Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। কৈফিয়ত
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
২০১১ সালে, একটি ঈদসংখ্যায় স্বাধীনতার চল্লিশ বছরের প্রধান বা সেরা ৪০টি প্রযোজনা নির্বাচন করে কিছু লিখতে বলেছিল। আমাদের মঞ্চের, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের, আলোচিত শতাধিক প্রযোজনা থেকে ৪০টিকে ‘প্রধান প্রযোজনা’ বলে উল্লেখ করেছিলাম এবং এই ‘প্রধান’ বলার পক্ষে যথাযথ যুক্তি হাজির করেছিলাম। প্রবন্ধটি প্রকাশ পাওয়ার পর অনেকেই ওটাকে ‘ভালো বিবেচনা’ বলে সাধুবাদ দিয়েছিলেন, আবার অনেকেই, এমনকি এই দ্বিতীয়-‘অনেকের’ পাল্লাটাই ভারী, যারা ঐ বাছাইকে মোটেও মেনে নিতে পারেন নি।
যারা মেনে নিয়েছিলেন, তাদের দলের বা রচনার অথবা নির্দেশনার নাটকগুলো তালিকায় ছিল। আর যারা বিভিন্ন প্রযোজনার সাথে জড়িত অথচ তাদের সেই প্রযোজনাগুলো আমার তালিকা থেকে বাদ গিয়েছিল, তারা তালিকাটি মেনে নেন নি। তবে আরেকটি সত্যও আমার সামনে ধরা পড়েছিল, যাদের মাত্র-একটি নাটক তালিকায় স্থান পেয়েছিল, তারা মনে করেছেন তাদের একাধিক নাটক তালিকায় আসা উচিত ছিল। আবার, দলের-নাট্যকারের-নির্দেশকের একাধিক নাটক স্থান পেলেও তারা মনে করেছেন, তার বা তাদের সবগুলো প্রযোজনাই প্রধান ৪০টি নাটকের তালিকায় স্থান পাওয়ার যোগ্য। সে বিবেচনায় বলা যায়, ওইপর্যন্ত মঞ্চে আসা সব নাটককেই ‘প্রধান প্রযোজনা’ বলা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই!
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে যখন সেরা/প্রধান/আলোচিত ৫০টি প্রযোজনার তালিকা তৈরির কথা চিন্তা করি, সেই তালিকাটি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থেকে নির্বাসন দেয়ার জন্য, নাটকের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মতামতের উপর জোর দেয়ার পরিকল্পনা নিই। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কয়েকজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির কাছে আবেদন জানাই, তাদের বিবেচনায় ‘প্রধান বা সেরা’ কিছু প্রযোজনার তালিকা যেন পাঠিয়ে দেন। কিন্তু তারা জানান যে, আমাদের মঞ্চে আসা শত শত প্রযোজনার নাম মনে-করে-ওঠা কঠিন। ‘থিয়েটারওয়ালা’ যেন নিজ বিবেচনায় কিছু প্রধান নাটকের তালিকা পাঠাই। সেখান থেকে এবং সেগুলো দেখে অন্য প্রযোজনা স্মৃতিতে আসলে, সেগুলোকেও বিবেচনায় নিয়ে, ‘প্রধান/সেরা প্রযোজনা’র তালিকা বানানোর কাজটি করা যাবে। এই পরামর্শ-অনুযায়ী ‘থিয়েটারওয়ালা’র পক্ষ থেকে ১০০টি নাটকের একটি তালিকা তৈরি করে শতাধিক গ্রহণযোগ্য নাট্যজন-নাট্যভাবুক-দর্শকের কাছে পাঠিয়ে দেই। সেই সাথে স্পষ্ট করে এ-ও উল্লেখ করি যে, ‘এই তালিকার বাইরেও যেকোনো নাটক আপনি নির্বাচন করতে পারেন, তবে, নির্বাচিত নাটকটি অবশ্যই আপনার দেখা থাকতে হবে...এবং তালিকায় নাট্যদল ও রেপাটরি দলের নাটক নির্বাচন করতে হবে, নাট্যশিক্ষালয়ের প্রযোজনা যেন অর্ন্তভুক্ত না করা হয়’। এবং এবার এই বিবেচনা মাথায় রাখি যে, সবার নাটক দেখার অভিজ্ঞতা যেহেতু সমান না, তাই, একটা অংশকে ৩০টি, একটা অংশকে ২৫টি এবং নবীন অংশটিকে ২০টি প্রযোজনা বাছাই করে তালিকা করতে অনুরোধ করি।
এবার মুখোমুখি হই নতুন ঝামেলার!
‘থিয়েটারওয়ালা’র তালিকাটি যেহেতু মাত্র ১০০টি প্রযোজনা নিয়ে তৈরি, তাই, বলা বাহুল্য, অনেক অনেক সেরা বা প্রধান অথবা আলোচিত প্রযোজনা এই তালিকায় ছিল না। তাই একটি পক্ষ থেকে আপত্তি আসতে থাকে। তাদের ভাষ্যের সারসংক্ষেপ এই যে, তাদের নির্দেশিত বা রচিত কিংবা দলীয় সব প্রযোজনাই তালিকায় স্থান পাওয়া উচিত ছিল। আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দেই যে, তালিকাটি তৈরি হয়েছে কিছু ভালো নাটক স্মরণে আনবার জন্য। তালিকার নাটকগুলো মোটেই ‘সেরা প্রযোজনা’ না। চাইলে তালিকার বাইরের যেকোনো নাটক অন্তর্ভুক্ত করে নিজেদের তালিকা পাঠাতে পারেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
একজন বললেন, এই তালিকা প্রমাণ করে, বাংলাদেশের থিয়েটার নিয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। তার ওমোক ওমোক নাটক বাদ দিলে বাংলাদেশের থিয়েটারের পরিচয়ই বিলীন হয়ে যাবে। আমি বললাম, আপনি সেই নাটকগুলো আপনার তালিকায় দিন, যেগুলো নির্বাচন করলে বাংলাদেশের থিয়েটারের অস্তিত্ব টিকে থাকবে। তিনি বললেন, আমি দিলেই হবে? অন্যদের নির্বাচনের কী হবে? আমি বললাম, আপনার নির্দেশিত কয়েকটা প্রযোজনার নাম আমাদের তালিকায় আছে। সেগুলো দেখলেই আপনার অন্য ‘ভালো প্রযোজনা’র নাম নির্বাচকের (ভোটার) মনে পড়বে। তারপরও তিনি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেন- আমি তোমাদের এই কাজের সাথে নাই।
এক তরুণ নাট্যকার তো মহা-খেপেছেন, বললেন, আমার তো আরো নাটক আছে, সেগুলো তো তালিকায় দেখছি না। আজে-বাজে নাটক দিয়ে তালিকা বানিয়েছেন। আমার নাটক বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশ থেকেই সমাদৃত হচ্ছে অথচ...। আমি পুরনো রেকর্ড বাজালাম- আমার তালিকাটি মাথায় রাখতে পারেন, না-ও রাখতে পারেন। আপনি আপনার বিবেচনামতো সমাদৃত নাটকের তালিকা করে পাঠান। তিনি বললেন, ঠিক আছে দেখি, হাতে অনেক কাজ জমে আছে, এসব করার সময় পাব কিনা এখনই বলতে পারছি না।- উনি সময় পান নি।
তোমার মেইল পেয়েছি, তালিকা পাঠিয়ে দেব। আচ্ছা, আমার ওই নাটকটা তো তালিকায় দেখছি না- এমন কথা দিয়ে শুরু করলেন আরেকজন। আমি বললাম, আমাদের তালিকাটি শুধু চোখ বোলাবার জন্য। শত শত নাটক হঠাৎ করে স্মরণে আনতে সমস্যা হবে বলেই এই সংক্ষিপ্ত তালিকা পাঠিয়েছি। তিনি বললেন- তারপরও, যে নাটক এতটা দর্শকপ্রিয় হলো, সবাই তারিফ করল, এমন একটা নাটক কীভাবে বাদ দিলে বুঝলাম না। আমি বললাম- বাদ দেই নি, বাদ পড়েছে- তালিকা সংক্ষিপ্ত করার তাগিদে। আপনি আপনার তালিকায় নাটকটি দিয়ে দিন আর অন্যদেরও নিশ্চয়ই মনে পড়বে নাটকটির কথা, তাদের অনেকেও তালিকায় নাটকটি আনবে আশা করি। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, আমি আসলে শিল্পে ‘সেরা কাজ’ বা ‘ভালো কাজ’, এসবে বিশ্বাস করি না। থিয়েটার করছি, করে যাব। সেরা অ-সেরা আবার কী? সবার কাজই ভালো। সবার কাজই সেরা। এসব তালিকা তৈরি করার দায়িত্ব তো তোমাকে কেউ দেয় নি, তাই না? অন্য কিছু করো। থিয়েটারের ভালো হয় এমন কিছু করো।
বুঝতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে না যে, তিনি তালিকা-তৈরিতে সময় নষ্ট করেন নি।
অনুজ একজন মেইল পাঠিয়েছেন। লিখেছেন, আপনি বোধহয় জানেন না, আমার নির্দেশনায় আমার দল থেকে আরো অনেক নাটক মঞ্চে এসেছে। আপনার তালিকায় সেগুলোর নাম দেখলাম না। উত্তরে আমি আমার আগের বক্তব্যই পেশ করলাম। জবাবে লিখলেন, আপনি এত দায়িত্ব নিচ্ছেন কেন? সব নাটকের নাম দিয়ে দিন, নির্বাচকরা বাছাই করে তাদের তালিকা দেবেন। আমি বললাম, হাজার নাটকের তালিকা পাঠালে সেখান থেকে হাতেগোনা সংক্ষিপ্ত তালিকা পাঠাতে পারবেন?
মেইল-১
হাজার নাটকের নাম দেবেন কেন? ভালো ভালো নাটকের নাম দেবেন।
মেইল-২
আমার তালিকাটি ভালো ভালো নাটকের হয় নি?
মেইল-১
তালিকার সব নাটকই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। শুধু আমার আরো ৫/৬টি নাটকের নাম জুড়ে দিন।
মেইল-২
এমন কথা তো অন্যরাও বলবে।
মেইল-১
বললেই হলো নাকি। নিজেদের কাজ নিয়ে একটা বিবেচনাবোধ থাকবে না? আমার নাটক দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। অন্য কেউ নিশ্চয়ই এমনটা দাবি করতে পারবে না।
বাকি কথা এখানে উল্লেখ না-ই-বা করলাম। শুধু এটুকু বলি, তার একটি প্রযোজনা, যেটি আমাদের পাঠানো তালিকায় ছিল, যেটির ব্যাপারে সে সর্বাধিক গর্বিত, দলের ‘সেরা প্রযোজনা’ বলে মনে করেন এবং সেটি নিয়ে সফল-বিশ্বভ্রমণ করেছেন বলেও দাবি করেন- সেটির পক্ষে মাত্র একটি ভোট পড়েছে, এবং, সেটিও দিয়েছেন তার দলেরই একজন সদস্য।
তো এই হলো আমাদের কাজের আত্মসমালোচনা, নিজের কাজ আয়নায় দেখার সক্ষমতা!
এসব প্রতিক্রিয়ায় মনের ভেতরে হতাশা জন্ম নিচ্ছিল। কিন্তু হতাশার বিপরীতে আশা-জাগানিয়া সমর্থন দিলেন অন্যরা। একের পর এক তালিকা আসতে থাকল। এক-দুই-তিন করে করে মোট ৭৮ জন নির্বাচক (ভোটার) ‘থিয়েটারওয়ালার’ ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের তালিকা পাঠিয়ে দিলেন। তারা মোট ২৩৯টি প্রযোজনার নাম উল্লেখ করেছেন, যা দিয়ে প্রমাণ হয়, আমাদের দেয়া তালিকার বাইরেও তারা তাদের প্রযোজনা নির্বাচন করেছেন (২৩৯টি প্রযোজনার নাম সাইফ সুমনের কলামে উল্লেখ করা হয়েছে)।
নাটক দেখায় যারা অভিজ্ঞ, অর্থাৎ স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময়পর্যন্ত প্রায় সব নাটক দেখার সুযোগ যাদের হয়েছে, তারা ৩০টি নাটকের তালিকা করে পাঠিয়েছেন। এর চেয়ে একটু কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নির্বাচকরা পাঠিয়েছেন ২৫টির তালিকা। আর যারা নবীন তারা পাঠিয়েছেন ২০টির তালিকা। সে হিসেবে বলা যায়, নির্বাচকদের সবারই গত ২৫ বছরে মঞ্চে-আসা নাটকগুলো দেখার অভিজ্ঞতা আছে। এর আগে মঞ্চে-আসা নাটকের দর্শক (এখানে ভোটার বা নির্বাচক) কিছুটা কম। ফলে ৭০-৮০’র দশকের নাটক নির্বাচনে নির্বাচকদের শতাংশের উপর নির্ভর করেছি। ঢাকার বাইরের দলের প্রযোজনা দেখার সময়-সুযোগ তালিকার সব নির্বাচক, অনুমান করা যায়, করে উঠতে পারেন নি। এটাই স্বাভাবিক। তাই ঢাকার বাইরের প্রযোজনার বেলায়ও একধরনের শতাংশনির্ভর হতে হয়েছে। এভাবে ২৩৯টি প্রযোজনার প্রকৃতভোট আর শতাংশনির্ভর ভোটের গণনায় সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্নভোট পাওয়া প্রযোজনাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এবং সেখান থেকে প্রাপ্তভোটের সংখ্যায় প্রথম ৫০টি প্রযোজনাকে বাছাই করা হয়েছে।
নির্বাচকদের প্রায় প্রত্যেকেই উল্লেখ করেছেন, তাদের পাঠানো তালিকাটিকে যেন ‘সেরা’ বা ‘প্রধান’ ইত্যাদি অভিধা দেয়া না হয়। কেননা, অনেক পছন্দের প্রযোজনা থাকা সত্ত্বেও, কেবল তালিকা সংক্ষিপ্ত করার জন্য সেগুলোর জায়গা হয় নি। ‘থিয়েটারওয়ালা’ও ঠিক তাই মনে করে। স্বাধীনতার পর থেকে আজঅব্দি যত প্রযোজনা মঞ্চে এসেছে তার থেকে ৫০টি প্রযোজনাকে ‘সেরা’ বা ‘প্রধান’ আখ্যায়িত করা কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। তাই, আমরা নির্বাচকদের এই মন্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করে প্রযোজনাগুলোকে ‘নির্বাচিত প্রযোজনা’ অভিধায় অভিহিত করার সিদ্ধান্ত নিই। এবং শিরোনামটির নাম দেই- ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা’।
এক্ষণে একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে, আমাদের দেয়া তালিকার বাইরেও একাধিক প্রযোজনা ‘নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা’য় স্থান করে নিয়েছে।
নির্বাচনকে সুষ্ঠু রাখার অভিপ্রায়ে যাদেরকে নাটক-নির্বাচনে অনুরোধ করেছি, তাদেরকে পরস্পরের কাছ থেকে গোপন রেখেছি এবং আমি নিজে নাটক-নির্বাচন থেকে বিরত থেকেছি। কেননা, আমি সবার তালিকা প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছিলাম প্রতিনিয়ত। ফলে আমার নির্বাচন, পক্ষপাতিত্বে রূপ নেয়ার আশঙ্কা ছিল। আরো উল্লেখ করছি যে, নির্বাচিত-প্রযোজনা-বাছাই সম্পন্ন না হওয়া-পর্যন্ত আমি ব্যতিরেকে অন্য কেউ ‘নির্বাচিত তালিকা’ প্রত্যক্ষ করেন নি- এমনকি ‘থিয়েটারওয়ালা’র সহযোগী সম্পাদকও নন।
‘থিয়েটারওয়ালা’র বর্তমান-সংখ্যায় নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনার একটি করে নাট্যসমালোচনা বা রিভিউ পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, ৫০টি প্রযোজনার মধ্যে কোনো ক্রম অনুসরণ করে প্রকাশ করা হয় নি। প্রযোজনাগুলো মঞ্চে আসার সময়-কাল ধরে একটির পর একটি সাজানো হয়েছে। সুতরাং এই ৫০টি প্রযোজনার কোনোটিই প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়...পঞ্চাশতম ইত্যাদির ক্রম প্রকাশ করছে না।
আমরা জানি, অনেকেই এই তালিকার সাথে সর্বাংশে একমত হবেন না। ওই ওই প্রযোজনা তালিকায় আসা উচিত ছিল- ইত্যাদি ধরনের মন্তব্যও কেউ কেউ করবেন। এমন মনোভাব কিন্তু তালিকায় আসা প্রযোজনাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। মনে রাখা দরকার, আপনার আকাঙ্ক্ষিত প্রযোজনা অন্তর্ভুক্ত করতে হলে, নির্বাচিত তালিকা থেকে যেকোনো প্রযোজনা বাদ দিতে হবে। আমাদের তালিকায় এমন কোনো প্রযোজনা সহসা মিলবে বলে মনে হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের ৭৮ জন নির্বাচকের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করি না, সুতরাং তাদের মতামতকে গুরুত্বের সাথে নেয়াই সমীচীন বলে মনে করি।
তবে কারো যদি খুব বড় ধরনের আপত্তি থাকে, তার কাছে বিনীত অনুরোধ, এর চেয়ে ভালো জরিপ যেন তিনি করেন এবং সেই জরিপের ফলাফলটা যেন আমরা জানতে পারি। প্রয়োজনে তার জরিপ-কাজেও ‘থিয়েটারওয়ালা’ পাশে থাকবে।
এবার করোনাকালের কিছু অস্থিরতার কথা বলি।
আমাদের নির্বাচক-তালিকার একমাত্র সদস্য যিনি এখন আর আমাদের মাঝে নেই। মান্নান হীরা। ২৩ ডিসেম্বর ২০২০ ওপারে যাওয়ার জন্য এমনই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে, কাছের মানুষগুলো অসুস্থতার খবর পাওয়ার আগেই মৃত্যুসংবাদ শুনলেন।
শুধু কি মান্নান হীরাই বিদায় নেয়ার তাড়া দেখিয়েছেন? ইশরাত নিশাত নেন নি? ন্যূনতম চিকিৎসা দেয়ার সুযোগটাও তো তিনি আমাদের দেন নি। আবার এ-ও ঠিক, যারা চিকিৎসা নিতে পারছিলেন তারাও তো করোনার থাবায় পড়ে ছুট দিলেন। ডাক্তার কি বলছেন না যে, আলী যাকের বা আবদুল কাদের কিংবা মনজুরে মওলা অথবা এস এম মহসিন আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতেন, যদি করোনার আগমন না ঘটত? এই করোনা তো কামাল লোহানী, কে এস ফিরোজ, সাদেক বাচ্চুকেও কেড়ে নিল। মজিবুর রহমান দিলুকে তুলে নিল নিউমোনিয়া- সে তো একই কথা হলো। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীখ্যাত হলেও আমরা তাকে নাটকের মানুষ হিসেবেও কাছে পেয়েছি, সেই মিতা হককে কেড়ে নিতেও করোনা কম করে নি। এটাকে নাকি বলা হয় ‘করোনা-উত্তর জটিলতা’। এই জটিলতার জালে পড়ে বিদায় নিলেন সাজেদুল আউয়ালও। কেবল তো এই বাংলার না, ওপার বাংলারও কতজন চলে গেলেন করোনা আর না-করোনার তাণ্ডবে- ঊষা গাঙ্গুলি, অরুণ সেন, সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের বিদায় তো স্বজন হারানোর বেদনা জাগায় আমাদের মনে। এভাবেই থিয়েটারওয়ালা’র গত সংখ্যার পর, গত এক-দেড় বছরে আরো কত কত নাটকের মানুষ চলে গেছেন, তার কতজনের খবরই-বা আমরা রেখেছি।
আসলেই তো অনেকের খবর আমরা রাখছি না। বরিশালের খেয়ালী নাট্যগোষ্ঠীর এ কে কবির, কিত্তনখোলা থিয়েটারের আক্তারুজ্জামান ইরান, কিংবা পার্বতী থিয়েটারের মোজাফফর আহমেদ যে আর আমাদের মাঝে নেই, তার খবর আমরা কজন জানি? নওগাঁর প্রসূন থিয়েটারের আশিক সেন তো শুনলাম মঞ্চে সেটের কাজ করার সময়ই চলে গেছেন! হয়ত তার মনের ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, থিয়েটারের জন্য প্রাণ দিতে পেরেছেন। বোধন থিয়েটারের ফিরোজা মহিউদ্দিনকে ধরা হয় কুষ্টিয়ার গ্রুপ থিয়েটারচর্চার প্রথম অভিনেত্রী। উনি যে চলে গেলেন, তেমন কোনো সাড়াশব্দ তো পেলাম না। গত ৩০/৩৫ বছর ধরে বোধন থিয়েটারেরই আরেক নাট্যজন আলী আফরোজ পিনুর নাম শুনে আসছি গর্বের সাথে। অথচ মৃত্যুর আগে, বেশ কবছর ধরে তিনি যে ওপারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে খবরটা জানতাম না। পরে শুনলাম নাটকের মানুষজনের গাফিলতি ছিল, সহযোগিতার অভাব ছিল। সুচিকিৎসার অভাবে তার এই চলে যাওয়া। ব্যাপারটা দুঃখজনক নিঃসন্দেহে। বোধন থিয়েটার বোধহয় স্বজন হারানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে, না হলে সম্পাদক সংগঠন, মো. মাহাবুব আলীও এ পথে সামিল হবেন কেন? বগুড়ার বিশিষ্ট নাট্যজন শ্যামল ভট্টাচার্য্যের বয়স হয়েছিল ঠিক, কিন্তু সিরাজগঞ্জের তরুণ সম্প্রদায়ের আ খ ম আজাদ ঠিক কী কারণে বিদায় নিয়েছেন, তার সঠিক খবর আমরা কজন জানি!
ঢাকার বাইরের নাটকের মানুষের খবর নেব কী, ভেতরের মানুষই তো অচেনা হয়ে থাকছেন। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের নিশাত, সুবচন নাট্য সংসদের আসিয়া কাওসার মুন্নী বা ঢাকা থিয়েটারের রতনের চলে যাওয়াই-বা আমাদের কতটা নাড়া দিয়েছে! কয়েকদিন আগে শুনলাম, প্রাচ্যনাটের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও ঢাকা থিয়েটার-সদস্য জহির রিপন চলে গেছেন। তারপরই জানলাম, শুরুতে থিয়েটার আর্ট, পরে নাট্যজন, তারপর নটরণ-করা থিয়েটারপ্রেমী হেলালের করোনার কাছে পরাজয়ের খবর। এত শোক কেমন করে সই!
তারপরও আমরা যারা বেঁচে আছি- তারা আশায় আছি, সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার জেগে উঠবে মঞ্চ।
সবশেষে দুই নাট্যবন্ধুর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। বাবুল বিশ্বাস আর অপু শহীদের আন্তরিক-সহযোগিতা না পেলে এই সংখ্যা প্রকাশ করা মুশকিল হয়ে পড়ত।
ইতি
হাসান শাহরিয়ার
(
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
)
৯ বৈশাখ ১৪২৮। ২২ এপ্রিল ২০২১।
মোহাম্মদপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।