Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: কেরামতমঙ্গল
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: কেরামতমঙ্গল। রচনা: সেলিম আল দীন।। নির্দেশনা: নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মঞ্চ ও আলোকপরিকল্পনা: সৈয়দ জামিল আহমেদ। পোশাকপরিকল্পনা: শিমূল ইউসুফ ও রেজাউল হায়দার। আবহসংগীতপরিকল্পনা: শিমূল ইউসুফ ও লীনু বিল্লাহ। পোস্টার ডিজাইন: আফজাল হোসেন। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৮৫। একটি ‘ঢাকা থিয়েটার’ প্রযোজনা
[কেরামতমঙ্গল নাটক নিয়ে গবেষণাধর্মী নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন বিপ্লব বালা। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ১৫তম সংখ্যায় (২০০৫ এ প্রকাশিত) এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
‘ঢাকা থিয়েটার’ প্রকাশিত স্যুভেনিরে কেরামতমঙ্গল সম্বন্ধে বলা হয়েছে:
সাম্প্রতিক প্রযোজনা কেরামতমঙ্গল-এর পটভূমি অধিকতর বিস্তৃত। এর কাহিনি ও চরিত্র ব্যাপ্তির দিক থেকে সমান্তরাল। নাটকের ব্যাপক পটভূমিতে পথিক কেরামত জীবনের কষ্ট দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে শেষ অবধি প্রায় যিশুর কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ক্রুশবিদ্ধ যিশু ফিরে আসেন নি, কিন্তু অন্ধ এবং পরিণত কেরামত শেষ গণ্ডির উদ্দেশে যাত্রা করে। হয়ত সেখানে শুধু দোজখের কপিশবর্ণ অগ্নিময় অন্ধকার। অভিজ্ঞতায় প্রৌঢ় কেরামত কাহিনির ব্যাপ্তিকেও অনেক স্থানে অতিক্রম করেছে। অথচ কেরামত এদেশেরই সাধারণ মানুষ। লোকজবৈশিষ্ট্য তার মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে তাকে জাতীয় চরিত্রের মর্যাদা দিয়েছে। কিত্তনখোলার ভাষা ও অভিনয়রীতির সঙ্গে কেরামতমঙ্গল নাটকে যোগ হয়েছে লোকজজীবনের বিস্তৃৃত জীবন-ভাষ্য। হিন্দু, মুসলমান, গারো, হাজং, ক্যাথলিক খ্রিস্টান, মুনি, ঋষি, হিজড়া, জমিদার, জেলে, মাঝি, জেল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর অবক্ষয় প্রভৃতি অজস্র জাতি, উপজাতি, ধর্ম, মানুষ ও প্রসঙ্গ নিয়ে গড়ে উঠেছে নাটকটির বিশাল আখ্যানভাগ। এর সাথে লোকজউপাখ্যান, উপকথা, কিংবদন্তীর সমন্বয় ঘটেছে। লোকজভাষার দক্ষ প্রয়োগে নাটকটি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে একটি পুরো ভূখ-ের অধিবাসীদের জীবনচিত্রকে তুলে ধরতে পেরেছে। আঞ্চলিকভাষার চরম সংবেদনশীলতা এখানে পরীক্ষিত সত্য। লোকজভাষা-ভঙ্গীর প্রধান বৈশিষ্ট্য তার অন্তর্র্নিহিত সুরতরঙ্গ ও গতিশীলতা। এই দুটি গুণের সমন্বয়ে কেরামতমঙ্গলর ভাষার স্থিতিস্থাপকতা বেড়েছে।
দর্শক-সমালোচকের মতামত
সমালোচনায় এই ব্যাপ্তির কথা উঠে আসেÑদীর্ঘ কালপর্বে নানা জনজীবনখ- রূপায়িত হয় নাট্যে। সেই সঙ্গে বিচিত্র উপকথা কিংবদন্তী উপাখ্যান, জাতি-ধর্ম সমন্বিত জনগোষ্ঠীর জীবনসমগ্রতা বিন্যন্ত হয়েছে। নাট্যরীতিতেও মহাকাব্যিকরীতি ইউরোপীয় একটিমাত্র ঘটনাবৃত্তের একক-বিকাশের পরিবর্তে প্রতিটি অখ- চলচ্ছবিমণ্ডিত। ভিন্ন আঙ্গিকের সঙ্গে সম্পর্কিত:
বাংলানাটকের কাহিনি বহু ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল যাবৎ পঞ্চাঙ্করীতির ভয়াবহ অনুবর্তনে ক্লিষ্ট। কিন্তু কেরামতমঙ্গল নাটকে মধ্যযুগীয় বাংলানাট্যআঙ্গিক ও সমৃদ্ধ উপাখ্যানের ধারা একীভূত। এই নাটকের বিষয়বস্তুর কোনো তুলনা আধুনিক বাংলানাটকে নেই। শুধু মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের বিস্তৃত কাহিনির সঙ্গে অংশত তুলনা চলে। মঙ্গলকাব্যও তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষিতে লিখিত হয়েছে। মানুষের মঙ্গল কামনায় দেবতার জয়গান মঙ্গলকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কেরামতমঙ্গল নাটকের দেবতা আদম সুরত। কেরামতকে পথের নিশানা দেয়। দশরথ তার অব্যক্ত কথা নেশার ঘোরে আদম সুরতকে শোনায়। অনেকটা দেবীর কাছে (চণ্ডীমঙ্গল) নির্যাতিত পশুসমাজের আর্তনাদের প্রতিধ্বণিত আধুনিক রূপায়ণ যেন। কেরামতমঙ্গল নাটকটি উপখ-সহ মোট এগারোটি খ-ে বিভক্ত এবং বৃত্তপরিকল্পনায় রচিত। আমরা এতে ইউরোপীয় নাটকের ঘটনা সংঘাতের রীতি থেকে কিত্তনখোলার মতোই একটি ভিন্ন আবহ পাই। প্রতিটি কাহিনি আলাদা বৈশিষ্ট্যের হলেও ঘটনা ও কালগত ঐক্য বর্তমান। কেরামতের জন্ম থেকে অন্ধত্ব পর্যন্ত প্রায় সমগ্র জীবনকাহিনি এতে বিবৃত হয়েছে। ১৯৪৬ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপরবর্তীজনপদের মূল্যবোধের অবক্ষয়কাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে কেরামতমঙ্গল-এ। পান্থজন কেরামতের চোখে দেখে ক্লিষ্ট ক্রুর জীবন দোজখ একের পর এক। এ জীবনের শেষ কোথায়? কোথায় সত্য, মানুষের মঙ্গল? এগারো গণ্ডি, এগারোটি দোজখ অতিক্রম করেছে সে।
সমগ্র নাটকের মধ্যে যে হতাশা, বঞ্চনা, অস্থিরতা, মৃত্যুর চিত্র দেখা যায়, খুব ক্ষীণ হলেও ‘একটি মাত্র ভ্রুণের মধ্য দিয়ে জীবনের অনন্ত সম্ভাবনাকে’ নাট্যকার ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। নাটক শেষে সরাসরি মহাকবির মতো অনিবর্চনীয় বাক্যে নাট্যকার সামাজিকগণের কাছে মানবমঙ্গল আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে:
ক।।
কেরামতমঙ্গল নাটকের সমাপ্তি এখানেই। সুপ্রিয় দর্শকমণ্ডলী, এই নাটক দর্শনে সামাজিকগণের কল্যাণ হোক। পুণ্য হোক। যে এই নাটক দেখে, সামাজিকমঙ্গল সাধনে সে যেন তৎপর হয়। অন্যায় অবিচার শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। যে এই নাটক দেখে সে যেন শমলার অপরিপুষ্টভ্রুণের নিরাপত্তা বিধান করে। পৃথিবীর সমস্ত ভ্রুণের জন্য যেন সে মমতার হাত বাড়ায়। এই নাটক দর্শনে বন্ধ্যানারী যেন ফলবতী হয়।
খ।।
এই নাটকের রচয়িতা কোরানের দোজখ বর্ণনাকে তার অতুলনীয় ভয়াবহ চিত্রকল্পের স্রষ্টাকে প্রণাম জানায়। এই নাটকের রচয়িতা আভূমি প্রণাম জানায় বাংলাকাব্যের মধ্যযুগের মহান কবিদের। এই নাটকের রচয়িতা মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গলের কবিদের প্রণাম করে। এই নাটকের রচয়িতা সন্তকবি দান্তেকে প্রণাম জানায়। এই নাটকের রচয়িতা যিশুর ক্রুশকাঠকে প্রণাম জানায়। ইতি। কেরামতমঙ্গল নাটক।
এই নাটকের প্রতিটি খণ্ড-পরিচয় নাটকের ব্যাপ্তি-বৈচিত্র্যকে স্পষ্টতা দেয়:
এক।। সাম্প্রদায়িকতার দোজখ, নখলা খণ্ড: কেরামতের পরিচয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মুসলমান তালুকদার আর হিন্দু মহাজনের অত্যাচার, বহু মানুষের মৃত্যু, অতঃপর ঘরছাড়া হলো কেরামত।
দুই।। উন্মূল মানুষের দোজখ, চন্দ্রকোণা খণ্ড: খালার বাড়িতে নিরাশ্রয় কেরামতের আশ্রয় গ্রহণ, খালাতো বোন নওশাদীর ভ্রুণ বিনষ্টি, অভিজাতমানুষেরা মুচিদের অচ্ছুত ভেবে উচ্ছেদ করে, আবার কেরামত আশ্রয়চ্যুত হলো।
তিন।। সামন্তবাদীদের সৃষ্ট দোজখে জমিদার-প্রজা সবাই দগ্ধ, ফইট্যামারী খণ্ড: কলকাতা প্রবাসী জমিদার চুনু মিয়ার গ্রামে আগমন, জমিদারীর শেষ-অবস্থা, জমিদারদর্শনাকাক্সক্ষী কেরামত নির্যাতিত হয়, তৃতীয়বার পথে নামলো কেরামত।
চার।। জন্ম ও সমাজবঞ্চনার দোজখ, হিজড়া খণ্ড: হিজড়াকে মেয়ে ভ্রম করে কেরামতের চোখ আবিষ্কার করে জন্ম ও সমাজবঞ্চনার কষ্টে করুণ অন্ধকারের রূপ। আশাভঙ্গকেরামত নতুন করে বাঁচবে বলে যাত্রা করে হাজং দেশের উদ্দেশে, তার ভাষায় ইছামতীর দেশ।
পাঁচ।। প্রতিবাদী যোদ্ধাদের দোজখ, হাজং খণ্ড: পাকিস্তানিদের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে বিদ্রোহী-হাজংদের দেশে আসে কেরামত, অজস্র মৃত্যু ও ভ্রƒণ বিনষ্টির সংবাদ, হাজং-বিদ্রোহীদের সহযোগী হিসেবে কেরামত পাকিস্তানি পুলিশের হাতে ধৃত হয়।
ছয়।। হাজত দোজখ, হাজত খণ্ড: হাজংবিদ্রোহে ধৃত হয়ে বিনাবিচারে কেরামতের আট বছর হাজতবাস, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র, আজমত ডাক্তার নামে এক হাজতবাসীর সঙ্গে পরিচয়, কেরামতের মুক্তি লাভ এবং গারোদের দেশ চিগাস্তানের উদ্দেশে যাত্রা।
সাত।। মিশনারীদের সৃষ্ট দোজখ। চিগাস্তান খণ্ড: গারোদের আদিমধর্মমত ও ক্যাথলিক খ্রিস্টানধর্মের সঙ্গে বিরোধ, মিশনারিদের অভ্যন্তরীণ রূপ, মৃত্যু, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের উত্তেজনা, কেরামতের আরেক গ-িতে যাত্রা।
আট।। রাষ্ট্রীয় মৌলবাদীদের সৃষ্ট দোজখ, রাজাকার খণ্ড: স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের ক্যাম্পে বন্দি কেরামতের গলা কাটার হুকুম। স্বাধীনতা লাভ, রাজাকারদের রূপ। স্বাধীনতার পর যন্ত্রণার সুড়ঙ্গপথে কেরামতের উপলব্ধি।
নয়।। যুদ্ধোত্তর-বাংলাদেশের মানুষদের আশাভঙ্গের দোজখ ক. জলসুখা খণ্ড খ. বিবাহ খণ্ড: স্বাধীনতা-উত্তর অস্থিরতা, হত্যা, রাহাজানি, বীরাঙ্গনাদের চিত্র; ধর্ষিতা বীরাঙ্গনা নূরজাহানের সঙ্গে কেরামতের বিয়ে, নববধূর বাসরসজ্জায় মৃত্যু, ভ্রুণ বিনষ্টি, স্ত্রীর লাশ নিয়ে নৌকাযোগে কেরামতের কুসুমপুর যাত্রা।
দশ।। আত্মদগ্ধমানুষের আশাভঙ্গের দোজখ, কুসুমপুর খণ্ড।
এগারো।। সামাজিক-বোধ-রহিত দুই মাসুম- শমলা ও বসিরের সহবাস এবং উন্মত্তমানুষজন কর্তৃক কেরামতের যিশুতুল্য পরিণতি।
শহীদ ইকবাল এনাম সমালোচনায় জানায়, খণ্ডে খণ্ডে কেরামত দেখে যেতে থাকে বিড়ম্বিত স্বদেশের নিদারুণ অভিজ্ঞতারাজি:
কেরামতের মতো সাধারণ মানুষেরা দেখে উঁচুস্তরের-লোকদের চক্রান্ত, হিন্দু-মুসলিম হানাহানি। দেখে স্বজাতির দ্বারা বোন-ধর্ষণ, সুবিধাভোগীমহলের পাঁয়তারা। দেখে প্রকৃতির হাতে সৃষ্ট অসহায় হিজড়া সম্প্রদায়কে এবং সেই সাথে মশালের মতো জ্বলজ্বলে উপজাতিবিদ্রোহ এবং স্বাধীন হয়েও পরাধীনতা ভোগ করা। কেরামতরা নীরব সাক্ষী নোলকহারা নির্যাতিত শমলার, রায়টে সর্বহারা দশরথের, যে কেঁদে কেঁদে গেয়ে বেড়ায়Ñ‘বুকের মধ্যে বিচ্ছেদের শোক আর উচ্ছেদের কষ্ট’। কেরামতরা দেখে পবিত্র নওশাদীকে অপবিত্র হতে এবং ভ্রুণ নষ্ট করতে। এক সময় কেরামতও জ্বলে ওঠে। তার শক্তি আর ভক্তির প্রতীক আদম সুরতকে তাই চিৎকার করে বলে, ‘এত দুঃখ যে সংসারে, সে সংসারে আমি আগুন লাগায়া দিমু’। কিন্তু কেরামত অনেকের মতোই পারে না। এক সময় নিজেই ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতো অন্ধত্ববরণ করে, লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে আসে তার নিজ গ্রামে।
এগারটি খণ্ডে কেরামত লাঞ্ছিত, বঞ্চিত আর নির্যাতিত হয়ে যেন এগারটি দোজখ অতিক্রম করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কোথায় এ জীবনের সমাপ্তি?
বিশিষ্ট নির্দেশক আতাউর রহমান সংক্ষিপ্তভাবেও নাটকটির চরিত্র বিচার করেন একই ধরনে:
সারা নাটক জুড়ে মহাকাব্যের একটা আবহ বিরাজ করে। হিন্দু-মুসলমান, গারো, হাজং, ক্যাথলিক খ্রিস্টান, মুনি-ঋষি, হিজড়া, জমিদার, জেলে-মাঝি, জেল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর অবক্ষয় অজস্র জাতি উপজাতি ধর্ম মানুষ ও প্রসঙ্গ নিয়ে গড়ে উঠেছে নাটকটির বিশাল আখ্যানভাগ। এর সাথে লোকজ উপাখ্যান রূপকথা কিংবদন্তীর সমন্বয় ঘটেছে। লোকজভাষার দক্ষপ্রয়োগ নাটকটিকে ধনী করেছে। এ নাটকে মধ্যযুগীয় বাংলানাট্যআঙ্গিক ও উপাখ্যানের ধারা লক্ষ করা যায়। কেরামতমঙ্গল নাটকটি উপখণ্ডসহ মোট এগারোটি খণ্ডে বিভক্ত এবং বৃত্তপরিকল্পনায় রচিত। প্রতিটি উপকাহিনি আলাদা হলেও কালগত ঐক্যে একীভূত। এ নাটকের নায়ক কেরামত ১৯৪৬ থেকে স্বাধীনতাপরবর্তী পর্যন্ত সময় অতিক্রম করে। দাঙ্গা, দেশবিভাগ, বন্যা-দুর্ভিক্ষ, রাষ্ট্রভাষাআন্দোলন, স্বাধীনতাআন্দোলন প্রভৃতি ঘটনাপ্রবাহে আকীর্ণ জীবনকে কেরামত দুচোখ ভরে দেখে। এগারো খ-ে বিভক্ত নাটকে সে যেন এগারোটি দোজখ অতিক্রম করে। দেখে হতাশা বঞ্চনা অস্থিরতা মৃত্যুর চিত্র এবং সব জায়গায় দেখে ভ্রুণের বিনাশ। একটিমাত্রভ্রুণের মধ্য দিয়ে যেন নাট্যকার জীবনের অনন্তসম্ভাবনাকে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন।
মননব্রতী আহমদ শরীফের মতে ‘এই মহানাটক’ বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে:
নাট্যকার সেলিম আল দীন এক বিরাট পটে বিস্তৃতকালের পরিসরে আমাদের দেশের মানুষের শাসন-শোষণ পীড়নে দৃঢ়, দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিক্ষত, বঞ্চনা-প্রতারণায় বিক্ষুব্ধ ও জীবন-জীবিকা ক্ষেত্রে সংগ্রামমুখরজীবনের আলেখ্যদানের চেষ্টা করেছেন তাঁর কেরামতমঙ্গল নাটকে। উপখ-সহ মোট এগারো খ-ে তিনি ১৯৪৬ থেকে আজকের দিন পর্যন্ত সময় পরিসরে ঘটা প্রধান-প্রধান বিপর্যয়গুলো তুলে ধরার প্রায় সার্থক চেষ্টা করেছেন। বিস্তৃত পটে বহু বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমাবেশে রচিত হলেও নাট্যকারের মূল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে বলেই আমার মনে হয়। অজ্ঞ, অক্ষম, নিঃস্ব, নিরন্ন গণ-মানব যে এ যাবৎ গ্রাম থেকে শহরাবধি শাসক-প্রশাসকদের ও তাদের মুৎসুদ্দীদের মধ্যে যে গণহিতকামী ও গণসুখবাদী কোনো নেতাকে বা গোষ্ঠীকে বা শাসক-প্রশাসককে পায় নি তা দুষ্ট-দুর্জন-দুঃশাসকআকীর্ণ দেশে গণ-মানবের দুঃখ যন্ত্রণা ও নির্যাতনের এ খ-চিত্রগুলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এদিক দিয়ে বিচার করলে এই নাটকের লক্ষ্যে উত্তরণ ঘটেছে। কাজেই এ নাটক চিরকালের জন্যে এই সময়কার সার্থক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রইলো। বুদ্ধিজীবী ও নাট্যকার হিসেবে সেলিম আল দীন দেশের প্রতি এবং বিশেষ করে দেশের গণ-মানবের প্রতি প্রত্যাশিত দায়িত্বই পালন করেছেন তাঁর কেরামতমঙ্গল নামের এই মহানাটকে। অবশ্য তিনি তাঁর প্রায় নাটকেই এই সমাজমনস্কতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। গণ-মানবের দুঃখ মোচনের জন্যে, জীবনে, জীবিকায় এবং জীবনাচারে তাদের বন্ধনমুক্তির জন্যে আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির যে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন, তা ঘটাবার জন্যে যে বিপ্লব কাম্য তা ত্বরান্বিত ও আসন্ন করবার জন্য এই ধরনের নাটক রচনা ও প্রদর্শন আবশ্যক বলেই আমার ধারণা। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে আর যাঁরা গণমানবের হয়ে, গণমানবের কথা নিয়ে নাটক লেখেন তাঁদেরও সেলিম আল দীনের সঙ্গে অভিনন্দন জানাই।
আহমদ ছফা কতক নাটকীয় অসঙ্গতি নির্দেশ করেন:
আপনার নাটকটিতে মহাকাব্যের একটা ব্যাপ্তি আছে। কোনো বাংলানাটকের এরকম প্রসর পাটাতন আছে এর আগে আমার নজরে পড়ে নি। সেদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে, অন্যেরা কী বলবেন জানিনে, আমার তো মনে হয়, এটা একটা মহৎ-মহত্তম প্রয়াস। সে জন্য আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। এই নাটকটির মধ্যে অসঙ্গতিও রয়েছে। Internal current সর্বত্র সঠিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে নি। নাটকীয় সংঘাতের চাপে বাস্তবের শিলা ফাটিয়ে নতুন যে দিগন্তের উন্মোচনের মধ্যে নাটকের নাটকীয়তা নিহিত-তা ঘটতে পারে নি। এর প্রধান কারণ, ইতিহাসকে আবিষ্কার করার বদলে ইতিহাসের Flattery করা হয়েছে। কখনও যদি দীর্ঘ রচনা এ বিষয়ে লিখি বিশদ বয়ান করবো।
লোকভাষা ব্যবহার করছেন এটা খুবই আশার লক্ষণ। আমাদের সাহিত্যের নবজন্ম অনেকাংশে লোকভাষার সার্থক ব্যবহারের ওপর নির্ভর করছে। আমার মনে হয় আপনি অনেকটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন।
‘চিত্রালী’ পত্রিকায় দীপক চৌধুরীর সমালোচনায় কেরামতমঙ্গল-এর বিশিষ্টতা নির্দেশ করতে চাওয়া হয়েছে বেশি করে:
নাটকের ব্যাপক পটভূমিতে পথিক ‘কেরামত’ জীবনের কষ্ট দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে শেষ অবধি অন্ধ ও পরিণত কেরামত শেষ গ-ির উদ্দেশে যাত্রা করে। আর এখানেই মনে হয় আবহমানকাল প্রচলিত নাটকের ‘স্টাইলাইজড’ রূপ। তাই বলা যায় কেরামতমঙ্গল আর ৫টি নাটকের মতো নয়। এখানে জীবনের যে ছবি তুলে ধরেছেন সেটা শুধু দেখার নয়, আমাদের ভাবায়ও। শেষে এক মর্মান্তিক পরিণতির দিকে মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় কেরামতকে।
সংস্কৃতিভাবুক অরুণ সেন নাট্যকারের বিশিষ্ট নন্দন-অভিযান বিস্তারিত করেন প্রতিক্ষণ পত্রিকায়:
কিত্তনখোলা থেকেই তাঁর নিজের সেই নাট্যভাবনা স্পষ্ট রূপ পেতে শুরু করেছিল। তিনি দেখলেন, পাশ্চাত্য নাটকে ঘটনাবহুল দ্বন্দ্বের যে প্রত্যক্ষ ধরন এবং তারই অনুসারী ক্রমোচ্চ গড়ন, সেই আদর্শের অন্ধ অনুকরণে সত্যিকারের কোনো মৌলিক সৃজন ঘটছে না বাংলানাটকে। হয়তো ঘটতে পারেও না। যামিনী রায় হলে বলতেন, যন্তরটা তো আমাদের প্রয়োজনে আবিষ্কার করি নি, তাই আমরা সেটা চালাব কী করে? কীভাবে অবিকল ফুটে উঠবে বাঙালির অস্তিত্বের সুখদুঃখ ওই পরজীবী নাট্যচর্চায়? অন্তত ফোটে নি যে তা বাংলানাটকের প্রায় আদ্যোপান্ত ইতিহাস প্রমাণ করেছে। সেলিম আল দীন এখানে দাঁড়িয়েই খোঁজ শুরু করলেন বাঙালির দূর ও নিকট অতীতে নাট্য-উপাদান যতটুকু আছে তার। কিন্তু, প্রশ্ন ওঠে, বাঙালির নাট্য-ঐতিহ্য কিংবা তার নাট্যবোধের স্বরূপটা ঠিক কী? ইওরোপীয় আদর্শকে মাপকাঠি ধরলে সেরকম কোনো নাটকই হয়তো ছিল না আমাদের। সেলিম অবশ্য সেই মাপকাঠিটাকেই চ্যালেঞ্জ করতে চাইছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, পাঁচালি, যাত্রা, কথকতা এবং আরো নানাবিধ লৌকিকফর্মকে ঘিরে যে আত্মপ্রকাশের একটা ধরন আছে বাঙালির সংস্কৃতিতে, তার মধ্যেই তিনি খুঁজতে চেয়েছেন বাঙালির নিজস্ব নাটকের সম্ভাব্য রূপ। সেখানে ঘটনার সমাবেশ ও সমারোহ এবং তার দুর্বার গতিটা প্রধান নয়- নৃত্য ও সংগীতের সহযোগে, বর্ণনা ও সংলাপের মেশামেশিতে এমন এক অখ- ও ব্যাপ্ত রূপাবয়ব গড়ে ওঠে, যেখানে বাঙালির কাব্য, কাহিনি ও নাটকের পিপাসা একসঙ্গে চরিতার্থ হয়। এ কথাগুলো যে খুব নতুন তা হয়তো নয়- আমাদের প্রাচীন ও মধ্যযুগ বিষয়ক অনেক তত্ত্বালোচনায় তার ইঙ্গিত আগেই পেয়েছি।
কিন্তু সেলিম আল দীনের কাছে তা নিছক তাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা নয়, কিংবা অতীতের দিকে ফিরে তাকানো নয়, এ হলো তাঁর নাট্যভাবনার উৎস ও যাত্রাবিন্দু, যার একাত্মতায় তিনি সাম্প্রতিকের জটিল বাস্তবকে মুঠোয় ধরতে চাইছেন।
কেরামতমঙ্গল নাটকের ‘আকাশ ছোঁয়া অভিপ্রায়’ সম্পর্কে অরুণ সেন আরো লেখেন:
...কেরামতমঙ্গল-এ সেলিম এই ব্যবধানকে অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছিলেন মনে হয়। এখানেও চরিত্রের সংখ্যা অগুণতি, বোধহয় আরও বেশি, দৃশ্যপট আরও ছড়ানো, লৌকিক উপাদানের ব্যবহার আরও ব্যাপক, আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগও আরও আপোসহীন। অর্থাৎ স্বভাব একটুও বদলায় নি, কিন্তু নিজস্ব একটা কেন্দ্র গড়ে নিয়েছেন তিনি। কেরামত চরিত্রটিই সূত্রের মতো কাজ করেছে বলে শুধু নয়, কতকগুলি জোরালো প্রতিমা ও রূপক নাটকটিকে গেঁথে রেখেছে, বিন্যাসে এনে দিয়েছে এমন সৌন্দর্য, যাকে ধরে অপ্রতিহত এগোনো যায়। কিত্তনখোলায় ছিল সর্গভাগ, কেরামতমঙ্গল বিন্যস্ত হয়েছে খ-ে-খ-ে। সেলিম আল দীন নাটকটির সূত্রে কোরানের দোজখ বর্ণনায় যে ভয়াবহ চিত্রকল্প আছে তার কথা স্মরণ করেছেন, স্মরণ করেছেন মঙ্গলকাব্যের কবিদের এবং সন্তকবি দান্তেকে একসঙ্গে। খ-গুলির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দুঃসহ অভিজ্ঞতারই বিস্তারÑসাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিজড়ের প্রণয়, অত্যাচারিত হাজংবিদ্রোহী, হাজতবাস, জয় বাংলার প্রচার-অপপ্রচার, রাজাকারদের অত্যাচার, ধর্ষিত নারীর মৃত্যু, তালাক-পাওয়া হতভাগ্য নারীর সঙ্গে বোবা পাগলের মিলন ও ভ্রুণহত্যাÑএই বেবাক নরক-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় কেরামতকে। এক ধর্ষিত নারীই ছিল কেরামতের দয়িতা, আবার আরেক ওই কন্যাসম হতভাগিনীর ভ্রুণরাই হয়ে উঠল তার দায়। কিন্তু শেষদৃশ্যে দেখি রক্তাক্ত ব্যর্থ অন্ধ কেরামতÑছেঁড়া জুতো তার গলায়। সেলিম আল দীন লাঞ্ছিত যিশুর ক্রুশকাঠকে প্রণাম জানান।
এতই বিস্তারিত এই নাটকের পট যে এর প্রযোজনাও সে-সময়ে অন্তত পশ্চিমবঙ্গে পুরোপুরি গ্রাহ্য হয় নি। কারণ, অনভ্যস্ততা তো বটেই, তার সঙ্গে এ নাটকের আকাশছোঁয়া অভিপ্রায়ই এমন যে, প্রযোজনার প্রকরণগত সুবিধা-অসুবিধাগুলোও খুব বড় হয়ে ওঠে। নাটকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা সীমার লঙ্ঘন ঘটেছে এখানেও, বরং তাকে অতিক্রম করার পথে আরো দুপা এগোনোও সম্ভব হয়েছে। হয়তো, কিন্তু তখনো ওই প্রগতি সম্পূর্ণ নয়। ফলে, লেখার পাঠে সেই টুকরো ও আপাত-বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতটা প্রোথিত হয়ে যায়, অভিনয়ের চটজলদি রূপে ততটা হতে পারে না। এতগুলো স্তর এই নাটকে- লোকায়ত জীবনের স্তর, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার স্তর, প্রকরণ ও উপকরণের নিজের-নিজের ভিন্ন-ভিন্ন স্তর- তাকে অনুধাবনের জন্য যে ধ্যানের প্রয়োজন অভিনয়ের সময়সীমায় তাকে ধরে রাখা খুবই দুরূহ। ফলে, মনে হতে পারে, প্রযোজনার বিচারে অন্তত, সেলিম আল দীন তাঁর অভিপ্রায়ের দিক থেকে এখনো কিছুটা মুশকিলেই আছেন।
এভাবেই দেশজ নাট্যআঙ্গিক নির্মাণের প্রশ্নে কেরামতমঙ্গল একটি বিবেচ্য নাট্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে ওঠে বাংলা-থিয়েটারে।
ড. বিপ্লব বালা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, সমালোচক