Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: এখনও ক্রীতদাস
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: এখনও ক্রীতদাস। রচনা ও নির্দেশনা: আবদুল্লাহ আল-মামুন। মঞ্চ ও আলোকপরিকল্পনা: কামরুজ্জামান রুনু। আবহসংগীতপরিকল্পনা: আনিসুর রহমান। রূপসজ্জা: আবদুস সালাম। পোস্টার ডিজাইন: মাহবুব আকন্দ। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৮৩। একটি ‘থিয়েটার’ প্রযোজনা
[ঢাকার থিয়েটার কলকাতায়- শিরোনামে নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন বিষ্ণু বসু। কলকাতার ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায় ১৯৮৬ সালে এটি ছাপা হয়। ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
কলকাতা তখন জলে ভাসছে। ১৯৮৬-এর সেপ্টেম্বরের আচমকা বন্যা সারা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কলকাতাকেও করে তুলেছে বানভাসি। আর ঠিক সে সময়েই ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপে’র আমন্ত্রণে, এখানে অভিনয়ের জন্য উপস্থিত হয়েছিল বাংলাদেশের অগ্রণী নাট্যদল ‘থিয়েটার’। প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে, এমনকি অভিনয়-স্থান পালটেও তাঁরা উপস্থাপিত করলেন দুটি নাটক এখনও ক্রীতদাস ও পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। সংস্থার সাম্প্রতিক প্রযোজনা বলে প্রথম নাটকটি নিয়ে এখানে খানিক আলোচনা করা হচ্ছে। এখনও ক্রীতদাস রচনা ও পরিচালনা করেছেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। প্রধান ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন তিনি। আল-মামুন সাহেব কমিটেড থিয়েটারে বিশ্বাসী। স্বাধীনরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের পর থেকে সেদেশের শ্রেণিসমূহের মধ্যে অবস্থানের যে বিপর্যয় ক্রমাগত ঘটে চলেছে, তার নানা ফাঁক-ফোঁকরের উপর সন্ধানী আলো ফেলে চলেছেন তিনি। কিন্তু সে আলো, স্বীকার করতেই হয় সত্যের খাতিরে, মোটামুটি একপেশে ও সাদামাটা। অন্তত এখনও ক্রীতদাস-এ ত বটেই। আসলে এখনও ক্রীতদাস-এর জোরের জায়গা তার নাটকত্বে তেমন নয়, যতটা প্রযোজনায়। বিশেষ করে অভিনয়ে।
স্বাধীনতা কোন শ্রেণির মানুষকে জুগিয়েছে বিলাস ও আড়ম্বর এবং কাদেরইবা ঠেলে দেওয়া হয়েছে বস্তির অন্ধকারে, তার একটা বিশ্বাসযোগ্য চেহারা অবশ্য নাটকে আছে। কিন্তু সমাজে দুটি শ্রেণির অবস্থানের তারতম্য আমাদের অভিজ্ঞতায় ত অপরিজ্ঞাত নয়, তার জন্য স্বাধীনতার স্বতন্ত্র ভূমিকা তেমন থাকে না। তথাকথিত স্বাধীনতার উপস্থিতি খানিক জ¦ালা বাড়িয়ে দেয় মাত্র। যে রাজনৈতিক-স্বাধীনতা অর্থনৈতিক সমতাকে স্বীকার করে না, বরং সাহায্য করে তাকে বাড়িয়ে তুলতেই, তার প্রতি শুধু মোহমুক্তির রূপায়ণ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে দুবাংলার বহু নাটকে। এখনও ক্রীতদাস তাদের মধ্যে একটি সংযোজন মাত্র। বাক্কা মিঞা আজাদির লড়াইতে পা হারিয়েছিল নিতান্তই পাকেচক্রে, সক্রিয় সংগ্রমে সে ছিল না। তবু বস্তিবাস তার পক্ষে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল জীবিকা থেকে বিচ্যুত হয়ে। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে বস্তি একটা বাস্তব ব্যাপার, তার জন্য স্বাধীনতার আলাদা ভূমিকা নেই কোনো। এবং নাটকে অতঃপর যা কিছু ঘটেছে তা ত বস্তিজীবনের শর্ত মেনেই। তার ফলে, প্রায় নিয়মমাফিকই যেন কান্দুনী নিযুক্ত হয়েছে ঝি-গিরি তে, তাকে বাগে আনবার চেষ্টা করেছে রিক্সাওয়ালা হারেস আলী, সিনেমার এক্সট্রা হবার লোভে ধর্ষিতা হয়েছে তার মেয়ে মর্জিনা। এবং সর্র্বোপরি নিয়তির মতো হাজির থেকেছে নারী-ব্যবসায়ী কাজী আবদুল মালেক। এসবের যোগফলে ক্রম-বিপর্যয় নাটকে তাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিয়েছে। অতএব, প্রায় জ্যামিতিক অনিবার্যতায় ঘটেছে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ, আপাত কলহের মধ্যেও পরস্পরের মধ্যে বিরাজ করছিল যে সম্প্রীতি, তার ভাঙন ঘটেছে এবং বাক্কা মিঞা নিহত হয়েছে সামাজিক দস্যুদের হাতে, যাদের প্রতিভূ কাজী সাহেব। তবু তার মধ্যেও, নাট্যকারের অভিপ্রায়কে প্রকাশ করতেই, স্বপ্ন দেখেছে নিজের পঙ্গুত্ব অতিক্রম করে প্রবল প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করার। এভাবেই নাট্যকার প্রকাশ করতে চেয়েছেন তাঁর দায়বদ্ধতাকে।
বরং নাট্যকার জোর ধাক্কা দিয়েছেন অন্য একটি জায়গায়। শরিয়তি শাসনে ‘তিন তালাক’ কীভাবে যৌথ জীবনে আনতে পারে বিপর্যয় এবং তার ফলে স্বামী-স্ত্রীকে ঠেলে দিতে পারে গভীরতর অন্ধকারের দিকে, তার বিরুদ্ধেও যেন ধিক্কার ধ্বনিত হয়েছে এ নাটকে। অবশ্য দীর্ঘকাল আগে মুনীর চৌধুরী তাঁর মানুষের জন্য গল্পে ফেটে পড়েছিলেন যে তিরস্কারে, তেমন তীব্রতা হয়ত নেই এ নাটকে, তবু যখন শরিয়তি শাসন নিয়ে দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন, সে প্রেক্ষিতে নাট্যকারের এ উপস্থাপনার অস্তিত্ববাদী দিকটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাই, ‘বাবা, মুখের একখান কতায় সব শ্যাষ হইয়া যায়?’- মর্জিনার এ সংলাপের অভিঘাত যেন কিছুতেই মিলিয়ে যেতে চায় না।
পুরো প্রযোজনার মধ্যেই ছিল যেন একটু বেশি মাত্রায় নাটুকেপনার চিহ্ন। মঞ্চের বস্তি, দুপাশে ঝোপড়ি, মাঝে বাক্কা মিঞার খাটিয়া, পিছনে আপস্টেজের উঁচু পাটাতন; সবকিছুর মধ্যেই ছিল খানিক থিয়েটারি গন্ধ। অবশ্য নাটকের সঙ্গে মানিয়েও গিয়েছিল তা। অনেকের অভিনয়ের মধ্যেও ছিল এই চড়ামাত্রার টান। বিশেষ করে কাজী আবদুল মালেকের। আবদুল কাদের অবশ্য এ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দাপটে, তবে চরিত্রটির একমাত্রিক ঝোঁকের সাহায্য তিনি পেয়েছেন অবশ্যই। তারিক আনাম খানের রিক্সাওয়ালাও মানানসই, যেমন চোখে পড়ে মর্জিনার ভূমিকায় নাহিদ রেজা রুমুকে। এ চড়া সুরের মধ্যে বাক্কা মিঞার ভূমিকায় নাট্যকার-নির্দেশক আবদুল্লাহ আল-মামুন সাহেব আগাগোড়া একটি আশ্চর্য নিচু পর্দায় অভিনয় করে গেছেন। তাঁর স্বরক্ষেপণের সংযম ও গভীরতা প্রযোজনায় আলাদা মাত্রা এনে দেয় অবশ্যই। কিন্তু অভিনয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন কান্দুরীর ভূমিকায় ফেরদৌসী মজুমদার। সারা মঞ্চ অনায়াসে দখল করে দাপুটে এমন অভিনয় কলকাতার মঞ্চে ইদানীং প্রায় দেখাই যায় না। যদিও চেহারায় তাঁকে বস্তিবাসী বলে কষ্ট হচ্ছিল মেনে নিতে, তবুও আবেগে-অনুরাগে, ক্রোধে-ধিক্কারে তাঁর অভিব্যক্তি যেন আছড়ে পড়ছিল দর্শকের চেতনার উপরে।
আবহসংগীত ভালোই, যেমন মানানসই কাওয়ালি গানটি। শুধু শেষের গানটির উপস্থাপনাকে মনে হচ্ছিল ক্লিশে বলে। আলেকসম্পাত যথাযথ, যদিও মাঝে মাঝে চলমান ট্রেনের আলোকপ্রক্ষেপণের মধ্যেও ধরা পড়ছিল খানিক থিয়েট্রিক্যালিটি। তবে একথাও ঠিক যে, চলমান ট্রেনের আলো নাটকে পেয়ে যাচ্ছিল একটি আলাদা তাৎপর্য। বস্তিবাসীদের পঙ্গুজীবনে (বাক্কা মিঞা) যেখানে রিক্সাই (হারেস আলীর গাড়ি) কিঞ্চিৎ উচাটন করে তোলে কান্দুনীদের, সেখানে ইলেকট্রিক ট্রেনের আধুনিকতা ও স্বচ্ছল জীবনযাত্রার প্রতিভাস নাটকে একটি গভীর অর্থ বহন করে আনে। এ ট্রেন তার সমস্ত আলো ও গতি নিয়ে ছুটে চলে বস্তিবাসীদের নাগালের বাইরে দিয়ে, শুধু সেখান থেকে ছুঁয়ে আসা ক্ষণিক আলোকসম্পাত বস্তিবাসীদের আরো তীব্রভাবে মনে করিয়ে দেয় যে, তারা এখনও ক্রীতদাস।
বিষ্ণ বসু: নাট্যসমালোচক, কলকাতা