Full premium theme for CMS
নাট্য-অবলোকন অনেকান্ত- অন্যতম এক পর্যবেক্ষণ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
দেশ-কালে বাঁধা থাকে তো মানবসমাজ, তাবৎ সৃজন-মনন বাঁচন-মরণ তার। সরল-সিধা বাস্তবিক রূপে তার প্রকাশ-পরিচয় সর্বদা তবে মেলে না। শিল্প-নন্দন কলায় তার আদল বহু বিচিত্র রূপে-বিরূপে সদা রূপান্তরিত। টেকনিকের সেই বিচিত্রবীর্য বহুরূপ রূপায়ণে সৃজনের মাহাত্ম্য। স্বয়ং বিষয় বা ভাব আখ্যানও এমত পুনর্ণবায়নশীল হয়ে ওঠে। ‘অপূর্ব’ নব বা নবীনতা সৃজনকলার মৌল বা সামান্য লক্ষণ বলে চিহ্নিত হয় অবিসম্বাদিতভাবেই। কোনো দেশ-কালেই তা নিয়ে মতদ্বৈধতা নেই।
বাংলাদেশের থিয়েটারে দেশ-কাল সংলগ্নতা প্রাথমিক সরল পর্ব পার হয়ে ক্রমে জটিল অসরল হয়ে ওঠে। রাজনীতির সরব ঘোষণা অবসিত হয়ে নিরালম্ব নন্দন-দোলায় দিশেহারা আজ তা। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ একদা ভুলভাবে যেমত কদর্য হয়ে উঠেছিল, এতদিনে তা-ই যেন সত্য হয়ে উঠেছে। দেশ-কালের কোনো সম্পর্ক-দায়ও অগ্রাহ্য করা যেতে পারে যেন শিল্প-নন্দনের স্বাধীকারের দোহাই দিয়ে। বাজারের মুক্ততা এমন এক বিমুক্ততা সূচিত করেছে বুঝি। সকলেই আর সবকিছু আজ বিচ্ছিন্ন একক। তবে এর বিপরীত এক এষণা, বলা যায় বিনির্মাণের বিনির্মাণও দানা বাঁধছে- negation of the negation-এর প্রক্রিয়ায় বুঝি।
২০০৮ সালে কয়েক প্রযোজনার কথা বলা যায় সবার আগে। সি.এ.টি-র অ্যাম্পিউটেশন, প্রাচ্যনাটের রাজা এবং অন্যান্য ..., ঢাকা থিয়েটারের নিমজ্জন, সুবচন নাট্য সংসদের খনা, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ত্রয়লাস ও ক্রেসিডা, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের প্রাগৈতিহাসিক আর পালাকারের রাইফেল-ও প্রাসঙ্গিক প্রযোজনা এ বিবেচনায়।
সি.এ.টি বৈদেশী অনুদান-নির্ভর দল। তাদের ঘোষণা যদিও থিয়েটারের পেশাদারিত্ব। ইবসেন প্রযোজনার পাশাপাশি ইউরোপীয় নানা রূপরীতি-ধারার নাটক করে তারা। সংস্কৃত নাট্য-উৎসব সেমিনার, রবীন্দ্রনাটক এবং সেই সঙ্গে গোটা দুই ‘লোকনাট্য’ও করেছে। দেশ-কাল সংলগ্নতার চেয়ে হাইব্রিড এক ক্রস-কালচারের কথা বলে তারা। তাতে যদিও স্বদেশীয় সত্তা তত লক্ষ্যগোচর হয় না- ইউরো নানা মুদ্রাই উচ্চকিত হয়ে ওঠে। দেশ-কালের দেখা তেমন মেলে না। অ্যাম্পিউটেশন তার একমাত্র ব্যতিক্রম।
বর্তমান এক বিশ্ব-কাল রূপায়িত এ নাট্যে। বিশেষত বাংলাদেশে ঘটমান বছর দুই অনূদিত এই নাটকেও এমন দৃশ্যকাব্যে বিন্যস্ত যার রগরগে অমানুষিক ‘ওপেন সিক্রেট’ দুঃস্মৃতি দুঃসহ অনুপুঙ্খতায় বিধৃত। ক্ষমতার তাণ্ডব-বীভৎসা ক্ষিপ্রগতির প্রলয়বিধ্বংশী নাট্যভাষায় রূপ পেয়েছে। জাতীয় নাট্যশালার বড় মঞ্চটির সহায়তায় মঞ্চেও লং-মিড-ক্লোজ শটের বিচিত্র মুহুর্মুহু গতিপ্রাবল্যে, স্থিতি-চলমানতার পয়েন্ট-কাউন্টার পয়েন্টে নাট্যক্রিয়া অমোঘ হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার নৃশংস উন্মাদনায় আদিম পশুশিকারী মানুষ যেন উলট এক নবপুরাণে রূপান্তরিত। বিরুদ্ধাচারী ভিন্নমতালম্বী ধরে ফেলার অপারেশন সার্চলাইট বা ক্লিনহার্ট পুনার্ভিনীত হয় বিচিত্র নাট্যক্রিয়ায়, থিয়েটারি ইডিয়মে। ‘রিমান্ড’- যা কিনা স্বদেশীয় ক্ষমতার মৌল ক্রিয়াকল্প হয়ে উঠেছে তারই অতিরেক অনুপুঙ্খতা দমচাপা সত্তাচেরা গোঙানিতে উচ্চকিত। তাতে কিছুটা মাত্রাতিরিক্ততা যদিও ঘটে, নাট্যের জ্যাবদ্ধ ছিলা যাতে করে ঢিলা হয়ে যায়। অত্যাচারের পুনরাবৃত্তি একটু যেন বেশি-ই মনে হয়। কোনো বাস্তবিকতার কথা বলেও তার বিপত্তি ঠেকে না। নারীকে যৌনপীড়ন আরও লাগসই মাত্রায় না হলে তো বিপরীত ফল দেয়। দর্শকের অভ্যস্ত সংস্কারকে আঘাত করা চাই নিশ্চয়ই তবে তারও দেশ-কালভেদ আছে- কোনো আন্তর্জাতিকতার দোহাই দিলেই চলবে না। এরকম কিছু অতিরেক সত্বেও অ্যাম্পিউটেশন বাংলাদেশের মঞ্চে বিশ্বমানের এক নাট্য-অভিজ্ঞতা। স্পেস ব্যবহার, কম্পোজিশন, কোরিওগ্রাফির ক্ষিপ্র চলন-বলন, খরতর আলোক প্রক্ষেপণ আর আবহ-ধ্বনির আতীব্র ধাতব অর্কেস্ট্রাযোগে আখ্যান লাগসই নাট্যক্রিয়ায় একেবারে আজকের বিশ্ববাস্তবতার প্রতিস্পর্ধী থিয়েটার হয়ে ওঠে। সি.এ.টি এবং কামালউদ্দিন নীলুর সম্ভবত শ্রেষ্ঠ অর্জন-নাট্য বলা চলে অ্যাম্পিউটেশন।
২০০৮-এর সবচেয়ে বিতর্কিত প্রযোজনা বুঝি প্রাচ্যনাট-কৃত আজাদ আবুল কালাম নির্দেশিত রাজা ...এবং অন্যান্য। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গঠিত, চর্চিত, প্রচারিত কল্পস্বর্গ তাতে বিষম আঘাত পেয়েছে। সৌম্য উপনিষেদীয় প্রশান্তির মিথ আজো ঘুচলো না তাঁকে নিয়ে। ছবিতে যার অমন কালাপাহাড়ি পরাক্রম রূপলাবণ্যের পেলব কোমলতা দুমড়ে মুচড়ে খানখান করে। অন্ধকার আর অগ্নির জ্বলন্ত প্রতিস্পর্ধা যেখানে। রূপপিয়াসী রাণী এই নাটকের রাজাকে কঠিন, কালো, ভয়ঙ্কর মনে ভাবে বারেবারে। কুসুম কোমল সুবর্ণকে রাজা বলে বিভ্রম ঘটে তার। রাণীকে কব্জা করার দখলদারি ব্যূহ ভেদ করেই তো তাকে উদ্ধার করে রাজা। যত সাধারণ জনে নিয়ে রাজার সেনাপতি হয় ঠাকুরদা, কোনো চোখধাঁধানো, ভয় দেখানো রাজাকে যে থোরাই কেয়ার করে। শম্ভু মিত্র তার সর্বশেষ পঞ্চম বৈদিক রাজা প্রযোজনায় তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতির ক্ষমতাদখলদারি লোফালুফি ধরেছিলেন ৭ রাজার চলন-বলন, অভিনয়, ব্যাখ্যানে। যেটা শুনেছি অনেকের ভালো লাগে নি রাবীন্দ্রিক আবহচ্যুতির জল্পনায়।
প্রাচ্যনাট সেখানে একটু বেশিই, একেবারে ইরাক দখলের ক্ষমতা লায়েক করে ছেড়েছে ৭ রাজাদের। প্রজেক্টরে যুদ্ধের তথ্য-চিত্রাবলী চলেছে; মিলনায়তনে ঢুকতে হয় ইউ.এস আর্মির ডিটেকটর পার হয়ে। আর মঞ্চটি তো ফ্যাশন প্যারেডের র্যাম্প। সেখানে ঠাকুরদার দলও ইউরো যন্ত্র-বাদ্য-ব্যালে নৃত্যে রবীন্দ্রগানের ইভেন্ট প্রেজেন্ট করে চলে। রাণী চরিত্রটিই কেবল আপাত রাবীন্দ্রিক থাকে। তার এক তাল-লয়ের অপরিবর্তনীয় আধা আড়ষ্ট স্মার্টনেসে। গোটা প্রযোজনায় একালীন যুদ্ধ পরিস্থিতি আর র্যাম্প মডেলিংয়ের গতিময়তা। রবীন্দ্রবচনেই ধৃত বাস্তব বিশ্বচরিত্রাবলীর জীবন্ত ভোকাবুলারি। শারীরিক ক্ষিপ্রতার লাগসই বিভঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে। এ প্রযোজনা আর অভিনয়ের সেরা অর্জন এটি। যদিও রাবীন্দ্রিক আখ্যানটি বর্তমান বাস্তবতায় পুনর্নিমাণ করতে গিয়ে যুদ্ধংদেহী ও ফ্যাশন-দুরস্ত অতিরেক লক্ষ্যহীন এক বিনির্মাণে ঝুঁকে পড়েছে। কাউন্টার পয়েন্ট যেখানে কোনো পয়েন্টের মুখোমুখি হয় না। রাজা আর ঠাকুরদার দলবল না একাল না বাংলা কোনো চরিত্র-পরিচয় পায়। মুক্ত এক ক্ষমতা-বিশ্বের একাধিপত্য এতটাই কি নিঃশেষ করে ছেড়েছে তাবৎ বিপরীত অস্তিত্ব-স্মারক বিবিধ বিচিত্র জাতীয় সাংস্কৃতিক চিহ্নাবলী (Signs)??
এ আখ্যানে রাবীন্দ্রিক যত স্বদেশীয় ভাব-চিন্তা-সুর-চরিত্র তুলে দেয়া হলো দুহাত তুলে যুদ্ধক্ষেত্র আর মডেল-র্যাম্পের হাতে- তাদের যাবতীয় ইডিয়মে রূপান্তরিত হলো একরঙা রাজা। তার ফলে, প্রথাগত রবীন্দ্র-মিথ কল্পজীবীরা সুযোগ পেল ‘রে রে’ করে উঠতে। একালের বাস্তবতায় রবীন্দ্র-নাট্যের পুনর্ণব-রূপায়ণ তার যথা-প্রাসঙ্গিকতা ঠিক পেল না। বিতর্কের ইন্ধনমাত্র হয়ে রইলো। যদিও এই প্রযোজনা রবীন্দ্র নাট্য-মুক্তির অমিত সম্ভাবনা সূচিত করেছে একুশ শতকীয় বিশ্ব-বাস্তবতায় তার এতখানি অভিনবত্বে, কালস্পৃষ্ট রূপায়ণে।
সেলিম আল দীনের নিমজ্জন অসামান্য রচনা। ইউরোপীয় নাটকের গঠনবিন্যাসের সীমা অতিক্রমণের নানা নিরীক্ষা করেছেন তিনি। মহাকাব্যের বর্ণনাত্মক প্রকরণে বিশ্বগণহত্যার এ আখ্যান উপস্থাপিত হয়েছে। ধ্বংসপুরে পঙ্গু এক অধ্যাপক সমীপে উপনীত হয়ে পাঠ নিচ্ছেন কথক। তাতে উঠে এসেছে মানবের অবিরাম বিনাসযাত্রা। নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ শিল্পনন্দনের নানা মাধ্যমের প্রয়োগে তার দৃশ্যকল্পসমূহ নির্মাণ করেছেন। বর্ণনার অনুপুঙ্খতার সঙ্গে মঞ্চপটে ছায়া-চলচ্চিত্র রূপায়িত হয়ে চলেছে। দৃশ্যশ্রাব্যতা পরস্পরের যোগে দর্শকের শ্রবণ-মনন-দর্শনিন্দ্রেয়ে যদিও ভারবহ হয়ে উঠেছে প্রায়শ। দৃশ্যকাব্যের সংহতি ও সামঞ্জস্য তাতে ব্যহত হয়েছে থেকে থেকেই। বর্ণনাত্মক অনুপুঙ্খ বাচনে শ্রুতির যে নিঃশব্দ অবকাশ আবশ্যক, তার বদলে দৃশ্যরূপের প্রবল আবহ যুক্ত হয়ে এহেন বিপত্তি ঘটিয়েছে। নাট্যক্রিয়া চিত্র বা ভাস্কর্যের স্থিরতা পেয়ে মুহূর্তসৃজন করে বাক্সময় হয় নি মুহুর্মুহু জটিল বাক্য-দৃশ্যের পুনরাবৃত্তিতে। অভিনব নানা ধ্বংসের ছায়াচিত্র বা লাগসই স্থাপনাসকল, বিবিধ মঞ্চসামগ্রী ও পঙ্গুতার কিম্ভুত রূপসজ্জা কিংবা ধ্বনির বিচিত্র আবহ-সৃজনের বিপুল আয়োজন বিস্ময় চমকিত করেও নাট্যভাষে কেলাসিত ক্রিয়া তত ঘটায় নি। শ্রবণ-দর্শন-মননের ওপরতলে আঘাত করে ফেরে কেবল। ভয়াল-বিভৎস-করুণ রসনিষ্পত্তি জমতে ঠিক দেয় না যেন। ধ্বংসের এক তাণ্ডব-যাত্রা চলতে থাকে কেবল বিরতিহীন। নৈঃশব্দের নন্দন-মাত্রা রূপায়িত হবার অবকাশ তত পায় না। আবিশ্বগ্রাসী এই বিধ্বংস মঞ্চবাচন ও প্রকরণে কী করে যে প্রলয়-নাট্য হয়ে উঠবে তা বোঝা দায়। বর্ণনা-দৃশ্যকল্পের এক ধরনের পরস্পর বিরুদ্ধতা আছে তো, কতদূর তাকে ভারসাম্যে মেলানো যায়- অভিনব এই সৃজন-স্পর্ধার সামনে উত্তরে থাকতে হয় বুঝি মৌন। তত্ত্বের কোনো মাহাত্ম্য কি বাহাদুরিতে তার নাগাল মেলা ভার। তবে, ঢাকা থিয়েটার তার নবীন অভিনেতৃ যোগে এক অভিযানই সম্পন্ন করেছে। বিমূঢ় বিস্ময়ে রচনাকার আর নির্দেশককে অভিবাদন তাই জানাতেই হয়।
সুবচন নাট্য সংসদ-এর খনা এক ধীমতি কিংবন্তীর ধীমান রচনা ও নির্দেশনা। নাট্যকার সামিনা লুৎফা নিত্রা আর নির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দার, দুই নবীনের মেলবন্ধনে, দলীয় তারুণ্য-যৌবন এমন ভারসাম্যের সামঞ্জস্য সৃজন করেছে- দুহাত তুলেই তারিফ করতে হয়। অথচ আখ্যান অনায়াসে অতিকথায় তরল নাটুকে হতে পারতো, প্রযোজনা ক্যারিসমা ভারাক্রান্ত হওয়া তো আজকালের থিয়েটারি মুদ্রাদোষ। বরং নাট্যকার কিংবদন্তীকে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ও যুক্তিগ্রাহ্যতায় এ প্রলোভনও সামলিয়েছেন ভালোই। ইতিহাসের পটভূমিতে দৈবনির্ভর জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে প্রকৃতিবিজ্ঞানে উত্তীর্ণ হবার সামাজিক প্রক্রিয়ায় বিন্যস্ত করেছেন আখ্যান। দৈব নিয়তিতে আচ্ছন্ন জ্ঞান-ক্ষমতা জনসমাজে বাহিত বিজ্ঞানের মুখোমুখি হয়ে নাট্যক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয়ের মানমন্দিরে, নিরীক্ষা-ক্ষেত্রটি ভূমিতে স্থাপন করে নাট্যদৃশ্যকল্পটি অর্থপূর্ণ করা হয়েছে। মধ্যমিলনায়তনে এরিনা-সদৃশ আয়তাকার মঞ্চক্ষেত্রটি নাট্যের দৃশ্যগত পরিমণ্ডলই তৈরি করেছে- অকারণ বর্ণনাত্মক মঞ্চানুগ মুদ্রাদুষ্ট লাগে নি। একটি দুটি নাট্যক্রিয়া যদিও ক্লিশে আক্রান্ত। নাট্যকার অভিনীত খনা-চরিত্রটি খানিকটা অপরিবর্তনীয় বিকাশ-রহিত লাগে। তুঙ্গ নাট্যমুহূর্তটি অনেক্ষণ ঝুলে থেকেও তেমন কোনো পরিণতির বিস্তার পায় না। তবুও এ নাট্য নানা ধরনের দর্শককে একটি নন্দন-মনন মুদ্রায় রসভোক্তা করে তোলে। মন তাতে সত্যসাধিকার নিবিড় ব্রতে একাত্ম হয়। যদিও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর আখ্যান-পরিস্থিতি তত লাগসই তীক্ষ্ণতায় টানটান হয়ে ওঠে নি। তাতেও যে নাট্যকৃতিত্ব কমে নি- সেটা কম কথা নয়।
ত্রয়লাস ও ক্রেসিডা- নিয়ে কত কথা শুনেছি হক ভাইয়ের মুখে। শেক্সপীয়রের নাকি সবচেয়ে দুরূহ নাটক এটি। কত কত বছর পরে নাকি মঞ্চস্থ হয়েছে। গ্রিক পুরাণের দেবদেবীদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা মজা করা হয় এ নাটকে। তাদের নাকি তৎকালীন ক্ষমতাবাজদের মতো লাগছিল- পুরাণ ও শেক্সপীয়র দুইকালীন রাজনীতি-মাস্তানদের মতো মনে হয়েছিল। অনুবাদেও সাধ্যমতো সৈয়দ শামসুল হক তাদের কমিক্যাল বাচন ধরতে চেয়েছেন। আবার যেন পৌরাণিক উচ্চতাও বহাল থাকে তারও কসরৎ করেছেন। অথচ প্রযোজনা আর অভিনয়ে আমরা কী দেখি? সেকালীন আর একালীন ক্ষমতার জীবন্ত বাচনমুদ্রা দেখি কি তেমন? এদের নিয়ে সঙ জোকারী মশকরা করতে পেরেছেন কতটা নির্দেশক-অভিনেতৃদল? আর একই সঙ্গে আমরা কি চেনা আর অচেনা লায়েকদের নিষ্ঠুর রঙ্গ দেখে মজা আর ভয়ের রস চাখতে পারি? পৌরাণিক ক্ষমতা-মানুষী লোভ, হিংসাবিদ্বেষ-ঘৃণা রিরংসায় চিরচেনা চিরকালের মানুষজন তাদের চলন-বলনে বাস্তব ও বাস্তবোত্তর কমিক্যাল হয়ে উঠবে না? আমাদের সঙ-যাত্রা-আলকাপ বা নাগরিক মেলোড্রামার সঙ্গে ইউরোপীয় মলিয়ের-ব্রেশট-মায়ারহোল্ড-পিচকাটর-পিটার ব্র“ক খানিকটা করে জানা চেনা আছে। আমরা কি তাহলে বাস্তবে ও দৈনন্দিনে নিজেদের আর অন্যদের, ক্ষমতাজনদের ঠিক দেখি না? দেখতে চাই না পাই না, পারি না? আমরা যে চলিফিরি নাটক করি সবই কেমন তাই কি বানানো? পারফরমেন্সের এক নাগরিক স্মার্টনেস সম্বল মাত্র? নাট্য ও পৌরাণিক চরিত্রাবলী তাই কি একধরনের ছদ্ম পৌরাণিক গাম্ভীর্যে নির্মিত?- যেমন কিনা জীবনের বাস্তবতায় আমরা? পায়ের নিচের বাস্তব কোনো ভিত্তি বিনা অনির্দিষ্ট, অচেনা, ভুল চরিত্রের ভুল অভিনয়ে? তার উপরে শেক্সপীয়রের অমন দাঁতভাঙা কথনের বাংলা ভাব-ভাষা-বাচন, আমাদের জীবন-অভিজ্ঞতায় যার দেখা তেমন মেলে না। তাই কি সংলাপ-কথন উগরানো কথার কথা লাগছিল? কেউ যেন তেমন কিছু সত্যি সত্যি বলছিল না। ভাবনা-অনুভব রহিত তাই সে বাচন। সেটাও তো একটা ক্যারিকেচার হতে পারতো। অথচ তা-ও তো হলো না।
মঞ্চের দৃশ্যকল্পও কোনো প্রতিবেশ ইমেজ গড়ে নি। খেলনা এক এরিনা মঞ্চ-কেন্দ্রে অভিভবহীন ছিল। বিরাট মহাকাব্যিক দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধ-ভূমির কোনো বিস্তার আলোধ্বনি অভিনয়ের সহায়তায়ও কখনো লাগে নি।- সব মিলে ‘প্রযোজনা’ নির্দেশক আতাউর রহমানের মানসম্মত ঠিক হলো না।
প্রাগৈতিহাসিক মঞ্চে করা হয়েছে শুনে কেমন অস্বস্তি আর বিরক্ত লাগছিল। সাধারণ মানুষজনের ক্ষুধা আর কামজীবন নিয়ে আমাদের কী হবে? কতটা কি পাবো তা থেকে আমরা? করতেই বা পারা যাবে তার কতটা? এককালে তবু এইসব মানুষ বিষয়ে অভ্যস্ত, চর্চিত কিছু চিন্তা-অনুভূতি ছিল, কিন্তু আজ? কোনোভাবে কতটা তাদের আর জানি চিনি বুঝি? অন্তত তার একটা সত্যিকার ইচ্ছা-চেষ্টা কিছুটাও কি আছে আজ আমাদের? তাহলে? অথচ এইসব ইতরজনের কাণ্ডকারখানা আমরাও তো অন্যভিন্ন রীতি-পদ্ধতি-বাচনে করি। তাই নিজেদের খুঁজে পেতে, নিজেদেরই ক্রিয়াকলাপের জীবন্ত স্পন্দেই হতে পারে তো চরিত্রের অভিনয়। নইলে ইতরজীবনের এই জৈব রাফনেস আমাদের ছদ্ম শালীন-শীলন দিয়ে কেমন করে কতটা ধরা যাবে? সাধারণ মানুষজন-চরিত্রের কতক চলন-বলন মুদ্রাভঙ্গির নানা ধরন আমরা মঞ্চে মিডিয়ায় তৈরি করেছি- তাই দিয়েই আমরা একেক চরিত্রের অভিনয় করি। তার কতক টাইপও আছে। তবে গুণি অভিনেতৃ নতুন নতুন টাইপ সৃজন-নির্মাণও করেন। বেশি টাইপ্ড হলে নতুন ধরন বা রকমের চাহিদা জাগে। একেই বলে বুঝি টেকনিক, অভিনয় শৈলী। তারই চর্চা-শিক্ষা-প্রয়োগ হয় নাট্যকলা বিভাগে-মঞ্চে-মিডিয়ায়।
এই প্রযোজনায় একধরনের টাইপ কোনো চরিত্রানুকরণের অভিনয়ই করা হয়েছে। যাকে বলে বাস্তবমন্য চরিত্রাভিনয়। একটি কোনো দেখা-চেনা ধরনের অনুকরণ করা। যেন বিশ্বাস্য হয়ে ওঠে চরিত্রটি- সেটাই তো অভিনয়ের অন্বিষ্ট। ঢাকার মঞ্চে অবশ্য এই ধরনের অভিনয় খুব বেশি হয় নি। বিষয়-রীতি-অনুগ বাস্তবোত্তর নানা স্টালাইজেশন আমরা করেছি, করি। গণনাটক পথনাটকে যার স্থূল ব্যবহার। মঞ্চে স্বাভাবিকতার একটা জীবন্তস্পন্দ আনার চর্চাশীলন হয়। কমবয়েসী অভিনেতৃদল ভালোই শিক্ষা-প্রয়োগ করেছে এ রীতির প্রাগৈতিহাসিক নাটকে। গোল মাথা চোখা মাথা ছাড়া অন্য কোনো নাটকে তেমন কোনো রীতির ভালো রূপায়ণ তেমন দেখি নি। তবে হাল-ফ্যাশন বর্ণনাত্মকের ছোঁয়াচ না লাগিয়ে ব্রেশট অনুসরণে ব্যাখ্যান-কথন হলে আর একটু স্বাভাবিক লাগতো বুঝি আখ্যান-উপস্থাপন। একালে কামুকতার যে বাণিজ্যমুক্তি, আমাদের জীবনের যাপনেও তার চর্চা-প্রয়োগ যেমন উলঙ্গ হয়ে উঠেছে প্রাগৈতিহাসিক ভালো অবলম্বন হতে পারতো- তার উদ্ঘাটনে, রূপায়ণে। কিন্তু আমরা যে তা ঘটাতে চাই না, লুকাতে চাই, তেমন কোনো চেতন-হুঁশ-ভাবনা-সংকট নাই যে তা নিয়ে। স্মার্ট এক পারফরমেন্স-এর অভিনয় হলেই হলো। তবে এ নাটকে অভিনেতৃদল ভালোই খেটে সব করেছে। ইনামুল হক-লাকী ইনাম সংঘটিত করে চলেছেন নাট্য মঞ্চে, মিডিয়ার সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে। মত্ত ষাঁড়ের দ্বিমুখী শিং ভালোই বাগ মানিয়ে চলেছেন তরুণতুর্কী তেজে। অভিনন্দন মাহমুদুল ইসলাম সেলিমকেও, এমন একটি গল্পের নাট্যরূপ দেয়ায়।
ব্রেশটের রাইফেল রূপান্তর করেছে ‘পালাকার’। তাদের স্টুডিও থিয়েটারে মুক্তিযুদ্ধের এক আখ্যানে তা মিলিয়েছে। দর্শকসহ ছোট পরিসরটি, বাস্তবানুগ দৃশ্যকল্প সহযোগে, অনেকখানি স্বাভাবিক অভিনয়রীতে, ভালোই নাট্যের ভাষায় রূপায়ণ করেছে। তবে ধ্রুব আবহধ্বনিটি বড়ই বৈদেশী- তাতেই আলগা বিযুক্ত করে ফেলে রূপান্তরিত আখ্যানের বাস্তবানুগ পরিবেশ ও মেজাজ। অথচ সুরটি নিশ্চয় নাট্যের নিহিত বেদনাকে টানটান বুননে বাঁধতে চেয়েছিল- থিয়েটারি এক ইডিয়ম হিসেবে প্রয়োগ করে। ইয়াহিয়ার মুখে কেন তবে টিপিক্যাল থিয়েটারি মুখোশ? কামরুল হাসান যে পশুর অবয়ব বানিয়েছিলেন তার সঙ্গে কোনো যুক্ততা থাকা দরকার ছিল যে-কোনো অনুষঙ্গে। মায়ের অভিনয়ে কমবয়েসী মনিরা রহমান অবনী থিয়েটারি ধরন আয়ত্ত করেছিল ভালোই- বাচনের এক স্টালাইজেশনে, চলাফেরা হাবভাব ভঙ্গি নিয়ে। ধর্মীয় লোকটি কিছু চেনা টাইপ তবে ছোট ছেলেটি নয়। চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তার তেমন দাঁড়ায় নি বলেই হয় তো। শহীদের লাশ একক মিছিল-প্রতিভূ আনলে চলে না। তবুও নবীন নির্দেশক আশিকুর রহমান আর অভিনেতৃদের তারিফ করতে হয়।
দেশ-কাল-পাত্র বড় বেশি বিস্রস্ত অষ্টাবক্র ত্রিশঙ্কু হয়ে আজ ঝুলছে বুঝি ছদ্ম এক নন্দন-মনন রুচিতে। তবুও মঞ্চে চলছে সংশপ্তক একলব্য কতক রোখ। সে বড় কম কথা নয়। নিন্দা-সমালোচনা করা খুবই সুলভ-সহজ। উল্টা স্রোতে নাক উঁচিয়ে টিকে থাকা, প্রাণপাত করে কিছু করা অপার বীরত্বের কাজ আজ। সেই তাদের স্যালুট করেই, করেও, তবু কিছু বলা, লেখা।
যে-কোনো বিবেচনাই তো আরো অনেকের ভাবনা জাগায়। সেটাও নাট্যক্রিয়ার অন্বিষ্ট প্রক্রিয়া। একমাত্র বা শেষ কথা বলে তো কিছু নেই।- তাই এই এক অন্যতম পর্যালোচন অনুধ্যানে যদি আরো কিছু অনেকান্ত অন্য কথা উঠে আসে।
ড. বিপ্লব বালা: নাট্যকলাশিক্ষক ও সমালোচক