Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: নূরলদীনের সারাজীবন

Written by বিপ্লব বালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

নাটক: নূরলদীনের সারাজীবন। রচনা: সৈয়দ শামসুল হক। নির্দেশনা: আলী যাকের। মঞ্চপরিকল্পনা: শেখ মনসুরউদ্দিন আহমেদ। আলোকপরিকল্পনা: সৈয়দ লুৎফর রহমান। আবহসংগীতপরিকল্পনা: কে বি আল আজাদ। রূপসজ্জা: বঙ্গজীৎ দত্ত। পোস্টার ডিজাইন: কাইয়ুম চৌধুরী। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৮২। একটি ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ প্রযোজনা

[নূরলদীনের সারাজীবন নাটক নিয়ে গবেষণাধর্মী নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন বিপ্লব বালা। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ১৫তম সংখ্যায় (২০০৫ এ প্রকাশিত) এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]

‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ কর্তৃক প্রকাশিত স্যুভেনিরে নাট্যকার বিস্তারিত করেন নূরলদীনের সারাজীবন বিষয়ে তাঁর রচনা-ভাবনা:
আজ থেকে দুশো’ বছর আগে এক অগ্নিপুরুষের অভ্যুত্থান ঘটেছিল রংপুরে। গেরিলা নেতা বলতে এখন আমরা যা বুঝি তিনি ছিলেন তাই-ই। কিন্তু তিনি ‘নবাব’ ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষের কাছে।

...এই মানুষেরাই একদিন নূরলদীনের পেছনে সমবেত হয়েছিল, তাঁর ডাকে হাতিয়ার তুলে নিয়েছিল এবং তারা শাসক-শোষক-লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল তাঁরই নেতৃত্বে। সেই গণবাহিনীর পরাজয় ঘটেছিল, তার নেতা নূরলদীন শহীদ হয়েছিলেন। যারা বেঁচেছিল তারা এই কাহিনি সন্তানদের কাছে বলেছে, সন্তান সে কাহিনি তার সন্তানদের বলে গেছে। এইভাবে আমিও আমার ছেলেবেলায় শুনেছি, শুনেছি রংপুরের এক সাধারণ কৃষকÑতাঁর নাম আর কারো ঠিক মনে পড়ে নাÑইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।

...সেই তথ্যের সন্ধানেই লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে যাই। সেখানে সমকালীন বেশ কিছু নথিপত্র, দলিল, পুরনো বই কয়েক বছর ঘাঁটবার পর নূরলদীন এবং তাঁর কাল সম্পর্কে একটা ছবি আমার মনের মধ্যে গড়ে ওঠে।

আমি আমার একটি পূর্ব-ধারণার সমর্থন পেয়ে যাই যে, বাংলার সাধারণ মানুষ- কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ঊনিশশো একাত্তরেই যে গেরিলা হয়েছে তা নয়, এই গেরিলা হয়ে যাবার একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, এটা উপলব্ধি করতে না পারলে আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে কেবল লঘুই করে যেতে থাকব।

আমি কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করি যে, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে যাবার আগে সতেরোশো’ বিরাশিতে নূরলদীন যেমন ইংরেজ শাসকের কাছে প্রতিকার চেয়ে দরখাস্ত করেছিলেন, একাত্তরের শেখ মুজিবুর রহমানও তেমনি পাকিস্তানি সামরিক শাসকের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন।

আমি বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করি যে, নূরলদীনকে সাধারণ মানুষেরা ‘নবাব’ ঘোষণা করবার পরপরই তিনি ইংরেজ বাহিনীকে প্রথম সরাসরি আক্রমণ করেন এবং পরিণামে শহীদ হন। আমার কাছে মনে হতে থাকে, এ তাঁর আত্মহত্যাই বটে, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর যিনি পেরিয়ে এসেছেন, নবাব-জমিদার মহাজনদের পৈশাচিক ভূমিকা যিনি লক্ষ করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ সিপাহীর মতো অস্ত্র ধরেছেন, তিনি নিশ্চয়ই ইংরেজ সৈন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ‘নবাব’-এর দম্ভ দেখাতে নয়, আরো একজন ‘নবাব’ তাঁর নিজেকেই, নির্মূল করবার জন্যে। অথবা তাই কি?

এই বিস্ময়, কৌতূহল এবং প্রশ্ন থেকেই আমার নূরলদীনের সারাজীবন লেখা।

...লক্ষ করা সম্ভব হবে, এই কাব্যনাট্য দুটি পট মিলে গড়ে উঠেছে। প্রথম ভাগ- কালের মানচিত্র, বিরতির পর দ্বিতীয় ভাগটি মনের মানচিত্র। আমার অভিপ্রায় ছিল, কালের পটভূমি রচনা করে মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী ও অন্তঃস্থল তার প্রেক্ষিতে স্থাপন করা।

নূরলদীনের সারাজীবন নাটকের ৭৫তম মঞ্চায়ন উপলক্ষে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ প্রকাশিত পুস্তিকায় নির্দেশক আলী যাকেরের নূরলদীনের বিষয়ে ভাষ্য:
নূরলদীনের সারাজীবন ইতিহাসনির্ভর একটি বীরগাথা। এই ধরনের বীরগাথা বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে, এমনকি আমাদের দেশেও একাধিক লেখা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সিরাজদ্দৌলাহ্, তীতুমীর, সূর্যসেন এই নামগুলোর সাথে আমরা সবাই প্রায় ছেলে-ভোলানো-ছড়া-শোনা কাল থেকেই বাস করে আসছি। এঁদের প্রত্যেকের জীবনের ওপরে অত্যন্ত মঞ্চসফল নাটকও লেখা হয়েছে। ঐ নাটক দেখে আমরা বংশপরম্পরায় রাত থেকে রাত চোখের জল ফেলতে ফেলতে ঘরে ফিরে গেছি। নূরলদীন কি সেই সব নাটকের সমগোত্রীয়? নূরলদীন কি আমাদের সেইভাবে কাঁদায় হাসায়? নূরলদীন কি ইতিহাসনির্ভর বীরগাথার নামের সারিতে একটি এবং নবতম সংযোজন কেবল?

বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তের মানুষ, উন্নততর যোগাযোগের কল্যাণে যে সারা বিশ্বেরই মানুষ, এই মানুষ বড় শক্ত প্রাণ। এর হৃদয়তন্ত্রীতে স্পন্দন তোলা বড় কষ্টসাধ্য কাজ। আমি এমন এক সময়ের মানুষ যখন হিরোশিমা আমার কাছে এসেছে ঘুমপাড়ানিয়া ভয় হিসেবে। অসউইজ বা বুখেনওয়াল্ড সভ্যতার (!) অবিসংবাদিত সত্য হিসেবে। মাই-লাই জলখাবারের সাথে উত্তেজক খবরের চাটনি হিসেবে। আর একাত্তরের বাংলাদেশ- হায়! একাত্তরের বাংলাদেশ একটা দুঃস্বপ্ন, একটা স্বর্গ; একটা দীর্ঘশ্বাস! এসবের সাথে, এসবের মাঝে একেবারে একদেহে লীন হয়ে যার বাস, তার চোখ বড় সহজে ভিজে আসে না। অথচ নূরলদীন চোখ ভেজায়। অথচ নূরলদীন নিদ্রাহরণ করে। অথচ নূরলদীন এই নিñিদ্র হতাশাগ্রস্ত ভুবনে আমার প্রত্যয় হিসেবে এসে দাঁড়ায়। কেন? কারণ নূরলদীনের সারাজীবন কোনো সনাতন সংজ্ঞাবদ্ধ বীরগাথা নয়; এই বীরগাথার নায়ক তাবৎ বীরগাথার নায়কদের মতো প্রায় অতিমানবিক কোনো বীরশ্রেষ্ঠ নয়। নূরলদীনকে বড় কাছের মানুষ বলে মনে হয়। বড় বেশি চেতনাগ্রাহ্য বলে মনে হয় আর আর সব চরিত্রগুলোকে। বড় পরিচিত বলে মনে হয় ঘটনাপরম্পর। নাটকেরই সংলাপে আছে, ‘পাগল পাগল তারে বলিবে দুনিয়া’ যে সংলাপ হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত করে। আবার ‘এক এ নূরলদীন যদি চলি যায়, হাজার নূরলদীন তবে আসিবে বাংলায়’- আশায় উদ্বেলিত করে আমাদের এই রকম সব প্রাণের কথা। আবার নূরলদীনের প্রতিপক্ষকে যখন হাজির করানো হলো তার কথায় চমকে উঠে আবিষ্কার করলাম এতো আমার জানা চিরাচরিত ভিলেন নয়? এর জন্ম কেবল জন্ম থেকেই দুষ্কৃতি সাধনের জন্য নয়। এর, এই ঘৃণ্য বর্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লালিত ইংরাজেরও তো আত্মপক্ষ সমর্থনের বলিষ্ঠ যুক্তি রয়েছে। তাহলে সংঘাতটা কোথায়? সংঘাতটা শ্রেণির। নাটকেরই সংলাপে রয়েছে ‘যে করিছে শোষণ হামাক শোষণকারী তাই...আরেক জাতি হামরা হনু গরীব বলিয়াই।’ বাংলাভাষায় রচিত কোনো বীরগাথা এতখানি বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে রচিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।

...জীবন যদিও একটি সুগ্রথিত নাটক যাকে মঞ্চায়িত করা যায় ওয়েল মেড প্লে হিসেবে, এর নির্দেশনা ছিল আমার জন্যে একটি পরীক্ষা। কারণ, এর গ্রন্থনায় যে ব্যাপ্তি (ল্যাটিচ্যুড) তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সত্যিই দুষ্কর। এই নাটকের শুরু ক্লাইম্যাক্স দিয়ে। তারপর প্রায় প্রতিদৃশ্যেই লোভ হয় ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছুতে অথচ নাট্যকার তা হতে দেন না। ঘটনার মধ্যে সম্পৃক্ত কোনো এলিয়েনেশন উত্তেজনাকে প্রশমিত করে। ঘটনার যখন হচ্ছে বিস্তার, চরিত্র তখন তাঁর আত্মগত সংঘাতে পৌঁছে গেছে ঝালায়। একপক্ষ যখন ভাবাবেগ মথিত, তার প্রতিপক্ষ তখন ধীর, স্থির। যখন নূরলদীনের গণবাহিনী সম্মুখসমরের জন্য প্রস্তুত, কেবল ইংগীতের অপেক্ষায়, তখন নূরলদীনের সখা আব্বাস একান্তে দাঁড়িয়ে যুক্তি খুঁজে চলেছে, নিন্দা করছে এই হঠকারী সিদ্ধান্তের, এইভাবে এগিয়ে গেছে নাটক।

দর্শক-সমালোচকের মতামত

একের পর এক সামরিক জান্তা-দলিত বাংলাদেশের, তাবৎ অর্জন-সুকৃতি বীর্যবত্তা, ইতিহাস বিস্মৃত ঘোর এক অকাল তখন। এমতকালে নূরলদীন, নাম-না-জানা নূরলদীন, নব বীরবেশে মঞ্চে প্রবেশ করেনÑউদ্বোধিয়া তোলেন জনমানস। ‘থিয়েটার’ পত্রিকায় সে কথা বলা হয়:
নাটকের অবতারণাকালে সূত্রধার যখন বলেন, ‘আবার বাংলার বুঝি পড়ে যায় মনে/ নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়/ যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়’, তখনই দর্শক যেন জেনে যান এ কাহিনি দুইশত বৎসর আগের এক ব্যর্থ কৃষক বিদ্রোহের গাথা মাত্র নয়। যতদিন আমাদের স্বপ্ন লুট হয়ে যেতে থাকবে, কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে এবং/ অথবা দেশ ছেয়ে যাবে দালালের আলখাল্লায় ততদিন নূরলদীন বারবার ফিরে আসবে বাংলায়। কিন্তু কেবল সূত্রধারের বিরতিসুলভ বয়ানে নয়, কাহিনির অন্তর্গত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও বারংবার দর্শকের সামনে ভেসে ওঠে বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের লাঞ্ছিত নিপীড়িত দুঃখভরা বাংলার ছবি। নূরলদীন যেন কুঠিবাড়ি আক্রমণ করে নি, আঘাত করেছে ভিন্নকালে ভিন্ন পটভূমিকায় শোষণের দৃশ্যমান দৃশ্যাতীত যত রকম কুঠিবাড়ি আছে তার সব কটিকেই।

এবং রংপুরের এই লোক-আন্দোলনের নায়ক যখন তার স্বপ্নে ভাবাবেশ মেলে ধরেন আমাদের সামনে, তখন সবার অন্তরে লালিত সুখী স্বদেশের ছবি যেন আবার মৃদুমন্দ হাওয়ার ছোঁয়া পেয়ে থিরথির করে কাঁপতে শুরু করে। ‘দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ’ বলে যে দীর্ঘ সংলাপে নূরলদীন তাঁর স্বপ্নের স্বদেশের ছবি আঁকতে থাকেন, সে স্বপ্ন তো আজো আমরা বহন করে চলেছি।...পরিচালক অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবেই নাটকটিকে কোনো বিশেষকালে সীমিত রাখার চেষ্টা করেন নি; অথচ অতীত বিস্মৃত হয়ে তিনি আধুনিক পটভূমিকায়ও নূরলদীনকে উপস্থাপন করেন নি।

তানভীর মোকাম্মেল নূরুলদীনের সারাজীবন নাটকে এক দ্বন্দ্বময় প্রতিবেশ লক্ষ করেন। বীরগাথা-রহিত বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের ‘আইডেনটিটি ক্রাইসিস’ ঘুঁচাবার একটা উপায় হতে পারবে নূরলদীন- সমালোচক এতটাই মর্যাদাশীল বিবেচনা করেন নাটকটিকে:
সময়টা ১৭৮৩ সাল। এ বাংলার সেই দুঃসময় যখন সৃষ্টি পরমেশ্বরের, জমি বাদশাহর আর হুকুম কোম্পানির। সেই দুঃসময় যখন পলাশীর যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, মসনদে আছেন ইংরেজের হাত ধরে বসা কোনো নবাব। এ সেই দুঃসময় যখন কোম্পানির লাগামহীন শোষণের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মধ্য দিয়ে সবে মাত্র হেঁটে গেল দুঃখিনী বাংলা। কৃষকের অভিজ্ঞতায় এ সেই দুঃসময়, যখন সিনার উপর নীল বুনে দেয় গোরা, গলায় রশি দিয়ে খাজনা তোলে দেবী সিং। এরই ফলশ্রুতিতে রংপুরে নূরলদীনের বিদ্রোহ যা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে দিনাজপুর ও কুচবিহারে। উত্তরবঙ্গের ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ যা মেদিনীপুরের চোয়াড় বিদ্রোহের খুব কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিল নূরলদীনের বিদ্রোহ।...

যেকোনো নাটকেরই মূল ভিত্তিই দ্বন্দ্ব। সেদিক থেকে নাটক হিসেবে নূরলদীন অত্যন্ত ধনী। আছে সাদা ও কালোর দ্বন্দ্ব, আছে স্থিরমতি আব্বাস আর জনতার ভাবোচ্ছ্বাসের দ্বন্দ্ব, আছে আদর্শে মাতোয়ারা নূরলদীনের সঙ্গে বস্তুমুখী আম্বিয়ার দ্বন্দ্ব, আছে লিসবেথের দুই প্রণয়ী মরিস ও ম্যাকডোনাল্ডের দ্বন্দ্ব, আছে ‘নবাব’ ডাকে চমকে ওঠা, কৃষক-সন্তান নূরলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। তবে সব দ্বন্দ্বকে ছাপিয়ে ওঠে যে দ্বন্দ্ব, তা হচ্ছে- শ্রেণিদ্বন্দ্ব। জাতিগত দ্বন্দ্ব নয় শ্রেণিগত দ্বন্দ্বই যে আসল কথা তা কত সহজ ভাষাতেই না তুলে ধরে নূরলদীন। ‘কালায় কালা, ধলায় ধলা, উপরতলায় এক, উপরতলায় এক যে জাতি খেয়াল করি দ্যাখ, খেয়াল করি দ্যাখ রে হামার লেঙ্গুটিয়া ভাই আর এক জাতি হামরা হনু গরীব বলিয়াই’।...

একই সাথে ইংরেজ চরিত্রদের শ্রেণিগত দ্বন্দ্বটাও লেখক তুলে ধরেছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকাংশ কর্মচারীর জন্ম দরিদ্র ঘরে। ঈশ্বরবর্জিত এ বঙ্গ দেশে গোক্ষুর আর বিদ্রোহী নেটিভদের মাঝে তারাই আসে, কোম্পানির মালিক ব্যারন, ডিউক বা লর্ডেরা আসে না। আর এসব দরিদ্র কর্মচারী, যাদের দেহে নাই নীলরক্ত, তারাও স্বপ্ন দেখে ইয়র্কশায়ার কিম্বা সাসেক্সে তাদের বাড়ির আকাশে চিমনির ধোঁয়া, স্বপ্ন দেখে শৃগাল শিকার, লন্ডনের ক্লাব, প্রাসাদের কন্যার নাচে নিমন্ত্রণের অর্থাৎ অভিজাত হওয়ার। তবে যে দ্বন্দ্বটি ফুটিয়ে তুলতে নাট্যকার তীক্ষ্ণ মনোবিশ্লেষণ আর ইতিহাস সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন, তা হচ্ছে ভাবোচ্ছ্বাসী জনতার কাছ থেকে ‘নবাব’ উপাধি পাওয়া কৃষকসন্তান নূরলদীনের মনোযাতনা। তার উপর নূরলদীনের রয়েছে ‘পার্সোনালিটি কাল্ট’-এর সেই পুরনো সমস্যাটিও। তেত্রিশ কোটি দেবতার এ দেশের ‘মিথ’ তৈরি করার একটা স্বাভাবিক তাড়না আছে মানুষের। এদেশের মানুষ গণনায়কদের দেবতা বানায়।...

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’- স্বপ্ন দেখেছিল মধ্যযুগের এক কবি। বাঙালি মানসের এ এক চিরন্তন স্বপ্ন। নূরলদীনও স্বপ্ন দেখে-
...
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ
নবান্নের পিঠার সুঘ্রাণে দ্যাশ ভরি উঠিতেছে।...
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ
হামার পুত্রের হাতে ভবিষ্যৎ আছে।...
সোনার বাংলার সোনা বাংলাদেশে আছে।

এ যুগে জন্মালে আব্বাস নির্ঘাত হতো পলিটিক্যাল কমিশনার। বাস্তববাদী সে। ভাবোচ্ছ্বাসে মাতে না মোটেই। আছে তার তীক্ষè সমাজ সচেতনতা।

‘গোরার কী শক্তি আছে যদি তার সঙ্গে নাই থাকে এই দেশীয় শুয়র’। আছে সংগঠন প্রতিভা ও বিপ্লবী আশাবাদ।

ধৈর্য সবে, ধৈর্য ধরি করো আন্দোলন লাগে না লাগুক বাহে, এক দুই তিন কিম্বা কয়েক জীবন। আমাদের যাত্রাপালার ‘বিবেক’ এর ভূমিকা ছাড়াও নূরলের আবেগ তাড়নার পাশাপাশি আব্বাসের সংযত স্থিতধী ভূমিকাটি, নূরলের ‘অলটার-ইগো’ হিসেবে এনেছে এলিয়েনেশন অ্যাফেক্ট, তার বাক্যের বিদ্রুপছটা যুগিয়েছে হিউমার।...চরিত্র হিসেবে আম্বিয়া স্মরণে আনে এযুগের মধ্যবিত্ত রাজনীতিবিদদের সেই সব স্ত্রীদের কথা, যাদের বস্তুসর্বস্বতার সঙ্গে স্বামীর বিত্তহীন আদর্শবাদিতার দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত ঘটাচ্ছে স্বামী প্রবরটির আদর্শ বিচ্যুতি, যা আমাদের চারপাশে আমরা দেখি প্রায়শই।...

নাট্যকার বেশ সচেতনভাবেই ভাষার আঞ্চলিকতা, যা লোকজ ঐতিহ্যে জারিত তার ওপর জোর দিতে চেয়েছেন। রংপুরের ভাষায় আঞ্চলিকতা এ নাটকটির এক বড় সম্পদ।...

নূরলদীনের সারাজীবন হচ্ছে একটি বীরগাথা, যে রকম শৌর্যময় বীরগাথা পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই রয়েছে। আমাদের নেই, অর্থাৎ মুসলমান মধ্যবিত্তের নেই, যারা মহিলা সমিতির দর্শকের প্রায় ষোলো আনা। একটা ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এ ভোগে এ মধ্যবিত্ত। কৃষক ভোগে না। তার আছে হাজারো বছরের শোষণ, নিপীড়ন ও বিদ্রোহের ইতিহাস। নূরলদীন সে ইতিহাসেরই একটি পাতা। ‘নাগরিক’-এর এ নাটকটির এক বিশেষ সাফল্য হচ্ছে যে, তা আমাদের বাকি পাতাগুলোও খুলে দেখতে আগ্রহী করে, অনুপ্রাণিত করে।

`The Bangladesh Observer’-এর সমালোচক নাটকটির প্রতিপদে সমকালীনতা প্রত্যক্ষ করেন। দুশত বছরের একটা পর্যায়ক্রমিক সত্তাহারা তিতিক্ষা:

Syed Shamsul Huq, in selecting the life and struggle of Nuraldeen, a forgotten hero of this land, has evidently chosen a befitting subject for the creation of a contemporary classic. The elements were already there. A pervading appeal in the clarion call for uprising against the British colonialists and their cohorts. A landscape of post-famine north Bengal. A personal tragedy of a magnitude that has the intrinsic qualities reminiscent of any time-honoured tragedy. All these were there. But given the incompetence of a presumptuous playwright, the finished work could well have been reduced to a benign gibberish. That was not to be with Nuraldeen. For SSH has a penetrating pair of eyes that observe life without the trapings of despondency & a facile pen that exudes brilliance with each advancing line. ...

Nuraldeener Sharajibon (the life of Nuraldeen) is, as the name suggests, based on the life of Nuraldeen, a peasant rebel of Rangpur in 1782. He fought against the oppression of the local land-lords and by virtue of his integrity and forthright won for himself the undisputed leadership of the toiling peasants of Rangpur & the surrounding areas. Though he clearly identified the British the mentors of the local land-lords, as his prime enemies, he skillfully avoided a direct confrontation with the British for he realized that unless the quislings were uprooted a fight with the British could be devastating. His plan was immaculate and he was steadily inching towards a finality when for reasons unknown he decided to attack the British garison at Mughalhat. This battle proved fatal nuraldeen was killed alongwith a number of his compatriots.

The play of Syed Huq begins immediately after the death of Nuraldeen and through a dramatic flashback taken us to his prime. Syed Huq dedicates the first half of his play in establishing the time, the people and the events. Where each party on its own and through atleast one confrontation successfully takes us back by a couple of hundred years. And in the second half he digs deep into the inner-self of each of his major characters friends and foes alike. It is then that with an unflinching attention we discover the seeds of the characters' being.

Then there is the inner conflict of the protagonist. Is he or more accurately he is a victim of time or actions. He started off as a mere coordinator of an uprisal. But ended up being a Nawab. An imposed title that stink. A crown that hurts. A wanton bearing that smacks of expediency, cruelty and disgraced humanity. His tragedy is further aggravated when his friend Abbas hints at how ambition can destroy fortitude and destry the sense of purpose.

Through the events of Nuraldeen's life, past and present, the playwright tries to unearth the reasons behind his decision to directly involve the British in a prematured war. Is it the conflict in him of being called a Nawab & his not wanting to be one that goaded him to what transpired to be a suicidal adventure? These baffling intrigues as are wont by the playwright, bring the audience to the fore of their total commitment.

Conflicts aside the mere gusto of the events or message entwined in every line give it a contemporary relevance that is clear from the very word go. However enigmatic the personality the protagonist is not ambiguous in giving us a sense of direction that makes the history of Bengal replete with self-less sacrifices over the past two hundred years. ...

Be it as it may `Nagorik’'s Nuraldeener Sharajibon is a comprehensive work of art. A clasic well made.

কাব্যকে অক্ষুণ্ন রেখে বিদ্রোহগাথা রচনা সম্ভব, অনেকদিন পরে আবার যেন জানান দিল- দেবাশিস দাশগুপ্তের এমত মত:
শামসুল হক ইতিহাস থেকে আহরণ করে যে বিপ্লবের নাটক রচনা করেছেন সেই ধারার সঙ্গেও আমরা অপরিচিত। কাব্যকে অক্ষুণ্ন রেখেও যে বিদ্রোহের জন্য রক্তে টান ধরান যায়, সেটাও আমাদের বেশ কিছুদিন অজানা ছিল। প্রস্তাবনায় যখন ডাক দেওয়া হয় ‘আসুন আসুন তবে আজ এই প্রশস্থ প্রান্তরে/যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে/তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?/কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?’-সেই আহ্বান থেকেই আমরা একাত্ম।...এই নাটকের পূর্ববিভাগটি বিচিত্র। বিদ্রোহের নাটক শুধু যে দামামা বাজিয়েই হয় না, এই নাটক সেই শিক্ষা দেয়। প্রথম পর্ব কালের মানচিত্র, দ্বিতীয় পর্ব মনের মানচিত্র।

সাধারণত এইসব নাটকে ঘটনার ঘনঘটায় মনের ঠিকানা হারিয়ে যায়।...

শেষ দিকে একটি তানপুরায় সুর মিলিয়ে যখন নূরলদীন নতজানু হয়ে দীর্ঘ স্বস্তিবাচন করেন, তখন আমরা রোমাঞ্চিত।

দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ।
সবার অন্তরে মোর অগ্নি জ্বলিতেছে।...
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ।
হামার পুত্রের হাতে ভবিষ্যৎ আছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ।
হামার কন্যার চোখে সুস্বপন আছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ।
হামার ভাইয়ের মুখে ভাই ডাক আছে।
দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ।
হামার ভগ্নীর ঘর নিরাপদ আছে।...
সুখে দুঃখে অন্নপানে সকলেই একসাথে আছে।
সোনার বাংলার সোনা বাংলাদেশে আছে।

ওপারের এই প্রার্থনা এ পারেরও।

নবান্ন-পরবর্তী এক সার্থক গণনাটক এটি। বাংলাভাষার শক্তিমত্তার নমুনা:
ভেবেছি, বারেবারে ভেবেছি, একটি গণ-নাটকের আবেদন কেমন করে সার্থক নাট্যরস সৃষ্টির মাধ্যমে সহজ উপস্থাপনা ও জীবনধর্মী অভিনয়ের গুণে দর্শকদের হৃদয়বৃত্তির দুয়ারে পৌঁছে যেতে পারে। বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকের পর অনেক চড়াইউৎরাই ভেঙে এ বাংলার কতিপয় নাট্যগোষ্ঠী বর্তমানে যখন নিছক বুদ্ধিবৃত্তির প্যাঁচ কষাকষিতে পরিণত হয়েছে, ঠিক তখন নূরলদীনের সারাজীবন আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে সেই হারানো স্বাদ। সামন্ততন্ত্র আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেদিনের রংপুরের মাটিতে নূরলদীনের নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কৃষকের এক গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিকা এই কাব্যনাট্যটির বিষয়বস্তু।...

শেষদৃশ্যে নূরলের শান্ত বিনম্র ভঙ্গীতে বাংলা আর বাঙালির জন্যে সহজ প্রার্থনা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে দর্শকদের বুকে। এইভাবে যুগ ছাড়িয়ে যুগোত্তীর্ণ নূরলের কণ্ঠস্বর নাটকটিকে স্বার্থক করে তুলেছে।

নাটকটি সম্পর্কে শেষ কথা, বাংলাভাষা যে কত শক্তিশালী ওপার বাংলার নূরলদীনের সারাজীবন সেই সত্যটিকে এপার বাংলার মানুষের কাছে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে বারবার তুলে ধরলো। ডাইনী পূজোর ঢাক বাজান এপার বাংলার বুদ্ধিজীবীদের এক অংশ এই নাটকটি দেখলে ‘মোহভঙ্গের কালরাত্রি’ পেরিয়ে আসতে পারতেন।

আশিসতরু মুখোপাধ্যায়ের কাছে নূরলদীন উদ্বোধনের দীক্ষাদাতা, অপহৃত মূল্যবোধ যেন ফিরে পাওয়া গেল:
বিশেষ করে এমন কাব্যনাটকেও যে জীবনকে সহজ করে ধরা যায়, তার বিরল নজির রাখলেন নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক এবং নির্দেশক আলী যাকের। রিয়ালিটির সঙ্গে সঙ্গে এই কাব্যনাট্য হয়েছে লিরিক্যাল। কত কম আয়োজন। কিন্তু নাটক কত বড় মাপের। কী বক্তব্যে, কী গভীরতায়। জীবনের মূল্যবোধগুলো ফিরে পেতে আমরা নাটকে ফিরে গেছি সেই অতীত ঐতিহ্যে। নতুন করে যেন দীক্ষা নিতে চাইছি ওই অগ্নিপুরুষ নূরলদীনের কাছে, যেন নূরলদীনের মৃত্যু নেই। যদিও তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে শহিদ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই গৌরবের কাহিনি আজও বেঁচে আছে, থাকবে, যত দিন মানুষ বেঁচে থাকবে।

চিত্তরঞ্জন ঘোষ কাব্যনাটক হিসেবে নূরলদীনের সারাজীবন-এর শক্তিমত্তার কথা বলেন:
বাংলাকাব্যনাট্যে সাধারণত কাব্যের ভাগ বেশি পড়ে, নাট্যের ভাগ কম। হক সাহেবের চেষ্টা সমতা আনবার। বাংলাকাব্যনাট্যে ‘সারফেস’ রিয়ালিটি লুপ্ত করে দিয়ে একেবারে ভেতরের শাঁসটুকুকে আনার প্রয়াস থাকে। তাতে ‘বিশেষ’ বা ‘ব্যক্তিক’ চরিত্র লুপ্ত হয়ে সাধারণ একটা সত্য নিরবয়ব বা নিরক্তভাবে দেখা দেয়। অথবা কথার প্রেমে অন্ধ কবি কথা একটু বেশি বলেন, এসব হক সাহেবের একটুও নেই তা নয়। তবু অনেক কম। জন-ঘনিষ্ঠ আঞ্চলিক ভাষার শক্তিকে তিনি কাজে লাগাচ্ছেন, এই পরীক্ষাও বিশেষ প্রশংসনীয়।

নবাব-পীড়িত চাষিকুলের নিকট প্রতিরোধকারী নূরলদীনও হয়ে ওঠে নবাব- এই নিয়ে তাঁর যে মানসিক সংকট ঘটে সেটা নতুন মাত্রা দেয় নাটকে। অমৃতবাজার পত্রিকা-র সমালোচকের এই হলো ভাষ্য:
Nuraldin fought against the native agents of the East India Company for its exploitation and genocide. He was elected not only the leader, but was given the title on `Nawab’ by his followers. The play also touched upon Nuraldin's emotional and political crisis after being called 'Nawab' as he himself was the worst victim of the oppression and exploitation by the Nawabs, landlords and money lenders. This crisis developed into a tense dramatic sequence which added a new dimension to the play.

অতীতের বীরপ্রবর রচনা করেন ভবিষ্যতকেও- সমাজরাজনৈতিক এই নাটক নবধারার সূচনা করল রামেশচন্দ্রের এমত মত:
The playwright Syed Shamsul Huq, who has already made a mark as a poet and novelist enfolds not only Nuraldin's life but what is more important highlights the role of the people in the fight against the exploiters and their allies. By reminding the nation of its past heroes the playwright shows the way to build the future. But on the whole this was indeed a most welcome production for it shows a new direction in sociopolitical theatre in Bangladesh of which we were not aware.

ইতিহাসের জাতীয় এক বীরের উজ্জ্বল উদ্ধার হিসেবে নূরলদীনের সারাজীবন নানা অবস্থান থেকে বহুনন্দিত।

ড. বিপ্লব বালা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, সমালোচক