Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: কিত্তনখোলা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: কিত্তনখোলা। রচনা: সেলিম আল দীন। নির্দেশনা: নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মঞ্চপরিকল্পনা: সৈয়দ জামিল আহমেদ। আলোকপরিকল্পনা: রফিক মাহমুদ। পোশাকপরিকল্পনা ও পোস্টার ডিজাইন: আনওয়ার ফারুক। আবহসংগীতপরিকল্পনা: শিমূল ইউসুফ। রূপসজ্জা: মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৮১। একটি ‘ঢাকা থিয়েটার’ প্রযোজনা
[কিত্তনখোলা নাটক নিয়ে গবেষণাধর্মী নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন বিপ্লব বালা। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ১৪তম সংখ্যায় (২০০৪ এ প্রকাশিত) এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
‘ঢাকা থিয়েটার’ মুদ্রিত স্যুভেনিরে দলের নাট্যাদর্শ ও কিত্তনখোলার আখ্যান-পরিপ্রেক্ষিত জানায়:
বাংলাদেশ একটি জাতির নাম। একটি সংগ্রামক্ষুব্ধ অকুতোভয় জনপদের নাম। যুদ্ধ, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে এই জনপদ সমুন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রজ্জ্বলিত করেছে তার সামুদ্রিক দুই চোখে। এই দেশ, তার ইতিহাস, সংগ্রাম, সংস্কৃতি সবকিছুকে আমরা সম্মান করি। পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা, আত্রাই, ধবলার কূলে কূলে নামহীন গোত্রহীন মানুষের সংগ্রামী জীবন হোক আমাদের নাটকের বিষয়বস্তু।
সমকালীন নাট্যচর্চার দিকে তাকালেই যেকোনো সচেতন দর্শক এদেশের নাটকের দুটি ধারা স্পষ্টতই দেখতে পাবেন। একটি ধারা গতানুগতিক বাংলানাটকের সোজা পথ ধরে বইছে, অন্যটি বিদেশি নাটকের অনুবাদ ভাবানুবাদ মঞ্চায়নের মাধ্যমে লক্ষ্যহীন ও বিভ্রান্ত ধারায় উচ্ছ্রিত হচ্ছে। ‘ঢাকা থিয়েটার’ এদেশের নাটকের প্রকৃত প্রবাহটি সৃষ্টি করতে চায়।
আমরা দেশজ আঙ্গিকের স্পর্শে রচিত নিগূঢ় শিল্পবোধের দ্বারা সৃষ্ট নাটক ও নাট্যচর্চায় বিশ্বাসী।
মানিকগঞ্জ মহকুমার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল। টাঙ্গাইল জেলার কিয়দংশ ও যমুনার পূর্বতীর ঘেঁসে বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ কিত্তনখোলা নাটকের পটভূমি। এই অঞ্চলের টপোগ্রাফি প্রায় একই রকম প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
এই নাটকের মনাই বয়াতি মূলত তালুকনগরের আজহার বয়াতি। তালুকনগরে এই সাধক-শিল্পীর কবর আছে। প্রতি বছর তাঁর মাজারকে কেন্দ্র করে মাঘ মাসের ৬ তারিখে মেলা বসে। তেরশ্রী, টুইটাম, ঘেওরকুল, দৌলতপুর, ভদ্রা, জালাই, দপ্তিয়ার নলসন্ধা, কৈজুরী ইত্যাদি প্রায় সবগুলি গ্রাম বাস্তবেই আছে। এই অঞ্চলে খুব কম বাড়িই আছে যে বাড়িতে বছরে দু-একবার গানবাজনা হয় না। জনগণের এই সঙ্গীতপ্রিয়তার জন্য এই অঞ্চল জুড়ে অসংখ্য গায়ক, সাধক ও বয়াতির জন্ম হয়েছে। এই এলাকার অনেক পরিবারই বহু বছর আগে ফরিদপুর, পাবনা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে এসে বসবাস করছে। ইতালির কবি ওভিদের মেটামরফোসিস কাব্যে যে পৌরাণিক রূপান্তরের কথা বলেছেন, আমরা তাকে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক পটভূমিতে প্রত্যক্ষ করেছি। এই নাটকের সোনাই বছির, বনশ্রী, ছায়ারঞ্জন, গোলাপ গাছি, প্রায় সবগুলি চরিত্রই জীবন জীবিকার সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়।
এই রূপান্তর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতই শুধু নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের মধ্যে, জীবনের অনিঃশেষ প্রক্রিয়ায় বিস্তৃত।
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির সংগ্রামী রূপান্তরে এই জনপদের মানুষকে সাহায্য করে কিনা, কিত্তনখোলা নাটকে আমরা তা দেখতে চেয়েছি। কিন্তু বাস্তবজীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রচলিত সংস্কৃতির প্রভাব একক ও সার্বভৌম নয়। একটু সচেতন হলেই আমরা দেখব সয়ফুল মুলুকের সমুদ্রযাত্রা ও সোনাইর দুখাইপুর যাত্রা সমান্তরাল হলেও বাস্তবে তা কত ভিন্ন।
সোনাইর জন্য কোনো পরী-কন্যা নয়, হয়ত-বা বিবরবাসী শঙ্খচূড়ের ফণা অপেক্ষা করে। কিন্তু সোনাই যে দুখাইপুরে যাত্রা করে তার পেছনে সয়ফুল মুলুকের সমুদ্রযাত্রার প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না। একে দ্বৈতাদ্বৈত সম্পর্কও বলা যায়। কিত্তনখোলা নাটকটি নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা সর্বদাই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমির কথা মনে রেখেছি।
নাটকটিতে একটি শোষণমুখী সমাজের রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে মঞ্চে উপস্থাপন করার চেষ্ট করা হয়েছে। বাস্তব চিত্রগুলিকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এবং চরিত্রনির্মাণে সেই বাস্তবতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছি।
বাংলাদেশ নামক জনপদের নদী তীরে তীরে নামহীন গোত্রহীন মানুষের জীবন নাটকের বিষয়বস্তু। তার ইতিহাস সংগ্রাম-সংস্কৃতিসহ। দেশজ আঙ্গিকে সৃষ্ট তাদের নাটক বলেও ঘোষণা করা হয়। এই নাটকে জীবন জীবিকার সংগ্রামে রূপান্তরিত মানুষকে আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষ করা হয়েছে। সংস্কৃতি সংগ্রামী রূপান্তরে মানুষকে সাহায্য করে কিনা তা দেখতে চাওয়ার কথা আছে। লোককথার সমান্তরাল রূপান্তর বাস্তবে কত ভিন্ন। তবু দুইয়ের ভিতর সম্পর্ক আছে। প্রভাব আছে। শোষণমুখী সমাজের রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে মঞ্চে উপস্থাপনের চেষ্টা হয়েছে। নাটকে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনাসৃষ্টির জন্য পৌরাণিক, অতিলৌকিক ঘটনার আমদানি করা হয়েছে, নাটকের চূড়ান্ত মহলায় একথা বলেন নাট্যকার।
দর্শক-সমালোচকের মতামত
কিত্তনখোলার চূড়ান্ত মহড়ানুষ্ঠানের শেষে উপস্থিত সুধীদের কাছ থেকে নাটকটি সম্পর্কে মতামত আহ্বান করা হয়। এ পর্যায়ে বক্তব্য রাখেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শওকত আলী ও রশীদ হায়দার। এঁরা অভিমত ব্যক্ত করেন, আমাদের লোকজ ঐতিহ্যকে সংগ্রামীচেতনায় উজ্জীবিত করার চেষ্টা এ নাটকে নেয়া হয়েছে, এটি উদ্যোগের দিক থেকে অবশ্যই ব্যতিক্রম। এঁরা আরো বলেন, নাটকটিতে কিছু-কিছু দৃশ্য অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। কিছু ঘটনা নাটকের অগ্রসরমানতার অপ্রত্যাশিত শৈথিল্যের সৃষ্টি করেছে। নাটকের রচয়িতা সেলিম আল দীন তাঁর বক্তব্যে অবশ্য এ নাটকে ঘটনার উপর্যুপরি উপস্থাপনার কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, কিত্তনখোলা নাটকে মহাকাব্যিক ইমেজ সৃষ্টি করার জন্য পৌরাণিক, অতিলৌকিক ঘটনার আমদানি করা হয়েছে। মহাকাব্যিক ব্যাপ্তির জন্য ঘটনাকে নানা প্রসঙ্গে ধাবিত করতে হয়, এ নাটকেও তা-ই করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কিত্তনখোলা নাটকে দেখা যাবে ‘অঙ্কের’ পরিবর্তে ‘সর্গ’ করা হয়েছে এবং তা করা হয়েছে মূলত মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টির জন্য।
নাটকে তিন ধরনের পৃথক ও অভিন্ন দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করেন এক সমালোচক:
কিত্তনখোলার কাহিনি তিন ধরনের পৃথক, অথচ অভিন্ন দ্বন্দ্বের সমন্বয়, সোনাইয়ের জমির প্রতি ইঁদু কন্ট্রাক্টরের লোভ ও তাদের উভয়ের দ্বন্দ্ব; যাত্রাদলের কুশলীদের সুখ-দুঃখ, মানবিক-আর্তি, নেশা ও পেশার দ্বন্দ্ব এবং মালিকের লোভের কাছে নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিসর্জন ও শোষণ; এবং লাউয়া শ্রেণির অস্তিত্বগত সংগ্রামের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, জাত্যাভিমান ও পেশা বদলের প্রচেষ্টা, ইত্যাদি এই নাটকের কাহিনিসূত্র। আপাতদৃষ্টিতে এই কাহিনিসূত্রত্রয়কে বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে, কিন্তু তারা বিচ্ছিন্ন নয়, বরং পরস্পর সম্পর্কিত। কিত্তনখোলা মেলার বর্ণাঢ্য ও আনন্দমুখর পরিবেশে নাট্যকার এই তিন শ্রেণির inner Souter উভয় সংগ্রামকে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে উপস্থিত করেছেন। ফলে ঘটনা যত বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি বড় হয়েছে ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণ। মেলার আবরণে নাট্যকার এসব কাহিনিসূত্র সংগ্রথিত করতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন রূপকাশ্রয়ী রীতির। কবির লড়াই, পুঁথিপাঠ ইত্যকার কিছুর ব্যবহার একারণেই এসেছে। প্রাথমিক বিচারে এগুলোর ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত ও বাণিজ্যিক প্রচেষ্টা বলে ভ্রম হতে পারে, তবে মেলার মূলভূমি কিত্তনখোলার অন্যতম আকর্ষণ মনাই বয়াতির মাজার, একথাটি স্মরণ রাখলেই সমস্যার সমাধান লাভ সম্ভব। মনসাকাহিনি ও আমলকি-কে রূপক হিসেবে নাট্যকারের ব্যবহার প্রশংসনীয়।
ইঙ্গিতময় মঞ্চে উপস্থিত এক মেলাজীবন, বিশেষ কোনো কাহিনি ছাড়িয়ে যায়। মধ্যবিত্তের স্থবির জীবন ছাড়িয়ে জনজীবনে পৌঁছে যায়, শিকড় ও শিরদাঁড়া ফিরে পাওয়ার আবেগ বোধ করেন হাবিব হাসান এ নাটকে:
চলো যাই কিত্তনখোলা...গীত দিয়ে মঞ্চে প্রবেশ। মঞ্চের মেলাটিকে যেন লোকায়ত বাংলাদেশ থেকে কেটে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে পোড়াকাঠ, আলো-ছায়া অন্ধকার, বিগতপত্র কাঁটাগাছে হঠাৎ কাটা কোনো ঘুড়ি, কেবল অনেক দূরে পেছনে একটি মাত্র একাকী সবুজ, অপ্রস্তুত বৃক্ষ। যেন এই টানাপোড়েন, জীবনের পাক, আশ্চর্য আবর্তের বিরুদ্ধে অকৃত্রিম সবুজ আলোর রেখা, অনিঃশেষ প্রাণময়তা। শুরুতেই দর্শককে এভাবে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলে কিত্তনখোলার মঞ্চ।
বিশেষ ও প্রতিষ্ঠিত কোনো কাহিনি নাটকটিতে আছে বলে মনে হয় না। যা আছে, সেগুলো দর্শকের নিকট কিছু উপকাহিনি মাত্র। কিছু উপকাহিনির মাঝ দিয়ে নাটকটিতে একটি শোষণমুখী সমাজের রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে মঞ্চে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। যে কারণে এসেছে মেলায় আসা যাত্রাদল, যাত্রাদলের কুশীলবদের দিয়ে মানব-মানবীর সম্পর্কের রহস্য উন্মোচনের প্রচেষ্টা, অর্থগৃধু অধিকারী, সমাজ থেকে বিতাড়িত ছিন্নমূল ‘ইঁদু’র অপ্রকৃতিস্থ ছেলে ছায়া, সমাজব্যবস্থার সুবিশাল থাবার সুচতুর ও পরিকল্পিত শিকার সোনাই, বছির রুস্তম, ডালিমন, মালকা-এরা। গোটা নাটক জুড়ে একটি নির্দিষ্ট কাহিনিকে ছাড়িয়ে নেওয়ার নাট্যকারের অব্যাহত প্রচেষ্টা বারংবার চোখে ঠেকে। এবং এমনও মনে হয়, আদৌ কি কোনো কাহিনি নির্মাণের দরকার রয়েছে? যে কারণে, সবকিছু ছাপিয়ে একটি মেলাজীবন, যা এই মানবজীবনেরই প্রতীকী প্রতিভাস মাত্র, তা অপরূপ সততা ও খুঁটিনাটিসহ দর্শকের হৃদয়ে খুব সহজেই স্থান করে নেয়। সোনাই, ইঁদু কিংবা ডালিমন নিয়ে যে অন্তর্গত কাহিনি নাট্যকার তৈরি করতে চান তাকে ঠেলে দিয়ে একটি নির্বিশেষ মানবজীবন দর্শককে স্পর্শ করে। এতে ব্যঞ্জনা আনে শামসল বয়াতীর পুঁথি (সয়ফুল মুলুকের সমুদ্রযাত্রা), বনশ্রীর মনসা-রূপ, কখনো বা ছায়া কিংবা সোনাইর রক্তে দোলা জীবনজিজ্ঞাসা। মঞ্চ ও আলো, সংগীত ও স্বচ্ছন্দ অভিনয়ে নাটকটি একটি সম্পূর্ণ আলাদা, মানবিকজগৎ নির্মাণ করে।
নাট্যকারের অ্যাম্বিশন নাটকটিকে কি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে? এ জাতীয় প্রশ্ন উঠতে পারে। নাট্যকার একটি মহাকাব্য নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মহাকাব্যের যে বিশালত্ব, ব্যাপ্তি, ব্যঞ্জনা অথবা গূঢ়ার্থ তা নাটকটিতে নেই। যে কারণে কিত্তনখোলার কিছু কিছু দৃশ্য কেবল বিপজ্জনকভাবে অর্থহীন ও বিনোদনমূলক বলে সন্দেহ হয়। অ্যাম্বিশনের কারণেই নাট্যকার কোনো কোনো কুশীলবের মুখে তুলে দেন তাঁরই রচিত জীবনজিজ্ঞাসা, তারা ছন্দ গেঁথে গেঁথে অদ্ভুত সব জীবনজিজ্ঞাসু প্রশ্ন করে চলে। লাফিয়ে উঠে আসে কোনো চরিত্র, দু-একটা আঁচড়ে তাদেরকে আঁকার চেষ্টা করা হয়, কেউ কেউ তাদের বিকশিত হবার আগেই শেষ হয়ে যায়। বলতে চাইছি নাটকটি যেনো বা একটু তাড়াহুড়ো করেই শেষ করে দেয়া হয়েছে। যার ফলে যে সম্ভাবনাময় শুরু ছিল নাটকটিতে, শেষাবধি তা টেকে না। শেষ দৃশ্যটি হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়, দর্শক তখনো অপেক্ষা করে, কিন্তু দ্রুত আলো জ্বলে এবং নাটক শেষের বাঁশি বেজে ওঠে।
গতিময়তা নাটকটির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। নাট্যকার অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে কিত্তনখোলাকে মানবজীবনের প্রতীক করে তুলেছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর শক্তি নিশ্চয়ই স্বীকার্য। বলাবাহুল্য, এ জীবন মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের স্থবির, একঘেঁয়ে জীবন নয়, বরং নিচু, অন্ত্যজশ্রেণির বিশাল, গতিশীল মানবজীবন, যেকোনো ক্রোধ-হিংসা-প্রতিশোধ প্রেম ও অনুরাগ মুখোসহীন উঠে আসে। নাটকের সাহিত্যগুণও অগ্রাহ্যের নয়। সেলিম আল দীনের কিত্তনখোলা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন।...
কিত্তনখোলা আমাদের একটি সম্পূর্ণ আলাদা অভিজ্ঞতা দান করে। আমাদের শূন্যস্থিত, শহুরে পা জোড়া পুনরায় মাটিতে নেমে আসতে চায়, হঠাৎ যেন ঝলসে উঠতে দেখি হারানো দিগন্ত, যেন আবার ফিরে পেতে চাই নিজেদের শেকড় ও শিরদাঁড়া। সয়ফুল মুলুুকের সমুদ্রযাত্রা তখন কেবল রূপকথা থাকে না, কিন্তু সোনাই কেবলমাত্র কিত্তনখোলার কোনো কুশীলব নয়; মুহূর্তে আমাদের রক্তোজ্জ্বল চেতনার সাথী হয়ে যায়।
শোষক আর শোষিতের দ্বন্দ্ব সংঘাত এবং পরিশেষে সামগ্রিক জনতার ক্রোধ প্রকাশের প্রচলিত কাঠামো নাটকে পুরোপুরি না পেয়ে সমালোচনা হয়েছে:
চরিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায় ইঁদু কন্ট্রাক্টর আর সোনাই দুই তীরের দুই মানুষ। ইঁদু শোষকের প্রতীক আর সোনাই শোষিতের প্রতীক। শোষিত সোনাইকে ঘিরেই নাটকের কাহিনি-বিস্তার। শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সোনাই যেন মৃগীরোগী। ইঁদু’র শোষণের কৌশলে সোনাই ভীত সন্ত্রস্ত। ইঁদু এমন একটি রূপান্তরিত শোষক, যে পরের জমি করায়ত্ত করে। আবার টাকার বিনিময়ে বনশ্রীর নাচও দেখে। নাটকের বনশ্রী ছায়ারঞ্জন রবিদাশ বছির এদের উপরও ইঁদু কন্ট্রাক্টর তার শোষণের হাত বিস্তার করেছে। শোষণের প্রয়োগকৌশল ভিন্ন ভিন্নভাবে এলেও পুরো সমাজজীবনে নাড়া লেগেছে। যেমন নাড়া লেগেছে সোনাইয়ের জীবনে তেমনি লেগেছে বনশ্রী ও ছায়ারঞ্জনের জীবনে। বনশ্রীর নাচ দেখে ভালো লাগায় ইঁদু কন্ট্রাক্টর যখন বলে, ‘আমি সাইঝেরবেলায় বনশ্রীর ঘরে যাবো’- ভালো লাগার এই যে অশ্লীল কামনা, যার প্রতিক্রিয়া পড়েছে ছায়ারঞ্জন ও রবিদাশের উপরে। যা আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন লেখক বনশ্রীর মুখে মনসার সংলাপ জুড়ে দিয়ে; আবার বিপরীতে টেনেছেন জীবনের প্রতীকী আমলকীর স্বাদ বিলিয়ে। একদিকে ইঁদু কন্ট্র্রাক্টরের ইন্দ্রিয়ের লালসা আর অপরদিকে প্রিয়জনের আত্মপীড়ন জীবনের টানাপোড়েনে বনশ্রী কাতর। পরিশেষে লেখক জীবনযুদ্ধে পরাজিত করে বনশ্রীকে এন্ড্রিন পানে আত্মহত্যা করিয়েছেন। এই মৃত্যু দর্শকের চিন্তা ও চিন্তনে আঘাত করেছে। ভাবতে শিখিয়েছে, ইঁদুদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছে।
ইঁদুকে হত্যা করে সোনাই সমাজ পরিবর্তনের কোনো গন্তব্য বা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে নি বরং তার পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। সে একা নিঃসঙ্গ। কাজেই এ হত্যাকাণ্ডকে স্বীকার করা যায় না। কেননা এ হত্যাকাণ্ড সামগ্রিক জনতার ক্রোধ হয়ে ওঠে নি। ইঁদু’র প্রতি ঘৃণাবোধের সৃষ্টি করেছে।
শহুরে দর্শকের মানসিকতা এ নাটক উন্নত করবে, গ্রামের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে, একথাও এক সমালোচনায় বলা হয়:
আজ তাই ঊনিশ শতকের প্রান্তে এসে নগরসভ্যতার মুহ্যমান এবং গ্রাম সম্পর্কে যাদের ধারণা অস্পষ্ট গল্পের মতো অথবা ছাড়িয়ে যাওয়া স্মৃতি, তাদের মানসিকতা উন্নত করার প্রয়াসে ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর নাটক কিত্তনখোলা, অর্থাৎ গ্রামের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ার একটা সুন্দর বাহন এ নাটক।
প্রথাবদ্ধ গ্রামজীবন নাটকে না আসায় তারিফ করেও, সামাজিক বঞ্চনার প্রতিকার সামাজিকভাবে না হওয়ায় মধ্যবিত্তের বিপ্লব-বিলাসিতা প্রত্যক্ষ করেছেন এ সমালোচক:
তবে কিত্তনখোলা যেখানে মধ্যবিত্তের বিপ্লব-বিলাসে রূপান্তরিক হয়েছে, ভাসানী হুজুর, ক্ষেতমজুর হয়ে যাওয়া চাষির দুঃখ, গ্রাম্যধনীকের সামাজিক নিষ্পেষণ ইত্যাদি সব কিছু এনেও নাটক যেখানে অর্থহীন পরিণতিতে মাথা কুটে মরে সেখানে পরিচালকের কিছু করার ছিল না। জীবনের মোটাদাগের রূঢ় ছবির চাইতে প্রেমকাহিনি ফাঁদার টানেও নাট্যকার অনেকটা ভেসে গেছেন।
বাংলাদেশের গ্রামজনসংখ্যার অধিকাংশ আজ ভূমিহীন কিন্তু ভূমিহারানো এই সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষির ছবি শিল্প-সাহিত্যে খুব একটা তো লক্ষ করা যায় না। সেদিক দিয়ে কিত্তনখোলার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় ও সাহসিক। তদুপরি এখানে ক্রুর জমিদার, জোতদার ও দরিদ্র-চাষির সেই চির পরিচিত মঞ্চক্লান্ত কিন্তু বাস্তবে অনুপস্থিত কাঠামোটি অবলম্বন করা হয় নি। কিন্তু এটুকু কৃতিত্বেই একটি নাটক সফল হয়ে ওঠে না। যেহেতু বঞ্চনার প্রকৃতিটি সামাজিক তাই এর প্রতিকারের প্রচেষ্টাও হবে সামাজিক অর্থাৎ মিলিত ও যৌথ। কিন্তু নাট্যকারের মধ্যবিত্ত-সুলভ বিচ্ছিন্ন বিপ্লব-বিলাসের কারণেই বোধহয় সমস্ত ক্ষোভ ও বঞ্চনার জ্বালা নিয়ে সোনাই শেষ পর্যন্ত একক ঘাতক কী ডাকাতেই রূপান্তরিত হয়, সোনাইয়ের দুঃখ-বেদনাকে সামাজিক চরিত্র প্রদানের চাইতে লেখক বরং দুঃখমোচনের একক পথেই তাঁকে ঠেলে দেন এবং কন্ট্রাক্টরকে দায়ের আঘাতে হত্যার পর জায়মান লাল সূর্য পটভূমিতে রেখে যেভাবে সোনাই মঞ্চ ত্যাগ করে, তা কোনো গভীর চেতনার পরিচয় বহন না করে বরং বাহাদুরিকেই প্রকাশ করেন বেশি। বস্তুত নাটকের অবতারণা সুন্দর হলেও যতই কাহিনি অগ্রসর হয়, ততই সব এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। বাংলায় মৌলিক নাটকের মস্তঅভাবটুকু খুব সহজে পূরণ হবে বলে বোধ হচ্ছে না।
তবে নাটকটি নানা মাধ্যমের বিশিষ্টজনকে আলোড়িত করে। শিল্পী কামরুল হাসান এই নাটকে মাটির গন্ধ পেয়ে আপ্লুত:
অত্যন্ত শঙ্কিত ছিলাম এতোদিন। আজ কিত্তনখোলা দেখে অনেক স্বস্তি পাচ্ছি। ভাবতাম আমাদের লোকজ সংস্কৃতি, যা কিনা একেবারেই আমাদের নিজস্ব সম্পদ, সেটা ক্রমশ আমরা হারিয়ে ফেলছি, আমদানি করা বিদেশি সংস্কৃতি সেটা আমাদেরকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। ঠিক তখনই এই কিত্তনখোলা দেখে এই মেলা, মেলার মানুষ, মানুষের ভাষা, সেট ডিজাইন, সঙ্গীত সবকিছু আমাকে আমার মাটির কাছে নিয়ে গিয়েছে। আমি আমার মাটির গন্ধ পাচ্ছি। আর শঙ্কা নেই আমার। আমি এখন শান্তিতে মরতে পারবো।
শিক্ষাব্রতী জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এই নাটকে লোকসংস্কৃতির নবমাত্রিক প্রয়োগ লক্ষ করেন:
মেলার আয়নায় আমরা দেখি একই সঙ্গে শাশ্বত বাংলা ও সমকালীন বাংলার এক চেহারা, যা আমাদের নাগরিক স্বস্তিকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়। যাত্রা, জারী, পুঁথি ও কেচ্ছার আবেদন কেন ও কেমন- তার উত্তর পাওয়া যায় লোকসংস্কৃতির এই উপাদানগুলোর নাট্যসম্মত ব্যবহারে। প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা বেশি জায়গা এরা নিলেও, এগুলোর উপস্থাপনার সৌন্দর্য দর্শককে বাধ্য করে এই আপত্তিকে ভুলে যেতে। জীবনের কোমলতা ও কঠোরতা, পবিত্রতা ও পশুত্বকে তুলে ধরতে গিয়ে যে পরিস্থিতিগুলো ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলোকে মামুলি বলে মেনে নিয়েও, সেগুলোর যথার্থতা অস্বীকার করা যায় না। সমাজ সম্পর্কে নাট্যকারের একটা বক্তব্য আছে। কিন্তু কিত্তনখোলার সেই বক্তব্যের চেয়ে যেটা মূল্যবান সেটা হলো, নাট্যকল্পনায় একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হলো- এই কথাটা। এই পথে আরও নতুন, আরও সার্থক নাট্যকর্মের ইশারা আছে। ‘ঢাকা থিয়েটারে’র শিল্পীদল নাট্যকারের কল্পনাকে শুধু নৈপুণ্য দিয়ে নয়, প্রাণের দরদ দিয়ে এগিয়ে দিয়েছেন। দর্শকের অনুভূতির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তারা সবাই একটু চড়া গলায়, একটু ঊর্ধ্বশ্বাসে কথা বলেছেন; কণ্ঠস্বরের ব্যবহার বিষয়ে যদি আরও মনোযোগী হন, তাহলে মানুষের মুখের কথা, উচ্চারিত সংলাপ, আরও নাটকীয় মর্যাদা পাবে। কিত্তনখোলা শুধু একটা পরীক্ষা নয়, একটা অভিজ্ঞতাও।
কবি ও মননব্রতী আবু হেনা মোস্তফা কামালের ভাষ্য মতে, অভিনব এই নাটক নিয়ে যায় ‘স্বদেশের হৃদয়ের কাছে’:
কিত্তনখোলা, এক কথায় ব্যতিক্রমী স্বাদের নাটক। ঢাকায় আমরা সাধারণত যেসব নাটক দেখি- কখনো মঞ্চে, কখনো টেলিভিশনে, তার সাথে কিত্তনখোলার কোনো মিল নেই। শহুরে জীবনের সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকে এই নাটক আমাদের নিয়ে যায় একেবারে স্বদেশের হৃদয়ের কাছে। তথাকথিত নাগরিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা অন্তত আড়াই ঘণ্টার জন্যে আমরা সবাই ভুলে যেতে পারি। কিত্তনখোলার মেলায় আসে সোনাই, বসির, রবিদাস, বনশ্রী, শামসল বয়াতী, ছায়ারঞ্জন, গোলাপ গাছি, আরো কতো বিচিত্র পেশা ও পরিচয়ের মানুষ। এদের জীবনের নেপথ্য-বেদনা নাট্যকারের চোখ এড়ায় নি। গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতির সহজ উৎসারণ আর ব্যবসায়ী অধিকারীর বণিকবুদ্ধির দ্বৈরথে শেষ পর্যন্ত অশুভ ব্যক্তিই জয়ী হয়। বনশ্রীর আত্মহত্যার ভেতর দিয়ে তারই প্রতীতী উল্লেখ পাই। কিন্তু গ্রাম্যঠিকাদার ইঁদুর পরিণাম যে সামাজিক শক্তির উত্থানের সঙ্কেত দেয়, সম্ভবত তাকে নিয়েই রচিত হবে কিত্তনখোলার উত্তরকাব্য।
কিত্তনখোলা আমার অপরিসীম ভালো লেগেছে, কারণ এই নাটকে এতোটুকুও নাটুকেপনা নেই।
কিত্তনখোলা নাটকের আখ্যানব্যাপ্তি, বিশিষ্ট বিন্যাস ও তার মঞ্চরূপায়ণের সিদ্ধি দর্শক-সমালোচককে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। কাহিনির অভিনব জটিল বিন্যাস, মহাকাব্যিক চারিত্র্য প্রদান-প্রচেষ্টার মধ্যে কতক অসঙ্গতি এবং পরিণতির প্রতিকারপন্থা নিয়ে বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শগত আপত্তি উঠেছে। সেটা যদিও নাটকটির বিশিষ্ট ধরনের সামর্র্থ্য বিচার করে ততটা নয়। নাটকটির সমূহ অভিনবত্ব বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করে। বিশিষ্ট এক রাজনৈতিক নান্দনিকতা এভাবে ওঠে থিয়েটারে শিল্প ও রাজনীতি সম্পর্কের প্রশ্নে।
ড. বিপ্লব বালা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, সমালোচক