Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: কোপেনিকের ক্যাপ্টেন
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: কোপেনিকের ক্যাপ্টেন। মূলরচনা: কার্ল স্যুখমায়ার। রূপান্তর ও নির্দেশনা: আলী যাকের। মঞ্চপরিকল্পনা: শেখ মনসুরউদ্দিন আহমেদ। আলোকপরিকল্পনা: সৈয়দ লুৎফর রহমান। আবহসংগীতপরিকল্পনা: কে বি আল আজাদ। রূপসজ্জা: বঙ্গজীৎ দত্ত। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৮১। একটি ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ প্রযোজনা
[কোপেনিকের ক্যাপ্টেন নাটক নিয়ে গবেষণাধর্মী নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন বিপ্লব বালা। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ১৪তম সংখ্যায় (২০০৪ এ প্রকাশিত) এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
নাটকটির প্রচারপত্রে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ বিস্তারিত জানায় কোপেনিকের ক্যাপ্টেন-এর লেখন-পরিপ্রেক্ষিতে, সেই সঙ্গে নাট্যকারের রচন-প্রণোদনার বাস্তব পরিস্থিতি:
এই নাটকের মূল ঘটনাটি সত্য। ঘটেছিল ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে। যখন জার্মানির সম্রাট ছিলেন কাইজার উইলহেম। সেনাবাহিনী এবং সেনাবাহিনীর পোশাকের প্রতি কাইজারের ছিল অসীম দুর্বলতা। এবং এই দুর্বলতার শিকার হয়েছিল তৎকালীন জার্মান জনগণ। তখনকার জার্মানিতে সেনাবাহিনীর পোশাকপরিহিত যে কেউ প্রায় যা খুশি তাই করতে পারতো। এই ঘটনার নায়ক, উইলহেম ভয়েগট নামে এক ব্যক্তি। বিভিন্নরকম অসামাজিক কাজে লিপ্ত হবার জন্যে সে একাধিকবার জেল খেটেছে। প্রতিবারই সে জেল থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে জীবন শুরু করবার কথা ভেবেছে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। কারণ কাইজার উইলহেমের সামরিক শাসনাবৃত জার্মানিতে তখন যে কোনো শহরে বাস করতে হলে চাই একটি পারমিট। এ এক দুর্ভেদ্য চক্র। উইলহেম ভয়েগট এই চক্র ভেদ করতে অক্ষম। ফলে আবার জেল। ছাপান্ন বছর বয়সে এই শেষবার জেল থেকে বেরিয়ে এসে ভয়েগট’র বোধোদয় হলো। সে আবিষ্কার করলো যে, মহামান্য কাইজার উইলহেমের সরকারের কল্যাণে যে একটি শ্রেণি যা খুশি তাই করে বেড়াতে পারছে, তা হলো তৎকালীন জার্মান সামরিক বাহিনী। এই পরিস্থিতিতে ভয়েগট একটি ক্যাপ্টেনের পুরোনো ইউনিফর্ম কেনে এবং সেই ইউনিফর্ম পরে কিছু সৈনিকের নেতৃত্ব দিয়ে সে দখল করে বার্লিনের শহরতলী কোপেনিকের পৌরসভা। তার প্রয়োজন খুবই সামান্য। হয় দেশে বাস করবার জন্য একটি পারমিট, নয়তো দেশ ছেড়ে চলে যাবার জন্য একটি পাসপোর্ট।
নাট্যকার:
কার্ল স্যুখমায়ার জার্মানির প্রথমসারির নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম। জার্মানির নাট্যগুরু বের্টল্ট ব্রেখ্টের মতোই ক্ষুরধার সমাজ সচেতন নাটক রচনায় তিনি সিদ্ধ। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে, স্যুখমায়ার উইলহেম ভয়েগটকে দেখেছিলেন মাইনজ শহরের মেলায়। তাঁর মনে আছে, ঐ মেলায় ভয়েগট তার সামরিক পোশাকপরা ছবি বিক্রি করছিল। তবে ভয়েগট’র এই ঘটনা স্যুখমায়ারকে নাটক রচনায় অনুপ্রাণিত করে আরও পরে।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে নাট্যকার স্যুখমায়ার প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর অসীম সাহসিকতার জন্য তিনি বিশেষ সম্মানখচিত পদকে ভূষিত হন। ঠিক এর পর থেকেই তিনি জার্মান জাতির ইউনিফর্ম এবং সামরিক বাহিনীর প্রতি অস্বাভাবিক দুর্বলতায় আশাহত হয়ে পড়েন। ১৯৩১-এ যখন হিটলার ক্ষমতা দখল করে তখন তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী বন্ধু ১ম মহাযুদ্ধে পাওয়া সম্মান এবং পদক প্রত্যাহার করেন। এই সময় জার্মানিতে এক অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল। ষাট লক্ষ লোক বেকার হয়ে পড়েছিল, ব্যাংকগুলো সব একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। অথচ জার্মান সেনাবাহিনী জার্মান জাতির তথাকথিত রক্ষক হিসেবে রাজত্ব করে চলেছিল মহাদাপটে। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্যুখমায়ার লিখলেন দা ক্যাপ্টেন অব কোপেনিক। ক্ষমতাসীন নাৎসী চক্রের কাছে এ এক অমার্জনীয় অপরাধ। ফলে, স্যুখমায়ারের ভাষায়, বুদ্ধিবিবেকহীন, অশিক্ষিত, আড়ম্বরসর্বস্ব হিটলার বন্ধ করে দিলেন এই নাটক। কিন্তু হিটলারের পতনের পর থেকে আজ অবধি কোপেনিকের ক্যাপ্টেন অভিনীত হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র, প্রশংসিত হচ্ছে মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন দর্শক দ্বারা।
প্রযোজনা প্রসঙ্গ:
স্যুভিনিরে উল্লেখ আছে, আমরা এই নাটকটিকে প্রথাসিদ্ধ উপায়ে উপস্থাপন করছি না। কারণ, এই নাটকে এতো চরিত্র, এতো স্থান-কালের সমাবেশ যে, তা দৃশ্যপট পরিবর্তন করে মঞ্চায়ন অসম্ভব। এ ছাড়া নাটককে দর্শকের মাঝে নিয়ে আসার একটা ইচ্ছে আমাদের সবসময়েই ছিল। এই প্রযোজনায় তা সফলভাবে সম্পাদিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। মূল নাটকে চরিত্র রয়েছে ৯০টি, আমাদের নাটকে চরিত্র রয়েছে ঊনপঞ্চাশটি। তবে ঊনপঞ্চাশটি চরিত্র অভিনীত হবে সতেরোজন কুশীলব দ্বারা। এ ছাড়া রয়েছে একজন একক কোরাস-দৃশ্য, পরিচিতির জন্য। অর্থাৎ একজন অভিনেতা কী অভিনেত্রী একাধিক চরিত্রে অভিনয় করবেন দৃশ্য থেকে দৃশ্যে। নেপথ্যের সব কাজ, যেমন পরিচ্ছদ পরিবর্তন, আসবাব পরিবর্তন ইত্যাদি সংঘটিত হবে দর্শকের সামনেই।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের একটি ঘটনা ১৯৩১-এ যে প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করে, ১৯৮১-এর বাংলাদেশে তার মঞ্চায়ন-তাৎপর্য স্যুভেনিরে উল্লেখ করা হয় নি।
দর্শক-সমালোচকের মতামত
পাকিস্তানি যুগের সামরিকীকরণের তিক্ত অভিজ্ঞতা ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে পুনরাবির্ভূত। তাই বুঝি নিজস্ব ইতিহাসে ফিরে আসে দূর কোপেনিকের শহর। নাটকের প্রতিবেশ ও চরিত্রমালা সবকিছু হয়ে ওঠে বাংলাদেশরই চেনাজানা জগতের আখ্যান, অভিজ্ঞতার পরিচয়লাভের দুর্লভ সুযোগ ঘটে এই নাট্যপ্রযোজনায়- জানান সমালোচক মফিদুল হক:
একটি দুর্নামের দায়ভাগ প্রায়শই ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে’র উপর বর্তায়, তাঁদের দৃষ্টি বড় বেশি বিদেশের দিকে ফেরানো। দেশীয় নাটকের চাইতে বিদেশি নাটকের ভাষান্তর, রূপান্তর মঞ্চায়নেই তাঁরা যেন অধিকতর আগ্রহী। এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা কিংবা অসাড়তা প্রমাণে আমরা অগ্রসর হচ্ছি না, তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ‘নাগরিকে’র সর্বশেষ প্রযোজনা জার্মান নাট্যকার কার্ল স্যুখমায়ার রচিত কোপেনিকের ক্যাপ্টেন দেখে স্বদেশি প্রশ্নে কেউ আলোড়িত হবেন না। নাটকটি নিঃসন্দেহে বিদেশি এবং সরাসরি অনুবাদই বটে, নাটকের পটভূমিও রয়েছে শতাব্দীর সূচনায় জার্মানিতে, তবু যে এই নাটকের সঙ্গে আমরা সহজেই একাকার হয়ে যাই, ভুলে যাই দেশ-কালের ভিন্নতা বা ব্যবধান, তার মূল নিহিত রয়েছে নাটকের বক্তব্যের বলিষ্ঠতায় এবং তার কুশলী উপস্থাপনায়।
রাষ্ট্রের মাধ্যমে যে নিয়ন্ত্রণ শাসক-শোষকগোষ্ঠী সমাজের উপর প্রতিষ্ঠা করে তার একটি নগ্ন প্রকাশ হচ্ছে সামরিকীকরণ। সমাজের সামরিকীকরণ ও সামরিক শাসন সমার্থ নয়, এর রূপ হতে পারে নানা ধরনেরই রাজতন্ত্র থেকে মায় গণতন্ত্র অবধি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পুঁজিবাদ যখন পরিণত হচ্ছিল সাম্রাজ্যবাদে, সমাজের সামরিকীকরণের তীব্রতাও তখন থেকে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। জায়মান মার্কেন্টাইল ও ফিনান্স বুর্জোয়ার পেছনে ছিল উনিশ শতকের শ্রমিক আন্দোলনের ভীতিকর অভিজ্ঞতা এবং সামনে ছিল বিশ্ববাজারের দখলি-স্বত্ব নিয়ে জোর লড়াইয়ের সম্ভাবনা। এই পটভূমিতে যে সামরিকীকরণ ঘটতে থাকে, সমাজে তার বর্বরতম প্রকাশ আমরা দেখেছি জার্মানির দুই মহাযুদ্ধের ইতিহাসে।
প্রথম মহাযুদ্ধ পূর্ববর্তী এক ঘটনার সূত্রে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পূর্ববর্তীকালে, ১৯৩১ সালে, কার্ল স্যুখমায়ার রচনা করেন কোপেনিকের ক্যাপ্টেন। হিটলারের বিস্ময়কর উত্থান তখন অভিভূত করে রেখেছে গোটা জার্মান জাতিকে। ঘটে গেছে চ্যান্সেলর পদে হিটলারের অধিষ্ঠান, নুরেমবার্গের যন্ত্র-নিপুণ ঐতিহাসিক সমাবেশ ‘জিস হেইল’ ধ্বনি নিয়ে স্টর্মটুপারদের মিছিল, তাতে নারকীয় অভিজ্ঞতাটুকু তখনো ছিল সামনে, গ্যাস চেম্বার, বুখেনভাল্ড কিংবা অপারেশন বারবারোসা যে ভবিতব্যে নিহিত ছিল স্যুখমায়ার যেন দিব্যদৃষ্টিতে তা দেখতে পেয়েছিলেন। এবং এই অভিজ্ঞতার নির্যাসকে নিংড়ে নিয়েই রচিত হয়েছিল কোপেনিকের ক্যাপ্টেন।
হিটলারের পতন হলেও সামরিকীকরণের অভিশাপ থেকে সভ্যতার মুক্তি তো ঘটে নি, বরং তৃতীয় বিশ্বের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখা যায় অশ্বারূঢ় শাসকের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। পাকিস্তানিযুগের তিক্ত অভিজ্ঞতা তো আমাদের রয়েছে এবং স্বাধীনতাপরবর্তী অভিজ্ঞতাও মোটেই সুখকর নয়। স্যুখমায়ারের নাটকের পাঠ নিতে গিয়ে আমাদের দৃষ্টি তাই বারবার ফিরে আসে নিজস্ব ইতিহাসে, দূর কোপেনিক শহর। বৃদ্ধ ইউলহেম ভয়েগট কিংবা ন্যূব্জ চরিত্রমালা সবকিছু হয়ে ওঠে আমাদের চেনাজানা জগতের।
আমাদের দেশে নাট্যপ্রযোজনার সমস্যা সংকটের কথা আমরা ভালোভাবেই জানি। এর সমাধানও আমাদের কাম্য। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতাবানদের কাছে কোনো সমস্যাই যে আর সমস্যা থাকে না, তার আরেক প্রমাণ মিললো ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে’র সর্বশেষ প্রযোজনায়। মহিলা সমিতির হল ঘরের মাঝখানে দুই স্তর বিশিষ্ট প্ল্যাটফর্ম দিয়ে নির্মিত হয়েছে মঞ্চ, তিনদিক ঘিরে বসেছে দর্শক। এ যেন আমাদের যাত্রা মঞ্চেরই আধুনিকীকরণ। মঞ্চের উপর স্রোতের মতো ভেসে চলে চরিত্র-ধারা, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ঘটনার অবতারণা ঘটে। কাহিনিসূত্র এতে এগোয় না। অন্তত প্রথমার্ধে। নাট্যকারের উদ্দেশ্যও তা নয় বরং খণ্ড খণ্ড দৃশ্যে পটভূমিকার সঙ্গে আমাদের পরিচয়টুকু ঘটিয়ে দেয়া হয়, টুকরো-টুকরো ঘটনাগুলো দিয়ে গেঁথে তোলা হয় এক মালা। কারাবন্দিদের ড্রিল, তাদের উদ্দেশে কারা-কর্তার ভাষণ (এর চমৎকার অভিনয় করেছেন আতাউর রহমান); পাবের বেশ্যাদের মনোভঙ্গি ইত্যাদি দৃশ্যাবলি বিরাট তাৎপর্য নিয়েই উপস্থিত হয়। শিথিল দর্শকের জন্য তরল কাহিনি-স্রোতের নাটক এ নয়, প্রথম দৃশ্য থেকেই মেরুদণ্ড সোজা করে দেখতে হয় নাটক এবং ব্রেখ্ট অনুরক্ত নাগরিকের পরিবেশনাগুণে দর্শকের সামাজিক অভিজ্ঞতার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ভাবিত করে তোলা হয় তাঁদের।
সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন-যাপনের অবকাশ কখনোই ঘটে নি উইলহেম ভয়েগট’র, শাটল ককের মতো বারবার তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছে কারান্তরালে। ছাপ্পান্ন বছর বয়সে সর্বশেষ কারামুক্তির পর আবারও মানবজীবনকে নতুন করে গেঁথে তুলতে সচেষ্ট হয় ভয়েগট। কিন্তু পদদলন, নিগ্রহ ও অবজ্ঞা ছাড়া কিছুই জোটে না তার কপালে। অবশেষে মরিয়া ভয়েগট পুরনো-কাপড়ের-দোকান থেকে ক্যাপ্টেনের পোশাক কিনে বার্লিন রেল স্টেশনের শৌচাগার থেকে কাপড় পাল্টে ক্যাপ্টেনের বেশে আবির্ভূত হয় (পাঠক লক্ষ করবেন এই ক্যাপ্টেনের উদ্ভব শৌচাগার থেকে)। ছোটমাপের মানুষটি উর্দিবান হয়ে হঠাৎ যেন অনেক বড় হয়ে উঠলো সকলের চোখে। রূপান্তরের এই দৃশ্যে স্মরণীয় অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। ক্যাপ্টেনের-পোশাক পরে বেরিয়ে এসেছেন ভয়েগট, গলার স্বর হয়ে উঠেছে ভারী, চিবুক সামান্য উচানো। চোখ দুটো ঈষৎ কুঞ্চিত। যেন শ্লেষ, অবজ্ঞা বিদ্রুপের সঙ্গে তাকাচ্ছেন চারপাশের জগতের দিকে। চকিতে বুঝিবা সেই চোখে ধরা পড়ে বিষাদের ছায়া; কেননা জীবনের মুখে পদাঘাত করার এই আনন্দটুকু সে কিনেছে বড় চড়া দামে।
পরবর্তী নাটকীয় দৃশ্যগুলোতে আমরা দেখি উর্দিবান মানুষটির সামনে কী করে ন্যূব্জ হয়ে যায় মেয়র, কাউপ্সিলর, রাজনীতিক, অভিজাত সকলেই। উর্দিবানের সামনে এমনি নতজানু হওয়ার দৃশ্য তো আমরা অনেক দেখেছি, এখনও কি দেখছি না?
কোপেনিকের ক্যাপ্টেনের অপরূপ উত্থানের পতন ঘটলো হুড়মুড়িয়ে। কিন্তু চকিত বিদ্যুৎ আভায় তা উচ্ছ্বসিত করে গেল জীবনসত্য।
‘নাগরিকে’র অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযোজনাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত রইবে কোপেনিকের ক্যাপ্টেন। নাটক নির্বাচনে ‘নাগরিক’ যে সর্বদা কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পেরেছে তা নয়। কিন্তু এবার এমনি নাটক বাছাই ও তার সফল উপস্থাপনার জন্য ‘নাগরিকে’র প্রতি জানাই তিন উল্লাস। তবু খেদ থেকে যায়, শ্লেষ ও বিদ্রুপে আগাগোড়া বাঁধা স্যুখমায়ারের নাটক, ছোট এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা আবর্তিত, কোনো কিছু বলার চেষ্টা মোটেই প্রকট নয় এখানে অথচ বলা হয়ে যায় অনেক কিছু। এমন নাটকে ঢাকাই কায়দায় ভাঁড়ামোতে লোক হাসানোর চেষ্টা পীড়াদায়ক বৈকি।
কোপেনিকের ক্যাপ্টেন যারা একবার দেখেছেন তাঁদের আবারও ফিরে আসতে হবে মহিলা সমিতি মিলনায়তনে এবং পুনর্দর্শনের অভিজ্ঞতা ফলপ্রসূই হবে, কেননা স্যুখমায়ারের নাটক ছোট বড় অসংখ্য কারুকর্মে সমৃদ্ধ, দর্শক-দৃষ্টি যত তীক্ষ্ণ হবে রসাস্বাদনের মাত্রা তত বৃদ্ধি পাবে। যাঁরা এখনো কোপেনিকের ক্যাপ্টেন দেখেন নি তাঁদের উচিত প্রথম সুযোগেরই সদ্বব্যহার করা, কেননা সর্বকালীনতা সর্বজনীন জীবনাভিজ্ঞতার এমন পরিচয় লাভের সুযোগ দুর্লভই বটে।
নাট্যদল ও নির্দেশকের নান্দনিক অবস্থান চিহ্নিত করে। পরোক্ষে দেশ-কাল-রাজনীতি এতটা ধারণক্ষম হতে যে পারে, নির্দিষ্ট নাট্যনির্বাচন ও উপস্থাপনের সিদ্ধি তাতে প্রত্যক্ষ হয়। শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্কেরই বিশিষ্ট চরিত্র দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। নন্দনরীতির বাস্তবোত্তর বিস্তার সম্ভাবনারও নিরিখ তৈরি করে কোপেনিকের ক্যাপ্টেন।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান পুলিশ পাঠিয়ে মঞ্চায়নকালে নাটকটি বন্ধ করে দেন। বহুপূর্বে রচিত বিদেশি এক নাটকের অনুবাদসামর্থ্য এবং বাংলাদেশের নাট্য-ইতিহাসে শিল্প ও রাজনীতির মেলবন্ধনের এক নজির হয়ে আছে এই নাট্যটি।
ড. বিপ্লব বালা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, সমালোচক