Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: সক্রেটিসের জবানবন্দী

Written by বিপ্লব বালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

নাটক: সক্রেটিসের জবানবন্দী। রচনা: শিশিরকুমার দাশ। পোশাকপরিকল্পনা ও নির্দেশনা: রাজু আহমেদ। মঞ্চপরিকল্পনা: হাসান শাহরিয়ার। আলোকপরিকল্পনা: ঠাণ্ডু রায়হান। আবহসংগীতপরিকল্পনা: আলী মাহমুদ। রূপসজ্জা: জীবন উদ্দিন লাল। পোস্টার ডিজাইন: পারভেজ চৌধুরী। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৯৭। একটি ‘দৃশ্যপট’ প্রযোজনা

[‘দৃশ্যপট’ (আদি নাম ‘জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার-ঢাকা’) প্রযোজনা সক্রেটিসের জবানবন্দী নিয়ে নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন বিপ্লব বালা। লেখাটির শিরোনাম ছিল- সক্রেটিসের জবানবন্দী : অভিনয়ে অভিনব মুক্তি। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ৩য় সংখ্যায় (১৯৯৯ সালে প্রকাশিত) এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]

ভালো নাটক করার একটা ধারা নবীন দলগুলোর মধ্যে গড়ে উঠেছে। তার ফলে একেবারে মৌলিক হবার রোখও কাটছে। সংস্কৃত-হিন্দি-মারাঠি ভালো নাটকের অনুবাদ-রূপান্তরও হচ্ছে। আর সেই কাজে অসামান্য মুন্সিয়ানার পরিচয়ও পাওয়া যাচ্ছে। ‘কোর্ট মার্শাল’ যে রূপান্তর-নাটক সহজে তা মনে করা যায় না। তাছাড়া একের পর এক ভারতীয় পুরাণ-উপকথা নিয়ে লেখা নাটকও যে হচ্ছে তাতে অন্য রকম একটা তাকদ বোঝা যায় নবীন প্রজন্মের দলের, নির্দেশকের। যা নিয়ে বড় দল সাতবার ভাবতো সহজেই ছোটরা তা করে ফেলছে, এতে তারুণ্য-যৌবনের একটা শক্তিমত্তা ঠাহর করা যায়। ভেবে ভেবে ভয় পেয়ে কেবল পিছিয়ে গিয়ে দুহাত-তোলা মান্যতা তাদের না করলেও বুঝি চলে। তাই দেখি, যযাতি, হয়বদন, মাধবী, নাগম-ল হচ্ছে ঢাকার মঞ্চে। একসময় ত এমনই অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে মনে  হতো, নাটকের পাত্রপাত্রীদের ধূতি পরাটাও যেন একটা বৈপ্লবিক ঘটনা। এমনভাবে বিষিয়ে তোলা হয়েছিল পরিবেশ, সমাজমন। ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতো সকলে- এই বুঝি সমালোচনা হয় পত্রিকায়, সভাসমিতিতে, ব্রাহ্মণ্য হিন্দুয়ানি করা হচ্ছে বলে।

সক্রেটিসের জবানবন্দী করার মধ্যেই একটা ভিন্ন রুচিবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। বিশেষত দলটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়-ফেরত ছেলেমেয়েদের দল। খুব বেশিদিন তো কাজ তারা নিশ্চয় করছে না। জ্ঞানীর পুরাণকল্প চরিত্র সক্রেটিস। তাঁর সেই প্রবাদপ্রতিম জবানবন্দীর নাট্যরূপায়ণ, বিষয় হিসেবেই তা বর্তমানে যেন মহা ‘অপ্রাসঙ্গিক’, ‘হাস্যকর’- এমনকি ‘সৌখিন বিলাসিতা’ও বলা যেতে পারে। এবং এই অবস্থা কেবল বাংলাদেশ বলে নয়, সারা বিশ্বেই সমান সত্য। কতটাই যে পৌরাণিক বিষয় হয়ে গেছে ‘সত্যের সন্ধান’ বা ‘বিবেকের নীতি’র জন্য কিছু বলা বা করা! সক্রেটিসের সেইসব উক্তি-প্রবাদ ছোটবেলায় শুনে আপ্লুত হওয়া আর-সব নীতিকথার মতই বড় বেশিই ছেলেমানুষি অথবা/বড়জোর কোনো দূর কালের কল্পগাথা আজ। জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার (বর্তমানে ‘দৃশ্যপট’) এমনই এক সময়ে সক্রেটিসের জবানবন্দী করলো তাতেই তবু বুঝি আশা জাগতেই পারে, সব শেষ তাহলে হয়ত হয় নি, হয় না।

নাটকের আখ্যান-পরিস্থিতিও কেমন লাগসই। হয়তো সবসময় সবদেশের জন্যই বুঝিবা, বহিরঙ্গের হেরফের দেশকালের জন্য যতটা যা হওয়ার হয়েও। ৩০ জন মস্তান গডফাদার দখল করেছে অ্যাথেন্স; ৫০০ জনের গৃহপালিত এক সমর্থক-বাহিনী আছে তাদের; তারা ১১ জন টপ মস্তানকে ইজারা দিয়েছে। দেশ-রাষ্ট্রটি-নির্মূল করে চলে যাদের ক্ষমতাবিরোধী তাবৎ ক্রিয়াকলাপ। বুদ্ধিজীবী-ক্রয়ও একই সঙ্গে চলে। বিপদ্জনক সক্রেটিসকে কী করে কব্জা করা যায়? হুকুম হলো তাঁর প্রতি এক আসামিকে ধরে দেবার জন্য। তবে তিনি যে সক্রেটিস, তাই অপারগ হন এহেন হুকুম তামিল করতে। তখন শুরু হয় অপারেশন, যেখানে পাও নাম গন্ধ ধরে আনো। স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন অবশ্য তিনি। তাঁর প্রতি অভিযোগ হলো- যুবকদের বিপথে নেয়া আর রাষ্ট্রধর্ম-দেবতা না মানার অপরাধ। সক্রেটিসের সত্যের যুক্তিতে অভিযোগকারী হারলেও বিচারক দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে। তখনকার নিয়ম মতো নির্বাসন নিয়ে মৃত্যুদ- এড়াতে পারতেন তিনি। এমনকি পালানোর ব্যবস্থাও হয়েছিল তাঁর। তবে তিনি যে সক্রেটিস, হাসিমুখে তাই হেমলক পান করেন। মানবের এক মহিমা রচিত হয়েছিল এভাবে। সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা চক্র, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র আর লুণ্ঠনজীবী ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ মিলে রাষ্ট্রের যে ক্ষমতা-ব্যবস্থাপনা, সবদেশে সবকালে তার মৌল চরিত্র প্রকৃতি একই বুঝিবা। ভিন্নতা কেবল সক্রেটিস আর প্লেটোর দলের নানা রকমফেরে। বর্তমানকালে যার মুখ-থুবড়ে-পড়া দশা।

নাট্যভাষ্য আর তার রূপায়ণে আখ্যানটিকে একালের সঙ্গে নানা রকমভাবে যুক্ত করা যেতো হয়তো। নাট্যকার শিশিরকুমার দাশ ও নির্দেশক রাজু আহমেদ সেদিকে তত মন দেন নি। যদিও নাটকটির স্বকীয় মূল্য কমে না।

কালো পর্দায় মোড়া মঞ্চে দু-তিনটি ছোটো ত্রিভূজাকারে রাখা তল। ১১ মাস্তানের জনাকয়েক শুরুতে ঢোকে। তাদের কথাবার্তায় রাষ্ট্রপরিস্থিতি, স্বৈরাচারী-মুদ্রাসকল জানা যায়। সক্রেটিসকে ধরে আনার পাঁয়তারা চলতে থাকে। কে যে কার চেয়ে মৌলিক-মস্তান তার প্রতিযোগিতা চলে। সেই সঙ্গে মনুষত্বরহিত উন্মত্ত, জান্তব বিকার আর নপুংশক মদ্যপ বেলেল্লাপনা-ক্ষমতা-মস্তানির যা কিনা চিরকালের অমানবমুদ্রা। তবে ক্ষমতার নানা স্তরের মস্তানি চরিত্রাভিনয়ে তত বিশিষ্টতা পায় নি। পুঁচকে বা মধ্যম-স্তর মস্তানের অধিক দাপট অভিনয়ে অনায়ত্ত থেকেছে। হাঁটা চলাফেরায় বা হাতের বিচিত্র কোণের বিস্তারভঙ্গি ব্যক্তির ক্ষমতাপরিচয়কে মধ্যবিত্ততার ওপরে নিতে পারে নি। রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতামত্ত প্রতিনিধির প্রতীকচরিত্র তার ফলে তত স্পষ্টতা পায় নি। ব্যক্তিত্বে ওসি-এসপির ওপরে উঠতে পারে নি কেউ। অথচ আমাদের স্মৃতিতে আছে ডালিম-রশিদ-ফারুকদের মস্তানির স্মৃতি-অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ একালের জান্তব উন্মত্ততার আর্কেটাইপ তো আমাদের নিকট ইতিহাসেই আছে। অভিনয়ে তা যেন তত ব্যবহার করা যায় নি। আর, প্রথমার্ধে মঞ্চের তল তিনটির উচ্চতা, অবস্থান ও ব্যবহার পদ্ধতিতে ছিল মনে হয় গোলমাল- কেউ তাতে চড়লে দৃশ্যমূল্য প্রায়ই বাড়ে নি। অন্য অভিনেতার সঙ্গে মিলে ক্ষমতাবিন্যাসের নানা মুহূর্ত তেমন তৈরি হয় নি। চতুর্দিক মোড়ানো কালো পর্দা, পোশাকে রঙের যে বুনন, মেজাজ এবং মঞ্চে গতিময়তার নানা আকার ও ঘনত্ব বিন্যাসে বিচিত্র নাট্যমুহূর্ত তত গড়ে ওঠে না। একেবারে শেষ দৃশ্যে রায় ঘোষণার পরে সক্রেটিস এবং আর-সকলকে নিয়ে যেমন আলোছায়ার এক দৃশ্যছবি তৈরি হয়।

মস্তান-চরিত্রাভিনেতারা বাকছন্দের জীবন্ত ভঙ্গি-ভিত্তি পেতে পেতেও পায় নি মনে হয়। সংলাপের বাক্যগঠন আর শব্দ ব্যবহার কিছুটা হয়তো এর জন্য দায়ী। তাতে বাংলাদেশীয় বাকমুদ্রা সর্বদা স্ফূর্তি পায় নি। একটু-আধটু পাল্টে নিলে হয় শব্দ, বাক্য। যদিও সংলাপ বেশ ঝরঝরে। বলাও হয়েছে যতœ করে। নির্দেশক এদিকে মন দিয়েছেন বোঝা যায়। তবে স্বর-সুরে কখনো খানিকটা কলকাতার ছাঁট লেগেছে। সেটা হয়তো সংলাপ গঠন ও নির্দেশকের কলকাতাবাসেরও অচেতন ফল। বলার গতি নিয়েও আর একটু ভাবতে হবে। এমনিতে ঢাকার অভিনেতারা দর্শককে তত গুরুত্ব দেয় না। তারা কী শুনলো না শুনলো, কী বুঝলো, কেমন কতটা কী সেটা তেমন ধর্তব্যে সাধারণত আনে না। তার ফলে যোগটা ঠিক ঘটে না। থিয়েটার তৈরি হয়ে ওঠে না। দর্শক-অভিনেতা পারস্পরিক ক্রিয়ায়ই তো গড়ে ওঠে নাট্য। এটার প্রয়োগের দিকে সযত্ন মনোযোগ তেমন দেখা যায় না। তাই বলছি, ভালো করে বলাটি ঠিক করতে গিয়েই কিন্তু দর্শকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে হয় অভিনেতাকে। এই দিকে আর একটু যেন মন দেয়া হয়। চেষ্টাটা যদি থাকে কী করলে ঠিক ঠিকভাবে যা কিছু বলার, প্রকাশের তা দর্শকের মনে ক্রিয়া করবে, তাহলেই পথ তৈরি হবে- কীভাবে কী করতে হবে। বাস্তব জীবনে যেমন আমরা গুরুত্বপূর্ণ কাউকে বলতে বোঝাতে সামগ্রিক এক চেষ্টা-মনোযোগে একাগ্র হই এবং তাতেই বুঝে যাই কীভাবে কী বলবো না বলবো। দর্শককেও সাধ্যমতো বলা বোঝানো, ক্রিয়া বা কম্যুনিকেট করা, সঞ্চার করা অর্থ-ভাব, এটা চাইলেই ক্রমে শিখে নেয়া যাবে রীতিপদ্ধতি। কেবল চাই এই বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া, দর্শককে মূল্য দেয়া। সম্পর্কবোধ করা, জানা-বোঝা-অনুভব করার নিরন্তর চেষ্টা করা, কীভাবে মানুষজনের মনে ক্রিয়া করা যায়, সঞ্চার করা যায় অনুভূতি-চিন্তা।

মাতাল-মস্তানটি বা ধোপা-সক্রেটিস বা শেষদৃশ্যের অভিযোগকারী ভাঁড়-রাজনীতিবিদ-হাস্যরসিকতা করেছেন যারা, তারা বেশ ভালো, স্বচ্ছন্দ বলতে হবে, বাড়াবাড়ি না করে একেকটা ধরন বার করেছেন চরিত্রের, ব্যক্তির। তবে সবচেয়ে বেমানান প্লেটো। নবীন কাঁচা অভিনেতাটিকে এমন একটা আর্কেটাইপ-চরিত্র দেয়া কি ঠিক হয়েছে? যতই কেন যুবা-বয়সের হোক প্লেটো তবুও বিশিষ্ট এক ব্যক্তিসত্তার অভিনয়ই তো করতে হবে। কথাগুলোই স্পষ্ট করে বলতে পারে নি অভিনেতা। আর কান্নার জায়গাটি তো হয়ই নি।

তবু সব মিলে এটা একটা মধ্যম মানের ভালো প্রযোজনা হতে পেরেছে। ধন্যবাদ নির্দেশক রাজু আহমেদ।

একটি কেবল প্রবল ব্যতিক্রম আছে, যার তুলনা ঢাকার মঞ্চে পাওয়া দুষ্কর, এই এতটাই বলা যায়। সে হলো, সক্রেটিসের ভূমিকায় আলী মাহমুদের অভিনয়। এযাবতকালের অভিনয়ধারা থেকে একেবারে ভিন্ন ঘরানায় উত্তরণ ঘটে গেল যেন। যাকে ঢাকার মঞ্চের সর্বশেষ অর্জন-মাত্রা হিসেবেই প্রায় চিহ্নিত করা যায়। এটা ব্যাখ্যা করতে গ্রুপ থিয়েটারের ২৫ বছরের অভিনয় রীতি-ধারার একটা ক্রম-নকশা কাটতে হয়।

স্বাধীনতার পর নবনাট্যরীতির সামগ্রিকতায় অভিনয়েও এক নবত্বের সূচনা হয়।

সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ নাটক থেকে আল মনসুর কাটা কাটা, ছাড়া ছাড়া অথচ সংহত কাব্যানুভবে টানটান এক বাচনে এবং শারীরিক রূপারোপের অভিনয়রীতিতে ঝকঝক করে ওঠেন আমূল নবীনতায়। স্বাধীনতাপরবর্তী অস্থির ছটফটে তারুণ্যের দিশেহারা আত্মসচেতনতা যেন রূপ পেয়েছিল সে প্রকাশভঙ্গিতে। সেই সঙ্গে রাইসুল ইসলাম আসাদও ক্রমস্ফূটমান হচ্ছিলেন বিশিষ্ট এক অভিনয়রীতিতে। শকুন্তলা, কিত্তনখোলা, চাকা হয়ে হাত হদাই নাটকে যার পরিণতি মেলে। এছাড়া আবদুুল্লাহ আল-মামুন ও ফেরদৌসী মজুমদার দ্রুতগতির (STACCATO) এক বিশিষ্ট বাচন এবং সেই মতো শারীরিক ক্ষিপ্র স্টাইলাইজড ভঙ্গির দৌত্যে এতকালের ঢিমে, সুরেলা, নিয়ন্ত্রণহীন গদাইলস্করী অভিনয়ধারায় নবত্ব আনেন। যা পরে হয়তো ম্যানারিজমে ক্লিশে হয়ে গেছে, তবু বাচন-শারীরভঙ্গির এই ক্ষিপ্র প্রকাশরীতি নবীনতায় চেতন করে তোলে দর্শকসাধারণকে। কালের গতিবেগ এক আত্মসচেতনায় অভিনয়রীতিতেও বৃত হয়।

শকুন্তলা নাট্যে আফজাল হোসেন ও হুমায়ূন ফরীদি হাস্য-ব্যঙ্গ-কৌতুকশ্লেষের এক কালধারক অভিনয় প্রবর্তন করেন যা পরে আরও বিকশিত হয়েছিল স্তরমাত্রার বিচিত্র পরিণতিতে। মুনতাসির ফ্যান্টাসি নাটকে আফজাল এবং কিত্তনখোলা নাট্যে ফরীদির অভিনয় এই ধারারই অগ্রসরণ। কেরামতমঙ্গল-এ যার ভিন্ন পরিণতি ঘটে। কিত্তনখোলা নাট্যে জহিরউদ্দিন পিয়ার আর পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় দুটি ভিন্ন ধরনের অভিনয় করেন। শারীরিক অভিব্যক্তিপ্রবল এক স্টাইলাইজড অভিনয় করেন পিয়ার, বলা হয় মায়ারহোল্ডের বাই-মেকানিকঅনুসরিত এ রীতি। বোঝা যায় সামাজিক সঙ্কট যন্ত্রণার এক আতীব্র আততি মুক্তি খুঁজে নিয়েছে বিশিষ্ট এই প্রকট প্রকাশরীতিতে। এতে সচেতনতারও একটা মাত্রা নির্দেশ হয়। জনসমাজে উন্মুল মানুষের ট্র্যাজেডি-ধারণোন্মুখ তীব্রতা থেকেও এমতরীতির উৎসারণ ঘটেছে বলা যায়। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় খল-চরিত্রের এক অধিক-সেয়ানা সামাজিক ভঙ্গির রূপায়ণ করেন সমর্থ অভিনয় দক্ষতায়। প্রতিশ্রুতিশীল এই অভিনেতা মঞ্চে আর কোনো পরিণতির সুযোগ পান নি- এটা দুঃখজনকই বলতে হবে।

আবুল হায়াত বাকি ইতিহাস নাট্য থেকে হলেও দেওয়ান গাজীর কিস্সা নাটকেই তাঁর তুরন্ত স্বাভাবিক অভিনয়রীতির তুলনারহিত প্রবর্তনায় এক অনিঃশেষ ধারার সূচনা করেন। আসাদুজ্জামান নূর, খালেদ খান এই ঘরানার গুণী অভিনেতা। যদিও আবুল হায়াত তাঁর ক্ষমতার শ্রেষ্ঠ রূপায়ণ মঞ্চে এখনও ঘটান নি বলেই মনে হয়। আসাদুজ্জামান নূর কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, নূরলদীনের সারাজীবন এবং গডোর প্রতীক্ষায় নাটকে তার সামর্থ্যরে একটা উচ্চমান চিহ্নিত করেছেন। খালেদ খান অচলায়তন থেকে ঈর্ষা নাটকে পরিণতির একটা অবস্থানে পৌঁছেছেন। স্বাভাবিকতার সঙ্গে কাব্যময় অভিনয়-ছন্দের এক ভারসাম্য রচনা করেছেন তিনি। সুবচন নির্বাসনে থেকে শুরু করে এখনো ক্রীতদাস, ম্যাকবেথ, দুই বোন এবং মেরাজ ফকিরের মা- বিশিষ্ট এক উচ্চকণ্ঠ স্বাভাবিকরীতির দাপট ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয়ে। শিমূল ইউসুফ সেলিম আল দীনের বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতির প্রতিভাময়ী রূপকার। কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই এবং যৈবতী কন্যার মন ও বনপাংশুল নাটকে দেশজ বর্ণনাত্মক অখ- পরিপূর্ণ (নাচ-গান-অভিনয়) অভিনয়রীতির সঙ্গে একালের অনুভব-চিন্তার, বাকছন্দের এক মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছেন। বিস্ময়কর তাঁর সাফল্য বলা চলে- স্বরেসুরে, শরীরমনের প্রকাশবলিষ্ঠতায়। পাশাপাশি সুবর্ণা মুস্তাফা টিভিতে স্বভাবানুগ অভিনয়রীতির ধারা তৈরি করলেও মঞ্চে শকুন্তলা-র মোহনীয়তা কী মুনতাসির ফ্যান্টাসির হাস্যরসিকতায় মানানসই হলেও কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল বা হাত হদাই-এ বর্ণনাত্মকরীতির স্বাচ্ছন্দ্য পান না। আত্মসচেতন আড়ষ্টতা ভুলতে দেয় না কখনোই তাঁকে তাঁর তারকা-পরিচয়। নাগরিক স্বরক্ষেপণও তাঁর মঞ্চে অনুপযুক্ত ঠেকে। তবে যৈবতী কন্যার মন নাট্যে তিনি তাঁর সীমাবদ্ধতাকেই ব্যবহার করেছেন, পেরিয়ে গেছেন মনে হয়।

সারা যাকের সৎ মানুয়ের খোঁজে নাটকে অভিনয়ের সেই দাপট কিছুতেই যেন আর ফিরে পাচ্ছেন না। নূরলদীনের লিসবেথ বা ঈর্ষার স্বাচ্ছন্দ্য সত্ত্বেও। তাঁর ব্যক্তিস্বরূপে কোথাও আছে এ অতিতানিত প্রতিক্রিয়া-বেগ, সেটার অনর্গল যথাব্যবহার হয়েছিল সৎ মানুষের খোঁজে নাটকে। অন্যত্র সবটা সেই মতো ধারণ যেন কিছুতেই হয়ে ওঠে না। একালের এক বিড়ম্বিত ব্যক্তিস্বরূপের আত্মপ্রকাশ সঙ্কটকেই বলা চলে একে। নাজমা আনোয়ার গ্রামীণ এক তেজ তার অভিনয়ে আনতে পারেন, তেমন চরিত্রে যেটা খুব বিশিষ্ট সততায় প্রকাশিত হয়। নাগরিকজনের বানানো গ্রাম্যভঙ্গির মধ্যে ঝলমল করে ওঠে তার তাকদ। মুহূর্তে গ্রামীণ নারীর ব্যক্তিত্বই বুঝি ফুঁসে বেরোয়। মামুনুর রশীদ এবং এস এম সোলায়মানও একধরনের স্বভাবানুগ অভিনয়ের মুদ্রায় অভ্যস্ত যেটা এখনও তেমন পরিণতির গভীরতা অর্জন করে নি মনে হয়। আমিনাসুন্দরী নাটকে রোকেয়া রফিক বেবীর অভিনয়ে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সচেতন নারীর এক প্রকাশভঙ্গির বিশিষ্টতা পেয়েই গেছে বলা যায়। শংকর সাঁওজাল এবং আশীষ খন্দকার বিশিষ্ট অভিনয়রীতিতে দক্ষ। সামাজিক সচেতনতার একটা প্রকাশধরন তাতে স্পষ্ট ব্যক্তিস্বরূপের অঙ্গাঙ্গিকতায়।

সবশেষে বলতে হয় আলী যাকেরের কথা। বাকি ইতিহাস নাটকের অভিনয়ে আত্মসচেতন স্বাভাবিকরীতির যে সূচনা দেওয়ান গাজীর কিস্সা নাটকে তারই এক উন্মুক্ত সম্প্রসারণ; নূরলদীনের সারাজীবন নাট্যে অভিনয়সামর্থ্যরে দুই-শিং-যোঝা আত্মপ্রকাশ রূপ অর্জন গ্যালিলিও অভিনয়ে পরিণতির উচ্চতর ধাপে আরোহণ করেছে। তাঁর শরীর-স্বভাব-শিক্ষা সচেতনতার একটা মুক্তি পেয়েছে। বিক্রম গাম্ভীর্য আর ব্যঙ্গ হাস্যরসায়নে বাঙালির ব্যক্তিস্বরূপের বিশিষ্ট এক পরিচয়কেই রূপ দিয়েছে। ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ যখন সামাজিক জাতিগত আর্কেটাইপ ধারণ করতে পারে তাতেই শিল্পী অভিনেতার সিদ্ধি, মুক্তি। কালের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক-বিনিময়, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির ও সমাজের যে সম্পর্কচারিত্র্য সেটাই তো সময়ের বিশিষ্ট রূপের উদভাবন ঘটায়। এতে জাতির, সমাজ-সময়ের এবং ব্যক্তির পরিচয় একই সঙ্গে রূপায়িত হয় মানবমুদ্রার বিশিষ্টতায়, অভিনয়ে ব্যক্তিস্বরূপের নান্দনিক প্রকাশ তাতে ঘটে।

বাঙালিমনের আবেগ উচ্ছ্বাসের প্রাবল্য স্বভাবত নাগরিক অভিনয়েও থাকে, যতই যুক্তিবুদ্ধির সচেতনতা থাকুক না কেন। আতিশয্য একটা প্রধান চরিত্রলক্ষণ বাঙালির। সামাজিক সম্পর্কের এই মুদ্রা স্বভাবত অভিনয়ে ঢুকে পড়ে। যদিও নাগরিক-সম্পর্ক অমানবিক যান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন। তাতে একধরনের ওপরচৌকস চালিয়াতির প্রচলন। মানবসম্পর্কের কোনো তাপ যাতে নেই। তার উপর আধুনিক-অভিনয় সম্পর্কে এই ভুল ধারণাও কাজ করে যেন আবেগ অনুভূতিহীন প্রাতিষ্ঠানিক আমলাসুলভ আড়ষ্ট স্মার্টনেস হলো আধুনিকতা। অথচ তাতে অন্তত বাঙালির স্বভাব ও মন অপ্রকাশিত থাকে। নাগরিক এই অস্বাভাবিকতা অভিনয়েও কাজ করে। তবু ভেতরকার আবেগপ্রাবল্য সুযোগ পেলেই বের হয়। তাই দেখি বাক্যের টেকচার স্বরক্ষেপণে টানটান খাপিবুননের হয়েও হঠাৎ হঠাৎ নিয়ন্ত্রণহীন ভাবালু সুর গড়ে তোলা সুক্ষ্মতা ভেঙ্গে ফেলে। বাক্যের শেষে প্রায়ই নাটুকে বাড়তি সুর লাগে। অথচ তাতে নিশ্চয় স্বর-সুর-ছন্দের গ্রামীণ লাবণ্য নেই। নাগরিক কর্কশ ভাবাতিশয্যই প্রকট হয়ে ওঠে। তার ওপরে অভিনয়ের কোনো ধারার সংযুক্তি বাংলাদেশের অভিনেতারা পান নি। কথ্যসুরের স্বাচ্ছন্দ্য তাই বুঝি অনায়ত্ত-আঞ্চলিক সংলাপ হলেও। নাগরিকজনের সামাজিকসম্পর্কের মধ্যে যে অস্বাভাবিকতা আছে তার ফল এটা মনে হয়। অথবা সংলাপে দৈনন্দিন বাগভঙ্গির যথাপ্রয়োগ নেই বলেও হয়তো এমন ঘটে। সব মিলে একটা জগাখিচুরি ব্যাপার আছে যাতে কিনা অভিনয়ে মানবিক স্বাভাবিকতার গভীরতা এবং প্রকাশের বিচিত্র সূক্ষ্মজটিলতাকে ধরবার উপযুক্তরীতি ঠিক যেন ভিত্তি পায় নি। অভিনয়ের এই দুর্বলতা গ্রুপ থিয়েটারের সবাই স্বীকার করেন। দিনে দিনে তা আরও প্রকট। এতদিন তবু প্রতিভাবান অভিনেতৃগণ নানা ধরনের অভিনয়ের এক সাফল্যধারা তৈরিও করেছেন।

সক্রেটিসের জবানবন্দী নাটকে আলী মাহমুদ সক্রেটিসের অভিনয়ে এক আশ্চর্য ছন্দের উত্তরণ ঘটিয়েছেন। সেটা প্রায় ধারাবিহীন উল্লম্ফই বলা চলে। দুই বাংলার নানা অভিনয়ধারার ফলগু ভিত্তিভূমি কোথাও কাজ করেছে নিশ্চয়। বিশেষত সক্রেটিসের ভূমিকায় এমত সাফল্য অধিক বিস্ময়কর। দেশে সমাজে প্রাজ্ঞ বৃদ্ধের অভিজ্ঞতাহীন বাস্তবতায় সক্রেটিসের মতো আর্কেটাইপ মানবমহিমা ধরবার আধার কী করে পাওয়া যাবে, যেখানে কথা, বড় কথা আজ পুঞ্জীভূত মিথ্যার জঞ্জাল। নতজানু হওয়ার মতো বড় মানুষ কোথাও নেই। এমত চরিত্রের অভিনয় স্বভাবত কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনা ষোল আনা। অথচ মঞ্চে দেখা গেল সত্যালোক আর জ্ঞানরসে টুইটম্বুর এক জীবন্ত বৃদ্ধকে, বাস্তবকল্পনা স্মৃতির অভিজ্ঞতায় চেনাই লাগে যাকে। বাউল ফকির, রবীন্দ্রনাথের দাদাঠাকুর আর ভূতপূর্ব গ্রামসমাজের ক্ষ্যাপা পাগল কিংবা বিভোর শিল্পীজনের এক মিশ্র আদল রূপায়িত হতে দেখি। অথচ অভিনয়ে বিশেষ কারুকৃতি কানে-চোখে লাগে না এমনই স্বাচ্ছন্দ্যে এক বিরাট মানুষের সম্প্রকাশ ঘটে। মানবস্বভাবের সেই লাবণ্য আপ্লুত করে যেমন হওয়ার কথা মানুষের। গভীরকে এমন সহজ ছন্দে ধরা বড় কম শক্তির কথা নয়। নবীন অভিনেতা কোথায় পেলো এমন প্রকাশ-ধরন? কোথা থেকে পেলো এই গড়ন-ধারা, এমন মানুষ আর অভিনয়রীতির? কোথায় তার উৎসভূমি? শম্ভু মিত্রের এক আত্মস্থ অনুরণন মনে এলেও আসতে পারে কখনো যা একেবারের স্পষ্ট উচ্চকিত নয়। এই ঘরানার মেজাজের মানুষের পরিচয় পেলো কোথায় সে- গ্রামে, ঢাকায়, কলকাতায়? শুনেছি পন্ডিচারিতে পড়তে গিয়েছিল অভিনেতা।

সব মিলে এক বিস্ময়কর মুগ্ধতা জাগে। মানবমহিমার কোনো সত্যপ্রকাশে যেমন ভালোলাগার ঘোর নামে। প্রায় ততটাই এই অভিনয়। মানুষের অমলিন সত্তাস্বরূপের নান্দনিক রূপায়ণে আপ্লুত হওয়ার অভিজ্ঞতা এত কম ঘটে জীবনে, শিল্পে। নবীন শিল্পীকে বিনতি জানাই।

ড. বিপ্লব বালা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, সমালোচক