Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: জয়জয়ন্তী
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: জয়জয়ন্তী। রচনা ও নির্দেশনা: মামুনুর রশীদ। মঞ্চপরিকল্পনা: ফয়েজ জহির। আলোকপরিকল্পনা: ঠাণ্ডু রায়হান। আবহসংগীতপরিকল্পনা: বিশ্বজিৎ রায়। রূপসজ্জা: নূরুল হক ও আমিনুল এহসান দীপু। পোস্টার ডিজাইন: ধ্রুব এষ। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৯৫। একটি ‘আরণ্যক নাট্যদল’ প্রযোজনা
[জয়জয়ন্তী নাটকের এই নাট্যসমালোচনাটি রামেন্দু মজুমদার-সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ পত্রিকায় (২১ বর্ষ, ১ ও ২ যৌথসংখ্যা, ১৯৯৮) ছাপা হয়। ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
‘আরণ্যক নাট্যদল’-এর মূল-ঘোষণা হচ্ছে, ‘নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণী সংগ্রামের সুতীক্ষ্ম হাতিয়ার’। দলের এই শ্রেণিসংগ্রাম এবং শ্রমনির্ভর-মানুষের প্রতি পক্ষপাত ঘোষণাপত্রে উচ্চারিত থাকলেও জয়জয়ন্তী নাটকের প্রধান-চরিত্রসমূহ গড়ে উঠেছে শ্রমবিমুখ মানব-সম্প্রদায়কে নিয়ে, যা ‘আরণ্যকে’র অহঙ্কারকে দ্বন্দ্বময় করে তোলে।
পলিবাহিত এই ব-দ্বীপের মানুষের অন্তঃস্থলে যে বৈষ্ণবীয় সহজিয়া সুর আছে, তাকে নাট্যকার এই নাটকের প্রধান-সুর হিসেবে বিবেচনায় এনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক যে করুণ কাব্যগাথা, তাকে একত্রে বিন্যাস করার প্রয়াস গ্রহণ করেছেন। বাঙালির অন্তরের কীর্তনিয়া সুরকে নাটকের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত প্রবাহিত করেছেন। নাটকের শুরুতে যে কীর্তনিয়া সংগীতের আসর, সেখান থেকে সমাপ্তি-পর্যন্ত এই করুণসুর বাজতে থাকে। বেহালায় কান লাগিয়ে দুলালের গুরু নবদ্বীপ শোনে বেহালার অন্তরের করুণ রাগিনী; অন্যদিকে, মানবতার প্রতীক যে দুলাল, মানবতার অপমানে মৃত-দুলালের বিদেহী আত্মা, লজ্জায় অবনত। এই প্রতীকী উপস্থাপন নাটকের শিল্পগুণকে বাড়িয়ে তুললেও নাটকের নাম জয়জয়ন্তী বিতর্কিত থেকে যায়। নাটকের বিজ্ঞাপনে বলা আছে বিজয়ের শোকগাথা জয়জয়ন্তী। ‘বিজয়ের শোকগাথা’ কী করে হয়? বিজয় একটা জাতির জন্যে বীরত্বের, প্রাপ্তির, মর্যাদার- শোক সেখানে সামান্য, তা ব্যক্তিক অনুভব। বিজয়ী জাতি শহিদের জন্য মর্যাদাবোধ করবে, গৌরববোধ করবে- মর্যাদা-গৌরব-সম্মানবোধ এই ক্ষেত্রে একটি বিজয়ী জাতির প্রধান অনুভব, প্রান্তীয় অনুভব হচ্ছে শোক- তা কোনোমতেই প্রধান অনুভব নয়। একজন শ্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকর্মকে শুধুই ব্যক্তিক অনুভবের বাহন করবেন- তা প্রতাশিত নয়।
মূলমঞ্চ-পরিকল্পনার ব্যাপ্তি ও অভিনবত্ব দেখে প্রতীতি হয়েছিল জয়জয়ন্তীর পটভূমি হবে বিশাল, বিরাট ক্যানভাসে এতদিন পরে একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক মঞ্চস্থ হবে। মূলত মঞ্চটি বাংলাদেশের মানচিত্রের আদলে নির্মিত হলেও তার বিষয়বস্তু সমগ্র বাংলাদেশকে ছুঁয়ে যায় নি। নাট্যকার একটি বিশেষ-সম্প্রদায়ের মধ্যে নাটকের ঘটনাকে, ভাবকে সীমিত রেখেছেন। এই নাটকের ঘটনায় ১৯৪৭-এর উল্লেখ থাকলেও ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত সময়ে বাঙালিদের বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের সমগ্র মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে নাট্যকার স্পর্শ করতে পারেন নি। বরং ঘটনাবিন্যাসে সম্প্রদায়-বিশেষে একক-কেন্দ্রিক ছিলেন। বাংলাদেশ-নামক ভূখণ্ডে শ্রমবিমুখ, মানে ভাবুক-সম্প্রদায় যেমন বাস করে তেমনিভাবে শ্রমনির্ভর মানুষও বাস করে। দুটিই সত্য। জয়জয়ন্তী নাটকের বহিরাবরণকে ব্যাপ্ত-বিস্তৃত করলেও এর অন্তরাবরণকে উন্মুক্ত ও ব্যাপ্ত করতে পারেন নি নাট্যকার। যেমনটি ঘটে নি মঞ্চবিন্যাসের ক্ষেত্রেও। মূলমঞ্চটি বাংলাদেশের মানচিত্রের আদলে নির্মিত বলে মঞ্চ ঘিরে তিনদিকের দর্শকের আসনকে বলা যায় বাংলাদেশের তিনদিকে বিশাল স্থলভূমি। তাই পুরো মিলনায়তন, সেক্ষেত্রে দর্শকও মঞ্চের আওতায় এসে যায়। সে বিচারে মঞ্চের চতুর্থদিক অর্থাৎ জলসীমানা, সেদিকে কালো রঙের পর্দার ব্যবহারের ফলে সমুদ্র বা জলসীমানার যে শুভ্রতা ও সুদূরের ইমেজ তাকে বন্ধতা দিয়েছে। এটি মঞ্চপরিকল্পনার ত্রুটি বলা যায়। যদি মনে করা হয় ‘কালো’ শোকের প্রতীক, তা দর্শক মানতে অবশ্য বাধ্য। কিন্তু সমগ্র-মিলনায়তনে কালোর ব্যবহার আর মঞ্চের চতুর্থপাশ্র্বটি যদি শুভ্র হতো তাহলে এই বৈপরীত্য দর্শককে আরও সাড়া দিতে সমর্থ হতো। সেক্ষেত্রে কীর্তনিয়াদের পোশাক শুভ্র হতে পারে, হতে পারে গেরুয়া অথবা আকাশনীল (উদারতার প্রতীক)। মঞ্চনির্মাণে মঞ্চপরিকল্পক গ্রিক রোমান ও সংস্কৃত নাট্য থিয়েটার বা রঙ্গালয়ের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। সেক্ষেত্রে তিনি সংস্কৃত রঙ্গালয়ের ত্রিকৌণিক মঞ্চ, রোমান ধাঁচের কেইভ অডিটরিয়াম এবং গ্রিস ধাঁচের অর্কেস্ট্রা-ভূমি সহযোগে নবরূপে যুগোপযোগী করে মঞ্চনির্মাণ করলেও নাট্য-নির্দেশক নাটকের কোরিওগ্রাফির ক্ষেত্রে আবদ্ধ ছিলেন প্রসেনিয়াম থিয়েটার ধাঁচে। তিনদিক বন্ধ একদিক খোলা প্রসেনিয়াম থিয়েটারের রীতির কোরিওগ্রাফিসমৃদ্ধ ত্রিকৌণিকমঞ্চে দর্শক নাটক দেখতে গিয়ে একদিকের দর্শক পুরো নাটকটি উপভোগ করতে পেরেছে আর বাকি দুদিকের দর্শক মঞ্চায়নের প্রোফাইল দেখেছে মাত্র। পুরো নাটক নিয়ে যে সামগ্রিকমঞ্চায়ন তা দেখতে পায় নি। তাই বলা যায়, মঞ্চের অবস্থান ও দর্শকের আসনবিন্যাসের সঙ্গে নাট্য-অভিনয়রীতি সাদৃশ্যপূর্ণ নয়, অথচ সুযোগ ছিল। মঞ্চে ঘটনার স্থান নির্দেশে বা ঘটনা উপস্থাপনে নির্দেশক মিশ্ররীতি ব্যবহার করেছেন। কখনো ব্যবহার করেছেন রিয়ালিস্টিক, কখনো সাজেস্টিভলি রিয়ালিস্টিক পদ্ধতি।
মুক্তিযোদ্ধা মানেই চাদর পরিহিত ভীত-সন্ত্রস্ত যুবকের পদচারণা, বিটিভির নাটকে বহুলব্যবহৃত চরিত্রায়ন মঞ্চের জন্যেও টাইপড। আর যোদ্ধা মানেই ছাত্রসমাজ- এই খণ্ডিতউপস্থাপন ইতিহাস খ-নের ব্যথা জাগ্রত করে। সর্বস্তরের জনগণ, সর্ববয়সের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। অন্যদিকে পালাগানের ধরনে, যাত্রার রঙঢঙে পদ্ধতিতে যুদ্ধকালীন সময়ে রাজাকারের সরাসরি যুদ্ধ করবার দৃশ্যের ইংগীতময় উপস্থাপনা ইতিহাসসিদ্ধ নয়। রাজাকার অর্থাৎ সাহায্যকারীরা মানে দালালেরা সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছিল যুদ্ধ দিয়ে নয়, জনসংযোগ দিয়ে- ইতিহাস-বিকৃতি ঘটানো ঠিক নয়।
এই নাটকে প্রশংসাযোগ্য স্থান হচ্ছে মীরার ধর্ষিত হবার প্রসঙ্গ উপস্থাপন। এখানে প্রতীকী উপস্থাপনে নির্দেশক ধর্ষণের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে ঘটনার বাস্তবতাকে নির্মাণের যে শিল্পসুদ্ধতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা বোধ করি দর্শক অনেকদিন মনে রাখবেন। অন্যদিকে রাজাকার কাবিলের বিধবা স্ত্রীকে ঝলমলে সাদা শাড়ি লাল পাড় (সুতি নয়) পরানো কি চরিত্রের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত? একজন রাজাকারের স্ত্রীর কি স্বামী-শোকেরও অধিকার নেই? অথচ কাবিলের স্ত্রীর সাধারণ-পোশাকে ফৌজপ্রধানের বিরুদ্ধাচরণ যেমন নাট্যকারকে পক্ষপাতের অভিধা থেকে মুক্তি দিত, তেমনি তিনি একজন স্রষ্টা হিসেবে এই ক্ষেত্রে খণ্ডিত হয়ে পড়তেন না। ইন্দ্রনাথ চরিত্রের কাটা-হাতের মেকআপ ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তার কাটা হাতে পাতলা সাদা কাপড় ব্যবহার করার ফলে হাতের উপর আলো পড়ায় আঙ্গুলের অস্তিত্ব দর্শক উৎকটভাবে টের পাচ্ছিল। মীরার হত্যার পর মীরার বাবার বেহালা-হাতে কান্নার দৃশ্যে আবহসংগীতে হারমোনিয়ামের ব্যবহার ঠিক বোধগম্য ও সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হচ্ছিল না। বিপরীতে মনে পড়ছিল সত্যজিৎ রায়ের চিত্রিত পথের পাঁচালীতে দুর্গার মৃত্যুসংবাদ শ্রবণে হরিহরের কান্নার দৃশ্য চিত্রায়ণ- হা হতোস্মি বৈপরিত্য।
সবশেষে বলা যায়, মঞ্চের পাটাতনে ধূসর রঙের ব্যবহার কি বিষণ্নতা নাকি বৈরাগ্য নাকি রিক্ততার প্রতীক? তা হলে আবার নাটকের নাম নিয়ে মনে সংশয় জাগে। সঙ্কটে পড়ি- এতদিনকার পরিচিত বস্তুবাদী নাট্যকারের ভাববাদী নাট্য-অভিযাত্রায় তাঁর শিল্প-সম্ভাবনাকে কোন অভিধায় ভূষিত করা যায়!
জয়জয়ন্তী রচনা ও নির্দেশনায় মামুনুর রশীদ। সহকারী নির্দেশক মান্নান হীরা। ডিজাইন ও মঞ্চনির্মাণে ফয়েজ জহির এবং তাঁকে সহযোগিতা করেছেন চন্দন, লিটু, ইমন, মিঠু ও রিপন। আলো- ঠাণ্ডু রায়হান। সংগীত- বিশ্বজিৎ রায়। অভিনয়ে- ফজলুর রহমান বাবু, মুন্সী মজনু, সুজিত বড়ুয়া, সাইফুজ্জামান শামীম, দিলয়ারা দিলু, শাহজাহান কবীর বাবু, এজাজ মুন্না, মান্নান হীরা, প্রদীপ সরকার, চন্দন চৌধুরী, জয়রাজ, সারোয়ার চৌধুরী, সৈয়দ মোশাররফ, ফয়েজ জহির, সাগর, মিরাজ মামুন, দিলু মজুমদার, মোমেনা চৌধুরী, রহমান রুক্কু, লিপি প্রমুখ।
অরাত্রিকা রোজী: নাট্যসমালোচক