Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

বিনির্মাণবাদী সাহস এবং রবীন্দ্রনাথের সংকোচন

Written by শাহমান মৈশান.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

সমালোচকগণ স্বভাবতই সন্দিগ্ধ- রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যের মধ্যে বিরাট স্রষ্টার শিল্পদগ্ধ প্রজ্ঞা প্রকাশ পায়। রবীন্দ্রতুল্য পাশ্চাত্যের আরেক নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো নাটকেও ভ্লাদিমির আর এস্ট্রাগণের সময়-যাপনের নিরর্থক খেলা আর কথোপকথনের মধ্যে এক সুতীক্ষ্ণ গালি হিসেবে উচ্চারিত হয় ‘সমালোচক’। জীবনানন্দ দাশও ‘সমারুর’ কবিতায় তাঁর কবিতা সমালোচকদের একটি কবিতা লিখে দেখিয়ে দিতে সক্রোধ নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আল মাহমুদ একবার বলেছিলেন, আমি সমালোচনা বলতে বুঝি অ্যাপ্রিসিয়েশন। কিন্তু আল মাহমুদ উদ্ধৃত অ্যাপ্রিসিয়েশন মানে কী? স্বচ্ছ প্রশংসা? সম্ভবত নয়। শিল্পকর্মের বিপরীতে রসগ্রাহীর উদ্দীপনাময় ভাষা নির্মাণের একটি নতুন প্রকল্প হয়ত-বা।

তথাপি সমালোচনার অনন্ত স্রোত বয়ে চলেছে। সমালোচনা স্বয়ং একটি এস্টাবলিশমেন্ট, একটি দ্বান্দ্বিক প্রতর্ক বা ডিসকোর্স। সমালোচনার ভাষা নির্মিত হয় এডওয়ার্ড সাঈদ কথিত ইন্টারপ্রিটেশন (রেহনুমা আহমেদ অনুদিত শব্দ হচ্ছে ‘তাফসীর’। এই অনুবাদের মাধ্যমে ওরিয়েন্টালিজমের বিপরীতে দাঁড়াতে গিয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা রেহনুমা বাংলাদেশের ‘মৌলবাদী’ রাজনীতির অবগুন্টন ‘তাফসীর’ই কবুল করেন।) বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। আর বিশ্লেষণ কখনোই একটি নিরপেক্ষ পরিভাষা ও প্রপঞ্চ নয়।

নিরপেক্ষতা শব্দটিকে আমি এই লেখার পরতে পরতে অতি পরোক্ষ মোকাবিলা করতে থাকবো। আমি মোকাবিল করবো রবীন্দ্রনাথকে এবং রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকের প্রাচ্যনাট কর্তৃক প্রযোজনা রাজা এবং অন্যান্য... কে। এটি একটি সাবজেক্টিভ ভাষা-প্রকল্প। কেননা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সর্বদাই সাবজেক্টিভ।

২.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধুনিক এবং একটি গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ বা মহাবয়ান। রবীন্দ্রনাথ তাই একটি এস্টাবলিশমেন্ট বা প্রতিষ্ঠান। এধরনের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে হলে প্রতিভা, বিরাট প্রতিভা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের সেই মারাত্মক প্রতিভা আছে। কালিক বিবেচনায় মনে করি রবীন্দ্রনাথ একটি ঘটমান বর্তমান। রবীন্দ্রনাথ তাই পরলোকগত নন, তিনি বিদ্যমান। এমনকি রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটি প্রতিভা বা জিনিয়াস। প্রতিভার নামাঙ্কন হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই ভাষা ও ব্যাকরণ।

আমার ইত্যকার হাইপোথিসিস উৎপাদনের মূলে রয়েছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর অনুধ্যানময় বিশাল শিল্পজীবন। একে অভিহিত করবো উৎপাদিত পূর্বানুমানগুলোর প্রথম কারণ হিসেবে। আর প্রথম কার্যকারণ সূত্রটির শিরোনাম রাখছি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথের এই বিদ্যমানতা, এই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া এবং ভাষা ও ব্যাকরণের অ্যালিগরি নয় মেটাফরে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি সামাজিক উৎপাদন-প্রক্রিয়া দ্বিতীয় কার্যকারণসূত্র হিসেবে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। এ হচ্ছে ব্যক্তি-প্রতিভা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি অদ্যাবধি বাঙালি পাঠক-শ্রোতা দর্শক তথা বিদ্বৎসমাজের রেসপন্স বা বহমান প্রতিক্রিয়া। এভাবে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিজে যেমন নির্মাণ করেছেন, তেমনি পাশাপাশি, অবিচ্ছেদ্যভাবে ‘সমষ্টি’র দ্বারাও নির্মিত হয়েছেন, হয়ে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথকে সামাজিক প্রক্রিয়ায় নির্মাণ করার মধ্য দিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিকে অবয়ব দানের তৎপরতা হিসেবেও এটি চিহ্নিত হতে পারে। রবীন্দ্রনাথকে নির্মাণ করার কিংবা রবীন্দ্রনাথকে একটি গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ আকারে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার মধ্য দিয়ে একটি সংরক্ষণশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল বা মৌলবাদী চরমপন্থাও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে ঘুনপোকা হয়ে প্রবেশ করেছে। আমি ‘সমষ্টি’ বলতে উপরোক্ত রবীন্দ্রভক্ত বিদ্বৎবলয়কেই বুঝিয়েছি। এই সমষ্টি বাংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতির একটি সর্বজনীন ‘রবীন্দ্ররূপ’ অনুসন্ধান করেছে। এই অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে ‘সমষ্টি’ বা বিদ্বৎসমাজ একটি অধিপতিমূলক কর্তৃত্ব বা হেজিমনিও বিস্তার করেছে। এর ফল স্বরূপ, রবীন্দ্রনাথের কাছে যে-কারো পৌঁছবার ক্ষেত্রে একটি বাধার মহাপ্রাচীর দাঁড়িয়ে থাকে। রবীন্দ্র-আশ্রয়ী এই ‘সমষ্টি’ এভাবে একটি স্কুলিং বা একাডেমি তৈরি করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে এই একাডেমির বাইরে কোথাও রবীন্দ্রনাথ নেই। এই প্রতিষ্ঠিত ও অধিপতিমূলক রবীন্দ্র-নির্মাণের কিছুটা হলেও বিপরীতে দাঁড়াতে চেয়েছে ঢাকার নাট্যদল প্রাচ্যনাট তার রবীন্দ্র-প্রযোজনা রাজা এবং অন্যান্য ... নিয়ে। এর মধ্য দিয়ে গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ রবীন্দ্রনাথকে ইন্টারপ্রেট করা কিংবা এনকাউন্টার করার একটি সাহস সূচিত হয়েছে। এটি একটি বড় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইভেন্ট হিসেবে বিবেচনাযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গড়ে তোলা মিথের শক্তির বিপরীতে তারুণ্যনির্ভর নাট্যদল প্রাচ্যনাট হয়ে উঠতে চেয়েছে বিনির্মাণবাদী। তাই প্রাচ্যনাটের রাজা এবং অন্যান্য... তথা রবীন্দ্র প্রযোজনাটি রবীন্দ্রনাথভিত্তিক মৌলবাদের বিপরীতে একটি সাহসী বিনির্মাণবাদী নাট্যতৎপরতা। এই প্রযোজনার নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম ও তাঁর সহকর্মীরা শিল্পনির্যাস সৃষ্টির চেয়েও একটি গুরুত্বপূর্ণ নৃবৈজ্ঞানিক সৃষ্টির পথে হাঁটবার জন্য অভিনন্দন পাবেন। প্রাচ্যনাটের রবীন্দ্র-প্রযোজনার প্রধান ও প্রায় একমাত্র তাৎপর্যটিকে আমি এভাবেই চিহ্নিত করতে চাই। এই প্রযোজনার মধ্য দিয়ে আজাদ আবুল কালাম-গণ ‘সমষ্টি’র রবীন্দ্র-বিষয়ক একাডেমির বিপরীতে গিয়ে একটি নতুন ধরনের অ্যাটিচ্যুড প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে এই প্রযোজনাটি হয়ে ওঠে উত্তরাধুনিক।

নির্দেশক আজাদ আবুল কালামের এই উত্তরাধুনিক প্রবণতা খুঁজে এনে তাঁর প্রযোজনাগত সমস্ত বিশৃঙ্খলা এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকের মূল বক্তব্য প্রযোজনার মধ্যে যেভাবে অস্ফূট ও দিকভ্রান্ত হয়েছে তাঁকে জায়ের করার কোনো যুক্তি নেই।

৩.
আজাদ আবুল কালাম নির্দেশিত রাজা এবং অন্যান্য ... প্রযোজনাটির লক্ষণীয় কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন নাট্যিক উপস্থাপনার পাশাপাশি মাল্টি-মিডিয়ার প্রয়োগ। ইউরোপের বার্টল্ট ব্রেখট পূর্ববর্তী পিসকাটরের প্রযোজনাতেও চলচ্চিত্রিক প্রয়োগের দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর বর্তমানে বাংলাদেশেরও বহু প্রযোজনায় তরুণদের কাছে থিয়েটারের এখন একটি প্রিয় শিল্পকৌশল হিসেবে প্রযুক্ত হচ্ছে মাল্টি-মিডিয়া। আমেরিকান সর্বগ্রাসী বর্বরতা, জাতিসংঘ কিংবা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বৈঠকী অসারতা ইত্যাদি মাল্টি-মিডিয়ার মধ্য দিয়ে এই প্রযোজনায় দর্শকের কাছে চেনা ইনফরমেশনগুলোই ফিরে এসেছে। মঞ্চে চলমান নাট্যক্রিয়ার সাথে মাল্টি-মিডিয়ার এই প্রয়োগ যুক্ত হয়ে নাট্যকর্মটিকে তৃতীয় কোনো বাক্সময় অর্থ বা তাৎপর্য সৃষ্টির দিকে নিয়ে যেতে পারে না। এই প্রযোজনায় তাই মাল্টি-মিডিয়ার প্রয়োগ শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে বৈশ্বিক রাজনীতির চেনা অনুসঙ্গ বা দৃশ্যকল্পগুলোর চমকপ্রদ ও বিচ্ছিন্ন উপস্থাপনা মাত্র।

রাজা এবং অন্যান্য... প্রযোজনার ত্রিমুখী মঞ্চবিন্যাস ও স্বল্পসংখ্যক মঞ্চ-উপাদান ও দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবহার অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও কার্যকর। ত্রিমুখী মঞ্চবিন্যাসের ফলে দর্শকের কাছে এই নাট্য উপস্থাপনা অনেক অন্তরঙ্গ ও নিবিড় মনে হয়। কিন্তু অন্ধকার ঘর, পথ, কুঞ্জদ্বার, প্রাসাদ দ্বার, শিবির, কুঞ্জবন, স্বয়ম্ভরসভা ইত্যাদি স্থানিক বৈচিত্র্যকে নির্দিষ্ট করতে ডিজাইনিংটি ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে আলোক পরিকল্পনাও কার্যকর হয় নি। তীব্রতা, বন্টন, অবস্থান, গতির বুদ্ধিদীপ্ত ও সংবেদশীল পরিকল্পনার অভাবের কারণে দৃশ্যান্তর ও নাট্যঘটনার মনস্তাত্ত্বিক অর্থ নির্মাণ করতে আলো উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারে নি।

সুদর্শনা, সুরঙ্গমা, রোহিনী ও ঠাকুরদা’র পোশাক পরিকল্পনার মধ্যেই সুচিন্তা ও কার্যকারিতা খুঁজে পাওয়া যায়। অন্যদিকে কাঞ্চীরাজ ও অন্যান্য রাজাদের পোশাকের মধ্যে নির্দেশক কথিত আমেরিকানাইজড্ সভ্যতার উপসর্গগুলোর প্রেক্ষিতে একমুখী ও সরল পরিকল্পনার ছাপ থাকলেও এই নাটকের লিটারারি টেক্সটের গভীর বিমূর্ততার লেশ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।

রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকে উল্লেখিত গানগুলোর প্রত্যেকটি বিশেষ বিশেষ নাট্যঘটনার আবর্তে চরিত্রগুলোর একেকটি উত্তীর্ণ বোধকে তুলে ধরে। তবে প্রযোজনার মধ্যে সেই সুনির্দিষ্ট বোধ-ই যে অভিব্যক্ত হতে হবে- তা নয়। কিন্তু এর সমান্তরাল শক্তি ও কার্যকর প্রয়োগ তো প্রযোজনায় ঘটবে। রবীন্দ্রনাথের নাটকের গান কোনো অলঙ্কার নয়, নাটকের কাঠামোর অনিবার্য জৈবিক উপাদান। কিন্তু এই প্রযোজনায় কাঠামোগত তাৎপর্য ও অর্থ নিয়ে গানের সংযোগ ঘটে নি। তবে আবহসংগীত ছিল কৃতিত্বপূর্ণ।

প্রযোজনাটির সবচেয়ে অসহনীয় দিক হচ্ছে এর অভিনয়-রূপায়ণ। বাহ্যিক অবাচনিক ক্রিয়ায় অভিনেতৃবৃন্দ যতটা কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, সেই তুলনায় অভিনেতার মনের মধ্যে চরিত্রসুলভ যথার্থ প্রণোদনার ঘাটতির কারণে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে রাজা নাটকের মধ্যে ব্যক্ত হওয়া মানুষের শক্তি অনুসন্ধানটি তৃতীয় কোনো মাত্রায় বাক্সময় হয়ে উঠতে পারে নি। উত্তীর্ণ ও তৃতীয়মাত্রিক অভিনয়ের জন্য প্রয়োজন নাটকের মধ্যে সুনির্দিষ্ট চরিত্রটির খণ্ডিত ও সার্বিক ভূমিকাকে স্পষ্টরূপে চিহ্নিত করতে পারা। রাজা নাটকের ভাব ও বক্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে এক ইউনিক চরিত্র হচ্ছে সুদর্শনা। সুদর্শনার ভূমিকাটি চরিত্ররূপায়ণকারী আফসানা মিমি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের রাজা-র প্রথম দৃশ্যেই আমরা দেখতে পাই- অন্ধকার ঘর; রাণী সুদর্শনা ও তাঁহার দাসী সুরঙ্গমা। শেষ দৃশ্যে দেখতে পাওয়া যায়, আবার,- অন্ধকার ঘর; সুদর্শনা ও রাজা। মাঝখানের ১৮ টি দৃশ্যান্তরের মধ্য দিয়ে ঘটে যায় সুদর্শনার এক জীবন-পর্যটন। রবীন্দ্রনাথের কথায়- ‘রাজা নাটকে সুদর্শনা আপন অরূপ রাজাকে দেখতে চাইলে, রূপের মোহে মুগ্ধ হয়ে ভুল রাজার গলায় দিলে মালা- তার পরে সেই ভুলের মধ্যে দিয়ে যে অগ্নিদাহ ঘটালে, যে বিষম যুদ্ধ বাধিয়ে দিলে, অন্তরে বাহিরে যে ঘোর অশান্তি জাগিয়ে তুললে তাতেই তো তাকে সত্য মিলনে পৌঁছিয়ে দিলে। প্রলয়ের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টির পথ।’ এই ভুল, এই অগ্নিদাহ, যুদ্ধ সংঘটন, মনের অবিরাম দ্বন্দ্ব ও প্রলয়বাহিত মিলন ও সত্যের যে অজস্র বাঁক ফেরার উত্তুঙ্গ অভিজ্ঞতা- অভিজ্ঞতার এই রূপায়ণ আফসানা মিমির চরিত্রায়িত অভিব্যক্তির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠে নি।

রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকটি অসরল ও বহুস্তরায়িত। এই নাটকের মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের জীবনশক্তির অনুসন্ধান ও স্বরূপ যেমন প্রকাশ পায় তেমনি এক অদর্শায়িত রাষ্ট্ররূপকল্প নির্মিত হয়। রবীন্দ্রনাথের রাজা কোনো অখণ্ড ব্যক্তিগত চরম সত্তা নয়। ‘রাজা’- এই রাজনৈতিক প্রত্যয়টি অদর্শায়িত হয়েছে মহানায়ক হিসেবে নয়, লোকনায়ক হিসেবে। মানুষের উদ্বোধিত শক্তির মধ্যে রাজশক্তি তথা প্রভুশক্তি নিহিত। এক অর্থে রাজা কিংবা নায়ক হচ্ছে মানুষ। আর প্রতিটি মানুষ জীবনভর অনুধ্যনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত নায়কোচিত রাজা ও প্রভূর সঙ্গ লাভ করতে পারে। সমস্ত ব্যক্তিগত এককের খণ্ড খণ্ড ‘রাজা’ সত্তা ও শক্তির অভিন্ন রূপকল্পনা হলো প্রকৃত ও মহামানবিক রবীন্দ্রনাথের রাজা।

তাই রাজা নাটকটির কমপক্ষে দুটি পাঠ উঠে আসে। একটি হচ্ছে এর দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিত, অন্যটি এর রাজনৈতিক সিগনিফিকেন্স। কিন্তু প্রাচ্যনাটের প্রযোজনার স্নায়ুকেন্দ্রে কোনোটিই ঐক্যের মহিমা নিয়ে প্রমূর্ত হয় নি। সমকালীন বিশ্ব রাজনৈতিক বাস্তবতায় মূলত আমেরিকানাইজড্ উপসর্গগুলো তথ্য আকারে এই প্রযোজনায় প্রতিফলিত হয়েছে, বিশ্লেষণ হিসেবে নয়। রবীন্দ্রনাথের রাজা প্রাচ্যের মানুষের জীবন, সংগ্রাম ও সত্যে পৌঁছার সাধনা এবং রাজনীতিকে শ্বাশ্বত সময়ের কাঠামোতে ব্যক্ত করেছে। প্রাচ্যনাটের রাজা এবং অন্যান্য... প্রযোজনাটি প্রাচ্যের মানুষের জীবন, সংগ্রাম ও সত্যে পৌঁছার অনুধ্যানের পরিবর্তে অনুপ্রবেশক নয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর রাজা-কে নিজেদের বিপুলায়তনিক, পরিশ্রমী ও সাহসী নাট্যপ্রচেষ্টায় বন্দী ও সংকুচিত করেছেন।

শাহমান মৈশান: শিক্ষাথী, নাট্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়