Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: চাকা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: চাকা। রচনা: সেলিম আল দীন। মঞ্চ-আলোকপরিকল্পনা ও নির্দেশনা: সৈয়দ জামিল আহমেদ। পোশাকপরিকল্পনা: রাশাদুল হুদা। আবহসংগীতপরিকল্পনা: শিমূল ইউসুফ। পোস্টার ডিজাইন: আনওয়ার ফারুক। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৯১। একটি ‘ঢাকা থিয়েটার’ প্রযোজনা
[ঢাকা থিয়েটারের চাকা- শিরোনামে নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন ইশরাত নিশাত। ‘পাক্ষিক তারকালোক’-এর ১-১৪ জুন ’৯১ সংখ্যায় এটি ছাপা হয়। ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
কাল-প্রবাহের প্রাকৃতিক আয়োজন জন্ম-জীবনসংগ্রাম-মৃত্যু। পৃথিবীর সমতা রক্ষায় এই তিন শর্তই মানুষকে আত্মস্থ করতে হয়। মানুষ; জন্মকাল থেকেই যাকে মৃত্যুর দুর্লঙ্ঘ আকর্র্ষণের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম সম্পন্ন করতে হয়। একটিমাত্র জীবনে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যে প্রকারেই স্থাপন করা হোক, ভ্রুণ, সে এক অথচ পবিত্র অনুভূতি নিয়ে কেন সকলকে নাড়া দেয় না। বেঁচে থাকা সময়টুকু কেবলই মৃত্যুর দিকে টান দিয়ে নেয়, তবুও মানুষ বারবার জীবনকে সওদা করে আনে অচিন মৃত্যু দরিয়া থেকে। কিন্তু জন্মাবধি যে মানুষ অবিশ্রাম শ^াস গ্রহণের সংগ্রামে স্থিতি চায় নি কখনো, প্রকৃতির অমোঘ আকাক্সক্ষায় যার স্থাপনা হতেই মানুষের সঙ্গসুখ, সে জীবনের চাকায় জড়িয়ে বহু খাদ-প্রান্তর পেরিয়ে অনাকাক্সিক্ষত ঘুম পাড়ানিয়া চরে কী ভীষণ অসহায় একা এক লাশ।
কেরামতমঙ্গল, হাতহদাই, চাকাÑভ্রুণ, বাঁচা, লাশ- নাট্যবিত্তসম্পন্ন নাট্যকার সেলিম আল দীন পৃথিবীর তিন শর্ত তিনটি নাটকের মাধ্যমে অন্তরের গহীন গোপনে খোঁচা দিয়ে রক্তাক্ত করে তুলতে পেরেছেন পাঠকের, দর্শকের। যে কোনো নাট্যকারের মনে ঈর্ষা জাগবে, ইচ্ছের জন্ম হবে তীব্র জীবনবোধের, যদি সেলিম আল দীনের লেখনীশক্তির বহিঃপ্রকাশিত নাট্যশরীরে অবগাহন করা যায় অনুভূতির দেহ।
মৃত লাশের সঙ্গী হয়ে চারজন মানুষ অনবরত চাকা ঘুরিয়ে চলেছে, লাশের সঠিক ঠিকানায় স্বজনের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু, অনাকাক্সিক্ষত ক্রন্দনে শোকের বাতাসকে আলোড়িত করবে এই ভাবনা নিয়ে। কিন্তু লাশ- মৃত মানুষের শরীরে আত্মা থাকে না, আর তার গন্তব্য অতি প্রাচীন এক অজানা ঠিকানা। তাহলে লাশের আত্মীয় কিংবা ঠিকানা খুঁজে খুঁজে পরিশ্রান্ত জীবিত মানুষগুলো কী পাবে? নয়ানপুর, নবীনপুরের জীবন্ত মানুষেরা আত্মজনের লাশ নয় জেনে সহজ-প্রশান্তি গায়ে মাখে। মাত্র পঞ্চাশটি টাকার জাগতিক-সুখের আশায় বাহের গাড়োয়ান যে লাশ বহনে স্বীকৃত হয়েছিল কিংবা জীবনাভিজ্ঞ প্রৌঢ় অথবা কী হয় জানতে আগ্রহী শুকুর চান, আত্মসুখে নিমগ্ন আইন কুঠরীর ভয়ে ভীত দুগ্রামের মানুষের লাশ সনাক্তকরণে অপারগতায় চক্রব্যুহে আবদ্ধ হয়ে যায়। কারণ, হোক অজানা অচেনা তবু তো মানুষের লাশ, তাই পথের ধারে অবহেলায় ফেলে যেতে পারে না মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষেরা। লাশের পচন-ধরা শরীরের গন্ধ-বাহিত বাতাস ডেকে আনে শেয়াল, কুকুর আর পিঁপড়ের সারি। বাহের গাড়োয়ানের সহ্য হয় না, বিপুল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে সঙ্গী লাশের শরীরকামী পিঁপড়ের ওপর। মৃত মানুষের শরীর জাগতিক সকল চাহিদায় নিরুৎসুক, কিন্তু জীবিত মানুষের ক্ষুধা অবিচলিত প্রশ্ন হয়ে বারবার বেঁচে থাকার মৌলিক শর্ত স্মরণ করায়। পথসঙ্গী অচেনা বন্ধুর লাশ বহনকারীরা পবিত্র মানসিক বিত্তে ভরপুর হয়ে অবশেষে দাফন করে বিস্তীর্ণ বালুচরের মাত্র তিনহাত মাটির সীমায়। বালুচরের মাটি তিনটি অচিন মানুষের কিছু অশ্রুক্ষরণ নির্বাক হয়ে গ্রহণ করে। অচেনা মানুষের শরীর হয়ে যায় স্বজনের লাশ।
এই গল্প দৃশ্যকাব্যরূপে চাকা হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে দর্শকের কাছে চলে আসতে পারে। কারণ, নির্দেশক জামিল আহমেদ ফাঁকি দিতে চান নি নিজেকে অথবা দর্শককে। নাটকের শরীরকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে চিত্রিত করার কষ্ট সাধনায় তিনি উপযুক্ত ব্যক্তিদের সাধনসঙ্গী হিসেবে লাভ করেছেন। তবে জানতে ইচ্ছে করে, কচ্ছপ, হাঁস, কেঁচো, কাঁকড়ার আসা যাওয়া কি নাট্যশরীরের আরো স্বচ্ছন্দ অংশ করে তোলা যেত না? এই নাট্যাংশটুকু কি আরেকটু তীক্ষ্ম স্পর্শ লাভ থেকে বঞ্চিত হয় নি অন্যান্য অংশের তুলানায়? সচেতন নির্দেশক জামিল আহমেদের বেশিরভাগ প্রযোজনায় অভিনেতারা বেশ দ্রুত সংলাপ প্রক্ষেপণ করেন। হয়ত নির্দেশক নাটককে গতিসম্পন্ন করতেই এই বিশেষ ধারায় অভিনয়কে পরিচালিত করেন। তবে কিছু অভিনেতা দ্রুত সংলাপ উচ্চারণ করতে গিয়ে অনেক সময় কথাগুলো এমন জড়িয়ে ফেলেন যে. সেগুলো কথা না হয়ে শুধু দুর্বোধ্য কিছু শব্দে পরিণত হয়। চাকা নাটকেও দু-একটি চরিত্রের সংলাপ তেমনি কিছু জটিলতায় আক্রান্ত। বিশেষত ধরমরাজ চরিত্রের অভিনেতা একটু পাশ ফিরলেই শব্দ শুনে সংলাপ বোঝার দায়িত্ব নিজেরই বহন করতে হয়।
মঞ্চপরিকল্পনা এবং ব্যবহারে জামিল আহমেদ সত্যিই এক সম্পদশালী মানুষ। মঞ্চের প্রাকৃতিক রঙ সারাক্ষণ উন্মুক্ত দর্শকের দৃশ্যচিত্র-নির্মাণী কল্পনার রঙ তুলির কাছে। অভাবনীয় গভীরতায় দর্শকের আবেগকে সার্থকভাবে সংক্রমিত করেছে মঞ্চ ও আলোকপরিকল্পনা এবং প্রক্ষেপণ। চরিত্র বা ঘটনা বিশেষায়িত করার উদ্দেশে নির্মিত প্রোজেক্টরবিহীন জীবন্ত চতুষ্কোন ফ্রেম প্রয়োজনীয়তার দাবি রাখে। তবে পর্দাটির ওঠা-নামায় কর্কশ শ্রবণযন্ত্রণা দূর করা গেলে ভালো হয়। লাশ হিসেবে ব্যবহৃত আঁকাবাঁকা গাছের ডালটি হৃদয়গভীরে আলোড়ন তুলে দেখিয়ে দেয়, যে জীবন মানব শরীরে ধারণ করে থাকে সে জীবন কত উঠন্ত-পড়ন্ত বিকেলের কষ্ট-সোহাগ-মাখা।
“আমি কথার শাসনে নাটক রচনা করেছি তাই এর নাম দিয়েছি ‘কথানাট্য’। একে ‘কথকতা’ও বলাা যায়। কিন্তু কথকতা অভিনয়রীতির নাম, নাট্যরীতির নয়।” স্যুভিনিরে লেখা সেলিম আল দীনের এই বক্তব্যকে সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিতে কষ্ট হয়। কারণ, কথকতা অভিনয়রীতির সাথে সাথে অবশ্যই একটি নাট্যরীতি।
তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিকতায় ব্রেখটের এপিক থিয়েটার ও এলিয়েনেশন প্রাচীনকাল থেকে ভারতের নাট্যরীতি ও অভিনয়রীতি হিসেবে প্রচলিত আছে পুঁথি, পালাগান, কীর্তন প্রভৃতি আঙ্গিকের মাধ্যমে। সেই ঐতিহ্যিক আঙ্গিককে চাকা নাটক রচনা ও প্রযোজনায় নাট্যকার, নির্দেশক এবং সুর ও আবহসংগীতপরিকল্পক আত্মস্থিত উপস্থাপনা করেছেন সুক্ষ্ম আধুনিকতায়। নাট্যরীতি ও অভিনয়রীতি এমনই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত যে ডিম আগে না মুরগী আগে জাতীয় তর্ক এ বিষয়ে বালখিল্যজনক।
সেলিম আল দীন ওই একই লেখায় অপর এক জায়গায় জানাচ্ছেন, “ চাকা রূপক-সাংকেতিক নাটক নয়, নিরবলম্ব বাস্তবতাও যে এর লক্ষ্য ছিল তা বলা যায় না। গল্পটি এভাবে বলতে ভালো লেগেছে সেভাবেই বলা”। খুব স্বাভাবিক। সৃষ্টির আগে ব্যাকরণ নয়, তাই সৃষ্টির পর চাকা কথকতার নাট্য ও অভিনয়রীতিতেই পড়েছে। সেক্ষেত্রে গল্পটি যেহেতু পুরাণ বা লোকগাথা নয়, সেহেতু একে শাস্ত্র বলা যাবে না। কিন্তু রামায়ন আহৃত ঘটনা না হলেও চাকাকে কথকতার আঙ্গিকে এক আধুনিক নাট্য-নির্মাণ হিসেবে উল্লেখ করতে হবে।
সেই সত্য অনুধাবনে নির্দেশক জামিল আহমেদ, সুর ও সংগীতপরিকল্পনাকারী এবং সূত্রধার চরিত্র দৃশ্যমানকারী অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ সঠিক পারঙ্গমতা প্রকাশ করেছেন। তবে নাট্যআঙ্গিক অনুযায়ী চরিত্রটির নাম সূত্রধারের পরিবর্তে কথক হওয়াই উচিত ছিল। কথক শিমূল ইউসুফ পুরো নাটকটি শুরু থেকে শেষপর্যন্ত সার্থকভাবেই বহন করেছেন। তাঁর অভিনয়-উৎকর্ষতার মধ্যগগনে অবস্থান দেখে সহজেই উপলব্ধি করা যায়, উচ্চমার্গীয় অভিনয় আয়ত্তে আনার সাধনায় তিনি সফলকাম হবেন। শিমূল ইউসুফ ইডিয়ট বক্সের সস্তা জনপ্রিয়তা ব্যতীত মঞ্চ-নন্দিত-অভিনেত্রী হওয়ায় সব সময়ই মঞ্চে সাহায্য পাচ্ছেন ‘ঢাকা থিয়েটারে’র শক্তিশালী টিমওয়ার্কের।
এই ‘ঢাকা থিয়েটারে’র নাটকর্মী সেলিম আল দীন লেখকের কথায় লিখেছেন, “পূর্ব-পুরুষের সমৃদ্ধ ক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কৃষকের সাহস বাড়ে। নইলে একজন গায়েন আমার হাতের লেখায় সত্তর/বাহাত্তর পৃষ্ঠার নাটক গাইবেন, এ ধারণা ইউরোপীয় ধাঁচের নাটক থেকে পাওয়ার কথা নয়”। লেখার এই অংশটুকু পড়ে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। ‘দেশ নাটকে’র আমন্ত্রণে তৃতীয় থিয়েটারের প্রবক্তা বাদল সরকার ঢাকায় একটি সেমিনারে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে একজন প্রশ্নকারী জানতে চান, তৃতীয়বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্রেখ্টের এপিক ও এলিয়েনেশন ফর্ম কি যথেষ্ট নয় যে, তৃতীয় থিয়েটার সৃষ্টি করে যে কোনো স্থানে নাটক করার প্রয়োজন পড়বে? প্রশ্নটির উত্তরে বাদল সরকার স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘আমার বিশ্বস ব্রেখ্ট যদি এখন তৃতীয়বিশ্বের এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবেশে থাকতেন তাহলে তিনিও প্রসেনিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে এভাবেই নাটক করতেন’।
ইশরাত নিশাত: অভিনেত্রী-ডিজাইনার-নির্দেশক