Full premium theme for CMS
পেদ্রো পারামো এবং জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা- পুনর্পাঠ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
সাধারণত আমরা উপন্যাস বলতেই ভাবি, কোনো একজন ঔপন্যাসিক বা লেখক শুধু তার কল্পনা থেকে তুড়ি মেরে বের করে আনেন ঘটনা পরিবেশ চরিত্র আর সেসবের পশ্চাৎপট। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা-র কোথাও যেন উপন্যাসের সেই ব্যাপারটি নেই। নামের ভেতরই যেন এই ছোট্ট উপন্যাস বা নোভেলার বাস্তবতা, যা নোভেলার পুরোটা জুড়ে ম্যাজিকের মতো রুদ্ধশ্বাসে আবর্তিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ও পরের কাহিনী। সময়ের ক্রম, বিভিন্ন স্থান এমনকি ঘটনাগুলো পর্যন্ত বাস্তবের সমান্তরাল আরেক বাস্তবের নির্মিতি। পাকিস্তান আর্মি, গোলাম আযম তার গং, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মাটিতে রাজাকারদের পুনর্বাসনে দেশের অভ্যন্তরের চক্রান্ত, এই চক্রের শক্তিসঞ্চারে বাধাদানে সমষ্টিগত মিলনের অভাব; এসবই এই নোভেলার ভিতরগত মূল সুর। এ নোভেল যেন ঐতিহ্য পুনর্নির্মাণের নতুন ধাপ।
পিছিয়ে পড়ার ভাবনায় আমরা যারা সারা পৃথিবীর লেখার খোঁজ করে বেড়াই, বেশিরভাগ তারাই কিন্তু নিজের বাড়ির খোঁজ রাখি না। তারাই সবসময় নিজেদের নন্দনচিন্তাকে পরখ করে দেখতে চাই পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে, এটাই পূর্বকাল থেকে শিখে এসেছি, কারণ আমাদের উপন্যাসের সচল ধারাটি বঙ্কিম বাবুর হাত দিয়ে এসেছে, নকশার যে নিজস্ব ধারা তার আদল আখ্যানে ব্যবহৃত হয়নি তেমন, পশ্চিমি আদলে স্বদেশি মাটিতে চেরি ফলের আবাদ দোষের তেমন নয় যদি খাদ্যগুণসম্পন্ন হয়। একে অস্বীকার করার স্পর্ধা এত দিনে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তবে অস্বীকারের কথা বলছি না, বলছি নিজেদের চেনার কথা, আত্মপ্রত্যয়ের কথা।
এই লেখায় আমিও পশ্চিমি কোনো উপন্যাস না নিয়ে লাতিন আমেরিকার একটি ছোট উপন্যাসের তুলনা টেনেছি, পাঠক প্রধানত ধরতে পারেন, আত্মপ্রত্যয়ের অভাব, ঔপনিবেশিক মানসিকতা, পঠন-পাঠন দেখানোর ভান অথবা এই উপন্যাস আলোচনায় পূর্ববর্তী বাংলা উপন্যাসের কোনো প্রতিতুলনা বা সাদৃশ্য ও স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করার মতো কিছু পাইনি বলে। যাই ভাবুন, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে ‘কালের খেয়া’র সম্পাদক কবি মাসুদ হাসান যখন লিখতে বললেন, তখন প্রথম পেদ্রো পারামো’র কথাটিই মনে পড়ল; শহীদুল জহিরের জাদুবাস্তবতা আর হুয়ান রুলফোর জাদুবাস্তবতা একেবারেই এক নয় যেমন, তেমনি সাদৃশ্যও কিছুটা পরিলক্ষিত হয়। লাতিনিকরণ করে যারা শহীদকে হেয় করতে চান, তাদের পাঠ-অভিজ্ঞতার প্রতি শ্রদ্ধা হারাই তখনই, যখন দেখি শহীদুল যে আপন ভুবন তৈরি করেন তার লেখায়, তা একান্তই আমার স্বদেশি যার অস্তিত্ব আমার মাটির শিকড়ে প্রোথিত। তাই শহীদুলকে পড়তে গিয়ে পেদ্রো পারামো-র মতো অমন ছোট্ট উপন্যাস আবার পড়তে শুরু করি, যে উপন্যাসের চরিত্রেরা সব মৃত, তাদের স্বদেশ ভাবনা চরিত্রদের কথোপকথন ও ভূ-মানচিত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাকালীন সময়কেই মনে করিয়ে দেয়, মেক্সিকো ও বাংলাদেশ আমার কাছে একাকার হয়ে যায়, সময়হীন সময়ের মধ্যে চেনা-অচেনা এক রূপ-বাস্তবতায়। তখনই ‘উপন্যাসের নন্দন’ প্রবন্ধের কথা মনে আসে, যেখানে দেবেশ রায় স্পষ্টতই যে চিন্তার সূত্রের কথা বলেন, ‘নন্দনচিন্তার নতুন সূত্র কখনোই তৈরি হয়ে উঠতে পারে না, নিজের ভাষার সৃষ্টি বৈচিত্র্যের নতুন নতুন গভীর স্তরের ভিতর ঢুকে যেতে না পারলে ... যখনই কোনো দেশে নন্দন আলোচনার নতুন সূত্র তৈরি হয়, তখনই সেই দেশের বা ভাষার শিল্পসাহিত্যের এক নতুন পাঠ আমরা পাই। শিল্প-সাহিত্যকে অনিবার্যতই স্থানিক ও সাময়িক হতে হয়- দেশকালের দ্রাঘিমা-অক্ষাংশে সে এমনই বাঁধা। সেই স্থানিকতা ও সাময়িকতাকে বিশ^জনীনে নিয়ে আসাটাই নন্দনসূত্রের প্রধান বা হয়তো একমাত্র কাজ। গ্রিস দেশ ছাড়া গ্রিক নাটক হতো না, গ্রিক নাটক ছাড়া অ্যারিস্টটল হতেন না...’। এই যে ‘অনিবার্যতাই স্থানিক ও সাময়িক’- কথাগুলো শহীদুল জহিরের সাতচল্লিশ পাতার এই নোভেলা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় গভীরভাবে পরি¯ম্ফুট। যা কি-না সঠিক অনুবাদ হলে স্থানিকতা ও সাময়িকতাকে ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠবে। কারণ মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন ছোট্ট পরিসরে আর কোনো মহৎ কর্ম বাংলা সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এখানে কোথাও লাতিনিকরণের দোহাই দিয়ে পার পাওয়া যাবে না কিংবা ছোট করা যাবে না এমন মহৎ কর্মকে। আমি মনে করি, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের সবাক দলিল।
স্বাধীন বাংলার মাটিতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হয়েছিল এদেশের স্বাধীনতার স্থপতির মুখ দিয়ে। সেই স্বাধীন দেশে বার বার হয়েছে ক্ষমতার পট পরিবর্তন। ঘটনাক্রম এবং কালপঞ্জি- নিয়ে যেমন নিপুণভাবে খেলা করেন হুয়ান রুলফো, আলোহো কার্পেন্তিয়ের, গার্সিয়া মার্কেজ, তেমনি নিপূণ খেলা খেলতে চেষ্টা করেছেন শহীদুল জহির। অনেকাংশেই সার্থক হয়েছেন, স্বদেশের মাটিতে পারস্যের গোলাপের চাষ যেমন আপনার হয়েছিল এদেশে, তেমনি তিনি যোগ্যতার সাথে ম্যাজিক ও বাস্তবতাকে প্রথম রোপন করেন বাংলায়। সদ্য স্বাধীন শেকড়-বাকড় উপড়ানো একটা দেশ যেখানে প্রতিদিন ক্ষমতালোভীদের লড়াই, আচম্বিতে খেয়াল খুশি ইচ্ছামত হঠাৎ অভ্যুত্থান এ সবকিছুই লাতিন আমেরিকার চাইতে কোনো অংশে কম নয়, চিত্র আর বাস্তবতার রূপটি হয়ত কিছুটা ভিন্ন। হাত ধরে ক্ষমতালোভীরা পুনরায় সঙ্গী করে স্বাধীনতা বিরোধীদের আর বিকলাঙ্গ করেছে স্বাধীনতা ফসল- সেটা ছিল একাত্তর সনের ডিসেম্বর মাসের একত্রিশ তারিখ। কিন্তু দু’বছর পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে বদু মওলানা যখন লক্ষ্মীবাজারে ফিরে আসে মহল্লার লোকেরা তার গায়ে পুনরায় পপলিনের ধূসর সেই আলখাল্লা দেখতে পায়। পুনরায় ফিরে আসার পর প্রথম দিনে সে মহল্লার সকলের সঙ্গে বিনীতভাবে কুশল বিনিময় করে, সে একাত্তর সনে মহল্লায় নিহত আট ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যায়। মহল্লার লোকেরা পরে তাদের এই বিশ্বাসের কথা বলেছিল যে, এই দুঃসাহসিক কাজের দ্বারা আসলে সে সাতটি ক্ষতচিহ্ন পরীক্ষা করতে চেয়েছিল মাত্র। তখন সেই মঙ্গলবারের অপরাহ্নে আবদুল মজিদ তাদের প্রাঙ্গণের ফটকের কাছে কামিনী গাছতলায় বদু মওলানাকে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কেমন আছো তোমরা? এই প্রশ্নের ভেতরকার পরিহাস এমন নিদারুণ ছিল যে, নিজের বাড়ির প্রাঙ্গণের ভেতর তা শুনে এবং বদু মওলানাকে দেখে আবদুল মজিদ বাক-রহিত হয়ে থাকে। এই আবদুল মজিদ যদি হয় আমাদের এই স্বাধীন ভূখণ্ড তাহলে এই ভূখণ্ড তার সাত বীরপ্রতীকের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই প্রত্যক্ষ করেছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের সদর্প আগমন।
সামাজিক আর রাজনৈতিক টানাপোড়েনের তীব্রতাকে জীবন্ত করে তোলার জন্য বাস্তব রূপায়ণের মধ্যেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে কী অদ্ভুত সব কিম্ভূত কাল্পনিক সব উপাদান, যা আমার পাঠক হৃদয়ে লেখকের মতোই স্বতোৎসারিত, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবর্তিত হয়েছে। লাতিন আমেরিকার জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারায় লিখিত আপাত মনে হলেও শহীদুল জহির বাস্তবে কল্পনার মিশেল দিয়ে রচনা করেছেন এক নতুন ভূখণ্ডের নতুন শিল্পধারার ইতিহাস। যা তার পূর্বসূরি ওয়ালীউল্লাহর রচনাতেও আবাস মেলে, বিশেষ করে কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসের প্রথম কয়েক পৃষ্ঠায়। হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো’র কোমালা, গার্সিয়া মার্কেজের এক শ’ বছরের নিঃসঙ্গতা’য় যে জনপদের পত্তন হলো, তা ওই সকল লেখকদের মায়া-কল্পনারই সৃষ্টি, নতুন ইতিহাস বা ঐতিহ্য। কেননা লাতিন আমেরিকার কোথাও কোমালা বা মাকোন্দো নামে কোনো গ্রাম বা শহর নেই। আমাদের যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের দ্বীপ ময়নাদ্বীপও নেই বাংলাদেশের কোথাও। কিন্তু শহীদুল জহিরের নবাবপুর, লক্ষ্মীবাজার সব তো আমাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত ইতিহাসের কেন্দ্রে বিদ্যমান। তবে গার্সিয়া মার্কেজের মতো শহীদুল জহিরও শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছেন ইতিহাসেরই এক সজীব সংজ্ঞার্থে।
মহল্লার প্রতিটি বালক এবং বালিকার কাছে, পুরুষ এবং রমণীর কাছে যেন এই প্রথম উদ্ঘাটিত হয়েছিল যে, জগৎ সংসারে একটি ব্যাপার আছে যাকে বলে বলাৎকার। তারা আজীবন যে দৃশ্য দেখে কিছু বোঝে নাই, যেখানে একটি মোরগ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মুরগিকে; মহল্লায় মিলিটারি আসার পর তাদের মনে হয়েছিল যে, প্রাঙ্গণের মুরগির মতো তার মা এবং কিশোরী কন্যাটি, পরিচিত ভালোবাসার স্ত্রী, তাদের চোখের সামনে প্রাণভয়ে এবং অনভিপ্রেত সহবাস এড়ানোর জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে ... পাকিস্তানি মিলিটারি এক ঘণ্টায় বিশ লক্ষ বছর ধরে মানুষের বুনে তোলা সভ্যতার চাদর ছিঁড়ে ফেলে এবং লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা তাদের মহল্লায় মানুষের গুহাচারিতা হাজার এবং লক্ষ বছর পর এক মর্মান্তিক অক্ষমতা পুনরায় অবলোকন করে।
শহীদুল জহিরের এই উপন্যাস পড়লে বোঝা যায় কতটা ক্ষোভ, কত ঘৃণা লালিত হয়েছে ঔপন্যাসিকের গভীর মননে। এই উপন্যাসের পটভূমি হলো স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি এবং যুদ্ধোত্তর দেশে রাজাকারদের সদম্ভে পুনর্বাসন এবং ক্ষমতায়ন। এটা সম্পূর্ণভাবে একটি খোলামেলা রাজনৈতিক উপন্যাস, পোস্টমর্ডানিজমকে পাত্তা না দিয়ে এটা নিঃসংকোচ বাস্তবের আখ্যান। কিন্তু আশ্চর্য তা আবার রাজনৈতিক ইশতেহারও হয়ে ওঠেনি। পরতে পরতে মিশে আছে স্বপ্ন এবং প্রেম, সাম্প্রদায়িকতা এবং মানবজীবনের হতাশা। এ তো জাদুবাস্তবতা নয়, বাস্তবের জাদুষ্ক্রিয়া। ইতিহাস, বাস্তব আর স্বপ্ন সময় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে উপন্যাসটি পরিণত হয়েছে বাস্তবের পরপারে কোনো অধিকতর বাস্তবে, সময়ে।
স্বল্প পরিসরে মাত্র কয়েকটি লাইনে একেকটি চরিত্রকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার বাহাদুরি ও জাদুকরি খেলা খেলেছেন শহীদুল জহির। কোন চরিত্রটি প্রধান হয়ে উঠবে, সেটা বোঝার আগেই আরেকটি চরিত্রকে প্রধান করে তোলেন অর্থাৎ সেই চরিত্রের ক্ষণিক উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ অথবা সেই চরিত্রের মুখ দিয়ে বের হয়ে আসা বাক্যাবলি বহন করে উপন্যাসের বিশদ তাৎপর্য- উপন্যাসটিতে ঘটনার বাস্তবতার সঙ্গে বর্ণনার জাদুবাস্তবতা এক নতুন মাত্রা এনে দেয়- যা ট্র্যাডিশনাল ইউরোপীয় উপন্যাসের ধারাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়, যার ফলে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে তৈরি হওয়া বাংলা উপন্যাসে অভ্যস্ত লেখকরা কিছুটা বেকায়দায় পড়তে পারেন।
পেরুর লেখক মারিও ভার্গাস য়োসা, ১৯৬৭ সালে ভেনেজুয়েলার কারাকাসে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে কাক্সিক্ষত ও সম্মানিত সাহিত্য পুরস্কার ‘রোমুলো গাইয়োগাস’ গ্রহণের সময় তার ছোট্ট ভাষণটিতে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, সাহিত্য হলো ‘আগুন’। কেননা সাহিত্যের আছে দুটি অঙ্গীকার: এক; তার শিল্পের কাছে, শিল্পী তার কাছে আর দুই; মানুষের কাছে, সমাজের কাছে, দেশের কাছে। এ আগুন সারাক্ষণ স্বয়ং সাহিত্যিককেই পোড়ায়; কিন্তু অন্য আগুন পোড়ায় সমাজ ও রাজনীতির যত অন্যায়, যত জঞ্জাল। শিল্পের আর জীবন দর্শনের জ্বলন্ত শিখা- শহীদুল জহিরের রচনায় দপদপ করে জ্বলে উঠেছে- ‘থুক দেই থুক দেই থুক দেই মুখে।’ বদু মওলানা জানে আবদুল মজিদরা একাত্তরের নয় মাসের কথা ভোলে নাই।
হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো-কে যেমন বলা হয় মেক্সিকোর আÍা থেকে বেরিয়ে আসা অনন্য উপন্যাস, তেমনি জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে বেরিয়ে আসা অনন্য নোভেলা। পেদ্রো পারামো-র চেয়েও ছোট্ট নোভেলা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা- মাত্র আটচল্লিশ পাতার এই নোভেলার প্রতি বাক্যের শরীরজুড়ে জ্বলজ্বল করছে চাপা বিদ্বেষ। হুয়ান রুলফো আশ্চর্য দক্ষতায় থামিয়ে দেন চরাচরকে, আর শহীদুল জহির সেই দক্ষতার উত্তরসূরি হয়ে জাগিয়ে তোলেন রায়েরবাজারের বধ্যভূমিকে। মোমেনাকে আবদুল মজিদ চার দিন পর খুঁজে পায় রায়েরবাজারের পশ্চিম প্রান্তে, বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারায়, বালুচরের মতো দেখতে এক মাঠের ওপর। আবদুল মজিদ এখন বুঝতে পারে না এই চার দিন তার আদৌ সংজ্ঞা ছিল কি-না। তার এখন শুধু মনে পড়ে খুঁজে খুঁজে সে যখন মোমেনাকে পায় সেই সময়টিকে। সে তখন তার বোনকে দেখে- তার একটি কেটে ফেলা, পেট থেকে ঊরু পর্যন্তক্ষতবিক্ষত, ডান ঊরু কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত চিরে তরমুজের মতো হাঁ করে রাখা।
নির্যাতনের এই চিত্র প্রত্যক্ষ করতে করতে পাঠকের দম বন্ধ হয়ে আসবে, অপরদিকে যুদ্ধবন্দি মানুষদের মতো আরেক মোমেনা এদিকে প্রতিনিধিত্ব করে লক্ষাধিক নির্যাতিত নারীর।
লক্ষ্মীবাজারের লোকদের মনে পড়ে একাত্তর সনে বদু মওলানা নরম করে হাসত আর বিকেলে কাক ওড়াত মহল্লার আকাশে। এক থালা মাংস নিয়ে ছাদে উঠে যেত বদু মওলানা আর তার ছেলেরা। ... একটি অদেখা মেয়ের জন্য লক্ষ্মীবাজারের এক বিষণ্ন বৃদ্ধের হৃদয় সেদিন ভেঙে পড়ে। এখন তার বাড়ির আঙিনায় তার নিজের আর তার বড় ছেলের জোড়া কবর। অন্য আরেকটি টুকরো পড়েছিল জমির ব্যাপারীর বাড়ির কুয়োতলায়, বিকেলে ভাতের চাল ধোয়ার সময়, হাঁড়ির ভেতর। এটা ছিল একটি কাটা পুরুষাঙ্গ। হাঁড়ির ভেতর এসে পড়তেই জমির ব্যাপারীর কিশোরী কন্যাটি চমকে উঠেছিল, কিন্তু হাঁড়ির ভেতর থেকে বের করে এনে সে বস্তুটি চিনতে পারে নাই।
ছোট্ট একটি উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই হত্যা-খুন, অত্যাচার-নিপীড়ণের চিত্র দু’পাড় ভাঙা খরস্রোতা নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। রাজাকার আর পাকিস্তানি আর্মিদের এই নির্যাতন থেকে যেমন রেহাই পাইনি নারী, পুরুষ, উভয়লিঙ্গ; রেহাই পায়নি তেমন বাড়ির পোষা প্রাণী কুকুর পর্যন্ত। নবাবপুর এবং লক্ষ্মীবাজারের বিধ্বস্তরূপ হয়ে ওঠে সারাবাংলা। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে তা ক্রমাগত জীবন্ত হয় যে, এর সব পরিবেশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে পাঠককে। আমরা যেমন শিউরে উঠি, তেমনি আমরা দেখতে পাই আমাদের নড়বড়ে অস্তিত্ব। যুগপৎভাবে ভয়ঙ্কর নয়, মারাত্মক হিংস্র অনুপুঙ্খ গল্প সৃষ্টি করেছে শহীদুল জহির আশ্চর্য দক্ষতায় গম্ভীর প্রখর অথচ সহজ, অনায়াস, স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিমায়; মনেই হয় না যে কোথাও একটা প্রখর শিল্পবোধ কাজ করে যাচ্ছে। কাটা কাটা, চাঁছাছোলা, নিরাসক্ত, নির্বিকার ভাষা, বাস্তব রূপদানে বাস্তবতার জাদুকরি মিশেল অথচ এই মায়া আখ্যানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোথাও বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া বয়ান তিনি দেননি বরং বোঝাতে চেষ্টা করেছেন এবং পেরেছেন কিসের ব্যঞ্জনা তৈরি করতে চাচ্ছেন। আর নয়তো কুয়াশার পর্দার মতো হয়ে ওঠে আখ্যানেরই কেন্দ্রীয় চিত্রাভাস। বোঝাই যায় না কী কঠোর শ্রমে ঘষে ঘষে অতিরিক্ত বোঝা ফেলে দিতে দিতে এই ঊনকথনের ভাষা তিনি আয়ত্ত করেছেন। কোনো অলঙ্কার যেন নেই কোথাও; কিন্তু পার্ট পার্ট নিভাঁজ সজ্জিত, ভয়ানক বাস্তব হয়ে উঠতে তার গা কাঁপে না। তার চিত্রকল্প স্থানিক বৈশিষ্ট্যে ভরপুর- ক্রমাগত নবাবপুর, লক্ষ্মীবাজার একটি যুদ্ধবন্দি মহল্লা- মহল্লার ভেতরের দুঃসহ অসহায় বন্দি মানুষ, পরিবেশ, তুলসীগাছ, কাক, উইপোকা, হাজামের ক্ষুর, কর্তিত পুরুষাঙ্গ- ব্যাপ্ত হতে হতে পরিব্যাপ্ত হয় একটি ভূখণ্ডে, একটি মানচিত্রে। কিন্তু কল্পচিত্র কখনো গায়ের জোরে আখ্যানের ভেতর ঢুকে পড়ে না- সে হয়ে ওঠে ইঙ্গিত বা ব্যঞ্জনার অংশ অথবা একান্ত সঙ্গী। আমরা আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে তাই অনুভব করি- দীর্ঘ একটি যুদ্ধের তাণ্ডব। ঠাণ্ডা মাপা মাপা নিরাভরণ গদ্য- বাস্তবতার জাদুতে মোড়ানো এই ঐতিহাসিক উপন্যাস একদিন হয়ে উঠবে আমাদের আত্মানুসন্ধানের ইতিহাস, যার শেকড় প্রোথিত কঠিন বাস্তবের ভেতর। এ কারণেই এটা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। আমরা জানি যে কোনো ভালো লেখাতেই সে লেখা কীভাবে পড়তে হবে, তার চাবিটাও লুকিয়ে থাকে। শহীদুল জহির চেয়েছেন, তার পাঠকরা তার উপন্যাসের চরিত্র হয়ে অংশগ্রহণ করুক। বাক্যের পর বাক্য ভেঙে বিশ্লেষণ করে পাঠকরা বের করে নেবেন এর মূল শাঁস, যেহেতু নোভেলার কোনো প্রচলিত গড়নও মানা হয়নি এই নোভেলা বা ছোট্ট উপন্যাসে। এ এমন এক নোভেলা, যেখানে লেখক নিজে অনুপস্থিত থেকে বলে যাচ্ছেন পাঠককে কী করতে হবে আর তা না হলে তাকে আপাতত বদলাতে হবে তার ঠিকানা।
[লেখাটি দৈনিক সমকালের সাহিত্য সাময়িকী ‘কালের খেয়া’য় ছাপানো হয় ৪ এপ্রিল ২০০৮। ‘কালের খেয়া’র সম্পাদকের সম্মতি নিলেও লেখকের সম্মতি নেয়া যায় নি সময়াভাবের কারণে। আশা করছি লেখক এটাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]
সালমা বাণী: লেখক