবিত হই; সেলিম ওঁর নাট্যকথায় কোনো দিন পাওলো ফ্রেইরে বা বোয়াল এর কথা বলেন নি- এঁরা বন্দি হয়েছিলেন কেবলমাত্র নাটকের জন্য, এমনকি এক পর্যায়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। সেলিম কোনো দিন নাটককে আনন্দদায়ক, প্রাণময় ও জঙ্গী শিক্ষার বাহন হিসেবে দেখেছিলেন কিনা জানি না। বোয়াল যেমন ভাবতেন, রূপান্তরের মাধ্যমে দর্শককে বাস্তব বিষয়ের মহড়ায় সাহায্য করতে চেষ্টা করা হবে, যা তাকে মুক্তির দিকে চালিত করবে-; সেলিম তাঁর কথাপুচ্ছ’এ এ-সম্পর্কিত কথা না বলে মূলত সচেষ্ট হয়েছেন ‘কথানাট্য’ নামক তাঁর প্রকাশের উপায়কে আবারও ঝোঁক দিয়ে বর্ণনা করতে। সে অর্থে, সেলিমের মৌল প্রবণতায় আমরা থিয়েটার ফর ডেভেলপমেন্ট বা থিয়েটার অব অপ্রেসড নামক কোনো পুস্তিকার বিশেষ আভাষ দেখতে পাই না। ‘মুক্তির ভীতি’ নিয়ে কি তিনি নাট্যতত্ত্বের ক্লাসে কোনো দিন এক-দু ঘন্টা অনর্গল কথা বলেছিলেন, অথবা সমস্যা চিহ্নায়ন শিক্ষার স্বরূপ নির্ণয়ে আমরা কি আদৌ কোনো দিন প্রশ্ন তুলতে পেরেছিলাম সেলিমের নাট্যতত্ত্বের ক্লাসে? পরক্ষণে ভেবেছি- সেলিমকে এ বিষয়ে আদৌ কাঠগোড়ায় দাঁড় করানো যায় কিনা? ওঁর স্বভাব, নাটক নিয়ে ওঁর ভাবনা, ওঁর গাজীগান, হাস্তর এবং অধ্যাপক সত্ত্বা যে ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ তৈরি করে- তাই সেলিম আল দীন নামক একজন লেখকের কথানাট্য। ওঁর কথানাট্য আমি ছবি, গান, পদ্য, গল্প অথবা ইমেজ আকারে পড়তে থাকি; কখনও খুব এলোমেলো উল্টে গেছি, কখনও থমকে দাঁড়াই, আবার কখনও অনেকখানি গুছিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছি- শেষমেষ ধারণা জন্মে, ওঁর কথানাট্যের নানান অর্থ, ভাষাকে বহন করে আসলে আমাদেরকে ক্রমাগত সংস্কৃতির নানা শাখা-প্রশাখার সঙ্গে যুক্ত করে গেছে। সংস্কৃতির অপর সদস্যরা তখন তাদের জ্ঞান নামক ‘ক্ষমতা’ এবং রিপ্রেজেন্টেশন-এর গুণে সেলিমকে গ্রহণ করে অথবা বর্জন করে। কেউ এই যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নতাড়িত হয়; উচ্ছ্বাসময় কণ্ঠে সিনেমার জয়গান গায়- শেক্সপীয়র, রেমব্যান্ট, বিটোফেন, এবার চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করবে। সেলিমের কথানাট্যও তবে কি যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে ঢুকে পড়ছে? কালচারাল স্টাডিজ এবং কালচারাল থিয়োরির মান্যজনেরা সেলিমকে আরো নানান স্তর থেকে ব্যবচ্ছেদ করার ক্ষমতা ও অধিকার প্রদর্শন করতে শুরু করেন- নাটকের নানা ফর্ম নিয়ে একজন রেমন্ড উইলিয়ামস জিজ্ঞাসু হন; পপুলার কালচারের সঙ্গে সেলিমের হাই কালচার নিয়ে তর্ক ওঠে; ওঁর লেখায় কালচার ও এ্যানার্কির বিস্তার খুঁজতে কেউ নামে, যেভাবে তিনি নেগোশিয়েট করতেন কালচার ইন্ডাস্ট্রির কাছে, তার বর্ণনা তৈরি হয়; তাঁর ‘পাঠ ও অপাঠ’র দ্বন্দ্ব ও নীরবতা নিয়ে সুলিখিত প্রবন্ধ আসে; যাঁরা তাঁর কালচারাল এন্টারপ্রেনিওরশিপ গ্রহণ করেন তাদের নাম ঠিকানা ও কৌলিণ্য চিহ্নিত হয়, আর সবশেষে তীব্র আলোচনা উত্থাপিত হয় আমাদের সামগ্রিক কালচারাল স্টাডিজ, কালচারাল ক্যাপিটাল এবং পলিটিক্যাল ইকোনোমি নিয়ে। একজন ক্ষ্যাপাটে আলোচক আমাদের বুরোক্রেসি এবং সময়কে রিচার্ড সেনেট (দি কালচার অফ দি নিউ ক্যাপিটালিজম)’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন- আমাদের পুরো সময় আসলে দি মিলিটারাইজেশন অফ সোশাল টাইম, এমনকি উত্তেজিত স্বরে তিনি এক সময় আমাদের রাজনীতি ও ভোগবাদীতার ভেতর লুকোনো ‘থিয়েটার’ আবিষ্কার করতে শুরু করেন- দা রিয়েলম অব কনজামশন ইজ থিয়েট্রিক্যাল বিকজ, দা সেলার, লাইক আ প্লেরাইট, হ্যাজ টু কমান্ড দা উইলিং সাসপেনশন অফ ডিজবিলিফ ইন অর্ডার ফর দা কনজুমার টু বায়। .. আবার দেখুন পলিটিক্স নিজেই এখন যথেষ্ট থিয়েটার করছে- পলিটিক্স ইজ ইকুয়েলি থিয়েট্রিক্যাল! মঞ্চের বাইরে বেড়ে ওঠা এই থিয়েটারের পাঁকে ডুবতে ডুবতে, কিংবা এই তীব্র সেনা শাসিত সময়ে দিক-চিহ্নের আন্দাজ নিতে নিতে সেলিমের ‘লেখা’ একটি উপলক্ষ হয় বটে, কিন্তু লেখাপাঠের মাধ্যমে পাঠক নিজেই নিজেকে পাঠ করার একটি সুযোগ খুঁজে পান। সেক্ষেত্রে, লেখক সেলিম একটি দেখার যন্ত্র সরবরাহ করেন, যাতে করে পাঠক নিজেকে আর এক প্রস্থ আত্ম-অবলোকনের অবকাশ পান।

সেলিমের ‘লেখা’ গান-কবিতা-উপন্যাস অথবা নিরেট নাটকের টেকস্ট হিসেবে রিপ্রেজেন্টেড হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলে কতিপয় যুবক লেখক এবং কাগজ-কোম্পানি সেলিমের বক্তব্য ঘষা-মাজা করে বই ছাপেন; তিনশ টাকার বিনিময়ে সেলিমের এই ভাবনা-বৃত্তান্ত আমরা উল্টে দেখি: সেলিমের বক্তব্য এবং বৈপরিত্য ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়- ... আমি লিটল ম্যাগাজিনকে অফ দা ওয়ে ম্যাগাজিন বলি। আমি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী। আমার লেখা এখন হিন্দি, ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং সুইডিশ ভাষায় অনূদিত। ঊষা গাঙ্গুলি হরগজ করেছেন। উচ্চমানের প্যাকেজ নাটকে হাত দিয়েছি, আমার মূল কাজ শিল্প রচনা। বিশেষত কবিদের মধ্যে আমার রচনা বিষয়ে গভীর উৎসুক্য দেখে আমি আশান্বিত। আমরা মুক্তিযুদ্ধে প্রকল্প গ্রহণ করেছি। চাকা-কে আপনি কবিতা করে সাজান। টেলিভিশনে শিগগিরই আমি উপস্থিত হবো। আমার পরিকল্পনা একটি পণ্য সভ্যতা-বিরোধী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলবো। (রম্যাঁ রলা বলতেন ‘বিশ্বগ্রন্থাগার’এর কথা।) এথনিক থিয়েটারে হাত দিয়েছি। পাঙ্খু ধীর লয়ের নাচ। চাকা নাটকে সংগীতের স্পর্শ খুঁজুন। দীলিপ রায় এবং উমা বসুর গান শুনছি। চর কাঁকড়া করতে যেয়ে নাট্যকর্মীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়লো। লেখকের লেখা গদ্য হতে পারে না। কাজের ভাষা গদ্য, শিল্পীর ভাষা কবিতা। পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ। ব্রেখটকে পলিটিক্যাল এজিটেটর ও সেলিমকে হিউম্যান এজিটেটর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বিশ্ব নাটকের ক্ষেত্রে। উত্তরকালে আমি জাতীয় নাট্য-আঙ্গিকের ধারণায় উপনীত হই। আমি নিশ্চিতভাবে ব্রেখটের শিল্পরীতির বিরোধী। চাকা লিখতে লাগলো পাঁচ দিন পাঁচ রাত। জন্মদিবসের পরিণতি মৃত্যুদিবস। পঞ্চাশ বছর, নক্ষত্রের আয়ূর তুলনায় কতই না কম। একটা কাছিমও একশ বছর বাঁচে। শুরুতে কবিতা লেখায় নিবিষ্ট ছিলাম। রফিক আজাদ আমাকে শুধুমাত্র নাট্য রচনায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেন, আমার লেখায় মূল বিন্দুতে উপন্যাস, সঙ্গীত, চিত্রকলা ও প্রবন্ধ ক্রমে ভীড় করেছে। (মালার্মের ‘সংগীতের ধর্ম’- কথাটি কি ভাবনায় আসে?)। আমার গভীর প্রার্থনা মঞ্চগুলো হয়ে উঠবে গণতন্ত্র চর্চার কেন্দ্রভূমি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, শিল্প-চেতনা-সংস্কৃতি- সব কিছুর পথ প্রদর্শক হিসেবে ঐ মঞ্চ একটা অসাধারণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। নতুন নাটক তৈরির জন্য কলম্বো, কেপটাউন, ভালেত্তি, রিও ডি জেনিরো, জাভা, হংকং, লিভারপুল, বার্সিলোনা প্রভৃতি সমুদ্র বন্দরের নানান বিবরণ জড়ো করেছি। (‘কারিগর যেভাবে চেয়ার বানায়, আমি সেভাবে নাটক তৈরি করি।’- জাঁ আনুই)। টেলিভিশন থেকে আমি গুটিয়ে নিয়েছি এ-কথা সত্য নয়- টেলিভিশনই আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমি মার্কসবাদী নই। আমি শিল্পীর সাহস এবং সততা নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াতে চাই। মুনীর চৌধুরীর সবচেয়ে বড় সমস্যা তার মধ্যে বার্নাডশ’র প্রভাব। আমি সাভারে থাকি। গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশান কী করছে, আমি কিছুই জানি না। (আপনারা ছুটছেন অর্থের পেছনে, জনপ্রিয়তার পেছনে। খুব কি ভুল বলা হবে?) আসলে জীবন ও জীবিকার কারণে এমনটা হয়েছে। নাটক তো তেমন কিছুই দিচ্ছে না। নাটক থেকে না পেয়ে এমনটা হচ্ছে। আমার লেখার প্রকাশক গ্রন্থ প্রকাশ করে অর্থদণ্ড নেয়। ... সরকার গোয়েন্দা কাহিনী কিনে পাঠাগারে পাঠায়। হরগজ রচনাকালে রাষ্ট্র ভাঙনের রাজনৈতিক ঘটনাগুলো নেপথ্যে সক্রিয় ছিল। এই সময়ে রাশিয়ার ভাঙনে বিশ্বরাষ্ট্র-ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি শঙ্কাও উপস্থিত হয়েছিল। ... সকল মহৎ কবিই বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথের জয় পরাজয় গল্পটি প্রায় সম্পূর্ণ সুরারোপ করেছি। চাকা-র সবকটি গানই সরাসরি গদ্যে সুরারোপ। ইংরেজী ভাষা বাংলার মতো গীতল নয়। ঢাকা থিয়েটার অভিনয়কে অনুকরণ মনে করে না। এটা হচ্ছে জীবন ও জগতের ব্যাখ্যা। শেক্সপীয়র আমার পছন্দ না। রুক্সবর্ণ আমার সবচেয়ে কাছাকাছি আত্মজৈবনিক লেখা। আমার প্রথম সন্তানটি অপরিপুষ্ট ভ্রুণ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। শিল্পের ভাষা সবটাই হবে নির্মিতি। নির্মিতি মানেই কাব্য। এস এম সুলতানের সাথে আমার কথা হয়েছিল। থিমের ব্যাপারে তাঁর সাথে আমার মতদ্বৈততা হয়েছিল। কিন্তু ভাষার ব্যাপারে তাঁর সাজেশনটাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছিলাম। সব লেখকেরই তিন-চারটা যুগ থাকে। লেখার প্রতœপ্রস্তর যুগ, প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ ... লৌহ যুগ। কম্পিউটার ব্যবসায়ীদের বানানো কথায় যারা পা দিয়েছে, তারা নিশ্চয়ই খুব বোকামী করেছে।  ... ঘড়ি দেখতে দেখতেই তুমি একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারো। মানুষের তো অবসর লাগে। অবসরটা কোথায় মানুষের? আমেরিকানরা এখন ৫-৬% নাটক দেখে। আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করি ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে। অষ্টম শ্রেণীতেই শান্তিনিকেতনে পালাতে চেয়েছিলাম। আধুনিকতা মানেই হচ্ছে সর্বগ্রাহিতা। ক্লাস টু-তে পড়ার সময় হাতির পিঠে চড়ে খাসিয়া পল্লীতে গিয়েছিলাম। মার্ক্সীয় ভাবনার একটি প্রধান ক্রুটি এর সাংস্কৃতিক দর্শন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমি প্রাচীন বাংলার ধর্মপাল, দেবপাল এবং নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ ও আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজ্য ও রাষ্ট্রনীতিকে বিশ্বাস করি। বাংলা সাহিত্য এত বড়, এত বিশাল, একটা মাছ শিকারের গল্প নেই। এখনকার তরুণ লেখকেরা বিশটি ধানের নাম জানে না। নাট্যকার ক্রমেই দূরবর্তী, ডিরেক্টর একটা বড় জায়গায় চলে আসছেন। মানুষের যে নিউরোবায়োলজিক্যাল বা স্নায়ূ-জৈবিক পরিবর্তন তার ভিতরে পপার এবং হকিংস, ইকলিস, এরা প্রমাণ করে ছেড়েছেন যে, স্নায়ূতন্ত্রের মধ্যেই মানুষের রূপসৃষ্টির স্থান। ফেরদৌসি মহাকাব্য যে না পড়েছে সে শিশু। মা কৃষ্ণনগরে নজরুলের গান শুনেছিলেন দোতলা থেকে- শিকলপরা ছল মোদের এই শিকলপরা ছল। ক্লাস এইটে ডিকশনারি দেখে দেখে মেঘনাদ বধ কাব্য পড়ে ফেলেছি। আবদুল্লাহ আল মামুন প্রশ্ন শুরু করলেন- তুমি কী কী পড়েছ? আমি তখন বললাম- চেকভ, আনুই, সার্ত্র এ-সব পড়েছি। ... ব্যস পেয়ে গেলাম চেক। ৪০০ টাকা পেয়েছিলাম (‘দর্শক ও সমালোচকদের জন্যও যদি রিহার্সেলের বন্দোবস্ত থাকত, চমৎকার হত।’- জাঁ আনুই)। কাম্যুর ক্যালিগুলা পড়ে ঘুমাতে পারি নি। রাজনীতি যারা করতো, তাদেরকে আমরা বিশেষভাবে উপহাস করতাম, বিশেষ করে আমরা যারা কবি ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের কালে বন্ধুরা বললো, আপনি শুধু কবিতা আর নাটক লিখবেন। আমিও তাই করতাম। আমি মূলত রবীন্দ্রনাথের পথেই চলেছি বলে মনে করি। বৌদ্ধের বাণী দিয়ে ধাবমান শেষ করেছি। আমি এই লেখাটায় নাট্যকার, কবি এবং উপন্যাসিকদের চ্যালেঞ্জ করলাম যে, ইউ শুড গো, ইউ শুড ফলো দিস লাইন- এই রাস্তায় তোমাদের আসা উচিত। ইউসুফের হাতে বাংলা নাটকের নতুন একটা গ্রামার তৈরি হচ্ছে, সেটা হচ্ছে যে, অভিনেতার ডিএ্যাক্টারাইজড হয়ে যাওয়া। মহররমের পুঁথি থেকে, অর্ধযতি দেবার জন্য আমি তারকা চিহ্ন ব্যবহার করি। একবার যেন কোথায় গেলাম- দিগন্ত জোড়া সর্ষেফুল, মনে হলো রঙের ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। এক সৈনিকের সঙ্গে কথা হল; আর্টিলারিতে যারা কাজ করে, তাদের আকাশের তারার হিসাব রাখতে হয়। তো টার্ম কিন্তু একটাই- সাবলাইম, যেটাকে বলে পেরি-হাইপসু, মানে চূড়ান্ত শিল্পকর্ম। আমাদের গ্রামীণ থিয়েটার এবং গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মকাল কিন্তু প্রায় একই সময়। কিন্তু আমরা নিয়েছি কেবল ইউনিসেফের ফান্ড। কিন্তু চিরটাকালই একটি সমস্যা থেকে গেল- আমার নাটকের যে নাগরিক দর্শক, তাদের বেড়ে ওঠা হলো গতানুগতিক, শাদা চোখ দিয়ে দেখে দেখে বেড়ে ওঠা। তাদের মধ্যে ক্যাথারসিস তৈরি করাটা প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। ... এই হলো ঢাকা শহর। জ্বী হ্যাঁ, কালোবাজারী, চোরাকারবারীর শহর, মুনাফাখোর, মজুতদারদের শহর, হাইজাকার, ব্যাংক লুটেরা ও নকলবাজের শহর। ঢাকা শহর ...।

সেলিম আল দীন, এই চিরকালের পরিচিত ঢাকা শহরের নাগরিকদের জন্য নাটক রচনা করে, একটি বিশিষ্ট নাগরিক শোকসভার জন্ম দান করেন ২০০৮ সালে ১৪ জানুয়ারি।

শোকসভার আনন্দ-বেদনা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই, অনুমান হয়- সেলিমের বিবিধ অভিজ্ঞান এবং ধ্যানমগ্নতা নিয়ে তর্ক তুলতে তুলতে দীর্ঘতম অভিসন্দর্ভ হয়তো লিখে ফেলবেন কেউ। সেনানিবাসের বুকের ভেতর শুয়ে থাকা নাট্যতত্ত্বের ছাত্ররা কবে ওঁর ৫০ বছর পূর্তি উৎসব করেছিল! কেউ কি সেদিন ওঁর রবীন্দ্র-প্রেমকে সম্মান দেখানোর জন্য রবীন্দ্রনাথের আত্মপরিচয় আবৃত্তি করেছিল? ওঁর কিউরেটরকে বশ করে, সেলিম আল দীনের ৫০ বছর বয়সী ছবির নিচে এই অংশটুকুর জেরোক্স ঝুলিয়ে দেয়া যায়- আমার তো বয়স পঞ্চাশ পার হইলো। এখন বনে যাইবার ডাক পড়িয়াছে। এখন ত্যাগেরই দিন। এখন নতুন সন্ধ্যার বোঝা মাথায় করিলে তো কাজ চলিবে না। অতএব এই পঞ্চাশের পরেও ঈশ্বর যদি আমাকে সম্মান জুটাইয়া দেন তবে নিশ্চয় বুঝিব, সে কেবল ত্যাগ শিক্ষারই জন্য।

সেলিম আল দীন-মিউজিয়ামের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হরগজ এবং নিমজ্জন-এর মৃত্যু উৎসবকে আরো বাক্সময় করার জন্য ওয়াল্টার বেঞ্জামিন এর বাংলা অনুবাদ চিত্রিত করেছেন অপরূপ ক্যালিগ্রাফিতে; দর্শকবৃন্দ বেঞ্জামিনের উদ্ধৃতিতে মারিনেডির ইশতেহার পাঠ করে- সাতাশ বছর ধরে আমরা যুদ্ধকে নান্দনিকতার শত্র“ হিসেবে অভিহিত করার বিরোধিতা করে আসছি। আমরা বলি যুদ্ধ সুন্দর। কারণ, যুদ্ধ গ্যাসমুখোশ, ভীতিকর মেগাফোন, অগ্নিশিখা নিক্ষেপক এবং ট্যাংকের মাধ্যমে মানুষের সর্বৈব কর্তৃত্বকে নিশ্চিত করে। যুদ্ধ সুন্দর, কারণ, তা মৃত্তিকাকে সমৃদ্ধ করে মেশিনগান থেকে ঝরে পড়া আগুনের অর্কিডে। যুদ্ধ সুন্দর, কারণ- তোপধ্বনি, বিরামহীন কামান দাগানো, যুদ্ধ-বিরতি, বারুদের গন্ধ, পচনের দুর্গন্ধ- সব কিছুকে একটি সিম্ফনিতে পরিণত করে। যুদ্ধ সুন্দর, কারণ এটি নতুন স্থাপত্যকলার উন্মেষ ঘটায়। বড় বড় ট্যাংক, বিমানের জ্যামিতিক রকম-ফের এবং প্রজ্জ্বলিত গ্রামগুলো থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি জুড়ে স্থাপত্যকলাসমূহ কেবল বিস্তার লাভ করে। ভবিষ্যৎবাদী কবি এবং শিল্পীগণ, সমর-নান্দনিকতার এই নীতিগুলো বিস্মৃতি হবেন না; নতুন সাহিত্য ও শিল্পের জন্য আপনাদের সংগ্রাম এগুলো দ্বারা উজ্জীবিত হতে পারে।

শিল্পের ভেতর বারুদ এবং সংগ্রামের দ্রোহ শ্মশানঘাটের আগুন ছাইয়ের মত উড়ে উড়ে আসুক- সেলিম আল দীন, এই কনফেশন কোথাও কি করেছিলেন? ছাপানো স্মারকগ্রন্থে সহসা আমরা এমনিতর বাক্যগুচ্ছ খুঁজে পাই না।

ধীরে ধীরে বেলা ডুবে যাচ্ছে ভেবে কিউরেটর মিউজিয়ামের দরজা-জানালা বন্ধ করতে চাইছেন। আমরা বেরুনোর জন্য দরজায় ভিড় করি। ভিজিটর্স বুকে লেখার জন্য গোপনে রবীন্দ্রনাথ নকল করেছিলাম। হতে কি পারে, কেউ দারোয়ানের অগোচরে সারা-রাত সেলিমের জাদুঘরে আটকে গেল? জাদুঘরের বাইরে অল্প-আলোয়, আকাশের কালপুরুষ দেখি অথবা সেনাশাসিত সামাজিক দিন-কালের জটায় সার খুঁজতে যেয়ে কৃষকের রক্তবমি দেখি, কৃষকের আত্মহনন পড়ি অথবা অনেক রাতে সিঁদ কেটে নিছক ভাত চুরির গল্প পড়ি। আমাদের ভোঁতা মন, মুমূর্ষু আত্মা, ক্ষুধার্ত শরীর, সেলিম আল দীনের নগদ মৃত্যুর জন্য কোথাও মায়া অনুভব করে। মিউজিয়ামের ভিজিটর্স বুকে, যা লিখতে পারি নি, তা এবার কাগজের ভাঁজ খুলে পড়ি- এক সময় যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলাম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়তো, সূর্য কিরণে আমার সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধ উত্তাপ উত্থিত হতে থাকতো, আমি কত দূরদূরান্তের দেশ দেশান্তরের জল-স্থল ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নিচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতেম, তখন শরৎ-সূর্য থেকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে একটি আনন্দরস, যে একটি জীবনী শক্তি অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকাণ্ড বৃহৎভাবে সঞ্চারিত হতে থাকতো, তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে। আমার এই যে মনের ভাব, এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত মুকুলিত সূর্যস্নাত আদিম পৃথিবীর ভাব, যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিকড়ে, শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে, সমস্ত শস্যক্ষেত রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে এবং নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থর থর করে কাঁপছে।

পৃথিবীর এই চেনা ঘাস-পাতার কাঁপুনি দেখতে দেখতে এবার অনুভব হয়, মিউজিয়ামের দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কর্পোরেশনের আলো এসে পড়েছে বন্ধ দরজায়। আমরা মিউজিয়াম ফেরত কতিপয় মানুষ দরজার গায়ে সেঁটে থাকা পুরনো একটি ছবি দেখে আবার দাঁড়াই- একজন মঈনউদ্দীন সেলিম অথবা সেলিম আল দীন-নামক কিশোর, হাতির পিঠে চড়ে খাসিয়া পল্লীতে হারিয়ে যেতে যেতে কেবল উদ্বেলিত হচ্ছে, শান্তিনিকেতনে পলায়নের পথ খুঁজে না পেয়ে। খাসিয়া পল্লী থেকে মৃদু-গম্ভীর-আনন্দময় সঙ্গীত ভেসে আসছে যেন। বহু বছর পর মালার্মের আদলে ‘সংগীতের ধর্ম’ ছিনিয়ে নেয়ার জেদ শুরু হয় কি ছেলেটির? (মালার্মের ভাগনার এক অনন্ত সংগীত তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা নাটকে নিখুঁত ঐক্যকে সম্ভব করে তুলবে, যেখানে সঙ্গীত, কবিতা, দৃশ্য, মঞ্চ-রূপায়ণ, নৃত্য মিশে একই লক্ষ্যের দিকে এগুবে!) ছেলেটি অতঃপর হাতির পিঠে ঘুমুতে ঘুমুতে রম্যাঁ রলা’র ‘বিশ্বগ্রন্থাগার’ এর মত একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির স্বপ্ন দেখে। (রম্যাঁ রলা ভেবেছিলেন গ্রন্থাগারের প্রথম পুস্তক হবে, নিজের অনূদিত রবীন্দ্রনাথের ফরাসী চতুরঙ্গ।) জাঁ আনুই-র নাম উচ্চারণ করে টেলিভিশন নাটকের প্রথম সম্মানী গ্রহণের সময় ছেলেটির একবার মনে হয়, বলি- ‘কারিগর যেভাবে চেয়ার বানায়, আমি সেভাবে নাটক তৈরি করি।’ নাকি খুব ক্রোধ ছড়িয়ে টেলিভিশন-মহাপরিচালককে বলতে পেরেছিল- ‘দর্শক ও সমালোচকদের জন্যও যদি রিহার্সেলের বন্দোবস্ত থাকত, চমৎকার হত’? দূর লোকালয় থেকে এবার অনুমান হয়- একজন স্বপ্নভূক কিশোর হাতির পিঠে এথনিক থিয়েটারের খোঁজে অরণ্যের অন্ধকার বুকের ভেতর এগিয়ে যাচ্ছে মৃদু ঘন্টা তুলতে তুলতে; আর আমরা অধীর অপেক্ষায়, কারণ আজ থেকে দর্শক ও সমালোচকদের জন্য জাঁ আনুই লম্বা এক রিহার্সেলের বন্দোবস্ত করবেন।


মামুন হুসাইন : গল্পকার