Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: আরজ চরিতামৃত
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: আরজ চরিতামৃত। রচনা: মাসুম রেজা। নির্দেশনা: তারিক আনাম খান। মঞ্চ ও আলোকপরিকল্পনা: পঙ্কজ নিনাদ। পোশাকপরিকল্পনা: তানভীর হাসান। আবহসংগীতপরিকল্পনা: ফজলুল কবির তুহিন। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০০০। একটি ‘নাট্যকেন্দ্র’ প্রযোজনা
[আরজ চরিতামৃত নাটক নিয়ে নাট্যসমালোচনার আয়োজন করেছিল নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’। নাটকটির রচয়িতা মাসুম রেজা ও নির্দেশক তারিক আনাম খানসহ আলোচনায় আরো ছিলেন মামুনুর রশীদ, আলী যাকের ও সারা যাকের। নাট্যালোচনায় সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ‘থিয়েটারওয়ালা’-সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ৭ম সংখ্যায় (২০০০ এ প্রকাশিত) অনুলিখন করে এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
হাসান শাহরিয়ার
‘থিয়েটারওয়ালা’র পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে শুভেচ্ছা দিয়ে শুরু করছি। আমরা সরাসরি আলোচনায় ঢুকে যাই। প্রথমেই আমি তারিকভাইকে দিয়ে শুরু করছি। ওনার কথার ভেতর থেকে প্রাসঙ্গিকভাবেই আমার মনে হয় যে, আলোচকবৃন্দ তাঁদের আলোচনার সূত্র ধরতে পারবেন। তারিকভাই আপনি এখানে দুটো জায়গায় আছেন, নাট্যদলটির অর্থাৎ ‘নাট্যকেন্দ্রে’র প্রধানব্যক্তি এবং সেই নাট্যদলের আজকের আলোচনার বিষয় যে নাটকটা...আরজ চরিতামৃত...তার নির্দেশকও আপনি। তাই আমি আপনাকে প্রথমেই একটু খেই ধরিয়ে দিতে বলবো যে, আপনার দল এই সময়ে এসে, এই নাটকটা কেন মঞ্চে আনলো এবং কী কারণে আপনি সেটার নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করলেন?
তারিক আনাম খান
এটা কিন্তু আসলে বিশাল ইতিহাস বলতে হবে। তবু আমি সংক্ষেপেই বলছি। আমাদের ইয়ে ছিল যে আমরা একটু...মানে খোলাদৃষ্টিটা নিয়ে বিভিন্ন দিকে তাকাবো। ওয়েস্টার্ন, ইস্টার্ন, অরিজিনাল, এইগুলোতে না গিয়ে নাটকটা করতে ভাল্লাগে...নিজেদের ইন্সপায়ার করে, এধরনের কাজ করবো। সেখানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যবিচার, কোনটা মৌলিক, কোনটা মৌলিক না...ব্যক্তিগতভাবে আমি সেটা খুব বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না এই ভেবে যে, যখন একটা নাটক হাতে আসে, তখন সেটার যে ইন্টারপ্রেটেশন, সেটা আসলে মৌলিকতা পেয়ে যায়। এর আগে আমরা যে নাটকগুলো করেছি, বিচ্ছু, তুঘলক, সুখ, জেরা, হয় বদন, ক্রুসিবল...আমরা একটা প্রযোজনা বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে যেতে চেয়েছি। বিচ্ছু সাকসেস হওয়ার পর ওটা বক্স অফিসে হিট করলো...‘বক্স অফিস’ কথাটা যতই খারাপ শোনাক না কেন, আমাদের এই পর্যন্ত, এমনকি বর্তমান নাটক করতেও আমাদের কারো কাছে দৌঁড়াতে হয় নি টাকা পয়সার জন্য, ঐ বিচ্ছুর কারণেই। তো আরজ চরিতামৃত, যেটা মাসুম লিখেছে... ইচ্ছা ছিল যে...দেশে লেখেন যারা, তাদের নাটক যদি আমাদের ইন্সপায়ার করে সেটা করা যেতে পারে।...পরবর্তীসময়ে একদিন বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় কে যেন বললো মাসুম একটা ক্রিপ্ট লিখেছে, আরজ চরিতামৃত। তো আরজ আলীর চরিত্র সম্পর্কে আমি খুব বেশি কিছু জানতাম না। নাটকটি যখন মাসুম পড়লো...মনে হলো যে বিশাল একটা ক্যানভাস আছে। এই জিনিসটা কী করা যেতে পারে? তাছাড়া দর্শকগ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারটাও মাথায় ছিল। সেই প্রসঙ্গে বলতে গেলে যতগুলো শো’ হয়েছে, আমার মনে হয় এই ধারণাটি ভুল। আসলে দর্শকগ্রহণযোগ্যতা অন্য জিনিস। দর্শকগ্রহণযোগ্যতার বিভিন্ন স্তর আছে, সেটা পরবর্তীসময়ে আমি আলোচনার ক্ষেত্রে বলবো। তো এই নাটকটা করবো কী করবো না...এই রকম একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলাম। এরমধ্যে নাটকটা আমি কয়েকবার পড়ে ফেললাম। তারপর আরও কিছু...আরজ আলীর উপর খ- খ-, টুকরো টুকরো অংশ খুঁজতে শুরু করলাম। জানার চেষ্টা করলাম। তারপর দলের মধ্যে পড়লাম নাটকটা। পড়ার পর...বেশ আলাপ-আলোচনা হলো, ডিবেট হলো। দেখা গেল দলের মূল যে চাহিদা অর্থাৎ নাটকটা কীভাবে দাঁড় করাতে হবে, সেটা আসলে নির্দেশকের দায়িত্বে পড়ে যায়। সেটা যদ্দুর পেরেছি করেছি আর পরে আলোচনাতে সে ব্যাপারে বলা যাবে। মোট কথা, প্রতিক্রিয়ার কথা বলছিলাম যে, হয়তো অনেকের মনে হতে পারে, কমেডি করলেই বোধহয় দর্শক খুশি হয়, আসলে তা না, আসলে ভালো নাটক ভালোভাবে করলে আমার মনে হয় দর্শক গ্রহণ করে এবং যে নাটকে মানুষ এখানকার জনজীবন...মানুষকে দেখতে পায়, সে নাটকের এক ধরনের...কী বলা যায়...মানে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। এটা আমার বিশেষ অভিজ্ঞতা। আপাতত এটুকুই আমার বলা। পরে প্রসঙ্গ ধরে কিছু বলা যাবে।
হাসান শাহরিয়ার
যাকেরভাই...এই যে একটা কথা এসেছে, সেটা হচ্ছে...নাটকের বিষয়গত ব্যাপারে...আমাদের থিয়েটার গ্রুপগুলোতে একটা ইয়ে আছে যে...আগে দর্শকের কথা চিন্তা করে...দর্শক যেন ভেবেই বসে আছে যে, আমাকে ঐ ধরনের নাটক করতে হবে বা...সে ঐ ধরনের জিনিস চায়...ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই সময়ে এসে...আমার মনে হয়...বিচ্ছুর পর তো ‘নাট্যকেন্দ্র’ তুঘলক করেছে। ভালো ভালো প্রযোজনা করেছে। যদিও অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছু বেশ সফল ছিল। কিন্তু এই যে আরজ আলীর মতো একটা বিষয় অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশের সক্রেটিস বা এই ভূ-খণ্ডের সক্রেটিস...এভাবেই যদি দেখি, তাহলে দেখা যায় যে, আসলে বিষয় যদি আমি দিতে পারি এবং আমার উপস্থাপনরীতিতে যদি মননশীল, নান্দনিক কিছু দিতে পারি...দর্শককে...তাহলে কিন্তু দর্শক সেটা গ্রহণ করে। এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু অনেক নাট্যদলই ওটাকে একধরনের রিস্ক মনে করে। এই ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন যে, এই ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচ্যনাটকেরবেলায় সফলতা এসেছে? সেভাবে উপস্থাপন এসেছে?...নাকি মনে হচ্ছে সেই রিস্ক রয়েই গেলে যে, দর্শক নিবে কী নিবে না?
আলী যাকের
আরজ আলী মঞ্চে এল...এখনও বলা মুশকিল, মানে...শেষপর্যন্ত দর্শক নেবে কিনা। আমি কথাটা এ কারণে বলছি...আমি আশা করি যে, নাটকটির একশ’ দেড়শ’ প্রদর্শনী হোক। প্রথমে আমি দর্শককে একটু বিশ্লেষণ করি...আমার মনে হয় একেবারে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে কয়েক রকম নাটকেরদর্শক আছে। একটা নাটকের দর্শক হচ্ছে যে...কমেডি-নির্ভর নাটকের দর্শক। মানে তারা আসলে নাটকের ডেডিকেটেডদর্শক নয়। তারা আনন্দ পেতে আসে। এর মধ্যে আবার একটা অংশ আছে, যারা তাদের পরিচিত প্রিয় স্টার যারা আছে, তাদেরকে রক্তমাংসে দেখতে আসে মঞ্চে। আরেক ধরনের দর্শক আছে, যারা নাটকের ডেডিকেটেড-দর্শক। নাটকের ডেডিকেটেডদর্শকের মধ্যেও কিন্তু আবার দুই রকম দর্শক আছে। একটা হচ্ছে স্যোশাল ডেডিকেশন নিয়ে থিয়েটার দেখতে আসে। আরেকটা আসে ভালো নাটক দেখতে। স্যোশাল ডেডিকেশন নিয়ে যারা আসে, তারা বেছে বেছে নাটক দেখতে আসে না। নাটক ভালো হতে পারে, খারাপ নাটকও হতে পারে।...ব্যক্তিগতভাবে যদি বলতে হয়...আমার নিজস্ব ধারণা, আমি ভ্যালু জাজমেন্ট দিয়ে ফেলি যে ক্রুসিবল হচ্ছে আমার গত পাঁচ বছরে দেখা শ্রেষ্ঠ তিনটি নাটকের মধ্যে একটি। অথচ ক্রুসিবলের একসেপটেন্সটা সেভাবে হয় নি। এর কারণ একেবারে হার্ড কোর ডেডিকেটেড নাটকেরদর্শক যারা, তারা ক্রুসিবল দেখতে এসেছে। কিন্তু যারা টেলিভিশনে দেখলাম আনন্দ পেলাম, স্টার দেখলাম আনন্দ পেলাম, নাটকে একটু যাওয়া...কোক খেলাম। সে ধরনের দর্শককে ক্রুসিবলে দেখা যায় নি। কাজেই ’ও (তারিক আনাম) যে কথাটি বলছিল সেটাও ঠিক, সামাজিকভাবে রেলিভেন্ট হলে নাটকটা দর্শক আরও বেশি হারে নেয়। তো আমি যদি এটাকে শ্রেণি বিভেদ করি যে...বিচ্ছু বা দেওয়ান গাজীর কিস্সা অথবা ইবলিশ, এই ধরনের নাটকের একটা দর্শক আছে...সেটা হচ্ছে গিয়ে যারা ঘুরে বেড়ায় সবসময়, বেইলি রোডে আসে যায়...টেলিভিশনও দেখে, তাদের কাছে এধরনের নাটক প্রিয় হয়। আবার সেটা স্যোশালি রেলিভেন্ট হলে ব্যাপ্তিটা একটু বেড়ে গেল। আর যখনি গভীর-গম্ভীর নাটকের কথায় আমরা আসি, যে নাটক খুবই হৃদয়স্পর্শূ কিন্তু সকলের জন্য না, সেটা একেবারেই ডেডিকেটেড দর্শকের জন্য। তবে বিটুইন বিচ্ছু এবং ক্রুসিবল আমি আরজ চরিতামৃত-কে ফেলতে চাই। এই হচ্ছে আমার বক্তব্য।
হাসান শাহরিয়ার
মামুনভাই...
মামুনুর রশীদ
আমার কাছে যেটা মনে হয় যে, ’ও (আলী যাকের) খুব সুন্দরভাবেই এটা ব্যাখ্যা করেছে। বিচ্ছু এবং ক্রুসিবলের মাঝখানে আমাদের আলোচ্য নাটকটার অবস্থান। ওর ব্যাখ্যাটা আমার কাছে ভালো লাগলো এই কারণে যে, তোমার (তারিক আনাম) প্রথমের কথাতে মনে হয়েছে...মানে...তুমি একটা নাটকের মার্কেটিংটাও ভাবছো...অ্যাজ আ ডিরেক্টর এটা ভাবা উচিত, হয়ত প্র্যাক্টিক্যাল ডিরেক্টর তুমি, তোমার হয়তো ভাবা উচিত। কিন্তু আরজ আলীর ক্ষেত্রে এই ভাবনাটা আমার কাছে সঠিক মনে হয় না। আরজ আলী তুমি করবে, হোয়াই? যে প্রশ্নটা হাসান শাহরিয়ার প্রথমেই করেছে। সেটার উত্তর অবশ্য এখনও হয় নি। আমরা হয়ত পরের আলোচনায় এর উত্তর পাবো। আমার স্নেহভাজন নাট্যকার...গত বিশ বছর ধরে দেখছি স্নেহের সাথে...তার হয়েই বলতে চাই...আরজ আলী করাটা আমি...মানে...এই নাটকগুলো লেখার একটা যেমন ঝুঁকি আছে, প্রযোজনারও তেমনি একটা ঝুঁকি আছে। কারণ, আরজ আলী কিন্তু নট ওনলি আ পারসন, সে কিন্তু একজন ফিলোসফার এবং সেই ফিলোসফির কিন্তু সে-ই উদ্যোক্তা না। তার মতো বহু নাস্তিক...সারা পৃথিবীব্যাপী...‘প্রশ্ন’ করেছে। সক্রেটিস ‘প্রশ্ন’ করেছে...তারপর তোমার ধরো যে, ডঃ আহমদ শরীফ...তিনিও তার দেহটাকে একইভাবে দান করে গেলেন। একটা নাস্তিক হিসেবে, মুরতাদ হিসেবে সারাজীবন তিনি লড়াই করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো যে, আরজ আলী এদের চাইতে আলাদা কোন দিক দিয়ে? একটা প্রকৃতি বিজ্ঞানী বলো তাকে...তাকে একটা ফিলোসফার বলো...কিংবা ঐ নাস্তিক্যবাদ দর্শনের একজন লোক বলো...এবং তিনি বেড়ে উঠেছেন একদম গ্রামে, একটা আমিনের কাজ করতো সেই লোকটা। তার যে জিনিসটা নাটকে অনুপস্থিত...সেটা হলো যে, আতাউরভাই প্রথমদিন নাটক দেখার পর আমাকে ফোন করেন, ফোন করে বললেন যে...বেশ ভালো নাটক। তারপর উনি যে কথাটা বললেন যে, আরজ আলীকে আমার খুব একসেপশনাল মানুষ মনে হয় নি। এখন কথা হলো, যে প্রশ্নগুলো উনি (আরজ আলী) করেছেন, এই প্রশ্নগুলো সব মানুষের মধ্যেই থাকতে পারে। আল্লাহ্ আছে কী নাই, অমুকটা আছে কী নাই...কিন্তু আরজ আলী কিছু সিরিয়াস প্রশ্ন করেছেন। এবং তার প্রশ্নগুলোর মধ্যেই তার জবাবগুলো নিহিত আছে। যেমন ধরো শিংগা...ইসরাফিলের শিংগা...এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারপর দোযখ সম্পর্কে প্রচুর প্রশ্ন তুলেছেন, কাঁধের উপর যে ফেরেস্তা থাকে...অসংখ্য প্রশ্ন তিনি করেছেন। এবং প্রশ্নগুলো আমরা যদি পাঠক হিসেবে রাত্রিবেলা চিন্তা করি...আমাদের ভয় করবে...কী করে একজন মানুষ এই প্রশ্নগুলো করতে পারলো।
আলী যাকের
আমি নাম করবো না, আমাদের মঞ্চেরই একজন খুব জনপ্রিয় অভিনেত্রী আমার কাছ থেকে বই তিনটা (আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র) ধার করেছিল...
মাসুম রেজা
নাটক দেখার পর?
আলী যাকের
না, দেখার আগে, অনেক আগে...পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ছয়মাস হয়ে গেল...বইগুলো পড়া শেষ হয়েছে? সে বললো না বইগুলো পড়া শুরু করলেই ভয় লাগে।
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, এই ভয়টা লাগবেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো যে তাপস সেনকে (পশ্চিম বঙ্গের থিয়েটার লাইট ডিজাইনার) আমি এক সেট বই দিয়েছি।...পরেরদিন ভোরবেলা ওদের সাড়ে পাঁচটার সময় কলকাতায় ফোন করলাম...উনি বললেন যে, সেকেন্ড পার্ট পড়ে, থার্ড পার্ট পড়ে সারারাত ঘুমাতে পারি নি।...তাপস সেন তো মনে করো সায়েন্সের লোক, ফিজিক্স-এর লোক, লাইট করেন এবং অনেক ধরনের বই তিনি পড়েছেনও। তার কাছে আরজ আলীকে এরকম মনে হলো কেন? এটা একটা ভয়াবহ প্রশ্ন। আরজ আলীকে মঞ্চে আনা...এবং যে আরজ আলীকে অনেক জীবিত লোক দেখেছে...এটা কিন্তু একটা রিস্কি কাজ করেছো...এবং এই দেশে...
তারিক আনাম খান
ফিলোসফিটা কিন্তু আমাদের এখানে একদম সেভাবে আনি নি...এটাকে নিয়ে ভাবার সময়ও জানতাম যে, দর্শনটা একদম নতুন হয়তো না। কিন্তু আপনি (মামুনুর রশীদ) এক্সাক্টলি বলেছেন এবং এটা নিয়ে শেষে আমরা এগুলাম যে, সেটা হলো ‘প্রশ্ন করা’। দ্যাটস মোর ইম্পর্টেন্ট। এমনকি নাটকের ক্ষেত্রেও যেটা কমে গেছে আজকাল, অনেকে...মানুষজন এখানে অনেক কিছু দেখে...ডিরেক্টর-অ্যাক্টর চ্যালেঞ্জটা খুব কম হয় এখানে। আমি কোনটা করবো? কেন করবো? এই কথা কেউ বলে না...নির্দেশক কোন শাড়ি পড়তে বলেছেন, কেন বলেছেন...এসব নিয়ে তর্ক করা, প্রশ্ন করা আজকাল বন্ধ হয়ে গেছে। যার জন্য বললাম যে, ‘প্রশ্ন করা’ এই ব্যাপারটা খুব আকর্ষণ করেছিল আমাকে।
মামুনুর রশীদ
তুমি বোধহয় আরও অনেক সুবিচার করতে পারতে...যদি, এই যে আরজ আলী...ফিলোসফি বলো, প্রশ্ন বলো, এইগুলোর জন্য...এই কথাটার জন্য, যেগুলো এসে যায় যে নাটকটি চলবে কিনা...অমুকটা হবে কিনা...এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে...
তারিক আনাম খান
মামুনভাই...
সারা যাকের
না-না শেষ করে নিক, আমরা শুনে নিই...
মামুনুর রশীদ
এখানে কিন্তু একটা ডেসপারেট ডিরেক্টরশিপ দরকার। সেটা কিন্তু নাটকটায় আমি কম দেখিছি। তুমি একটা কিছু বলতে চাচ্ছো, আবার ফিরে আসো। তুমি প্রশ্ন করে ফেলেছো...এমন অনেক সিচ্যুয়েশন আছে যে, একটা সিরিয়াস জায়গায় যাচ্ছো, কিন্তু আর যাওয়া হলো না।
মাসুম রেজা
এ নিয়ে এগুনোর আগে আমি একটু বলে নিই...
হাসান শাহরিয়ার
বলুন বলুন...
মাসুম রেজা
দুটো বিষয় এসে গেছে। বিচ্ছু ও ক্রুসিবল-এর মাঝামাঝির ব্যাপারটা। মানে আমি কিন্তু যখন নাটকটা লিখতে শুরু করলাম, আইয়ুব হোসেনের বইটা নিয়ে দুই তিন পাতার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এই নাটকটি লিখব। যখন বিচ্ছু, কঞ্জুস...মলিয়ের এবং আরও দুয়েকটি নাটক এভাবে দর্শক টানছে...আমি খুবই চিন্তার ভিতর ছিলাম। আমি খুবই চিন্তায় ছিলাম যে...আসলে নাট্যকার হিসেবে আমার কোনো ভবিষ্যৎ নেই...ভবিষ্যৎ নেই একদমই শিওর ছিলাম। কিন্তু নাট্যকার হিসেবে আমার একটা দায়িত্ববোধ মনে হলো যে, আরজকে মঞ্চে আনা উচিত।
তখন আমার মাথায় একটা জিনিস এল যে, দর্শক বিচ্ছু এবং কঞ্জুস দেখবে আবার আরজ আলীও দেখবে। এটা করা সম্ভব কিনা...তখন আমি...আমার অনেক বিষয় ছিল যেগুলো তারিকভাই রাখেন নাই (হেসে), ফেলে দিয়েছেন...তারপরও যে বিষয়গুলো আছে, বিশেষ করে হাফ টাইমের পরে...ঐ তেজটা থাকে আরকি, যার ফলে হয়তো দেখা গেল...একটা মাঝামাঝি জায়গায় নাটকটা দাঁড়িয়ে গেল। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, আমার মনে হয় যে, যে জায়গাগুলোর কথা আপনি (মামুনুর রশীদ) বলছেন যে আরও আনা যেত...নাটকের স্ক্রিপ্টের ভিতর অনেক ছিল, তারিকভাইও অনেক আনার চেষ্টা করেছেন...কিন্তু সমস্যা হচ্ছে...কিছুদিন আগের একটা ঘটনা...টাঙ্গাইলে...সবাই জানেন যে, আরজ আলীর বইটা পড়ার কারণে একজনকে মাথা মুড়ে ঘোল ঢেলে...আপনি (মামুনুর রশীদ) এটার সাথে জড়িতও ছিলেন।
আলী যাকের
মামুন ছিল মানে! ও কি ঘোল ঢালার মধ্যে ছিল! (হাসি)
মাসুম রেজা
না- না- না-
মামুনুর রশীদ
(হাসি) না, এটা প্রতিরোধ করার জন্য গ্রামে গিয়েছিলাম...
মাসুম রেজা
যাকেরভাই, সেই ব্যক্তিকে কিন্তু গ্রাম ছাড়তে হয়েছে...অনেক লেখালেখি হয়েছে। কেবল বইটা পড়েছে বলে তার এ অবস্থা। এখন এই কথা মঞ্চে বললে তারিকভাইয়ের কী হতে পারতো, আমার কী হতে পারতো...এটা কিন্তু বিরাট রিস্ক। আর একটা বিষয়, মানে সবচাইতে বড় বিষয়, যেটা হচ্ছে সত্যাসত্যবাদ। একসাথে তিনটা সত্য কোনোদিন সত্য হতে পারে না। এককালে একই বিষয়ে এক সত্যই সত্য, আরজ আলীর মূলদর্শন এই সত্যাসত্যবাদ, এই মূলদর্শনটাকে তারিকভাই আনতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি।
হাসান শাহরিয়ার
টেক্সটতো আমরা দেখছি না, আমরা মঞ্চটা দেখছি...এখানে যদি বলা হয় যে, আমার স্ক্রিপ্টে আরও অনেক কিছু ছিল...তখন কিন্তু আমরা সেটা মানবো না। কারণ...পাঠক সমাবেশের বইটা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি না...আমরা আলোচনা করছি ‘নাট্যকেন্দ্রে’র প্রযোজনা নিয়ে। যাক, এখন আমি সারা আপাকে বলছি যে...মামুনভাই একটা কথা তুলেছেন...আরজকে যেভাবে আমরা জানি, একটা বই পড়ে বা আরজ যা-যা...এই নাটক দেখার পর, আরজকে আরও জানার কোনো আগ্রহ তৈরি হয় কিনা। নাটকটি দেখার পর তৃষ্ণা জাগে কিনা, এ লোকটা কে...এর সম্পর্কে আরও বই আছে কিনা, আরও কিছু আছে কিনা, আরও জানতে হবে...এবং এই লোকটার উচ্চতায় যাওয়া যায় কিনা? এমন কিছু মনে হয়েছে?
সারা যাকের
আমি যখন আরজ চরিতামৃত দেখি, তার ঠিক আগে আগে এক মাসের ব্যবধানে আমার একটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সমাবেশে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। আমি একটা নাটকের নির্দেশনা দিচ্ছিলাম, সেখানে আমি একটি পাকিস্তানি গ্রুপের সাথে কাজ করেছি। তারপরেই জার্মানিতে একটি কনফারেন্সে গিয়েছিলাম...‘উইমেন টুমোরো’ এরকম একটা বিষয় নিয়ে এই কনফারেন্স হয়েছিল। আমরা অনেক দেশের লোকই ওখানে ছিলাম, তারমধ্যে ইরান থেকে নাটকের মেয়েরা এসেছিল...মেয়েদেরই কনফারেন্স ছিল ওটা, ঐ কনফারেন্সে গিয়ে, পাকিস্তানের সাথে নাটক করতে গিয়ে আমি নিজেকে সবসময় সৌভাগ্যবান মনে করেছি যে, আমরা বাংলাদেশিরা...বাংলাদেশেও ৮৫% ভাগ মানুষ মুসলমান, তারপরেও আমরা পাশাপাশি নাটক করছি, সংস্কৃতিচর্চা করছি এবং আমরা ঠিক ঐ খপ্পরে পড়ি নি, ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিজমের উপর পড়ি নি, আমরা বেঁচে আছি কারণ, আমরা আরজ চরিতামৃত ধরনের নাটক করছি, সংস্কৃতিচর্চা করছি। তারপরও মাথার মধ্যে ছিল যে...আসলে আমাদের দেশটাওতো কিছুটা মৌলবাদীদের খপ্পরে যাচ্ছে এবং কত রকম ঘোল ঢালা, মাথান্যাড়া করে দেয়া, এরকম মানুষও আছে...রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরুলে দেখি যে কত মানুষের মাথায় টুপি, কত মেয়ের মাথায় ঘোমটা...তারপরও যে আমরা নাটক করছি, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এটা একটা বিরাট বিষয়। নাচ হচ্ছে...মঞ্চে নাচ হচ্ছে, টেলিভিশনে হচ্ছে...ইসলামিক দেশে আজকাল চিন্তাই করা যায় না। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল পারসপেক্টিভে যখন চিন্তা করি তখন...আজকে মানতে হবে যে, আরজ আলীকে নিয়ে নাটক করা...বিরাট একটা...মানে আমি নিজের দেশ সম্পর্কে খুব গর্ববোধ করছি এবং আমার খুব ভালো লেগেছে যে, আজকে এত মানুষ মুসলমান, ইসলামিক একটা দেশ...মৌলবাদ আছে, সিলেটের মতো ঘটনাও ঘটেছে...এরকম একটা দেশে এরকম আরজ চরিতামৃত-এর মতো একটা নাটক মঞ্চে করা বিরাট সাফল্য। বই আকারে লেখা আর মঞ্চে করার মধ্যে বিরাট তফাৎ আছে...বই আকারে লিখলে কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আরজ আলী আমি মঞ্চে করছি, সেটা আমার কাছে বিরাট একটা বিষয়।
এবং আমার আরেকটা সৌভাগ্য হয়েছিল যে, আমি আমার মেয়ে...১৫ বছরের, তাকে আমি পাশে নিয়ে নাটকটা দেখছিলাম। তো আমি আমার এই বয়সে কীভাবে বিচার করবো, আর একটা তরুণ কীভাবে বিচার করবে...আমি সবসময় যদি আমার বয়সে দাঁড়িয়ে আমার পারসপেক্টিভে বিচার করি তাহলে হবে না। ’৭১ এর যুদ্ধ দেখেছি, আমি মঞ্চে এসেছি...সেই সময়টা উপযোগী ছিল মঞ্চে আসার, এখন কিন্তু আমরা প্রত্যেকে চিন্তার দিক থেকে, ভাবনার দিক থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। সেই অবস্থায় আমার মেয়েকে নিয়ে আমি নাটকটা দেখছিলাম এবং...যেখানে তরুণরা ব্যান্ড সংগীতের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে আমি কোন নাটকটা দেখবো এবং সেটার মধ্যে কী উপাদানটা আছে, যেটা শুধু আমাকে টানবে না...আমার মেয়েকেও টানবে...আমি সেই পারসপেক্টিভে এই নাটকটাকে বিচার করেছি। আমি মনে করি যথেষ্ট ম্যাচ্যুরিটি নিয়ে এবং একাধারে সমাজের সব শ্রেণির এবং সব বয়সের মানুষকে উদ্দেশ করে নাটকটা প্রযোজিত হয়েছে। এই জন্য আমার কাছে ভালো লেগেছে। সিম্বলটা কী?...জ্ঞান...একটা বই ছিল সারাক্ষণ মঞ্চে। বইয়ের উপর আলোটা ছিল সবসময়, আর খোঁজ, খোঁজ...সন্ধান করো। ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং ছিল, আমার কোনো সময় মনে হয় নি যে অনুসন্ধানটা ছিল না। সত্যের প্রতি, সত্যকে খোঁজ...কিসের মাধ্যমে খোঁজ? বইয়ের মাধ্যমে খোঁজ। আমার কাছে কোথাও অস্পষ্টতা ছিল না যে আমি কী বলতে চাইছি। এটা আমি বলবো যে, লেখার গুণ এবং একইসাথে নির্দেশনার গুণ এবং আমি খুব অবাক হয়েছি যে, যারা আমাদের দেশের ইন্টেলেকচ্যুয়াল, তারা এটাকে নানা-রকমভাবে দেখে...এটাকে খ-াতে চেয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছেÑকেন? আমার বাবা নিজে সারাক্ষণ...আমার দাদা পর্যন্ত প্রশ্ন করেছেন। তো ঈশ্বর কে প্রশ্ন করাটা আমার কাছে বিরাট বিষয় না। আমি দেখেছি যে, এই লোকটার পিছনে কী ছিল...একটা গ্রামের লোক ছিল, তার মা কে ছিল, তার বউ কে ছিল...ইট ইজ ভেরি ইম্পর্টেন্ট...এগুলো সব এসেছে এ নাটকে। এটা অনেকে বলেছে যে, সে ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দিয়েছে সেটা না এসে, অমুক...তার মায়ের বিষয়...ইত্যাদি বেশি এসেছে।...অবকোর্স একটা মানুষ চেনা যায় সে কীভাবে বড় হয়েছে তা দেখে। আর আরজ আলীর ফিলোসফি আসে নি, এটাও আমি একমত নই। কারণ, ফিলোসফি কীভাবে আসবে...ভীষণ কঠিন ভাষায় আসবে? ভীষণ কঠিন একটা বাহ্যিক অভিনয়ে আসবে?...আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি, সবকিছু মিলিয়েই নাটক এবং সবদিক থেকে এই সময়ের উপযোগী নাটক এবং এটা আমি বিচ্ছুর সাথে তুলনা করি না কারণ বিচ্ছুর মধ্যে অনেক ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং আছে, অনেক কমেডি আছে, এটাতো কমেডি ছিল না।
তারিক আনাম খান
নাটক শুরুর সময়...মানে মহড়া শুরুর সময় আরজ আলীর ফিলোসফি নিয়ে কথা হয়েছে, সবকিছু নিয়েই...মানে...এমন কী...আরজ চরিতামৃত এই নামটা নিয়েও আমরা দ্বিধায় ছিলাম...আরজের চরিত্র অমৃতসমান...সে রকম কিছু একটা মহামানব...নিশ্চয় স্বীকার করবো ইনি খুব...মানে...আমি বারবার আমার ডিরেকশনের সময় বলেছি, আরজ একজন মানুষ। যে মানুষটা তার সমস্ত আগ্রহ নিয়ে নিজেকে বড় করেছে। একেবারে মাটি থেকে এসেছে...সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যে লোকটি মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছে। যেমন আমরা এই মুর্হূতে...আজকের দিনেও মেনে নিচ্ছি, এটা বলা যাবে না, সেটা বলা যাবে না...আরজের যে কন্টেম্পরারি জিনিসগুলো ছিল...তাঁর কিন্তু ইজিলি কম্প্রমাইজ করার কথা ছিল। অনেকে আমরা করি। আমাদের জীবন-ব্যবস্থার সাথে আমরা করেছি। সেই জন্য আমি কোনোভাবেই...তাকে মহামানব হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই নি। একটি মানুষ, যে সমস্ত কিছু থেকে নিজের সংগ্রামটা বড় করে দেখেছে এবং সে যখন মারা গেছে তখন কিন্তু তার লাশ কী হবে, ডেড বডি নিতে কত টাকা খরচ হবে, সেটুকু পর্যন্ত লিখে গেছে। লাইব্রেরির কথা বলেছে...সে কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলে নি। সে বইয়ের মধ্যে বলেছে...আমার ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন আছে। স্ট্রেইট ফিলোসফি যে, মনকীর নকির এসে যদি প্রশ্ন করে, সওয়াল করে সাজা দিবে কেন, যদি আল্লাহতালা সাজা না দিয়ে থাকে? ইট ইজ আ কোশ্চেন, ইট ইজ নট সল্যুশান। যদি হয় তাহলে হিন্দু মারা গেল, তার দেহ পুড়িয়ে ভস্ম করে দেওয়া হলো, তার গোর আজাবটা কী করে হবে? তারতো দেহই নেই। ইসলামিক চিন্তাবিদরা হয়ত চিন্তা করলে একটা উত্তর বের করতে পারবে কিন্তু আমাদের কাছে মূল হচ্ছে যে, আস্ক কোশ্চেন...আশপাশে যা ঘটছে, সেগুলো ঠিক ঘটছে কিনা...সে সমস্ত আমরা মেনে নিচ্ছি কিনা ইত্যাদি। এটা কিন্তু একটা মানুষকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে তৈরি করেছে। আর একটা কথা ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং-এর কথা যেটা বলা হলো...
হাসান শাহরিয়ার
তারিকভাই, আমরা অ্যাক্টিং, মিউজিক...এগুলো একটু পরে আনছি। মামুনভাই কী যেন বলতে চাচ্ছিলেন...
মামুনুর রশীদ
আমার একটা প্রশ্ন এসে গেল...তুমি (তারিক আনাম) কি বলতে চাও যে আরজ আলী ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন? তোমার নাটকেও কিন্তু এই কথাটি এসে যাচ্ছে...সে বলছে...আরজ আলী সম্পর্কে যখন স্ট্রেইট কোশ্চেন করা হয়, তখন সে বলছে যে, আমি প্রশ্ন করতে চাই।
তারিক আনাম খান
ও নিজে বলেছে কিন্তু...
মামুনুর রশীদ
ও যে ফিলোসফি ব্যাখ্যা করেছে...ওর নিজের কিন্তু ব্যাখ্যা আছে...আগের যারা ফিলোসফার তাদের সম্পর্কে নোটস আছে এবং যদি সে নাস্তিক না হয়, সে যদি ধর্মেই বিশ্বাস করত, তাহলে সে কি ধর্ম পালন করেছেন সারাজীবন? এটা এক নম্বর প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো যে, কোনো ধর্মবিশ্বাসী তার দেহ এভাবে দান করে দিয়ে যেতে পারে মেডিক্যাল কলেজে?
তারিক আনাম খান
এটার পিছনে তাঁর ইমোশন ছিল। তাঁর মায়ের...
মামুনুর রশীদ
ইমোশনতো আছেই...মাকে দাফন করে নি, করতে দেয় নি। ঠিক আছে...
তারিক আনাম খান
মামুনভাই, সে কিন্তু বলেছে, আমার মা দোষ করে নি অথচ তাকে দাফন করা হয় নি। সে বলেছে, দোষটা আমার, ছবি তুলেছি আমি। সাজা আমার হবে...আমার মায়ের জানাজা কেন হবে না, মায়ের দাফন কেন হবে না?
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, সেটাতো আমাদের জানাই তাই না ? আমি আরও পরের প্রসঙ্গে যেতে চাই সেটা হলো...
তারিক আনাম খান
সেই কারণেই...বইয়ের মধ্যেও আছে...যেটা হলো...সে বলেছে যে, আমার মায়ের দাফন হয় নি বলে আমার দাফন হবে কী হবে না, এই কনট্রাডিকশনের মধ্যে যেতে চাই না। পরিবারের ভেতরে যখন এটা নিয়ে ডিসকাশন হলো, সবাই কান্নাকাটি শুরু করে দিলো, আপনার দেহ কবরে যাবে না, এটা কী কথা হয়! আবার, মায়ের জন্য যখন কবর খুড়লো সে, লোকদের দিয়ে, তারপর যখন কবরের নিচটা বাঁধাতে গেছে তখন কিন্তু গ্রামে বিরোধিতা এসেছে...মোল্লারা বললো কবরের নিচটা আপনি বাঁধাতে পারবেন না...মাটি থাকবে...কারণ মাটি খুঁড়ে নাকি সেখানে ফেরেস্তারা আসবে। আরজ আলী বলছে যে, না বাঁধাবো...আমি বাঁধাবো। রাজমিস্ত্রীর কাজ সে নিজে করেছে। বলেছে যে, ফেরেস্তা যদি শক্তিশালী হয়...যদি আল্লাহ পাক থেকে আসে, সে তা ভেঙ্গে চলে আসবে...
মামুনুর রশীদ
তুমি যদি সংশয়বাদী করো...
মাসুম রেজা
সংশয়বাদী না মামুনভাই...আমার কাছে আরজ আলীকে যেটা মনে হয়েছে...আরজ আলীর এটাই হচ্ছে বড় কৌশল...সে প্রশ্নগুলোকে দাঁড় করিয়েছে...এটা হিন্দু মতে...এটা বিজ্ঞান মতে...এটা ইসলাম মতে...এটা খ্রিস্টান মতে, আউট অব দিজ কোনটা সঠিক, কোনটা আমার মানা উচিতÑসেটা যেন আমি ঠিক করি। এই যে কৌশলটা সে নিয়েছে এবং সে কখনো...আমি কিন্তু কোনো বইতে...কোনো জায়গায়তেই পাবো না যে, সে নাস্তিক ছিল এবং কোনো জায়গাতে পাবো না যে সে আস্তিক ছিল। আমরাই তার ব্যাপারে সংশয়বাদী হয়ে পড়বো কিন্তু কোনো বইয়ের কোনো অংশ থেকে বা তার কোনো ভাষ্যের অংশ থেকে প্রমাণ করতে পারবো নাÑসে নাস্তিক কিংবা আস্তিক।
মামুনুর রশীদ
তাহলে সে কী ছিল?
মাসুম রেজা
এটাই হচ্ছে যে...আমাদের সবচেয়ে অমীমাংসিত...
মামুনুর রশীদ
তুমি যদি এটাকে থিয়েট্রিক্যালি ইন্টারেস্টিং মনে করো, যদি মনে করো যে আরজ আলী আস্তিকও না, আবার নাস্তিকও না...সেক্ষেত্রে কিন্তু অন্য কথা। নাটকতো আর বিজ্ঞান না, নাটক ইতিহাসও না। ধরো গ্যালিলিও। গ্যালিলিওকে নিয়ে লেখা হয়েছে....গ্যালিলিও কী করলো? গ্যালিালিও আত্মসমর্পণ করলো, আপোষ করলো। কিন্তু তারপর ব্রেখট দেখাচ্ছে যে, এই অপোষটার ফলে বিজ্ঞান একটা...মানে...ডিসকোর্স বইটা পার পেয়ে গেল। সেটা তার ব্যাপার, তার স্ট্র্যাটেজি। তারপরও তো গ্যালিলিও ছোট হলো না। তার যে বিজ্ঞানের...
হাসান শাহরিয়ার
যেটা আবার সক্রেটিসের বেলায় উল্টো ছিল। সক্রেটিস মৃত্যুকে মেনে নিলো...সে বললো যে, আমি চলে গেলে এ পৃথিবীর কিছুই আসবে যাবে না, কিন্তু সত্যের মৃত্যু হলে পৃথিবীর ক্ষতি হয়ে যাবে।
সারা যাকের
আরজ আলীর কিন্তু এ রকম কোনো থিয়োরি ছিল না...সে তো সাধারণ মানুষের বিশ্বাসগুলোকে প্রশ্ন করেছে শুধু।
মাসুম রেজা
এটা একটা ব্যাপার যে, কবরটা কেন তৈরি করলো? সে যদি পরিপূর্ণভাবে নাস্তিক হতো তাহলে কিন্তু তার কবরটা তৈরির দরকার ছিল না। এটা কিন্তু আরজ আলীর ব্যাপারে একেবারে অমীমাংসিত প্রশ্ন।
তারিক আনাম খান
লামচরি গ্রামে কিন্তু তার একজন বন্ধু এখনো জীবিত আছেন। ৮০ বা ৮৫ বছর বয়স। সে বলেছে যে, সে জুম্মার নামাজে আসতো।
মামুনুর রশীদ
জুম্মার নামাজ পড়েছে?
তারিক আনাম খান
নামাজ পড়তো না। জুম্মাতে আসতো, কারণ ওটা একটা জমায়েত, ওখানে গেলে অনেক লোকের সাথে কথার আদান-প্রদান হয়। তারপর ধর্ম-টর্ম করার ব্যাপারে বলেছে যে...আল্লাহর কাজ হচ্ছে আমাকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে দেওয়া, আমার কাজ করার দায়িত্ব আমার। আমি আমার মতো কাজ করে যাচ্ছি।
মামুনুর রশীদ
একটা নাট্যকারের সাথে একটা বিজ্ঞানীর সম্পর্ক কিন্তু স্থাপিত হতে হয়। গ্যালিলিও’র বহু পরে শেক্সপীয়র রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নাটক লিখলেন। রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট-এ একটা সংলাপ আছে...রোমিও জুলিয়েটকে বলছে, ‘তুমি হচ্ছো আমার সূর্য, আর আমি হচ্ছি তোমার পৃথিবী, তোমাকে কেন্দ্র করে আমি ঘুরছি’। এখন প্রশ্নটা হলো, আমি যেটাকে রিস্ক বলছি...আরজ আলীর এই যে টেক্সট লেখা আছে...দু-একজন তাকে নিয়ে উপন্যাস লিখছে...হাসনাত আবদুল হাই লিখছে, এখন আরজ আলীকে নিয়ে গবেষণা হতে পারে। হবে না? আমরা যেমন করছি, আরও কোনো গবেষক আসবে। সেই গবেষণায় যদি প্রমাণিত হয় আরজ আলী নাস্তিক ছিল...তুমি কিন্তু তাকে নাস্তিক বানও নি, তাই না?...নাটকে কিন্তু অনেক চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্যালিলিও যেটা ঐ সময় করতে পারলেন না, শেক্সপীয়র কিন্তু সংলাপ দিয়ে...‘সূর্যের চারিদিকে ঘুরছি’ তত্ত্বটাকে পার করে দিলেন। নাট্যকারের এই ভূমিকাটা কিন্তু আছে। এটা কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। দিস ইজ ভেরি ইম্পর্টেন্ট।
সারা যাকের
নাট্যকারের ভূমিকা হিসেবে অবশেষে আরজ আলী মহামানব-রূপে প্রতিষ্ঠা পেল না? নাটকে আরজ আলী কি অবশেষে সাধারণ মানুষ হিসেবে এসেছে? নাকি বিরাট মানুষ হিসেবে এসেছে? আমি মনে করি আরজ আলীর ছোট ছোট ঘটনা...আমার কাছে মনে হয় যে, এ ধরনের ছোট ছোট প্রশ্ন...উত্তরসন্ধান...উত্তর সন্ধান করে করে অবশেষে একটা মহামানবকে আমরা পেয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে।
মামুনুর রশীদ
মহামানবতো তিনি বটেই। মহামানব না হলে...
আলী যাকের
ব্যাপারটা হচ্ছে...যিনি সত্য খোঁজেন, প্রতিনিয়ত, তিনিতো মহামানবই হবেন।
মামুনুর রশীদ
কিন্তু মজার ব্যাপার যে, আমার মনে হয়...তারিকও আমার সাথে একমত হবে...‘নাট্যকেন্দ্র’ কিন্তু ঐ ধরনের এপিকের মতো মহামানবটাকে করতে চায় নি।
তারিক আনাম খান
এটা অবশ্য করতে চাই নি, একদম ঠিক ধরেছেন...কিন্তু কী হয়...যাকে নিয়ে নাটক হতে পারে...তার মধ্যে যদি কিছু না থাকে নিশ্চয়ই নাটকটা হয় না। নাস্তিক আস্তিকের প্রসঙ্গটা যদি আনি তাহলে দেখবো যে প্রত্যেক মানুষই বিশিষ্ট হয়েছেন নিজের সময়কে প্রশ্ন করে করে। যেমন, মোহাম্মদ (সঃ), তিনি কিন্তু তাঁর সময়ের সবকিছু মেনে নেন নি...তখন তো মূর্তি পূজা চালু, মেয়েদেরকে মেরে ফেলা, বেশি মেয়ে সন্তান হলে মেরে ফেলা...এগুলো চালু-ব্যাপার ছিল। তিনি কিন্তু প্রশ্ন করে করে ভেবেছেন যে, না এটা ঠিক না। তারপর এক আল্লাহর থিয়োরি এসেছে। তো সে হিসেবেই...আমি জানি না, ভবিষ্যতে আরজ আলী নাস্তিক হবে কী আস্তিক হবে। আমি ঠিক এভাবে কোনো প্ল্যান করে...
মামুনুর রশীদ
তোমার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে থিয়েট্রিক্যালি ইন্টারেস্টিং বলেই এটা এনেছো?
তারিক আনাম খান
অবকোর্স।
মামুনুর রশীদ
আরজ আলীর চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলো...যে শুধু প্রশ্ন করে, যে মতামত দেয় না, শুধুই প্রশ্ন করে...কিন্তু যে লোকটা এত বড় বড়...বড় বড় মিনস এত গভীর প্রশ্ন করতে পারে...
আলী যাকের
এবং প্রত্যেকটা প্রশ্নই ইঙ্গিতবাহী...
তারিক আনাম খান
ধর্ম নিয়েই না কিন্তু। সব কিছু নিয়েই...
আলী যাকের
আমার একটি বক্তব্য আছে, নাটকটি দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে, নাটকটি পেরিফেরাল...মানে পেরিফেরি নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে...আরজ আলীর ভেতরে বা আরজ আলীর দর্শনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টাটা খুব বেশি ছিল না। পেরিফেরাল কেন মনে হয়েছে...দুটো কারণে...একটা হচ্ছে, নাটকে মা থাকবে না, ওটা হতে পারে না।...আরজ আলীর প্রত্যেকটা প্রশ্নই কিন্তু একটা দিকনির্দেশ দিয়েছে, একটা ইঙ্গিত দিয়েছে। সেই ইঙ্গিতটা নিয়ে কাজ করতে পারতো নাট্যকার। আমরা সেটা না করে দেখেছি যে, আরজ আলীর মাকে নিয়ে ইমোশন, আরজ আলীর একটা বক্তব্যকে নিয়ে অনেক বেশি সিম্বলের ব্যবহার করা হয়েছে, যেটাকে পেরিফেরাল অ্যাক্টিং হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। আমার মনে হয় এভাবে অনেক কালক্ষেপণ হয়েছে।
তারিক আনাম খান
কোনো উদাহরণ...মানে আমার বোঝার সুবিধার জন্য।
আলী যাকের
এ মুহূর্তে...ঠিক আছে বলছি...আজকে যখন আমি গাড়িতে আসছিলাম, তখন এ কথাটা আমার মনে হচ্ছিল...যদি আমাকে কেউ প্রশ্ন করে, আচ্ছা নাটকটার কোন জায়গাটা আপনার কী লাগলো? উত্তরে কিন্তু আমি কিছু বলতে পারবো না। কেন বলতে পারবো না? কারণ, নাটকটা আমার মধ্যে কোনো ইমপ্রেশন তৈরি করে নি...ইন দ্যাট সেন্স কোনো ইমপ্রেশন তৈরি করে নি। অথচ ঢাকার মঞ্চের অন্তত ১৫/২০টা নাটক সম্বন্ধে আমি বলে দিতে পারবো...আমাদের দলের নাটক না, অন্যদের করা, যে, এটা এই লেগেছে, ওটা ঐ লেগেছে। সামগ্রিকভাবে আমার কাছে খুব একটা...মানে আমার ভেতরে...যেরকম সারাকে সাংঘাতিকভাবে টাচ করেছে, আমাকে সেভাবে টাচ করে নি।
মামুনুর রশীদ
না করতেই পরে...
আলী যাকের
সেটাই আমি বলতে চাচ্ছি। এটা কেন টাচ করে নি? আমি অনেক ভেবেছি...উত্তরও পেয়েছি, আমার মনে হয়েছে যে পেরিফেরাল ব্যাপারটা বেশি থাকাতে...ভেতরটা, নির্যাসটা কম থাকাতে এই জিনিসটা ঘটেছে।
হাসান শাহরিয়ার
তারিক আনামভাই বলছিলেন, নাটকটা প্রায় চার ঘণ্টার ছিল, কেটে ছোট করা হয়েছে। তো কোন দেড় ঘণ্টা কাটার প্রয়োজন, বাদ দেয়া প্রয়োজন, সেখানে কোনো ভুল ছিল?
আলী যাকের
আমি জানি না ভুল ছিল কী খারাপ ছিল, নাট্যকার বলতে পারবে। আমি একদমই কিন্তু... মানে আমি বলতে চাচ্ছি না আরজ আলীর নিজস্ব লেখায় কী ছিল, আমি বলতে চাচ্ছি না নাট্যকার কী লিখেছিল, পরিচালক কী বাদ দিয়েছে...আমি যা দেখেছি সেটার উপর আলোচনা রাখতে চাচ্ছি।
মাসুম রেজা
কোন জায়গার কথা বলছেন...মানে কোনো উদাহরণ দেয়া যাবে কি?
মামুনুর রশীদ
আমি বলছি। কয়েকটা জায়গায়...ঐ যে...গ্রামে যে প্রস্রব করতে গেল এক ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অথবা তার যে বন্ধু, প্রফেসার, কী যেন নাম?
তারিক আনাম খান
কাজী গোলাম কাদের।
মামুনুর রশীদ
কাজী গোলাম কাদের...ওনার কিন্তু একটা বড় ধরনের ভূমিকা আছে আরজ আলীর জীবনে, বিরাট একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু দেখা গেল যে, এদের ভূমিকাগুলো খুব মুখ্য হয়ে দাঁড়ালো না, মানে খুব দানা বাঁধলো না। আমরা এন্টারটেইনমেন্ট পেলাম। ওদের পারফরমেন্সে আমরা এন্টারটেইনমেন্ট পেলাম কিন্তু এগুলো যেন কন্ট্রিবিউট করলো না। তুমি দেখ...ছেলেটি বিভিন্ন স্ট্রাগল করেছে...যেমন, আরজ আলীর কথা মনে হলেই, আমার সবসময় মনে পড়ে স্বরূপকাঠির পীরের বাড়িতে যে আসলো, লেখাপড়া করার জন্য এবং ওখানে বলে দেয়া হলো যে, তোমার বাবার পারমিশন নিয়ে আসো। তারপর আরজ আলীর যে জার্নি...যখন সে ওখান থেকে ফিরে আসছে...অনাহারে, অভাবে, বাধ্য হয়ে। সেখানে তার যে একটা রিট্রিট করতে হচ্ছে...এই যে একটা স্ট্রাগল...এই ধরনের একটা স্ট্রাগল কিন্তু আমরা নাটকে অনুপস্থিত পেয়েছি...
তারিক আনাম খান
আরজ নিজেই এই ফিরে যাওয়াটাকে পজেটিভ বলে গেছেন। উনি বলেছেন যে, আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি হতে হয় নি...সেটা আমার কপাল, নতুবা যদি আমি মাদ্রাসায় ভর্তি হতাম তাহলে কিন্তু এই প্রশ্নগুলো করা হতো না। দ্যাটস হোয়াই আমি ওটাকে...
মামুনুর রশীদ
তোমার কাছে ইম্পর্টেন্ট মনে হয় নি, ফাইন, ঠিক আছে। আবার আমার কাছে ঐ জার্নিটা...কিশোর বয়সতো...ঐ জার্নিটা আমার কাছে খুব স্ট্রাগলিং লেগেছে। এটাও তো সে জ্ঞানের অন্বেষণেই গেছে। সে চেয়েছিল লেখাপড়া শিখবে, জ্ঞানের অন্বেষণ করবে...তাই না?
আলী যাকের
আমি বলছিলাম যে পেরিফেরাল ব্যাপারটার কথা...সব কিছুই কেমন যেন...মানে বাইরে বাইরে যাচ্ছে...ভেতরে আর ঢোকা হচ্ছে না।
হাসান শাহরিয়ার
কী যেন আসবে আসবে করছিল, কিন্তু শেষমেশ একটা ঘটনা এসেছে, আর কিছু না, এমন কি?
আলী যাকের
হ্যাঁ, অনেকটা তাই।
হাসান শাহরিয়ার
মাসুমভাই এ ব্যাপারে বলুন।
মাসুম রেজা
আমি ব্যক্তিগতভাবে যেটা মনে করি...আরজ আলীর ফিলোসফি, স্ট্রাগল...এগুলোকে মঞ্চে আনার জন্য যে রিস্কটা নিতে হতো, ঠিক এই মুহূর্তে সেই রিস্কটা তারিকভাই নেন নি। নেন নি অন্য কারণে যে, আরজ অ্যাজ আ ক্যারেক্টার...এই রকম একটা মানুষ, তাকে ইনট্রুডিউস করিয়ে দেয়া উচিত ছিল...এই দায়িত্বটুকু তারিকভাই নিয়েছেন। তার ফিলোসফিক্যাল লাইফ, স্ট্রাগলÑসেটা নিয়ে আলাদা নাটক হতে পারে।
আলী যাকের
তাহলে আমাদের ধরে নিতে হচ্ছে যে, বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে...বাংলাদেশের সামাজিক-জীবনব্যবস্থা এখানে যেমন, তাতে করে উই ক্যান গো দিস ফার অ্যান্ড নো ফারদার...এটা মাথায় রেখেই নাটকটা করেছো? আচ্ছা, তাহলে আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, ইফ আই ক্যান গো দিস ফার অ্যান্ড নো ফারদার, তাহলে আরজ আলীর প্রতি কি আমরা সুবিচার করতে পারি? অথবা আরজ আলীকে নিয়ে নাটক করাটা কি পূর্ণতা পায়? ফিলোসফার হিসেবে না, তাঁর যদি আত্মজীবনী পড়েও আমরা দেখি, সেখানে ১৮০টা প্রশ্ন আছে...তার মধ্যে যদি তিনটা ডিল করি...
মাসুম রেজা
ফিলোসফির কথা যখন আসছে, যাকেরভাই, আমি একটু বলি...আরজ আলীর সমস্ত প্রশ্ন থেকে একটি বের হয়ে আসে, তা হলো সত্যাসত্যবাদ। এই সত্যাসত্যবাদকে প্রমাণ করতে যদি আমি ১৮০টা অতি সংবেদনশীল প্রশ্ন নিয়ে আসি এবং এতে যদি আজকে মুরদাত ঘোষিত হই বা আজকে মঞ্চে মারামারি...এই জাতীয় একটা ঝামেলায় পড়ি, তখন তো আরজ আলীকে প্রকাশ করা...আরজ আলীকে আনা...মানে মানুষের সামনে তুলে ধরাকে রিস্কি মনে করেছি।
মামুনুর রশীদ
এটা খুব প্র্যাক্টিক্যাল চিন্তা করেছো তোমরা, এটাও সত্যি কথা। তাহলে কথা হলো, আমি আরজ আলী করবো কেন? যদি আমি ঐ ঝুঁকিটুকু না নিতে পারি, তাহলে আরজ আলীকে নিয়ে নাটক কেন?
মাসুম রেজা
আরজ আলীকে পরিচিত করছি। আমি তো দেখেছি অনেকগুলো বই বিক্রি হয়। পাঠক সমাবেশ ব্যবস্থা করেছে...ওখানে বই রাখে...এই নাটকটা দেখে অনেকে বইগুলো কিনছে।
মামুনুর রশীদ
সেটা যদি হয় ভালো...কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমার কাছে মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে যে, তোমরা যেতে চাচ্ছো একটা জায়গায়...আবার এসকেইপ করে যাচ্ছো...
হাসান শাহরিয়ার
সারা আপা কিন্তু কথা শুরু করেছিলেন...আপনার কাছে গর্বের মনে হয়েছে যে, নাটকটা মৌলবাদবিরোধী, এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে নাটকটা করা হয়েছে যা কিনা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বিরাট সাফল্য মনে হয়েছে। কিন্তু মাসুমভাই বললেন যে তারা মৌলবাদ বা সংবেদনশীল জায়গাগুলো এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন...
আলী যাকের
শাহরিয়ার আমি একটু বলি। আরজ আলীর আসল যে চিত্র...যে জন্য আরজ আলী আজকের এই আরজ আলী, যাঁকে নিয়ে নাটক করা যায়...সেই আরজ আলী কিন্তু...মানে আমার কাছে মনে হয়েছে, ঐভাবে উঠে আসে নি।
হাসান শাহরিয়ার
এ পর্যায়ে আমরা মনে হয় প্রযোজনায় ঢুকে যাই। কনটেন্ট নিয়ে অনেক কথা হলো। পরে প্রাসঙ্গিক হলে আবার আসা যাবে।
মামুনুর রশীদ
সেটাই ভালো...ফিলোসফি নিয়ে কথা শেষ হবে না। আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে যে তোমার (তারিক আনাম) প্লে ডিজাইনটা আমার কাছে খারাপ লাগে নি। এরকম একটা হাই সাবজেক্ট...যেটা মানুষের মাথার মধ্যে একেবারে চিন্তা ছাড়া আর কিছু দেয়ার কথা না, এরকম একটা সাবজেক্ট নিয়ে...খুব সুন্দর একটা স্মুথ ল্যান্ডিং করলা...একটু এন্টারটেইনমেন্ট থাকলো, মাঝখানে অনেকগুলো দৃশ্যও আছে যেগুলো হাসির উদ্রেক করে, মাঝে মাঝে হাসি পায়...আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে...অনেকের কাছেই ভালো লেগেছে...যাকেরের ১৫ বছরের মেয়ের কাছেও এই জায়গাগুলো ভালো লেগেছে...
আলী যাকের
আমি একটু বলি...
মামুনুর রশীদ
আমি দোস্ত শেষ করে নিই। তারপর তোর যত খুশি বলিস হাঃ হাঃ। প্রযোজনাটার যেটা নাকি আমার কাছে মনে হয়েছে...তোমার কাছে (তারিক আনাম) আমি আরও স্ট্রং কোরিওগ্রাফি আশা করেছিলাম। গানের অংশটা আরও স্ট্রং হতে পারতো...মানে তুমিতো প্রফেশনাল কাজ করো, তোমার কাছে আমার এক্সপেক্টেশন থেকেই বলছি। কিছুদিন আগে তোমার ক্রুসিবল দেখেছি। সব কিছু মিলিয়ে ক্রুসিবল এবং আরজ চরিতামৃত...প্রোডাকশনের অনুপাতে যদি আমরা আজকে ভাবি তাহলে কিন্তু...ক্রুসিবলের ঐ একসেলেন্সটা এখানে নেই...হতে পারে, তুমি একহাজার রকমের একসেলেন্স করতে পারো। আর তোমার যে গানটা, খোঁজ খোঁজ, এটা আমার কাছে স্থূল মনে হয়েছে...সুরটাও...আমি তোমার কাছে আরও অনেক অনেক বেটার সুর এবং লিরিক আশা করেছিলাম। এবার তুই (আলী যাকের) ’ক দোস্ত।
আলী যাকের
তোর শেষ?
মামুনুর রশীদ
আপাতত...হাঃ হাঃ।
আলী যাকের
আমি কিছু ফিলোসফিক্যাল কথাবার্তা বলবো। আমার বক্তব্য হচ্ছে...আমি ক্রুসিবল সম্পর্কে সূচনায় যে কথাগুলো বলেছি সেগুলো যদি সত্য হয়, তাহলে আমি আরজ চরিতামৃত থেকে সেই মাপের কাজ পাই নি।
হাসান শাহরিয়ার
সেই মাপের প্রোডাকশন ডিজাইন পান নি? নাকি অন্য কিছু?
আলী যাকের
প্রোডাকশন ডিজাইন থেকে আরম্ভ করে স্ক্রিপ্ট পর্যন্ত এবং ডেপ্লয়মেন্ট অব ফিজিক্যাল এবং কোরিওগ্রাফি আমি সেই মাপের পাই নি। দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হচ্ছে, এটা নিয়ে হাসতে পারো তোমরা...আমার কাছে আরজ আলী চরিত্রে তারিকের মতো ‘পাহাড়’ (হাঃ হাঃ) দরকার ছিল বলে মনে হয়। যদি নাটকটা মঞ্চের উপরে হতো (মেঝেতে না হয়ে, প্রসেনিয়ামে) আর তারিক যদি নিজেই আরজ আলী করত, তাহলে কি সেই গ্র্যান্ড ব্যাপারটা পেতাম না? আমার ধারণা আরজ আলী বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ডিজারভস ফার মোর গ্র্যান্ডি।
মামুনুর রশীদ
না দোস্ত...আমার কিন্তু ঐ ছেলেটির অভিনয় ভালো লেগেছে। আরজ আলীর ক্যারেক্টারের প্রতি সুবিচার করা হয়েছে।
আলী যাকের
ছেলেটির অভিনয় কিন্তু আমারও ভালো লেগেছে। কিন্তু ধরো ওথেলো চরিত্র, তারিক আনাম করেছে...তখন ওথেলো করা ছেলেটিকে দেখে আমি...মানে সেই মানের দেহ, অভিনয়...
মামুনুর রশীদ
সেটা তুই যদি আরজ আলী বানাস তাইলে তুই আরজ হইস হাঃ হাঃ।
আলী যাকের
হাঃ হাঃ, না না...আমার বক্তব্য হচ্ছে আরজ আলী যে মাপের মানুষ, সে মানুষটা ডিজারভস মোর কালারফুল এক্সপোজ।
মাসুম রেজা
তাহলে কিন্তু...রিপ্রেজেন্টেশন হয়ে যাচ্ছে যে, যেহেতু বড় মাপের মানুষ, ফিজিক্যালি তাকে আমি মঞ্চে বড় করে নিয়ে আসছি।
তারিক আনাম খান
প্রসঙ্গ যেটা উঠে এসেছে সেটার জবাব দিয়ে নিই...তাহলে বোধহয় ভালো হয়...সেটা হলো যে, আমি প্রোডাকশনটা...যারা থিয়েটারে নতুন এসেছে, তাদের রিস্ক নেয়ার ব্যাপারটা শেখানোর চেষ্টা করেছি। এই জন্য যে, যতক্ষণ অডিয়েন্স ফেইস না করি ততক্ষণ পর্যন্ত এক্সপেরিয়েন্সটা...ঠিক, হয়ে ওঠে না...আমি ভেবেছিলাম যে, এই রিস্কটা নতুনকর্মীদের দিয়ে নিতে। এবং এ কারণেই এই প্রযোজনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছি। আজকে থিয়েটারে যেটা অনুভব করছি সেটা হচ্ছে যে, পরবর্তীপ্রজন্মের ক্ষেত্রে, চ্যালেঞ্জিং লোকজন কমই এগিয়ে আসছে। আমি প্রথমে প্রোডাকশন ডিজাইন করেছিলাম প্রসেনিয়ামে করার জন্য। জানি প্রসেনিয়ামেই কিন্তু অনেক কাজ করা যেত, প্রসেনিয়ামকে ভেবেই এগিয়েছিলাম। কিন্তু পরে আমার কাছে মনে হয়েছে, নাটকটা ইন্টেমেসি ডিমান্ড করে। যার ফলেই আমরা রাউন্ড কনসেপ্ট-এ ইয়ে করেছি...প্রেজেন্ট করেছি। কোরিওগ্রাফির ব্যাপারে মামুনভাই যে বললেন, সেটার ব্যাপারে বলি যে...আমি চেয়েছি ওরা নিজেরা ভুলগুলো বুঝে অডিয়েন্স ফেইস করুক। যখন দেখবে হচ্ছে না, তখন নিজেদের এক ধরনের লজ্জাবোধ থাকবে। গানটাও কিন্তু আমি নিজে বেশি...মানে...কিউটা বিশ্লেষণ করেছি যে, এটা হওয়া উচিত...এখন তোমরা ভাবো।
আলী যাকের
আমি একটা বাক্য ব্যবহার করেছিলাম। আমি ঐ দিন ’শো দেখার পর সারার সাথে কথা বলতে বলতে বলছিলাম যে, অনেকটা ‘ওয়ার্কশপ প্রোডাকশন’ করেছে।
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, প্রথম দিকে অবশ্য মনে হয়...
তারিক আনাম খান
হোয়াট ইজ দ্য ডিফারেন্স বিটুইন ওয়ার্কশপ প্রোডাকশন অ্যান্ড প্রোডাকশন?
আলী যাকের
ডিফারেন্স ইজ দ্যাট...আমি জানি যে সীমিতক্ষমতা দিয়ে নাটকটা হচ্ছে এবং আমি ঐভাবেই করবো।
সারা যাকের
আমার সাথে ‘নাট্যকেন্দ্র’র একটি ছেলে কাজ করে...’ও বিভিন্ন সময়ে আমার সাথে কথা প্রসঙ্গে নাটকটার কথা বলেছে, ফলে আমি জানতাম যে, যারা নতুন...তাদেরকে নিয়ে নাটকটা হচ্ছে। হয়তো এর জন্য আমি ভেবেছিলাম যে...একদম নতুন যারা, তারা নাটক করছে...সেই হিসেবেই হয়তো আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। কারণ আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, কিছু কিছু ঘাটতি ছিল, থাকতেই পারে। আমি মামুনভাইয়ের সাথে একমত যে...অভিনয়ে ভালো এক্সপ্রেশন আসছে মেয়েটার মুখে...একেবারে তৈরি অভিনেত্রী...কিন্তু কোথায় যেন কনফিডেন্সটা নেই, জোরে কথা বলার কনফিডেন্স...এই রকম ছোট খাটো ব্যাপার...
আলী যাকের
ব্যাপারটা হচ্ছে...আজকে আলোচনা করছি নাটকটাকে নিয়ে, সেজন্য কথাটা বলি যে...তুই (তারিক আনাম) যে বললি কোরিওগ্রাফির ভঙ্গি ওদের মতো করে করতে, গানও ওদের মতো করে করতে...আমার মনে হয় যদি তরুণ, নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি করতে হয় তাহলে একটু গাইডেন্স প্রয়োজন রয়েছে।
তারিক আনাম খান
আমি বলেছি, আমি ফিজিক্যালি দেখিয়েছি, এক্সপ্রেশন দেখিয়েছি...খোঁজ খোঁজ তে আমি বলেছি, অ্যাগ্রেসিভ হতে, বলেছি একদম অডিয়েন্সের চোখে চোখ রেখে বলতে হবে। আসলে ফিজিক্যালি অ্যাগ্রেসিভনেসটা আসতে হবে...
মামুনুর রশীদ
তুমি মিউজিকে যে চ্যালেঞ্জটা দিয়েছো সেটা হলো ওখানে ছিল মাত্র একটা ছোট ঢোল...রিদম ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে একটা ঢোল। আর কিছু ছিল?...আমার মনে আসছে না...হ্যাঁ, একটা কৃষ্ণকাঠি ছিল...এবং একটা ড্রাম ছিল...পারফরমারদের জন্য সুবিধা ছিল যে...পা মেলানো, হাত মেলানো...রিদমের সাথে মেলানোর এটা একটু সহজ ছিল...দেখা গেল যে, এই জায়গায় পা’টা পড়ছে না...বডিটা যাচ্ছে না। এখন এটা একটা বিরাট সমস্যা...এটা তো স্বীকার করতেই হবে যে, বাঙালি মুসলমানের ড্যান্স, মিউজিকে কারো এক্সপেরিয়েন্স নেই এবং বডিতে...
সারা যাকের
কিন্তু মামুনভাই...আজকাল যেটা হয় যে, নাচের একজনকে নিয়ে আসা হয়। সেই নাচের ব্যক্তি যখন কোরিওগ্রাফি করে তখন বাপারটা...
মামুনুর রশীদ
ওটা থিয়েটার হয় না...
হাসান শাহরিয়ার
আমি একটু বলি তারিকভাই...যাকেরভাই যেটা বলছেন সেটা হচ্ছে যে...আমি কিছুই জানব না যে আপনি কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন...একজন দর্শকহিসেবে আমার এক্সপেক্টেশন থাকবে যে আমি ম্যাক্সিমাম ভালোটা চাই। যাকেরভাই যে ওয়ার্কশপ প্রোডাকশন বলছে, সেটা কিন্তু এই অর্থে যে, এই ‘নাট্যকেন্দ্র’ই কিছুদিন আগে ক্রুসিবল করেছে...এর আগে তুঘলক, হয় বদন ইত্যাদি করেছে...সুতরাং ওনার এক্সপেক্টেশন আপনি বা আপনারাই বাড়িয়ে দিয়েছেন।...থিয়েটার গ্রুপ হিসেবে কিন্তু একটা বড় তৃপ্তি প্রাথমিকভাবেই চলে এসেছে...সেটা হচ্ছে যে, এই কাজটার ফলে দলের বেশ কিছু নতুনকর্মীরা ভালো একটা কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কাজটা করে সন্তুষ্টি পেয়েছেন কিনা...নাকি...মানে অমুক চরিত্রটা যদি তমুককে দিয়ে করানো যেত তাহলে আরও বেটার হতো বলে মনে হয়েছে?
তারিক আনাম খান
আমার যা রিসোর্স সেটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। একটা দলে ১২টা ছেলে এক সাথে কাজ করেছে...১২জনের কাজই ভালো হবে...মানে একরকম হবে তা কিন্তু না। এখন...এখানে দলের কথা চলে আসে...আগেও যেমন বলেছি...তুমিও (হাসান শাহরিয়ার) বললে...একটা ছেলে থিয়েটারে আসছে...আর কদ্দিন সে শুধু চেয়ার ঠেলবে...কদ্দিন পর্যন্ত চা আনবে...কদ্দিন পর্যন্ত ব্যাক স্টেজে কাজ করবে।...যারা খারাপ করে তারা সত্যিই গালাগাল খাচ্ছে এবং বকুনি খাচ্ছে...সবসময় বকা হচ্ছে...কিন্তু যেটা হলো যে, কোনোরকমে যদি সে থিয়েটারে টিকে থাকে...সেটা আমার দলের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গল, তাই না?
আলী যাকের
স্যরি, আসলে আমার চোখে ক্রুসিবল লেগে আছে তো...মানে ঐ যে শাহরিয়ার বললো, তারিক আমার এক্সপেক্টেশন বাড়িয়ে দিয়েছে, সেজন্যই এত কথা বলা...
তারিক আনাম খান
না না যাকেরভাই স্যরি হওয়ার কিছু নেই। খোলামেলা আলোচনা খুবই প্রয়োজন।
সারা যাকের
ক্রুসিবল তো অন্যরকম প্রোডাকশন, আমি এটাকে ওটার সাথে কমপেয়ার করতে চাই না। নজরুলগীতির সাথে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কমপেয়ার করার দরকার কী?
মামুনুর রশীদ
সেটার জন্য না, সারা, আমার আর যাকেরের ভাষ্য হচ্ছে যে...আমরা বলছি...আর্টিস্টিক একসেলেন্স...
আলী যাকের
হ্যাঁ, আমরা বলছি আর্টিস্টিক একসেলেন্স অব ক্রুসিবল এবং ক্রুসিবল-এ অনেক বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের কাছ থেকে যে কাজ তারিক আদায় করে নিয়েছে, আরজ চরিতামৃত নাটকে সেটা সেভাবে হয় নি।...আরেকটা ব্যাপার বলি...হঠাৎ মনে পড়ল...যে ছেলেটি পরে আরজ আলী করছে...কিশোর আরজ আলীর পরে...পারফরমার আরজ আলী...এই ছেলেটিকে কিশোর আরজ আলীর সময়ে মঞ্চে আনাটা...আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ঠিক হয় নি। কোরাসে অভিনয় করে পরে আরজ আলী হলো...এ ব্যাপারটা না করলে বোধহয় ভালো হতো।
মামুনুর রশীদ
আমি কিন্তু আরজ আলীকে, এখানে যে আরজ আলীর চরিত্রে অভিনয় করেছে, তাকে আমি প্রথম দর্শনেই একসেপ্ট করেছি।
মাসুম রেজা
আরজ আলী পড়ে বা যেভাবেই হোক অভিনেতার অ্যাপিয়ারেন্সটা বোধহয় মিলে গেছে...তাই না মামুনভাই?
মামুনুর রশীদ
নট নেসেসারিলি, আরজ আলী চরিত্রের অভিনেতা তো আর আরজ আলীর মতো দেখতে হবে না। হওয়ার প্রয়োজনও নেই, তাই না? আলী যাকেরতো গ্যালিলিও করেছে...গ্যালিলিও কি ওর মতই ছিল নাকি? আজকে যদি এই নাটকটি এস্কিমোরা করে...তাহলে আরজ আলী চরিত্রেতো একজন এস্কিমোই অভিনয় করবে, নাকি না?
মাসুম রেজা
তাতো অবশ্যই।...এবার সেটের ব্যাপারে একটা কথা বলি...সেটে’র ব্যাপারে একটা কারিশমা করার প্রবণতা থাকে। ‘ঢাকা থিয়েটার’ বলি, ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ বলি বা অন্য যেকোনো নাটকের...এমনকি ‘নাট্যকেন্দ্র’র ক্রুসিবল পর্যন্ত...একটা বিশাল সেট বা এরকম অনেক ক্ষেত্রেই হয়েছে...
আলী যাকের
আমি কিন্তু সেট-এ বিশ্বাস করি না।
মাসুম রেজা
এ নাটকে কিন্তু এটাকে ভাঙা হয়েছে। এ নাটকে কিন্তু কোনো সেট ছিল না।
মামুনুর রশীদ
মাসুম...আমার মনে হয়, আমরা যারা আজ নাটক করছি, তাদের কিন্তু কনটেম্পরারি বিষয় নিয়ে নাটক লেখা উচিত।
মাসুম রেজা
আরজ আলী কি কনটেম্পরারি না?
মামুনুর রশীদ
না।
তারিক আনাম খান
স্ট্রাগল এগেইনস্ট ফান্ডামেন্টালিজম ইজ নট কনটেম্পরারি?
মাসুম রেজা
আমার তো মনে হয় আজকে যদি কেউ...কোনো ব্যক্তি, কোনো দর্শন যদি কনটেম্পরারি হয়, তবে তা অবশ্যই আরজ আলীর দর্শন।
হাসান শাহরিয়ার
কিন্তু আপনারাতো তার দর্শনকে সেভাবে আনতে চান নি, রিস্কি মনে করেছেন।
মামুনুর রশীদ
তোমরা বলতে পারো যে, থিয়েট্রেক্যালি ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে, তাই করেছো।
আলী যাকের
দোস্ত আমার একটা কথা আছে। শাহরিয়ার বলেছিল...যদি প্রাসঙ্গিক হয় তাহলে আমরা আবার কনটেন্ট নিয়ে কথা বলবো। তাই বলছি। তাসলিমা নাসরিন থেকে আরম্ভ করে তাবৎ এই ধরনের লেখকদের, ইভেন রাহমানভাইকে (শামসুর রাহমান)...মৌলবাদীরা খুন করার জন্য উদ্যত। কিন্তু আরজ আলীর বই সম্পর্কে একটি কথাও বলে না কেন তারা?
মাসুম রেজা
সেটাই তো মজার একটা ব্যাপার। এটা থেকে আমি মনে করি...আরজ আলী একজন অনায়ক মানুষ ছিলেন, তার বই এবং তাকে আলোচনার মাধ্যমে আজকে তিনি নায়ক হিসেবে পরিচিত পেয়েছেন। অনায়ক অবস্থায় সে যে কাজ করে গেছে...তাসলিমা নাসরিনের ঠিক বিপরীত আমি মনে করি, কিন্তু ফান্ডামেন্টালিজমের এগেইনস্টে যে কাজটা হওয়া দরকার সেটা করেছে।
মামুনুর রশীদ
না না আমার কথা হচ্ছে, ওনার বইটা কি ধর্মব্যবসায়ীদের আঘাত করে?
মাসুম রেজা
ধর্মব্যবসায়ীদের আঘাত করে।
মামুনুর রশীদ
করে নাতো...করলেতো তারা প্রত্যাঘাত করতো।
মাসুম রেজা
আচ্ছা টাঙ্গাইলের ঘটনা কেন ঘটলো? আরজ আলীর বইটা পড়েছে মাত্র...বইটা পড়ার ফলে এই শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে কেন? আমি জানিতো এই নাটক যদি আজকে...মানে ঢাকার বাইরে গিয়ে করি, তাহলে কোনো না কোনো রিয়েকশন ‘নাট্যকেন্দ্র’কে ভোগ করতে হবে।
মামুনুর রশীদ
কিচ্ছু হবে না...আমি তোমাকে বললাম কিচ্ছু হবে না। তোমরা যেভাবে প্রোডাকশনটা করেছো...তোমরা যেভাবে আরজ আলীকে উপস্থাপন করেছো এতে আমার মনে হয় না যে কোনো আঘাত আসবে। ভেরি ইন্টেলিজেন্টলি তোমরা কাজটা করেছো।
তারিক আনাম খান
আমরা... আসলে, মানুষের একটা ধর্মবিশ্বাস আছে তো, সেখানে, সেই জায়গাটায় আঘাত করতে চাই নি।
মাসুম রেজা
যেটা আরজ আলীও করে নি।
মামুনুর রশীদ
আরজ আলী করেছে, কী যে বলো তুমি!
আলী যাকের
যে জিনিসটা শুরু করেছিলাম তা কিন্তু কমপ্লিট করি নি। আমি প্রসঙ্গক্রমে তসলিমা নাসরিনের নাম আনলাম...মুরতাদ হিসেবে...এখন সে দেশের বাইরে...আমার একটা ধারণা হচ্ছে, সত্য কথা যদি তুমি ভেতর থেকে বলো, কনভিকশন থেকে বলো, সেটা এক জিনিস আর সেনসেশন মন থেকে বললে আরেক জিনিস। আরজ আলী কিন্তু কনভিকশন থেকে কথা বলেছে, এবং যখন কনভিকশন থেকে কেউ কথা বলে, তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো খুব মুশকিল হয়ে পড়ে।...ঐ ব্যাপারটা মনে আছে? ঐ যে কবর খুঁড়ে দেখছিল...কবর দেয়ার পরে...ফুটা দিয়ে কেউ আসছিল কিনা?
মামুনুর রশীদ
তারপরও তোমরা বলছো যে সে...মানে আস্তিক্যবাদী দর্শন আর নাস্তিক্যবাদী দর্শনের মধ্যে...
আলী যাকের
আগামীকাল থেকে হয়ত একলক্ষ বছর পরে কেয়ামত হবে...একলক্ষ বছর পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে...আর কেয়ামতের আগেরদিন যে মারা যাবে, তার বিচার পরদিনই শুরু হবে...
মামুনুর রশীদ
তুমি (মাসুম রেজা) এরকম প্রশ্নগুলো কেন আনলে না?
মাসুম রেজা
সমস্তটাই টেক্সট-এ ছিল মামুনভাই...কিন্তু...
হাসান শাহরিয়ার
না না, এইগুলো যদি আনা না হয়...তাহলে আমি আরজকে নিয়ে নাটক করতে যাচ্ছি কেন? তার জীবনী আনার জন্যতো নিশ্চয়ই নাটক করেন নি তাই না?
মামুনুর রশীদ
এটা কোনো না কোনোভাবে এসে গেছে...এটাই একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়...
আলী যাকের
আজকে আরজ আলী আলোচিত হচ্ছে কেন?
মামুনুর রশীদ
এখানে আরজ আলীর জীবনটাই বড় হয়ে গেল? নাকি আরজ আলীর দর্শনটা বড়?
হাসান শাহরিয়ার
জীবনতো গ্যালিলিও’র ছিল, জীবন কিন্তু সক্রেটিসেরও ছিল।...তো নাটকে আনতে গিয়ে আমি কোন জিনিসটা এনেছি সেটা হলো কথা।
মাসুম রেজা
মামুনভাই, আমি তো বারবার এই ব্যাপারে একটা কথা বলার চেষ্টা করছি যে, দর্শন যেটা...সেটা আমরা এনেছি কিন্তু সেই দর্শনকে আরও ব্যাপকভাবে বলার জন্য যে জিনিসগুলো আনতে হতো, সেগুলো এত বেশি সংবেদনশীল যে...
আলী যাকের
এত বেশি ভয়াবহ...
মামুনুর রশীদ
নির্দেশকের কথায় কিন্তু যুক্তি আছে...সেটা হলো...সময়ের কারণে, কালের কারণে, সে একটা আপোষ করেছে...সৎভাবে বলছে যে, আমরা দর্শককে আঘাত করতে চাই নি।
মাসুম রেজা
আমি এই কথাটাই বলছি...এটা আনলে যে অবস্থাটা দাঁড়াতো...সাধারণ মানুষকে হার্ট করতো।
মামুনুর রশীদ
করতো এটা তোমাদের কল্পনার কথা। আমাদের মাইন্ড সেট আছে একটা...আমরা প্রি-সেন্সিবল। তুমি কেন প্রি-সেন্সিবল হয়ে আছো? তারিক কিন্তু একটা ব্যাপারে খুবই সৎ-অবস্থানে আছে, সেটা হচ্ছে, ’ও প্রথম থেকেই বলছে, যেদিকটা থিয়েট্রেক্যালি ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে, সে সেটাই আনার চেষ্টা করেছে। মাসুম কিন্তু বলছো অন্যটা...
মাসুম রেজা
কিন্তু মামুনভাই আমি যেদিকটা জোর দিতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে, মূল স্ক্রিপ্ট-এ যেভাবে আছে, সেটা আনলে মৌলবাদীরা যেকোনো কর্মকা- করে বসতে পারতো।
আলী যাকের
তুমি বলছো পারতো। কিন্তু আদতে কিছু হতো কিনা এ নিয়ে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
হাসান শাহরিয়ার
মাসুমভাই...মৌলবাদবিরোধী ব্যাপারে যে কথা বলছেন...সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোক কিন্তু অনেক বড় বড় এই বিরোধীকাজ করে যাচ্ছে...এই যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিবির’ তাড়িয়ে দেয়া, তাদেরকে রাজনীতি করতে না দেয়া...তাদের হাতে খুন হওয়া...এগুলো অনেক কিছুই কিন্তু প্রত্যেকটা জায়গায় হচ্ছে। তো সেখানে থিয়েটারতো আরও বড় কিছু করতে পারে এবং আমার মনে হচ্ছে যে, আমরা অনেক দূর না গিয়েই বলছি যে, এটা দেখালে বোধহয় একধরনের রিয়েকশন হতো।
তারিক আনাম খান
আমরাতো বিচ্ছিন্ন নই। যেমন ধরো, একটু আগে মামুনভাই বলছিলেন যে, তাপস সেনের কাছে মামুনভাই যখন বইটা দিলেন...তাপস সেন একরাত্রে বইটা শেষ করার পরই বলছে যে তার ভয় করেছে। আবার যাকেরভাই বলছে যে, উনি একটি মেয়েকে দিলেন, তখন বলছে আমি ভয় পাচ্ছি পড়তে...
সারা যাকের
আমার জানা মতে ১০জনের মধ্যে ৮জন বিশ্বাসী...যেরকমভাবে মানুষ বিশ্বাস করে...মাথার উপরে সূর্য থাকবে, দোজখ আছে, শাস্তি আছে ইত্যাদি...এমন সবাইকেই আমি বলেছি নাটকটি দেখার জন্য। ওরা খুব বিশ্বাসী, নামাজ পড়ে। ওরা দেখেছে নাটকটা। কিন্তু নাটক দেখে...প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েও তারা, মানে তাদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করে নি।
আলী যাকের
তার মানে কী দাঁড়াল? নাটকটাতে আঘাত পাওয়ার মতো কিছু ছিল না।
তারিক আনাম খান
আরজ আলী নিজেও কিন্তু আঘাত দেন নি, তিনি শুধু প্রশ্ন করেছেন...
আলী যাকের
না...আমি বলি যে, (সারা যাকের) কালকে বইটা পড়, আবার শুরু করো...তুমি দেখবে যে, সত্যিই যদি অবিশ্বাসী না হও...আমি তো নাস্তিক, আমার কোনো ভয় নেই...যদি তোমার একটুও ভয় থাকে...একটু যদি চিন্তা হয় যে, না পরকাল বলে কিছু আছে...তাহলে কিন্তু তোমার ভয় হবেই। একটা কথা বলি, একটা কথা আছে...কথাটি হলো যে, যদি তুমি ধর্ম মানো, মানে যদি ধার্মিক হও, তাহলে তুমি নন-কম্যুনাল হতে পারো না। কোরআন পড়েছিস নিশ্চয় (মামুনুর রশীদকে)...কোরআনের ট্রান্সলেশনও পড়েছিস নিশ্চয়...আমি কিন্তু ভালোভাবে ট্রান্সলেশন পড়েছি...প্রথম সুরা যেটা, আলিফ লাম মীম...মানে গায়েবের প্রতি তোমার বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করে তবেই তুমি এটা পড়। আমি পড়ে তারপর কিছু প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না, পড়ার পর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এটা যখন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়...তখন তুমি ধর্ম মানলে, নন-কম্যুনাল হওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। কোরআনের যুক্তি...এ যুক্তিগুলোকে ধাক্কা দিয়েছে কিন্তু আরজ। এখন এগুলো আনতে গেলে নাটকটি হতো কিনা...
তারিক আনাম খান
আমাদের, যাদের নিয়ে আমি কাজ করি, তাদের সবাই কি এসব যুক্তিতে কনভিন্সড হবে?
আলী যাকের
আমাদের দলে রোজার মাসে ৭:৪৫ মিনিটে মহড়া করতে হয় কেন? নাট্যকর্মীরা সবাই...
তারিক আনাম খান
কথা হচ্ছে...আমাদের হয়তো রিহার্সেল হচ্ছে...তখন একটা আযান শুনে হয়ত আমি বললাম যে, আযান দিচ্ছে এখন বন্ধ কর। এটা কিন্তু এই নয় যে, আযান হচ্ছে আর আমরা অপবিত্র কাজ করছি...সমস্যাটা হচ্ছে...আমি ঢোল বাজাচ্ছি আমার হারমোনিয়াম বাজছে, পাশে পাঁচটা বাড়ি আছে, ওরা কিন্তু আমাকে রিহার্সেল করতে দিবে না। এটাকে কম্প্রোমাইজ বলেন অ্যাডজাস্ট বলেন, সমন্বয় বলেন...যাই বলেন এটা করতে হচ্ছে।
হাসান শাহরিয়ার
এটাতো করতেই হবে, তা না হলেতো আপনার দলে লোক পাবেন না। আশপাশের বাড়ির কথা বাদ দিন, দলের অনেকেইতো আযান দিলে মাথায় কাপড় দেয়। থিয়েটারে তো আমি তাদেরকে নিয়েই চলছি...সেখানে আরজকে কতটুকু দেখাতে পারবো সেটাতো বোঝাই যাচ্ছে। যাক, আমার মনে হয় আমরা আলোচনার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এ অবস্থায় আলী যাকেরভাইকে তাঁর মন্তব্য রাখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
আলী যাকের
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মাসুম যে বললো...যেভাবেই আমি আরজকে আনি না কেন, আরজ এসেছে, আরজকে আনা উচিত ছিল মঞ্চে। এখন আরজ আলোচিত হবে, মানুষ আরজ দেখে, বই কেনায় অনুপ্রাণিত হবে অথবা পাশের লোককে জিজ্ঞেস করবেÑভাই, এরকম একটা লোক ছিল নাকি?...এই যে একটা অনুসন্ধিৎসা বা কৌতূহল সৃষ্টি হলো, এই নাটকটি দেখে...নাটক সম্পর্কে আমার ভিন্ন অভিমত থাকতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয় সময়ের প্রয়োজনে, অতি সূচারুভাবে আরজ আলী মঞ্চে এসেছে, সেই জন্যে আমি ‘নাট্যকেন্দ্র’কে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।
হাসান শাহরিয়ার
মামুনভাই...
মামুনুর রশীদ
ঐতো...আমাদের পা-ুলিপি সম্পর্কে, প্রযোজনা সর্ম্পকে নানান কথা থাকবে। কিন্তু এটাও তো কম নয় যে, আরজ আলী মাতুব্বরের জীবন নিয়ে নাটক আমাদের নাট্যমঞ্চে এসেছে। এই যে আমরা একটা অগ্রসর চিন্তার অধিকারী মানুষ, এটাও তো এখানে প্রমাণিত। তবে একই সঙ্গে আমি যেটা আগেও বলেছি আবারও বলবো, আমরা কিন্তু আমাদের নিজস্ব যে আকাক্সক্ষা, আমরা যে শ্রেণিকে রিপ্রেজেন্ট করবো...তার যে সংকটকাল আছে, এটা নিয়ে কিন্তু আমি ‘নাট্যকেন্দ্রে’র কাছ থেকে নাটক আশা করি। দল হিসেবে তো ‘নাট্যকেন্দ্রে’র আমি খুব নিয়মিত দর্শক...নির্দেশক হিসেবে তারিক আনামও আমার অত্যন্ত প্রিয়। সেই কারণেই দাবি করছি যে, আমাদের এই শ্রেণিদ্বন্দ্বের বিষয় নিয়েও নাটক আসবে। তো এই ক্ষেত্রে এটাই আমার কাছে ভাবতেও একটু ইয়ে লাগে...বিচ্ছু, ক্রুসিবল আবার আরজ চরিতামৃত আবার তুঘলক...এটার কীভাবে সমাধান হবে জানি না। আমার মনে হয় এই বাংলাদেশের...আমরা যে শ্রেণিকাঠামোর মধ্যে অবস্থান করি, এই শ্রেণিকাঠামোর আঘাতটা যেন নাটকে থাকে এবং যেন আসে এবং নাট্যকারের কাছ থেকেও তা কামনা করি।
হাসান শাহরিয়ার
সারা আপা...
সারা যাকের
মঞ্চে সব সময় সাহসী এবং প্রগতিশীল বক্তব্য রাখা হয়েছে...কিন্তু ধীরে ধীরে একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে...আমি নাটকে বক্তব্য রাখছি এমন একটা ভাব দেখিয়ে...একটু হাস্যরস, একটু কৌতুক, একটু কমেডির দিকে চলে যাচ্ছি। এরই মধ্যে আরজ আলী নিয়ে আমরা দেখলাম যে, বক্তব্য, মৌলবাদবিরোধী বক্তব্য সহজভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং আবারও প্রমাণ হলো যে, প্রগতিশীলবক্তব্য মঞ্চ রাখছে এবং যদিও এখানে উপস্থাপনার আঙ্গিকে একটা তারুণ্যের ছাপ ছিল...তরুণেরা কাজ করেছে, তারপরও মানের দিক দিয়ে আরজ চরিতামৃত অবশ্যই একটা মানে পৌঁছেছে বলে আমি মনে করি। আমি এজন্য ‘নাট্যকেন্দ্র’কে ধন্যবাদ জানাই আর এই নাটক নিয়ে আলাপনের আয়োজনের জন্য ‘থিয়েটারওয়ালা’কেও জানাই অভিনন্দন।
হাসান শাহরিয়ার
তারিকভাই, এতক্ষণ যে আলোচনা হলো...আমরা চেষ্টা করেছি যে আপনি যা করেছেন তো করেছেনই, তারপরও আমরা যে কথাগুলো বলেছি, সেগুলোর ব্যাপারে যদি আপনি কনভিন্সড হন, তাহলে হয়ত চেইঞ্জ করবেন বা নতুন করে ভাববেন। আমি অন্য একটি প্রসঙ্গ নিয়ে বলি, সেটা হলো কয়েকদিন আগে আপনি ‘আরণ্যক নাট্যদল’ প্রবর্তিত ‘দীপু স্মৃতি পদক’ পেয়েছেন। পদক নেয়ার সময় বলেছিলেন যে, থিয়েটারটা ছেড়ে দিচ্ছেন দিচ্ছেন করছিলেন কিন্তু এমন সময়েই এই পদক আবার আপনাকে বেঁধে ফেললো। তো এমন বৈরী সময়ে এই যে তরুণ-নবীনদের নিয়ে একটি কাজ করলেন...আপনার কী মনে হয়?...থিয়েটারে অনুপ্রেরণাদায়ক কিছু পাচ্ছেন কি?
তারিক আনাম খান
প্রথমেই তোমার উদ্যোগকে অভিনন্দন জানাই। যাকেরভাই, সারাআপা, মামুনভাইÑএঁদের আসা এবং আলোচনা করা, আমাদের প্রযোজনা নিয়ে... এটা ভীষণ একটা ব্যাপার। মানে এই ধরনের ডিসকাশনটা খুব কমে গেছে...আমরা এত বেশি...অনেককিছুকেন্দ্রিক হয়ে গেছি...পারস্পরিক আদান-প্রদান কমে গেছে। টেলিফোনে কথা হয়েছে ওনাদের সাথে, দু-একটি কথা হয়েছে...এখানে অনেক বিষয়ে আমি জানতে পারলাম। এটা খুব পজেটিভ মনে হয়েছে আমার কাছে। আমাদের নাট্যকর্মীদের মধ্যে আদান-প্রদানটা খুব কমে গেছে। এবং আমরা যে কাজগুলো করছি, নিজেদের কাজে নিজেরাই বেশ...বুক ফুলিয়ে কিছু একটা করে ফেলছি এরকম একটা ভাব নিয়ে আমরা আছি। সেই সব কারণে মনে হচ্ছে যে, এই আলোচনাগুলো প্রয়োজন।
আর অনুপ্রেরণার কথা বললে বলতে হয়...আমরা একটা সময়ে প্রচুর পরিশ্রম করে থিয়েটার করেছি। পরিশ্রম বলতে শুধু গায়ে খাটা না, মেধা দিয়ে...মানে একটা জেদ কাজ করতো...আমাকে পারতেই হবে, আমাকে করতেই হবে...কিন্তু এখনকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এটা কমে গেছে। আসছি, করছি...কেমন যেন গা ছাড়া ভাব। কোনো হোম ওয়ার্ক নেই, দুঘণ্টা রিহার্সেলের বাইরে আর কিছু না। আসলে থিয়েটার করতে হলে ডিভোশন লাগে...সেটা আজকাল দেখা যায় না। সে জন্য মাঝেমধ্যে হতাশ লাগে। আবার এই ধরনের আলাপের ব্যবস্থা হলে...তখন হয়তো আবার কিছু করতে ইচ্ছে হয়।
আলী যাকের
বিশেষ করে আজকের এই আলোচনার আয়োজনটাকে সাধুবাদ জানাই এই কারণে যে, আমার-মামুন-তারিকের মধ্যে এমন একটা বন্ধুত্ব আছে...রেখে ঢেকে কথা বলতে হয়...পাছে যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। কিন্তু একটা নিরপেক্ষ পত্রিকা যখন এরকম একটা আলোচনার ব্যবস্থা করে, তখন মন খুলে কথা বলি, আজকে যেমন বললাম। আমার অনেক ভেতরের কথা বেরিয়ে আসলো...মামুনের অনেক কথা বেরিয়ে আসলো...তারিক কিছু মেনে নিল আবার কিছু মানলো না। তো এই যে ওপেননেসটা...এটা তৈরি করার ব্যাপারে এই আলোচনাটা অনেক সাহায্য করবে। এ জন্য ‘থিয়েটারওয়ালা’কে সবার পক্ষ থেকে আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি।
হাসান শাহরিয়ার
সবাইকে ধন্যবাদ।