Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: হাতহদাই
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: হাতহদাই। রচনা: সেলিম আল দীন। নির্দেশনা: নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মঞ্চ ও পোস্টার ডিজাইন: আফজাল হোসেন। আলোকপরিকল্পনা: রফিক মাহমুদ। পোশাকপরিকল্পনা: রেজাউল হায়দার ও আফজাল হোসেন। আবহসংগীতপরিকল্পনা: শিমূল ইউসুফ। রূপসজ্জা: মোয়াজ্জেম হোসেন। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৮৯। একটি ‘ঢাকা থিয়েটার’ প্রযোজনা
[ঢাকা থিয়েটারের হাতহদাই: মৃত্যুর অন্ধকারে জীবনের জয়গান- শিরোনামে নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন আতাউর রহমান। তাঁর নাট্যসমালোচনা-গ্রন্থ ‘পাদপ্রদীপের আলোয়’ থেকে সংগ্রহ করে নাট্যসমালোচনাটি ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
যে রচনা আমাদেরকে একই সঙ্গে হাসায়-কাঁদায় তাকে আমাদের অর্থপূর্ণ মনে হয়। সেলিম আল দীনের হাতহদাই তেমনি একটি নাট্যরচনা। ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর চতুর্দশ প্রযোজনা হাতহদাই। হাতহদাই-এর মঞ্চায়ন-বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় দেখেই ২৯. ০৪. ৯২ তারিখ সন্ধ্যায় নাট্যপ্রযোজনাটি দেখে ফেলি। সৌভাগ্য বলতে হবে, না দেখলে অনেক কিছু হারাতাম। এই নাট্যরচনা সম্পর্কে অনেক কথা এক সঙ্গে বলতে ইচ্ছে হয় কিন্তু হড়বড় করে বলতে গিয়ে বেধে গিয়ে অনেক কথা না বলাও থেকে যেতে পারে। মাহাকাব্যিক-আবহে-সৃষ্ট এই রচনাকে জীবনের গভীর-মর্মস্পর্শী-রসঘন ও ধ্রুপদী ধারাপাত বললে অত্যুক্তি হবে না। হারজিতের খেলায় ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তিম সৌন্দর্যে ভূষিত আমাদেরই নিত্যদিনের যাপিতজীবনের রোজনামচাটা হাতহদাই। এই নাটকে প্রবাহিত জঙ্গমতা, পেশল-শক্তিতরঙ্গ আমাদের শুধু স্পর্শ করে না, স্পৃষ্টও করে। সহস্রকণ্ঠে জীবনের এমন জয়গান শিল্পকর্মে বহুদিন দেখা যায় নি। সেলিম এই নাটকে অতীতের সব বড় সৃষ্টিশীল শিল্পীদের মতোই চূড়ান্ত আশাবাদী, মহৎ-জীবনবাদী। কে বলেছিলেন সঠিক মনে নেই, খুব সম্ভবত ইন্দিরা গান্ধী হবেন, বলেছিলেন, চাঁদের চেয়ে আমাদের নিত্যদিনের সংগ্রামমুখর পৃথিবীটা বেশি সুন্দর। এই উক্তির মর্ম হাতহদাই নাটক অনেকাংশে বুঝিয়ে দেয়। হাতহদাই নাটকে সেলিম আল দীন আমাদের আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি উপন্যাসের নায়কের মতো এক ওল্ডম্যানের গল্প শোনান। এই দুর্ধর্ষ ‘ওল্ডম্যান’ নাবিক আনার ভাণ্ডারি শুধু আমাদের সমুদ্র-সওদার কথাই শোনান না, জীবনের বিকিকিনির হাটের গল্পও শোনান। জীবনের বিক্ষুব্ধ ফেনিল-সমুদ্রে আনার ভাণ্ডারির সওদা-সাঙ্গাতেরা হলো হাস্না, চুক্কুনী, বজল, মোদু, লুত্তা ও জামালরা। এরাও সমুদ্রমন্থন করে জীবনের জুয়াখেলায় গ্রথিত হয় এই নাটকে, অর্থবহ হয়ে ওঠে ব্যাপকভাবে। সেলিম এই নাট্যরচনায় আগের চেয়েও ঋদ্ধ, গভীরভাবে জীবনমনস্ক, উদ্দেশ্যে স্থিত। লক্ষ্যবস্তুতে এই নাটকে তাঁর দৃষ্টি স্থির-নিবদ্ধ এবং সবার উপরে এখানে আমরা তাঁকে পাই মুক্ত-স্বাধীন এক স্রষ্টা হিসেবে। এমন উক্তি সঙ্গত হবে কিনা জানি না যে, এই নাট্যরচনায় তিনি তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ পূর্বতন দুই নাট্যরচনা কিত্তনখোলা ও কেরামতমঙ্গলকেও ছাড়িয়ে গেছেন। গল্পবলা, কাহিনিবিন্যাস, সংলাপরচনা, চিত্রকল্প ও চরিত্র-সৃষ্টিতে সেলিম এই নাটকে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তিনি আমাদেরকে চর-বাংলার হৃদয়ে প্রবিষ্ট করিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে চর এলাকার বেগুনি রঙের চেঁওয়া মাছ ধরার অনাস্বাদিত উপাখ্যানও শোনান। আসলে সম্পূর্ণ নাট্যপ্রযোজনাটাই ছিল এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা। নাটক দেখার সময় মনে হয়েছে নাট্যকারের হৃদয়টি আরণ্যক-এর বিভূতিভূষণের মতোই বাংলার মাটিতে প্রোথিত অথবা যেমন প্রোথিত ছিল ডাক্তার লিভিংস্টোনের হৃদয়টি আফ্রিকার কালো মাটিতে। আঞ্চলিক-ভাষা, বিশেষ করে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম বা সিলেট অঞ্চলের ভাষা সাধারণভাবে কমিক-উপাদান হিসেবে নাটকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেলিম আল দীন তথা ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর এই প্রযোজনার অন্যতম অর্জন হলো তাঁরা হাতহদাই-এর মতো একটি সিরিয়াস নাটকের সমগ্র-সংলাপ নোয়াখালীর আঞ্চলিক-ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। নাটকের শ্রোতা-দর্শকেরা নাট্যকারের সৃষ্ট হাসির জায়গা ছাড়া কখনো হাসাহাসি করেন নি।
হাতহদাই নাটকে মুখ্যচরিত্র নাবিক আনার ভাণ্ডারির মুখে আমরা সমুদ্র-ভ্রমণের দুটো কাহিনি শুনি। বস্তত এগুলো নিরন্তর জীবনসংগ্রামেরই কাহিনি। সমগ্র নাটকে দূর মিসরের বন্দর, ভালেত্তির সেই মেয়েটি, ভূমধ্যসাগরের চাঁদ, রিওদি জেনারিওর সুগারলোফ মাউন্টের স্বপ্নছায়ায় আনাগোনা করে ও আনার ভাণ্ডার সমুদ্র-সম্ভোগ শেষ হয় না। কত বিচিত্র অথচ আমাদের অতি চেনা-মানুষদের আনাগোনা দেখতে পাই আমরা এই নাটকে এবং মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা ধরে নাটকের এই মানুষেরা জীবনসম্ভোগে ব্যাপৃত। খুন-খারাবি, বাটপারি, মিথ্যাচার, হতাশা, বঞ্চনা, নির্যাতন এই সবের পাঁকে আশ্লিষ্ট হয়েও হাতহদাই নাটকে জীবনসংগ্রাম বড় হয়ে উঠেছে। চর এলাকার মানুষদের যথার্থ নাম নির্বাচন থেকে শুরু করে সমগ্র জীবনাচরণ এবং জাহাজীদের জীবন-পাঁচালি সেলিম অত্যন্ত বিশ^স্ততার সাথে এঁকেছেন।
‘ঢাকা থিয়েটার’ খুব জোর দিয়ে একটি কথা বলে যে, এই নাট্যদলটি আমাদের জাতীয় নাট্য-আঙ্গিক নির্মাণ করতে চায়। জানি না এই প্রয়াসের পথে তাঁরা কতদূর এগিয়েছেন, তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনাগুলোকে নিজস্ব-বৈশিষ্ট্যগুণে একেবারে আলাদা করে চেনা যায়। হাতহদাই-এর নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ আবারও প্রমাণ করলেন যে, তিনি যথার্থই শক্তিমান ও রূপদর্শী। তিনি সেলিমের পাণ্ডুলিপিকে মৌলভিত্তিভূমি করে সেলিমের হাত ধরাধরি করে সক্ষম দোসরের (সদর্থে) মতোই অপূর্ব-দক্ষতায় মঞ্চে অনুবাদ করেছেন হাতহদাই-কে। কয়েকটি বিশেষ দৃশ্য-পরিকল্পনার কথা সহজে ভোলার উপায় নেই। এমনি একটি দৃশ্য বিরাট কাছিমের সাথে নাড়–র মরণপণ যুদ্ধ, কী অপূর্ব আলোর-কাজ ও দৈহিক-অভিনয়, যা মনে করিয়ে দেয় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি¬ চলচ্চিত্রের ওল্ডম্যানের সাথে ডলফিন ও হাঙ্গরের লড়াইয়ের দৃশ্যকে। এমনি সৃজনশীল পরিকল্পনা দেখা যায় মোরগের লড়াই, ভেড়ার লড়াই, চেঁওয়া মাছ ধরা ও জ্বিন তাড়ানোর দৃশ্যে। এক কথায় নাসির উদ্দিন ইউসুফ আমাদের বহুমাত্রিক অথচ সুশৃঙ্খল, সুবিন্যস্ত ও সুচিন্তিত এক প্রযোজনা উপহার দিয়েছেন। সেলিম আল দীনের রচনার মতো নাসির উদ্দিন ইউসুফের হাতহদাই নির্দেশনাকেও একটি বড় কাজ মনে করি। হাতহদাই প্রযোজনার সহজ-সরল বিস্তৃত মঞ্চসজ্জা ও আলোকপরিকল্পনা সহজ-সৌন্দর্যে তার প্রাপ্য জায়গা করে নেয়। দৃশ্যসজ্জা, আলোকপরিকল্পনা, পরিচ্ছদপরিকল্পনা ও রূপসজ্জার যথার্থতা পেশাদারিত্বের স্বারকবাহী। তবে মঞ্চে প্রথম আত্মপ্রকাশের দৃশ্যে চুক্কুনীর শাড়ির রঙ আরও উজ্জ্বল হতে পারত। চর এলাকার পুরুষদের বিশেষ ঢঙে লুঙ্গি পরাটা এই প্রযোজনার অনেক ডিটেইলের সাথে যুক্ত হয়ে আলাদা মাত্রিকতা দান করে। এই প্রযোজনায় যান্ত্রিকশব্দ ও সংগীতের উৎসকে পরিহার করা হয়েছে। নাটকের কুশীলবেরা মঞ্চের বিভিন্ন স্থান যথার্থভাবে ব্যবহার করেছেন। এ সবই নির্দেশনার কৃতিত্ব। এই প্রযোজনার অন্যতম শ্লাঘার বিষয় হলো, নির্দেশকের উপস্থিতি কোথাও উচ্চকিত নয়, তিনি নিঃশব্দে-নীরবে মিশে আছেন সমগ্র নাট্যক্রিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নাট্যকার ও নির্দেশক দুজনে মিলে হাতহদাই-এর প্রতিটি চরিত্রকে পর্যবেক্ষণের বিষয় হিসেবে গড়ে তুলেছেন। হাতহদাই নাটকের দলগত অভিনয় নিটোল-নিচ্ছিদ্র। বেশিরভাগ কুশীলব নোয়াখালীর বাসিন্দা না হয়েও, নোয়াখালীর আঞ্চলিক-ভাষার মতো দুরূহ আঞ্চলিক-ভাষা, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া, ভালোই রপ্ত করেছেন। রাইসুল ইসলাম আসাদ সত্যনিষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ইতোমধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। আনার ভা-ারির চরিত্রে, হাতহদাই নাটকে তিনি আমাদের উপহার দেন এক গভীর, নিবিষ্ট ও সত্যানুসন্ধানী অভিনয়। এমনি সমৃদ্ধ উপস্থিতির সাক্ষাৎ পাই আমরা শিমূল ইউসুফ, শহীদুজ্জামান সেলিম, শতদল বড়ুয়া, সুভাশীষ ভৌমিক, কৌশিক সাহা, সাবেরী আলম, জহিরউদ্দিন পিয়ার প্রমুখের নিজ নিজ চরিত্র-আত্মস্থতায়। অভিনয়ে সব কুশীলবেরা প্রায় সমান পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন, যদিও চা দোকানদারের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন তাঁকে ইষৎ দুর্বল মনে হয়েছে। একক কোরাস-চরিত্রে উচ্চারণের শুদ্ধতা ও স্পষ্টতার কারণে সাবেরী আলমকে সফল মনে হয়েছে। অশুদ্ধ ইংরেজি ও নোয়াখালীর ভাষার রসোগ্রাহী সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন শহীদুজ্জামান সেলিম তার অভিনয়ে। এমনিতেই এ নাটকের ব্যঙ্গকৌতুকময় সংলাপ দর্শক-শ্রোতাকে প্রভূত আনন্দ দিয়েছে।
সব শেষে বলব, মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী সত্য জেনেও মৃত্যুর মুখে তুড়ি মেরে হাতহদাই প্রযোজনায় জীবন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। এই কৃতিত্ব সামগ্রিকভাবে ‘ঢাকা থিয়েটারে’র। তাদের অকুণ্ঠ সাধুবাদ জানাই।
আতাউর রহমান (
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
): নাট্যব্যক্তিত্ব