Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: বিনোদিনী
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: বিনোদিনী। অবলম্বন: আমার কথা ও আমার অভিনেত্রী জীবন- বিনোদিনী দাসী। রচনা: সাইমন জাকারিয়া। নির্দেশনা: নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মঞ্চপরিকল্পনা: কামালউদ্দিন কবির। আলোকপরিকল্পনা: ইশরাত নিশাত। পোশাক, রূপসজ্জা ও আবহসংগীতপরিকল্পনা: শিমূল ইউসুফ। পোস্টার ডিজাইন: আফজাল হোসেন। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০০৫। একটি ‘ঢাকা থিয়েটার’ প্রযোজনা
[‘ঢাকার থিয়েটার, জানুয়ারি-জুন ২০০৫ : সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি কলাকুশলীগণ’- এই শিরোনামে নাট্যালোচনার আয়োজন করেছিল নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’। আলোচনায় সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি হন ২০০৫-এ ঢাকার মঞ্চের নতুন নাটক বিনোদিনীর নির্দেশক ও ডিজাইনারগণ। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন ‘থিয়েটারওয়ালা’-সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার। নাট্যসমালোচনাটি অনুলিখন করে ‘থিয়েটারওয়ালা’র ১৮তম সংখ্যায় (২০০৫ এ প্রকাশিত) ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
হাসান শাহরিয়ার
আমি বিনোদিনী নাটকের উপর প্রশ্ন চাচ্ছি।
গোলাম শফিক (নাট্যকার)
বিনোদিনী দেখবার পর, এর অভিনয় দেখবার পর একটা মুগ্ধতা আসে আমার মধ্যে। কিন্তু যে বেদনাবোধ বা বিষণ্নতা নিয়ে বের হওয়ার কথা ছিল, সেটা আমার মনে হয় নি। কিন্তু আমার একটা পূর্বধারণা ছিল যে, একটা নাগরিক-আবহ পাবো...তো সেটা পেলেও, বেদনাবোধ সেভাবে পাই নি। এ ব্যাপারে বাচ্চুভাইকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ (নির্দেশক- বিনোদিনী)
নাগরিক-আবহটা কিন্তু স্বাভাবিক, কারণ, বিনোদিনী কিন্তু শহরের থিয়েটারটা করেছে। বিনোদিনীর মেলামেশা ছিল উচ্চবিত্তের মানুষের সাথে। এটি তার পেশার কারণে ঘটেছে। ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’, ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’, ‘বেঙ্গল থিয়েটার’সহ যেখানেই সে কাজ করেছে, পুরো পরিবেশটাই কিন্তু আধুনিক কলকাতার। সুতরাং এটা মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে আমরা একটা নিউট্রাল স্পেস দেখতে চেয়েছিলাম যেটা আধুনিক থিয়েটারের প্রারম্ভিক সময়ের। আর বেদনাবোধটা ম্যান টু ম্যান ভেরি করে। এই থিয়েটারটা করার সময় সবসময়ই ভেবেছি যে এটা বিনোদিনীকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্যই করছি। আর এটাকে আমি সবসময়ই ‘পরিবেশনা’ বলেছি...বিনোদিনীর আত্মজীবনীর পরিবেশনা...এর মাঝখানে যা আছে সেটা একজন আধুনিক থিয়েটারনির্মাতা হিসেবে কিছু করার চেষ্টা। সুতরাং সর্বত্র একধরনের উজ্জ্বলতা, চাকচিক্য কাজ করেছে, কোথাও মলিনতা স্পর্শ করে নি। আমি খুব সচেতনভাবেই এটা করেছি, কারণ, আমি বিনোদিনীকে মলিন দেখতে চাই নি।
অনন্ত হিরা (অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক)
বাচ্চুভাইয়ের কাছে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই যে, এই কাজটা করতে গিয়ে আপনি বিনোদিনীর কোন দিকটাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন...মানে বিনোদিনীকে নিয়ে কাজ করার মতো অনেক এলিমেন্টস ছিল...তার উপর নাটক হয়েছে, লেখালেখিও হয়েছে, তো এর মধ্য থেকে এই ডায়েরিটিকে কেন নির্বাচন করলেন?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আসলে যখন ঠিক করলাম যে বিনোদিনীকে শ্রদ্ধা জানাতে একটা কাজ করবো, তখন এটা নিয়ে নানাজনের সাথে কথা বলেছি। তার উপর বের হওয়া লেখাগুলো পড়েছি, সিডিটা শুনেছি কিন্তু কোনোটাতেই আমার মন ভরে নি বা আমাকে স্পর্শ করে নি। লেখাগুলো আমার কাছে ফিকশন মনে হয়েছে। যে যার মতো করে লিখে গেছেন। কিন্তু যদি আমি একজন মানুষকে সম্মান জানাতে চাই, তাহলে সেই মানুষটি সম্পর্কে সত্য-মিথ্যায় যে ফিকশন লেখা হয়েছে সেটা নিয়ে আসবো, নাকি তার নিজের কথাগুলো, সেগুলোকে নিয়ে আসবো? তখন আমরা বিনোদিনীর দুটি আত্মজীবনীর আশ্রয় নিলাম এবং তার শিল্পসংগ্রামের জায়গাটার উপর আমি বেশি জোর দিতে চেয়েছি। ধন্যবাদ।
ফয়েজ জহির (নির্দেশক-ডিজাইনার)
বাচ্চুভাই বললেন যে, আপনি বিনোদিনীর সৃজনশীল জায়গাটাই উজ্জ্বলতর করতে চেয়েছেন। কিন্তু ওনার জীবনসংগ্রামের জায়গাটা যদি তুলে ধরা যেত, তাহলে ওনার জীবনের যে স্ট্রাগল বা আজকের সময়েও তো আমাদের স্ট্রাগলগুলো আছে...তো সেই জায়গাটা পেলে কি ভালো হতো না?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, এটার জন্য আমাকে তাহলে এ যুগের একজন লেখককে দিয়ে লেখাতে হতো নতুনভাবে। আর জীবনসংগ্রামটাকে আমি একটু অন্যভাবে দেখি। আমি মনে করি আমাদের আধুনিক থিয়েটারে দৈন্য এবং দুর্বলতা হচ্ছে পুরাণের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা। মধ্যবিত্তের...আমাদের এই জীবন তত গভীর নয়, সংকটগুলো যত গভীরই হোক না কেন এই বিশ্বায়নেরকালে আমাদের জীবনবোধগুলো, জীবনসংঘাতগুলো এত গভীরতা অর্জন করতে পারে নি, যেখান থেকে কাব্য উঠে আসতে পারে। আমার কাছে মনে হয়েছে যে, পুরাণ-আশ্রিত চরিত্রগুলোই সবসময় বড় চরিত্র হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য আমরা অনেক ভেবেচিন্তে তিনটা নারী চরিত্র রেখেছি- এরা হলো প্রমীলা, চিত্রাঙ্গদা এবং সীতা। এই তিনটা চরিত্র এই জন্যই বেছে নিয়েছি যে এদের মধ্য দিয়ে জীবনসংগ্রাম গভীরভাবে উপস্থাপন করা যায়। যেহেতু একটু ভেতরে গিয়ে কাজটা করতে চেয়েছি, সেজন্য এই আশ্রয়টা নিয়েছি। আর জীবনসংগ্রামের ব্যাপারটা তো প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত মোটামোটি পরিষ্কার আছে। আর স্ট্রাগলের ব্যাপারটা ওনার লেখায় যতটুকু ছিল, ততটুকুই রাখার চেষ্টা করেছি।
ফয়েজ জহির
আমার কবিরভাইয়ের কাছে একটা প্রশ্ন আছে। বিনোদিনী-র সেটে উনি একটা কার্ব লাইন নিয়ে এসেছেন এবং কিছু হিউম্যান ফিগার নিয়ে এসেছেন, এই হিউম্যান ফিগারগুলো আপনি কেন নিয়ে এসেছেন?
কামালউদ্দিন কবির (সেট ডিজাইনার- বিনোদিনী)
এই নাটকটির মূলবিষয় হচ্ছে আমাদের আধুনিক মঞ্চনাটকের বা শহুরে নাট্যচর্চার সূচনালগ্নের অন্যতম অভিনয়শিল্পীর জীবন, জীবনসংগ্রাম, শিল্পসংগ্রাম। তো একটি নাটক যখন আমরা মঞ্চে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি তখন আমরা ভেবেছি যে, নাট্যঘটনাটি কোথায় ঘটছে, কখন ঘটছে এবং কীভাবে ঘটছে। এই নাটকের ক্ষেত্রে পা-ুলিপি যেটি তৈরি হয়েছে সেখানে এরকম কোনো সুনির্দিষ্ট ইংগিত বা বিবরণ ছিল না। সেটি একদিকে যেমন অসুবিধা আবার অন্যদিকে সুবিধাও আছে। এখানে স্পেস তৈরির স্বাধীনতা পাওয়া গেছে বেশি। আর যেহেতু অভিনয় শিল্পীর জীবনসংগ্রাম, শিল্পসংগ্রাম...তার এই স্বল্পকালীন জীবনে ৯০টার মতো চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তো আমি কল্পনা করেছি বিনোদিনীকে, তার অনেক ছায়া, যে ছায়াগুলোর রেখাগুলো দেখার...যেহেতু একজন শিল্পী এককভাবে এটা উপস্থাপন করছেন, তো এই স্পেসে তার ছায়াগুলো বা তার সেই প্রতিরূপগুলো যেন উঠে আসে। ঐ কাপড়গুলো নানান চরিত্রকে প্রকাশ করতে সাহায্য করেছে আর এই কাপড়গুলো দিয়ে ঐ ফিগারগুলোতে কোথাও একটু ঢাকা, কোথাও একটু খোলা...যাতে পুরোপুরি একদম তার অভিনয়কে মূর্ত করে দেখাচ্ছি তা না হয়...এটা তার নানা প্রতিরূপ যেন হয়, এই চিন্তা থেকেই মূলত এই ফিগারগুলো দাঁড় করানো হয়েছে।
রতন দেব (অভিনেতা)
বিনোদিনী বিষয়ে নির্দেশকের কাছে আমার একটু জানার আছে। বিনোদিনী যখন মঞ্চে এলো, তখন আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খুবই অস্থির...ক্রসফায়ারে লোক মারা যাচ্ছে, শহীদ মিনারে প্রবেশ বন্ধ করে দিচ্ছে, এরকম একটা অবস্থা। তো আমরা জানি যে, যখন কোনো একটা নাটক নির্বাচন করা হয়, তখন ঐ নাটকটাতে সমসাময়িক অনেক বিষয়ের বা ঘটনার...মানে দর্শক হিসেবে ঐগুলো দেখতে চাই। তো বিনোদিনী-কে এই সময়ে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে নির্দেশক আসলে কীভাবে বা কতটুকু সমসাময়িকতা খুঁজে পান?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমার এই নাটকের মূল টার্গেট-অডিয়েন্স হচ্ছে নাট্যকর্মীরা। বাইরের দর্শক যদি দেখে সেটা বাড়তি পাওনা। তো নাট্যকর্মীদের জন্য এই নাটক অনিবার্য ছিল কিনা, এটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। আমার কাছে মনে হয়েছে বিনোদিনীকে জানা বা সেই সময়টাকে জানা, সেই সময়ের থিয়েটারের সংগ্রামকে জানার একটা মিথষ্ক্রিয়া তৈরি করে। আর সমসাময়িকতার যে ব্যাপারটা...সেটা হচ্ছে যে, ২০০ বছর আগের কোনো ঘটনাও যদি এখন নিয়ে আসা যায় এবং সেই ঘটনা যদি একজন দর্শকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, তাহলেও সেটি এখনকার থিয়েটারই হয়ে যায়। আর প্রতিটি নাটককেই রাজনৈতিক-থিয়েটার হতে হবে সেটা আমার মনে হয় না।
হাসান শাহরিয়ার
নীলুভাই কিছু বলবেন।
কামালউদ্দিন নীলু (নির্দেশক-অভিনেতা)
আমার মনে হয় একটা বিষয় জানা খুব প্রয়োজন, বিনোদিনীর সেট ডিজাইনের ক্ষেত্রে, সেটা হলো, পেছনে একটা বৃত্তাকার লাইন আছে...তো এগুলো কিন্তু হয় যে বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করা হয়...তার সবগুলোই কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না। কারণ, ডিজাইনারের ব্যাখ্যা জানার কিন্তু কোনো সুযোগ থাকে না। তাই আজকের এই অনুষ্ঠানে সেই সুযোগটা নিতে চাই...জানতে চাই পেছনের ঐ বৃত্তাকার লাইনটির ব্যাখ্যা।
কামালউদ্দিন কবির
প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমি একটু অন্য কথা বলতে চাই, সেটা হলো, একটা পা-ুলিপি যখন নাট্য হয়ে ওঠে তখন কিন্তু এর পেছনে অনেক সৃষ্টিশীল লোক থাকে। তো একটা বিষয় আজকাল একেবারেই হয়ে ওঠে না, সেটা হচ্ছে নাট্যসমালোচনা। যা-ও কিছু কিছু হয়, সেখানে আবার একটা বিষয় একেবারেই উপেক্ষা করা হয়, সেটা হলো ডিজাইনারদের ব্যাপারে কিছু বলা। তো আজকের এই অনুষ্ঠানে ‘থিয়েটারওয়ালা’ এই কাজটা করলো যে, আমাদের ডিজাইনারদেরও স্বীকৃতি দিল এবং পুরো নাটকে আমাদের সৃজনশীলতার ব্যাপারটাকে সবার সামনে নিয়ে এলো। সে কারণে আমি ‘থিয়েটারওয়ালা’কে ধন্যবাদ জানাই। এবার প্রসঙ্গে আসি...বিনোদিনীর সেট ডিজাইন আমি যখন করতে যাই তখন নির্দেশক এবং অন্যান্য ডিজাইনারদের সাথে বসে অনবরত কথা বলেছি এবং সেখানে একটা বিষয় মুখ্য ছিল যে, বাচ্চুভাই তার কল্পনায় বিনোদিনীকে দেখতে পাচ্ছিলেন একটি বৃত্তের মধ্যে। তো এই একটি কিউ আমি পেয়েছিলাম। তারপর এই বৃত্ত নিয়ে নানা আলোচনা হয়, এই বৃত্ত যে কেবলই বৃত্ত না, এ যে নানা মাত্রা তৈরি করে, নানা অর্থ তৈরি করে জীবন-স্পেসে...সেগুলো নিয়ে কথা হলো, আলোচনা হলো। অনেকে বলেন একটা অসম্পূর্ণ বৃত্ত...না, আমি কোনোভাবেই এটাকে অসম্পূর্ণ বৃত্ত বলি না বরং এটা লক্ষ করা যাবে যে, এটা ছুটছে, যেটা কিনা আমরা বিনোদিনীর জীবনসংগ্রামকে লক্ষ করলেও দেখি।
বিপ্লব বালা (নাট্যশিক্ষক-সমালোচক)
বিনোদিনীর জীবনে ছোটাটা কিন্তু ফ্যাক্ট হিসেবে রিয়াল নয়। তার জীবনের ঘটনার মধ্যে কিন্তু ছোটাটা নেই। বিনোদিনী কিন্তু শেষপর্যন্ত হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ট্র্যাজেডি কিন্তু ওখানে। সে ক্ষেত্রে বৃত্তের ছোটার কনসেপ্টটা কি মেলে?
কামালউদ্দিন নীলু
বিনোদিনী কিন্তু বারবার জন্মগ্রহণ করছে। পুরো নাটকটাই কিন্তু একটা লাইফ-সাইকেল। যার ফলে ঐ বৃত্তটা রিলেট করেছে বলে আমার মনে হয়েছে।
বিপ্লব বালা
কিন্তু বাস্তবে শেষ কথা হচ্ছে যে, সে ভেঙে গেছে। তো সেই ভাঙনটা কি কোথাও থাকবে না?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি একটু বলি...এখানেই বিনোদিনীর শেষসংলাপটা কিন্তু জরুরি, সেটা হচ্ছে- আমার শেষও নাই, আরম্ভও নাই, এ-ই আমার পরিচয়। আমার মনে হয় টু বি অর নট টু বি-র সমকক্ষ একটা সংলাপ, যেটা কিনা বিনোদিনী নিজেই লিখে গেছেন। মামুনুর রশীদ একটা কাজ করবেন, তারপর উনি মারা গেলে আরেকজন আসবেন...তাই বলে তাঁর তো শেষ নেই। তাঁর এক্সটেনশন হবে আরেকজন। সুতরাং এই সাইকেলটাই কিন্তু ঘটছে।
মামুনুর রশীদ (নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা)
আমাদের সঙক্রান্তি নাটক নিয়ে ‘থিয়েটারওয়ালা’ একটা আড্ডা করেছিল...সেখানে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেছিল এবং পরে আমরা সেটা নিয়ে ভেবেছি যে...সেট-টা যাই হোক না কেন, সেটা ওয়ার্ক করছে কিনা, সেটা জরুরি। তো বিনোদিনীতে বৃত্তরেখা বা আরো যা যা আছে সেগুলো ইনডিভিজ্যুয়ালি বেশ চমৎকার, কিন্তু ইজ ইট প্রপারলি ইউটিলাইজড? আমার কাছে কিন্তু মাঝেমাঝে ওগুলোকে বেশ রিজিড মনে হয়েছে। বিনোদিনী যখন ওখান থেকে প্রপস্ নিয়ে ব্যবহার করছে, সেগুলো কিন্তু আমাকে চমৎকৃত করছে কিন্তু সেট-টা আমার মনে হয় কখনো কখনো কম ব্যবহৃত...এটা মনে হয় কিনা?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
না, আমার মনে হয় না। কিছু জিনিস আছে যেগুলো সরাসরি স্পর্শ করে ব্যবহার করবেন। আর কিছু কিছু জিনিস আছে যেগুলো দৃষ্টি দিয়ে আপনি স্পর্শ করবেন। বিনোদিনীর কোনো সংলাপের সাথে যদি পেছনের বৃত্ত কোনো ইমেজ তৈরি করে...দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে সেটাও একধরনের ব্যবহার বলা যায়।
মামুনুর রশীদ
যেখানে অভিনেত্রী বিনোদিনীর নানা মুভমেন্ট মঞ্চে তৈরি হচ্ছে এবং সেই মুভমেন্টগুলো তৈরি করার সময় যদি অন্য কোনো একটা ইমেজ দ্বারা ডেস্ট্রাকটেড হয়ে যাই, তাহলে সেটা কেমন হয়?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
হ্যাঁ, ডেস্ট্রাকটেড হয়ে গেলে সমস্যা, আর যদি ডেস্ট্রাকটেড না হয়ে কিছু অ্যাড করে, যোগ করে, সেটা নিশ্চয়ই ভালো...আমি বলতে চাইছি একটা ভার্টিক্যাল লাইন যদি সরাসরি মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকে, তার বিপরীতে একজন দর্শক ঐ ভার্টিক্যাল লাইনের সাথে এই সংলাপের যদি কোনো সাজুজ্জ খুঁজে পায় তাহলে তো অসুবিধা নেই।
মামুনুর রশীদ
সেটা তো পেতেই হবে, মাস্ট। যেমন ধরো, আমাদের জয়জয়ন্তী নাটকের সেট ডিজাইনে কোনো ভার্টিক্যাল লাইন ইউজ করা হয় নি।...সেদিন বিনোদিনী দেখার পর আমার কাছে মনে হয়েছে, ভার্টিক্যাল লাইন না থাকলে শিমূলের অভিনয় আরও ইফেক্টিভ হতো কিনা...ঐ রকম কমপ্লেক্সে ভার্টিক্যাল লাইন না থাকলে অসুবিধা হতো কিনা?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি আসলে ভিজ্যুয়াল-তাড়িত মানুষ, আমি ভিজ্যুয়ালি দেখার চেষ্টা করি। পুরো নাটকটা দেখার পর দর্শক কি পুরো নাটকটা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরে? না, নিশ্চয়ই না। একটা ইমেজ নিয়ে বাড়ি ফেরে। আমি ইমেজ-তাড়িত মানুষ বলেই আমার মনে হয়েছে বিনোদিনীর একটা ইমেজ নিয়েই মানুষ বাড়ি ফিরে যাবে...ঐ সাইকেলটা আর বিনোদিনীর ফিগার, আর অন্য কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। ঐ সাইকেলটা আমার থিয়েটারটায় খুব সহযোগিতা করেছে বলে আমার মনে হয়েছে।
বিপ্লব বালা
আমি সেট ডিজাইনারকে প্রশ্ন করছি, সেটের ইলিমেন্টগুলো মেটাল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কেন?
কামালউদ্দিন কবির
ডিজাইন শেষ করে ভাবছিলাম, এই রেখাগুলো কী দিয়ে করা যায়...তো প্রথমে বেতের কথা ভেবেছিলাম এবং অনেকেই হয়তো মনে করবেন বেতটাই হয়তো বেশি রিলেট করতো এখানে। সেটা দুটো কারণে হয় নি। এক হচ্ছে ঐ রেখাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে বেতের মাধ্যমে আনতে গেলে যে খরচ ও শ্রম দরকার, সেরকম বাজেট ও শিল্পী পাওয়া মুশকিল হতো। আমি খুব সহজে খুঁজে পাচ্ছিলাম এই মেটালের জায়গাটা এবং মেটালটা কেবল সহজলভ্য বলেই ব্যবহার করেছি তা না, বিনোদিনীকে আমরা ২০০৫ সালে উপস্থাপন করছি এবং এই সময়ের একটা এলিমেন্ট হচ্ছে মেটাল...আমরা বিষয়টাকে এভাবেই দেখছিলাম।
কামালউদ্দিন নীলু
ডিজাইনে আরেকটা বিষয় ছিল কাপড়ের ব্যবহার...তো কাপড়গুলো ঐভাবে ছুঁড়ে না দিয়ে যদি রঙগুলো মঞ্চে এসে এক জায়গায় দানা বাঁধতো, তাহলে কিছু একটা হতে পারতো...কারণ ওভাবে ছুঁড়ে ফেলার কারণে আমার কাছে মনে হয়েছে রঙগুলোও হারিয়ে গেল। এটা অবশ্য আমি নির্দেশনার ব্যাপারে বলছি।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
ছুঁড়ে ফেলার ব্যাপারটা আমার লেটো থেকে নেয়া। এটা আমাদের থিয়েটার ফর্মের একটা জায়গা। সেটা অনেক সময় ওয়ার্ক করে, অনেক সময় করে না।
এরশাদ কমল (সাংবাদিক)
আমি একটা বিষয় জানতে চাই, নাটকটার মধ্যে প্লে উইদিন দ্য প্লে দেখানোর জন্য সাজেস্টিভ প্রসেনিয়াম আর্চটা ফেলা হচ্ছিল, এবং দেখতেও ভালোই লাগছিল, কিন্তু এটার সাথে রিলেট করে লাইট ডিজাইনে কোনো ইলিউশন কিন্তু ক্রিয়েট করা হয় নি...সেটা কেন একটু জানতে চাই। আর বাচ্চুভাইয়ের কাছে আমার প্রশ্ন, আমরা জানি যে, আপনি আমাদের বিভিন্ন ট্র্যাডিশনাল থিয়েটার আছে তার রিপ্রেজেন্ট করেন। বিনোদিনী নাটকে কিছু জায়গায় দেখা গেছে যে, কাবুকি বা ওধরনের ড্যান্সের কিছু কিছু প্রয়োগ আছে...তো এখন আপনি নতুন কিছু ভাবছেন, না শুধু এই নাটকের ক্ষেত্রেই আপনার চিন্তাটা একটু অন্যরকম করে দেখাচ্ছেন?
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
আমি তো পৃথিবীর মানুষ, সে হিসেবে সব কিছুই আমার নাটকে আসতে পারে। তবে আমার নতুন ভাবনা নেই। একেকটা নাটক, চরিত্র, উপস্থাপনা একেক রকম হতেই পারে। নাটকের রঙের সাথে সব কিছু ডিজাইন করতে হয়। বিনোদিনী যখন প্রেজেন্ট করতে গেছি, একটা ক্লাসিক্যাল ভাবনা থেকে প্রেজেন্ট করতে গেছি। সে কারণে দেখবেন যে কথাকলি নাচের প্রভাব আছে। এটা এই নাটকের ভাবনা...অন্য নাটকে এটা না-ও থাকতে পারে। আর কামালউদ্দিন নীলুর প্রশ্ন...লাইটের কথাটা নিশাত বলবে।
ইশরাত নিশাত (অভিনেত্রী-নির্দেশক। লাইট ডিজাইনার- বিনোদিনী)
লাইট দিয়ে ইলিউশন ক্রিয়েট করাটা ইন্টেনশনালি অ্যাভয়েড করা হয়েছে। বিনোদিনী নাটকের লাইটের থিমে একটা বড় ব্যাপার আছে, সেটা হচ্ছে, কোনো কালার লাইট সামনে থেকে ব্যবহার করা হয় নি। সব কালার লাইটগুলো পেছনে এবং শুধুমাত্র একটা কালার লাইট সামনে থেকে আনা হয়েছে, সেটা হলো যখন প্রসেনিয়াম আর্চটা নেমে আসে। আমি সব সময়ই চেয়েছি বিনোদিনীর সাদামাটা উপস্থাপনাটা লাইটে আনতে।
এরশাদ কমল
আমি যেটা জানতে চাচ্ছি সেটা হলো, সেট ডিজাইনে যখন একটা সাজেস্টিভ প্রসেনিয়াম আর্চ ফেলছেন, উপর থেকে, তখন আপনি কেন ইলিউশন ক্রিয়েট করছেন না? এখানে দুটো ডিজাইনকে কো-অর্ডিনেট করতে হবে না?
ইশরাত নিশাত
আমি তো বললাম যে আর্চটা যখন নেমে আসে তখন একটা কালার লাইট পড়ে, আর্চের উপর।
এরশাদ কমল
যখন থিয়েটারের মধ্যে আরেকটা থিয়েটার শুরু হলো, তখন তো মঞ্চের মধ্যে আরেকটি মঞ্চ তৈরি হয়, কিন্তু আপনার মঞ্চের আলো-প্রক্ষপণ কিন্তু আগেরটাই থাকে। আমি সেটার কথা বলেছি।
ইশরাত নিশাত
সেটা আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছি।
কামালউদ্দিন নীলু
কেন? সব ইচ্ছার তো একটা কারণ থাকবে, সেই কারণটা জানতে চাচ্ছে।
ইশরাত নিশাত
আমি আর্চের উপর লাইট ফেলেই এই কাজটা করতে চেয়েছি, পুরো মঞ্চে নতুন লাইট দেয়ার আসলে প্রয়োজন হয় নি।
মোহাম্মদ বারী (অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক)
নিশাতের কাছে জানতে চাই, আপনি বাচ্চুভাইয়ের সাথে কাজ করতে গিয়ে ডিজাইনার হিসেবে কতটুকু স্বাধীন থাকতে পারেন?
ইশরাত নিশাত
শুধু আমি না, এখানে ডিজাইনার আরও আছেন, বাচ্চুভাইয়ের সাথে কাজ করেছেন যারা সবাই বলতে পারবেন যে, ডিজাইনার এবং পারফরমার সবাইকেই তিনি খুব স্বাধীনতা দেন। এই নাটকে এবং প্রাচ্যতে আমি বাচ্চুভাইকে অ্যাসিস্ট করেছি, সেজন্য শেয়ারিংটা প্রথম থেকেই ছিল। চিন্তার-স্বাধীনতাটা প্রচ- দেন। প্রয়োগটা যখন হচ্ছে তখন হয়তো উনি বলেন যে, অমুক জায়গাটা তুই আরেকটু অন্যভাবে কর, বা আমি এইভাবে চেয়েছিলাম, তুই সেটা মাথায় রাখ ইত্যাদি। কিন্তু আমার কাজটা উনি আমাকে দিয়ে বের করেন।
হাসান শাহরিয়ার
‘থিয়েটারওয়ালা’র আজকের এই আয়োজনে থাকার জন্য, অংশ নেয়ার জন্য, আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।