Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যরীতি ও সেলিম আল দীন

Written by কাজী সাঈদ হোসেন দুলাল.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

বাংলাদেশ হাজার বছর ধরে টিকে আছে- এর নদী আছে, বন আছে, মানব সমাজ আছে। পৃথিবীর ভৌগলিক অবস্থানে রকমফের ঘটেছে। বাংলাদেশের নামও এক থাকে নি। এর নাম কখনো পুণ্ড্র, সমতট, হরিকেল, গৌড়, বঙ্গাল- নানান নামে অভিষিক্ত হয়েছে। আচার-আচরণ ও ঐতিহ্যবাহী রীতি, তার সংস্কৃতি, নদীর গতিপথ, ফলবৃক্ষের আকার, প্রকৃতির নানান পরিবর্তন ঘটেছে। আমাদের এই বঙ্গদেশে ঐতিহ্যবাহী নাট্য ও তার শিল্পরীতি অনেক প্রাচীন। প্রায়োগিক দিক থেকে হেরফের হয়েছে। আমরা যদি লক্ষ্য করি প্রত্যক্ষ করব, মহাভারত ও রামায়ণের গল্পকাহিনী নিয়ে হাজার হাজার লোকপালা নাট্য-গীত-নৃত্যধারা রচিত হয়েছে।

মঙ্গলকাব্য ধারায় মাটির মঞ্চে চারণ দ্বারা গীত হয়েছে অন্নদামঙ্গল, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, গোবিন্দমঙ্গল, মৎসমঙ্গল, শস্যমঙ্গল, সরোবরমঙ্গল। পাশাপাশি পৌরাণিক কাহিনী ও মিথ দ্বারা রচিত বা চারণ দ্বারা গীত পালাসমূহ- শিবপুরাণ, কালিকাপুরাণ, বিষ্ণপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, লক্ষ্মীপাঁচালী, স্বরসতীপাঁচালী।

পরবর্তীকালে আমরা প্রত্যক্ষ করি আমাদের এই ভূখণ্ডে উপরে উল্লিখিত নানান সূত্রের আদলে এবং সুফিবাদের পদার্পনের আঙ্গিকতায় মিশ্রিত শিল্পধারা পথ থেকে পথে প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। গ্রামসমাজগৃহের আলোকবর্তিকায় লক্ষিণদরের হাস্তর, আসমানসিংযাত্রা, ঈমানযাত্রা, কৃষ্ণলীলা, নৌকাবিলাস, কবিগান, পুতুলনাচ, ষষ্ঠিরগান, ঘোড়ানাচন, গোরনাথ, কাজলরেখা, গাজীরগান, নারীধামালী, ঘেটুযাত্রা, শিবেরগাজন, ইসমাইলের কোরবানীরজারি, শিব গৌরিরপালাসমূহ।

পরবর্তীকালে যাত্রার নানা আদল আমরা প্রত্যক্ষ করি নাম ও প্রায়োগিক ঢঙে ভিন্নতা। আমরা লক্ষ্য করি যাত্রা, লেবেলযাত্রা, ঝুমুরযাত্রা। ঘেটুযাত্রা, খৈলান যাত্রা-র এই পালাসমূহ প্রত্যক্ষ করি। আমেনাবিবির পালা, বেদেনির পালা, রাখালবন্ধু, মহুয়া, আলোমতি, প্রেমকুমার, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না, ভেলুয়াসুন্দরী, আমিনসাধু, নছিমন পরিবানুর পালা, পাতালপুরির রাজকন্যা-সহ নানা পালাও প্রত্যক্ষ করি।

ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস ও কাল্পনিক ইতিহাস সমন্বয়ে লিখিত পালাসমূহ আমাদের সামনে আসতে থাকে- শাহজাহান, টিপু সুলতান, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, মীর কাশেম, বাঁশেরকেল্লা, সাধক রামপ্রসাদ, লালনফরিক, কোহিনুর-সহ নানা পালাসমূহ। সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে যাত্রাপালা আমাদের সামনে হাজির হয়- একটি পয়সা, বাঙালি, নিহত গোলাপ, রক্তের বাধন, মাটির মানুষ, গলি থেকে রাজপথ, অশ্রু দিয়ে লেখা, সমাজের বলি, রক্তে রোয়া ধান। উপরোক্ত পালাসমূহ ছাড়াও গান নির্ভর বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো- কির্তন, কবি পাঁচালী, কালি কির্তন, নৌকা বাইচের গান, রয়ানী, গাজীর গান, ভাদু, টুসু, চটকা, মুর্শিদী, ছাঁদ পিটানো গান, ভাওয়াইয়া, নবীর গান, সাঁওতালী গান, মাইজভাণ্ডারী, মারফতি, ঝুমুর বিয়ের গান, মিছিল যাত্রা, গজল, গম্ভীরা, গৌরগীত, বিচ্ছেদ, নীলেরগান, রাখালিয়া, দেহতত্ত্ব গুরুভজন, ঘেটুরগান, ঢাকেরগান, মাদার গান, বিভিন্ন মঞ্চ ছাড়াও বার মাসের তের পার্বণের এই দেশে বিভিন্ন মেলা হত, সেই মেলায় পালা গানসমূহ পরিবেশিত হতো। মেলাসমূহ- পৌষ পার্বণের মেলা, গঙ্গাøানের মেলা, মহরমের মেলা, বৈশাখী মেলা, শ্রাবণ সংক্রান্তির মেলা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, চরকের মেলা, মহাদেবের মেলা, বাটুদার মেলা, গাজী পীরের মেলা। উপরোক্ত ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যসমূহের ধারার পাশাপাশি বাঙালি জীবনের নানা লোকাচারের আয়োজনে চলতে থাকে বট পাইকুড়ের বিয়ে, হাজরা নৃত্য, নবান্ন উৎসব। পৌষ পার্বণ মেলা, খেলা, অন্নদা মঙ্গলিক, এই ধারায় নৃত্য-ছন্দে গীত ও বর্ণনে নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ বাঙালির মানসপট।

একথা অনস্বীকার্য বাংলার লোকপালা, লোকসংস্কৃতি লোক ধারার আদলে বাহিত বাঙালির জীবন কর্মের বহতা নদীর পরিপূর্ণ স্রোতের সবটাই বহন করেছিলেন সেলিম আল দীন। পুরাণ বা মিথের শাখা প্রশাখায় হেঁটেছেন তিনি। দেশের আটচালা, দোচালা, নাটমণ্ডপ, রাজার বাগান, তে রাস্তার মোড়, নদীর বাঁকের বটতলায়, গৃহাঙ্গণে, উঠানে, কৈলানে পালাসমূহ প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি নৃত্য ধরেছেন ছন্দ ধরেছেন। চরিত্রে প্রবেশ করেছেন, সুরের মুর্ছনায় চারণের গায়িত গীত চরিত্র নিজের মানসপটে সৃজনের ধারায় সৃষ্টির নতুনতর মার্গে গেছেন।

মহাভারতের কৃষ্ণ উপাখ্যানের সমরাসুর বধপালা সেলিম আল দীন তেমাথায় দেখেছেন। কৃষ্ণ বধ করছে সমরাসুরের পুত্রকে। সমরাসুর প্রতিজ্ঞা করল বধ করবে কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্নকে। শাপগ্রস্ত কামদেব ভ্রুণ হয়ে কৃষ্ণের স্ত্রীর উদরে গেলেন। জন্মালেন কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন হয়ে। সংবাদে রাগান্বিত সমরাসুর একে একে তিন মায়া শক্তি দ্বারা কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন হরণে ব্যর্থ হলো।

অধিক যজ্ঞে আরো বলবান হয়ে দৈত্যকুলের শিরমণি সমরাসুর নিজেই মায়া শক্তি বলে কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামার রূপ ধারণ করে হরণ করলেন কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্নকে। আকাশে রথ থাকাবস্থায় হত্যা করতে চাইলেন প্রদ্যুম্নকে। দেবশ্রী নারোদ উপস্থিত সমরাসুরকে বললেন শিশু হত্যার দায় না নিয়ে আকাশ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করাই শ্রেয়। সমরাসুর তাই করলেন। আকাশ থেকে পড়ে কৃষ্ণপুত্র গেলেন মাছের পেটে। দেবতার অভিশাপগ্রস্ত ‘স্বর্ণবোয়ালের’ পেটে গেলেন প্রদ্যুম্ন। সমারাসুরের সেনাপতি ভানুসুরের স্ত্রী ভানুমতি মাছের পেট থেকে পাওয়া কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্নকে গ্রহণ করলেন নিজপুত্র রূপে। ধ্যানে আসিন দৌত্য কুলের ঋষি সদানন্দের মর্ত্যলোকে সমরাসুরের ঘাতকের আগমন টের পেলেন। সেনাপতি ভানুসুরকে আদেশ করলেন ঘরে পালিত পুত্রকে হত্যা করতে। ভানুমতি ছিলেন স্বর্গ লোকের অপ্সরা পদ্মমিনি। শ্রীহরি বিষ্ণু অপ্সরার নৃত্যে সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলেন। পদ্মমিনি বর পেলেন রামায়ণ ও মায়াবি শাস্ত্রের অপপ্রয়োগ করার অপরাধে দৈত্যকুলে নিঃসন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন পদ্মমিনি ভানুমতি রূপে। পালিত পুত্র প্রদ্যুম্নকে কৃষ্ণের নির্দেশে রসায়ণ মায়াবি শাস্ত্র দিয়ে বড় করলেন। প্রদ্যুম্ন হত্যা করল দৈত্যকুলের মহারাজ সমরাসুরকে। পালা দর্শন করলেন সেলিম আল দীন, আমরা পেলাম নাটক শকুন্তলা। স্বর্গলোকের অপ্সরা মেনকা মর্ত্যলোকের ঋষি বিশ্বামিত্র। ফল হল প্রতারণায় ভ্রুণ শকুন্তলার জন্ম। মনুষ্য শক্তির পরাজয়।

গোবিন্দবাড়ির আঙ্গিনায় চারণ দ্বারা গীত হচ্ছে অদ্ভুদরামায়ণ ও তত রামায়ণের পালা যা কৃত্তিবাস রামায়ণ বা প্রচলিত রামায়ণের আগের অংশ। নাচ-গান-কথা অঙ্গভঙ্গীর বর্ণনাত্মক রীতিতে পরিবেশিত। সেলিম আল দীন পালা দেখছেন। রাবণ পূর্বজন্মে ঋষিপুত্র রূপে ঋষি পল্লীতে জ্ঞানার্জন করছেন। জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি পৃথিবীর মনুষ্য জাতির সেবায় চিকিৎসা শাস্ত্রের দুর্লভ ভেষজ বৃক্ষের বাগান করছেন বারণ। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করছেন ভেষজ বৃক্ষ। রাবণ সংবাদ পেলেন ঋষিদের মহিষের রাবণের শখের ভেষজ বাগানসহ মানুষের ক্ষেতের পর ক্ষেতের শস্য নষ্ট করেছে মহিষগণ। এই মহিষ ঋষিদের যজ্ঞের মহিষ। ঋষিগণ দেবতার ভক্ত তাই ঋষিগণের মহিষ ফসল নষ্ট করলে তার কোনো অপরাধ নেই। রাবণ বাধা দিলেন। রাবণের সহপাঠী মহিষের আঘাতে মারা গেল। সহপাঠীর মৃত্যুতে রাগত রাবণ এক মহিষ হত্যা করে। রাবণের সাথে দেবতাদের বিবাদের সৃষ্টি পূর্বে জন্মে। সেলিম আল দীন দেখলেন পালা। আমরা পেলাম নাটক ধাবমান। সম্পূর্ণ বিপরীত মহিষ সোহরাবকে। মানুষের প্রেমের প্রতীক সোহরাব। প্রকৃতির অংশ সোহরাব।

রাজশাহী অঞ্চলের শস্যভাণ্ডার এই বরেন্দ্র ভূমি। রাজা জমিদারের বিরুদ্ধে ফসলের নায্য হিস্যার ইতিহাস অনেক পুরনো। সিরাজগঞ্জ জামতৈল ভাঙ্গুড়া ফরিদপুর মূলাডলি শরৎপুর লাহিড়ী মোহনপুর সলঙ্গা এই অঞ্চলের মানুষ ফসলের অধিকার আদায়ের জন্য ‘আধিয়ার’ আন্দোলন করছেন অনেক বছর আগে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফরাজিরা। ফরাজিদের ঐতিহ্যবাহী আন্দোলন ও তাদের ব্যবহৃত থালা নিয়ে সেলিম আল দীন লিখলেন নাটক বাসন। যা এ দেশে সর্বাধিক মঞ্চায়িত নাটক।

গ্রামীণ নবীন প্রবীণ সৌখিন যাত্রামোদীদের সমন্বয়ে শারদীয়া দূর্গা উৎসবে শিব মন্দিরের আঙ্গিনায় পৌরাণিক পালা দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভা চলছে। হ্যাজাক লাইটের ক্ষীণ আলোয় বাঁশের কঞ্চির তৈরি তীর ধনুক আকাশের দিকে লক্ষ্য তখন স্থির। দর্শককুল তখন অভিনয় দর্শনে মগ্ন। মঞ্চে আসলেন রাজকন্যা দ্রৌপদী। দর্শকের করতালি। হঠাৎ দর্শকের একজন বলছে আরে এ-তো দ্রৌপদী না, গোপেশদা, দেখ দেখ দাঁত নেই। দর্শকের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। মিনিট পাঁচেক হবে গোপেশদা অনর্গল দ্রৌপদীর ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছেন। দর্শকের মন নেই মগ্ন নিস্তদ্ধ দর্শক বৃদ্ধ গোপেশদা অভিনয়ের প্রশংসা করলেন সেলিম আল দীন। ক্লান্ত মুখের দিকে চেয়ে বললেন আপনাদের ঘাম শ্রমে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের ভিত শক্ত হয়েছে।

মানিকগঞ্জ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের অস্তিত্ব খুবই প্রাচীন। পুরাণ পালা যাত্রা পালা লোকপালা এবং মাঙ্গলিক পালাসমূহ বিদ্যমান। ঐ অঞ্চলের শ্রদ্ধেয় গায়েন হাকিম আলী, তার গাজীর গান দেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আমন্ত্রণ জানালেন সেলিম আল দীন। গাজীর গান মূলত মানতের গান। সুফি-দরবেশ, গাউস-কুতুব, ওলিগণের অলৌকিক শক্তির বর্ণনা নৃত্যগীত অভিনয় কথামালার এক সূত্রে অভিনয়রীতি প্রচলিত। চামর আসকান টুপি কাঙ্গাল কোর্তা পোষাক পরে অনেকটা কিচ্ছা পালার মত। হাকিম আলী গায়েন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন।

সেলিম আল দীনের আগ্রহে নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও শিমূল ইউসুফের তত্ত্বাবধানে সাত রাত্রির পালা নাগরিকদের জন্য তিন ঘন্টার মত কাঁট কাঁট করে তৈরি করা হল। পোশাক-আশাক মঞ্চপরিকল্পনা করলেন ডঃ জামিল আহমেদ। নান্দনিকভাবে ঢেলে সাজানো হল। অনেক পরিশ্রম করা হল। লোকপালার সম্রাট হাকিম আলী গায়েন বেইলি রোডের গাইড হাউসে মঞ্চায়নের জন্য এলেন। সেলিম আল দীনের ভাবনা তখন জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণ। আয়োজকদের পক্ষে ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার ঢাকার নাট্যজন ও নাট্য বোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানালেন। এলেন মাত্র পনের থেকে বিশজন নাটকের মানুষ। শুরু হল অভিনয়। বৃদ্ধ হাকিম আলী গায়েন ছন্দে-নৃত্যে অভিনয়ে একেকটি ধ্র“বতারার জন্ম দিচ্ছে অভিনয়ের উচ্চতা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের কাছাকাছি ভূমণ্ডলের সমস্ত শিল্পমালা তখন জ্যোর্তিময় আভায় হাকিম আলী গায়েনের সমস্ত শরীর থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে সরে যাচ্ছে ধুলিকণা। বাংলার চারণের গীত গান তখন বিশ্ব দরবারে উপস্থিত। পালা সমাপ্ত হল। ব্যথিত আয়োজকরা- কেন এলেন না নাটকের বন্ধুরা। সেলিম আল দীন ঘোষণা করলেন ৩০ চৈত্র হবে জাতীয় নাট্য আঙ্গিক দিবস। হাকিম আলী গায়েনের কাছ থেকে বর্ণনাত্মক রীতির নাটক লেখার ধারণা ও এক থেকে একাধিক চরিত্রে প্রবেশের শিল্পের স্বরূপ আমার ধারণামতে সেলিম আলদীন ও ঢাকা থিয়েটার পেয়েছিলেন।

গ্রাম বাংলার বাংলা নাট্যের অন্যতম পালা মনসামঙ্গল বা মনসার গান বা পদ্মার নাচন বা রয়ানী বা ভাসানপালা। মনসা মঙ্গলের কিছু লিখিত পাণ্ডুলিপি আছে তবে গ্রামাঞ্চলে চারণগণ কাহিনীর মূল বিষয় বস্তু ঠিক রেখে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন পয়ার ও ধোয়া তৈরি করে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় আজ রাত্রে যে পয়ার গীত হয়েছে কালরাত্রের সেই পয়ারের শব্দমালা পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা ভুখণ্ডের সকল স্থানেই মনসামঙ্গল মঞ্চায়নের স্থান। প্রাচীনকালে মনসামঙ্গলের উপাখ্যানে বেহুলা-লক্ষ্মিণদার পর্ব সংযোযিত করে। অপার কৃপাময়ি মনসা দেবীকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মনসা দেবীর পোড়ো জীবন। বিয়োগান্তক জীবন প্রবাহ। বাসর ঘরে লক্ষ্মিণদারকে সর্প দ্বারা দংশন স্বামীর জীবন ফিরে পাওয়ার আশায় মৃত স্বামীর সাথে থাকা, নদীর সাত বাঁকে অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। কোনো কোনো চারণের মতে নেচে গেয়ে শিবকে সন্তুষ্ট করে স্বামীর জীবন ফিরে পাওয়া অন্যমতে ধোপানির ঘাটে শিবশংকরের কাপড়ের পরতে পরতে বালা বালি নাম লিখে অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে ভোলানাথ শিব শংকর সন্তুষ্ট হয়ে স্বামীর জীবন ফেরত দেন। মনসামঙ্গল পালায় বাজার নির্মাণ, লোহার বাসর নির্মাণ অথবা সর্পকুলের অলংকারের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা আধুনিক নগরায়ণ ও সৌন্দর্য বর্ধিত অলংকারও ঐ বর্ণনার কাছে হার মানে। মনসামঙ্গল মূলত মানতের গান। যা নিুবর্ণের উভয় জাতি দ্বারা পুজিত হয়। সেলিম আল দীন অনেক আগেই মানিকগঞ্জ অঞ্চলের চারণ গায়কদের কাছ থেকে মনসামঙ্গল সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়া দেশের নানা স্থানে মনসা পালা তিনি দর্শন করেছিলেন। মনসামঙ্গল পালার অস্তিত্ব সেলিম আল দীনের নানা নাটকে পাওয়া যায়। শকুন্তলা নাটকে মনসা মন্ত্রের চিহ্ন দেখা যায়। বনপাংশুল-র সুকি বা হাত হদাই-য়ের ছুক্কুনি চরিত্রের সাথে পেড়ো জনম মনসার যোগফল মিলে যায়। প্রাচ্য নাটকে উল্টো মনসার অস্তিত্ব বিদ্যমান। নদীতে বেহুলা-লক্ষ্মিণদারের জন্য লড়াই করে ছয়ফরচাঁন নোলকের জন্য মাটি খোঁড়ে। একজন সাপ হত্যা করতে চায় অন্যজন জীবন রক্ষা করতে চায়। এক জায়গায় মিলে যায়। ছয়ফরচাঁন প্রকৃতির কাছে হার মানে, চাঁনসওদাগর দেবীর কাছে হার মানে। সেলিম আল দীন লিখেছিলেন এখানে বিপরীত পুরাণ। বেহুলাকে দংশিছে কান্দে লক্ষ্মিনদার। লোনাপানির মহাকাব্য হাত হদাই নাটক। হাত হদাই নাটকে নাবিক আনার ভাণ্ডারি সাতবার সমুদ্র ভ্রমণ, বেহুলার সাত বাঁকে অগ্নি পরীক্ষা মিলেতো যায়।

সমান্তরাল তূমির আদিবাসীদের অন্যতম কারাম উৎসব সেলিম আল দীন দর্শন করেছেন। আদিবাসীদের উঠানে একটি বৃক্ষের ডালপুতা আছে। সন্ধ্যা আরতির পর থেকে একজন আদিবাসী পৌঢ় মাদল বাজাচ্ছে। আদিবাসী পল্লীর ছেলে মেয়েরা উপোষ আছে। রাতের প্রথম প্রহরে আদিবাসীর প্রতিটি বাড়ি থেকে সপ্ত প্রদীপের চালুন ডালা সাজিয়ে রঙ্গিন সাজে মায়েদের কোলে প্রায় একই সাথে শত শত বাতির সাথে বৃক্ষকে ঘিরে বসে শিশুরা। প্রৌঢ় শুরু তখন বৃক্ষের উদ্দেশ্যে মন্ত্র পাঠ শুরু করেন। স্বীকার করে আদিবাসীগণ এই বৃক্ষ তাদের পিতা-মাতা আশ্রয়দাতা। প্রশ্ন করে পুরোহিত কারাম কারাম ক্যা পালা, ছেলে-মেয়েরা উত্তর দেয় কারাম কারাম ব্যাটা পালা। আবার প্রশ্ন করে পুরহিত কারাম কারাম ক্যা পালা, ছেলে-মেয়েরা উত্তর দেয় কারাম কারাম বেটি পালা।

যে কারাম উৎসবে ভক্তবৃন্দ ছেলে মেয়ে পায় সেই বৃক্ষ নিধন হয় বনের পর বন। আদিবাসীদের জমি বিক্রির অধিকার নেই। জমি দখল করে নিচ্ছে ভূমি দস্যুরা। নিজের মাতৃভাষা অন্যের ভাষা দ্বারা আজ অস্তিত্বহীন। বনপাংশুল নাটকে মান্দাই নৃগোষ্ঠী কোচগণের বনের পর বন হারিয়ে যায়। অন্য জাতি দ্বারা ধর্ষিত হয় সুকি। অনিল কোচ কাছে এসে দাঁড়ায়। সেলিম আল দীন লিখলেন উদরে বেড়ে উঠা ভ্রুণের কী দোষ, বৃক্ষের কোনো জাত নেই বৃক্ষের কোনো সীমারেখা নেই। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য লালিত নানা পদের যাত্রাপালার আমরা অভিনয় দেখি। কাহিনিরগভীরে প্রবেশ করে চিত্রস্থির মনোরঞ্জনের পূর্ণ সাধ নিয়ে ফিরি। যাত্রার কুশীলবগণের জীবন কথার কতটকুই বা জানি। কখনো জানতে চেষ্টা করি নি। সেলিম আল দীন কিত্তনখোলা নাটকে যাত্রার মানুষদের জীবন জীবিকা ব্যথা বেদনার কথা নিয়ে আসলেন আমাদের সামনে। যে মেলা পত্তনের কথা ভেবেছিলেন আশি সালে। সেই মেলা ফিরে এলো কিত্তনখোলা নাটক। নদী মাতৃক বাঙালদের এই দেশে বেদে বহর ফিরে এলো মঞ্চের আঙ্গিনায়। ঘাটে ঘাটে যাদের বিচরণ সামাজিকগণের সম্মুখদারে উপনীত হল বেদে বহর।

বর্ণবাদের দ্বারা নিপতিত হল মর্তলোকের অধিকাংশ মানুষ। পৃথিবীর প্রতিটি কণায় যাদের অধিকার নিশ্চিত ছিল, তারা হল এক ঘরে। বিত্তশালী মানুষের প্রয়োজনে উপাধি পেল ডোম, চাড়াল, মুচি, মেথর, চাঁই, ভূইমালি, রজক নামে। সেলিম আল দীনের চাকা নাটকে লাশের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলে। কৃষ্ণ-ব্রক্ষ্ম হরিগৌরি বঞ্চিত। জিও ঠাকুর (শিব) ভক্ত ডোমকুল হয়ে ওঠে চাকা নাটকে গতিমান আরেক চাকা।

সঙ ও পুতুলনাচের ঠেটাগণের চরিত্রের চিত্রাবলি সেলিম আল দীনের নাটকে অপরিহার্য। যেমনটি এই ভূমির আদি মানবের গোষ্ঠী গারো সম্প্রদায়। তাদের জীবন যেমন বাংলা যেমন বাংলা নাট্যে অপরিহার্য তেমনি সেলিম আল দীনের নাটকসমূহে গারোরা মধ্যস্তরের অস্তিত্বাধীন। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যরীতি যেমন হাজার বছরেও পুরানো হয় নি। যেমন রয়েছে তার লক্ষ লক্ষ ভক্ত তেমনি সেলিম আল দীনের বাঙলা সাহিত্যের নাট্যধারা হাজার বছরের জন্য প্রতিষ্ঠিত। আজ যা দেখি মঞ্চে কাল দেখব পুস্তকে ভবিষ্যতে তা হবে মিথ। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের অনুসন্ধানে বীজ রোপিত হয়েছিল তালুকনগরে। যমুনা পাড়ে দাঁড়িয়ে যখন সেলিম আল দীন বলেছিলেন ঐ দূর শহরের কেউ জানে না আমি এখানে। জ্যোৎøায় শিশির ভেজা বালি চিক চিক করে। মাটির অনেক নিচে একদা যৌবনবতী যমুনা কবর শয়ানে শায়িত। আমরা তাকে সঞ্জীবিত করতে চাই। বালু কণাকে সাক্ষী রেখে বলেছিলেন ‘হে মৃত নদী তোমাকে বিমূর্ত স্রোতে বয়ে নিয়ে যাব একদিন’। পৃথিবীর ফোরাত, ভলগা রাইন ও টেমসের তীরে জানবে তুমি ও তোমার প্রেমিক পুরুষেরা বিশ্ব মানবের পথে ছুটে চলেছে। কিন্তু সে শপথ কি পূরণ হবে এক জীবনে? পূরণ না হওয়ার কারণ দেখি না। সেলিম আল দীনের মধ্যযুগের বাংলা নাট্য এখন আমাদের হাতে। বাংলা নাট্যকোষ আমরা বহন করে বেড়াই। যা সংস্কৃতির একমাত্র শব্দকোষ।

সেলিম আল দীনের নাট্যধারায় হাজারো চরিত্রের মুখাবয়ব দেখি সমস্ত জীবকুল ও বস্তুর অস্তিত্বমান পূর্ব থেকে পশ্চিম উত্তর থেকে দক্ষিণ মানবকুলের মানবতাকে যিনি রেখায় ধারণ করেছেন। তিনি থাকবেন লোকজীবন থাকবে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের ধারায়, বিশ্ব মানবের ভুবনে প্রতিষ্ঠিত হবে বাঙালির নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক।

[ঢাকা থিয়েটার আয়োজিত প্রয়াত সেলিম আল দীনের জন্ম উৎসবে (আগস্ট ২০০৮) ‘বাঙলা নাটক : সেলিম আল দীন সৃষ্টিকথা’ শীর্ষক সেমিনারে পঠিত]


কাজী সাঈদ হোসেন দুলাল : গ্রাম থিয়েটারকর্মী, পুঠিয়া, রাজশাহী