Full premium theme for CMS
আমরা, মৌলবাদী-যুদ্ধাপরাধী চক্র, অতঃপর সংস্কৃতির লড়াই
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
আমরা কেবলই স্বপ্নে বিভোরই হই না, মজেই থাকি না- স্বপ্নকে বাস্তবের পোশাকও পড়াই।
সৃজনশীল মানুষই স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন আপনা-আপনি বাস্তবে রূপ নেয় না। স্বপ্নকে বাস্তবে পেতে হলে লড়াই লাগে। লড়াই একটা সার্বক্ষণিক কাজ বলে আমরা মেনে নিই এবং লড়াইয়ে ভয় পাওয়ার চেয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়াকে আমরা ব্রত মনে করি। স্বপ্ন এমনই, যা কিনা কেবল প্রত্যাশা বাড়িয়েই তোলে। একটা স্বপ্ন পূরণ হয় আরেকটা স্বপ্ন জন্ম দিতে। মানুষের ঐতিহ্যে স্বপ্ন আছে, স্বপ্ন পূরণও আছে, স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থতাও আছে। ঐতিহ্য মানেই গর্বের ব্যাপার না। ঐতিহ্য মানে পরম্পরাগত প্রথা। সব প্রথাই সুখকর না, গর্বের না। প্রথাকে মানবমুখি করতে পারলেই গর্ব করা যায়। আমাদের ঐতিহ্যে সতীদাহ প্রথা আছে, নারী-শিক্ষার দমন প্রথা আছে, আবার সেই প্রথা ভাঙারও ঐতিহ্য আছে। আমরা শত শত বছর ধরে উপনিবেশের কবলে থেকেছি, সেই কবল থেকে বেরিয়ে আসার লড়াইও করেছি। ইতিহাস বলে, আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। আবার এই ইতিহাসও পাই, সেই ভাষা রক্ষার জন্য লড়াইও করেছি। মনে রাখা দরকার, ভাষার জন্য লড়াইটা কেবলই মর্যাদার লড়াই না। বোঝা বোধকরি দরকার- কেবল সামাজিক পরিবেশেই উৎপত্তি লাভ করে ভাষা এবং ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ পায় মানুষের ভাবনা বা চিন্তা। ভাষা ছাড়া চিন্তার কোনো সামাজিক অস্তিত্ব নেই, থাকতে পারে না। মানুষের চৈতন্যের উন্মেষ ঘটে প্রধানত শব্দ (বা ধ্বনি) এবং ভাষার মাধ্যমেই। সমাজের অবর্তমানে মানব চৈতন্য বা চিন্তা অর্থহীন। এবার, আবার, ইতিহাসেই ফিরে যাই- ইতিহাস বলে আমরা পরাধীন ছিলাম। ইতিহাসই আবার সাক্ষ্য দেয়, পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, স্বাধীন হয়েছি।
লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এক লড়াই বার বার করা মানে পেছনে চলে যাওয়া। আগেই বলা হলো স্বপ্ন পূরণের জন্য চাই লড়াই। স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাওয়ার পর স্বপ্নকে ধরে রাখার লড়াইটাও তাহলে চালিয়ে যেতেই হয়। নইলে একই লড়াইয়ের পুনরাবৃত্তি হয় এবং তখন ইতিহাস বলে স্বাধীনতার পর গোটা চল্লিশেক বছর ধরেও আমাদের পরাধীনই থাকতে হয়। স্বাধীনতা পাওয়ার পর আবার পরাধীনতার প্রশ্ন আসে কখন? আসে তখন, যখন লড়াইয়ের মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত হই। মূল চেতনা কী ছিল? অর্থনৈতিক মুক্তির কথা ছিল, ছিল অসাম্প্রদায়িক সমাজের কথা। অর্থনৈতিক মুক্তি বা গতিশীলতার প্রথম শর্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করা। আর রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার মূল হাতিয়ার হলো সম্প্রদায়গত বিভেদ তৈরি হওয়া। একটা রাষ্ট্রের ভেতরে যখন উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু থাকার চেয়ে সম্প্রদায়গত বিভেদই দানা বাঁধতে থাকে, তখন বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তর যে লড়াই- পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, এ-সব থেকে অনেক পিছিয়ে যেতে হয়। এই যে পিছিয়ে যাওয়া এটা কোনো প্রকৃতিগত ব্যাপার না, এটা তৈরি করা এক প্রক্রিয়াও বটে। বিশ্বব্যাপী যে লড়াইয়ে নিজেদের সামিল করার কথা ছিল, তার পরিবর্তে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সম্প্রদায়গত বিভেদে জড়িয়ে পড়লে এই ধারণার জন্ম দেয়া যায় যে, আমরা বিশ্ব জনপদের কেউ নই, আমরা কেবলই একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের পিছিয়ে পড়া এক জনপদের মানুষ। এবং একটা জাতির জনগণের মনোগঠনে যখন প্রতিনিয়ত এই প্রক্রিয়াই চলে যে, সে পিছিয়ে পড়া জনপদের মানুষ, তখন তার ভেতরে নিয়তি-নির্ভর প্রবণতার জন্ম হয়। যখন কোনো জনপদের বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের নিয়তি-নির্ভর মনে করে, তখন তাদের সংস্কৃতি বলতে আর কিছু থাকে না। সংস্কৃতি মানে তো এই যে, যাপিত জীবন পদ্ধতির পরিবর্তশীলতা- শিক্ষা বা চর্চা দ্বারা লব্ধ বিদ্যাবুদ্ধি, শিল্পকলা, রুচি, নীতি ইত্যাদির উৎকর্ষ সাধন। এই যে শিক্ষা বা চর্চা দ্বারা লব্ধ বিদ্যাবুদ্ধি বা এই যে শিল্পকলা, রুচি, নীতি এসবের থোরাই কেয়ার করে তারা, যারা মনে করে মানুষের কর্মপরিকল্পনা বা জীবনপদ্ধতি সবই এক অমোঘ-অলৌকিক-ঐশ্বরিক- কারো পূর্বনির্ধারিত নিয়ম দ্বারা চালিত। কোনো কিছু যদি পূর্বনির্ধারিত নিয়মে চলে তাহলে তার ‘পরিবর্তনশীল’ হওয়ার পেছনে মানুষের লড়াইকে অস্বীকার করা হয়। অলৌকিকভাবে কোনো কিছু ‘পরিবর্তনশীল’ হয় না- ‘পরিবর্তনশীল যাপিত জীবন’ তো নয়ই। এবং যা ‘পরিবর্তনশীল যাপিত জীবন’ না, তা কোনোভাবেই ‘বিদ্যাবুদ্ধি, শিল্পকলা, রুচি, নীতি ইত্যাদির উৎকর্ষ সাধন’ করতে পারে না। এবং অতঃপর এ-ই সত্য হয় যে, তা কোনো সংস্কৃতি নির্মাণ করতে পারে না।
কিন্তু যদি এ-ই হয় যে, আমরা কোনো সংস্কৃতি নির্মাণ করবো না, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বা বলা যায় পূর্বনির্ধারিত সূত্রে পাওয়া ‘আচার’ নিয়েই থাকবো, তাহলে এ-ও সত্যি হয় যে- সংস্কৃতি এক ‘অপরিবর্তনশীল’ ‘যাপিত জীবন’ যা কিনা অমোঘ। আর যা অমোঘ বলে মেনে নেয়া হয় তার বিরুদ্ধে কোনো লড়াই চলে না। যদি কোনো কিছুর বিরুদ্ধে লড়াই না-ই চলে, তাহলে আমাদের এতদিনের লড়াই বা লড়াই থেকে প্রাপ্ত মানবিক-আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনগুলোকেও (অর্জনগুলোকেও) অস্বীকার করা হয়। এই অস্বীকারের পক্ষেই আমাদের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার পথ চলা, যাদেরকে বলা হয়, বড় বেশি ক্লিশে হলেও এই শব্দই উচ্চারণ করতে হয়- মৌলবাদী গোষ্ঠী।
এই মৌলবাদী গোষ্ঠী; আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন, লড়াই করে অর্জন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জনে বিরোধীপক্ষ তথা পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষে ছিল। সে হিসেবে তারা পরবর্তীকালে (যুদ্ধকালীন সময়ে তো বটেই) যুদ্ধাপরাধী বলে গণ্য হয়। এই যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী গোষ্ঠীর কোনো উৎপাদন সম্পর্কিত নীতিমালা নেই। বাংলার (বাংলার কেন, কোনো ভূখণ্ডেরই নয়) কৃষক-শ্রমজীবী মানুষের ভরণ-পোষণগত নীতিমালা নেই। বিদ্যাবুদ্ধি, শিল্পকলা, রুচি ইত্যাদির উৎকর্ষ সাধনে নীতিমালা নেই। বলতে তো হয়-ই যে, এসব উৎকর্ষ সাধন করে একমাত্র ‘মানুষ’ এবং এই ‘মানুষেরই’ বিরুদ্ধে তারা কেবল এ-ই জাহির করে যে- সব কিছুই হলো অমোঘ এবং পূর্বনির্ধারিত। এবং তখন আমরা একটা বিষয় একটু বুঝে নিতে চাই যে, এযাবৎ পৃথিবীর যেকোনো যন্ত্রপাতি- সেই হাতুড়ি-শাবল থেকে শুরু করে (তার আগেরগুলো না হয় না-ই বললাম) আজকের এই ইন্টারনেট যুগের, এই উদ্ভাবনের, নির্মাণের, এই প্রযুক্তিবিদ্যার যুগান্তকারী উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা বলা যায় মূল উপকরণ যে ‘মানুষ’- সেই মানুষকে এবং তার অর্ন্তগত লড়াইকে ওরা অস্বীকার করে। ফলে, বলা তো যায়-ই যে, যারা মানুষকে অস্বীকার করে, মানুষের শক্তিকে অস্বীকার করে, এবং, অবশ্যই, মানুষের লড়াইকে অস্বীকার করে, তাদের সাথে সমাজ বা রাষ্ট্রের (সমাজ বা রাষ্ট্র তো মানুষ নিয়েই, নাকি?) কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। যাদের সাথে মানুষেরই সম্পর্ক নেই (বলা যাবে না যে তারা ‘পশু’, কেননা পশু জোয়াল টানে, আমাদের খাদ্য দেয়, এবং, ফলে তারা উৎপাদন শক্তি- এবং অবশ্যই মানুষের সাথে সম্পর্কিত) তারা আসলে কোনোভাবেই এই প্রকৃতির (হধঃঁৎব) কিছু হতে পারে না। আর যারা কিনা প্রকৃত অর্থে এই প্রকৃতির কেউ না, তারাই এখন হয়ে গেছে প্রকৃতি বিষয়ে বলার (যার একমাত্র সৃজনশীল অঙ্গ হচ্ছে ‘মানুষ’ এবং লক্ষণীয়, একটু আগেই বলা হলো ‘মানুষ’-এর সাথে তারা সম্পর্কিত নয় ) একমাত্র সিদ্ধান্তদাতা!
স্বাধীনতার পরপরই এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটির মূল উৎপাটন করা হয় নি। ফলে, একটা স্বাধীন দেশের জনগণের প্রথম যে লড়াইটা হওয়া উচিত ছিল উৎপাদন ও তার বন্টন ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধনের, শিক্ষা বা চর্চা দ্বারা লব্ধ বিদ্যাবুদ্ধি, শিল্পকলা, রুচি, নীতি ইত্যাদির উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচিতি বিনির্মাণ করা, তা না করে এক পিছিয়ে পড়া লড়াই নিয়েই জনগণকে বার বার ব্যস্ত থাকতে হয়েছে- তা হলো ধর্মীয় মৌলবাদী যুদ্ধপরাধীদের প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই। মনে রাখতে হবে যে, কোনো উৎপাদন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পুরনো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সঙ্গে সঙ্গেই বিলুপ্ত হয় না। তারা নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে পুরাতনকে টিকিয়ে রাখার জন্য মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে থাকে। ফলে নতুন মতাদর্শের বিবর্তন ও বিকাশের পথে পুরাতন প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শও দীর্ঘদিন যাবৎ জড়াজড়ি করে থাকে। তাই নতুন সমাজ ব্যবস্থায়ও পুরাতন সমাজ-ব্যবস্থার সাংস্কৃতিক অবশেষগুলোকে নির্মূল করার জন্য নতুন লড়াকুদের লড়াই করে যেতে হয় বিরামহীনভাবে। আমরাও তাই প্রত্যক্ষ করি, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করার পরও পাকিস্তানী ধর্মীয় মৌলবাদী চিন্তা চেতনার রেশ এদেশের যুদ্ধাপরাধীদের ভেতরে থেকে গেছে এবং তারা এটাকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বার বার আমাদের উৎপাদন কৌশল-নীতিমালা, সর্বোপরি শিল্পকলা, রুচি ইত্যাদির উৎকর্ষ সাধনে বাধা দিয়েছে, দিয়ে আসছে। সুখের বিষয় এই বাধার বিরুদ্ধে বিরামহীনভাবে লড়াই করে গেছে এদেশের জনগণ, যার সর্বশেষ ফলাফল সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচনে মৌলবাদী যুদ্ধাপরাধী চক্রকে সর্বোতভাবে প্রত্যাখ্যান করা।
জনগণের এই প্রত্যাখ্যান আশার আলো দেখায় বৈকি। কিন্তু মনে রাখতে হবে জনগণের এই প্রত্যাখ্যানের বিপরীতে যাদেরকে গ্রহণ করা হয়েছে, তারাও কম-বেশি এই মৌলবাদী যুদ্ধপরাধীদের ফুলে ফেঁপে ওঠার পেছনে দায়ী। বিজয়ী দলের নির্বাচনী ইশতেহারেও সেই ধর্মব্যবসায়ী যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্জাগরণের অনেক আভাস পাওয়া যায়। আমাদের সংবিধান হবে আমাদের তৈরি, আমাদের জন্য তৈরি। কোনো শরিয়া আইন বা ব্লাসফেমী আইন দিয়ে জনগণের সংস্কৃতিকে আটকে ফেলার চেষ্টা তাই অর্থহীন। কিন্তু এই অর্থহীন কিছু আভাস এখনও আমরা প্রত্যক্ষ করি। আগেই বলা হলো, সাম্রাজ্যবাদের লড়াই থেকে পিছিয়ে যাওয়াটা প্রকৃতিগত কোনো ব্যাপার নয়, তৈরি করা এক প্রক্রিয়াই বটে। তাই আশঙ্কা হয়, বর্তমান শাসকগোষ্ঠীও যখন জনগণের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা দিতে পারবে না, বন্ধ মিল-কারখানা চালু করে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে পারবে না- তখন জনগণের বিক্ষোভকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য তারাই হয়তো চাঙ্গা করে তুলবে মৌলবাদী আগ্রাসনকে। ফলে লড়াই থেমে গেছে, এমনটা ভাবা মোটেই উচিত হবে না। লড়াই এক বিরামহীন কাজ। কিন্তু আমরা লড়াই করতে চাই মানুষে মানুষে সম্পর্ক উন্নয়নে, উৎপাদন প্রক্রিয়া ও তার বন্টনের উৎকর্ষ সাধনে। আমরা কখনোই চাইবো না যাদের সাথে উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই, যারা মানুষের লড়াইকে অস্বীকার ক’রে সব পরিবর্তনকে অমোঘ বা ঐশ্বরিক ভাবে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে গিয়ে বর্তমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, বিশ্বায়নের এই যুগে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে ভুলে যাই।
আমরা চাই অনতিবিলম্বে যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিচার হোক। তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক এবং আমাদের মূল লড়াই হোক পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, জনগণের সংস্কৃতির পক্ষে।
ইতি
হাসান শাহরিয়ার
জানুয়ারি ২০০৯
সোবহানবাগ, ঢাকা