Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: গ্যালিলিও

Written by বিপ্লব বালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

নাটক: গ্যালিলিও। মূলরচনা: বের্টল্ট ব্রেশট। অনুবাদ: আবদুস সেলিম। নির্দেশনা: আতাউর রহমান। মঞ্চপরিকল্পনা: শেখ মনসুরউদ্দিন আহমেদ। আলোকপরিকল্পনা: সৈয়দ লুৎফর রহমান। আবহসংগীতপরিকল্পনা: কে বি আল আজাদ। পোস্টার ডিজাইন: মনসুর আহমেদ। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৮৮।। একটি ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ প্রযোজনা

[গ্যালিলিও নাটক নিয়ে গবেষণাধর্মী নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন বিপ্লব বালা। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ১৫তম সংখ্যায় (২০০৫ এ প্রকাশিত) এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]

স্যুভেনিরে গ্যালিলিও সম্পর্কে বলা হয়:
তবুও গ্যালিলিও প্রযোজনার চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করলাম এই বিবেচনায় যে, গ্যালিলিও আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে গভীরভাবে অর্থবহ। গ্যালিলিও নাটকে আমরা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কুপমণ্ডুকতা ও মৌলবাদের আগল ভেঙ্গে নবযুগের সোচ্চার আহ্বান শুনতে পাই, যে নবযুগ নির্মাণ করবে কর্মজীবী সাধারণ মানুষেরা। নাটকের শেষদৃশ্যে গ্যালিলিও’র কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই বিজ্ঞান সাধারণ মানুষের জন্যে, সবার জন্যে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যদি শুধুমাত্র স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাসীনদের ভয়ে তাঁদের জ্ঞানের চর্চা করে তৃপ্ত হয়, তবে বিজ্ঞান হবে একটা অর্থহীন বিষয় আর নবআবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি শুধুমাত্র অত্যাচারের নতুনযন্ত্ররূপে ব্যবহার হবে মাত্র। ফলে বিজ্ঞানী আর সাধারণমানুষের মাঝের ফাঁকটা একদিন এমন বেড়ে যাবে যে, নতুন কোনো আবিষ্কারের আনন্দধ্বনি ভীতির সঞ্চার করবে। গ্যালিলিও’র কণ্ঠে উচ্চারিত এ সংলাপ আজকের বিশ্বের বিদ্যমান সত্য।

‘উদ্যোক্তাদের কথা’ শিরোনামে স্যুভেনিরের ভাষ্য হলো:
গ্যালিলিও নামের মানুষটি সত্য অনুসন্ধানকারী বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর নিজস্ব সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ব্রেশট তিন তিনবার নাটকটির শেষাংশ পরিবর্তন করেছিলেন। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের প্রেক্ষাপটে সত্য উচ্চারণ না করে চার্চের প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্যে ব্রেশট গ্যালিলিওকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছেন। আজকের বিশ্ব যেখানে পারমাণবিক সমর-অস্ত্রের বিধ্বংসী শক্তির ভয়ে কম্পমান, সেক্ষেত্রে এ নাটকের প্রাসঙ্গিকতা কোনো বিশেষ দেশ ও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর মর্মবাণী যথার্থই বিশ্বজনীন।

নাটকটির বিষয়ে অনুবাদকের বিশেষ এক অনুভাবন দেখা যায় নাটকে New time বা age অর্থাৎ নবযুগ কথাটি নিয়ে কর্তৃত্বের, ক্ষমতা-কাঠামোর স্বরূপ উন্মোচন করাই নবযুগের কাজ বলে। অনুবাদক আবদুস সেলিম বলেন:
প্রসঙ্গত, এই নাটক সম্বন্ধে আমার নিজস্ব একটি অভিমত জ্ঞাত না করলে বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গ্যালিলিও নাটকে একাধিকবার New time বা age অর্থাৎ ‘নবযুগ’-এর উল্লেখ আছে। ব্রেখ্ট-এর এই নবযুগের মূলচেতনা হলো সেই সত্যের উপলব্ধি যা মানুষের মুক্তি বয়ে আনবে। অথচ আদিকাল থেকে 'authority' অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ অজ্ঞ সাধারণ জন-মানুষকে স্বীয় স্বার্থসাধনে ব্যবহার করে আসছে। নবযুগের মূলচেতনা হলো এই বদভ্যাসকে মানবজাতির কাছে উন্মোচিত করা। যুগে-যুগে, দেশে-দেশে এই কর্তৃপক্ষের রূপ ভিন্নতর। কখনও সে ধর্ম-প্রতিষ্ঠান, কখনও সামরিক জানতা, কখনও রাজনীতিজ্ঞ, কখনও আমলা, কখনও ব্যবসায়ী আবার কখনও এইসব মিলে এক সর্বশক্তিমান দুর্ভেদ্য অশুভ আবর্ত-চক্র। চার্চ এই নাটকে একটি রূপক মাত্র। বিজ্ঞানকে বা প্রকৃত জ্ঞানকে নিজ উদ্দেশ্য চরিতার্থে ঠিক এই মুহূর্তেও ব্যবহার করে চলেছে এইসব কর্তৃপক্ষ; আর সেই বহুপ্রতীতী ‘নবযুগ’-এর দেখা এখনও মেলে নি। তবুও মানুষের আশা আছে, নাটকের শেষদৃশ্য তাই প্রতিফলিত করে। সমগ্র নাটকের কাঠামোতে আকীর্ণ হয়ে আছে দারুণ সব ঘটনাবলি, যা প্রতিটি পাঠক-দর্শকের চেতনাকে প্রবুদ্ধ করে মুহুর্মুহু।

নির্দেশক আতাউর রহমান নাটকটিকে দেশে ও বিশ্বে নিদারুণ প্রাসঙ্গিক মনে করেন:
আমাদের বিবেচনায় গ্যালিলিও আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভীষণভাবে অর্থবহ। গ্যালিলিও নাটকে আমরা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কুপমণ্ডুকতা ও মৌলবাদের আগল ভেঙ্গে নবযুগের সোচ্চার আহ্বান শুনতে পাই, যে নবযুগ নির্মাণ করবে কর্মজীবী সাধারণমানুষেরা। নাটকের শেষদৃশ্যে গ্যালিলিও’র কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই, বিজ্ঞান সাধারণমানুষের জন্যে, সবার জন্যে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যদি শুধুমাত্র স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাসীনদের ভয়ে তাঁদের জ্ঞানের চর্চা করে তৃপ্ত হয়, তবে বিজ্ঞান হবে একটা অর্থহীন বিষয় আর নবআবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি শুধুমাত্র অত্যাচারের নতুনযন্ত্ররূপে ব্যবহার হবে মাত্র। ফলে বিজ্ঞানী আর সাধারণমানুষের মাঝের ফাঁকটা একদিন এমন বেড়ে যাবে যে, নতুন কোনো আবিষ্কারের আনন্দধ্বনি ভীতির সঞ্চার করবে। গ্যালিলিওর কণ্ঠে উচ্চারিত এ সংলাপ আজকের বিশ্বের বিদ্যমান সত্য।


দর্শক-সমালোচকের মতামত

রিশিত খান নাটকের প্রাসঙ্গিকতা নির্দেশ করতে গ্যালিলিও’র সংলাপ উদ্ধৃত করেন:
নাটকে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কুপমণ্ডুকতা এবং মৌলবাদের আগল ভেঙ্গে এক নতুনসমাজের সোচ্চার আহ্বান শুনতে পাই আমরা। সে সমাজ নির্মাণ করবে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষেরা। নাটকের শেষদৃশ্যে তাই গ্যালিলিও’র কণ্ঠে শুনতে পাই, ‘বিজ্ঞান সাধারণমানুষের জন্যে, সবার জন্যে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যদি শুধুমাত্র স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাসীনদের জন্য তাঁদের জ্ঞানের চর্চা করে তৃপ্ত হন, তবে বিজ্ঞান হবে একটি অর্থহীন বিষয় আর নবআবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি শুধুমাত্র অত্যাচারের যন্ত্ররূপে ব্যবহার হবে মাত্র। ফলে বিজ্ঞান আর সাধারণমানুষের মাঝের ফাঁকটা একদিন এমন বেড়ে যাবে যে, নতুন কোনো আবিষ্কারের আনন্দধ্বনি ভীতির সঞ্চার করবে।

‘থিয়েটার’ পত্রিকার সমালোচক বিস্তারিত করেন ব্রেখ্ট ও গ্যালিলিও পরিচয়:
ব্রেখ্ট গ্যালিলিওকে ইতিহাসভিত্তিক নাটকের গতানুগতিক নায়কের মতো উপস্থাপন করেন নি। তাঁর নাটকে গ্যালিলিও যেমন নিবেদিত-প্রাণ বিজ্ঞানী, অন্যদিকে তেমনি সাধারণমানুষের মতোই দৈহিক নির্যাতনের প্রতি ভীত। বিজ্ঞানের নবতর দ্বার উন্মোচনের প্রতি তিনি যেমন আকৃষ্ট, তেমনি ভালো আহার্যের প্রতিও তাঁর সমান আকর্ষণ। এই শারীরিক ও মানসিক চাহিদা পূরণের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে দিয়ে তাঁর চরিত্রের স্ববিরোধিতাই তুলে ধরেছেন ব্রেখ্ট। কারো কারো মতে তিনি ভুল করেছিলেন। বিশুদ্ধ এক বিজ্ঞান সৃষ্টি করতে গিয়ে বিজ্ঞানের সামাজিক তাৎপর্যকে উপেক্ষা করেছিলেন। এ কারণে বিজ্ঞানীদের মধ্যেই বিভক্তির সৃষ্টি হয়। ব্রেখ্ট তাঁর এই নাটকের সমালোচনায় অবশ্য বলেছেন, এই নাটকের মূলবক্তব্য হচ্ছে সমাজ ব্যক্তি থেকে কী আহরণ করে বা করা উচিত।

তবে নাটকটির নিগূঢ় একটি অর্থও আছে। গ্যালিলিও নাটকে আমরা বারবার নবযুগ (NEW AGE)-এর উল্লেখ পাই। এই নবযুগ কুসংস্কারের ওপর যুক্তি আর সত্যের জয়, পুরাতনকে স্থলাভিষিক্ত করে নতুনের আগমন। গ্যালিলিওকে আমরা বলতে শুনি, ‘সত্য সময়েরসন্তান, কর্তৃত্বের নয়।’ ব্রেখটের নবযুগ হলো সেই সময়, যখন সত্যের উপলব্ধি জনমানুষের মুক্তি বয়ে আনবে। অথচ আদিযুগ থেকে ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ (AUTHORITY) সেই মুক্তির পথ রোধ করে রেখেছে। ক্রমশ প্রাচীন অর্বাচীনরাই সবল হয়ে উঠেছে আর নবীন নিমজ্জিত হয়েছে হতাশায়। এই পুরাতনই নতুন বেশে এক সারশূন্য ‘নবযুগের’ অবতারণা করেছে।...অনুবাদে সাবলীলতা রয়েছে, সেই সাথে ভাষার সরলতা দর্শকবৃন্দের কাছে নাটকটি সহজবোধ্য করেছে। প্রতি দৃশ্যের কোরাসে তিনি যেমন ছন্দময়তা রক্ষা করেছেন, তেমনি প্রয়োজনবোধে দেশীয় উপাদানে সহজবোধ্য প্রেক্ষাপট রচনা করেছেন। অতিরিক্ত জটিল অংশ প্রয়োজনানুযায়ী সংক্ষিপ্ত করেছেন।...

বিশ্বে আজও এই গোষ্ঠী সক্রিয়। সর্বত্র, এমনকি এদেশেও কখনো কুসংস্কারের প্রলেপে, কখনো ধর্মের আড়ালে, কখনো সামরিক পোশাকে, আবার কখনো রাজনীতির ফাঁকা বুলির আচ্ছাদনে বারবার এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সাধারণজনগণকে বিভ্রান্ত ও বঞ্চিত করেছে। স্বার্থ ও ক্ষমতার লোভে বিজ্ঞান তথা প্রকৃত জ্ঞানকে এরা ব্যবহার করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এই প্রাচীনপন্থী ক্ষমতাসীনদের নবীন সম্প্রদায় উচ্ছেদ করতে পারলেই ব্রেখ্টের সেই নবযুগের অবতারণা হতে পারে।

বাংলাদেশে মৌলবাদী পশ্চাদ্পদ সমাজ-রাষ্ট্রের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে গ্যালিলিও ভিন্ন রাজনৈতিক-তাৎপর্য অর্জন করে। গ্যালিলিও একটা প্রতীকী চরিত্রই পেয়ে যায়, যার ফলে এর প্রাসঙ্গিকতা অটুটÑনানা সমালোচক ও নাট্যকার-নির্দেশক প্রায় একই ভাষ্য করেন।

ড. বিপ্লব বালা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, সমালোচক