Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: নানকার পালা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: নানকার পালা। রচনা: আব্দুল্লাহেল মাহমুদ। নির্দেশনা: আরণ্যক নির্দেশনা দল। মঞ্চপরিকল্পনা: ফয়েজ জহির। আলোকপরিকল্পনা: ঠাণ্ডু রায়হান। রূপসজ্জা: বঙ্গজীৎ দত্ত। পোস্টার ডিজাইন: অশোক কর্মকার। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৮৫। একটি ‘আরণ্যক নাট্যদল’ প্রযোজনা
[নানকার পালা নাটক নিয়ে গবেষণাধর্মী নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন বিপ্লব বালা। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ১৫তম সংখ্যায় (২০০৫ এ প্রকাশিত) এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
‘আরণ্যক নাট্যদল’ কর্তৃক প্রকাশিত নানকার পালা নাট্যের প্রচারপত্রে জানানো হয়:
গাঙেয় অববাহিকার এ অঞ্চলের ইতিহাস দাহ ও দ্রোহের ইতিহাস। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির সমসাময়িক এ অঞ্চলের সভ্যতা, জলসেচনির্ভর ও কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। সেই প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই সুপেয় পানি আর ঊর্বর মৃত্তিকার লোভে ছুটে এসেছে বহু বিদেশি, বিভাষী আর বিজাতি। তাদের সে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছে অসংখ্য কৃষকবিদ্রোহ। তেমনি এক শতাব্দী প্রাচীন কৃষকবিদ্রোহের আবেগতাড়িত ইতিহাস নানকার পালা।
নান শব্দের অর্থ রুটি, আর নানকার হলো রুটি দিয়ে কেনা গোলাম। নানকার মূলত এক ধরনের ভূমিদাস। সামান্য একটুকরো জমির বিনিময়ে তারা সামন্ত প্রভুর আজ্ঞা পালনে বাধ্য থাকতো। নানকার সম্প্রদায় অতি প্রাচীন সম্প্রদায়। চলতি শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত নানকারী প্রথার প্রচণ্ড প্রকোপ ছিল বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বসীমান্তের সিলেট জেলায়। মধ্যযুগীয় বর্বর নানকার প্রথার বিরুদ্ধে সিলেট জেলা নানকারদের বিদ্রোহের সূচনা সেই মধ্যযুগেই। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে এক নাগাড়ে কয়েক শতাব্দী পার হয়ে অবশেষে তা আমাদের কালে এসে পৌঁছেছে। শতাব্দীপ্রাচীন এ বিদ্রোহের ধারাটি এক প্রবাহমান অখ- স্রোত। তাই একে নানকার পালার কাহিনিতে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়।
নানকার পালা নানকার বিদ্রোহের ইতিহাস নয়। ইতিহাসের কালপঞ্জী আর ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণের অবকাশ এখানে সীমিত। নানকার পালা তাই নানকার বিদ্রোহের ইতিহাস নয়, নানকার বিদ্রোহের জ্বালাযন্ত্রণা, ক্ষোভ, রক্তক্ষরণ, ভালোবাসা আর প্রতিরোধের দলিল।
দর্শক-সমালোচকদের মতামত
ঐতিহাসিক এক কৃষকবিদ্রোহ মঞ্চে রূপায়ণ করে এবং তাকে বর্তমানের সঙ্গে অন্বিত করে ‘আরণ্যক’ এক ঐতিহাসিক দায়পালন করেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক আন্দোলনে একদা সক্রিয় সংগঠক, সাংবাদিক-সমালোচক সন্তোষ গুপ্ত:
নাট্যকার আব্দুল্লাহেল মাহমুদ রচিত নানকার পালা নাটকের পরিচিতিতে বলা হয়েছে, এ নাটক নানকার বিদ্রোহের ইতিহাস নয়। এদেশের ইতিহাস অচেতন মানুষ নানকার প্রথা ও তাদের বিদ্রোহের কথা জানে না, কিম্বা জানবার চেষ্টা করে না। ‘আরণ্যক নাট্যদল’ নানকার বিদ্রোহের সেই ইতিহাসকে কেন্দ্র করে তাদের যন্ত্রণা, নির্যাতন ও প্রতিরোধের একটা ধারণা দর্শককে উপহার দিতে চেয়েছে।
নাটক সম্পর্কে কিছু বলার আগে নানকার পালা নাটক মঞ্চস্থ করার সপক্ষে যে কথা ‘আরণ্যক’ বলতে চেয়েছে তার সূত্র ধরে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এ প্রজন্মেরই ঘটনা। তা আমাদের প্রত্যক্ষ ঘটনা, অনেকের জীবনের আরক্ত দলিল, অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রণায় ধমনির রক্তে মিশ্রিত, তবুও কি আমাদের সচেতন রাখতে পেরেছে। বর্তমানের চেতনার যেখানে গ্রহণ লেগেছে, সেখানে অতীতের কাহিনি তো বেদনাবিলাস বলে অনেকের মনোরম সন্ধ্যা কিংবা নির্ঝঞ্ঝাট সকাল কাটানোর বাইরে মর্মে কী দোলা দিবে? ‘আরণ্যক’ স্বীকার করবেন এ ক্ষুব্ধ প্রশ্ন আমাদের রক্তে এখনও আর্তনাদ তোলে।
যাক সেকথা। নানকার পালা নাটকটি উপস্থাপন করা হয়েছে পালাগানের ভঙ্গিতে এবং তার সাথে নানকারদের যন্ত্রণাময় জীবন, বিদ্রোহ আর জমিদারদের অত্যাচারের খণ্ড খণ্ড দৃশ্য সংযোজন করে দর্শককে ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার সাথে যুক্ত করা হয়েছে চলতিকালের কৃষকজীবনের বঞ্চনা সংগ্রাম ও প্রতিরোধের চেতনার স্ফুলিঙ্গকে। এখানেই নানকার পালা নাটকটি শুধুমাত্র ইতিহাসের প্রতিরোধের দলিল না হয়ে আজকের সংগ্রামের পথ নির্দেশক এবং জীবনসংগ্রামের আয়োজনের ব্যাপ্তিরও বাহন হয়েছে। সার্থকতাও এখানে।
সিলেটে মধ্যযুগীয় বর্বর নানকার প্রথার বৃটিশ আমলে সংঘবদ্ধ বিদ্রোহ দেখা দিলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও নানকারদের মুক্তি আসে নি দীর্ঘ দিন।
এই বর্বর প্রথা চালু রাখার পিছনে জমিদারদের স্বার্থের সাথে কংগ্রেস-লীগও অভিন্ন হতে বাধ্য। ব্রিটিশ আমলে আর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ সরকার এই নানকার প্রথা জিইয়ে রাখতে গিয়ে যে অত্যাচার দমননীতির আশ্রয় নিয়েছিল সে কাহিনি কার্যত তৎকালীন কোনো পত্রিকায় স্থান পায় নি। কাজেই দেশের সাধারণ মানুষের নিকট এই অঞ্চলের নানকার প্রথা তথা অনুরূপভাবে জমিদারিতে বেগার খাটার নানা সম্প্রদায়ের লোকের মানবেতর জীবনযাপন ও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাহিনি অজানা রয়ে যায়। নানকার পালা নাটক সে অভাব মোচনে এগিয়ে এসেছে। নাটক যে সংগ্রামের হাতিয়ার এবং গণমানুষের প্রতিরোধের ভাষা, সেই কথাটার সার্থকতা প্রমাণ করছে নানকার পালা।
নানকার পালার নানকারদের মাঠে জমিদারের ঘোড়া মেরে ফেলার দৃশ্যটি নানকার বিদ্রোহের অন্তর্গত একটি প্রকৃত কাহিনি। জমিদার ছয়াব মিঞা ও দারোগা করম আলী কোনো কল্পিত চরিত্র নয়। মাহিষ্য দাস সম্প্রদায়ের একজন জমিদারের হাতের চাবুক কেড়ে নিয়েছিল, তাও প্রকৃত ঘটনা। কলা চুরিকে কেন্দ্র করে কিশোরকে পিটিয়ে মারার কাহিনিও সত্য ঘটনা।
অমানুষিক শোষণ-পীড়ন এবং অকথ্য ও বর্বর অত্যাচারে নানকারদের মধ্যে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে থাকে। আর সে বিদ্রোহ দমনের জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর চক্রান্তও ঐতিহাসিক তথ্য। জমিদারদের মধ্যে নরমপন্থী জমিদারও ছিল, তাদের যুগোপযোগী কৌশল পরিবর্তনের পরামর্শও ইতিহাস-সত্য।
কলা চুরির ঘটনাটি ১৯৪১ সালে ঘটেছিল। তখন আসামে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা। জমিদারের নির্যাতনে এ ধরনের মৃত্যুর কিনারা হতো না তৎকালে। এর আগে ছিল কংগ্রেসি মন্ত্রিসভা। তাদের সময়ে রায়ত কৃষক সমিতির আন্দোলনের ফলে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলে সিলেট জেলা প্রজাস্বত্ব আইনটি আসাম আইন পরিষদে গৃহীত হয়। তার আগে কৃষক সমিতি ‘শিলং অভিযান’ মিছিল সংগঠিত করেছিল। দেবপুর কৃষক আন্দোলনের দাবি ছিল ওই বিলের একটি নির্দিষ্ট ধারার বিরুদ্ধে। তা হলো ফসলে খাজনার বদলে টাকায় খাজনা প্রথা চালুর দাবি। ১৯৪১ সালে গৃহীত আইনে সে দাবি গ্রাহ্য হয় নি। ভারত রক্ষা আইনের কারণে ওই দাবিতে কৃষকদের আন্দোলন সার্থক হতে পারে নি। আন্দোলন শুধু দেবপুরেই সীমিত ছিল।
নানকারআন্দোলনকে সংগঠিত রূপ দেওয়া ও সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতির বিরুদ্ধে সচেতন করার পথে কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালিত কৃষক সমিতির কর্মীরা এগিয়ে আসেন। নানকার পালা নাটকে হামিদালীর চরিত্রে মামুনুর রশীদ তা ফুটিয়ে তোলেন। নাটকে কৃষক সমিতির সাথে নানকারদের আন্দোলন যুক্ত করার সংলাপে অজয় দা অর্থাৎ নানকার আন্দোলনের অন্যতম নেতা অজয় ভট্টাচার্যকে বুঝানো হয়েছে। নাটকের অপর একটি দৃশ্যে দেখান হয়েছে যে, জমিদার একজন নানকারকে তেড়ে মারতে গেলে কাছারি বাড়িতে উপস্থিত নানকারদের কয়েকজন গর্জে ওঠে। ১৯৪৬ সালে বটরশি বিদ্রোহের ইতিহাস থেকে এ অংশ নেয়া হয়েছে বলে মনে হয়।
নানকার পালা নাটকে জিরাতি কাশেমালী নিজেদের জীবন ও জীবিকারসংগ্রামের ফাঁকে ফাঁকে পালা গানের আকারে নানকারবিদ্রোহের কাহিনি তুলে ধরলে এই কাহিনি জিরাতিদের শোষণের বিরুদ্ধে একজোট হবার চেতনা সঞ্চারিত করে জাগ্রত করে আত্মবিশ্বাস। জোতদার গেন্দু মিয়া, শামসু ও খলিলের শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দীক্ষা নেয় এভাবে ইতিহাস থেকে জিরাতিরা। জিরাতিদের একজনের দুর্বলতায় যখন তারা জোতদারদের দ্বারা নির্যাতিত হয় অসতর্কতার মুখে, সেখানেই নানকার পালা নাটক শেষ হলো এই ঘোষণা দিয়ে যে, আজ দেশের সকল কৃষকসমাজ একই অবস্থার শিকার। নানকারদের প্রতিরোধ সংগ্রাম আজও শেষ হয় নি।
বিপ্লবে জয়ী হওয়ার কোনো স্বস্তি বাণী নয়, দেশের বর্তমান অবস্থার নির্মমচিত্র তুলে ধরার সাথে নানকারবিদ্রোহের সফল উত্তরাধিকারের গর্ব ও শপথ উচ্চারিত। নানকার পালা নাটক প্রকৃত অর্থেই তাই গণমুখীন একটি নাটক।
দর্শকের মধ্যে মন্তব্য শুনেছি- এ রকম ঘটেছিল তা তো জানতাম না। আবার ২/১ জনকে হতাশ হয়ে উঠে যেতে দেখেছি নাটকের মধ্যপথে। সহজেই বোঝা যায়, এরা এসেছিলেন প্রণয় বা চড়ালয়ে বাঁধা বিপ্লবের রোমান্টিক শব্দাবলি শুনে শিহরিত হতে। এ দুটোই মধ্যবিত্তমনের উত্তেজনার খোরাক। আশাভঙ্গ হয়ে তারা চলে গেছেন। নাটকের সার্থকতা এই দুই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রমাণ করেছে।
ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে সংগঠিত নানকার প্রথাবিরোধীআন্দোলনের খণ্ডচিত্রের সঙ্গে, দেশের বর্তমান অবস্থার নিমর্মচিত্র তুলে ধরার সাথে, নানকারবিদ্রোহের সফল উত্তরাধিকারের গর্ব ও শপথ উচ্চারিত নাটকে। সাধারণজনের বিদ্রোহগাথা আজকের তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন সংস্কৃতিজনেরও মনে ক্রমবিস্মৃত।
আলোচক দর্শক-প্রতিক্রিয়ার যেকটি নমুনা উল্লেখ করেছেন, তাতে তাদের শিল্প আকাক্সক্ষার স্বরূপ প্রকাশিত। বিশেষত এই মন্তব্যটি- ‘এরা এসেছিলেন প্রণয় বা চড়ালয়ে বাঁধা বিপ্লবের রোমান্টিক শব্দাবলি শুনে শিহরিত হতে। এ দুটোই মধ্যবিত্ত মনের উত্তেজনার খোরাক। আশাভঙ্গ হয়ে তারা চলে গেছে। নাটকের সার্থকতা এই দুই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রমাণ করেছে।’ এ নাটকে পালাগানের ভঙ্গিতে নানকারদের জীবন ও বিদ্রোহ এবং জমিদারদের অত্যাচারকে খণ্ডে খণ্ডে দৃশ্য যোজনার সঙ্গে সঙ্গে ‘চলতিকালের কৃষকজীবনের বঞ্চনা সংগ্রাম এবং প্রতিরোধের চেতনার স্ফুলিঙ্গকে’ যুক্ত করেছে। তাতে নাটকটি ‘ইতিহাসের প্রতিরোধের দলিলমাত্র না হয়ে আজকে সংগ্রামের পথনির্দেশক এবং জীবনসংগ্রামের আয়োজনের ব্যাপ্তিরও বাহন হয়েছে’। চড়ালয়ে বাঁধা বিপ্লবের রোমান্টিকতার বিপরীতে এক শিল্পরূপায়ণ যে ঘটেছে বলে মনে করছেন সমালোচক, তার থেকেই শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্কের প্রশ্নে বিশিষ্ট এক নান্দনিক অবস্থানকে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ এই বিষয়ের নাটকে যার অন্যথা হওয়াই প্রচলিত ধরনÑপ্রযোজনা ও সমালোচনা, দুই ক্ষেত্রেই।
ড. বিপ্লব বালা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, সমালোচক