Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: সঙক্রান্তি
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: সঙক্রান্তি। রচনা ও নির্দেশনা: মামুনুর রশীদ। মঞ্চপরিকল্পনা: ফয়েজ জহির ও চঞ্চল চৌধুরী। আলোকপরিকল্পনা: ঠাণ্ডু রায়হান ও তারিক মাহবুব রুশো। আবহসংগীতপরিকল্পনা: পরিমল মজুমদার ও উত্তম চক্রবর্তী। রূপসজ্জা: নূরুল হক ও রবীন। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০০০। একটি ‘আরণ্যক নাট্যদল’ প্রযোজনা
[সঙক্রান্তি নাটক নিয়ে নাট্যসমালোচনার আয়োজন করেছিল নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’। নাটকটির নাট্যকার-নির্দেশক মামুনুর রশীদসহ আলোচনায় আরো ছিলেন, আতাউর রহমান, নাসির উদ্দিন ইউসুফ ও আজাদ আবুল কালাম। নাট্যালোচনায় সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ‘থিয়েটারওয়ালা’-সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ১০ম সংখ্যায় (২০০২ এ প্রকাশিত) অনুলিখন করে এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
হাসান শাহরিয়ার
আমি প্রথমেই মামুনভাইকে দিয়ে শুরু করছি। মামুনভাই জয়জয়ন্তীর পর...অনেকদিন পর আবার আপনার একটা নাটক আমরা পেলাম। তো আপনার কাছে আমার জানতে চাওয়া, আপনি নিয়মিত নাটক লেখেন এবং আপনার দল সেই নাটক নিয়মিতভাবেই মঞ্চে এনে থাকে...কিন্তু এই প্রথম আপনি দীর্ঘদিন পর দলের জন্য নাটক লিখলেন...এই বিরতি কেন? আমি জানতে চাচ্ছি জয়জয়ন্তীর পর এই বিরতি কি সঙক্রান্তি লেখার প্রস্তুতিপর্ব ছিল? নাকি অন্যকোনো কারণে আপনার এই কলমবিরতি?
মামুনুর রশীদ
আমার ধারণা যেকোনো লেখক তার লেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। অপেক্ষা করতে হয়, কারণ, তাকে অনুপ্রেরণা পেতে হয়...চারদিক থেকে...সেই প্রেরণার অভাব ছিল আমার। সেটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর এর মধ্যে মঞ্চনাটক লিখি নি বটে, কিন্তু নির্দেশনা দিয়েছি। আব্দুল্লাহেল মাহমুদ রচিত প্রাকৃতজন কথার নির্দেশনার কাজ করেছি, পথনাটক ঐ আসে আমার লেখা এবং নির্দেশনাও আমি দিয়েছি। সঙক্রান্তিও কিন্তু আমার বেশ আগের লেখা। নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সে কারণেই এত গ্যাপ মনে হচ্ছে। তাছাড়া চারিদিকেই একটা সংকট এই সময়ে ছিল।
হাসান শাহরিয়ার
আপনার সঙক্রান্তি নাটকটা ‘সঙ’দের জীবন নিয়ে, তাদের সংকট নিয়ে। তো এই বিষয় বেছে নেয়ার পেছনে...
মামুনুর রশীদ
আসলে আমি বহুদিন ধরেই ভাবছিলাম কৃষকদের নিয়ে একটা নাটক লিখবো। খাঁটি কৃষকদের নিয়ে আমাদের সাহিত্যই বোধহয় কম হয়েছে। তো সঙক্রান্তি নাটকটা কিন্তু আমি লিখতে চেয়েছিলাম কৃষকদের নিয়ে। তারপরও লক্ষ করে থাকবে আমার নাটকটাতে, তারা সঙ করে বটে, কিন্তু তারা মূলত কৃষক। এবং এই কৃষিজীবী সম্প্রদায় তাদের জীবনের মধ্যে থেকে আরেকটা পেশাকে অবলম্বন করা... এন্টারটেইনমেন্ট এবং পেশা হিসেবে...এটাই কিন্তু সঙক্রান্তি নাটকের পটভূমি। একজন কৃষক দিনেরবেলায় কৃষিকাজ করে, এবং রাতেরবেলায় সঙ করে। এবং তারা খুব কনটেম্পরারি বিষয় নিয়ে এই সঙ’টা করে।
হাসান শাহরিয়ার
আমি এখন আতাউর রহমানভাইয়ের কাছে জানতে চাচ্ছি যে, সঙক্রান্তি নাটকে কৃষক-সঙ এর সাথে সমাজের এলিট ক্লাসের যে দ্বন্দ্ব দেখানো হলো সেটা কতটুকু নতুনভাবে এসেছে? অর্থাৎ মামুনভাইয়ের আগের অনেক নাটকেও কিন্তু এধরনের শ্রমজীবীদের সাথে এলিট শ্রেণির দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে...তো এই নাটকে কি একইভাবে দ্বন্দ্বের অবতারণা করা হলো, নাকি আরও পরিপূর্ণভাবে এবং আধুনিকভাবে এই দ্বন্দ্বের উপস্থিতি ঘটলো?
আতাউর রহমান
এটা খুব ডিফিকাল্ট। কোনো জীবনকেই পরিপূর্ণভাবে ধরা যায় না। খুব বড় ক্রিয়েটিভ লোকের পক্ষেও জীবনের এই টোটালিটি ধরা মুশকিল। এটা রবীন্দ্রনাথ পেরেছেন কিনা, গ্যাটে পেরেছেন কিনা আমি সন্দিহান। সে হিসেবে আমার জন্য এটা বলা মুশকিল যে পরিপূর্ণভাবে দ্বন্দ্বটা এসেছে কিনা। আমার যদিও গ্রামে জন্ম, তবুও আমার মেন্টালিটিটা ‘ফোক’ থেকে দূরে, আমি সবসময়ই আধুনিক, আরবান লাইফের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম...
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আধুনিক না, আরবান...‘ফোক’ থেকে দূরে থাকলে আরবান হওয়া যায়, আধুনিক না। হা হা...
আতাউর রহমান
সেটা অবশ্য অনেক তর্কের ব্যাপার। আমি সেই তর্কে যেতে চাই না। এই নাটকে কনফ্লিকশন কিছু এসেছে। তবে আমার কাছে সবচেয়ে রিভিলিং পয়েন্ট মনে হয়েছে, বিষয়ের দিক থেকে যতটা না, তারচেয়ে বড় হলো ইটস এ ওয়েল অ্যাক্টেড প্লে। বিষয় বলতে জয়জয়ন্তীতে যে ডেপথ বা গভীরতা পেয়েছিলাম, এই নাটকে সেটা অনুপস্থিত ছিল। জয়জয়ন্তীতে ওনার নাটকের একটা যে মোড় নিয়েছিল...বিষয়, ডিজাইন সবদিক থেকে...এই নাটকে সেই অন্তরঙ্গটা তেমনভাবে আসে নি। কোনো কোনো জায়গায় আমার কাছে সুপারফিশিয়াল মনে হয়েছে। কোনো কোনো জায়গা আমার মনে হয়েছে ইমপোজড। তবে আমার কাছে সঙদের জীবনটা বেছে নেয়াতে ভালো লেগেছে, কারণ, এই জীবনটার সাথে আমি পরিচিত ছিলাম না। এলিট শ্রেণির সাথে যে দ্বন্দ্ব, সেগুলো এসেছে, ভালোভাবেই এসেছে। এই দ্বন্দ্ব সর্বকালের, সেগুলো এসেছে। কিন্তু ‘বড় কাজে’র কাছে আমার একটা প্রত্যাশা থাকে যে, আমি আকাশচারী হতে চাই, রিচিং অলমোস্ট দ্যা হেভেন...সেটা হয় নি। দু-এক জায়গায় হয়েছে, আমার প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি।
হাসান শাহরিয়ার
বাচ্চুভাইয়ের কাছে আমাদের জানার আছে...সেটা হলো অভিনয়, সেট, লাইট ইত্যাদি ডিজাইনে আসার আগে জানতে চাইবো, এই নাটকের কন্টেন্টের বিষয়ে। এবং যেহেতু নাট্যকার নিজেই এই নাটকের নির্দেশক তাই নির্দেশনার ব্যাপারেও কিছু বলুন। নির্দেশনা বলতে উপস্থাপনার আঙ্গিক নিয়ে...
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমার মনে হয়েছে মামুনভাইয়ের আগের অনেক নাটকের চেয়ে...অন্তত পাঁচটা নাটকের নাম করা যাবে...যেগুলোর চেয়ে এই নাটকটা অনেক দুর্বল। এটা আমার কাছে মনে হয়েছে লেখার দিক থেকে। আর বিষয়ের দিক থেকে বেশ অভিনব ছিল যে, উনি যাদের জীবনটা, সঙদের জীবনটা ধরতে চেয়েছিলেন। মামুনভাই যেভাবে লেখাটা নিয়ে আসেন, সবসময়েই, তিনি একেবারে রাজনীতিসচেতন জায়গা থেকেই কিন্তু থিয়েটারটা করেন। তো সে জায়গা থেকে কন্ট্রাডিকশনটা তুলে আনা, ওয়েস্টের ফিলসফির মধ্যে আমাদের কনফ্লিকশনটাকে মামুনভাই যেভাবে তাঁর লেখায় নিয়ে আসেন, এই নাটকের বেলায় কেন যেন মনে হয়েছে যে, তিনি অতটা গভীরে গিয়ে কাজটা করেন নি। আমি আতাভাইয়ের সাথে এই জায়গাটায় একমত। নির্দেশনার ব্যাপারে আমার মনে হয়েছে, সেট আর কস্টিউমের সমন্বয়টা কি হয়েছে? সেটটা কি একটু আলাদা মনে হয় না? সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে স্তানিস্লাভস্কি থিয়োরিতে কাজ করে করে আবার কখনো স্টাইলাইজেশনের দিকে চলে এসেছে। এটা আসা যাবে না তা না, কিন্তু কতটুকু সফলভাবে এসেছে সেটা আমার মনে হয় বিতর্কের বিষয়। এ বিষয়ে আমি আবার পরে বলবো।
হাসান শাহরিয়ার
পাভেলভাই (আজাদ আবুল কালাম), আপনার কথা শুনি...
আজাদ আবুল কালাম
আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে...নাটকটার দুটো বিষয়ে...একটা হচ্ছে লেখার ক্ষেত্রে, আরেকটা হচ্ছে নির্দেশনার ক্ষেত্রে...আমি একটু আলাদাভাবেই বলি। ওনার লেখার সাথে আমি খুবই পরিচিত। ওনার লেখা যে পরিবর্তিত হচ্ছিল, সেটা বোঝা গেছে অনেক আগেই। সমতট নামে একটা নাটক উনি লিখেছিলেন। সমতট’র আগ পর্যন্ত তাঁর লেখায় থাকতো একটা জনগোষ্ঠী...একটা জনগোষ্ঠীর উত্থান-পতন। কিন্তু ঐ জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকটা মানুষ যে আলাদা, তাদের যে আলাদা আলাদা ভাবনাচিন্তা কিংবা আলাদা আলাদা জীবন, এই বিষয়টা সমতট’র আগের নাটকগুলোতে অনুপস্থিত। ওরা কদম আলী, ইবলিশ ইত্যাদি হলো ঐ ঘরানার নাটক। সমতট, আদিম, জয়জয়ন্তী এবং সঙক্রান্তি হলো ঐ ধরনের নাটক যেগুলোতে আমি মনে করি ইনডিভিজ্যুয়াল মানুষের জীবনটা এসেছে। এবং এই সঙক্রান্তিতে এসে...লেখার ক্ষেত্রে আমার যেটা মনে হয়েছে...আমি বাচ্চুভাই এবং আতাভাইয়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই, মামুনভাই আস্তে আস্তে ডেভালপ করছে। ডেভালপ করছে এই সেন্সে যে, আগে ওনার নাটক দেখলে মনে হতো যে উনি থিয়েটার করছেন, লিটারেচারটা উপেক্ষিত থাকতো। এখন আমার মনে হচ্ছে ওনার লেখা ক্রমশ লিটারেচার হয়ে উঠছে। যেমন, সঙক্রান্তিতে আমি দেখেছি সিম্বলিজমের ব্যবহার হয়েছে। টেক্সটের কথাই বলছি আমি। একটা জনগোষ্ঠীর কথাই উনি বলছেন, সঙদের কথা, অথচ সঙদের সঙকে উনি দেখাতে চান নি। উনি চেয়েছেন তাদের অন্য একটা জীবন দেখাতে, তাদের অন্য রুচির ব্যাপারটা দেখাতে চেয়েছেন। এই নাটকের প্রত্যেকটা চরিত্রকে আমার পূর্ণাঙ্গ মানুষ মনে হয়েছে, অথচ তারা একই গোত্রের। যেমন এই নাটকে গফুরকে দেখা যাচ্ছে যে, তার স্ত্রীর সন্তান হবে, আবার ঐ স্ত্রীরই একটা মাত্র মুরগী আছে, এই ব্যাপারটা দেখানো হচ্ছে। আরেকটা চরিত্রের একটা ট্র্যাম্প্যাট আছে, ঐ ট্র্যাম্প্যাটের একটা নট ভেঙে যায়...এমন প্রত্যেকটা বিষয়কেই আমার কাছে সিম্বলিক মনে হয়েছে। মামুনভাইয়ের সাথে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে মামুনভাই যতটা লেখেন তারচেয়ে ভালো নির্দেশনা দেন, তারচেয়ে একটু ভালো অভিনয় করেন এবং তারচেয়ে অনেক ভালো বোঝেন। তো এই বোঝাটাতো দেখা যায় না। ওনার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বুঝতে পারতাম যে, উনি থিয়েটারটা বেশ ভালো বোঝেন। আমি ওনার যে শেষের দিকের নাটকগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, সেগুলোর ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, উনি যা বোঝেন এটা নাটকের মাধ্যমেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।
নির্দেশনার ব্যাপারে আমার যেটা মনে হয়েছে, নির্দেশনার সময় অনেক কিছু ভাবা হয় যে, এই সংলাপটা এভাবে বলবো কিংবা এটা ওভাবে প্রকাশ করবো...ইত্যাদি যে প্যাঁচগুলো আছে, সেই প্যাঁচগুলোর মধ্যে উনি ঢোকেন নি। সহজ কথাকে কঠিনভাবে বলানোর ঝামেলায় উনি যান নি। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে ফর্ম এবং কনটেন্টে খুব একটা বেগ ওনাকে পেতে হয় নি। উনি সহজভাবে বলতে চেয়েছিলেন, এবং নাটকটা দেখার পর মনে হয়েছে সহজ কাজটা উনি করতে পেরেছিলেন। কিছু কিছু জায়গায় অন্য নাটকের প্রভাব পেয়েছি। এটা একান্তই আমার মনে হওয়ার ব্যাপারটা বলছি। কিছু কিছু জায়গায় কিনু কাহারের থেটার বা চরণদাস চোর নাটকের প্রভাব দেখতে পেয়েছি। এটা ওনার সচেতন প্রয়াস না-ও হতে পারে। আমার কাছে সবচেয়ে পজেটিভ যেটা মনে হয়েছে...মামুনভাইয়ের নাটকে এক ধরনের মেলোড্রামা থাকে, এটা মামুনভাই পছন্দও করেন...কিন্তু এই নাটকের বেলায় আমি সেটা প্রত্যক্ষ করি নি। এবং প্রচ- বাস্তবতাজনিত কিছু দোষে দুষ্ট যে ব্যাপারটা থাকে, সেটার বাইরে এসে, কিছু প্রতীক, কিছু মেটাফোর, কিছু সিম্বলিজম, কিছু সাইলেন্স...এসব দিয়ে বাস্তবতার বাইরে বেরিয়ে এসে কিছু কাজ করেছেন বলে আমি মনে করি। তারপরও ‘আরণ্যকে’র প্রযোজনার একটা নির্দিষ্ট ধারা তৈরি হয়েছে, কিছু চিন্তাভাবনার উপস্থিতি থাকে...যেমন শ্রেণিসংগ্রামের কথা ইত্যাদি...এই ধারাটা কখনো কখনো না চাইলেও এসে ভর করে। এই ভর করাটা কখনো কখনো শাপে বর হয়। কিন্তু সঙক্রান্তির ব্যাপারে আমার মনে হয়েছে দু-একটা জায়গায় শাপে বর হয় নি। সেসব জায়গাগুলোতে শিল্পমান কিছুটা ক্ষুণœ হয়েছে বলে আমি মনে করি। পরে আবার অন্য প্রসঙ্গে বলবো।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি এখানে পাভেলের সাথে একটু ডিফার করি। আমার মনে হয়েছে মামুনভাইয়ের ওরা কদম আলী বা এসব নাটকগুলোতে চরিত্র নেই বা চরিত্রে গভীরতা নেই এটা মেনে নেয়া যায় না। সমতট থেকে শুরু হয়েছে তা না। মামুনভাইয়ের নাটকের গভীরতা কিন্তু আগের নাটক থেকেই শুরু হয়েছে। পাভেলের সাথে আমি একটু যোগ করবো যে, একটা নাটকে অনেক চরিত্র থাকে এবং তার আশপাশের অনেক ব্যাপার নিয়ে নিয়ে একটা ম্যাপিং হয়। পুরো দেশটার একটা ম্যাপিং হয়। এই জায়গাতে আমার মনে হয়েছে মামুনভাই জয়জয়ন্তীতে এসে একটা বড় ধরনের কাজ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সঙক্রান্তিতে এসে ঐ জায়গাটা আবার হারিয়ে গেছে।
আতাউর রহমান
আমার কাছেও এটা মনে হয়েছে। ওরা কদম আলী আমার কাছে অনেক বড় মাপের কাজ মনে হয়। প্রথম দিকের কাজ হলেও খুব গভীরে যেতে পেরেছিল। স্টোরি লাইন খুব ভালো, পরম্পরা সাংঘাতিক। ওরা কদম আলীতে একজন নির্দেশকের ইন্টারপ্রেটেশনের সুযোগ অত্যন্ত বেশি ছিল। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম যখন ওরা কদম আলী ওয়েস্টে হলো। একজন লোক কথা বলতে পারে না, যেটা আমাদের অপারগতা, না বলা কথা...মানে অনেকগুলো কদম আলী সিম্বল হিসেবে এসেছে। আসলে হি ইজ দ্য গ্রেটেস্ট অ্যালিগরি দ্যাট ওয়াজ এভার ইউজড...অন্তত আমাদের নাট্যসাহিত্যে। প্রতিনিয়ত আমাদের ক্ষোভ হচ্ছে, রাগ হচ্ছে...ওয়ার্কিং পিপলদের তো হচ্ছেই...সেই নাটক যখন ওয়েস্টে হলো তখন মনে হলো সমস্ত তৃতীয় বিশ্বের ক্ষোভ, শোষণের তীব্রতায় শোষিতের যে ক্ষোভ, সেটা প্রতিনিধিত্ব করলো ওরা কদম আলী নাটকের মাধ্যমে। তো আমার কাছে মনে হয়েছে ওরা কদম আলী যে মাপের নাটক সঙক্রান্তি তা নয়। সঙক্রান্তি নাটকে কখনো কখনো ন্যাচারেলিস্টিকের ছোঁয়া পাওয়া গেছে, কখনো রিয়ালিজম, কখনো আবার সুরিয়ালিজমের ছোঁয়া পাওয়া গেছে। একটা মিশ্রণ ছিল। মিশ্রণতো হতেই পারে কিন্তু এই মিশ্রণ সঙক্রান্তির বেলায় ভালো লাগে নি। আর বাচ্চু যেটা বললো যে, সেট, লাইট আর অভিনয় এসব ডিজাইনে সমন্বয়ের অভাব ছিল...আমি তখন সেটা লক্ষ করি নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এমন একটা অসমন্বয় বোধহয় হয়েছে। বাচ্চু বলাতে এটা আমার মনে পড়ছে। তবে সঙক্রান্তির সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো অভিনয় এবং টিমওয়ার্ক। চমৎকার অভিনয় করেছে ছেলেরা। আর মামুন তার দলের জন্য নতুনদের এই উত্থান ঘটাতে পেরেছে। এটা একটা বড় কাজ হয়েছে।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
সঙক্রান্তি আমার কাছে অবভিয়াস মনে হয়েছে।
আতাউর রহমান
প্রেডিক্টেবল মনে হয়েছে।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
যা ঘটছে তা আগে থেকেই জানা মনে হচ্ছে। একজন জোতদার আসবে, তার জন্য একটা চেয়ার আসছে...এগুলো কেমন যেন জানা জানা মনে হয়েছে। অজানা মনে হয় নি।
হাসান শাহরিয়ার
মামুনভাই, আপনি তো শুনলেন...তো আমার মনে হয় একজন শিল্পী অবশ্যই নিজের শিল্পকর্মের খুব বড় সমালোচক। তিনি বুঝতে পারেন তিনি কী সৃষ্টি করলেন। এখানে নাটকের সাহিত্য প্রসঙ্গটা এসেছে। যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নাটককে আমরা খেলাখেলা ভাবতেই আগ্রহী, কিন্তু নাটককে যে সাহিত্য হতে হয় সেটা প্রায়শই উপেক্ষিত। তো আলোচনায় এসেছে যে, আপনার নাটক আগে সাহিত্য ছিল না, এখন সাহিত্য হচ্ছে। আবার এর উল্টো আলোচনাও আসলো যে, পূর্বেই আপনার নাটক সাহিত্য হয়েছিল, সঙক্রান্তিতে এসে বাধা পেল। আপনার আত্মসমালোচনাটা শুনতে চাই।
মামুনুর রশীদ
আমার আত্মসমালোচনাটা আসলে আমার রিয়েলাইজেশন। সেটা হলো, একটা সময় থিয়েটারকে আমি খুব কালেক্টিভ মনে করতাম। গোত্র, সম্প্রদায় এভাবেই ভাবতাম। কিন্তু পরবর্তীসময়ে আমার মনে হয়েছে, ব্যক্তিও ইম্পর্টেন্ট। যে কারণে সঙক্রান্তিতে কিন্তু ব্যক্তির ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি ব্যক্তি তার ইন্টারেস্ট দিয়ে, আবেগ দিয়ে কিন্তু আলাদা। এখন বাংলার জনপদ নিয়ে, আমাদের জনপদ নিয়ে যদি আমি নাটক লিখি বা করি তাহলে সেটা অবভিয়াস মনে হতেই পারে। সেটা আমি কোনো সমস্যা মনে করি না। কিন্তু আমি যেভাবে উপস্থাপন করলাম, সেই উপস্থাপনটা সমকালীন কিনা, সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমার প্রেজেন্টেশন যদি কখনো স্লানিস্লাভস্কির স্কুলের মতো মনে হয়, আবার যদি মনে হয় আমি ওখান থেকে ডেভিয়েট করেছি...আসলে আমি ন্যাচারেলিস্টিক রীতি থেকে মুক্তিও চাচ্ছি।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
কিন্তু বেশিরভাগ ওদিকেই গেছে।
মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ গেছে, কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি...এক্সট্রিমলি অপজিটে যাই নি...আমার যে রিসোর্স, সেটা নিয়ে আমি আসলে...মানে সীমাবদ্ধতা ছিল।
আতাউর রহমান
আমি দুটো জায়গায় একটু কন্ট্রাডিক্ট করবো। ঠিক কন্ট্রাডিক্ট না...মানে, মামুন আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, আপনি এই নাটকে ব্যক্তির উপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু আমি মনে করি আপনার ওরা কদম আলী বা অন্যান্য নাটকেও ব্যক্তিই প্রধান ছিল। কারণ, ব্যক্তিইতো সমাজ তৈরি করে, দেশ তৈরি করে। তাহলে সেটাকে আপনি ইগনোর করবেন কী করে? সুতরাং কেবল এই নাটকেই আপনি ব্যক্তির উপর জোর দিয়েছেন তা কিন্তু না।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
মামুনভাই, একটা বিষয়ে একটু বলি...সেটা হলো একটা চরিত্র যে ট্র্যাম্প্যাট ব্যবহার করে, সেই ট্র্যাম্প্যাটটা কিন্তু পুরো সমাজের একটা সুর হতে পারতো, কণ্ঠস্বর হতে পারতো। আমি ভেবেছিলামও তাই, কিন্তু এটা শেষপর্যন্ত নাটকটাকে খুব বড় জায়গায় নিয়ে যায় না। সেটা দুটো কারণে হতে পারে। স্ত্রিপ্টে কী আছে আমি জানি না...নাটক দেখে মনে হলো, যে অভিনয় করেছে, সেই অভিনেতা এটাকে ব্যবহার করতে গিয়ে, প্রপস হ্যান্ডেলিং-এ...মানে অভিনয়ে টোটালি ফেল করেছে বলে মনে হয়েছে। এত বেশি ওভার ডুয়িং বা নির্দেশক হিসেবে আপনি এত বেশি ওভার ডুয়িং করিয়েছেন যে, পুরো ব্যাপারটা একটা সাবজেক্টিভ জায়গায় চলে আসলো।
আতাউর রহমান
এটা আসলে মামুন বোধহয় যেটা করতে চেয়েছেন, ট্র্যাম্প্যাট নিয়ে যাওয়া মানে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, সর্বহারা হয়ে যাওয়া। কৃষকের যেমন গরু চলে যাওয়া মানে সব চলে যাওয়া, ঠিক তেমনি তার ট্র্যাম্প্যাট নিয়ে যাওয়া। তো এই জায়গায় আমি ভেবেছিলাম, সর্বহারার চিত্রটা...
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
শুধু খাদ্য না, আমাদের জীবনে শিল্পটা কত বড় গুরুত্বপূর্ণ, সেটা উঠে আসার সম্ভাবনা জেগেছিল। কিন্তু ওনার ওভার ডুয়িং-এর ফলে সেটা হারিয়ে গেল।
আতাউর রহমান
একজন গায়কের গান কেড়ে নিলে তার আর কী থাকে? মামুন আপনি সে জায়গাটাতেই যেতে চেয়েছিলেন, কোথায় যেন কী সমস্যার কারণে সেখানে যাওয়া যায় নি।
মামুনুর রশীদ
আমি কিন্তু গফুরের বেলায় সেটা করতে চেয়েছি। ওর যখন গরুটা মরে যায়, যেটা মঞ্চে কখনো আসে না, সেই গরু চলে যাওয়ায় যে নিঃস্ব হওয়া, সেটা আনতে চেয়েছিলাম। হতে পারে তার অভিনয়ের কম পারদর্শিতার ফলে বা যেকোনো কারণেই হোক চরিত্রটা ওয়ান ডাইমেনশনাল হয়ে গেছে।
আতাউর রহমান
তবে একটা খুব বড় ব্যাপার আপনি অ্যাচিভ করেছেন, সেটা হলো আমরা শিল্পী বললেই কিন্তু ধরে নিই আয়েশি মানুষ, সুশীল সমাজের মানুষ ইত্যাদি...কিন্তু আপনি দেখিয়েছেন যে, শিল্পী নিজেও কিন্তু ওয়ার্কিং ক্লাসের মানুষ। সেও কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ। আরেকটা জিনিস...পরে আবার ভুলে যাবো, সেটা হলো আগে যে প্রসঙ্গটা এসেছিল, স্তানিস্লাভস্কি বা ব্রেখটিয় মেথড ইত্যাদি মাথায় রেখে কিন্তু শিল্পী কাজ করে না। আমার মনে হয় না যে, কোনো ক্রিয়েটিভ লোক এগুলোর ব্লুপ্রিন্ট মাথায় রেখে কাজ করতে পারে। ইট কামস অটোমেটিক্যালি।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমার মনে হয় মাথায় রাখতে হয়। তা না হলে সমস্যা হয়। সঙক্রান্তির উদাহরণ দিয়েই বলি...সঙক্রান্তির টিমওয়ার্ক নিয়ে যদি বলতে হয় তাহলে আজকের গ্রুপ থিয়েটারের যে সংকট, সেই সংকটকালে একেবারে নবীন অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে মামুনুর রশীদ যে কাজটি বের করেছেন, সেটা খুবই ইতিবাচক। দলগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অভিনয়ের কথা যদি বলি, অভিনয়ের যে ছকটা আমি পেলাম, সেটা আমার কাছে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলানাটকের অভিনয় মনে হয়েছে। আমার কাছে খুবই স্থূল কাজ মনে হয়েছে, অভিনয়টা...
আজাদ আবুল কালাম
অভিনয়ের ব্যাপারে বাচ্চুভাইয়ের সাথে আমি একটু দ্বিমত পোষণ করি। আমার কথা হচ্ছে সঙক্রান্তিতে যে জনগোষ্ঠীর উপর কাজ করা হয়েছে তাদের জীবনাচরণ তাদের কাছে থেকে দেখলে একরকম মনে হবে, আবার দূর থেকে, এই শহর থেকে দেখলে একরকম মনে হবে। মামুনভাই সঙদের নিয়ে কাজ করবেন এটা আমি আগে থেকেই জানতাম। আমি যখন মামুনভাইয়ের সাথে কাজ করতাম তখন থেকেই জানতাম। ফলে এই লোকগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। এবং তাদের প্রাত্যহিকজীবনের আচরণ দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। সেখানে আমি লক্ষ করেছি যে, তাদের প্রাত্যহিকআচরণ অন্য একজন কৃষকের মতো না। সে নিজেও কৃষক কিন্তু তার আচরণ অন্য কৃষকের মতো না। এদের কাজে বা কথায় অনেক বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাপার লক্ষ করা যায়। তো এখানে যারা অভিনয় করেছেন, তারাও ঐ জীবনাচরণ প্রত্যক্ষ করেছেন। ফলে আমরা যতই বলি না কেন, বাস্তবতার বাইরে গিয়ে অভিনয় করবার জন্য, কিন্তু এই নাটকের অভিনেতারা আমাদের প্রচলিত মেথডের বাইরে গিয়ে তাদের জীবনকে তুলে এনেছেন...ফলে আমার কখনো তাদের অভিনয়কে ঊনবিংশ শতকের বলে মনে হয় নি। মনে হয়েছে এখনকার আধুনিক অভিনেতারা আধুনিকভাবেই অভিনয় করেছেন।
মামুনুর রশীদ
না, কিন্তু তাদের অভিনয় যদি ঊনবিংশ শতকীয় হয়ও, তাতেই বা দোষ কী? হোয়াট ইজ দি হার্ম? বাচ্চুর কাছে আমার প্রশ্ন।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি কিন্তু আমার কথা শেষ করতে পারি নি। পাভেল শুরু করে দিয়েছিল। আমি দোষের কথা বলছি না। আমি বলছি অভিনেতার কাজ না যে সে যা দেখলো তাকে অনুকরণ করা। তাই না? আমি যদিও শহরে বড় হয়েছি, কিন্তু নাটকের জন্য আমাকে প্রচুর সময় গ্রামেই থাকতে হয়। আমার কিন্তু সঙ দেখার অভিজ্ঞতা ভিন্ন রকমের। আমি অনেক শান্ত সঙ দেখেছি, আবার শার্প সঙ দেখেছি। কিন্তু আপনার নাটকে মনে হয়েছে সঙ মানেই একটু ফান করবে। আমি যে কারণে কথাটা বললাম সেটা হলো, এই নাটকে গফুর বা জোতদারের চরিত্রে যে অভিনয় করলো, হাসান বা মুন্না, ওরা কিন্তু একটা টিপিক্যাল ধারায় একটা চরিত্র ধারণ করে অভিনয় করছিল। এবং এরকম ধারা কিন্তু পাঁচ/দশ মিনিট ভালো লাগে। তারপর কিন্তু আর ভালো লাগে না।
মামুনুর রশীদ
তোমার কি কখনো মনে হয়েছে যে, যারা সঙ করছে তাদের ছাড়া অন্য যেসব চরিত্র ছিল, যেমন, জোতদার বা পলিটিশিয়ান, এরা আরও বেশি সঙ-এর মতো করেছে?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ।
আতাউর রহমান
এখানে আমার একটা কথা আছে, সেটা হলো, আমরা মাঝে মাঝে কোনো নেগেটিভ চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য বেশি করে কেরিক্যাচার করে থাকি। কিন্তু আমরা যদি নিজামীর (রাজাকার নিজামী, যিনি বর্তমানে (২০০২) মন্ত্রীপরিষদের সদস্য) কথা শুনি, বক্তৃতা শুনি, তাহলে দেখবো কত পোলাইটলি, কত মোলায়েমভাবে তিনি কথা বলছেন। তো আসলে কোনো কোনো শিল্পী চরিত্রের ভিতরের কালোটা বোঝাতে গিয়ে অভিনয়ে অতিরঞ্জন নিয়ে আসে...আসলে...
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি একটু বলি, সেটা হলো শামীম যে চরিত্রটি করছিল সেটাকে আমার কাছে অনেক প্রাণবন্ত মনে হচ্ছিল। অথচ গফুর চরিত্রটি এত কসরৎ করার পরও আমাকে সেভাবে টানছিল না। মানে ’ও নিজস্ব একটা ঢঙ নিয়ে নিয়েছে এবং ঢঙ কিন্তু অভিনয়ের ক্ষতি করে...যেটা আরও অনেকে নিয়েছে...
হাসান শাহরিয়ার
একটা কথা বলি, তা নাহলে সেটা আবার হারিয়ে যাবে...মামুনভাই, একটা প্রসঙ্গ এসেছিল, সেটা হলো শুধু খাওয়া-পরাটাই মানুষের সব কিছু না...তার একটা কালচার থাকতে হয়, সংস্কৃতি থাকতে হয়...
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি একটু আগে সেটাই বলেছি।
হাসান শাহরিয়ার
হ্যাঁ, এবং মামুনভাইও এটা সব সময় বলে থাকেন। জীবিকার-তাগিদই তো সব না, জীবনের-তাগিদ বলেও তো একটা কথা থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে গফুরের গরু মারা যাওয়ায় যে ক্রাইসিস তৈরি হয়, ঠিক একই ক্রাইসিস কিন্তু তৈরি হওয়া উচিত আরেকটা চরিত্রের ট্র্যাম্প্যাট কেড়ে নেয়ার কারণে। কিন্তু আমরা লক্ষ করি, গফুরের ক্রাইসিসটা যত হাইলাইটেড, অন্য চরিত্রের ক্রাইসিস ততটা নয়। কেন?
আজাদ আবুল কালাম
মামুনভাইয়ের আগে আমার এখানে একটু বলার আছে। যখন নাটকটা শুরু হয় তখন আমরা দেখি যে, একটা গরুর সাথে গফুর চরিত্রটা একটা প্লে করছে। অর্থাৎ নাটকটা শুরু হয় একটা গরু ও একটা মানুষ দিয়ে। তারপর কিন্তু অনেক এলিমেন্টস যোগ হতে থাকে। ট্র্যাম্প্যাট, মুরগী...ইত্যাদি। তো এদের মধ্যে কখনো ট্র্যাম্প্যাটটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল, আবার কখনো হয়তো-বা মুরগীটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। কখনো আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল নেতার আগমন এবং তাদের যে প্রতীক্ষা। এই প্রতীক্ষা করতে করতে তাদের যে ক্ষুধা পেয়ে গেল সেটাও কিন্তু স্বাভাবিক। তো এভাবে সবগুলো উপাদান যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই কিছু উপাদান তো হারিয়ে যাবেই। নাটকটি তো ওয়েস্টার্ন ফর্মে লেখা, সুতরাং ক্লাইমেক্স বলি বা ক্যাথারসিস বলি এই ব্যাপারগুলো এই ফর্মে আসবে এবং সেজন্যই কিছু কিছু উপাদান হারিয়ে যাবেই। নাটক দেখার সময় আমি সব সময় চেষ্টা করি যে, আমি ইনভলব হবো না, ইমোশনালি ইনভলব হবো না। কিন্তু এই নাটকটা দেখতে দেখতে আমি কিন্তু ইমোশনালি ইনভলব হয়েছিলাম। অভিনেতাদের মিলিত অভিনয়টা কিন্তু আমাকে দাগ কেটেছে। এমনিতে প্রত্যেকটা অভিনেতা-অভিনেত্রীই আলাদা আলাদাভাবে হয়তো টাইপড ছিল, কিন্তু...
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
পাভেল, এ জায়গাটাকে তুমি কীভাবে দেখছো যে, গফুর শুরুতে একটা মাইম করে গরু নিয়ে আসে এবং সেই গফুরই একেবারে রিয়ালিস্টিক একটা চরিত্র নিয়ে এলো। তো তুমি কি মনে করো না যে, এটা একটা চরিত্র বিল্ডিং-এর জন্য বাধা হয়েছে?
আজাদ আবুল কালাম
অবশ্যই, যখন আমি কিছু করবার জন্য টিপিক্যাল কিছু একটা নেব, শরীরের ভেতর, অভিনয় করার জন্য...তখন পরবর্তীসময়ে চরিত্রনির্মাণে কিছুটা বাধা আসবেই। কিন্তু আমার আরেকটা জিনিস মনে হয়েছে...এই অভিনেতাদের...শহুরে-অভিনেতাদের যে অভিজ্ঞতা, সেটা থেকে ঐ জীবনের, সঙদের জীবনের যে ব্যাপ্তি সেটাকে ধরার মতো দক্ষতা তাদের আছে কিনা সেটার ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যার জন্য হচ্ছে কী, তারা এক ধরনের...মানে পলায়নপর ছিল, সে কারণেই তারা হয়তো এক ধরনের টাইপ নিয়েছে এবং প্রত্যেকে টাইপ নেয়াতে যে টোটাল থিয়েটারটা দাঁড়িয়েছে, সেটাকে কিন্তু আমার কাছে একসূত্রে গাঁথা মনে হয়েছে।
মামুনুর রশীদ
বাচ্চুর কথার সূত্র ধরে আমি বলি, বাচ্চু খুব সেনসেটিভ একটা পয়েন্ট ধরেছে, সেটা হলো ট্র্যাম্প্যাটের ব্যাপারটা। ট্র্যাম্প্যাট নিয়ে কিন্তু আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, সেটা হলো ট্র্যাম্প্যাটটা কিন্তু পুরো নাটককে ধ্বংস করে দিতে পারতো।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
সত্যিই তো। এই ট্র্যাম্প্যাটটার ফেইলিওরের জন্য আমার কাছে মনে হয়েছে, পুরো নাটকটা ব্যর্থ হয়েছে।
মামুনুর রশীদ
না, আমি যদি ট্র্যাম্প্যাটটা নিয়ে আরও বাড়াবাড়ি করতাম...
আতাউর রহমান
না, আপনি যতটুকু করেছেন ততটুকুতে সে কিন্তু মনে দাগ লাগাতে পারে নি। যদি সে বিঠোফেনের মতো বাজাতো, আমরা মন ভরে উপভোগ করতাম।
মামুনুর রশীদ
বাজাবে কোত্থেকে! সে তো ভালোমতো ‘সাড়ে আট’ই লাগাতে পারে না, সুর লাগাতে পারে না, তাল কাটে...
আজাদ আবুল কালাম
এ ব্যাপারে মামুনভাইয়ের কাছে আমি জানতে চাচ্ছি, সেটা হলো আপনি নাটকটা লিখেছেন এবং নির্দেশনাও দিয়েছেন, তো দুটি সত্তা। লেখক হিসেবে এক ধরনের ইন্টারপ্রেটেশন আবার নির্দেশক হিসেবে এক ধরনের ইন্টারপ্রেটেশন থাকার কথা। তো আমার কাছে মনে হয়েছে, লেখক নির্দেশককে এত ডমিনেট করেছে যে, অভিনেতাদের কাছ থেকে আরও কিছু বের করে নেয়াটাতে আপনি বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। মানে আপনার এমনটা মনে হয়েছে কিনা?
মামুনুর রশীদ
না, আমার কিন্তু এমনটা মনে হয় নি। আমার তো স্বাধীনতা ছিলই। আমারই তো টেক্সট। তবে একটা ব্যাপার কী, থিয়েটারের লোক হিসেবে তোমরা অবশ্যই বুঝতে পারছো যে, এই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে তো আমাকে স্ট্রাগল করতে হয়েছে। কখনো ন্যাচারেলিস্টিক, কখনো আবার স্টাইলাইজেশন এমন বিভিন্ন ফর্ম কিন্তু নাটকটাতে আছে। সেক্ষেত্রে তাদেরকে দিয়ে, এমন একটা নবীন টিমকে দিয়ে, ব্যাপারগুলো বের করে আনতে কিন্তু একটা স্ট্রাগল আমাকে করতে হয়েছে।
আজাদ আবুল কালাম
হ্যাঁ, কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, যে টাইপড ব্যাপারটা প্রত্যেকটা অভিনেতা আনতে চেয়েছে এবং পেরেছে, সে ক্ষেত্রে আপনার অভিনয়টা বরং আমার কাছে...মানে আপনি যে ডিজাইন করেছেন সেই ডিজাইনে আপনি পড়েন নি বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
না, আমি কিন্তু মামুনভাইয়ের অভিনয়টাতে মেধার উপস্থিতি পেয়েছি...
আতাউর রহমান
আমার কাছে পাভেলের কথাটাই সত্য মনে হয়, সেটা হলো ওর (মামুনুর রশীদের) অভিনয় নিয়ে তো প্রশ্ন নেই, কিন্তু ওর ডিজাইনের সাথে ’ও নিজেই খাপ খায় নি।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
মামুনভাইয়ের অভিনয়ে এক ধরনের কেয়ারফুল্লি কেয়ারলেস ভাব থাকে, এবং সেটা আমার ভালো লাগে। কিন্তু সব জায়গায় স্টাইলাইজেশন থাকাতে মামুনুর রশীদের...
আজাদ আবুল কালাম
বাচ্চুভাই, এখানে যারা অভিনয় করেছে তাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা এই প্রথমবার মঞ্চে উঠলো বা এই প্রথম কোনো বড় চরিত্রে অভিনয় করলো।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি তাদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। ‘আরণ্যকে’র এই নবীন দলটির অ্যাচিভমেন্ট নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু গফুর যখন মাইম ছেড়ে একেবারে একটি সাধারণ-চরিত্র হয়ে যায়, তখন আমি ঠিক বুঝতে পারি নি মামুনভাই কী ডিজাইন করতে চেয়েছিলেন। এই জায়গাগুলোই আমার কাছে খটকা লেগেছে।
হাসান শাহরিয়ার
আচ্ছা আমরা একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। সেটা হলো কোনো কোনো দর্শকের আমি কিছু অভিমত নিয়েছিলাম...তো তাদের কেউ কেউ বলেছে, নাটকটা যেহেতু সঙদের জীবন নিয়ে, সেজন্য তাদের প্রত্যাশা ছিল সঙদের জীবনের ব্যাপারটা বেশি করে দেখানো হবে। কিন্তু সঙদের জীবনের চেয়ে সঙদের কার্যকলাপ বা ক্রিয়া অর্থাৎ সঙ সেজে তারা কী করে সেই দিকটা বেশি করে দেখানো হয়েছে। তো এই অভিমতের ব্যাপারে আপনারাও কি একমত?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
না, আমি একমত নই। যা দেখানো হয়েছে, আমার সেটা বরং ভালো লেগেছে। এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যেটুকু করেছে তাতে আমি খুশি।
আতাউর রহমান
আমার দেখার বিষয় হচ্ছে, তাদের জীবনের যে বেদনাটা দেখাতে চাওয়া হয়েছে সেটা দেখানো গেল কিনা। সে হিসেবে আমার কাছে সঙদের কার্যকলাপগুলো ইন্টারেস্টিং লেগেছে। এবং বেশি ভালো লেগেছে এই জন্য যে, সঙদের জীবন আগে আমার দেখা ছিল না। এই নাটকের মাধ্যমে দেখা হলো।
আজাদ আবুল কালাম
আমার কাছেও তাই। যেটুকু দেখানোর দরকার ছিল ততটুকুই দেখানো হয়েছে বলে আমার ধারণা।
হাসান শাহরিয়ার
তার অর্থ দাঁড়ায়, সঙদের কার্যকলাপ বা ক্রিয়াপ্রদর্শনে পরিমিতিবোধ ছিল। এখন এই নাটকের অন্য ডিজাইনের বিষয়ে আলোচনায় যাই। বাচ্চুভাই বলতে চেয়েছিলেন, পোশাক-সেট-আলোকপরিকল্পনায় কিছুটা অসঙ্গতি লক্ষ করেছেন...কী রকম?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি বলেছি সেট ডিজাইনটা স্টাইলাইজেশন, কস্টিউমটা পুরোপুরি ন্যাচারেলিস্টিক বা রিয়ালিস্টিক এবং অভিনয়টা এগুলোর মিশেল। ফলে সমস্ত ব্যাপারটা কখনো যায়, আবার কখনো যায় না। যেমন, সেটটার নিচের অংশটা যেমন যায়, কিন্তু ভার্টিক্যাল অংশটা মনে হচ্ছে যায় না। বোঝা যাচ্ছে খুব চওড়া রঙ দেয়া হয়েছে, ইচ্ছা করেই। আবার যখন চেয়ারটা আসছে সেটা আবার একেবারেই রিয়ালিস্টিক। এই জন্য কেমন অসঙ্গতি...মানে আমার কাছে মনে হয়েছে। এটা একেবারেই আমার মতামত। অন্যদের সাথে না-ও মিলতে পারে।
মামুনুর রশীদ
আমি কিন্তু পুরো নাটকে একটা ডিজাইন অ্যাডাপ্ট করি নি। যেমন, প্রপসগুলো সব রিয়ালিস্টিক। চেয়ার, দড়ি, লাঠি...সব কিন্তু রিয়ালিস্টিক। আবার কস্টিউমও কিন্তু তাই। কোঅর্ডিনেশনের অভাবটা ধরা পড়ে এদের সাথে সেটের। এখন সেটের ব্যাপারে আমি একেবারেই রবীন্দ্রনাথের ধারায় বিশ^াসী। আমি সেট পরিহার করতে চেয়েছিলাম। পেছনে আমি যেটা করতে চেয়েছিলাম, সেটা হচ্ছে ‘রঙ’, একটা কালার...জীবনের একটা রঙ দেখাতে চেয়েছিলাম। এটা হচ্ছে তাদের স্বপ্ন। তো আমার মনে হয়, তোমার (বাচ্চু) যদি মনে হয়ে থাকে যে, কোঅর্ডিনেশন হচ্ছে না, তাহলে আমি বলবো সেটাই হচ্ছে ইনডিরেক্টলি একটা সাকসেস। জীবনের ঐ রঙটার সাথে তাদের একটা কন্টিনিউয়াস বিরোধ লেগেই আছে...
আজাদ আবুল কালাম
এক্ষেত্রে আমার একটা জিনিস মনে হচ্ছে, নাটক শুরু হওয়ার আগে আমরা তো সেটটা দেখিÑতাই না? এক্ষেত্রে যেটা ঝামেলা হয়, আমরা বসেই দেখি মঞ্চে একটা লাইট, দেখা যাচ্ছে একটা কাকতাড়–য়া আর লাল রঙ। আমার কাছে কিন্তু ন্যাচারেলিস্টিক কিছু মনে হয় না। আমার কাছে মনে হয় সিম্বলিক, সুরিয়ালিস্টিক কিছু...
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
তোমার সাথে আমি একেবারে একমত।
আজাদ আবুল কালাম
ওটা মনে হওয়ার পর আমি ভাবলাম মামুনভাই কী যেন একটা করবে। কিন্তু পরে যে ধারার অভিনয় হলো, তাতে কিন্তু সেটের সাথে একটা দ্বন্দ্বই দেখতে পেলাম। তো যদি মামুনভাই প্রকৃতঅর্থেই সেটের সাথে অভিনয়ের বিরোধ দেখাতে চেয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে আমি বলবো দর্শক হিসেবে আমাদের মনে খটকা লেগেছে।
আতাউর রহমান
তবে মামুন সাহেব যদি প্রকৃতঅর্থে এমন কিছু দেখাতে চেয়ে থাকেন, যেমনটা আমরা অ্যাবসার্ড নাটকে দেখে থাকি...কিছুতেই যেন কিছু মিলছে না...এমনটা অ্যাবসার্ড নাটকে হয়, সব কিছুই কেমন যেন আউট অব হারমোনি...তো সে রকম হয়ে থাকলে উনি সাকসেসফুল। তবে রঙটা বেশি কটকটে হয়ে গেছে, এ কথা আমি বলবো।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আউট অব হারমোনিরও কিন্তু একটা হারমোনি আছে আতাভাই। বিশৃঙ্খলারও কিন্তু একটা শৃঙ্খলা আছে। যদি ওটা অ্যাবসার্ড কিছু হয়, তবে কস্টিউমের বেলায় কেন এত সাদামাটা দিকে গেলেন?
মামুনুর রশীদ
খুব সাদামাটার দিকে যাই নি বোধহয়।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
ধরুন গফুরের কস্টিউম। একেবারেই রিয়ালিস্টিক। সেটের সাথে মিলিয়ে কিছুটা হলেও...
মামুনুর রশীদ
আমি একটু মনে করিয়ে দিতে চাই...যখন সঙের অভিনয় হচ্ছে, মেকআপ নিচ্ছে তখন কিন্তু সেটটা ওয়ার্ক করছে। কিন্তু যখন ন্যাচারেল অভিনয় হচ্ছে তখন আবার সেটটা ওয়ার্ক করছে না। তাহলে ওদের জীবনের রঙ কোনটা? এই দুই রঙের পার্থক্যটা ধরতে যদি অসুবিধা হয়ে থাকে তবে আমি বলবো এখানে মঞ্চের একটা সমস্যা আছে। নাটকের লাইট ডিজাইনে আমি স্পষ্ট বলেছি, পুরো নাটকে মঞ্চের মতো করে দর্শকের উপরও আলো পড়বে। এই নাটকটা যখন ‘নাটম-লে’ হয়েছে তখন এই কাজটি করা গেছে। কিন্তু ‘গাইড হাউজে’ সেটা পারি নি। দর্শকের আলো ছড়িয়ে যায়। তোমার চোখের উপর যদি সার্বক্ষণিক আলো পড়তো, তাহলে পেছনের ঐ রঙটা হয়তো এত কটকটে লাগতো না। এমনকি যদি ‘মহিলা সমিতি’তেও দেখার সুযোগ হয় তবে তুমি অবশ্যই রিথিং করবে বলে আমার বিশ^াস।
আতাউর রহমান
তবে প্রথমদৃশ্যটি আমার প্রত্যাশা, নাটকটির প্রতি প্রত্যাশা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। যখন গায়েন দল প্র্যাকটিস করছে...মানে বিগিনিং ওয়াজ...মানে আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু ঠিক সেই প্রত্যাশাপূরণ শেষঅব্দি হয় নি।
আজাদ আবুল কালাম
আরেকটা দিক আমার কাছে মনে হয়েছে, গফুরের স্ত্রী যে সম্ভাবনা নিয়ে নাটকটিতে আবির্ভূত হয়েছিল, শেষপর্যন্ত কিন্তু সেই সম্ভাবনাটা বিকাশ লাভ করে নি। এমনকি যখন তার ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যায়, তখন যে আবেগটা দর্শকের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়ার কথা ছিল, সেটাও কেমন যেন পূর্ণতা পায় নি।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, কথাটা সত্য। কিন্তু এ-ও সত্য যে, নাটকের সব চরিত্রই শেষপর্যন্ত পূর্ণতা পাবে এমন কোনো কথা নেই। কিছু কিছু চরিত্র হারিয়ে যেতেই পারে। তবে এই চরিত্রটি নিয়ে আমার কথা হচ্ছে...লেখার দিক থেকে ঠিক আছে, কিন্তু অভিনয়ে চরিত্রটি মার খেয়েছে। এই যে পূর্ণতা পায় নি তার অধিকাংশ দায়ভার আমার কাছে মনে হয়েছে অভিনেত্রীর ব্যর্থতা।
হাসান শাহরিয়ার
আমি একটু আবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। আজকের আলোচকবৃন্দের সবাই আমাদের মঞ্চের প্রধান প্রধান নির্দেশক। তো সে জন্যই এই প্রসঙ্গ তুলছি। আমরা জানি, একটি চরিত্র ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারে অভিনেতৃদের সহজাত অভিনয়ক্ষমতা যেমন প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনি প্রয়োজন হয় তাদের মেধা-মনন-অভিজ্ঞতার। তো আমরা এখানে সবাই স্বীকার করেছি, ‘আরণ্যক’ এবং মামুনভাই একটা নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের দিয়ে একটা ভালো কাজ করেছেন এবং তাদের টিমওয়ার্ক ইজ এক্সেলেন্ট। এবং তাদের অভিনয় ঘাটতি তেমনভাবে চোখে পড়ে নি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে...যেহেতু ‘আরণ্যক নাট্যদল’ সম্পর্কে আমরা সবাই খুব ভালো জানি...সেজন্য বলছি, এমন কি মনে হয়েছে যে, মামুনভাই যদি পুরোনো অভিজ্ঞ পারফরমারদের দিয়ে নাটকটা নামাতেন, যেমন; বাবুভাই, দুলালভাই, তুষারভাই, আমিন আজাদ, তমালিকা কর্মকার, হাকিমভাই...তো তাদের দিয়ে কাজটা করলে কি বেটার কিছু পেতে পারতাম বলে আপনাদের মনে হয়?
আজাদ আবুল কালাম
না, আমার কাছে একবারও তা মনে হয় নি।
আতাউর রহমান
না, নাটকটার অনেক দিক হয়তো সমালোচিত হচ্ছে বা হবে, কিন্তু নতুন একটি দলকে দিয়ে মামুন যে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিং করিয়েছেন তাতে আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট সেটিসফাইড।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমার কাছে মনে হয়েছে সাংগঠনিক শক্তিটা প্রকাশ পেয়েছে। শৈল্পীকশক্তিটা ভবিষ্যতে প্রকাশ পাবে। আরও কয়েকটা শো হয়ে গেলেই তা চলে আসবে।
আজাদ আবুল কালাম
একটা ব্যাপার আমি এই নাটকে পেয়েছি, যেটা গত কয়েক বছরে থিয়েটারে পাওয়া যায় না, সেটা হলো শ্রম দিয়ে নাটক করা। এই নাটকটা আমার কাছে ওয়েল রিহার্সড মনে হয়েছে। আর শৈল্পীক দিকের যে কথাটা আসলো, সেটার ব্যাপারে বলি, এই নাটকটা কিন্তু খুব বেশি পরিমানে অভিনয়নির্ভর। ফলে অভিনেতাদের মধ্যে কেউ যখন কোনো একদিন ব্যর্থ হন, সেদিন হয়তো পুরো নাটকটাই ব্যর্থ হয়। কিন্তু পজেটিভ দিকটা হলো, আমাদের দেশে থিয়েটারটা অভিনয়নির্ভর না...কেবল ফর্ম আর টেক্সটের খেলা। অনেকদিন পর আমি একটা অভিনয়নির্ভর প্লে দেখলাম।
হাসান শাহরিয়ার
আমি আর সময় নেবো না। শেষ করার আগে আজকের আলোচকদের কাছে, বরাবরের মতো কয়েকটা পঙ্ক্তি দাবি করবো। সেটা হলো...আমরা থিয়েটার করতে চাই, সেটা করতে গিয়ে ব্যর্থতা আসবে, সাফল্য আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। তো এখন দেশের মঞ্চনাটকের যে একটা সংকট চলছে, অনেক ধরনের সংকট...সাংগঠনিক, কমিটমেন্টর অভাব ইত্যাদি...এতকিছুর মধ্যে ‘আরণ্যকে’র নতুন প্রযোজনা সঙক্রান্তি আমাদের ইতিবাচক কী নির্দেশনা দিল তা বলবার জন্য আমি আপনাদের অনুরোধ করছি। খুব সংক্ষেপে, প্রথমেই পাভেলভাই, আপনি বলুন।
আজাদ আবুল কালাম
বিচ্ছিন্নভাবে আসলে এগুলো আলোচনায় চলে এসেছে। তবুও বলি, এই সময়ে আমরা অনেকেই থিয়েটার করি এই মনে করে যে, একটা দোকান খুলতে হবে, তাই খুললাম। প্রোডাক্টের মান বড় কথা না, দোকান খুলতে হবে তাই খুললাম। সেটার একটা কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশে যাঁরা থিয়েটার বোঝেন, অভিজ্ঞ, তাঁরা আসলে নানা ব্যস্ততার কারণে পরিমান মতো সময় দিতে পারছেন না বা দিচ্ছেন না। সে কারণে ইয়াং জেনারেশন, যারা এখনো সেই পরিমান ব্যস্ত হন নি, তাদের দিয়ে ‘আরণ্যক’ বা মামুনভাই যে কাজটা করলেন তাতে একটা সফলতা এসেছে কিন্তু আমার মনে হয় এই সফলতা দিয়েও থিয়েটার বাঁচানো যাবে না, যদি অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বেশি সময় না দেন।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আজকের আলোচনায় আমি খুব বেশি পরিমানে সমালোচক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি বলে মনে হতে পারে। এজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, ‘থিয়েটারওয়ালা’র মাধ্যমে আমি আমার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছি। অন্য কোনো ফোরামে হলে হয়তো এভাবে বলতাম না...
মামুনুর রশীদ
না না, তুমি তোমার মতামত অবশ্যই ব্যক্ত করবে।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
ধন্যবাদ। শেষমন্তব্য করতে গিয়েও কিন্তু আমার কাছে মনে হয় যে, শিল্পের ব্যাপারে আমি মারসিলেস। নতুন, পুরাতন, রিহার্সেল করতে পারি নি বা টেকনিক্যাল শো করতে পারি নি...এসব কিছুর স্থান শিল্পে নেই বলেই আমার বিশ^াস। তবে ‘আরণ্যক’ নতুনদের দিয়ে যে কাজটা করলো, সেটা করার দরকার ছিল। আমাদের থিয়েটারের জন্যই দরকার ছিল। মামুনভাই নিজে তাদের হাতে যে আলোকবর্তিকা তুলে দিল, সেটা একেবারেই সময়ের দাবি ছিল এবং ‘আরণ্যক’ ও মামুনভাই এই কাজটা অত্যন্ত সফলভাবে করতে পেরেছেন বলে আমার বিশ্বাস। এজন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।
আতাউর রহমান
নিউ জেনারেশনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। তারপরও পাভেল যেটা বললো সেটার সাথে আমি একমত নই যে, পুরাতনরা সময় কম দিচ্ছেন। বরং আমি বলবো, নতুনরাই আজ বেশি পরিমানে ব্যস্ত। আজকে যদি আমার মহড়ায় সাতজন অনুপস্থিত থাকেন, তাদের মধ্যে পাঁচজনই নতুন প্রজন্মের। কেউ শ্যুটিং নিয়ে ব্যস্ত, কেউ এডিটিং নিয়ে ব্যস্ত- ইত্যাদি। তবুও এ কথা সত্য, থিয়েটার আসলে কোনো একক প্রজন্ম দিয়ে চালানো যায় না। সবাইকে নিয়েই থিয়েটারটা চালাতে হয়। সেক্ষেত্রে ‘আরণ্যকে’র সঙক্রান্তি আমাদের আশার আলো দেখায় নিঃসন্দেহে।
মামুনুর রশীদ
আসলে আমরা যারা থিয়েটার করি, তাদেরকে কাজ করে যেতেই হবে। এই কাজে কখনো ব্যর্থতা আসবে, কখনো সফলতা আসবে। সেই কাজের উপর কথাও হবে। আমার যেটা পরিকল্পনা ছিল, একেবারেই ফ্রেশ...মানে এই ব্যাচটাকে দিয়েই আমি কাজটা করবো। যদিও শেষপর্যন্ত আমার নিজেকেও অভিনয় করতে হয়েছে...তবুও এই ব্যাচটার উপর আমি আস্থা রাখার চেষ্টা করেছিলাম। এবং আমার কাছে মনে হয়েছে ওরা সাকসেসফুল। থিয়েটারের এই সংকটের মুহূর্তে তাদের কমিটমেন্টের দরকার ছিল, এবং তারা তা দেখাতে পেরেছে। এখন সমালোচনা হবে, প্রশংসা হবে...সেটা তো থাকবেই।
হাসান শাহরিয়ার
‘থিয়েটারওয়ালা’র পক্ষ থেকে আজকের আলোচকবৃন্দকে আন্তরিক ধন্যবাদ।