Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: ম্যাকবেথ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: ম্যাকবেথ। মূলরচনা: উইলিয়াম শেক্সপীয়র। অনুবাদ: সৈয়দ শামসুল হক। নির্দেশনা: ক্রিস্টোফার স্যান্ডফোর্ড। মঞ্চপরিকল্পনা: কিম উহচার। আলো-আবহসংগীতপরিকল্পনা: হাওয়ার্ড হ্যারিসন। রূপসজ্জা: বঙ্গজীৎ দত্ত। পোস্টার ডিজাইন: মাহবুব আকন্দ। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৮৩। একটি ‘নাগরিক ও থিয়েটার’ যৌথ-প্রযোজনা
[‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ ও ‘থিয়েটার’-এর যৌথ-প্রযোজনা ম্যাকবেথ-এর কোনো নাট্যসমালোচনা পাওয়া যায় নি। ‘থিয়েটারওয়ালা’র বিশেষ অনুরোধে এই প্রযোজনা নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় স্মৃতিচারণটি প্রকাশ করা হলো]
যাঁরা নাগরিক ও থিয়েটারের যৌথ-প্রযোজনা ম্যাকবেথ দেখেছেন, তাঁরা সকলেই স্বীকার করবেন, প্রযোজনাটি আমাদের নাট্যচর্চায় একটা মাইলফলক হয়ে আছে। ১৯৭৮ সালে বৃটিশ কাউন্সিল কয়েকটি নাট্যপ্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করে। তখনই একটা পূর্ণাঙ্গ নাটক প্রযোজনার প্রসঙ্গ ওঠে। পরবর্তীকালে আমরা শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ করার প্রস্তাব দিই। বৃটিশ কাউন্সিল ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ ও ‘থিয়েটার’কে বেছে নেয় যৌথ-প্রযোজনার জন্যে। সৈয়দ শামসুল হক-কে অনুরোধ করা হয় নাটকটি অনুবাদ করে দিতে, কারণ, আমাদের মনে হয়েছিল এ কাজের জন্যে তিনিই হবেন সর্বোত্তম ব্যক্তি। বৃটিশ কাউন্সিল উপযুক্ত সম্মানীর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর সাথে একটা চুক্তি করে ফেলে।
প্রথমে কথা ছিল বৃটিশ নির্দেশক রজার ক্রাউচার নাটকটি পরিচালনা করবেন। তিনি এখানে কর্মশালাও করেছিলেন। প্রথম-দফায় তিনি ম্যাকবেথ চরিত্রের জন্যে আলী যাকের ও লেডি ম্যাকবেথের জন্যে ফেরদৌসী মজুমদারকে নির্বাচন করে যান। পেশাগত কারণে পরে তাঁর পক্ষে ম্যাকবেথ পরিচালনা করা সম্ভব হয় নি, তাঁরই পরামর্শে বৃটিশ কাউন্সিল ক্রিস্টোফার স্যান্ডফোর্ডকে নিয়ে আসে।
ক্রিস্টোফার বাংলাদেশে দেড় মাসের মতো ছিলেন। থাকতেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। আমি আর আসাদুজ্জামান নূর দ্রুত তাঁকে চরিত্র নির্বাচনে সহায়তা করলাম। নূর ছিলেন সহকারী নির্দেশক, আমি প্রযোজনা সমন্বয়কারী। আমরা আমাদের দুই দলের প্রধান প্রধান অভিনেতাদের বিবেচনায় আনলাম। যাকের-ফেরদৌসী ছাড়াও অভিনয় করেছিলেন মোহাম্মদ জাকারিয়া, আবুল হায়াত, আতাউর রহমান, খায়রুল আলম সবুজ, তারিক আনাম খান, সারা যাকের, নিমা রহমান, রেখা আহমেদ, জামালউদ্দিন হোসেন, ইনামুল হক, লাকী ইনাম, ঝুনা চৌধুরী প্রমুখ। উল্লেখ্য এ নাটকের মাধ্যমেই তারিক-নিমার প্রেম হয় এবং পরবর্তীসময়ে বিয়ে। দুই দলের অন্যরকম মিলন। আমাদের আবদুল্লাহ আল-মামুন ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে এ নাটকে অভিনয় করেন নি।
ক্রিস্টোফার স্যান্ডফোর্ড মহড়ার একটা সূচি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সবাইকে সবদিন একসাথে আসতে হতো না। কে কোন দিন কোন সময়ে মহড়ায় যোগ দেবেন, ঠিক করে দেয়া হতো। এটা আমাদের কাছে বেশ নতুন লেগেছিল। মহড়া বৃটিশ কাউন্সিল মঞ্চেই হতো।
আমরা নির্দেশকের জন্যে একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করে দিয়েছিলাম। তাতে বাম দিকে থাকত ইংরেজি টেক্সট আর ডান পাতায় বাংলা অনুবাদ। ফলে তিনি বুঝতে পারতেন, অভিনেতা কোন সংলাপ বলছে। প্রয়োজনে অভিব্যক্তি নিয়ে তাঁর প্রত্যাশার কথা বলতেন।
আলো ও শব্দ পরিকল্পনার জন্যে শেষের দিকে এসেছিলেন হাওয়ার্ড হ্যারিসন। কালো কয়েকটি উইং, আলো আর শব্দের উদ্ভাবনী ব্যবহারে বৃটিশ কাউন্সিলের ছোট মঞ্চটিতে এমন ডেপথ্ তৈরি হয়েছিল যা আমরা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারি নি। একটি পেশাদারি প্রযোজনা আস্তে আস্তে কীভাবে গড়ে ওঠে, তা ম্যাকবেথ থেকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বৃটিশ কাউন্সিল যদিও প্রযোজনার সিংহভাগ ব্যয় বহন করেছিল, বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানি এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল।
আলো ও শব্দে সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন সৈয়দ লুৎফর রহমান ও কে বি আল আজাদ, ডিজাইনে কিম উহচারের সহযোগী ছিলেন তারিক আনাম খান ও সারা যাকের (পোশাক), কামরুজ্জামান রুনু (মঞ্চ) এবং কামালুদ্দিন নীলু (প্রপস্)। রূপসজ্জাকর ছিলেন বঙ্গজিৎ দত্ত। লাইভ ড্রাম বাজাতেন মনসুর আহমেদ। মুখোশ তৈরি করেছিলেন সাইদুল ও নজরুল ইসলাম অপু।
নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩। মোট প্রদর্শনী সংখ্যা ২৯। কলকাতায়ও নান্দীকারের জাতীয় নাট্য উৎসবে নাটকটি আমরা অভিনয় করেছিলাম। দুটো দলের প্রযোজনা হওয়াতে পরবর্তীকালে অভিনয়ের তারিখ নির্ধারণ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে, যার জন্যে নাটকটি আমরা বেশি অভিনয় করতে পারি নি। তারপর থেকে আমি বলে এসেছি যে, বিদেশি নির্দেশক এলে, একটি দলের সাথেই কাজ করা উচিত। তাহলে দলটি প্রযোজনাটিকে নিজস্ব মনে করবে।
থিয়েটারের জন্যে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যখন বৃটিশ কাউন্সিল এ প্রযোজনার সিদ্ধান্ত প্রচার করে। আরিফুল হক-তবিবুল ইসলাম বাবুদের নেতৃত্বাধীন আমাদের ভাগ হয়ে যাওয়া দল বৃটিশ কাউন্সিলকে উকিল নোটিশ পাঠায় যে, ‘থিয়েটার’ বলতে তাদেরকেই বোঝায়, তাই আমাদের সাথে যেন কাজ না করা হয়। বৃটিশ কাউন্সিল তাদের আইন উপদেষ্টাকে দিয়ে নোটিশের জবাব দিলে, এ নিয়ে আর জলঘোলা হয় নি।
অভিনয়ে এত উঁচুমানের দলগত অভিনয় পরে আর কোনো নাটকে দেখি নি। তাই এখন যখন এ নাটকের নতুন প্রযোজনা দেখি, তখন বড় অস্বস্তি বোধ করি। সৈয়দ হকের কাব্যিক সংলাপগুলো অভিনেতারা যেভাবে বলেছেন, সেটাই কানে বাজে। অনুবাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। শেক্সপীয়রের সংলাপের ওজস্বিতা পুরোপুরি রক্ষিত হয়েছে অনুবাদে। তৎসম শব্দ প্রচুর ব্যবহৃত হলেও সংলাপ উচ্চারণে তা কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। মুনীর চৌধুরী যেমন অমর হয়ে আছেন টেমিং অব দ্য শ্রু-র অনুবাদে, তেমনি ম্যাকবেথ ও টেম্পেস্টের অনুবাদ সৈয়দ শামসুল হক-কে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
রামেন্দু মজুমদার ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যব্যক্তিত্ব