Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: বনপাংশুল

Written by থিয়েটারওয়ালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

নাটক: বনপাংশুল। রচনা: সেলিম আল দীন। নির্দেশনা: নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মঞ্চপরিকল্পনা: নাসির উদ্দিন ইউসুফ ও কামাল পাশা চৌধুরী। আলোকপরিকল্পনা: আরিফুর রহমান মুনির ও জহিরুল ইসলাম রিপন। পোশাক ও আবহসংগীতপরিকল্পনা: শিমূল ইউসুফ। পোস্টার ডিজাইন: আনওয়ার ফারুক। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৯৮। একটি ‘ঢাকা থিয়েটার’ প্রযোজনা

[বনপাংশুল নাটক নিয়ে নাট্যসমালোচনার আয়োজন করেছিল নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’। নাটকটির নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফসহ আলোচনায় আরো ছিলেন, মামুনুর রশীদ, খালেদ খান ও কামালউদ্দিন কবির। নাট্যালোচনায় সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ‘থিয়েটারওয়ালা’ সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ৪র্থ সংখ্যায় (১৯৯৯ এ প্রকাশিত) অনুলিখন করে এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]

হাসান শাহরিয়ার
প্রথমেই আমি বাচ্চুভাইকে শুরু বলতে বলবো...বাচ্চুভাই, এই সময়ে বনপাংশুলের প্রাসঙ্গিকতা দিয়েই শুরু করুন...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আসলে একটা স্ক্রিপ্ট বা টেক্সট, টেক্সট বললেই ভালো হয়...তা যখন একজন নির্দেশকের কাছে আসে বা বাছাই করে এবং সেটার উাপর কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তখন কিন্তু বেসিক্যালি সে তার অ্যাসথেটিক জায়গা থেকেই বিচারটা করে। আর এটাকে থিয়েটারে প্রয়োগ...এটা থিয়েটার শিল্প হিসেবে কতটুকু সফল হতে পারে অথবা টেক্সট ইটসেল্ফ কতটুকু আন্দোলিত করেছে বা আলোড়িত করেছে...তখন সে ভাবে যে, এটাকে মঞ্চে প্রয়োগ করা যায়। এই সময়ে বনপাংশুল নিয়ে কাজ করার পেছনে আমার দু-তিনটা কারণ কাজ করেছে। প্রথমত, যে মান্দাই নৃ-গোষ্ঠী নিয়ে সেলিম আল দীন নাটকটি লিখেছে, বনপাংশুল...এটি আমার কাছে বেশ অভিনব মনে হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের বাঙলা থিয়েটারে...এ ধরনের বিষয় নিয়ে এর আগে লেখা হয় নি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে যে, এই আদিবাসীদের মধ্যে যে বিউটি-টা আছে...এই বিউটিটা আমাকে টেনেছে। ওদের জীবন যাত্রায়, ওদের রিচ্যুয়ালগুলোতে, ওদের কালচার, ওদের ক্রিয়া, ওদের সমাজ...টোটালটাতে এক ধরনের বিউটি বিরাজ করছিল...এটা কিন্তু টেক্সট-এ-ই বিরাজ করছিল...এটা আমাকে টেনেছে। আর তৃতীয়ত হচ্ছে যে, সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানুষ এবং মানুষের বেঁচে থাকা এবং...ধরো...এক ধরনের...মানে, মানবতাবোধ বলতে আমরা যা বুঝি...সেটা এই স্ক্রিপ্টে ছিল...এ কারণেই আমি এই স্ক্রিপ্ট বেছে নিয়েছি।
 
হাসান শাহরিয়ার
আলোচকগণ যদি প্রযোজনার ব্যাপারে কিছু বলেন, তাহলে...

খালেদ খান
বাচ্চুভাই যেটা বলছিলেন...পা-ুলিপি নির্বাচনের ব্যাপারে...এটা খুবই সত্যি যে একজন নির্দেশক একটা পা-ুলিপি বেছে নেয় ধবংঃযবঃরপধষষু তার সম্ভাবনা কত সেটা দেখে। এটা একটা বিষয়। এবং বাচ্চুভাইয়ের সাথে আমি এ বিষয়ে একমত যে, সেলিমভাই যে জনগোষ্ঠীকে নিয়ে নাটকটা লিখেছেন, সেটার মধ্যেও একটা ঔদার্য আছে। আমার আবার আরেকটা জায়গায় গিয়ে মনে হচ্ছে...সেটা ঠিক এই আলোচনার সূত্র ধরে না...সেটা হলো, একজন লেখকের রিপিটেশন, সেটা বিষয় নির্বাচনই হোক আর ভাষাশৈলীর দিক থেকেই হোক কিংবা...মানে, সেখানে গিয়ে...সেলিমভাইয়ের বিষয় নির্বাচন, তার নাটকের পরিপ্রেক্ষিত এবং বিস্তার...সবকিছুর মধ্যেই...যেমন উনি হাত হদাই লিখলেন, সেটাও একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ নিয়ে লেখা...কিন্তু একজন লেখকের লেখার শৈলী দেখে যদি মনে হতে থাকে যে...ও আচ্ছা এই স্টাইলটা ওনার...সেটা একজন নির্দেশককে কোথাও গিয়ে সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে কিনা, বা একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে ঐধরনের বাচনে অভ্যস্ত করে তুলতে পারে কিনা? কারণ আমরা যদি কিত্তনখোলা থেকে শুরু করি, তাহলে দেখা যাবে, বাচনের একটা ধারাবাহিকতা আছে...মানে একটা পার্টিকুলার স্টাইল আছে। সেটা বনপাংশুল পর্যন্ত আছে। মাঝখানে ব্রেকটা পড়লো ইয়েতে...মানে...হাত হদাইতে। কিন্তু হাত হদাইতেও আঞ্চলিক ভাষা...কিন্তু যখনই কোনো ইমেজ বা ইমেজারি তৈরি হচ্ছে, সেখানে ঐ আঞ্চলিক ভাষাই দেখা গেছে সেলিমভাইয়ের যে নিজস্ব মৌলিকত্ব আছে সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে। তো...সেখানে নির্দেশক হিসেবে আপনি বারবার যে একই স্ক্রিপ্টের মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখছেন...সেখানে আপনি কতটুকু স্বস্তিবোধ করছেন?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
ওখানে আমি খুব স্বস্তিবোধ করি না। কিন্তু আমার যা মনে হয়, সেলিমের এই নাটকটা বোধহয় স্টাইল বা স্ট্রাকচারের দিক দিয়ে একটু ডিফারেন্ট...আগের নাটকগুলোর থেকে...মানে এটা পাঁচালীরীতিতে লেখা। আর যতই ন্যারেটিভ এর কথা বলুক, এটা ন্যারেটিভের বাইরে এসে কাজ করেছে। হয়তো এই জায়গাটায় সেলিম পৌঁছতে চেয়েছিল...এটা আমার কাছে পরিষ্কার না...আর যুব যেটা বললো (খালেদ খান, নাট্যমহলে যুবরাজ বলে পরিচিত) সেটার সাথে আমি একমত যে, সেলিমের সিনটেক্সটা একই আছে।...বদলেছে, এগিয়েছে, কিন্তু ধারাটা একই আছে। কিন্তু আমার নিজের ধারণা যে, প্রযোজনাগুলো বোধহয় একটার সাথে আরেকটার মিল নেই।

খালেদ খান
না, আমি সেটা বলছি না, বলছি যখন সিনটেক্সটা বা ধরনটা একই রকম থাকছে, তখন আপনি বৈচিত্র্য পাচ্ছেন কিনা? কাজ করার ক্ষেত্রে, বাচিক অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় কিনা?
 
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, সেটা ‘ঢাকা থিয়েটারে’ অলরেডি একটা...মানে, দাঁড়িয়ে গেছে...ইতোমধ্যেই যে...‘ঢাকা থিয়েটার’ এইভাবে অভিনয় করে...এটা কিন্তু আমি খুব ভালো মনে করি না। হতে পারে এটা একটা স্টাইল...কিন্তু ওটা রিপিট করলে ভবিষ্যতে ক্ষতি হবে...এমনকি আমাদের নতুন যে জেনারেশনটা আসছে, ‘ঢাকা থিয়েটারে’...তাদেরকেও ভাঙতে হবে। কারণ, আমার যত কাজ আছে...সেখানে যারা অভিনয় করছে, তাদের নিজস্ব একটা স্টাইলও ডেভালপ করছে...এটা সত্যি। এই ব্যাপারে যুবরাজের সাথে আমি একমত এবং এটা সমালোচিত হচ্ছে, আলোচিতও হচ্ছে...আমি মনে করি সমালোচিত হওয়াটা ভালো। ধরো, আমি কথায় কথায় বলতে পারি, শিমূল বা আসাদ অথবা সুবর্ণা, ফরীদি...এরা প্রত্যেকেই একটা বাচনভঙ্গিতে অভিনয় করছে বলে অনেকের ধারণা এবং এদের কেউ কেউ হয়তো এটা ভাঙে, মঞ্চের উপর, তাৎক্ষণিকভাবে কিন্তু সব সময় পারে না...তো এটা সমালোচিত যে, ‘ঢাকা থিয়েটার?... ও আচ্ছা এমন হবে’...তো এটা সেলিমের লেখার জন্য কিছুটা, আরেকটা হয়েছে...সম্ভবত এটা আমারও একটু দোষ আছে...ত্রুটিটা আমার দিক থেকেও হয়েছে। আমি সম্ভবত স্ক্যানিং করার সময়...এই রিদমটা ডেভালপ করার সময়...আমার ভিজ্যুয়াল অ্যাক্টিং-এর সাথে বাচিক অভিনয়ের স্ক্যানিংটা প্রায় কাছাকাছি করি। তবে আমার মনে হয়েছে বনপাংশুলে একটু বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। তবে আবারও মনে হয় যৈবতী কন্যার মনের পরে আবারও কিত্তনখোলা বা কেরামতমঙ্গলেই ফিরে গেলাম কিনা।

মামুনুর রশীদ
আমার মনে হয়েছে যে, বনপাংশুলের অভিনয়-স্টাইল আগেরটাই রয়ে গেছে।...আরেকটা কথা...যেটা দুর্ভাগ্য মনে হয়...তোমার জন্য, নির্দেশকের জন্য...সেটা হচ্ছে যে, সেলিম আল দীনের নাটক করতে গেলেই তোমাকে একটা স্পেক্টল এর কথা ভাবতে হচ্ছে। যেমন বনপাংশুল কিন্তু আমার কাছে খুব স্পেক্টল মনে হয়েছে। একটা বিগ ফ্রেমে একটা ইন্টারেস্টিং স্পেক্টল দিয়ে কিন্তু নাটকটাকে...প্রথম থেকেই ডিজাইনেই জিনিসটা ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে যে, বনপাংশুলে যেটা আমার কাছে মনে হয়েছে...ইন্টারেস্টিং দিক...সেই দিকগুলো কিন্তু হচ্ছে মিউজিক, পাঁচালীর ব্যবহার...এইগুলো। কিন্তু যে জায়গাটাকে আমরা বাচিক টেক্সট বলি...লিটারেচারের যে জায়গাটা...সেই জায়গাটায় মাঝে মাঝে এমন সব স্থুল ব্যাপার চলে এসেছে...বিশেষ করে তোমার ঐ যে...ফরেস্টার হাসানের ঐ যে...বানর-টানর এসমস্ত...তো ব্যাপার হচ্ছে যে, এটা তোমার কাছে আমার একটা প্রশ্ন যে, কেরামতমঙ্গলেও দেখেছি, কিত্তনখোলাতেও দেখেছি ইভেন শকুন্তলাতেও দেখেছি, যেখানে তুমি প্রসেনিয়ামেই কাজ করেছো...অন্যগুলোতে প্রসেনিয়াম ভেঙেছো...তো...এই যে প্রসেনিয়াম ভাঙার একটা চিন্তা-ভাবনা, এটা কি স্পেক্টল তৈরি করার জন্যই? অর্থাৎ এই ধরনের একটা টেক্সট কি প্রসেনিয়াম এ করা সম্ভব নয়? সেই সঙ্গে আরেকটা দুর্ভাগ্যের কথা মনে হয়, সফোক্লিস বলো, শেক্সপীয়র বলো, ইবসেন বলো...বড় বড় নাট্যকারের নাটক সারা পৃথিবীব্যাপী অভিনীত হয়, কিন্তু সেলিমের নাটক নাসির উদ্দিন ইউসুফ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। এটার কারণ হতে পারে...তোমাদের মধ্যে একটা সাংঘাতিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং এবং তোমাদের অ্যাসথেটিকস এ কোনো একটা জায়গায় হয়ত মিলেও যায়...সেই জন্য...এটা একটা ভালো দিক...এবং তোমরা অনেক সফল প্রযোজনাও করেছো...কিন্তু এ নাটকগুলো বাইরে কেউ অভিনয় করে না, এবং অভিনয় করলে কতটা সফল হবে বা হবে না সেটা আজ পর্যন্ত দেখতে পাই নি। এটা অনেকটা জীবদ্দশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার লাইফ এবং তোমার লাইফ...এবং দুটো লাইফ টাইমে যদি না মেলে তা হলে এই নাটকগুলোর কী হবে?...এই অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমরা। কারণ আমরা চাই, সেলিমের নাটক বাঙলা ভাষা-ভাষী সব জায়গায় অভিনীত হোক কিন্তু সেটা হচ্ছে না কেন? এই দুটো প্রশ্ন তোমার কাছে।
 
খালেদ খান
মামুনভাই আমি যেটা বলতে চাই...আপনার প্রথম কথাটা...মানে...সেলিমভাইয়ের নাটক অন্যত্র অভিনীত হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে আমরা কি এরকম আরেকটা পারস্পেক্টিভে দেখবো কিনা...ধরা যাক বুদ্ধদেব বসু’র বেশ কিছু ভালো নাটক অভিনীত হয় নি। মানে তপস্বী ও তরঙ্গিনী কিন্তু অভিনীত হতেই পারতো। মানে...অন্য সব বাদ দিয়েও...যদিও এখন হচ্ছে।...মানে আমি বলছি যে, উনি ওনার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেন নি। কিন্তু শম্ভু মিত্রদের সময় থেকে যদি ভাবি...ওনারা যে সমস্ত ডিফিকাল্ট কাজগুলো করেছেন, সেই তুলনায় কিন্তু তপস্বী ও তরঙ্গিনী করা খুব কঠিন ছিল না।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
রবীন্দ্রনাথের রাজা বা রক্তকরবী অপেক্ষা করতে হয়েছে শম্ভু মিত্র পর্যন্ত।

খালেদ খান
সেটাই আশ্চর্য...এখন...এই যে সেলিমভাইয়ের নাটক বহু মঞ্চায়িত হচ্ছে না...তো, এটার দায় কি সেলিমভাইয়ের? নাকি আমরা যারা প্রয়োগ করছি তাদের? আমার প্রশ্ন হচ্ছে... প্রয়োগ আমরা যারা করছি... সীমাবদ্ধতার জায়গাটা সেখানে কিনা?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমার মনে হয়েছে সেখানেই।...আমার মনে হয়েছে থিয়েটার ল্যাঙ্গুয়েজটা যেটা আছে...সেখানে একটু সমস্যা হয়েছে। এদ্দিন পর্যন্ত যে থিয়েটার ল্যাঙ্গুয়েজটা ব্যবহৃত হতো...এখন পর্যন্ত আমরা ব্যবহার করি, সেটা কিন্তু মূলত ওয়েস্ট থেকে একেবারে আমদানি করা। সেটাকে কিন্তু খারাপ বলছি না। আমি বলছি...এটাই আমাদেরকে অনেক বেশি এনরিচ করেছে কোনো সন্দেহ নেই...কিন্তু ঐ ফর্মে বা ল্যাঙ্গুয়েজে আমরা সেলিমের নাটক ডিরেকশন দিতে পারতাম কিনা? নাকি শিফট করতে হবে? যদি শিফট করতে হয় তাহলে কিন্তু মেজর শিফট করতে হবে। আমাদের চলে যেতে হবে পালাগানে...আমাদের লোকজ ফর্মে গিয়ে তাদের অভিনয়রীতি, তাদের প্রয়োগরীতিকে আত্বস্থ করে তারপরে ব্যাক করতে হচ্ছে...ওয়েস্টের সাথে মিক্স করতে হচ্ছে...দুটোকে জড়িয়ে একসাথে প্রেজেন্ট করতে হচ্ছে। যেটা আমি চেষ্টা করেছি, সফলতা ব্যর্থতা পরের কথা। আর মামুনভাই যেটা বললেন...সেটা হচ্ছে সেলিমের নাটক বাইরে হচ্ছে না, হ্যাঁ একটু আগে রবীন্দ্রনাথের রাজার কথা এসেছে, বুদ্ধদেব বসু’র কথা এসেছে...আমি বলতে চাচ্ছি যে, অসবর্ণের লুথার-এর মতো কিংবা লুক বেক ইন এঙ্গার-এর মতো বা টি.এস.এলিয়টের মার্ডার ইন কেথেড্রেল-এর মতো নাটকও হচ্ছে না। এটা এমনও হতে পারে সময়ের সামনে পড়ে গেছেন তাঁরা। আমার কথা হচ্ছে...আমি মনে করি থিয়েটারের জন্য টেক্সটটা জরুরি কিন্তু টেক্সটকে উপযোগী করার দায়িত্ব কিন্তু ডিরেক্টরের। অর্থাৎ আমার কাছে যদি একটা টেক্সট আসে...সেটা মামুনুর রশীদের হোক বা সেলিম আল দীনের হোক কিংবা শামসুল হকের হোক...তো সেটা মঞ্চে না যাওয়া পর্যন্ত কিন্তু ওটা একটা জড় পদার্থ। এটাকে জীবন দেয় কিন্তু নির্দেশক, অভিনেতা অর্থাৎ প্রয়োগকর্মীরা...তো সে জায়গাটায় আমরা প্রিপেয়ার্ড কিনা...একটা নতুন ধরনের থিয়েটার কনসেপ্টে? আমার মনে হচ্ছে আমরা প্রিপেয়ার্ড না, বিশেষ করে ঢাকার বাইরের প্রয়োগকর্মীরা।

মামুনুর রশীদ
নতুন ধরনের থিয়েটার কাকে বলছো তুমি?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি বলছি...আমরা চেষ্টা করেছি...আমাদের লোকনাট্যরীতির সাথে...আমাদের ঐতিহ্যগত নাট্যরীতির সাথে...আমাদের আধুনিক মনন এবং বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধন করতে।
 
মামুনুর রশীদ
কীভাবে?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
সেটা আমাদের সংগীত, আমাদের সংলাপ, আমাদের নৃত্য...

মামুনুর রশীদ
সংগীততো আমাদের বাঙলা নাটকের প্রথম থেকেই আছে।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আছে, তবে সেটা অপেরা থেকে নেয়া...মামুনভাই আমি একটু...মানে আপনার আরেকটা কথার জবাব দিতে চাচ্ছি...প্রসেনিয়াম কেন ভাঙছি ঐ ব্যাপারটা একটু বলে নিই। আমি কিন্তু মামুনভাই এপিকের প্রতি একটু দুর্বল।...আমার মনে হয় পুরো জনপদ, তাদের টোটাল জীবন, তাদের ভাবনা...তাদের স্বপ্ন, সমস্ত কিছু মিলিয়ে অনেক মানুষ, অনেক ঘটনা...অনেক কিছু ঘটে। যার জন্য প্রসেনিয়ামটাকে আমার কাছে বাধ্যবাধকতা মনে হয়...মানে আমাকে একটা গিভেন ফ্রেমের মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে, একটা কমপ্রোমাইজের মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে বলে মনে হয়। তবে হ্যাঁ, অনেকেই প্রসেনিয়ামে ভালো নাটক করছেন কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে এপিকের পারস্পেক্টিভ তুলে ধরার জন্য আমাদের প্রসেনিয়ামগুলো যথেষ্ট না। যেমন আপনাদের, ‘আরণ্যকে’র, প্রাকৃতজনকথা ওটাও কিন্তু এপিক টেক্সট...তো সেটা আপনারা প্রসেনিয়ামেই করেছেন। কিন্তু সবার কাজ কি একই রকম হবে বা হওয়ার প্রয়োজন আছে?

খালেদ খান
আরেকটা কথা মামুনভাই...হকভাইয়ের (সৈয়দ শামসুল হক) নাটকও কিন্তু ঢাকার বাইরে তেমন একটা হয় নি...তো...এখন, এটাকে দিয়ে আমরা নাট্যকারের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করবো কিনা?
    
মামুনুর রশীদ
না, আমি কিন্তু গ্রহণযোগ্যতার কথা বলি নি। বলেছি দুর্ভাগ্যের কথা।...কারণ, আমরা চাই এই নাটকগুলো বহুল প্রদর্শিত হোক। বিশেষ করে ‘ঢাকা থিয়েটার’...যে বিষয়ের কথা বলছে, সেটা কিন্তু বাঙলার রুট লেভেলের জনপদের ফর্ম, বিষয়, সেটা কিন্তু পপুলার লাইন। সুতরাং তাকে গণমানুষের কাছে নিয়ে না যেতে পারা কিন্তু দুর্ভাগ্যই...তাই না? তুমি যদি এবস্ট্রাক্ট ছবি  আঁকো তা হলে দু-একজন দেখলো...বুঝলো কী বুঝলো না সেটা এক কথা...কিন্তু এই যে ন্যারেটিভ থিয়েটার তৈরির প্রচেষ্টা, এটা কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যেই আছে। সুতরাং তা নিয়ে কাজ করলে এর প্রচারটা সর্বব্যাপী হওয়া উচিত। তা না হলে এটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
মামুনভাই আমি আপনার আগের একটা কথার ডিফার করতে চাই। মানে...ঐ যে স্পেক্টল তৈরি করার ব্যাপারটা। আমি কিন্তু মঞ্চকে একটা ভিজ্যুয়াল কাব্য বলতে চাই। এবং আমি মঞ্চে চেষ্টা করি একটা ক্রিয়েটিভ ভিজ্যুয়াল তৈরি করতে। যেমন বনপাংশুলে গুণীনের মৃত্যুতে সমস্ত বৃক্ষগুলো গুণীনের কাছে চলে আসে...ঐ দৃশ্যটা, অথবা সুকীর ঐ যে, পিঁপড়ার কাছে যাওয়া...মানে যেখানে...ঐ যে, সুকী তার কামোত্তোজনা নিবারণ করতে চায়...তো ঐ সকল দৃশ্য কিন্তু ম্যাজিক না, ওটা হলো স্পেক্টল কিন্তু আমি বলতে চাই ওটা ক্রিয়েটিভ আর্ট। মামুনভাই আমি কিন্তু পাঁচালী, পালাগান এসব থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন ধরনের থিয়েটার তৈরির কথা বলছি, তাই না? কারণ, আমি একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে...

মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, তা তুমি পারো। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি সিমপ্লিসিটির কথা। তুমি যে নতুন নাট্যধারার কথা বলছো...আমাদের এই ভূখ-ের জনপদের, জনগণের সাথে মিশে যাওয়ার এই থিয়েটার নির্মাণ...তো আমাদের লোকজ ফর্মগুলো কিন্তু সিমপ্লিসিটিতে ভরা। তুমি মহাভারতের কথা ধরো। মহাভারতের ঐ যে...আমার যেটা সবচাইতে বেশি দাগ কাটে...ঐ যে, অভিমন্যু বধ। অভিমন্যু বধের পারফরমেন্স আমি দেখেছি। একটি ছেলে টোটাল পারফরমেন্সটা করছে এবং সাথে কেবল একটা বীণ বাজছে। সেই জায়গাটাকে তুমি সাপ্লিমেন্ট করছো নানা ধরনের ভিজ্যুয়াল দিয়ে। এটা তোমার ভাবনা। তো...এটা কিন্তু একটা কন্ট্রাডিকশন, সেটা হচ্ছে যে, তুমি যদি আমাদের ন্যাশনাল এপিক ফর্মকে ব্যবহার করতে চাও...সেই ন্যাশনাল এপিক ফর্মটা কিন্তু সিমপ্লিসিটিতে ভরা। এবং সেই সিমপ্লিসিটির যে কী সৌন্দর্য...সেই সৌন্দর্যটাকে কি আমরা থিয়েটারে দেখবো না?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
অবশ্যই দেখবো। কিন্তু সেটাকে কি আমরা রিপিট করবো, যেটা আমাদের গ্রাম এলাকায় হচ্ছে?...নাকি একজন আধুনিক নাট্যনির্দেশক হিসেবে আধুনিক নাট্যবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোকে ব্যবহার করে তাকে আরো এনরিচ করার চেষ্টা করবো?...কারণ, জয়নুল আবেদীনতো বিদ্রোহের সেই ষাঁড়টা এঁকেছেন...অথবা সাঁওতাল এঁকেছেন...তো আরেকজন যে, গ্রামের পটুয়া আঁকছেন...তার সাথে জয়নুল আবেদীনের কাজ কিন্তু একই রকম হচ্ছে না মামুনভাই।

মামুনুর রশীদ
এক হচ্ছে না। কিন্তু জয়নুল আবেদীনের দুর্ভিক্ষের ছবিতে যে সিমপ্লিসিটি ও গ্রেটনেস এক হয়ে গেছে...হয়তো এস. এম. সুলতানের সেটা মিলবে না। তো কথা হচ্ছে, অবকোর্স নির্দেশক হিসেবে তোমার একটা ইমাজিনারি থাকবে...কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের ঐতিহ্যের সিমপ্লিসিটিটা নিয়ে তুমি এগিয়ে যেতে পারতে।

খালেদ খান
এ ব্যাপারে আরেকটা উদাহরণ হতে পারে হাবিব তানভীর। উনি একটা বিশেষ জনপদের মানুষকে নিয়ে নাটক করেছেন।...সেখানে মামুনভাইয়ের সাথে আবার আমি একমত।...এই সিমপ্লিসিটিটা দিয়েই কিন্তু চরণদাস চোর-এর হাজার হাজার শো হয়েছে।...তো এখন মীমাংসাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে...

মামুনুর রশীদ
অথবা রতনের কাজগুলোতে...রতন থিয়াম... তো রতনের কাজগুলোতে একটু ওয়েস্টার্ন ধাঁচ-টাচ থাকলেও, সে কিন্তু একটা বিশেষ কালারফুল জনপদের...মানে ওদেরটা কিন্তু আবার কালারফুল, মনিপুরি...খুব স্পেক্টিকুলার, সে কিন্তু এই স্পেক্টলটাকে নিয়েছে ঐতিহ্য থেকে, এবং সেটা ব্যবহার করেছে।

হাসান শাহরিয়ার
কবির, তুমি কিন্তু শুরুই করো নি।
 
কামালউদ্দিন কবির
একটু আগে থেকে শুরু করি...মামুনভাই যে দুর্ভাগ্যের কথা বললেন...তো আমি একটু পেছন থেকে শুরু করতে চাই। আমার কাছে মনে হয়েছে বাঙলা নাটকের দুর্ভাগ্যটা অনেক আগে থেকেই।...বহু বহু বছর ধরে কিন্তু আমরা অভ্যস্ত হয়ে আছি...অভিনয়রীতি বলি, নাট্যরীতি বলি এমনকি পা-ুলিপির গঠন কাঠামো...সব ক্ষেত্রেই ওয়েস্টার্ন থিয়েটার-এর উপর। এটা সত্য যে, অভিনয়রীতি, প্রযোজনারীতি এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে ভিন্নতা অবশ্যই আছে কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে...পা-ুলিপির ক্ষেত্রে...নাটকের টেক্সট নিয়ে যে আলাদা, স্বতন্ত্র চিন্তা ভাবনা হতে পারে সেটি কিন্তু আমরা বলা যায় একমাত্র...এখানে...মানে এই বনপাংশুল...এই ঘরানার মধ্য থেকে পেয়ে যাচ্ছি। সেটা কীভাবে?...এই যে, আমাদের যে নাট্যরীতির কথা বলা হচ্ছে...আমাদের দেশজ নাট্যরীতি কিন্তু পাঁচালী, কিসসা, হাস্তরগান...ইত্যাদি ইত্যাদি এবং এই নাট্যরীতির মধ্য থেকে...মৌখিকরীতিসহ এবং পরে যে লেখ্যরীতি এসেছে...সেই লেখ্যরীতির মধ্যে পরিষ্কারভাবে...যে কী হতে পারে টেক্সট-এর আধুনিক কাঠামো...সে ক্ষেত্রে, হতে পারে নিরীক্ষার পর্যায়ে আছে কিন্তু তাও আমাদের নিজস্ব বাঙলা নাটকের পা-ুলিপি এই বনপাংশুল, এরকমটা বোধহয় নিশ্চিত। এখন আমি দুর্ভাগ্যের কথাটা বলি...মামুনভাইয়ের কাছে প্রশ্ন যে, আমাদের দুর্ভাগ্য কোথায়? এই যে সেলিম আল দীনের নাটক বহু জায়গায় চর্চিত হচ্ছে না? নাকি বহুকাল ধরে অভ্যস্ত হয়ে আছি অন্য রূপ ও আঙ্গিকের টেক্সট নিয়ে?

মামুনুর রশীদ
এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে দ্বিমত পোষণ করছি। সেটা হচ্ছে, পা-ুলিপি রচনার ক্ষেত্রে আমার কাছে খুব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মনে হয় নি। এজন্য মনে হয় নি...সর্গ দিয়ে যেটা ভাগ করা হলো...দৃশ্যপটগুলোকে...এই এপিসোডস কিন্তু ওয়েস্টার্ন থিয়েটারেও আছে...ইট ইজ নাথিং নিউ, যেকোনো এপিক-এ আছে, মঙ্গলকাব্যে আছে, ওয়েস্টার্ন এপিক-এ আছে, ওডিসিতে আছে... তো এটাকে তুমি নতুভাবে বলছো কেন?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
না, ও কিন্তু পঞ্চমাঙ্কের কথা বলছিল...

মামুনুর রশীদ
পঞ্চমাঙ্ক কনসেপ্ট তো ভেঙে গেছে এই শতাব্দীর শুরুতেই...এবং এখান থেকে সেলিম আল দীনও তেমন ডিফারেন্ট কিছু না। সেলিমের পুরো নাটকটি যদি দেখ...তো সেখানে...ওয়েস্টার্ন থিয়েটার থেকে কতটা পার্থক্য?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
লেখার দিক থেকে হয়তো কম পার্থক্য...কিন্তু আমার প্রয়োগের দিক থেকে অবশ্যই পার্থক্য আছে।

মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, প্রয়োগের দিক থেকে পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু লেখার দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। ইটস আ প্লে। যে বাসন নাটক লিখেছে অথবা বনপাংশুল লিখেছে, এ ধরনের টেক্সট কি আমাদের বাঙলা থিয়েটারে নেই?...উৎপল দত্তের প্রয়োগে তিতাস একটি নদীর নাম হয়েছে...তো সেখানে প্রসেনিয়াম ভেঙে...অনেক লোকজ গান ব্যবহার করে...মানে অসাধারণ প্রযোজনা করেছে...

কামালউদ্দিন কবির
কিন্তু মামুনভাই এসব উপাদান ব্যবহার করাই না কেবল...একটু আগেই যে প্রসঙ্গটা এসেছিল যে, পাঁচালীর কিছু একটা ব্যবহার করা, বা গাজনের কিছু একটা ব্যবহার করা...অর্থাৎ এসব লোকজ উপাদান জুড়ে দিলেই কি আমাদের দেশজ থিয়েটার হবে? নিজস্ব থিয়েটার হবে?...তা না বোধহয়...এটি একদম সামগ্রীকভাবে হয়ে ওঠার ব্যাপার আছে। যেটা আমাদের এখানে এর আগে হয় নি...

খালেদ খান
এখানে আমি...মানে...মামুনভাইয়ের সাথে একমত, ‘হয় নি’ বলাটা কতটুকু যৌক্তিক? বা এটিই শুরু এটাই-বা কতটুকু যৌক্তিক?

মামুনুর রশীদ
আর, কবির, তুমি যেটা বললে বাঙলা নাটকের পা-ুলিপির ব্যাপারে...তাহলে...তুমি নবান্নকে কী বলবে?

কামালউদ্দিন কবির
নবান্ন সেই...ঐ যে, ওয়েস্টার্ন রীতিতেই লেখা...মানে...

মামুনুর রশীদ
প্রসেনিয়াম?

কামালউদ্দিন কবির
প্রসেনিয়াম তো প্রায়োগিক ব্যাপার...আমি বলতে চাচ্ছি নাট্যরচনারীতির কথা...সেদিক থেকে নবান্ন...ঐ যে সংলাপ ধরে ধরে লেখা সেই রীতির...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আসলে মামুনভাই নাট্যরচনারীতির ব্যাপারটা নিয়েই কবির বলতে চাচ্ছে...এবং সেদিক থেকে কিন্তু...আমি বলবো...মানে...সেলিমের যে জায়গাটা আমি প্রশংসা করি...সেলিম একদম বাঙলার লোকজ জায়গা থেকে...একদম কালচার যে জায়গা থেকে হয়...সেখান থেকে লেখার চেষ্টা করে...ফলে এটাকে অনেক বেশি বাঙলা মনে হয়...আমাদের নিজস্ব মনে হয়।

হাসান শাহরিয়ার
আমরা এখন চেষ্টা করবো কেবলি বনপাংশুলের ব্যাপারে কিছু বলতে। সে হিসেবে আমি বাচ্চুভাইয়ের কাছে জানতে চাই...মানে আমাদের জানার আগ্রহ, সেটা হলো...বনপাংশুল একটা নির্দিষ্ট নৃ-গোষ্ঠীর জীবনাচরণের উপর প্রযোজনা...কিন্তু ঐ নৃ-গোষ্ঠী, মান্দাই নৃ-গোষ্ঠীর ভাষাটা এখানে অনুপস্থিত। তো...নিজস্ব ভাষাকে অনুপস্থিত রেখে সেই নৃ-গোষ্ঠীকে কি উপস্থিত করা যায়?
 
নাসির উদ্দীন ইউসুফ
আমার কথা হচ্ছে...তাদের...মান্দাইদের ভাষাটা এখন নেই...অবলুপ্ত। আমরা কেবল ৫০টা শব্দ উদ্ধার করতে পেরেছিলাম। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ‘ফাং’। ‘ফাং’ একটা চাইনিজ শব্দ, ‘ফাং’ মানে হচ্ছে ‘জঙ্গল’। আমরা সেটা ব্যবহার করি নি।...ঐগুলো উচ্চারণেও সমস্যা হচ্ছিল...তো...যে ভাষাটা নেই...তাকে নিয়ে আমরা চিন্তা করি নি...ওরা বাঙলা বলে...বাঙলা বলার ধরনটা একটু আলাদা, তো...আমি আসলে থিয়েটারটাকে রিয়ালিস্টিক জায়গা থেকে দেখতে চাই না। সেই প্রথম থেকেই...তো যেহেতু রিয়ালিস্টিক জায়গা থেকে দেখছি না, তাই ভাষার ব্যাপারটা আমার কাছে গুরুত্ব পায় নি। কামালউদ্দিন কবির অবশ্য তার একটা লেখায় কস্টিউমের উপর লিখেছিল।...বনপাংশুলের পোশাক খুব সাজানো গোছানো...ইত্যাদি, তো আসলে আমার মনে হয়েছে ওরা যে পোশাক পরে, সেই পোশাক এই নাটকে যাবে না। তাদের ইনার বিউটি ধরার জন্য আমার কাছে সাজানো গোছানো পছন্দ হয়েছে এবং একটা পাতা এঁকে দিয়েছি যাতে একটু...মানে তাদের আভাস থাকে। কস্টিউম করেছে শিমূল...ওকে বারবার বলেছি আমি রিয়ালিজম দেখতে চাই না, রিয়ালিস্টিক কিছু দেখতে চাই না। ‘কোচ’রা কী কাপড় পরে সেটা আমার কাছে সেকেন্ডারি ব্যাপার। কিন্তু বংংবহপব-এর দিক থেকে...টোটাল থিয়েটারটার যখন বংংবহপব নিয়ে চিন্তা করবো...তখন সেখানে ‘কোচ’রা আছে কিনা সেটা মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে।

খালেদ খান
এটা কি আমরা এভাবে বলতে পারি...আসলে ল্যাঙ্গুয়েজটা কতটা জরুরি? আমি কমিউনিকেট করতে পারছি কিনা...আমরা যখন হাবিব তানভীরের কাজ দেখি, রতন থিয়ামের কাজ দেখি বা সেদিন ইন্ডিয়া থেকে আরেকটা পুরোপুরি সংস্কৃত নাটক...উড়িষ্যার বোধহয়...দেখলাম...তো দর্শকের সাথে কমিউনিকেট কিন্তু করে। এখন বনপাংশুল যদি মান্দাইদের নিজস্ব ভাষা হুবহু ব্যবহার করে প্রযোজিত হতো...তবে হয়তো একটা গবেষণার কাজ হিসেবে বাঙলা সাহিত্যে স্থান করে থাকতো যে, সেলিম আল দীন এই কাজ করেছে। কিন্তু তাতে নাটকের কী লাভ হতো? আমি মনে করি না ঐ ভাষা ব্যবহারে খুব বড় ধরনের কোনো ‘কাজ’ হতো।
 
মামুনুর রশীদ
ধরো, আজকে যদি চাকমা সম্প্রদায় নিয়ে নাটক লিখ, তাহলে কোন ভাষায় করবে?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি বাংলায় করবো।

কামালউদ্দিন কবির
অবশ্যই বাংলায় এবং সেখানে চাকমাদের নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য যা যা...কমিউনিকেট করানো যায়...সহজে...সেগুলোও রাখবো।

মামুনুর রশীদ
বাংলায় করবে?

কামালউদ্দিন কবির
অবশ্যই বাংলায়।

মামুনুর রশীদ
তাতে কি একটা রক্ত-মাংসের মানুষকে পাওয়া যাবে?

কামালউদ্দিন কবির
পুরোটাতো পাওয়া যাবেই না।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
সেটাতো সম্ভব না, কিন্তু আমরাতো বাঙালি...

মামুনুর রশীদ
আমি কিন্তু এটাকে সমস্যা হিসেবে তুলছি...

খালেদ খান
এটাতো সমস্যাই...কিন্তু আমরা ভাষাটাকে এতো করে দেখছি কেন?...থিয়েটারের নিজস্ব একটা ল্যাঙ্গুয়েজ আছে...সেটাও কিন্তু শক্তিশালী।

কামালউদ্দিন কবির
আমি বলতে চাই, ভাষা আনার প্রয়োজন নেই...কিন্তু, যদি এই নাটকে মান্দাইদের আরও কিছু নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, আচার আচরণ খুঁজে পেতাম...যদি ইঙ্গিত পেতাম...তাহলে আমরা আরো ঘনিষ্ঠ হতে পারতাম...এই জনগোষ্ঠীর সাথে।

মামুনুর রশীদ
আমার কাছে বাচ্চু, আরেকটা সমস্যা যেটা, সেটা হচ্ছে যে, সেলিমের নাটকের যে বৈশিষ্ট্য...বনপাংশুলের বৈশিষ্ট্য...আমি মনে করি এটা তার প্রথম যে, আমি বা আমরা যে লাইনে চিন্তাভাবনা করি...শ্রেণি সংগ্রাম বলো বা...একটা আদিবাসী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে...এই প্রথম সংগ্রামের কথা আসলো। সে জন্য সেলিম আমার কাছে ধন্যবাদ পাবে। কিন্তু তারা (প্রয়োগকর্মীরা) যে ভাষাটা ব্যবহার করলো সেটা ওদের ভাষা, যারা তাদেরকে (মান্দাই নৃ-গোষ্ঠীকে) শোষণ করেছিল...তাদেরকে উচ্ছেদ করেছিল। এর জন্যই ভাষার কথাটা বললাম...আমি নিজেও জানি না এটার কী করা যেত। এখন আমি যুবরাজের একটা কথার জবাব দিচ্ছি...ঐ যে বললে, ভাষাটা মুখ্য নয়...সে কথাটা নিয়ে বলছি, সেটা হলো...এই অঞ্চলের (বাঙলার) ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যে অভিনয় করেছে, আঙ্গিক অভিনয়...সেই প্রকাশভঙ্গি কিন্তু ঐ নৃ-গোষ্ঠীর (মান্দাই) প্রকাশভঙ্গি নয়।...তুমি যদি মান্দাইদের অথবা অন্যান্য আদিবাসীদের দেখ...চাকমা, গারো, ইত্যাদি...তো সবাই কিন্তু খুব সফট স্পোকেন পিপল, কিন্তু ওরা যখন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তখন ওদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজটাও ডিফারেন্ট হয়ে যায়। তাই আমার ভাষ্য হলো বাঙলা ভাষা ব্যবহার করার ফলে অভিনয়টাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে এই নাটকে। এটাও একটা সমস্যা...এটার ব্যাপারেও আমি জানি না কী করা যেতে পারতো।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আসলে থিয়েটারতো মঞ্চে উচ্চারিত শব্দই নয়...মানে অভিনেতার বডি ল্যাঙ্গুয়েজসহ নির্দেশকের ভিজ্যুয়াল চিন্তাগুলোর সমন্বয়ে মঞ্চে যা করা হয়, তা কমিউনিকেট করতে পারলেই হলো। তাহলেই বুঝবো থিয়েটার-ল্যাঙ্গুয়েজটা ওয়ার্ক করেছে।...তো সেটা করেছে কিনা সেটা দর্শক বলবে। আর মামুনভাইয়ের কথার সূত্র ধরে বলতে পারি...সেটা হলো...এই নাটকটা ধরাই হয়েছে উত্তেজনার জায়গা থেকে...আরম্ভই হয়েছে কিন্তু হারানোর জায়গা থেকে, সংগ্রামের জায়গা থেকে, সুতরাং পুরো নাটক জুড়ে যে ক্ষোভ...সেটা প্রথম থেকেই আছে। এখন আমাদের যে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করেছে...তারা তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার ক্ষোভ, সেটা...মানে, বাঙালির ক্ষোভটা ব্যবহার করেছে। এখন সেটা পুরো আবহটাকে নষ্ট করেছে কিনা...

খালেদ খান
এখন কিন্তু মামুভাইয়ের বিষয়টা আমার কাছে ইমপর্টেন্ট মনে হচ্ছে যে, ভাষা আমরা যা-ই ব্যবহার করি না কেন...বডি ল্যাঙ্গুয়েজটা যদি ধরতে পারতাম তাহলে নৃ-গোষ্ঠীটাকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে চিনতে পারতাম কিনা।

মামুনুর রশীদ
বডি ল্যাঙ্গুয়েজটা তো প্রভাবিত করেছে এই ভাষা। এই যে...ধরো...‘গ্যাছাল’ এটা কিন্তু আমার গ্রামের ভাষা। তো এই কথাটা যখন মান্দাইরা বলবে...তখন...শত ক্ষিপ্ত হলেও তার গলাটা হয়তো বাড়িয়ে দিবে কিন্তু শোল্ডারটা কিন্তু পিছনে থাকবে। অন্যদিকে বাঙালি যখন ক্ষিপ্ত হবে...তখন তার গলা, কাঁধ সবকিছু নিয়ে সে ক্ষিপ্ত হবে। ভাষার সাথে কিন্তু জেশচারের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ...বাচিক অভিনয়, জেশচারকে প্রভাবিত করে...তো এটা কিন্তু এমন একটা প্যাঁচে আটকিয়ে আছে...কী বলবো...মানে...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
এই সমস্যাটা আসলে সব থিয়েটারেই আছে। এখানে যুবরাজও খুব ভালো অভিনেতা আছে...তো সেও...বা সকলেই...কমবেশি, যখন একটা চরিত্রে রূপ দিতে যান, তখন সে প্রয়োগ করে তার ভাবনাটাকে, সে ঐ চরিত্রটা কীভাবে হতে পারে...এসব ভেবে নিজের ভিতরে স্থাপন করে...ফলে আসলে...পার্টিকুলার গোষ্ঠীর ভাষা, জেশচার সব কিছুকে এক বিন্দুতে আনা...অভিনেতার জন্য আসলেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, চিরকালই অভিনেতার উপর দোষ চাপিয়ে দেয় নির্দেশকরা হাঃ হাঃ

হাসান শাহরিয়ার
আচ্ছা বাচ্চুভাই আপনি বলেছিলেন...নাটক সমাজের দর্পণ বা...অর্থাৎ, আমরা নাটককে যারা অনেকটা বৈপ্লবিকভাবে গ্রহণ করতে চাই...সেটার খুব একটা পক্ষে আপনি নন। আপনি শিল্প হিসেবেই নাটকটাকে দেখেন।
 
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, আমার কাছে আর্টটাই বড়।

হাসান শাহরিয়ার
হ্যাঁ, অবশ্যই, এবং আমাদের কাছে যে আর্টটা ছোট তাও কিন্তু না। আমার কথা হচ্ছে আর্টের মাধ্যমে আমি বিষয় হিসেবে দর্শককে কী দেবো সেটা কিন্তু জরুরি ব্যাপার। আমার কাছে বনপাংশুলের যে জায়গাটা সবচেয়ে সমৃদ্ধ মনে হয়েছে তা হলো তার ভেতরকার মূল দ্বন্দ্বটা। অর্থাৎ একটা নৃ-গোষ্ঠীকে, তাদের কালচারকে, তাদের মিথকে...মানে পুরো জনপদের জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিচ্ছে আমারই স্বজাতি বাঙালিরা। এই যে আগ্রাসন এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই...হোক সেটা পরাজয়...তো এই লড়াইটাই আমার কাছে সবচেয়ে সমৃদ্ধির জায়গা মনে হয়েছে।...এবং মামুনভাইও বললেন...এই প্রথম সেলিম আল দীন এই ধরনের নাটক লিখলেন...তো আপনার কী মত?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আসলে তোমার কাছে হয়তো সংগ্রামের জায়গাটা, দ্বন্দ্বের যে জায়গাটা আছে সেটা ভালো লেগেছে। কিন্তু আমার কাছে ওদের রিচ্যুয়ালটা, ওদের কালচারটা অর্থাৎ...বিউটি অব লাইফ, সেটা ভালো লেগেছে।

মামুনুর রশীদ
সেটাওতো তোমার ইসের, মানে ব্যাপারটাকে স্পেক্টল করার প্রয়োজনে...তোমার, মানে...আমার কাছে মনে হয়েছে যে, মান্দাইয়ের যে কালচার, তাদের গান, তাদের বিশ্বাস, তাদের নিজস্ব কাহিনি...সর্বোপরি যে মিথ তাদের আছে...অতি সমৃদ্ধ মিথ নিয়ে একটা জাতি দাঁড়িয়ে ছিল...তাকে ধ্বংস করে দেয়া হলো, তো বনপাংশুল যে কারণে আমার কাছেও, হাসান শাহরিয়ারের মতো, আমারও মনে হয়েছে যে, এই সংগ্রামের কারণেই বনপাংশুল সার্থক।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, সংগ্রাম অবশ্যই বনপাংশুলের একটা বড় ব্যাপার কিন্তু...তারচেয়ে বেশি আমার ভালো লাগে বিয়ের অনুষ্ঠান...আবার বাঁদরের জায়গাটা...এগুলো হলো পার্ট অব দেয়ার লাইফ, এখানেই তাদের বিউটি...ওরা যখন উৎসব করছে, রাশ উৎসব করছে, তখন আমার কাছে বেশি...মানে মনে হয় আমি যা করতে চেয়েছি তার অনেকটাই কাছে গেছি। অন্যদিকে লড়াইটা যতই করেছি...ঐ লড়াইয়ের থেকে মিউজিক, ড্যান্স এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসা জীবনটা, সেটাই বড় মনে হয়েছে, ইমপর্টেন্ট মনে হয়েছে।

হাসান শাহরিয়ার
তাতো অবশ্যই। কিন্তু এই মিউজিক, ড্যান্স বা তাদের অন্যান্য নান্দনিক দিকগুলোতো আছেই, সেগুলো চোখ জুড়িয়েছে, কিন্তু আজ, এতদিন পরেও যে বনপাংশুলকে আমার মনে পড়ে, সেটা কিন্তু মান্দাইয়ের সাথে বাঙালির দ্বন্দ্বের কারণে। কারণ, মিউজিক বলেন বা অন্যান্য উৎসব বলেন, যেগুলোতে আপনি আপনার আকাক্সক্ষার কাছাকাছি পৌঁছেছেন বলে মনে করছেন, সেগুলো কিন্তু আমাদেরও ভালো লেগেছে...ভালো লাগবেই। আমি কিন্তু ভাবনার বিষয়টার কথা বলছি...সেই সংগ্রাম আমার ভেতরে যে ভাবনার, চিন্তার বিস্তার ঘটালো, সেটাই এখনো আমার কাছে বনপাংশুলকে স্মরণ করিয়ে রাখে।

মামুনুর রশীদ
এখন তাহলে হাসান শাহরিয়ারের কথা থেকে কবিরের প্রসঙ্গে চলে যাই...সেটা হচ্ছে...টেক্সট, টেক্সট-এর মধ্যে ওর ঐ কথাটাই মনে আছে...কনফ্লিক্ট, থিয়েটারের যে কনফ্লিক্ট সে জন্যই কিন্তু...

কামালউদ্দিন কবির
অবশ্যই মামুনভাই। আমি কিন্তু কোনো কিছুই অস্বীকার করছি না। আমি টেক্সট-এর রচনাশৈলীর কথা বলছিলাম। অর্থাৎ কাঠামোর কথা বলছিলাম...বলছিলাম সেলিম আল দীনের নাটকের কোথাও চরিত্র উল্লেখ, পূর্বনির্দেশ...কোথাও নেই, ফলে একজন নির্দেশকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে, চিন্তার স্বাধীনতা থাকে...প্রয়োগের ব্যাপারে। এই স্বাধীনতার...প্রয়োগের স্বাধীনতার ব্যাপারটা কিন্তু টেক্সট-এর লেখ্যরীতিতেই আছে...সেটা কেমন? সেটা হচ্ছে কোথাও উল্লেখ নেই...বনপাংশুলের টেক্সট-এ যে, সুকীর ঘর, গুণীন আসছে কিংবা সুকী বলছে, গুণীন হুট হাট করে চলে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। যে সমস্ত নির্দেশবলি কিংবা ধারণা অন্যান্য পা-ুলিপিতে থাকে। বনপাংশুলে বা সেলিম আল দীনের নাটকে সেগুলো নেই।

হাসান শাহরিয়ার
এটা বোধহয় চাকা, যৈবতী কন্যার মন-এ নেই। বনপাংশুলে কিন্তু আছে। অর্থাৎ চাকা কিংবা যৈবতী কন্যার মন-যতটা ন্যারেটিভ, বনপাংশুল কিন্তু ততটা না। তাই না?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
না, বনপাংশুলও একই রকম।
 
হাসান শাহরিয়ার
না, বাচ্চু ভাই, বনপাংশুলের টেক্সট কিন্তু ঐ দুটোর চেয়ে বেশি সংলাপনির্ভর। এখানে কিন্তু চরিত্র এবং তার সংলাপ উদ্ধার করা সহজতর।

মামুনুর রশীদ
যদি সংলাপ না থাকে তা হলে... এটাতো মঙ্গলকাব্যের মতো...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
না, মঙ্গলকাব্য হবে কেন? মঙ্গলকাব্য থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো আধুনিক রচনা বলতে পারেন। পাঁচালীরীতিতে, পালাগান ইত্যাদি থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে...একটি রচনা।

মামুনুর রশীদ
তা হলে এখানে সেলিমের মৌলিকত্ব কোথায়?

কামালউদ্দিন কবির
মৌলিকত্ব হলো, ‘বিষয়ে’ তো আছেই...আর এখানে মানুষ এসেছে...

মামুনুর রশীদ
আচ্ছা...ধরো...ময়মনসিংহ গীতিকা নিয়ে মাধব মালঞ্চি কইন্যার মতো একটা অসাধারণ নাটক হয়ে গেল। তো সেখানেওতো বিষয় আছে, মানুষ আছে...তো...ঠিক আছে, আমাকে বলো যে, এই যে সেলিমের নাটকে সংলাপ নেই, বর্ণনা নেই, এমনকি নির্দেশনাও নেই...তো এই যে মঞ্চে চরিত্রগুলো কথা বলে...এই সংলাপ উদ্ধার করলো কে?

কামালউদ্দিন কবির
নির্দেশক ও অভিনয়শিল্পীরা।

মামুনুর রশীদ
তাহলেতো এগুলো নাটক না, মঙ্গলকাব্য।...তাহলে আমরা বলতে পারি সেলিম মঙ্গলকাব্য লেখেন এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ এগুলোকে মঞ্চরূপ দেন।

কামালউদ্দিন কবির
সেলিম স্যার কিন্তু নিজেও বলছেন যে, এগুলো কেবল নাটক নয়...উপাখ্যান...আপনি যদি নাটক বলেন বলতে পারেন, যদি গল্প বলেন বলতে পারেন...কবিতা বললেও বলতে পারেন। এ জন্যই তিনি (সেলিম আল দীন) একটা নন্দনতত্ত্বের নাম করতে চান...সেটা হলো দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্প...

খালেদ খান
মামুনভাইয়ের দ্বিতীয় একটা কথা ছিল...স্পেক্টল তৈরি করার ব্যাপারটা, তো আপনার (বাচ্চুভাই) সব নাটকেই, কিত্তনখোলা থেকে শুরু করে...এমনকি হাত হদাইতে কাছিম শিকার...এসব খুবই স্পেক্টেকুলার, তো বনপাংশুলে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে...এটা না করলেই কি ভালো হতো?...আমি উদাহরণ দিচ্ছি...বনপাংশুলে সুকীর যে কামার্ত হওয়ার দৃশ্য...সেখানে যদি আমরা শুধুমাত্র ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং-এর উপর ছেড়ে দিতে পারতাম...তা হলে আর ঐ ম্যাজিকটা তৈরি করার প্রয়োজন পড়তো না।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমার পয়েন্টটা হচ্ছে যে, প্রথমত থিয়েটারটাকে সবসময় মনে হয়, আমি ওখানে একটা কবিতা তৈরি করবো। তো আমি যদি মিউজিক বা অন্যান্য ব্যাপার দিয়ে, কম্পোজিশন দিয়ে বিষয়টা ফুটিয়ে তুলতে পারি এবং ফলে স্পেক্টেকুলার হয়...তাহলে অসুবিধা কোথায়?

খালেদ খান
না, আমি বলতে চাচ্ছি...এমন একজন অভিনেত্রী কাজটা করেছেন, শিমূল ইউসুফ, তার উপর আপনি আস্থা রাখতে পারতেন।
 
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, তাঁর যে, হাত হদাইতে মৃত্যু দৃশ্যে অভিনয় কিংবা ঐ যে, শুভাশিষ ভৌমিক, কাছিম শিকার করলো, হাত হদাইতে...এগুলো কিন্তু মেমোরিতে থেকে যায়। অভিনয়ের গুণে...

খালেদ খান
সেটাই বলছিলাম... এমন একজন অভিনেত্রী কাজটা করছিলেন... বনপাংশুলে...তাঁর উপর আস্থাটা রাখলেন না কেন?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হাঃ হাঃ...না, না, আস্থা রাখি নি ঠিক তা কিন্তু না...কিন্তু সেই সঙ্গে আমার মনে হয়েছে কিছু বৃক্ষ...মিউজিক, মানে...

হাসান শাহরিয়ার
মানে সবই যদি অভিনেত্রী করে তা হলে নির্দেশক হিসেবে আমি কী করলাম...হাঃ হাঃ

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হাঃ হাঃ...না, না, নির্দেশক ডেফিনিটলি অভিনেতা-অভিনেত্রীর উপর নির্ভরশীল থাকে। কিন্তু তার পাশাপাশি নির্দেশক যে অন্যকোনো ভিজ্যুয়াল বিষয় চিন্তা করবে না...তা কিন্তু ঠিক না।

হাসান শাহরিয়ার
অবশ্যই করবেন। আচ্ছা, আমরা এখন বনপাংশুলের অন্যান্য বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করবো। অভিনয়, মঞ্চ পরিকল্পনা, মিউজিক এই কটি বিষয়...তো বাচ্চুভাই, আগে যেমন আপনি ‘ঢাকা থিয়েটারে’র নাটক করার সময় ‘কঠিন’ ‘কঠিন’ অভিনেতা-অভিনেত্রী পেতেন...বনপাংশুলে কিন্তু আমরা দেখি অনেক নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী...নতুন বলতে আগে সমস্ত নাটক জুড়ে অভিনয় করার মতো সুযোগ পেতেন না, এমন শিল্পীদের কথা বলছি, তাদেরকে নিয়ে বনপাংশুলে কাজ করেছেন ..তারপরও কিন্তু অভিনয়-ঘাটতি তেমন একটা চোখে পড়ে নি...

খালেদ খান
এক্ষেত্রে বাচ্চুভাইকে আমি একটা বিশাল ধন্যবাদ দেব...সেটা হচ্ছে...বাচ্চুভাই বলছেন বনপাংশুল তার পছন্দের কাজ, তাঁর নিজস্ব ঘরানার কাজ। তো, এই কাজে সফলতা অর্জন করেছেন একদল নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে...এটা আমার কাছে দুরূহ এবং একই সাথে কৃতিত্বের কাজ মনে হয়েছে। নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরিতে এ কাজটা কিন্তু বড় ধরনের পদক্ষেপ। তবে, সাথে সাথে এও বলি...যেটা প্রথমেই বলেছিলাম অভিনয়রীতির ব্যাপারে...হতে পারে একটাদল ভাবে যে, তারা এই রীতিতেই অভিনয় করবে...সেই অভিনয়রীতিটা কিন্তু একই আছে। আমার বাচ্চুভাইয়ের কাছে একটা প্রশ্ন...সেটা হলো এই যে, আপনার হিউম্যান ক্যাপিটাল যেটা আছে, তাকে দিয়ে...মানে অভিনয়রীতিটা ভাঙছেন না কেন? নাকি ভাবছেন যে, রীতিটা এরকমটাই হওয়া উচিত?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি খুব কাছের একজনের উদাহরণ দিচ্ছি...উৎপল দত্ত। ওনার অভিনয়রীতিটা কিন্তু একই ছিল...সেখানে উনি খেলেছেন। এই খেলাটা হয়ত-বা ওনার দ্বারা খেলা সম্ভব ছিল। যুবরাজ যেটা বললো...ভাঙাটা খুব কঠিন...হ্যাঁ, আমারই ভাঙা উচিত...তা না হলে মনোটনিতে দাঁড়িয়ে যেতে পারে...বা এখনই হয়তো দাঁড়িয়ে গেছে...এটা হতে পারে এই জন্য যে, আমরা একটা পার্টিকুলার লক্ষে কাজ করছি...গীতল অভিনয়, লোকজ ধারায় অভিনয়রীতি নিয়ে...এগুলোতে প্র্যাক্টিস করছি বলেই হয়তো, ভাঙাভাঙির কাজটা হয়ে উঠছে না, কেননা, যদি আগের কাজের কথা ধরো...জ-িস ও বিবিধ বেলুন, মুনতাসির ফ্যান্টাসী...সেখানে কিন্তু একধরণের অভিনয় আর শকুন্তলা থেকে শুরু হয়েছে এই বর্তমান ধারার অভিনয়রীতি। হয়তো নতুন কোনো নির্দেশকের দ্বারা সম্ভব হবে...মানে, সহজ হবে এই রীতিটা ভাঙা। আমি কিন্তু নিজেও মনে করি অভিনয়-স্টাইলটা পরিবর্তন হওয়া উচিত।

মামুনুর রশীদ
বাচ্চু, বনপাংশুলে তুমি প্রসেনিয়াম ভেঙেছো, ভাঙা দরকার বলে তুমি মনে করেছো। অভিনয়রীতিতে কিন্তু প্রসেনিয়াম স্টাইলটাই মেনটেইন করেছো। সেটা কীভাবে?...সেটা হলো প্রসেনিয়াম-এ কিন্তু অভিনেতা-অভিনেত্রীরা একটা ফোরটাল ভিশন তৈরি করে অভিনয় করে...যেহেতু দর্শক সামনে। তোমার বনপাংশুলে কিন্তু দর্শক থাকে দুদিকে। সুতরাং তখন কিন্তু অভিনেতাকে স্মরণ রাখতে হবে যে, অভিনয় করতে হবে চতুর্মুখি, যেন সব দর্শকই তার অভিনয় দেখতে পায়...অনেকটা যাত্রার মতো। সেখানে কিন্তু আমার মনে হয়েছে সবাই...তোমার প্রয়োগরীতির সাথে ঠিক-ঠাক মতো খাপ খাইয়ে উঠতে পারে নি। এছাড়া অভিনয়ের ব্যাপারে বলবো যে...‘ঢাকা থিয়েটারে’র অন্যান্য নাটকগুলোর চেয়ে, বনপাংশুলকে অনেকটা আনরিহার্সড মনে হয়েছে। সমস্ত নাটক জুড়েইতো গান। সেই গান গাওয়ার ব্যাপারে যখনই কেউ ফেইল করেছে শিমূল হয়তো সেটা গিয়ে ধরছে...তাছাড়া সেলিমকে, শহীদুজ্জামান সেলিমকে আমি বলেছি যে, তুই বোধহয় রিহার্সেল ঠিকমতো করিস নি। তো সে বললো যে, প্রথমে আমাকে বাদ দিয়েছিল, পরে আবার সুযোগ দিয়েছে।...কি বাচ্চু, বাদ দিছিলা?...হাঃ হাঃ। যাক তবুও আমার মনে হয় একদল নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী বেশ দাপটের সাথেই কাজটা বের করে আনতে পেরেছে।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
গানের কথা যেটা বললেন, ওটা প্রথমদিকে ছিল, এখন কিন্তু নেই।

কামালউদ্দিন কবির
আমি মঞ্চ পরিকল্পনার ব্যাপারে বলতে চাই। মান্দাইদের জীবনাচরণ সম্পর্কে আমি একদম জানিই না। তবে অরণ্যের আভাসটা পাচ্ছি। এবং মাঝে মাঝে সেটার পরিবর্তন হচ্ছে...কাহিনির সাথে সাথে...গুণীনের মৃত্যু দৃশ্যে সব বৃক্ষগুলো জড়ো হচ্ছে...এসব ভালো লেগেছে। কিন্তু সব কিছুর পরেও...মান্দাইদের যে নিজস্ব বসতবাটি আছে...সেটার কোনো আভাস কি আমরা কোথাও পাই? বা সেটা দেয়ার বোধহয় উদ্দেশ্য...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
না, সেটা দেয়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এমনকি নাটকে বাঁশের যে ফ্রেম দিয়ে ঘর করা হয়েছে, সেটাও আমার ইচ্ছা ছিল না। আমি চেয়েছিলাম একদম প্লেইন প্লাটফর্ম।

কামালউদ্দিন কবির
হ্যাঁ, গ্যাবল পদ্ধতিতে যে মডার্ন আর্টিস্টিক-এ এবং লোকজ, মানে লোকজ মটিভ দিয়ে করা হয়েছে, কিন্তু...মানে এটা করার ফলে আমার কোনোরকম ধারণা নিতেই কষ্ট হচ্ছে যে, তা হলে মান্দাইদের ঘর আসলে কেমন...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
ওদের হচ্ছে মাটির ঘর।

কামালউদ্দিন কবির
সেটার আভাস যদি একটু পেতাম...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
সেটা না পেলেও অসুবিধা ছিল না যদি...

হাসান শাহরিয়ার
কিন্তু ফ্রেমটা না দিলে বরং আমরা ভুল ধারণা থেকে বেঁচে যেতাম।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, সেটাই বলছি। যে, কিছুই না দিলেই পারতাম।

মামুনুর রশীদ
একটা কথা সূত্রে ধরেই বলি...যেমন, অন্যান্য ফরেস্টগুলোতে দেখবে দোতলা বাড়ি থাকে। কাঠের উপরে ওঠে সিঁড়ি দিয়ে...

কামালউদ্দিন কবির
হ্যাঁ, এটার যদি কোনো আভাস পেতাম...

মামুনুর রশীদ
না, এটা তুমি পাবা না। কারণ, মান্দাইরা হচ্ছে সেই জাতি যারা...বাঘ, বা অন্যান্য জীব-জন্তুর সাথে সহবস্থান করে। এবং জঙ্গলে, মাটির ঘরে থাকা কিন্তু খুব রিস্কি...শুয়র, বাঘ, সাপ...এদের আক্রমণের ব্যাপার আছে। কিন্তু এমন একটা চমৎকার বোঝাপড়া বন্যপ্রাণীদের সাথে মান্দাইদের যে, ওরা একই সমতলে বসবাস করে।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
কেবল ঘরের দুদিকেই বাতাস ঢোকা-বোরোনোর জন্য গর্ত থাকে।

খালেদ খান
ভয় করে না?

মামুনুর রশীদ
না, সহবস্থান।...ঐ যে মিথ, এই মিথ কিন্তু ওদের বেলায় খুব ইমপর্টেন্ট...এই আদিবাসীরা কিন্তু সাংঘাতিক আধ্যাত্মিকবাদে বিশ্বাসী। ওরা বাঘের মন্ত্র জানে, সাপের মন্ত্র জানে...এমুকটা জানে, তমুকটা জানে...এই জন্যই এই মিথগুলো কিন্তু ডেভালপ করেছে। এবং সবচেয়ে বড় কথা প্রাণে যে শক্তি, এই শক্তিতে ওরা বিশ্বাস করে। এবং ওদের ধর্ম বিশ্বাসগুলোও কিন্তু ইন্টারেস্টিং । সেটা হলো, সনাতন ধর্ম বিশ্বাস করে, সেটা কিন্তু হিন্দু ধর্ম না...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
বৃক্ষপূজা করে, এমনকি...শুয়র...এই শুয়র কিন্তু সুকীর সাথে কথা বলে...এই জন্যই মামুনভাই যেটা বলছিলেন যে, মান্দাইদের সাথে পশুদের, প্রাণীদের কিন্তু চমৎকার একটা রিলেশন আছে...যেটা আমাদের সাথে নেই।
 
হাসান শাহরিয়ার
তা হলে, ঐ যে মাস্টার বানরকে বললো, ফরেস্টারের কাপড় চোপড় দিয়ে দিতে...এবং বানর কিন্তু সে কথা শুনলো। এটাও কি এই সম্পর্কের কারণেই?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, বাঁদর বুঝেছে।

কামালউদ্দিন কবির
আচ্ছা বাচ্চুভাই, সেটের প্রপস হিসেবে এমন কিছু আসতে পারতো কিনা...যেমন...আমার বাড়ি সুন্দরবন অঞ্চলে...তো সেখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই তাদের শিকার করা বাঘের চামড়া কিংবা হরিণের শিং ঝুলতে থাকে। আবার ধরুন মোরগের পালক দেখলেই আমরা বুঝি যে, আদি অষ্ট্রেলিয়ান কিংবা এ ধরনের...তো এরকম কোনো উপাদান মান্দাইদের মধ্যে কোনোভাবে দেখানো যেতো কিনা?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
না, থাকলেও হারিয়ে গেছে বহু আগে। ছিল হয়তো...আমাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। আরেকটা কথা হলো আমি ‘রেডি রেফারেন্স’ ব্যবহার করতে চাই নি। একটাই করেছি...সেটাতেও এখন আমার আপত্তি আছে, সেটা হচ্ছে যেখানে ওরা দরা বানায়, মদ...সেখানে হাঁড়ি পাতিল ব্যবহার করেছি। ওরাও হাঁড়ি পাতিলেই করে...রঙটঙ করে নেয়...মানে ওরা এটার ব্যাপারে খুব ফরমাল, কারণ, মদটা কিন্তু পার্ট অব রিচ্যুয়াল...আমার মনে হয়েছে রেডি রেফারেন্সগুলো থিয়েটার থেকে...যেহেতু আমি অ্যায়োয়ে ফ্রম দ্য রিয়ালিটি থাকতে চেয়েছি, এটা থেকে যতটুকু থাকা যায়। এ জন্যই এ নাটকে প্রপস ব্যবহার প্রায় করিই নি।

হাসান শাহরিয়ার
বৃক্ষগুলো কিন্তু মানুষ দিয়ে করা হয়েছে। সেটা কি বৃক্ষের সাথে, প্রাণীর সাথে, তাদের ঘনিষ্ঠতা বোঝাবার জন্য?

কামালউদ্দিন কবির
আমার কাছে এটা বেশ ভালো লেগেছে যে, মানুষই বৃক্ষ...এই নাটকে মানুষ ও বৃক্ষের সম্পর্কটা ধরা হয়েছে...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে, কেন নয় যে, একজন অভিনেতা শুধু সংলাপ উচ্চারণই করবে কেন? স্টেজের একটা প্রপস হিসেবেও সে ব্যবহৃত হতে পারে।

খালেদ খান
মাধব মালঞ্চি কন্যার মধ্যেও কিন্তু মানুষ গাছ হয়েছে।

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হয়েছে, না? আমার ঠিক মনে পড়ছে না।

হাসান শাহরিয়ার
হ্যাঁ, আপ স্টেজে মাধব না কার যেন গতি বোঝাবার জন্য উল্টোগতিতে বৃক্ষগুলো ছুটে যেতো।

কামালউদ্দিন কবির
মঞ্চে একবার হারমোনিয়াম নিয়ে আসা হয় এবং হারমোনিয়ামে গান গাওয়া হয় এবং তানপুরাও থাকে। তো...এগুলো কি মান্দাইরা ব্যবহার করে?

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
তানপুরাটা মান্দাইরা ব্যবহার করে না কিন্তু হারমোনিয়ামটা করে।

কামালউদ্দিন কবির
তাই! আমার জানা ছিল না, এবং এজন্য খটকা লাগছিল...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হারমোনিয়াম ব্যবহার করে...আমাদের অনেক কিছু ওদের মধ্যে ঢুকে গেছে। আর তানপুরাটা ব্যবহার করেছি আসলে সুর ধরে রাখার জন্য, স্কেলটা ধরে রাখার জন্য। কিছু কিছু টেকনিক্যাল ব্যাপারতো থাকেই...যেমন আমরা যদি আমাদের খোল ব্যবহার না করে মান্দাইদের খোল...হ্যাঁ, মান্দাইদের আলাদা খোল আছে...যদি ব্যবহার করতে পারতাম, তবে ভালো হতো...সেলিম আল দীন বারবার ইনসিস্ট করছিল...কিন্তু এটি আমাদের বানিয়ে আনা সম্ভব হয় নি।
 
খালেদ খান
আমার কাছে একটা জায়গায়, বাচ্চুভাই...যদিও খুব ব্রিলিয়েন্ট হয়েছে তবুও মনে হয়েছে যে, পিউর মালকোষ ব্যবহার না করে...আমাদের ফোক-এর মধ্যেও অনেক রকমের ব্যাপার আছে...সঙ্গীতে...সেখানে থেকে যদি...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
শিমূল মালকোষের উপর বড় একটা গলা সেধেছিল...মালকোষ রাগে একটা আলাপ আছে ওর...সেইটা কোনো ফোকের থেকে, যেকোনো একটা রাগ বের করা যেত কিনা...এটাইতো প্রশ্ন?...হ্যাঁ, আমার মনে হয় সেটা করা যেত। কিন্তু হচ্ছে কী, শিমূল যখন রিহার্সেল-এ একা একা ঐ রাগটা প্র্যাক্টিস করছিল...নাটকের জন্য না, এমনি এমনি...তখন শোনার পর ঐটাকে আর কান থেকে সরাতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, এই সংলাপের সাথে মালকোষটাই ভালো যাবে।

খালেদ খান
এটা কিন্তু সত্য যে, ঐ মুহূর্তে শুনতে খুব ভালো লেগেছে...কিন্তু পুরো নাটকটার সাথে ঠিক...মানে, যায় নি...মানে, আলাদা মনে হয়েছে। আরেকটা কথা...অভিনেতা-অভিনেত্রীদের খুব পরিপাটি মনে হয়েছে।...কিন্তু রিয়ালিটির কথা বাদ দিয়ে বলি...পাহাড়ি জাতিতো...মানে আরেকটু সয়েল রঙ করা গেলে...

নাসির উদ্দিন ইউসুফ
এটা কিন্তু ইচ্ছাকৃত।...মানে স্টাইলাইজেশন-এর প্রতি আমার ঝোঁক একটু বেশিতো...সব সময় ‘নিট অ্যান্ড পলিশ’ জায়গায় যেতে হবে, এমন একটা ভাব আমার ভেতরে কাজ করে।...তো সেটা করতে গিয়েই...দর্শক হোঁচট খায়, কেন এত পরিপাটি...আমি সবার পোশাক নিয়েই ভেবেছি...যেমন ফরেস্ট-এর পোশাক নিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছে...প্রথমে দিয়েছিলাম একটা চাদর, পরে দেখি চাদরটা ঠিক যায় না...খালি গা মনে হয়। পরে ওটাকে শার্ট বানিয়ে দিলাম, গলা বন্ধ একটা শার্ট। একটু রেফারেন্স রাখার জন্য খাঁকি রঙ, ঐ যে, পুলিশের রঙ...মানে সরকারি ব্যাপারটা দেখানোর জন্য। সেক্ষেত্রে যুবরাজ যেটা বলছে যে, সব জায়গায় বোঝালাম না কেন? হ্যাঁ, এসব জায়গায় আমার কিছুটা ঘাটতি আছে, নাটকটা দেখতে দেখতে আমারও সেটা মনে হয়েছে।...হ্যাঁ, সবাইকে আরেকটু কীভাবে মাটির কাছে আনা যেতো...

হাসান শাহরিয়ার
আমরা অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা করলাম। আবার অনেক বিষয়েরই বেশ একটা গভীরে যেতে পারলাম না সময় স্বল্পতার কারণে। ভবিষ্যতে যদি সময় করা যায় তো আবার আমরা বসবো।...এখন আমি মামুনভাই, খালেদভাই এবং কবিরকে অনুরোধ করবো পর্যায়ক্রমিকভাবে বনপাংশুল সম্বন্ধে আপনাদের শেষ মূল্যায়নটুকু বলবার জন্য।

মামুনুর রশীদ
আমি বলবো, মঞ্চ নাটকের যে সঙ্কট আজ চলছে, এই সঙ্কটকালে...বনপাংশুল নাটকটা খুবই প্রেরণা সৃষ্টি করেছে। আমি মনে করি এটা একটা মহৎ উদ্যোগ, আর ‘ঢাকা থিয়েটারে’র যে নাট্যভাবনাটা...প্রত্যেক দলেরই একটা নাট্যভাবনা আছে...সেই ভাবনাটাও প্রসারিত হোক, এটা চাই। এবং ইতোমধ্যে ভাবনার ক্ষেত্রে আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে, পশ্চিমবঙ্গে, কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। সেটাও খুবই পজেটিভ দিক। বনপাংশুল নির্দেশনার ব্যাপারে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে।...খুবই শ্রম সাধ্য কাজ। সন্দেহ নেই। বিশেষ করে মিউজিকের লেভেলে...খুবই শ্রম সাধ্য। তো আমি আশা করবো ‘ঢাকা থিয়েটার’ ভবিষ্যতে আরো ভালো কাজ করে আমাদের নাটককে সমৃদ্ধ করবে। সবাইকে ধন্যবাদ।

খালেদ খান
আমারও একই কথা, বহুকাল পরে...আমি বাচ্চুভাইকে আগেও বলেছি, আমাদের আবার একটা স্বপ্নের জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। গত কয়েকটা বছর আমাদের খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল। নতুন নাটক হয়েছে কিন্তু সেই নাটক এভাবে আলোড়িত করতে পারে নি। এটার একটা কারণ হয়তো-বা এরকম যে, বাচ্চুভাই একটা নতুন সেট অব পিপল নিয়ে এরকম একটা বড় কাজ করলেন...এটা আমাকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছে। এবং আমি মনে করি আমরা যারা বনপাংশুল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি, আমাদের কাজেও এর একটা রিফ্লেকশন পড়বে। এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ কাজ আমরা করবো।

কামালউদ্দিন কবির
আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল...আমাদের নিজস্ব নাট্যরীতি-অভিনয়রীতি এবং সর্বোপরি নাটক রচনাশৈলীর যে অণে¦ষা...শেষ পর্যন্ত মীমাংসায় নেয়া গেল কিনা, অবশ্য আমার এই বিশেষ আগ্রহের কারণে হয়তো বাইরের অন্যান্য বোঝাপড়াটা একটু কম বুঝে ফেলেছি...এটা আমার সীমাবদ্ধতা অবশ্যই। তবু জোর বিশ্বাসের সঙ্গেই বলবো...স্বতন্ত্র জাতিসংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের নাট্যভাবনা ও চর্চাতে অবশ্যই স্বকীয় ধারণা ও শৈলী থাকা প্রয়োজন, আর তা এই বর্ণনাভিনয় বা বর্ণনাত্মক নাট্যাভিনয় কিংবা তত্ত্বের আকারে দ্বৈতদ্বৈতাবাদী শিল্পÑযা-ই বলি না কেন, এসবের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠত করা সম্ভব। তবে বনপাংশুল প্রযোজনা সম্পর্কে যা বলতে চাই...বিশেষ করে চাকা, যৈবতী কন্যার মন প্রযোজনা সাপেক্ষে মনে হয়েছে, কেনো জানি, এই বনপাংশুলে পূর্বের চেয়ে বর্ণনাভিনয়ের ওই স্বকীয় ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করে সংলাপ প্রাধান্য বা গতানুগতিকতার দিকেই সরে আসা হয়েছে। অবশ্য এ মূল্যায়নই চূড়ান্ত নয়। বোধকরি শিল্প প্রসঙ্গে কোনো মূল্যায়নই চূড়ান্ত হবার নয়।

হাসান শাহরিয়ার
অনেক্ষণ ধরে আপনারা ‘থিয়েটারওয়ালা’ এবং এর পাঠকদের জন্য সময় দিলেন, এজন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আর ‘থিয়েটারওয়ালা’ চায় কোনো নাট্যসমালোচনা এমনই প্রাণবন্ত হোক, আলোচনাই যেন হয়ে ওঠে সমালোচনা। সবাইকে আবারও ধন্যবাদ।