Full premium theme for CMS
আমাদের সৈয়দ হক
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
প্রায় দেড়যুগ আগে সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিবসকে সামনে রেখে একটা গদ্য লিখেছিলাম ‘এক উজ্জ্বল যতিচিহ্ন’ শিরোনামে, মনে পড়ে। তার অনেক আগে থেকেই আমি তাঁর মুগ্ধ পাঠক, আর তখন আমি তরুণ এক লেখক, তাঁকে উজ্জ্বল যতিচিহ্ন বলে অভিহিত করতে পেরে সুখী বোধ করেছিলাম। এ এমন এক যতিচিহ্ন যার সামনে সাহিত্যের পাঠকদের মুগ্ধ বিস্ময়ে একবার হলেও দাঁড়াতে হয়। আজ নতুন করে লিখতে বসে অনুভব করছি, এতদিন পরও তাঁর সম্পর্কে আমার মতামত একইরকম রয়ে গেছে। মতামত বদলায়নি বটে, তবে এরপরও আমি তাঁকে আবিষ্কার করতে চেয়েছি বারবার এবং তাঁর রচনাগুলো আমাকে বিমুখ করেনি কখনো, একেক সময় একেক অর্থ নিয়ে ধরা দিয়েছে- নতুনতর অর্থ, ভিন্নরকম ব্যাখ্যা নিয়ে।
ছোটবেলায়, যখন কিশোর ছিলাম, মনে পড়ে, বাড়ির ক্ষুদ্র সংগ্রহে থাকা রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, মানিক, তারাশঙ্কর আর মনীষীদের জীবনী পড়তে পড়তেই ‘মাসুদ রানা’ এসে গিয়েছিল তার রোমাঞ্চ আর রহস্যভরা পৃথিবী নিয়ে, আমার কাছে। অনেকদিন মাসুদ রানা হওয়ার গোপন বাসনা বুকে পুষতে পুষতেই একসময় বুঝে ফেলি- কোনোদিনই ওরকম হতে পারবো না আমি। সদ্য তরুণ হয়ে উঠছি যখন, ছোটখাটো আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠি, কারণে-অকারণে বুকের ভেতরে হু হু করে বেদনার্ত বাতাস বয়ে যায়, সংগোপনে চোখ ভিজে ওঠে প্রায় অকারণে, কত কত বই পড়ে চোখের কোণ ভিজিয়ে ফেলেছি তার কি কোনো হিসাব আছে? সেই এক বয়স, নিষিদ্ধ আবেগে ভরপুর- হেনরি মিলার, টেক্সাস, নেক্সাস ইত্যাদি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নামাঙ্কিত তাবৎ পুস্তক পড়তে পড়তে আমার চেয়ে এগিয়ে থাকা জ্ঞানী বন্ধুর কাছ থেকে ‘খেলারাম খেলে যা’র নাম শোনা- নিষিদ্ধ গ্রন্থ হিসেবেই এবং পড়তে গিয়ে বারবার হোঁচট খাওয়া। উপন্যাসটি যেন এর আগে পড়া বইগুলোর মতো নয়। হ্যাঁ, এই উপন্যাসেও ওরকম ব্যাপাার-স্যাপার কিছু আছে বটে- লতিফা, বাবলি, জাহেদার মতো সদ্য-তরুণীদের সঙ্গে বাবর নামক এক মধ্যবয়স্ক লম্পটের (?) সঙ্গম বা সঙ্গম-চেষ্টার বিস্তৃত বিবরণ আছে, কিন্তু আছে আরো কিছু যা ওগুলোর চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। শেষ করে, উপন্যাসটি প্রথম থেকে আবার পড়তে শুরু করি, থেমে থেমে, আত্মস্থ করার চেষ্টা করতে করতে। অনুভব করে উঠি, আমার ভেতরে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। নানাবিধ বিষয়ে আমার মনে বহু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই উপন্যাসের পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে জাহেদার সঙ্গে বাবরের কথোপকথনের পর্বটি, যেখানে বাবর একের-পর-এক আঘাত হানছে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সংস্কার ও বিশ্বাসে! আবেগকে দু’ভাগে ভাগ করা হচ্ছে- মৌলিক আবেগ ও অর্জিত আবেগ। মৌলিক আবেগই আমাদের মূল সম্পদ, অর্জিত আবেগ আমাদের ওপর আরোপ করা হয়েছে এবং মূলত শেষেরটির জন্যই পৃথিবীর চেহারাটি এ-রকম, সভ্যতার রূপটি এমন। পড়ে আমি চমকে উঠি। তার মানে পৃথিবীকে আমি যে চোখে দেখেছি এতদিন, যেভাবে ভেবেছি এতদিন, সেটি ঠিক তেমনই নয়! এখানে অনেক প্রশ্নবোধক চিহ্ন আছে! মনে পড়ে- বাবর একের পর এক প্রসঙ্গ তুলছে, ধসিয়ে দিচ্ছে প্রচলিত মূল্যবোধ; বাজ ফেলছে সমাজ, সংস্কার, রীতি, আইন, নিয়ম, নীতিবোধ আর মূল্যবোধের ওপর; আর আমার ভেতরে ঘটে যাচ্ছে পরিবর্তন। জীবনের প্রতিটি অনুষঙ্গকেই তাহলে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়? কিংবা কোনোকিছুই প্রশ্নহীন নয়!
সেই প্রথম একটি উপন্যাস আমাকে প্রশ্নের চোখে তাকাতে শিখিয়েছিল।
সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গেও সেটিই প্রথম পরিচয়। না, ঠিক প্রথম পরিচয় নয়। আমি ছিলাম গোগ্রাসী পাঠক, তাঁর কোনো কোনো লেখা হয়তো এর আগেও পড়েছি, বিচিত্রা ঈদসংখ্যায় ‘এক যুবকের ছায়াপথ’ পড়ার কথা মনেও আছে, তবে ‘খেলারাম খেলে যা’ আমাকে তাঁর ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে। পাঠক হিসেবে বরাবরই এক অদ্ভুত অভ্যাস আমার, যাঁকে ভালো লাগে তার পুরোটাই পড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। তখন বই কেনার টাকা ছিল না, ফুটপাত থেকে অল্প দামে কিছু, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র লাইব্রেরি থেকে কিছু আর মহানগর পাঠাগারে প্রায় নিয়মিত বসে বসে তাঁর গ্রন্থগুলো পড়ে ফেলার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। তাঁর লেখা পড়ি আর মনে হতে থাকে বই পড়াটা শুধু চোখ ভিজিয়ে তোলার জন্য নয়, এমনকি মনীষীদের জীবনী পড়ে প্রেরণা পাওয়ার জন্যও নয়, নিষিদ্ধ আবেগে উত্তপ্ত হয়ে ওঠার জন্যও নয়, বরং জীবন ও পৃথিবীকে দেখার বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বই পড়ি আর আমি সত্যিকার অর্থে প্রাপ্তমনস্ক হয়ে উঠতে থাকি। অবাক হয়ে লক্ষ করি- একজন লেখক তার নিজেরই বিভিন্ন লেখায় কিভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে যান। দেখি ‘এক যুবকের ছায়াপথ’-এর সৈয়দ হক আর ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’র সৈয়দ হকের মধ্যে কত বিস্তর ব্যবধান!
‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ পড়ে আমি ভীষণ আলোড়িত হয়েছিলাম- মনে পড়ে। সংলাপবিহীন, একটি মাত্র অনুচ্ছেদেই উপন্যাসটি শেষ। তারই মধ্যে আমাদের ইতিহাস, সময়, সমাজ। কোনো সংলাপ নেই, ভাবনার বিবরণ নেই, কেবল ঘটনা আর ঘটনা। বিচিত্র, বিস্ময়কর, অভাবনীয় সব ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের দমবন্ধ করা ঘটনাবহুল বিমূঢ়-বিহ্বল সময়টিকে ধরার জন্য এর চেয়ে চমৎকার প্রয়াস আর চোখে পড়ে না। খুব বেশি তো লেখা হয়নি এরকম উপন্যাস আমাদের সাহিত্যে। এই উপন্যাসটি সম্পর্কে আমার কৌতূহল কোনোদিনই অবসিত হয়নি, আর তাই বহুবছর পর তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে এর প্রকরণ আর করণকৌশল সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন- ‘আমার ভাবতে ভালো লাগে যে দ্বিতীয় দিনের কাহিনী একসময় লিখতে পেরেছিলাম। ওর ভেতরে কোনো সংলাপ নেই, কোনো ভাবনার বিবরণ নেই। শুধু বলে যাওয়া। মুভমেন্ট, গতি। কী হচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, না করছে। কিন্তু ভাবনার ব্যাপারটা আমি ইচ্ছে করে রাখিনি। আর একটানা লিখে যাওয়ার কারণটা হচ্ছে, আমি ওই সময়ের যে ওজনটা, ভারটা, ওই ভারটাকে আমি ওভাবে সঞ্চারিত করতে চেয়েছি। পাঠকের মনে হবে, এটা থেমে থেমে পড়তে হবে, যে পর্যন্ত পড়েছি, একটানা পড়ার পর দাগ দিয়ে রাখতে হবে। কোনো অধ্যায় নেই, কোনো ভাবনা নেই। শুধু মুভমেন্ট আফটার মুভমেন্ট। ওয়েভ আফটার ওয়েভ।’
আমার সবসময় মনে হয়েছে ‘খেলারাম খেলে যা’ আর ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’ উপন্যাস দুটো সৈয়দ হকের লেখক-জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। শুধু তাঁর নয়, আমাদের কথাসাহিত্য চর্চারও টার্নিং পয়েন্ট। দুটো উপন্যাসের রচনাকালও লক্ষ করবার মতো। প্রথমটি ১৯৭০-১৯৭৩ সময়কালের মধ্যে লেখা, দ্বিতীয়টি ১৯৭৪ সালে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকালে রচিত তাঁর গল্প ও উপন্যাসগুলোর ভেতরে একটা সুরেলা ব্যাপার ছিল, রাজনীতি ব্যাপারটাকে এড়িয়ে চলতেন তিনি, কিংবা প্রচ্ছন্ন রাখতেন। তাঁর প্রথম জীবনে লেখা ‘শীতবিকেল’, ‘তাস’, ‘ফিরে আসে’ প্রভৃতি গল্প কিংবা ‘অনুপম দিন’, ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’ প্রভৃতি উপন্যাস পড়লে সেটি উপলব্ধি করা যায়। এমনকি ‘খেলারাম খেলে যা’র বাবরের জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছিল রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে, কিন্তু উপন্যাসে ওই ব্যাপারগুলো এতই প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে, খুব সচেতন পাঠক ছাড়া অন্যদের তা চোখেই পড়বে না। আর সেজন্যই বাবর আলীর বিকার ও লাম্পট্যের কথা আমাদের মনে থাকে; কিন্তু তার নিঃসঙ্গতা, তার শেকড়হীন ভাসমান জীবন, তার দুঃখ-বেদনা-হাহাকার আমাদের চোখে পড়ে না।
একটু আগে বলছিলাম, তাঁর লেখাগুলো বিভিন্ন সময়ে নতুনভাবে ধরা দিয়েছে আমার কাছে, নতুনতর অর্থ নিয়ে। ‘খেলারাম খেলে যা’ তার উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রথম বা দ্বিতীয়বার পড়ার সময় যেসব ব্যাপার চোখ এড়িয়ে গেছে, তৃতীয় পাঠে সেগুলোই প্রচ্ছন্নতার আড়াল সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই যে বাবর আলী, লম্পট-কামুক বাবর আলী, তার দিকেও তাকাতে হয়েছে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার চোখে। সে তো কোনো সুস্থ মানুষ নয় আসলে। আর হবেই বা কীভাবে? কৈশোরে, ওপার বাংলায়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এক ভীতিকর-জটিল সময়ে এক আকস্মিক বিপদের মুখে পড়ে নিজের বোন হাসনুকে সাম্প্রদায়িক পশুদের হাতে ফেলে পালিয়ে এসেছিল বাবর। কিন্তু সত্যিই কি পালাতে পেরেছিল সে? আজও হাসনু তার ‘পোকায় খাওয়া দাঁত’ নিয়ে, সরল কিশোরী সেজে হাজির হয় বাবরের কাছে, আর সে এলেমেলো হয়ে যায়, ভেঙেচুরে ফেলে নিজেকেই। স্বাভাবিক থাকতে পারে না বাবর, প্রায় উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকে- হাসনু উপস্থিত হলে। কেন পালিয়েছিল বাবর? এ নিয়ে তার নিজের কাছেই প্রশ্ন আছে, ক্ষরণ আছে, দ্বন্দ্ব আছে। যদিও উপন্যাসের দু-একটি জায়গায় সে বলেছে যে, অনুতাপ তার স্বভাববিরুদ্ধ, তার মধ্যে কোনো অনুতাপ নেই- কিন্তু কথাটি সত্যি বলে মনে হয় না। ‘আমার মধ্যে কোনো অনুতাপ নেই’- কথাটি বলার অর্থই হচ্ছে- এ নিয়ে আমার মধ্যে প্রশ্ন-দ্বন্দ্ব-ক্ষরণ আছে, নইলে আর ফলাও করে অনুতাপহীনতার কথা বলতাম না। এ হচ্ছে নিজেকে আড়াল করার একটা পদ্ধতি মাত্র। তার অর্ন্তগত এই রক্তক্ষরণ আর দ্বন্দ্বটি লক্ষ্য না করলে পুরো উপন্যাসটির কোনো মূল্যই থাকবে না। এবং সেটিই এই উপন্যাসের ভাগ্যে জুটেছে। যেসব পাঠক এ উপন্যাস সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা পোষণ করেন তারা সম্ভবত বাবরের চরিত্রটিকে একমাত্রিক হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন- সে লম্পট, কামুক, বিকৃত। তার মধ্যে খুব গভীর কিছু কষ্ট আছে, চোখ-ভিজে ওঠা কিছু বেদনা আছে, দ্বন্দ্ব আর ক্ষরণ আছে, অন্যমনস্ক পাঠক তা খেয়ালই করেননি।
শুধু বোনকে পশুদের কাছে ফেলে রেখে পলায়ন-ই কি তার বেদনার একমাত্র কারণ? না, তা-ও নয়। সে নিঃসঙ্গ। যে অনিবার্য, পরিত্রাণহীন অন্তর্গত নিঃসঙ্গতায় প্রতিটি মানুষ যাপন করে তার দুর্বহ জীবন, বাবরের নিঃসঙ্গতা তারচেয়ে খানিকটা অধিক। দেশভাগ তাকে টেনে এনেছে এখানে। এ দেশ তার নয়। এ মাটির জন্য জন্মগত কোনো টান নেই তার, এবং সঙ্গত কারণেই সে এখানকার কোনোকিছুর সঙ্গে সংলগ্ন বোধ করে না। তার যা কিছু মমতা বর্ধমানের জন্য, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি যেখানে ফেলে এসেছে সে। এমনকি ঘরের কোণে লেবু গাছটার জন্যও তার গভীর প্রেম। সে স্বজনহীন। মা-বাবা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে অন্তর্হিত, বোন অপহৃত ও নিহত, যার জন্য বাবরের ভেতরে আছে গভীর গ্লানি ও কান্না। তার স্মৃতি বলতে আছে এই একটি মাত্র ঘটনা, যা তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়! কোনোকিছুই তার নয়- এ দেশ তার জন্মভূমি নয়, এখানকার মানুষগুলোকে সে চেনে না। তার কেউ নেই। এখানে তার কোনো আশ্রয় নেই, ভালোবাসার মানুষ নেই, প্রেম নেই, মমতা নেই, ঘরে প্রতীক্ষিত মুখ নেই। তার বর্তমান নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত, অতীতকে ঘিরে আছে এক দুঃসহ স্মৃতি- সুখময় স্মৃতিগুলো তাই মৃত; আর আছে ছোট্ট বোনটির আর্তচিৎকার। এমন ‘নেই’ মানুষ, এমন শেকড়হীন মানুষ তো কোথাও শেকড় গেড়ে বসবার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে। সে কেবল ভেসে বেড়াতে পারে অবিরাম, অন্তহীন। বাবরও ভাসমান, যেহেতু সে শেকড়হীন- ‘লাইক আ ফ্লেক অফ ডাস্ট দ্যাট নেভার রেস্টস অন এনিথিঙ অ্যান্ড ফ্লোটস থ্রু টাইম ওনলি!’
এই নিঃসঙ্গ, একাকী, শেকড়হীন ভাসমান মানুষটি নিজের ভেতরে লালন করে এক ভয়ংকর প্রতিশোধস্পৃহা। কার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায় বাবর? সে নিজেও তা জানে না, আর জানে না বলেই সে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জানে না পাঠকরাও। উপন্যাসটি আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক নয়; হলে, আমরা বলতে পারতাম- সে প্রতিশোধ নিতে চায় তাদের ওপর যারা তাকে শেকড়-ছাড়া হতে বাধ্য করেছে, যারা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে একটি দেশকে ভেঙে দু-টুকরো করেছে, আর সে তার বোনকে হারিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঘটনা সেটিই। বাবরের প্রতিশোধস্পৃহা আসলে তাদের বিরুদ্ধেই। আর এখানে এসেই যেন আপাত-অরাজনৈতিক উপন্যাসটিও হয়ে ওঠে ভীষণভাবে রাজনৈতিক। কিন্তু ইঙ্গিতটা এতটাই প্রচ্ছন্নভাবে দেয়া হয়েছে যে, বোঝাই কঠিন- এই জটিল ঘটনাপ্রবাহ সম্বন্ধে লেখকের রাজনৈতিক ভাষ্যটা কী! এ-ও সত্য যে, একজন লম্পট, কামুক, বিকৃত মানুষের যৌনতাড়িত আচরণের বিপুল বর্ণনায় যে উপন্যাস এগিয়ে চলছিল, কখনো মনে হয়নি- একে রাজনৈতিকভাবে দেখবার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু হয়ে তো পড়লো! কোনোকিছুই তো আসলে রাজনীতির বাইরে নয়। একান্ত ব্যক্তিগত যে জীবন, প্রতিমুহূর্তে সেখানেও ঢুকে পড়ছে রাষ্ট্র ও রাজনীতি। ভয়াল এই রাজনীতি, যা দেশকে ভেঙে ফেলে, একটি জাতিকে বিভক্ত করে ফেলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দিয়ে।
পরবর্তীকালে এসব বিষয় আর প্রচ্ছন্ন থাকেনি তাঁর রচনাগুলোতে। এই দুই সময়ের রচনাগুলোর ভেতরে বিষয়, প্রকরণ এবং আঙ্গিকেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। নানা ধরনের গল্প এবং উপন্যাস লিখেছেন সৈয়দ হক যার এক প্রধান অংশ জুড়ে আছে মানুষের রাজনৈতিক বিশ্বাস, তার বিপ্লব-বিদ্রোহ ও বেঁচে থাকার যুদ্ধ। ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান’, ‘ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে’, ‘জমিরউদ্দিনের মৃত্যু বিবরণ’, ‘আরো একজন’ প্রভৃতি এই ধরনের গল্প। ‘রক্ত গোলাপ’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘দূরত্ব’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘ইহা মানুষ’, ‘স্তব্ধতার অনুবাদ’, ‘স্মৃতিমেধ’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’, ‘ত্রাহি’, ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ প্রভৃতি উপন্যাসের কথাও এই প্রসঙ্গে মনে পড়বে। ‘কালামাঝির চড়নদার’, ‘নেপেন দারোগার দায়ভার’, ‘আনন্দের মৃত্যু’, ‘মানুষ’, ‘পূর্ণিমায় বেচাকেনা’, ‘স্বপ্নের ভেতর বসবাস’-এর মতো অসামান্য গল্পের রচয়িতাও তিনি। এগুলো পড়ার সময় পাঠকরা লক্ষ্য না করে পারেন না যে, তাঁর প্রথম দিকের গল্প-উপন্যাসগুলোর চেয়ে পরের দিকের গল্প-উপন্যাসগুলোর ভাষা ও আঙ্গিক কী অসাধারণ কুশলতায় বদলে গেছে! ‘ফিরে আসে’ বা ‘রুটি ও গোলাপ’ গল্পের যে ভাষা ও উপস্থাপনা, ‘গাধা জ্যোৎস্নার পূর্বাপর’ গল্পের ভাষা ও উপস্থাপনা তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। আবার প্রাথমিক পর্বে তিনি আখ্যান-বর্ণনার দিকে যতটা মনোযোগী ছিলেন, পরবর্তীকালে সেটিও পাল্টে ফেলেছেন। বিশেষ করে আঙ্গিকে এমন এক পরিবর্তন এনেছেন যে, মনে হয়, লেখক কেবল গল্পটিই বলছেন না, বরং পাঠকদের সঙ্গেও কথা বলছেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন, আখ্যানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তোলার জন্য পাঠককে সরাসরি সম্বোধন করছেন, যেন পাঠক কেবল শ্রোতা-দর্শকের অবস্থানে না থেকে নিজেও অংশগ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ধারার গল্পগুলোতে তাঁর এই কৌশল বিশেষভাবে চোখে পড়ে। এসব গল্পকে অবশ্য তিনি নিজে শুধুমাত্র ‘গল্প’ না বলে ‘গল্পপ্রবন্ধ’ নামে অভিহিত করে থাকেন, কিন্তু এগুলো পাঠ করে একটি ‘গল্প’ পাঠেরই আনন্দ হয়। গল্পকে তিনি স্রেফ ঘটনা-বর্ণনার দায় থেকে মুক্ত রেখেছেন বটে, কিন্তু ‘গল্পহীনতা’র দায়ও নেননি। ধীরে ধীরে তিনি তৈরি করেছেন নিজস্ব একটি ভঙ্গী- কী ভাষায়, কী প্রকরণে- তাঁর লেখাটি যে সৈয়দ হকেরই লেখা সেটি চিহ্নিত করতে পাঠককে কোনোরকম কষ্টই করতে হয় না। তিনি তাঁর গদ্যভাষাকে একটি উচ্চ-মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। শব্দের ব্যবহার ও বাক্যের গঠনে তিনি এমন গভীর সচেতনতার পরিচয় দেন যার তুলনা মেলা ভার। আবার কিছু গল্প ও উপন্যাসে, বিশেষ করে যেগুলোতে উত্তরবঙ্গ উঠে এসেছে, তাঁর ডায়ালেক্টের অপূর্ব ব্যবহার রীতিমতো ঈর্ষণীয়।
যদিও গল্প দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক কিন্তু থেমে থাকেননি সেখানেই। একে একে তিনি বিচরণ করেছেন সাহিত্যের প্রায় সমস্ত শাখায়- কবিতায়, উপন্যাসে, নাটকে। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সফল হয়েছেন তিনি। তাঁর সাহিত্যকর্ম- সে গল্প বা উপন্যাসই হোক, অথবা কবিতা বা নাটকই হোক- তুমুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তিনি অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে থাকেননি। ছুটে বেড়িয়েছেন জীবনের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার সন্ধানে, ক্রমাগত নিজেকে ভেঙেচুরে নিজেকেই অতিক্রম করে গেছেন ঈর্ষণীয়ভাবে। মানব-জীবন, মানব-স্বভাব, সমাজ-জীবন প্রভৃতির প্রতিটি চেনা-অচেনা কোণে উজ্জ্বল আলো ফেলে দেখিয়েছেন সেগুলোর অর্ন্তগত চারিত্র-বৈশিষ্ট্য। তাঁর রচনায় চিত্রিত হয়েছে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের সমগ্র জীবনছবি- একদিকে মানুষের প্রেম, কাম, আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম, বিদ্রোহ, রাজনৈতিক চেতনা, তার ভালোবাসা, মমতা ও মহত্ত্ব।
সৈয়দ হকের কয়েকটি কাব্যনাটক আছে- এ-তো সবারই জানা। এর কয়েকটির মঞ্চস্থও হয়েছে- ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ প্রভৃতি। প্রথমটি দেখার সুযোগ হয়নি- যখন মঞ্চে গিয়ে নাটক দেখতে শুরু করেছি তখন ওটা আর মঞ্চস্থ হচ্ছে না। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ দেখেছিলাম, মনে পড়ে, খানিকটা বোঝা-না-বোঝার মাঝখানে থেকে। ‘ঈর্ষা’ মঞ্চে এলো- দেখলাম, তখন খানিকটা বোঝার বয়স হয়েছে। এই নাটকের তিনটি মাত্র চরিত্র, তিনজনই শিল্পী, তাদের সংকট, বিশেষ করে প্রৌঢ় শিল্পীটির সংকট- একবার তাঁর শিল্পীসত্তা পরাজিত হচ্ছে মানুষসত্তাটির কাছে, আরেকবার ঘটছে উল্টোটিও- এত অসামান্য কুশলতায় উঠে এলো যে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। প্রৌঢ় শিল্পীটির সমস্যাটি খুব গভীর, কোনোটিই তিনি মানতে পারছেন না পুরোপুরি। তার নিজেরই দুই সত্তা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, আলো-আঁধারি মঞ্চে দুজনেই যেন তাদের নিজস্ব বক্তব্য নিয়ে উপস্থিত দর্শকপাঠকদের কাছে- তারাই বা কোনটা নেবে? এরকম একটি জটিল বিষয় যে মঞ্চে এতো চমৎকারভাবে আসতে পারে, ভাবিনি কখনো। নাটকটি আমাকে দখল করে রাখলো অনেকদিন। তারপর আবার দেখতে হাজির হলাম কয়েকজন বন্ধুসহ। একা একা এমন একটি নাটক উপভোগ করা যায় না। তো নাটক দেখা হলো- সাতটি মাত্র সংলাপ, দেড়-ঘন্টার, বিশাল বিশাল, মনোযোগ দিয়ে না শুনলে সুতো কেটে যায়। মজার বিষয় হচ্ছে দর্শকরা প্রায় অলৌকিকভাবে চুপ হয়ে যায়, পিন-পতন নিস্তব্ধতা, নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায় কী যায় না, তার মধ্যে চলে তিন শিল্পীর অসাধারণ সব সংলাপ। আমার বন্ধুরা প্রায় বজ্রাহতের মতো চুপচাপ হয়ে দেখলো নাটকটি। এবং নাটক শেষে আমার সবচেয়ে মুখরা বান্ধবীটিকে- সাজগোজ আর মার্কেটে ঘুরে বেড়ানো যার একমাত্র প্রিয় বিষয়, ‘মানুষ কেন যে বই কিনে পড়ে, ওই টাকা দিয়ে তো লিপস্টিক কেনা যেত’ ইত্যাদি, লেখকদের মনে করে সে সবচেয়ে অলস, অকর্মা, অপদার্থ জীব- চুপ মেরে থাকতে দেখে ভড়কে গেলাম। কে জানে আমার কী অবস্থা করবে এখন! কিন্তু সেরকম কিছুই হচ্ছে না দেখে অবশেষে তার নীরব হয়ে যাওয়ার কারণটি শুনে অবাক হয়ে গেলাম- ‘আমি ভাবতেও পারিনি যে নাটক জিনিসটি এমন হতে পারে। আশ্চর্য! আশ্চর্য! আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর অনেক কিছুই আমি বুঝি না, জানি না।’ ওর এই হঠাৎ উপলব্ধি দেখে আমার মনে হলো- সৈয়দ হক কতো সফল একজন শিল্পী যে একটিমাত্র নাটক দিয়ে তিনি একজন মানুষকে ভিন্ন চোখে জীবনকে দেখতে শিখিয়ে দিলেন।
সৈয়দ হকের প্রধান সাফল্য আমার মনে হয় এখানেই- তাঁর অগুনতি পাঠককে তিনি জীবনের দিকে, সমাজ, পরিপার্শ্ব ও পৃথিবীর দিকে ভিন্ন চোখে তাকাতে শিখিয়েছেন, ভাবতে শিখিয়েছেন, চিন্তাজগতে গতি সঞ্চার করেছেন, প্রচলিত রীতিনীতি সম্পর্কে প্রশ্নমুখর করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। একজন লেখকের প্রধান কাজ কী, এ রকম তাত্ত্বিক আলোচনার জায়গা এটি নয়, কিন্তু এটাতো ঠিক যে, লেখকরা পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চান। শুধু পৌঁছানোই নয় অবশ্য, পাঠকদের হৃদয়ে রয়ে যেতে চান, সৈয়দ হক সেদিক থেকেও সফল- অনেক লেখকই পাঠকপ্রিয়তা পান বটে, কিন্তু ধূসরও হয়ে যান দ্রুত পাঠকদের কাছ থেকে। সৈয়দ হক অন্তত তা হননি।
সৈয়দ শামসুল হক হচ্ছেন আমাদের এমন এক বহুমাত্রিক প্রতিভা যাঁর সম্পর্কে বলে শেষ করা মুশকিল। তাঁর গল্প পড়ার সময় মনে হয়, আর কিছু না লিখলেও তাঁর চলতো। উপন্যাসেও তাঁর সাফল্য কম নয়। আর কবিতা? গল্প, উপন্যাস বাদ দিয়ে শুধু কবি হিসেবেও তিনি প্রধান একজন। প্রবন্ধে, নিবন্ধে, কলামে- যেখানেই যান তিনি, ফেলে আসেন উজ্জ্বল আলো। এক ‘মার্জিনে মন্তব্য’র তুলনা মেলা কী কষ্টকর বাংলাসাহিত্যে! কিংবা ‘কথা সামান্যই’-এর মতো অভিনব গদ্যগ্রন্থের তুলনাই বা ক’টা আছে বিশ্বসাহিত্যে? ‘হৃৎকলমের টানে’র জন্য বৃহস্পতিবারের সংবাদ সাময়িকীর জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম বছরের-পর-বছর ধরে, মনে পড়ে সেসব কথা। কী আনন্দময় দিনযাপন সম্ভবপর করে তুলেছিলেন তিনি তাঁর অমলিন কলম দিয়ে তাঁর পাঠকদের জন্য, ভাবলে কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে মন।
আমাদের এই ক্লিষ্টকালে, এই বিরানভূমিতে সৈয়দ হক অনেক দিয়েছেন, আমরা তাঁকে ফেরত দিতে পেরেছি সামান্যই। এমনকি তাঁকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনারও প্রয়োজন বোধ করিনি আমরা। এর একটি কারণ কি এসবের প্রতি তাঁর নিস্পৃহতা ও নিরাসক্তি? মনে পড়ে, প্রায় দুই যুগ আগে একবার তাঁর গল্প নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অতিতরুণ লেখক, আবার সাহিত্য আমার একাডেমিক পড়াশোনার বিষয়ও নয়, সাহিত্যের প্রতি নিতান্তই ভালোবাসা থেকেই ওগুলো লিখে চলেছি, হয়তো খানিকটা মনোযোগও প্রত্যাশা করছি, তরুণরা যেমনটি করে থাকেন। তখনও তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি, তবু ফোন করে তাঁর মতামত জানতে চাইলাম লেখাটি সম্পর্কে, তিনি কিছু না বলে বাসায় যেতে বললেন। আগ্রহভরে একদিন গেলামও, কিন্তু আমাকে ভাবির (আনোয়ারা সৈয়দ হক) সঙ্গে কথা বলতে বলে নিজে বাইরে চলে গেলেন। বেকুব বনে গেলাম। তাঁর একটু মনোযোগ আশা করেছিলাম, অস্বীকার করবো না- কিন্তু এ কেমন ব্যবহার! ভাবির সঙ্গে কথা হলো ঘন্টাখানেক কিন্তু অভিমান রয়ে গেল মনের ভেতরে। তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগই করলাম না। প্রায় বছরখানেক পর বইমেলায় তাঁর সঙ্গে দেখা। ভাবিও ছিলেন। মজার বিষয় হচ্ছে- ভাবি চিনলেন না আমাকে, চিনলেন সৈয়দ হক-ই। আমার হাত ধরে থাকলেন অনেকক্ষণ, হেঁটে বেড়ালেন বেশ কিছুটা সময় হাত ধরেই, বললেন- ‘তুমি আর এলে না তো! সেদিন এতো ব্যস্ত ছিলাম...।’ কিন্তু তারপরও যাওয়া হলো না আমার। দ্-ুএকবার ফোনে কথা হলো, তখন হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না, আর আমি ছিলাম ঘরবিমুখ তরুণ, বাইরে বাইরেই কাটতো অধিকাংশ সময়, নিজে থেকে ফোন না করলে আমাকে পাওয়াই কঠিন ছিল। তিনি ফোন করতেন, আমার মায়ের সঙ্গে গল্পও করতেন, কিন্তু তারপরও বিছিন্ন হয়ে গেল যোগাযোগ। বেশ ক’বছর পর একদিন অপ্রত্যাশিত ফোন এলো তাঁর কাছ থেকে আবার, বললেন- ‘অনেকদিন তোমার কোনো খবর নেই, তুমি কেমন আছো, কোথায় আছো? কোনো সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছো নাকি তুমি?’ হ্যাঁ, সত্যিই আমি তখন ভীষণ পারিবারিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। আকস্মিকভাবে আমার ভাই মারা গেছেন, বাবা তো আগেই গেছেন, সংসার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। এসবের কিছুই তাঁর জানার কথা নয়, কাউকেই জানাইনি আমি, তবু তাঁর স্নেহপ্রবণ মন কথা বলে উঠেছে। এবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। মনে হলো তিনি যেন স্নেহ প্রকাশে কুন্ঠিত। যেন স্নেহ প্রকাশ করাটা দুর্বলতার পরিচয়- পুরনোকালের পিতা বা বড়ো ভাইরা যেমনটি মনে করতেন আর কি- কিন্তু তিনি তাঁর মমতা জমা করে রাখেন বুকের ভেতর। যাহোক, তাঁর সঙ্গে যতদিন কথা হয়েছে তাঁর সম্পর্কে আমার লেখাগুলো নিয়ে কোনোদিন কিছু বলতে শুনিনি। একবার আমি জিজ্ঞেসও করেছিলাম, তিনি খানিকটা লাজুক হাসি হেসে বলেছিলেন- ‘তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়া ছাড়া আর কী বলতে পারি আমি!’ অদ্ভুত ব্যাপার। নিজের সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে এমন নিরাসক্তি অবাক করে দেয় আমাকে- তিনি ক্ষুব্ধ কিংবা আনন্দিত হতে পারতেন- হয়তো হয়েছেনও, কিন্তু তা প্রকাশ করেননি। অথচ ‘খেলারাম খেলে যা’ নিয়ে আমার দীর্ঘ আলোচনাটি জুড়ে দিয়েছেন তিনি ওই উপন্যাসের নতুন সংস্করণে! তাঁর স্নেহ প্রকাশের, সম্মান জানানোর ধরন ওরকমই। তাঁর স্বভাবের এই দিকটি সম্ভবত তাঁকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে- সবার সঙ্গেই একটু দূরত্ব রেখে চলেন তিনি, খুব বেশি কাছে যেতে দেন না। অথচ তাঁর হৃদয়টি থাকে মমতাময়, স্নেহে পরিপূর্ণ- গভীরভাবে লক্ষ্য না করলে ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যায় না। তাঁর রচনাগুলোও কি তাই নয়? বাইরে থেকে তাঁর লেখাগুলো যেরকম, খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লে সেগুলো অন্যরকম হয়ে যায়। এটা হচ্ছে সেই অন্তর্গত উজ্জ্বলতা- সৈয়দ হক যা ঢেকে রাখতে চান। না, আমার কোনো অভিযোগ নেই তাঁর বিরুদ্ধে। তাঁর স্নেহে আমি ধন্য হয়েছি, তাঁর কাছ থেকে অযাচিত সম্মান পেয়েছি, তাঁর লেখাগুলো আমাকে ঋদ্ধ করেছে। আমি তাঁর স্নেহসিক্ত-মমতাপূর্ণ হৃদয়ের পরিচয় পেয়েছি, তাঁর লেখায় লুকানো ঐশ্বর্যের সন্ধানও পেয়েছি। যোগাযোগ থাকুক আর না থাকুক, তাতে কী-ই-বা যায় আসে?
তাঁর ‘ফিরে আসে’ গল্পের কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করে এই লেখাটির আপাত সমাপ্তি টানবো। এই গল্পে আমরা পঞ্চাশ দশকের সৈয়দ হককে খুঁজে পাই, ফজলে লোহানীকে (গল্পে যে আব্দুল্লাহ) মনে পড়ে। প্রেম এখানে গভীর, কামনা তীব্র, কিন্তু তারচেয়ে বেশি তীব্র বোধহয় একজন লেখকের লিখতে না-পারার বেদনা, একজন শিল্পীর ছবি আঁকতে না-পারার কষ্ট। তিন শিল্পী বন্ধুকে নিয়ে লেখা এই গল্পটিতে এক আশ্চর্য সময়ের কথা বলা হয়েছিল; ওই সময়টির কথা যদি আমরা মনে রাখি, বুঝতে পারি, ব্যক্তিগত জীবন-যাপন ততটা জটিল না হলেও একজন লেখক কেন লিখতে পারেন না, একজন শিল্পী কেন ছবি আঁকতে পারেন না-
‘এখন আমি কিছুই লিখতে পারব না। এখন তায়মুর কোনো ছবিই আঁকতে পারবে না, এখন একজন আবদুল্লাহ লিখতে না-পেরে বিদেশে চলে যাবে। কারণ আমাদের কিছুই নেই পেছনে, কিছুই নেই সামনে। আমরা কিছুই বিশ্বাস করি না। আমাদের পায়ের নিচে সিঁড়ি নেই। এ হচ্ছে এমন এক সময়, আমরা কিছুই করতে পারব না, আমরা বয়ে যেতে পারব। আমাদের ভঙ্গি থাকবে, চাল থাকবে, মুখোশ থাকবে কিন্তু হাত থাকবে না স্রষ্টার।’
পঞ্চাশের সেই বিপন্ন ও আত্মপরিচয় খুঁজে-ফেরা সময়ের এর চেয়ে চমৎকার সংজ্ঞা আর কী হতে পারে? আর এই কথাগুলো কি আজকের যে-কোনো শিল্পীর জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য নয়? সৈয়দ হক এভাবেই মানব-হৃদয়ের অলি-গলি চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গে সময়কেও অতি চমৎকারভাবে ধরে রাখেন এবং এই অবলোকনের মধ্যে থাকে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি যে অর্ধ-শতক পরও তাকে সমসাময়িক মনে হয়। তাঁকে যখন পড়তে শুরু করেছিলাম, তখন ভাবিনি যে কোনোদিন নিজেই লিখবো। পরে যখন লেখার চেষ্টা করছি এবং মাঝে মাঝেই পরিত্রাণহীন বন্ধ্যাত্বে আক্রান্ত হচ্ছি, ততই যেন ষাট বছর আগের এ গল্পটি আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। এ আমাদের কেবলই বয়ে চলা, ভঙ্গি আছে, চাল আছে, শুধু হাত নেই স্রষ্টার। এখনো ‘আমরা কিছুই বিশ্বাস করি না’, ‘আমাদের কিছুই নেই পেছনে, কিছুই নেই সামনে।’
না, ভুল বলা হলো। আমাদের একজন সৈয়দ হক আছেন, যিনি তাঁর লেখায় দেশের কথা বলেন, মানুষের কথা বলেন, ভাষার কথা বলেন, ইতিহাসের কথা বলেন, আর পাঠককে দেখিয়ে দেন- এই সবকিছু তোমারই, তুমি তো নিঃস্ব নও!
প্রিয় সৈয়দ হক, আমাদেরকে আপনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন, আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে নিজের দিকে ফিরে তাকাতে হয়, গৌরবে ভরিয়ে দিয়েছেন আমাদের সাহিত্যকে। আপনার শারীরিক উপস্থিতি নেই, তবু আপনি রয়ে গেছেন আমাদের হৃদয়ে, আমাদের আলোচনায়, আমাদের যাপিত জীবনের ভেতরে। আমাদের টুপিখোলা অভিবাদন গ্রহণ করুন, প্রিয় লেখক।
আহমাদ মোস্তফা কামাল [
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
]: কথা সাহিত্যিক