Full premium theme for CMS
রূপবতী : ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
‘যেনবা তিনশ বছর পর কবর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে এক বৃদ্ধ বংশীবাদক। আলখাল্লায় মোড়ানো অবয়ব নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে পথ হাঁটে সে। হঠাৎ চেতনা হয়। ভূমণ্ডল ফাটিয়ে চিৎকার করে- কে হত্যাকারী?’... সুবচন নাট্য সংসদের নতুন নাটক রূপবতী’র ব্রোশিয়ারে নাটকের কাহিনীর সঙ্গে দর্শককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে এভাবেই। এই বর্ণনা, ধারণা করি, যে-কোনো নাট্যদর্শককে নাটকটি দেখার জন্য কৌতূহলী করে তুলবে। কেন করবে বলছি। এই নাটকটির রচয়িতা একজন কথাশিল্পী- নাসরীন জাহান, কথাশিল্পীরা তাঁদের গল্প-উপন্যাসে এরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটাতে পারেন- কবর থেকে একজন মানুষকে তুলে এনে স্ত্রীর হত্যাকারীকে খোঁজানো, পাখির মুখে কথা বলানো, জীবিত ব্যক্তিকে সরাসরি স্বর্গারোহন করানো- এসব তাঁদের জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। তাঁদের চরিত্ররা তো আর বইয়ের পাতার বাইরে আসে না, বাস্তবের মাটিতে তাদের কখনো পা রাখতে হয় না, সেই সব চরিত্রকে নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলা করাই যায়। কিন্তু মঞ্চনাটক তো তা নয়। একে দর্শকদের সামনে অভিনীত হতে হয়, এবং দর্শকরা বইয়ের পাতায় বা কল্পনার জগতে বাস করে না, তারা সব রক্তমাংসের মানুষ, বর্তমানের মানুষ, সমসাময়িক বাস্তবতার মধ্যে বাস করা মানুষ। সেই দর্শকদের সামনে একজন মৃত মানুষকে তিনশ’ বছর পর কবর থেকে তুলে এনে বর্তমানে স্থাপন করলে, বর্তমানের মানুষদের সঙ্গে কথোপকথনে নিয়োজিত করলে তারা তা মানবে কেন, কেনইবা মনে হবে না- এ-তো এক গাঁজাখোরি গল্প! আর এইখানটাতে এসেই নির্দেশকের ভূমিকাটি বড় হয়ে ওঠে। পুরো বিষয়টিকে দর্শকদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য, নিদেনপক্ষে সহনীয়, করে উপস্থাপনের একটি সুকঠিন চ্যালেঞ্জ তাঁকে গ্রহণ করতে হয়। যদিও এই নাটকের নির্দেশক- খালেদ খান- ইতোমধ্যেই একজন সফল নির্দেশক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তবু কৌতূহল তো জাগেই- তিনি ঠিক কীভাবে বিষয়টিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবেন! এবং স্বীকার করে নিচ্ছি যে, প্রথম দৃশ্যেই বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এবং সেটা দেখে আমরা, দর্শকরা, চমৎকৃতও হয়েছি। কাজটি তিনি করেছেন একটি ঘোরলাগা পরিবেশ তৈরি করে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে দর্শকের ভেতরে এই ঘোর জেগে থাকে যে, এ কি কোনো বাস্তব দৃশ্য নাকি কল্পনার রূপায়ণ দেখছি! একজন শিল্পীর জন্য- তা তিনি যে শাখারই হোন না কেন- বাস্তব এবং কল্পনার সীমারেখা বা ডিমার্কেশন লাইনটি খুব স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয়। অর্থাৎ বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে একটি মোটা দাগ টেনে বলা সম্ভব নয় যে, এই হচ্ছে বাস্তব আর এইটুকু কল্পনা। এই অস্পষ্ট ডিমার্কেশন লাইনটি কৃতিত্বের সঙ্গে হ্যান্ডেল করতে না পারলে যেমন শিল্পকর্ম উত্তীর্ণ হয় না, তেমনি শিল্পীরা সেটা জানেন বলেই অবলীলায় বাস্তব ও কল্পনার জগৎকে একাকার করে দিতে পারেন, একটি কাল্পনিক বিষয়কেও বিশ্বাসযোগ্য শিল্প করে তুলতে পারেন। খালেদ খান প্রথম দৃশ্যেই দর্শকের সামনে থেকে বাস্তব ও কল্পনার মধ্যকার সীমারেখাটি কৃতিত্বের সঙ্গে মুছে দিয়েছেন, আর এজন্য তিনি ব্যবহার করেছেন সঙ্গীতের অপূর্ব মুর্চ্ছনা এবং আলো-আঁধারীর এক চমৎকার পরিবেশ (এই নাটকটি নিয়ে কথা বলতে গেলে এই বিষয়গুলো নিয়ে বারবারই কথা বলতে হবে)। এই ঘোরলাগা পরিবেশের কারণেই কবর থেকে উঠে আসা বংশীবাদক যখন বর্তমানের বেঁচে থাকা মানুষদের সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হয়, বর্তমানের মানুষেরা যখন বারবার বলতে থাকে- আপনি ভুল করছেন, তখন এই কথোপকথনকে আর অস্বাভাবিক মনে হয় না, বরং উল্টো মনে হয়- এরকম তো হতেই পারে, যেন এরকমটি প্রায়ই আমাদের জীবনে হয়ে থাকে! নাটকটি দেখার আগে, গল্পটির সারাংশ পড়ে আমার মনে হয়েছিলো- এই বিষয়টিকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে পারাটাই নির্দেশকের প্রথম পরীক্ষা, এবং সেটিতে তিনি লেটার মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ হবার পর পুরো নাটকটি দেখবার কৌতূহল আরো তীব্র হয়- এই কৌতূহলকে জাগ্রত রাখতে পারাটাও নির্দেশকের একটি বড় সাফল্য।
প্রথম দৃশ্যের পরেই, নাটকের কাহিনী ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যায় তিনশ’ বছর পেছনে। আমরা পরিচিত হই এক তরুণ বংশীবাদক আর তার ‘রূপবতী’ স্ত্রীর সঙ্গে, পরিচিত হই তাদের জীবনযাপন, স্বপ্ন-কল্পনা, প্রেম-পরিণয়, তাদের পরিপার্শ্ব, বাস্তবতা, ক্ষুধা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের সঙ্গে- এবং আমাদের একবারও মনে হয় না যে, আমরা তিনশ’ বছর আগের কোনো গল্প শুনছি, মনে হয় এ তো বর্তমানেরই গল্প, শুধু তিনশ’ বছর আগের পাত্রপাত্রীকে বর্তমানের বাস্তবতায় স্থাপন করা হয়েছে মাত্র। সেক্ষেত্রে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, বর্তমানের গল্পই যদি হবে, তাহলে তিনশ’ (বা পাঁচশ’ বা সহস্র) বছরের এই ফাঁকটুকু তৈরি করা কেন? এটুকু তৈরি না করলে কি নাটকের কাহিনীতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসতো? হয়তো আসতো না, কিন্তু এই ফাঁকটুকুর কারণে নাটকটিতে একটি ভিন্ন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। নাটকটির, আমি যতোটুকু বুঝেছি, মূল থিম ক্ষুধা। ক্ষুধার কারণে সহস্র বছর ধরে মানুষ তার সম্মান ও সম্ভ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে, এবং ক্ষুধা-বাণিজ্যের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে নারীরা, বিশেষত রূপবতী-দরিদ্র নারীরা। তিনশ’ বছর আগেও যেমন সেটি সত্য ছিলো, এখনও এটিই সত্য- ‘সভ্যতা’ মানুষকে এ থেকে মুক্তি দিতে পারে নি। আবহমানকালের এই সত্যটিকেই সম্ভবত নাট্যকার-নির্দেশক মঞ্চে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, এবং সেটি সফলভাবে করতে সক্ষমও হয়েছেন। এই নাটকের সব চরিত্রই অতীতের, কেবল বাউল চরিত্রটি বর্তমানের। নাটকের শেষদিকে বাউলের সঙ্গে বংশীবাদকের কথোপকথনে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উঠে আসে- যে কারণে বংশীবাদক তার রূপবতীকে হারিয়েছিলো, ঠিক একই কারণে বাউলও তার প্রেমিকাকে হারিয়েছে। ক্ষুধার যন্ত্রণা আর অর্থ-বিত্তের প্রলোভনের কাছে পরাজিত হয়েছে প্রেম ও পবিত্রতা, বিকিয়ে গেছে সম্মান ও সম্ভ্রম, হারিয়েছে স্বপ্ন ও কল্পনা। বাস্তবতার এই সমান্তরাল রেখাটি টানার ফলেই তিনশ’ বছরের ব্যাপারটি যৌক্তিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু যতোই যৌক্তিক হোক না কেন, বিষয়টি মঞ্চে উপস্থাপন করা মোটেই সহজ ছিলো না। যেমন, কতোগুলো প্রশ্ন উঠতে পারে- চরিত্রগুলো যে ভাষায় কথা বলেছে, তিনশ বছর আগে চরিত্রগুলো সেই ভাষায় কথা বলতো কী না, চরিত্রগুলো মাঝে মাঝে যে উচ্চমার্গীয় সংলাপ উচ্চারণ করেছে, সেগুলো তাদের মুখে মানানসই হয়েছে কীনা, যে বাস্তবতা দেখানো হয়েছে তা কতোটুকু বিশ্বাসযোগ্য ইত্যাদি। দর্শকদের মনে এইসব প্রশ্ন উঁকিঝুকি মারতে থাকলে পুরো নাটকটিই যে মাঠে মারা যেত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্নগুলো ওঠে বটে তবে নাটক দেখার সময় তা ওঠে না, ওঠে নাটক দেখে বেরিয়ে আসার পর। আর সেখানেই নির্দেশকের কৃতিত্বের প্রশ্নটি এসে যায়। পুরো নাটকের সামগ্রিক উপস্থাপনা এতো হৃদয়গ্রাহী যে, দর্শকদের পক্ষে কোনো প্রশ্ন নিয়ে ভাবার ফুরসত আর হয় না, নাটকে মগ্ন হয়ে থাকাটাই একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই চমৎকার উপস্থাপনার কৃতিত্ব পুরো টিমেরই - নাট্যকার-নির্দেশক ছাড়াও এই কৃতিত্বের ভাগ বিশেষ করে সঙ্গীত পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেতৃ, আলোক পরিকল্পক, এবং কোরিওগ্রাফারের প্রাপ্য। অভিনেতৃরা আগাগোড়া মঞ্চটিকে জমজমাট করে রেখেছেন, বিশেষ করে জমিদারের ভূমিকায় সাইফুল ইসলাম দিপু এবং রূপবতীর ভূমিকায় সোনিয়া হাসানের অভিনয়, এক কথায়, অনবদ্য। দিপুর অভিনয় এতো আকর্ষণীয় ছিলো যে, দেখার প্রায় একমাস পরও তার কণ্ঠস্বরটি আমার কানে বাজছে। সোনিয়ার চরিত্রটিই আকর্ষণীয়, অভিনয়ে তাঁর ডেডিকেশনও চোখে পড়ার মতো, তবু আমার মনে হয়েছে- এই চরিত্রটিকে নিয়ে যতোদূর যাওয়া যেত, তিনি বা নির্দেশক ততোদূর যান নি, অনেক সুযোগ তাঁরা হেলায় হারিয়েছেন। যেমন দ্বন্দ্ববহুল এই চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে সোনিয়াকে কখনো বিষণ্ন হতে দেখি নি, তিনি হেসেছেন-কেঁদেছেন-গেয়েছেন-নেচেছেন, কিন্তু বিষণ্ন হন নি- যদিও বিষণ্ন হবার মতো পরিস্থিতি বহুবার তৈরি হয়েছে। মঞ্চে খুব একটা বিষণ্নতাকে রূপায়িত হতে দেখা যায় না, কেন যায় না এ আমার অনেক দিনের প্রশ্ন, দুঃখের মুহূর্ত উপস্থাপনের জন্য কেবল কান্না ছাড়া কি আর কিছু নেই? আমার তো মনে হয় - কান্নার চেয়ে বিষণ্নতা অনেক বেশি সুন্দর এক্সপ্রেশন, বিষণ্নতা মানুষকে সুন্দরও করে তোলে (বিশেষ করে রূপবতীদের!)। চিৎকার করে কান্না অনেক সময় বিরক্তিও তৈরি করে, অভিনেতৃ বা নির্দেশকরা যে এটা বোঝেন না তা তো নয়, তবু মঞ্চে বিষণ্নতা তৈরি না হওয়ার জন্য কি উচ্চস্বরে সংলাপ বলার বাধ্যবাধকতা একটা প্রতিবন্ধতা হিসেবে কাজ করে? রূপবতী’র পোশাক পরিকল্পনায়ও আমি তেমন সৃজনশীলতার পরিচয় পাই নি। রূপবতী দরিদ্র, কিন্তু দরিদ্র হলে কি তাকে সাধারণ পোশাকে সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায় না? এসব বিষয়ে সোনিয়া নিজেই খানিকটা মনোযোগ দিতে পারতেন, বড় অভিনেতারা তো পুতুল নন যে সব বিষয়ে নির্দেশকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, বরং তারা নিজেরাই অনেক নতুন দৃশ্য রচনা করেন। অবশ্য সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া গেছে জমিদারের পোশাক নির্বাচনে। তার পোশাক, গেটআপ-মেকাপ, বাচনভঙ্গি, অভিনয়, বিশেষ করে তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ- সবই ছিলো চোখে পড়ার মতো। জমিদাররূপী দিপু যতোক্ষণ দৃশ্যে ছিলেন, ততোক্ষণই মঞ্চ আলো করে ছিলেন। অন্যদিকে যাদুকরের চরিত্রটি আকর্ষণীয় হলেও অভিনয়ের কারণে তা মার খেয়ে গেছে, অভিনেতা আসাদুল ইসলাম আসাদ ছিলেন অতিমাত্রায় উচ্চকিত, সংলাপ না আউড়ে মনে হলো সারাক্ষণ চেঁচাচ্ছেন, এতো লাউড চরিত্র এটি নয়, তবু কেন তিনি সেটাকে এভাবে উপস্থাপন করলেন বোঝা গেলো না, এদিকটাতে নির্দেশকের চোখও কেন পড়লো না কে জানে! বংশীবাদকের ভূমিকায় খালিদ হাসান রুমী ছিলেন প্রাণবন্ত ও সচ্ছন্দ, কিন্তু তার অভিনয়ে বারবার খালেদ খানের অভিনয়ের ছায়া পড়েছে বলে মনে হলো আমার। এতে তার মৌলিক অভিনয়-প্রতিভা ক্ষুণ্ন হবার সম্ভাবনা আছে। বাউলের চরিত্রে ব্রাত্য আমিনও ভালো অভিনয় করেছেন।
এই নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক- এর সংগীত পরিচালনা, আর পরিচালক হিসেবে আহসান হাবীব নাসিম তাঁর গভীর সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলি, প্রাচীন বটবৃক্ষের নিচে আইবুড়ো আর বংশীবাদকের কথোপকথনের সময় তিনি আবহ তৈরি করার জন্য- সোজা কথায় বটবৃক্ষের পাতার ধ্বনি তৈরি করবার জন্য- ব্যবহার করেছেন এক্সরে ফিল্ম। কৌশলে এক্সরে ফিল্ম দোলালে যে পাতার মর্মর-ধ্বনি তৈরি হয়- এটা আমি নিজেও কখনো ভেবে দেখি নি, এই একটি কাজেই নির্দেশকের সৃজনশীলতার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। নাটকে অনেকগুলো গান আছে, সেগুলোর মিউজিক কম্পোজিশন ছাড়াও নানারকম আবহ তৈরি করার জন্য নানা ধরণের মিউজিকের প্রয়োজন হয়েছে, পরিচালক প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা এবং দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আলোক নির্দেশনাও এই নাটকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ঘোর লাগা আবহ তৈরিতে আলোর একটি প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে, সেটি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পেরেছেন আলোক-পরিকল্পক আবু দাউদ আশরাফী। উদাহরণ হিসেবে বলি, জ্যোতিষী জোসনালোকিত রাত ছাড়া রাজা-বাদশাদের হাত দেখেন না বলে পূর্ণিমার রাতে জমিদারের হাত দেখার ব্যবস্থা করা হয়, ওই দৃশ্যে এক অসাধারণ কৌশলে জোসনার আলো তৈরি করা হয়েছে, দৃশ্যটি মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো ছিলো।
এবার টেক্সট প্রসঙ্গ। নাট্যকারের তৈরি করে দেয়া পাণ্ডুলিপি আর মঞ্চে উপস্থাপিত নাটকটি যে হুবহু এক হয় না, সেটা বলাইবাহুল্য। কিন্তু কতোটুকু পরিবর্তিত রূপ আমরা দেখতে পাই, সেটা জানার সুযোগ বা সৌভাগ্য আমাদের কোনোদিনই হয় না। যেমন, সেলিম আল দীনের সাত ঘণ্টার নাটক কীত্তনখোলা-কে নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ যে পৌণে তিনঘণ্টায় নামিয়ে এনেছিলেন, সেটি তিনি নিজে একটি সাক্ষাৎকারে (থিয়েটারওয়ালা, সপ্তম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০০৫) বলার আগে দর্শকরা জানতেই পারে নি। এক্ষেত্রে নির্দেশক উদারভাবে স্বাধীনতা নিয়েছেন, নাট্যকার সেটা মেনেও নিয়েছেন। অন্যদিকে সৈয়দ শামসুল হক এ ব্যাপারে খানিকটা রক্ষণশীল, তাঁর নাটকগুলো কাব্যনাটক বলেই একে খুব বেশি ভেঙেচুরে উপস্থাপন করার সুযোগ থাকে না, সৈয়দ হক সেটা চানও না, তাঁর সাক্ষাৎকার (থিয়েটারওয়ালা, অষ্টম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ, ২০০৬) থেকেই আমরা সেটি জানতে পেরেছি। রূপবতী নাটকটির ক্ষেত্রে কী ঘটেছে সেটি জানার আগ্রহ আমার ছিলো, এবং নাট্যকার-নির্দেশক দুজনের সঙ্গেই পরিচয়ের সুবাদে পাণ্ডুলিপিটি পড়ার সুযোগও আমার হয়েছে এবং দেখেছি এখানেও নাট্যকার উদারভাবে সম্পাদনা করে পাণ্ডুলিপিকে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন। দৃশ্যের ধারাবাহিকতা, চরিত্রের উপস্থাপন, সংলাপের ব্যবহার যেভাবে পাণ্ডুলিপিতে আছে, মঞ্চে তার চেয়ে অনেক ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, এবং নাটকটি দেখার সময় এই ভাঙচুরকে দৃষ্টিকটু বা অস্বাভাবিক বলে মনে হয় নি, বরং ভিন্ন কিছু হলেই খারাপ লাগতো বলে মনে হয়েছে। যেমন পাণ্ডুলিপিতে আছে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রকে (ইমাম) মঞ্চে উপস্থাপনই করেন নি নির্দেশক, মঞ্চের বাউল পাণ্ডুলিপির কৃষক, বংশীবাদকের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনে যে সব সংলাপ ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর স্থান পরিবর্তিত হয়েছে অনেকখানি, অনেক সংলাপের সংশোধন যেমন করেছেন, বহু সংলাপ আবার ব্যবহারও করেন নি। সব মিলিয়ে মঞ্চে যা দেখলাম সেটার সাফল্য বা ব্যর্থতার দায়ভার তাহলে কার? মঞ্চ নাটক সম্বন্ধে এরকম একটি প্রশ্ন, আমার মতো আরও অনেক দর্শকেরই, আছে বলে ধারণা করি। এবং বলা যায় এ কথাই - মঞ্চ নাটক কারো একার সম্পত্তি নয়। নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতৃ এবং অন্যান্য কলাকুশলীর যৌথ মালিকানায় থাকে একটি মঞ্চ নাটক। তাহলে টেক্সটের ভূমিকাটি কি? এ প্রসঙ্গে আমাদের মঞ্চের সফলতম নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য- ‘লিখিত রূপটা হচ্ছে বাড়তি পাওয়া। ..এটা চায়ের কাপে পিরিচের মতো...তলাপাত্রটা বড় না, মহাপাত্রই বড় এবং সেটা হচ্ছে কাপ। এই তলাপাত্র হচ্ছে সাহিত্যমূল্য আর মহাপাত্র হচ্ছে থিয়েটার। ...রবীন্দ্রনাথই হোক আর সফোক্লিসই হোক বা কালিদাসের নাটকই হোক, যেটা পড়ছি সেটা সাহিত্য পড়ছি এবং পড়ে তলাপাত্রের প্রশংসা করছি। এগুলোর মহাপাত্রটা হচ্ছে মঞ্চরূপটা। মঞ্চে না আনা পর্যন্ত সেটা আবার নাটক হয় নাকি?’ (থিয়েটারওয়ালা, অষ্টম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ, ২০০৬)।
সৈয়দ হক, যিনি নিজের নাটকে নির্দেশকের হস্তক্ষেপ কামনা করেন না, তিনিও মনে করেন- মঞ্চে না আনা পর্যন্ত নাটক নাটক-ই হয় না। তাঁর কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করেও বলা যায়- টেক্সট ছাড়া আবার মঞ্চ নাটক চলেও না। একজন নির্দেশক যতোই প্রতিভাবান হোন না কেন, নির্দেশনা দেবার জন্য তাঁর একটি টেক্সট দরকার হয়, নইলে অভিনেতৃদের তিনি কিসের ওপরে দাঁড় করাবেন, নিজেই বা দাঁড়াবেন কোথায়? আর তাছাড়া, প্রতিভাবান নির্দেশকরা দূর্বল পাণ্ডুলিপিকে ঘষেমেজে উন্নত করে তারপর সেটাকে মঞ্চে এনেছেন এবং সাফল্য অর্জন করেছেন এমনটিও তো কোথাও দেখা যায়নি। খুব উঁচুমাপের না হলেও একটি মোটামুটি মানসম্পন্ন পাণ্ডুলিপি ছাড়া ভালো কোনো নির্দেশক তো সেটাতে হাতই দেবেন না! রূপবতী’ও তাই। আগেই বলেছি, সব মিলিয়ে মঞ্চে উপস্থাপিত রূপবতী একটি মানসম্পন্ন নাটক। কিন্তু শুধু টেক্সট হিসেবে যদি এটিকে পড়তে যাই, তাহলে অনিবার্যভাবে কিছু প্রশ্ন উঠে আসবে। প্রথম প্রশ্ন ভাষা ব্যবহারের ধরন নিয়ে। যেহেতু নাটকটির একটি চরিত্র ছাড়া আর সবাই তিনশ’ বছর আগের মানুষ, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, তিনশ’ বছর আগে মানুষ এই ভাষায় কথা বলতো কী না। এই প্রশ্ন আরো জোড়ালো হয়ে ওঠে বর্তমানের বাউলের সঙ্গে তিনশ’ বছরের প্রাচীন বংশীবাদকের সংলাপ বিনিময়ের সময়। দুজনের ভাষাভঙ্গি, শব্দ ব্যবহারের ধরন একইরকম! দুজন যে দুই সময়ের মানুষ, সেটা অন্তত তাদের ভাষা শুনে বোঝার উপায় নেই। তাহলে কি তিনশ’ বছরে মানুষের ভাষা ব্যবহারের ভঙ্গিতে এতোটুকু পরিবর্তন আসে নি? দ্বিতীয় প্রশ্নটি চরিত্রগুলোর চিন্তাভাবনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। নাটকের প্রায় সব চরিত্রই উচ্চমার্গীয় চিন্তাভাবনায় অভ্যস্ত, কিন্তু এই চিন্তাগুলো তাদের চরিত্রের সঙ্গে যায় কী না, সেই প্রশ্নটি থেকেই যায়। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। রূপবতীর প্রেমে পাগলদশাপ্রাপ্ত জমিদারের সংলাপ (জ্যোতিষীর সঙ্গে):
জমিদার
রাজা বাদশাদের একটাই শূন্যতা, শূন্যতা বলে তাদের কিছু থাকে না। তারা চাইলে পাবে না, অন্তত এই ভবের জগতে এমন কিছু তাদের থাকে না। কিন্তু সেই রাজাই যদি একটা কুমড়ো গাছের ফুল ...
জ্যোতিষী
অসুবিধা একটাই, আপনি যাহাকে কুমড়ো ফুল বলিয়া জ্ঞান করিতেছেন তাহারা তাহাদের জীবনের চাইতে গুরুত্ব দেয় সতীত্বকে।
জমিদার
সতীত্ব! ছেঃ, জ্যোতিষী আপনি সর্বসাধারণের মতো মুর্খই রয়ে গেছেন। সাহিত্যে বলুন, জীবনীতে বলুন সতীত্ব সতীত্ব বলে যেসব কিসসা লিখিত, এই সবই নারীদেরকে নিজের কব্জায় বন্দী রাখার জন্য পুরুষদের রচিত রূপকথা মাত্র। আপনি লক্ষ্য করে দেখেছেন কি জ্যোতিষী, লোক কাহিনীতে মেয়েদের সতীত্বে বিজয়ী করে পুরুষদের কী রকম লম্পটভাবে উপস্থাপন করা হয়? তারপরেও নারীদের চোখে যুগ যুগ ধরে পুরুষরাই মহান হয়ে থাকে। ...
রাজা বাদশাদের একটাই শূন্যতা, শূন্যতা বলে তাদের কিছু থাকে না- এই পংক্তিটি অসাধারণ এবং প্রাসঙ্গিক, সন্দেহ নেই। যে-কোনো কালের যে-কোনো রাজার জন্যই এই উপলব্ধিটি সত্য। কিন্তু তারপরের সংলাপ- সাহিত্যে বলুন, জীবনীতে বলুন সতীত্ব সতীত্ব বলে যেসব কিসসা লিখিত, এই সবই নারীদেরকে নিজের কব্জায় বন্দী রাখার জন্য পুরুষদের রচিত রূপকথা মাত্র- কি এই চরিত্রের সঙ্গে যায়? এটা তো আধু্িনক নারীবাদী-চিন্তা বলেই জানি, তিনশ’ বছর আগে বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামীণ জনপদের একজন জমিদার এরকম চিন্তা করতেন, এটা কি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়? সেক্ষেত্রে তো আমরা নিজেদেরকে নারীবাদের জনক বলে দাবি করতে পারি! আগেই বলেছি, জমিদার চরিত্রে দিপুর অভিনয় ছিলো অসাধারণ এবং তিনি নিজ গুণে পাণ্ডুলিপির এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠেছেন, ফলে নাটকটি দেখার সময় অসঙ্গতিটুকু খুব তীব্রভাবে অনুভূত হয় নি। কিন্তু এরকম আরেকটি উদাহরণ দিলে চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নয় এমন সংলাপ ব্যবহারের ধরনটি বোঝা যাবে।
রূপবতীকে কাবু করার জন্য জাদুকরের অনেকগুলো সংলাপের মধ্যে একটির কিয়দংশ : ‘... তুমি যে গান আমারে শুনাইতেছো, হেই সুরের উপরে তুমি বসাও আনন্দরে। তুমি তুমার স্বামীরে কও, এই গানের জন্ম হইছে তার লাইগাই। তুমরা দুই শিল্পী মিইল্যা জন্ম দেও এমুন এক শিশুর, যে জন্মের পরে মায়ের দুধের বদলে জিভ দিয়া খুঁজবো রঙধনু। বাঁশি আর গানের সুররে ধনুক বানায়া হেয় বিদ্ধ করবো আসমানের যা কিছু শূন্যতা।’ অংশটুকু লক্ষ্য করুন প্রিয় পাঠক, এরকম একটি সংলাপ রচনা করা যার-তার পক্ষে সম্ভব নয়, শিল্পের আগুনে যার হৃদয় পুড়েছে তার পক্ষেই এটা সম্ভব। নাসরীন জাহান যে শুধুমাত্র রূপবতী নাটকের রচয়িতাই নন, প্রকৃত অর্থেই একজন শিল্পী সেটার প্রমাণও দিচ্ছে এই সংলাপটি, কিন্তু জাদুকর চরিত্রের সঙ্গে যে এটা যাচ্ছে না! এবং বিষয়টি আরো প্রকট করে তুলেছেন অভিনেতা নিজেই, তিনি আগাগোড়া শুধু চিৎকার করেছেন, এরকম একটি সংলাপ বলার যে এক্সপ্রেশন এবং গভীরতা দরকার সেটা তার মধ্যে তো ছিলোই না, নির্দেশকও এ ব্যাপারে খুব একটা মনোযোগ দিয়েছেন বলে মনে হলো না। উদাহরণ না বাড়িয়ে বরং ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। নাটকের শেষদিকে একটি সংলাপের মাধ্যমে ‘রূপবতী হত্যা-রহস্যের’ জট খোলে- বংশীবাদক নিজেই যে তার স্ত্রীর হত্যাকারী সেটা জানা হয়ে যায়, কিন্তু ততোক্ষণে নাটকটি এমন এক ভিন্নমাত্রায় উপনীত হয়েছে যে, এই প্রসঙ্গটি নিতান্তই গৌণ, অপ্রয়োজনীয় এমনকি অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। ক্ষুধার্ত মানুষের বাস্তবতা আবহমানকাল থেকে একইরকম, তার কোনো দেশ-কাল নেই- এরকম একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার ঠিক আগের দৃশ্যেই, এরপর আর রূপবতীর হত্যাকারী কে এই প্রশ্নটি মনেই থাকে না। বরং ওই প্রসঙ্গ টেনে এই নাটকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকুকেই- বাস্তবতার এই সমান্তরাল রেখা টানার দৃশ্যটিকে- গৌণ করে ফেলা হয়েছে। তবে, একেবারে শেষ দৃশ্যটা তাৎপর্যপূর্ণ, এবং এটি মূল পাণ্ডুলিপিতে নেই- বোঝাই যাচ্ছে এটি নির্দেশকের নির্মাণ এবং দৃশ্যটি নাটকটি নিয়ে নতুন করে অনেককিছু ভাববার সুযোগ করে দেয়। কবরের মানুষ কবরে ফিরে যাওয়ার পর নাটকের পর্দা পড়তে পারতো, কিন্তু দেখা যায়- তারা আবার উঠে আসছে, যেন নতুন একটি গল্প বলবার জন্য - হয়তো এভাবেই ফিরে আসে মানুষ বার বার, বহুবার- আর তৈরি হয় নতুন নতুন গল্প।
আহমাদ মোস্তফা কামাল ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ) : কথাসাহিত্যিক