Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সেলিমের মঞ্চনাটক

Written by কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

আমরা যখন সেলিম আল দীনের কতিপয় মঞ্চনাটক নিয়ে আলোচনা করব, তখন আমরা কদাচিত ভুলে থাকতে চাইব যে, তিনি বেশকিছু টিভি-নাটক লিখেছেন, যেখানে, টিভি-নাটকের বাজারচলতি ধারণাকে একেবারে নাড়িয়ে-সারিয়ে দিতে পেরেছিলেন। নাটকের উপস্থাপনা, বক্তব্য, স্ক্রিপ্ট লেখার ধরন, অভিনয়ের ধারাবাহিকতা, টিভি-নাটকের আলাদা ভাষিক কৌশল সবই বদলে দিতে শুরু করেছিলেন। তেমন দুটি ধারাবাহিক নাটক ভাঙনের শব্দ শুনি ও গ্রন্থিকগণ কহে। রক্তের আঙুরলতা লিখে টিভি-নাটকে প্রচারিত প্রেমের ধারণাই যেন বদলে দিতে পেরেছিলেন। আমরা এও হয়ত ভুলে থাকতে চাইব যে, তিনি তাঁর ব্যক্তি-উন্নতিকে কখনও ভুলে থাকেন নি। শিল্পমেধাকেও তিনি এই কাজে ব্যবহার করে ছেড়েছেন। প্রশংসার দ্যুতিতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতেও কার্পণ্য করেন নি। এসবের পরও আমরা তাঁর সৃজনশীলতাকেই স্মরণ করব।
 
নাটকের ওরাল হিস্টোরির পরবর্তীতে নাট্যচর্চা একসময় কাব্যগন্ধী যেমন ছিল, তেমনি ছিল শাস্ত্রনির্ভর। উপনিবেশ সেই সাধনাকে একটা কাঠামোর ভিতর নিতে থাকল। কিন্তু এসবের বাইরে যে নাটকের আরেকটা প্রবাহ আছে তাই সেলিম আল দীনের নাটকের প্রধান বিবেচ্য হতে থাকে। তা অনেকটা হয় লোকনাট্যের আঙ্গিকে। সেই ধারায় তিনি যে একেবারে প্রথম থেকেই নিজেকে সমর্পণ করলেন তা কিন্তু নয়। তিনি নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন, ফের অন্যত্র যাত্রা করেছেন। তার এ কাজের প্রধান সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘ঢাকা থিয়েটার’। সেই থিয়েটারের কলাকুশীলব-এর সাথে সাথে এর অন্যতম কর্ণধার নাসির উদ্দীন ইউসুফ আর শিমূল ইউসুফের কথা আলাদা করেই বলতেই হয়। বরং আগবাড়িয়ে বলে রাখা যায়, কখনও কখনও নাসির উদ্দীনের শিল্পচৈতন্য সেলিমের শিল্পপ্রতিভাকে ক্ষুরধার করেছে। কখনও কখনও মনে হতে পারে, মঞ্চনাটকে তিনি সেলিমের নাটকের পুনর্জন্ম দিয়েছেন।
 
নাটক এক দর্শনমুখর শিল্প। সেই শিল্পের বিকাশের ইতিহাস মানুষের সভ্যতার সমান বয়েসি। মানুষ আসলে অভিনয়নির্ভর প্রাণী। সে তার বিকাশের বা নিজেকে নির্মাণের প্রয়াসে অভিনয়কে একেবারে নিঃশ্বাসের মতোই সহচর করতে বাধ্য হয়। সেই অভিনয় নিজেকে নির্মাণের জন্য যত-না, নিজের অস্তিত্ব নির্মাণই ছিল বড় বিষয়। যারফলে দেখা যাবে নাট্যচর্চা এই উপমহাদেশে একসময় পঞ্চবেদের মর্যাদা পেয়েছে। ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রের কথা আমাদের নাট্যকলায় এক মর্যাদাকর বিষয়। নাটকের সর্বব্যাপী সৌন্দর্যের একটা ধারা তিনিই নির্মাণ করতে চাইলেন। তার পরবর্তী কোহলদত্তিল, শাণ্ডিল্য, বাৎস্য, শাতকর্ণ, অশ্মকুট্ট, নখকুট্ট, বাদরায়ণ প্রমুখ ভরতভক্তরা একে আরও সম্প্রসারিত করেছেন। সেই ধারাবাহিকতা আমাদের এই জনপদে বিশাল প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়। পরবর্তীকালে কলোনিপ্রভাবিত প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ধারা অনেকেই অনুসরণ করেন। লেবেদফকে নাট্যসংস্কৃতির প্রয়োজনীয় ব্যক্তিত্ব বলেও গণ্য করেন অনেকেই। সেলিম এই ধারাকে শিকড়লগ্ন মনে করেন না। এই দেশের শিল্পসংস্কৃতির জন্য মাটিঘেঁষা একটা রূপ নির্ণয়ের প্রাণান্ত চেষ্টা তিনি করে গেছেন। ড. সাধনকুমার ভট্টাচার্যের নাটক লেখার মূলসূত্র থেকে নাট্যচর্চার ইতিহাস সম্পর্কে আরও জানা যায়, দশম শতাব্দীতে ধনঞ্জয় লিখলেন দশরূপক, সাগরনন্দীর নাটকরত্নকোষ, দ্বাদশ শতাব্দীতে রামচন্দ্র ও গুণচন্দ্র লিখলেন নাটকদর্পণ, রজ্জকের নাটকমীমাংসা, শারদাতনয়-এর ভাবপ্রকাশন, চতুর্দশ শতাব্দীতে বিশ্বনাথ কবিরাজ সাহিত্যদর্পণ নাটক পরিভাষা রচনা করেছেন। নাট্যচর্চার গ্রন্থনির্ভরতার ইতিহাস তো এর পরবর্তীকালে আরও হয়েছে। তবে ইউরোপ বা আমেরিকায় একাডেমিক যে চর্চাটা নাটকের হয় তা কিন্তু আামাদের এখানে তেমন হচ্ছেই না। বলা যায়, লৌকিক আঙ্গিকেই বিভিন্ন ধারার নাট্যচৈতন্যের বিকাশ বেশি ঘটেছে। আমাদের সেলিম আল দীন সেই ধারার সাথে আধুনিক স্মার্ট সাহিত্যের একটা সংশ্লেষ ঘটিয়ে নাটককে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পেরেছেন বলা যায়।

শিল্পচর্চা তো ধরা-বাধা নিয়ম বা ছকে-বাধা কথকতা দিয়ে হয় না। তাই যদি হতো তাহলে তো শিল্পচর্চার একই সাধনার পরিপ্রেক্ষিতে একই ধরনের শিল্পকাঠামো বা ধরন বা নির্যাস আমরা প্রত্যক্ষ করতাম। তা কিন্তু হয় না। একই চৈতন্য লালন বা পালনের ঐকান্তিকতা থাকলেও আমরা শিল্পের ভিন্ন-ভিন্ন প্রকাশ বা কাঠামো রূপেই পাই। শিল্প প্রকাশ কেন করা হচ্ছে, শিল্পবিষয়ক মৌলিক প্রশ্নের সমাধানও এক-এক রীতিতে পাই। কথাসাহিত্যচর্চার নানান ধরন, গল্প/উপন্যাস আলাদা ফর্ম নিয়ে থাকলেও, কবিতার উন্মেষের ধরন আলাদা আধুনিক চিন্তার বাহক অনেকেই তা মানতে চান না। সেলিম আল দীনও তার নাট্যচর্চার একটা কালে সাহিত্যচর্চার এই নানাবিধ ধরনের দেয়ালকে ভেঙে ফেলার সাধনায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শেষতক শুধু নাট্যচর্চার সাধনায় নিমগ্ন থাকলেও তিনি নিজেই শিল্পমাধ্যম সম্পর্কে দ্বৈতাদ্বৈতবাদী বলতে চেয়েছেন; কেননা শিল্পের সমস্ত রঙ, শব্দচিত্র. পাহাড়, নদী, পাথর, নীলিমা, অগ্নি ও বরফ, শেষ পর্যন্ত পুরুষ অর্থাৎ মানবাভিসারী। এই প্রত্যয়ে বদ্ধমূল হাজার হাজার বছরের নাটকের ফর্ম ভেঙে ভেঙে জাতীয় (!) নাট্যরীতি নির্ণয়ে ব্রতী হলেন। আবার একই সময়ে বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় জনপদের প্রাকৃত ও কর্মমুখর ভাষাতেই নাটক বা দৃশ্যকাব্য রচনা করতে চেয়েছেন। আমি তার নাট্যচর্চার অতি সামান্য আলোচনায় সেই দিকটা অতি স্মরণীয় বিবেচনা করব।
 
তার মঞ্চনাট্যচর্চা বা দৃশ্যকাব্য রচনার নামাবলী মোটামুটি এ-ধরনের- নীল শয়তান : তাহিতি ইত্যাদি (১৯৭২), সর্প বিষয়ক গল্প (১৯৭২), জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন (১৯৭২), এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা (১৯৭৩), করিম বাওয়ালীর শত্রু অথবা মূল মুখ দেখা (১৯৭৩), সংবাদ কার্টুন (১৯৭৩), মুনতাসীর ফ্যান্টাসি (১৯৭৩-৭৪), আতর আলীর নীলাভ পাট (১৯৭৫), একমাত্র পথনাটক- চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারী (১৯৭৭), শকুন্তলা (১৯৭৭), কিত্তনখোলা (১৯৮০), কেরামতমঙ্গল (১৯৮৫), হাত হদাই (১৯৮৯), চাকা (১৯৯০), হরগজ (১৯৯২), যৈবতী কন্যার মন (১৯৯৩), একটি মারমা রূপকথা ( ১৯৯৫), বনপাংশুল (১৯৯৮), প্রাচ্য (২০০০)।
 
সেলিমের নাটকে শেকড়সন্ধানের যে হুলস্থূল আয়োজন আমরা প্রত্যক্ষ করি তা কিন্তু একেবারে পরিকল্পিতভাবে শুরু হয় নি। বরং তার নাটকে ফর্মের ভাংচুর, ক্লাসিকেল ফর্ম, কাব্যনাট্যধারা, মঞ্চের সনাতনী ধারাই বার বার চেঞ্জ হয়েছে। বলা যায়, তিনি মূলত রূপবদলের কারিগর। তিনি নাট্যরচনার শুরুতেই দেশকালের অস্থির অবস্থা, সর্বগ্রাসী দখলি-পুঁজির বিস্তার, বেয়াদব মধ্যবিত্তের উৎপত্তি, মানুষের হাহাকার, স্বাধীনতা পরবর্তী মানুষের স্বপ্নভঙ্গকেই মৌলস্বর করে তোলেন। তিনি যেমন রূপবদল করতে চেয়েছেন, তেমনি ‘ড্রামা সার্কেল’ হয়ে ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর সাংগঠনিক আয়োজন, শিল্পীদের শক্তিমত্তার কাছে নিজের সৃজনশীলতার একটা সমন্বয় করেছেন। এক-হিসাবে আধুনিক নাটকের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা যেমন প্রকাশ পায় তেমনি নিজের সৃজনশীলতাকে, বিশেষত মঞ্চনাটকের ফলপ্রসূ আয়োজনের প্রতি একধরনের নেশার অনুভবও প্রকাশ পায়। সময়ের দিক চিন্তা করে তিনি তার নাটককে অনেক ছোট করে আনার কথাও শোনা যায়। এমনকি তাঁর এপিক ফর্মের আয়োজন কেরামতমঙ্গল যখন লেখনি স্তরে ছিল তখন মঞ্চে আনতে গেলে প্রায় ৯ ঘণ্টার মতো লাগত। সেই নাটককে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার এক মঞ্চরূপ দেন বলে জানা যায়। এমন বেশকিছু পরিবর্তন তার নাটকে দেখা যায়। আমরা এও জানি, এ-সময়ের মঞ্চনাটকে একজন সৃজনশীল নির্দেশকের দারুণ প্রভাব থাকে। এমনকি টেকস্ট থেকে সেই রূপ অনেকটাই অচেনা হয়ে যায়। কোরিওগ্রাফি, সাউন্ড ইফেক্ট, লাইটিং, কোরাস, সেট ডিজাইন, কম্পোজিশন ইত্যাদি মিলে নাটকের স্ক্রিপ্ট যেন নতুন প্রাণ পায়। দলীয় কর্মযোগে একটা নাটকের অবস্থানে তাই হওয়া স্বাভাবিক। যারফলে আমরা যখন একটা মঞ্চনাটকের ব্যাপারে কথা বলব, তখন সার্বিক আয়োজনকে মাথায় রেখেই আমাদের কথা বলা দরকার। একটা মঞ্চনাটক মানেই শুধু স্ক্রিপ্টের কথকতা, তা যেন অনেকটা অপূর্ণ রূপই বলা যায়। আমি আমার আলোচনার শুরুতেই আমার দুই-দুইটি সীমাবদ্ধতার কথাই বলব। এক. এ আলোচনা অনেকটাই টেকস্ট নির্ভর কথার সমাহার। দুই. যেহেতু নাট্য-অঙ্গনে আমি অনেকটাই অনাহুত, তাই আমার অবজার্ভেশন অনেকটাই হয়ত শাদামাটা কথকতাই হয়ে ওঠবে।
 
হাত হদাই নোয়াখালীর সমুদ্র উপকূলীয় মানুষের জীবন-আলেখ্য আঞ্চলিক ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে। আলাদা আলাদা উপাখ্যানরূপী একেকটা চরিত্র নাটকটির শরীর নির্মাণ করেছে। বহুমাত্রিক গল্প এসেছে এতে। হুলস্থূল বর্ণনা, গীত, এথনিক ডিটেইল, ভাষার কারুকাজ মিলে এতে স্বতন্ত্র এক রূপ দিয়েছে।

সেলিম আল দীনের নাট্যচর্চার উন্মেষকাল থেকেই সামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রিক বিষয়াবলী স্থান পেতে থাকল। তাঁর নীল শয়তান : তাহিতি ইত্যাদি, সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা, করিম বাওয়ালীর শত্রু অথবা মূল মুখ দেখা ইত্যাদি নাটকে যেন সময়টাই মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করছে। এতে এবসার্ডিটি থাকলেও এর ভিতর রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা, মানুষের ভাঙন কিন্তু প্রকাশ পেতেই থাকল। সংবাদ কার্টুন এক-হিসাবে কৌতুকনাট্য ধরলেও সমাজ তাঁর নাটকের মৌলস্বর হয়েই থাকে। এক্ষেত্রে রঙ্গ-রস প্রয়োগের যে চিরস্থায়ী বিন্যাস আমাদের নাটকে আছে তার এক নতুন কিন্তু সহনশীল রূপ আমরা দেখি। ভাঁড়ামিও যে উচ্চমার্গীয় এক বিষয় তাও আমরা এতে প্রত্যক্ষ করতে পারি। সেই সময়ে, সদ্য স্বাধীন দেশে নাটকের নামকরণেও প্রথা ভাঙার একটা ব্যাপার আমরা লক্ষ্য করি। এরপর তিনি লিখলেন মুনতাসীর ফ্যান্টাসি। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল তিনি এই নামকরণের রঙ্গ-রস থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে চাইছেন। তিনি দীর্ঘদিনের মঞ্চনাটকে ব্যবহৃত নামকরণে নতুনত্ব আনার লক্ষ্যে মুনতাসির ফ্যান্টাসি’র শেষাংশ অর্থাৎ ফ্যান্টাসি বাদ দিলেন। তিনি শিকড়সন্ধানের নামে নিজের নাটকের নামই বদলে ফেললেন। অবশ্য আমরা জানি না, তাঁর অন্যসব নাটকের নামকরণেও এমন এক নিষ্ঠুর আচরণ করলেন কিনা। ইংরেজি শব্দ বাদ দিলেই তাহলে শেকড় পাওয়া যায়? আমরা যারা অতি সাধারণভাবে সাহিত্য বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখতে চাই তারাও জানি যে, বাংলা এমন ভাষা নয় যে শুধু মৌলিক বাংলা শব্দ নিয়েই তার ঘর-গেরস্থালি সাজাতে পারবে। আর ভাষা এমন এক প্রবহমানতার বিষয় যে, এতে শব্দ, বাক্য, উচ্চারণভঙ্গিতে তার রূপবদল করবেই। তিনি এই কাজটি কি বাঙলা একাডেমী থেকে গ্রন্থ প্রকাশের সময়মাফিক সুবিধা নেয়ার জন্যই করলেন? আমরা দ্বিধান্বিত হই, আমাদের মনে কিঞ্চিত প্রশ্ন জাগে, বইটির পুনর্মুদ্রণে এ কাজ তিনি করলেন কেন? বাংলা একাডেমীই বা তাঁর এ প্রস্তাব বা কর্মধারাকে মানল কেন? আমার মনে একধরনের আগ্রহ এই জন্য যে, সরকারি সমস্ত মাধ্যমই একরৈখিকতায় আশ্বাস রাখে। ‘ফ্যান্টাসি’র প্রতি তাদের অভিমানও থাকতে পারে। এতবড় ইজ্জতি প্রতিষ্ঠান কী করে ‘ফ্যান্টাসি’র (!) মতো গ্যাঞ্জামে ভরপুর এক শব্দ লালন করবে! রাষ্ট্রের ইজ্জত নিয়ে তো রাষ্ট্রকেই ভাবতে হয়। তবে ফ্যান্টাসির মতো প্রয়োজনীয় এবং বহুমাত্রিক শব্দকে ছেটে ফেলা একেবারেই একটা অন্যায় কাজ বলে আমার মনে হয়েছে। তাঁর এমন কর্মের প্রতি প্রতিবাদ জানিয়েই নাটকটির বিষয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।
 
আমরা যখন মুনতাসির নিয়ে আলোচনা করবো তখনও কিন্তু আমাদের স্মৃতি থেকে ফ্যান্টাসি শব্দটি বাদ যায় না, কারণ এর সাথে মঞ্চনাটকটির স্মৃতি, সমস্ত আয়োজন, ভালোবাসা বা উষ্মা আমাদের ঘিরে রাখে। তিনি যখন বাংলা একাডেমী থেকে তিনটি নাটক (মুনতাসির ফ্যান্টাসি, শকুন্তলা, কিত্তনখোলা) পুনর্মুদ্রণ করেন তখন নাটকটির শিরোনাম থেকে ফ্যান্টাসি শব্দটি বাদ দেয়ার জন্য শুধুমাত্র নাসির উদ্দীন ইউসুফের কাছে ক্ষমা চান। এখানে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিকে আমলে ধরলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট দর্শক, প্রকাশক, অভিনেতা, আলোচক- এরা সবাই জড়িত। যাই হোক, ইংরেজির দোহাই দিয়ে আমরা এধরনের ভদ্রলোকি সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে পারি না। এতে নাটকটির প্রতি নিরবিচ্ছিন্ন টান কোথায় যেন হোঁচট খায়। ফ্যান্টাসি এক বহুমাত্রিক আর প্রয়োজনীয় শব্দ, আমাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্য, প্রবাহ কিংবা অবদমন থেকে একে একেবারে বাদ দেয়া যায় না। আমি আমার আলোচনায় একে মুনতাসির ফ্যান্টাসি-ই বলব।
 
নাটকটির শুরুতেই আমরা দেখি মুখোশধারী একদল বাদ্যযন্ত্রী, আমরা উপভোগ করতে থাকি। মিউজিকেল কমেডিটি’র শুরু থেকেই এরা এভাবে অবস্থান করে। প্ল্যাকার্ডধারী কিছু সঙ-ও একে একে প্রবেশ আর প্রস্থান করে। আমরা একটা সময়কে এখানে পাই, এটি স্বাধীনতা-পরবর্তী একটা সময়, যেখানে খামখেয়ালী আর রাক্ষসময়তায় পরিপূর্ণ একখান চরিত্র মঞ্চ নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি, মুনতাসির, সময়ের সৃষ্টি, বস্তু থেকে শুরু করে সৃজনশীলতা, প্রেম, দ্রোহ, ইতিহাস, আন্দোলন সবই খেয়ে ফেলার তাড়না নিয়ে মঞ্চে চলমান থাকে। তিনি আবার ঘুমের ভিতর হাঁটেন। লক্ষ্যহীন তালগোল পাকানো তাঁর দৃষ্টি। সমাজ, রাষ্ট্র, অফিস, আদালত, বিশেষ করে হাসপাতালের মতো মানবিক চেতনায় উন্মুখ থাকার জায়গাও অবহেলা আর উদাসীনতার প্রতীক হয়ে ওঠে। নাটকটির লেবার সর্দার মুনতাসিরের দৈনিকের রুটিন ধরে অসুখের কথা জানান এভাবে-
 
    আরে রোববার তিনি ক্ষিপ্ত হলেন
    সোমবার তিনি ঘুমিয়ে কাটালেন।
    মঙ্গলবারে দেখি ডাকেন নাক,-
    বিছানা ও পেটে ছিল ভীষণ ফাঁক।
    বুধবারের বেলা এলেন ডাক্তার-
    চিবিয়ে খেলেন থার্মোমিটার।
 
কোনো এক ডাক্তার এ চরিত্রটি সম্পর্কে জানান, ‘মিঃ মুনতাসির মাল্টিমিলিওনার। তাছাড়া তিনি জাতীয়তাবাদী নেতা। সকলে জানে- তা এবং বাঙালি সংস্কৃতির জন্য এ শহরে সবার বরেণ্য। তবু প্রশ্নটা মেইন, নো রিস্ক নো গেইন।’
 
নাটকটি পাঠে বা দেখে হবুচন্দ্র রাজা আর গবুচন্দ্র মন্ত্রীর কথা আমাদের মনে পড়ে। তার চরিত্রটি আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট হয় যখন তিনি নিজেই নিজের সম্পর্কে জানান, প্রতি লোমকূপে- রক্তাক্ত জিভ জেগেছে আমার। সবকিছুর স্বাদ নিতে পারি আমি। সেই সময়ের মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল নিজেকে অবলীলায় সার্জন হালাকু খাঁ বলে দাবি করেন।
 
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুনতাসিরের সবকিছু খাই-খাই ধরনের অসুখের বৃত্তান্ত একজন ডাক্তারের জবানিতেই শোনা যাক, ‘বাঙালি জাতির ইতিহাসে তিনি সেই বিশ্রুত ব্যক্তি যাঁর রাজনৈতিক ইতিহাস তাঁর ব্যাংক ব্যালেন্সের অঙ্কের মতই বহু চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পরিপূর্ণ।... যুদ্ধপূর্ব অবস্থায় তিনি ছিলেন দুটি ছোটখাট লজেন্স ও শিশুতোষ খেলনা তৈরি কারখানার মালিক। শুনলে অবাক হবেন- উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর ঐ ফ্যাক্টরীর লজেন্স খেয়ে মার্চের রৌদ্রে স্লোগান প্রসেসনে সংগ্রামের প্রথম প্রেরণা লাভ করে।
 
কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে তিনি অকস্মাৎ নিশ্চুপ হয়ে যান। তখন দুটো কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার কদ্দিন আগে পয়লা ডিসেম্বরে তিনি পশ্চিমা শোষকদের দ্বারা ধৃত হন। তারা একটানা সেলে তাঁকে আটকে রাখে ষোল দিন। ... তাঁর এপেটাইট অসুখটার সূত্রপাত তখন থেকে।’
 
সারাদেশ যেন তার পেটে ঢুকে যাবে! অবশেষে তার পেটে অস্ত্রোপাচার হয়। কতকিছু যে তার পেট থেকে বার হয়। তিনি অপারেশন টেবিলেই মারা যান। তবে এখানেই এই মিউজিকেল কমেডি শেষ হয় না। অতৃপ্ত পুঁজির হিংস্র থাবা যেন মুনতাসিরের ক্ষুধা ধরে ধরে আমাদের সবকিছু নিঃশেষ করে দিতে চাচ্ছে।

শকুন্তলা (আমরা এই প্রথম তাঁর নাটককে তিনি দৃশ্যকাব্য বলে চিহ্নিত করতে দেখি) নামের নাটকটি লেখার পেছনে একটা অতৃপ্তির কথা ঢাকা থিয়েটারের বক্তব্যে আছে,- ‘পুরাণ নির্মাণের দৃষ্টান্ত বাংলা কাব্যে যতটা আছে, বাংলা নাটকে ততটা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা নাটকে পুরাণ এসেছে ধর্মীয় আবেগ থেকে।’ তাহলে সেলিমের এই উদ্ধৃতি ধরে বলা যায়, শকুন্তলা নাটক রচিত হওয়ার পিছনে সমন্বিত আবেগ বা আকাক্সক্ষা কাজ করেছে। একটা নাট্যদলের প্রতি সেলিমের চমৎকার দায়বদ্ধতা সত্যি আমাদের প্রীত করে।

আমরা নাটকটির শুরুতেই সূত্রধরের কথকতা থেকে নাটকটির প্রবহমানতার শানে-নজুল পাঠ করতে পারি- ‘পূর্বকালে বিশ্বামিত্র নামে এক ঋষি ছিলেন। সে সময়ে ত্রিশংকু নামে মহাপরাক্রমশালী রাজা রাজত্ব করতেন। একদা তাঁর কোনো প্রিয় রানীর মৃত্যুতে তিনি শোকগ্রস্থ হন। তখন থেকে মানুষের পচনশীল শারীরবৃত্ত ও মৃত্যুযন্ত্রণা তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। এ থেকে মুক্তির উপায় কি?’ এতেই নাটকটির একটা আকাক্সক্ষার স্পষ্ট ইঙ্গিত আমরা পাই।

আমরা এই নাটকের পচনশীলতা আর শারীরবৃত্ত নিয়ে কথা বলার সাথে সাথেই তাঁর লেখা আতর আলীর নীলাভ পাট-এর কথা মনে পড়বে। আমরা চরম বিস্ময়ে এর ভাষা-বৈশিষ্ট্য, রূপ-রস-গন্ধ নিতে পারি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে কৃষককুলের, বিশেষ করে পাটচাষীদের ভোগান্তির বিষয়টা তো আছেই, নাটকটির ক্রমাগত ভাষার জাদুজাল আমাদেরকে দারুন বিস্মিত করতে থাকবে। গ্রাম যেমন আছে, আছে সেই চাষীদের নিয়ে নানান সামাজিক-রাষ্ট্রীক অসঙ্গতি। এখানে শারীরীয় পচনশীলতার বিষয়টি যেমন আছে, তেমনি আছে মঞ্চনাটকে নতুন আঙ্গিক খোঁজার হুলস্থূল প্রচেষ্টা।

শকুন্তলা নাটকে আমরা কালিদাসের শকুন্তলাকে পাই না, পাই পৌরাণিক কাহিনীকে ভিত্তি করে স্বর্গের সাথে মর্ত্যের এক দ্বন্দ্বময় প্রকাশ- দেবতা আর মানবিক জীবনের এক নিরন্তর টানাপোড়েনের কাহিনী। সেই কাহিনী বয়ান বা নাট্যআঙ্গিকে আমরা সংস্কৃত নাটকের ধাঁচ প্রত্যক্ষ করি। এখানে রাজা ত্রিশংকুর স্ত্রীবিয়োগ, বিয়োগব্যথা, যন্ত্রণা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে মানুষের পচনশীলতার বিরুদ্ধে এক দ্রোহের আয়োজন আমরা দেখি। শকুন্তলার জন্মবৃত্তান্ত, তার লজ্জা, স্বর্গদেবতার কারসাজিই এই নাটকের মূল উপজীব্য বিষয়। তবে নাটকটির শকুন্তলার পরিবেশ-প্রেম, রাজা দুষ্মন্তের প্রতি ভালোবাসা, নিয়তি নির্ধারিত কষ্ট, প্রেমের প্রতীক অঙ্গুরীয় জটিলতা, নিজের অধিকার আদায়ের চেষ্টা ইত্যাদির কোনো ধারণা এই নাটকে নেই। শকুন্তলার যে চিরন্তনী প্রকাশ-উন্মুখ এক রূপ আছে, এখানে তার ধারাবাহিকতা নেই। শকুন্তলার অযাচিত জন্মযন্ত্রণাই মূল বিষয় হয়ে ওঠেছে। ওর জন্মের রহস্যময়তা, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, হাহাকার, ষড়যন্ত্র আমরা এখানে দেখি। স্বর্গের সাথে মর্ত্যরে, দেবতার সাথে দেবতার, দেবতার সাথে মাটিলগ্ন জীবনের আপাত সংঘর্ষের জন্ম তাকে নিঃসঙ্গ করে দেয়, লোকাতীত ঘৃণার অবস্থা আমরা দেখি। চরিত্রটির কথকতায় তার মনোভাব আমরা পাই, ‘কি চাই আমি? আমি চাই মেনকার উদরে নেই পুঁতিগন্ধ, মুখ ভরে ওঠে না কৃমিকীটে। সোনালী চাঁপার গন্ধ ফুরোবার আগে আমি চলে যেতে চাই ওই নক্ষত্রের দেশে।’ মৃত্যুর প্রতি তার ঘৃণা আমরা দেখতে পাই। শকুন্তলা চায় জীবনের রূপান্তর। এটাই এই নাটকের মৌলচেতনা। ইতোপূর্বে বলাও হয়েছে মঞ্চনাটক শুধু টেকস্ট দিয়ে তেমন কিছুই বোঝানো যায় না। আমরা শুধু জীবন, আলো, অন্ধকার, হাহাকার, ভালোবাসা সম্পর্কে অনেকটা আন্দাজ করে রাখতে পারি। সেলিম শকুন্তলা-কে কতটুকু আমাদের, মানে এই জনপদের করতে পারলেন, সেটা অবশ্য একটা প্রশ্নই বটে। কারণ জীবনের রূপান্তর, জীবনতৃষ্ণা, নাটকের প্রবহমানতা ইত্যাদিতে সেলিমের পরবর্তী আকাক্সক্ষা অর্থাৎ এই পূর্ববঙ্গীয় জনপদের জীবন, ভাষা, সুখ, যন্ত্রণা নির্ণয়ের যে নব-নব কায়দা খুঁজেছেন, তা কিন্তু এই নাটকে খুব বেশি নেই।

আমরা অতি বিস্ময়ের সাথে বাংলা নাটকের, বিশেষ করে, মঞ্চনাটকের এক আয়োজন লক্ষ্য করি কিত্তনখোলা নামের নাটকে। এত আয়োজন, এত চরিত্র, জীবনের বহুমাত্রিক রূপ-রূপান্তর, দৃশ্যের দেশজ উপাদান, মঞ্চের প্রচলিত ধরনকে একেবারে উলটপালট করে দেয়ার এমন জাদুকরি আয়োজন আমরা ইতোপূর্বে দেখি না। বলা যায়, একজন দর্শক হিসেবে নিজেকে ক্ষণে ক্ষণে আবিষ্কার-করণ, নিজেকেই বদলে দেয়ার মাদকতা আমরা দেখতে থাকি। নাটকের চলতি রূপ বা ধারণা ভেঙে যেতে দেখা যায়। মঞ্চনাটকে পরনির্ভরশীল বুর্জোয়া ধারণাশ্রিত যে নাট্যপ্রবাহ চালু ছিল তা এখানে এসে যেন রীতিমতো ধাক্কা খায়। জনজীবন হুড়মুড় করে ভেঙে যেতে থাকে, কোনো আয়োজন, অপেক্ষা ছাড়া, এমনকি নাট্যকারের ভদ্রলোকি আয়োজনকে অস্বীকার করে একেবারে দর্শকের সাথে একধরনের মাটিঘেঁষা প্রেম গড়ে তুলতে থাকে। কিত্তনখোলার মেলায় যাত্রাপার্টি যেমন আসে, তেমনি আসে নানান ধরনের লোক, তাদের মেজাজও নানান ধরনেরই হয়। মনাই বয়াতির উপলক্ষেই এই মেলার আয়োজন। এই আয়োজনে একটা লৌকিক রূপ যেমন আছে, রাজনৈতিক ধারণাও এতে স্পষ্ট হয়। মওলানা ভাসানীর লৌকিক প্রেম, জনজীবনের প্রতি নিরঙ্কুশ প্রেমের কথাও আমরা জানতে পারি। নাটকটির আয়োজনে সনাতন ধর্মের পূজার আবহ লক্ষ্য করা যায়। সোনাই একালের এমন এক অপরিহার্য নায়ক যা আসলে স্বাধীনতা পরবর্তী ৮০-এর দশককে যেন নানান মাত্রায় আমাদের সামনে সামগ্রিকভাবে উন্মোচন করে। মঞ্চনাটকে এত শক্তিশালী, রূপান্তরশীল চরিত্র এর আগে এই জনপদের মানুষজন দেখেছে বলে মনে হয় না। সমাজের নানান স্তরের ভিতর দিয়ে গড়ে উঠা এক নবমাত্রার আঙ্গিককেই সে প্রকাশ করতে থাকে। গ্রামীণ সমাজ, লাওয়া সম্প্রদায়, যাত্রাপার্টির সাথে সম্পর্ক, ডালিমনের সাথে প্রেম, একালের অসুররূপী ইদু কন্টাক্টরের সাথে দ্বন্দ্ব- সব মিলিয়ে একালের এক অপরিহার্য নায়ক হয়ে উঠে সে।

তবে এই নাটকের কিছু কিছু বিষয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। এখানকার মঞ্চনাট্যকারদের একটা কমন প্রবণতা হচ্ছে দর্শকের সাথে হাস্যকোলাহলের মাধ্যমে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রবণতা। তারা যেন পোলাও-কোর্মার সাথে একটু সালাদ দেয়ার মতোই কিছু চরিত্র আমদানি করে। দর্শক হাসায়। এ কাজটি সেলিম আল দীন, মামুনুর রশীদ, আব্দুল্লাহ আল-মামুন থেকে শুরু করে একালের বদরুজ্জামান আলমগীররা করে যাচ্ছেন। একজন দর্শক হিসেবে বলতে পারি, জীবনের নিগূঢ় বাস্তবতাকে মোকাবেলা করার জন্যই এসব পরিত্যাজ্য। তেমনি এক চরিত্র ছায়ারঞ্জন। মেয়েলি ঢঙের এক পুরুষ- সে নাকি যাত্রার অভিনয়ের সাথে নাচেও। আবার কথা বলে লৌকিক ঢঙে। যাত্রায় কি এধরনের চরিত্র আদৌ থাকে? আর যাত্রার চরিত্রসমূহ এখানে যেভাবে কথা বলে, চলে, নানান অনুষঙ্গে অংশগ্রহণ করে তা যাত্রার প্রতি একধরনের অবজ্ঞাই প্রকাশ করা হয়। যাত্রাদলের নায়ক-ভিলেন-ব্যান্ডপার্টির লোক থেকে শুরু করে গ্রিনম্যান পর্যন্ত শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে চায়। যাত্রার জীবনাচারে আলাদা একটা টোন মর্যাদা, দায়িত্ব নিয়ে তারা তাদের সিজন শুরু এবং শেষ করতে চায়। এ তাদের এক সাধনা। শিল্পের প্রতি নিরন্তর এক দায়বদ্ধতা।  

কিত্তনখোলা ঘরানার ব্যাপক আয়োজনের এপিক ফর্মীয় নাটক কেরামতমঙ্গল। এতে জীবনের প্রাচুর্য শুধু নয়, এ পূর্ববঙ্গীয় জনপদের ব্যাপক আয়োজন এটি। গল্প নয়, গল্পের ভিতরের ব্যাপক জনমন এখানে হুড়মুড় করে ঢুকে বসে আছে। একমানুষই বহুজন্মে যেন বহুমানুষ হয়ে আছে। স্থান-কাল, মানবসকলের সুনিয়ন্ত্রিত কোনো ঐক্য নেই। এখানে অনেক জাতি ক্ষুদ্রজাতিসত্তা, ধর্ম, বর্ণ, সরবতা, নীরবতা এক লৌকিক আবহে স্টেজ দখল করে। স্বাধীনতা সংগ্রাম, সশস্ত্র বাম-আন্দোলন, রণহুঙ্কার, দেশভাগ, রায়টের ফলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংগ্রাম- সবই সবিস্তারে দর্শকের সামনে উঠে আসে। আমরা ক্ষণে ক্ষণে কিছু পাই, আবার যেন সবই হারায়।

চাকা, যৈবতী কন্যার মন আর হরগজ-এর বর্ণনাভঙ্গি অনেকটাই একই রকম। এসব সেলিম কথিত কথানাট্যের এক-একটা স্বরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। চাকা নাটকের বর্ণনাভঙ্গি যেমন শব্দময়তার সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ, তেমনি এর মানবিক দিকটাও অসাধারণ। গল্পটি এমন সরল বা কুটিল কিছু নয়। সরকারি হাসপাতালে অস্বাভাবিক এবং পরিচয়হীন একটা লাশকে যথাস্থানে পৌঁছে দেয়ার জন্য নিছক ভাড়া খাটানো লোক হিসেবে গরুর গাড়িতে করে এরা নিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু লাশটির নিখুঁত পরিচয় জানা না থাকাতে একে আরও পৌঁছানো যায় না। অবশেষে পচা-গলন্ত লাশটিকে গাড়ির দুইজনই মাটিতে পুঁতে দিতে থাকে। এরি মধ্যে কিছু সময় পার হয়, লাশটির সাথে জ্যান্ত দুইজনের একটা বন্ধন তৈরি হয়। তারা লাশটির জন্য কাঁদে। একটা মানবিক আর্তির মুখোমুখি হই আমরা। কথিত কথানাট্যটির ভাষা, শব্দচয়ন, যতিচিহ্নের ব্যবহারে প্রচলিত রীতি ভাঙার এক দুর্দদমনীয় চেষ্টা লক্ষণীয়।

এনাটক নিয়ে কিছু ভিন্নমত সহজেই তৈরি হতে পারে। একটা লাশ বেওয়ারিশ হতেই পারে। কিন্তু লাশটিকে এভাবে পৌঁছে দেওয়ার কোনো রেওয়াজ কি সরকারিভাবে আছে? আর বেওয়ারিশ লাশের ময়নাতদন্ত হলেই তা তো পুলিশ কাস্টডিতে থাকবে। লাশকাটা ঘর, ডোম, লাশকাটার ডাক্তার, থানা-পুলিশ এর সাথে একটা সম্পর্ক থাকে। এখানে হাসপাতালের সাথে লাশটার সম্পর্ক কী করে থাকে? তবে আইনের মারপ্যাঁচে অনেক সময় সাহিত্যকে প্যাঁচানো যায় না। এখানে শেষ পর্যন্ত মানুষের সাথে মানুষের মানবিক সম্পর্কটাই বড়। নাটকের ভাষার রীতি ভাঙার চেষ্টা আরও চমৎকার। নাটক যে বদলে যাচ্ছে, সামাজিক-রাষ্ট্রিক বাস্তবতা জীবনকে বদলে দিচ্ছে, এ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। যৈবতি কন্যার মন-ও শিল্পসংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ এক আখ্যানই। এ নাটক নয়, গল্প বা উপন্যাসও নয়, নয় কাব্য, যেন জীবনের সব কথা, শিল্পের নেশাগ্রস্থ স্পৃহাই এখানে মুখ্য হয়ে ওঠেছে। এক নারীই দুইজীবনে একজীবন কিংবা একজীবনেই বহুজীবনের ক্ষরণ ধারণ করে। এখানে যাত্রাশিল্প, পুতুল নাচ, নাটকের প্রতি একজন শিল্পীর কমিটমেন্ট অতি বেপরোয়াভাবেই প্রকাশ পেয়েছে।

হরগজ-ও কথানাট্যের এক চলমান নিদর্শন। টর্নেডো কীভাবে একটা জনপদকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে, জীবন কতভাবে বদলে যায়, প্রকৃতির কত হিংস্রতা আমরা দেখি, এ তারই এক কথাচলচ্চিত্র যেন। মানুষের বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা তাতে দারুণভাবে মুদ্রিত হয়েছে। একজন নিষ্ঠুর কিন্তু মানবিক আবেদনে ভরপুর ক্যামেরাম্যান যেন বারবার আমাদের সামনে তুলে ধরছেন। বাইবেলে বর্ণিত কেয়ামতের তছনছ করা অবস্থা আমরা যেন সেলিমের এ কথানাট্যে দেখতে পাই। তবে কথানাট্য হলেও, এখানে এক্সপেরিমেন্ট থাকলেও, ভাষার ব্যাপারে বারবার সনাতন ধারায় তিনি ফিরে এসেছেন।

কথানাট্যে, বিশেষ করে চাকা-য় কমলকুমারের অন্তর্জলী যাত্রা-র কথা মনে পড়বে, আর যৈবতী কন্যার মন-এ ময়মনসিংহ গীতিকার কথা পাঠকের বা দর্শকের মনে পড়তে পারে।   

একটি মারমা রূপকথা-কে একটি নিও এথনিক থিয়েটার বলা যায়। মারমা সম্প্রদায়ের একটি প্রচলিত রূপকথা মনরি মাৎংসুমুইকে ভিত্তি করে আধুনিক লোকজ উপাদানে ভরপুর এক গবেষণাধর্মী নাটক লিখলেন তিনি। তবে এ নাটকে প্রায়ই তিনি তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ছিন্ন করেছেন। এ নাটক নির্মাণে এত তাড়াহুড়ো করার কি দরকার ছিল বোঝা গেল না। ঘটনার এত সংক্ষিপ্ততা প্রায়ই শিল্পরস ক্ষুণœ করেছে। বনপাংশুল নাটক মান্দার সম্প্রদায় নিয়ে লিখলেন। কেরামতমঙ্গল-এ আমরা দেখি গারো-হাজং সম্প্রদায়। এভাবে ক্ষুদ্রজাতিসত্তার প্রতি দায়বদ্ধতা তিনি বরাবরই প্রকাশ করেছেন।

ভাষার প্রতি তিনি সবসময়ই যে খুবই নিবিড় মনোসংযোগে কাজ করতে পেরেছেন তা কিন্তু মনে হয় না। বনপাংশুল আর যৈবতী কন্যার মন-এর ভাষা প্রায়ই ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেছে। প্রাচ্য তো দৃশ্যকাব্য হিসেবে দাপট দেখাতে পেরেছে নাট্য-নির্দেশনা আর এর সার্বিক প্রযোজনার গুণে। নতুবা এর ভাষা তো খুবই সাদামাটা।

অনেকটা প্রাসঙ্গিকভাবেই আমরা দুটি নাটকের কথা স্মরণ করতে চাই। স্মরণের এই কারণ হচ্ছে, নিজেকে সেলিম এত অপরিহার্য করতে যেয়েও মুক্ত বা পথনাটক থেকে নিজেকে কেন সরিয়ে নিলেন। তা কি নিজের উপরে ওঠার সিঁড়িকে অনেকটা ঝামেলামুক্ত রাখার জন্য? চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি আর বাসন-র কথা আমরা এই ক্ষেত্রে স্মরণ করছি। চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি করতে যেয়ে তো ঢাকা থিয়েটার অনেক রাষ্ট্রীয় নাজেহালের মুখোমুখি হয়েছে। জেল-জুলুম খাটতে হয়েছে। এই একবারই সেলিম আল দীন এত বড় ঝুঁকি নিলেন। তারপর এই জীবনে আর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মতো ঝামেলায় পড়তে হয় নি তাঁকে। বরং ইন্টেলেকচুয়েল স্পিরিটকে নেশা করে অনেক দূর যেতে পেরেছেন। তাঁর আরেকটি অসাধারণ নাটক বাসন। চট্টগ্রামের অরিন্দম নাট্যগোষ্ঠী খোলামঞ্চে এটি মঞ্চস্থ করত। এমন স্বার্থহীন প্রযোজনা আর সেলিমও করেন নি।   

আমরা এভাবেই নানান মাত্রার সেলিমকে দেখি- কখনও বিস্মিত হই, ক্ষুব্ধতায় মন ভেঙে আসে, কখনও তার সৃজনশীলতায় একেবারে চমকে ওঠি। নাটক শুধু দর্শনের নয়, পাঠ করার, সৃজনশীল সাহিত্যের সমমর্যাদার এক ব্যাপার, তাই তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তিনি নিজেই নিজের অপরিহার্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চেয়েছেন। এভাবেই তিনি আমাদের নাট্যজগতের এক অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। বাংলা নাটক সেলিম আল দীন ব্যতীত আলোচনা হতে পারে না।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): গল্পকার, সম্পাদক- কথা (কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ)