Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: ময়ূর সিংহাসন
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: ময়ূর সিংহাসন। রচনা: মান্নান হীরা। নির্দেশনা: শাহ আলম দুলাল। মঞ্চপরিকল্পনা: ফয়েজ জহির। আলোকপরিকল্পনা: ঠাণ্ডু রায়হান। পোশাকপরিকল্পনা: জাহানারা নূরী। আবহসংগীতপরিকল্পনা: সুজিও সিয়াম। রূপসজ্জা: নূরুল হক। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ১৯৯৯। একটি ‘আরণ্যক নাট্যদল’ প্রযোজনা
[ময়ূর সিংহাসন নাটক নিয়ে নাট্যসমালোচনার আয়োজন করেছিল নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’। নাটকটির রচয়িতা মান্নান হীরা ও নির্দেশক শাহ আলম দুলালসহ আলোচনায় আরো ছিলেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক শুভ রহমান, অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যশিক্ষক বিপ্লব বালা, নাট্যনির্দেশক কামালউদ্দিন কবির এবং ‘প্রাচ্যনাট’সদস্য শাহেদ ইকবাল। নাট্যালোচনায় সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিল ‘থিয়েটারওয়ালা’-সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ৫ম সংখ্যায় (১৯৯৯-২০০০ এ প্রকাশিত) অনুলিখন করে এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
হাসান শাহরিয়ার
প্রথমেই আমি শুভ রহমানকে শুরু করতে অনুরোধ করছি...শুভ দা’, ময়ূর সিংহাসন-এর কনটেন্ট নিয়ে কিছু বলুন।
শুভ রহমান
প্রথমত, এই ধরনের আলোচনায় আমার প্রথম আসা। আর আমি এ বিষয়ে আলোচনার তেমন একটা যোগ্যতা রাখি না। কিন্তু দর্শক হিসেবে...মানে প্রথমত আমি দর্শকই...নাটক দেখি, দেখে আমার ভালো লাগে। আর আমি এ ধরনের নাটকই দেখি, সব নাটক দেখি না। যেটা মোটামুটি বলা যায় যে, রাজনীতির সঙ্গে মেলে...আমি আনন্দের জন্যেই নাটকটা দেখি, আমার আনন্দটা এধরনের নাটকের মধ্যেই পাই। আলাপনের প্রয়োজনেই আলোচনাটা এই নাটকটা ঘিরেই করবো...যেটার উপর আমি সব সময় জোর দিই, সেটা হলো কনটেন্ট। নাটকের তো অনেক কিছু থাকে...অভিনয়, সেট, লাইট...তো এ সব কিছুর উপরে নাটকের বিষয়বস্তুটা কী, কাহিনিটা কী অর্থাৎ নাটকটার মধ্যে কোন রাজনীতিটা কাজ করছে, সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।...তো ময়ূর সিংহাসন নাটকটাতে এটা আছে। এ ধরনের অসংখ্য নাটক আমাদের হওয়া উচিত। এখানে যে এ ধরনের নাটক অতীতে হয় নি তা না। অনেক ইতিহাসকে, ক্ল্যাসিককে সমকালীন করে নাটক হয়েছে। শাহজাহানের ইতিহাস নিয়েও বহু নাটক হয়েছে বিভিন্ন নামে। উৎপল দত্ত করেছিলেন আজকের শাহজাহান নাম দিয়ে। তো হীরাভাইয়ের উপর আমার সাংঘাতিক শ্রদ্ধা...নানাভাবেই, নানা-কারণেই আরকি। নাটকে ষাট দশকের কুশীলবদের পাওয়ার ব্যাপারে যে সমস্যা হতো, এই যে...কোনো ভদ্রঘরের মেয়েরাতো থিয়েটারে আসতো না...বিভিন্ন ধরনের মেয়ে জোগাড় করতে হতো...এই ক্রাইসিসটা এসেছে, এটার সাথে আমি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিচিত। কিন্তু ময়ূর সিংহাসন নাটকে এটাই মুখ্য ব্যাপার না। হীরাভাইয়ের মাথায় অনেক কিছু ঢুকে আছে। নাট্যকারের এটা বোধহয় একটা সমস্যাই। মানে দর্শককে যখন...মানে প্রেক্ষাপট যখন তুলে ধরা হয়, তখন তার যাবতীয় সমস্যা তিনি তার একটা নাটকেই ঢুকিয়ে দিতে চান। এটা...মানে আমার কাছে মনে হয়েছে...তিনি সব সমস্যা এনে ভিড় করিয়েছেন, এই নাটকে। যেমন এই যে, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংকট, তার সঙ্গে আছে দেশভাগের বিষয়, সাম্প্রদায়িকতা আছে...এটা তীক্ষèভাবেই আছে কিন্তু এটা কেন্দ্রীয়ভাবে নেই যেটা থাকা উচিত ছিল, এই মেসেজটা আরও ভালোভাবে দেয়া যেত। আর যেটা আছে, প্রচ্ছন্নভাবে...তা হলো মানুষের উপর মানুষের শোষণ, অনেকভাবে মানুষকে পণ্য করা, শিল্পকে পণ্য করা ইত্যাদি।
তো এগুলো তো আসবেই, আসতেই পারে...আবার ইয়ের কথাও এসেছে...ঐ যে...শত্রু সম্পত্তির কথাও এসেছে...তো এতসবের মধ্যেও একটা ফোকাল পয়েন্ট তো থাকবে। সেটা কতটুকু দর্শকের সাথে কমিউনিকেট করতে পারলো বা আদৌ পারলো কিনা, এটা আমার একটা প্রশ্ন।
হাসান শাহরিয়ার
আমরা নাটকের কনটেন্ট নিয়ে আরেকটু এগিয়ে যাবো। বিপ্লব দা’র কাছে আমার জানতে চাওয়া, সেটা হলো...এই যে ময়ূর সিংহাসন...সেটার সাথে জড়িত হীরাভাই (মান্নান হীরা) এবং সর্বোপরি ‘আরণ্যক নাট্যদল’। তো ‘আরণ্যক নাট্যদল’ ও হীরাভাই...এদের সাথে ময়ূর সিংহাসনের কনটেন্ট যেমন হওয়ার কথা ছিল এটা সে ধরনের কিনা...ইত্যাদি বিষয়গুলোকে জড়িয়ে কিছু বলুন।
বিপ্লব বালা
হ্যাঁ সেটা যদি বলতে হয়, তাহলে আমার যা মনে হয়...আমাদের যে থিয়েটার, স্বাধীনতার পর থেকে থিয়েটারটা যে একটা কাজ হিসেবে নেয়া হয়েছে...শুরুর থেকে যেটা ছিল যে, একটা আদর্শের সন্ধান...এবং তার মধ্যে সততা, সদিচ্ছা সবই ছিল। কিন্তু সেটাতে সেই সময়, সেই স্বাধীনতার পরবর্তীপরিস্থিতি, তখনকার রাজনীতি বা তখনকার যে সামাজিক আকাক্সক্ষাগুলো...অর্থাৎ নাটকের আদর্শটা অনেক বেশি রাজনৈতিক বা তখনকার যে সামাজিক আকাক্সক্ষাগুলো...অর্থাৎ এমন একটা কথা বলা হয় যে, আমরা বেশি রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে মিলে গিয়েছিলাম। আমরা অস্ত্র রেখে নাটক করতে এলাম। তার অর্থ ঐ অস্ত্র আর নাটক করাটা একই জিনিস বোঝাতে। এবং তখন রাজনীতিতে একটা আদর্শ ছিল ও উজ্জীবিত ভাব ছিল...আর সেই আদর্শ সেই উজ্জীবন নাটকেও ছিল। কিন্তু জীবন ও বাস্তবতা তো ভয়ানক। দেখা গেলো সেই আদর্শের জায়গাটা নানা বাস্তবতার পরে এসে...সেই আদর্শের সন্ধানটা আর একটা জায়গাতে রাখা যায় নি। সেটা ভালোও আবার মন্দও। ভালো এই অর্থে যে, ঐ আদর্শের মধ্যে একটা...কী বললো...সদিচ্ছা ছিল, কিন্তু কোথাও যেন আবার একটা অস্পষ্টতা, ভাবালুতা...একটা রাজনীতিসর্বস্বতা ছিল। তারপর ক্রমান্বয়ে যখন দেখা গেল রাজনীতির জায়গাটা একটা ব্যর্থতার দিকে যাচ্ছে, তখন থিয়েটারটা একটা বিপদের মধ্যে পড়লো। এমন একটা কথা বলা হয় যে, আমাদের আদর্শটা মঞ্চেই আছে কিন্তু তার প্রয়োগটা আমরা রাজনৈতিক জীবনে করতে পারছি না।...এই যে, ‘এই সমাজটা পাল্টানো হবে’ সেটা দেখা গেল দেশে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, সেটা কেবল মঞ্চে টিকে আছে। এই ব্যাপারটা লোকের বেশিদিন ঠিক লাগে নি...কেমন যেন মনে হলো যে, জোর করে আদর্শকে ধরে রাখতে চাইছি, কেবল ইচ্ছাপূরণ হচ্ছে এবং সেটা মঞ্চেই কোনোভাবে বেঁচে আছে। এখানে সদিচ্ছার কমতি ছিল না, কিন্তু কোথাও যেন, সত্যের অভাব ছিল। এবং একটা সময় দেখা গেল...আশির দশকের দিকে...তখন একটা কথা উঠেছে যে, শিল্প সম্মত নাটক হওয়া চাই, কেবল বক্তব্য থাকলে চলবে না। তারপর একটা কথা উঠেছে যে, দেশজ হতে হবে, দেশজ ধারা...লোক থিয়েটার ইত্যাদি...তারপর এখন শুনছি অ্যাসথেটিক হওয়া দরকার অর্থাৎ ঐ শিল্পের কথাটাই আবার নতুনভাবে আসলো। আমি বলছি একটা আদর্শের সন্ধান...এটা বাংলাদেশের থিয়েটারের একটা চরিত্র, এবং এই চরিত্রের মধ্যে সদিচ্ছা আছে কিন্তু কোথাও একটা গোলমেলে ব্যাপারও আছে। গোলমেলে এই অর্থে বলছি যে, আমরা যে অর্থে বলি থিয়েটার হলো দর্পণ...তো দর্পণ মানে কী? দর্পণ হলো, যে জীবনটা আছে সেটা প্রকাশ করা। যারা করছে এবং যারা দেখছে তাদের জীবনসমগ্রতা প্রকাশ হবে। তো এখানে আমার মনে হয় যে...এই জায়গাটিতে...মানে, সাধারণ জায়গা থেকে ভাবা হয় নি...মানে যারা থিয়েটার করছে এবং দেখছে তাদের জীবন উঠে এসেছে? উত্তর ‘হ্যাঁ’ উঠে এসেছে, তবে তা হাতে গোনা। আর উঠলেও এটা একটা আদর্শ করে উঠেছে। সত্যের বহু স্তর মাত্রায় সত্য ‘সত্য’ হয়ে উঠে নি। এই চেষ্টাটাই যেন হয় নি। আমাদের জীবন মানে মধ্যবিত্তের জীবন...এটা নিয়ে থিয়েটার করাটা মনে হয় ছোট কাজ, বড় কাজ হলো আদর্শায়ন...সমগ্র দেশ, সমাজ...এটার মধ্যে খুব সততা আছে, সদিচ্ছা আছে কিন্তু কোথাও যেন একটা গোলমেলে ব্যাপারও আছে। অর্থাৎ সেই শিল্প করে যদি আমার জীবন প্রকাশ করতে না পারি তাহলে আদর্শ কিন্তু আমাকে বেশিদিন বাঁচাবে না। ঐ সমগ্র দেশের আদর্শের সাথে আমার জীবনের আদর্শেরও কোথাও না কোথাও মিলতে হবে। অর্থাৎ এই প্রকাশটা আমার প্রকাশ হতে হবে, জনগণের প্রকাশ কেবল না। আমি এটা পরিপ্রেক্ষিত বললাম...মানে একেক দল একেকভাবে এই আদর্শ তুলে ধরলো। সেখান থেকে ‘আরণ্যক’...আমার মনে হয়...ঐ যে, বিষয়ের আগে যে একটা একমুখী আদর্শায়নের জায়গা ছিল, তার থেকে ‘আরণ্যক’ বিষয়ের আদর্শই খুঁজতে নানা রকম করছে। নানা দিক থেকে দেখতে চাইছে।
এখন ময়ূর সিংহাসন নিয়ে বলবো। সেটা হলো...আমি...হয়তে পুরোপুরি নাটকের লোক না...তবুও...আমার একটা সমালোচনা আছে, স্বাধীনতার পরবর্তী এই নাট্যআন্দোলন কোথাও যেন একটা ঐতিহ্য স্বীকার করে নি। গোটা দেশজুড়ে, অন্তত শহরে...আমি নাগরিক থিয়েটারের কথাই বলছি...তো সে গোটা নাগরিক থিয়েটারের মধ্যে কোনো ঐতিহ্য খুঁজে পায় নি, সে কোনো পূর্বপুরুষ পায় নি। সে আগের থিয়েটারকে খুব ছোট চোখে দেখেছে, সে অবহেলা করেছে। এবং তাদের (পূর্বপুরুষদের) সৌখিনতা নিচু চোখে দেখেছে। এটা একটা খুব বড় ক্ষতি করেছে নাট্যআন্দোলন। এই নাট্যআন্দোলন কোথাও স্বীকার করে নি, সে তার ঐতিহ্যকে খুঁজে দেখতে চায় নি। সে বাস্তবতাকে বোঝবার চেষ্টা করে নি, যে, ঐ বাস্তবতার মধ্যে, ঐ থিয়েটারটার মধ্যে, আমাদের পূর্বপুরুষের কী সন্ধান ছিল, তার কী আকাক্সক্ষা ছিল। এবং তার সাথে আমার যোগসূত্রটা কোথায়? সেইখানে এই ময়ূর সিংহাসন, আমার মনে হয়েছে...একটা বোঝবার চেষ্টা, ষাট দশকের থিয়েটারের...তখন সেই সব মানুষের, সেই সব কুশীলব, যারা বিশেষত...ঐ যে প্রশ্নটা এসেছে যে, অভিনেত্রীদের প্রাপ্যতা...সেটাতো একটা বিরাট ব্যাপার...মানে আমার মনে পড়ছে যে, উৎপল দত্তের সেই টিনের তলোয়ার-এর কথা। সেও সেই ঐতিহ্যকে বোঝবার চেষ্টা করেছিল। উৎপল দত্তও নিশ্চয়ই প্রথম দিকে ঐ থিয়েটারকে ভালো চোখে দেখে নি। পরে তিনি গিরিশ ঘোষ...বা ঐ লোকদের থিয়েটারকে শ্রদ্ধা করতে গিয়েই তার ঐতিহ্যকেও শ্রদ্ধা করেছেন। এই শ্রদ্ধার জায়গাটায় ‘আরণ্যক’ ফিরে এসেছে, এটা একটা ভালো কাজ করেছে। ঐ থিয়েটারের লোকদের সাথে আমাদের দূরত্ব থাকলেও, আমরা পরিচিত হতে পেরেছি। সেজন্য আমি ‘আরণ্যক’কে ধন্যবাদ জানাই। আরেকটা হলো সাম্প্রদায়িকতার কথা এসেছে...বেশ ভালোভাবেই এসেছে। তারপর ঐ যে...মানে শত্রু সম্পত্তি আইন...এটাও আমাদের জানা হলো...এবং এটা এভাবে বোধহয় কোনো থিয়েটারে আসে নি।...যদিও যতটুকু এসেছে, যেভাবে এসেছে...সেখানে আমার সমালোচনা আছে। তবুও এই আসাটাও আমি খুব ইতিবাচক বলছি। আপাতত এটুকুই। পরে প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু বললো।
হাসান শাহরিয়ার
নাট্যকার, আপনি কিছু বলে নিন। পরে আমরা আলোচনার প্রসঙ্গও খুঁজে পাবো আপনার বলা থেকে।
মান্নান হীরা
আসলে আমার উচিত ছিল...এখানে না থাকাটা, তাই না?...পীযূষ দা’, কী বলেন? কারণ, আমি ‘থিয়েটারওয়ালা’ আয়োজিত আরেকটি আলাপন, মানে নাট্যসমালোচনা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম...সেখানে ‘ঢাকা থিয়েটারে’র বনপাংশুল-এর উপর আলোচনা হয়েছিল।...সেখানে কিন্তু সেলিমভাই (সেলিম আল দীন) ছিলেন না।...সেলিমভাইয়ের সাথে আমি নিজেকে তুলনা দিচ্ছি না...আমি বলছি যে...আমারতো আসলে কিছু বলবার নেই। আর যা বলার সেটাতো বলা হয়ে গেছে। তবুও যেহেতু সম্পাদকের নির্দেশ আছে...
হাসান শাহরিয়ার
নির্দেশ না অনুরোধ আছে...
মান্নান হীরা
অনুরোধ আছে, সে জন্য বলছি...হ্যাঁ, আমি আসলে দুটো বিষয়কে জানবার চেষ্টা করেছি। নাটকটি লিখবার সময় আমার পূর্ব যে ভাবনা, এটা কীভাবে আসে একজন নাট্যকারের মাথায়, এগুলো বলার মতো সুযোগ বা প্রয়োজনীয়তা এখানে নেই। মফস্বল শহরেই আমার অনেকটা সময় কেটেছে...সেখানে আমি ছোটবেলায় নাটকের লোকজনকে দেখেছি। এবং ওখানকার বিশেষ করে কেয়ারটেকারের মতো যারা থাকতো, তাদের জীবন দেখেছি। আমার মনে হয়েছিল, যে, এরকম একটি লোক...আমি আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে...একটা মফস্বল টাউন হলে ওয়ার্কশপ করাতে গিয়েছিলাম..তো সেখানে একটা নিরিবিলি সময়ে আমি টাউন হলটার কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলছিলাম।...কেয়ারটেকার বর্তমান নাটকের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ। এবং তার ক্ষুব্ধতার প্রধান কারণ হচ্ছে যে, এখন, বর্তমান সময়ে...নাটকে যেটাকে আমরা প্রপস বলি, সেটা থাকে না। এবং আমি যখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কীভাবে চলেন...তখন তার একটা কথা আমাকে খুব আকৃষ্ট করলো...আকৃষ্ট মানে আহত করলো...সেটা হলো সে সর্বশেষ মাছ খেয়েছে প্রায় বছর খানেক আগে। একটা নাটকে একটি শোল মাছের ব্যবহার ছিল। তো তার দাবি হচ্ছে এই রকম নাটক...যেখানে মাছ, মিষ্টি, লাউ, চাল ইত্যাদি থাকবে সেসব নাটক আসলে বেশি করে হলে ভালো হয়। এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথা বললাম।
আরেকটা হচ্ছে, এসব অভিনেত্রীদের...যারা ময়ূর সিংহাসনে ছিল...এদের আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। যখন আমার বয়স আট-দশ তখন আমি এই ধরনের নাট্যপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থেকেছি। কখনো কৌতূহল বশত, কখনো এক দৃশ্যের অভিনয়ের জন্য, কখনো অভিনয় না করার জন্য...তো এসব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আমি সেই বয়স থেকেই দেখেছি। এই সবটা মিলিয়ে...আমার যেটা মনে হচ্ছিল যে, আমাদের নাটকের যারা পূর্বসূরি, তাদের বোধহয় ধরা উচিত। কারণ, আমরা সবকিছুর আঙ্গিকের অনুসন্ধান করছি...পালাগান, যাত্রাগান...এতে সব খুঁজে পাওয়া যাবে না। এবং সেই মানুষগুলো খুঁজতে গেলেই...সেই মানুষগুলো আমার কাছে একভাবে ধরা পড়েছে, অন্যের কাছে অন্যভাবে...আরও মহৎ হয়ে ধরা পড়তে পারতো।...তো আমি এখনো খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সেই ’খোকা’ চরিত্রে যে অভিনয়টা হয়েছে, যিনি পতিতাদের সুযোগ পেলেই প্রেম নিবেদন করবার চেষ্টা করছেন...তার মধ্যে একধরনের তথাকথিত সভ্যতা ভব্যতা আছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তার আবার একধরনের...মানে আমি জানি না...এটাকে অশ্লীলতা বলবো নাকি অন্যকিছু...সে শ্মশান ঘাটে পতিতাকে প্রেম নিবেদন করছে, আবার এই খোকা চৌধুরী, দিলীপ দাসের ভিটামাটি যখন শত্রু সম্পত্তি হয়ে যাচ্ছে, তখন সবচেয়ে প্রবলভাবে প্রতিবাদ করছে এবং পরবর্তীসময়ে এই চরিত্রটাই আবার জ্যোৎস্না যখন নাটক করবার জন্য ফিরে আসছে...তখন সে বলছে একে আর নেয়া যাবে না, কারণ সে (জ্যোৎস্না) খেজুরতলা...মানে বেশ্যা পাড়ায় চলে গেছে। আমি যে জিনিসটির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে চাচ্ছি...শুভ দা’ (শুভ রহমান)...আমি এই চরিত্রগুলোকে ঠিক সিঙ্গেল ডায়মেনশনে দেখি নি। কারণ, এদের লোভ লালসা, জীবনের প্রতি আকর্ষণ, নাটকের প্রতি মমতা, রাজনীতির প্রতি একাগ্রতা, এগুলো সব মিলিয়ে...ভুলচুক মিলিয়ে...আদর্শ মিলিয়ে...একটা রক্তমাংসের মানুষ। কারে কারো মধ্যে ভুলটা বেশি ছিল, কারো কারো মধ্যে ভুলটা কম ছিল। কিন্তু এরা আমাদের পূর্বসূরি এই কথা স্বীকার করতেই হবে। সেই বারবণিতা থেকে যারা অভিনেত্রী হয়েছে, তাদেরকে আমার এখনো সবচেয়ে নিকটতম মানুষ মনে হয়।...আর রাজনীতির যে ব্যাপার বলছিলেন শুভ দা’, সেটা হচ্ছে যে, আমি সাম্প্রদায়িকতার কথা আনতে চেষ্টা করেছি। সাম্প্রদায়িকতা দুভাবে এসেছে। একটা হচ্ছে নাটকে শিল্পীদের অংশ্রগ্রহণের মধ্যে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক গন্ধ তৎকালীন, মানে ঐ থিয়েটারকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা খুঁজে পাচ্ছিলেন। আরেকটা হচ্ছে গভর্নমেন্টের যে আচরণ ছিল...তৎকালীন মাইনরিটির প্রতি...সেটাকেও আনবার চেষ্টা করেছি।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
সেই সাম্প্রদায়িকতা কি সামাজিক এবং প্রশাসনিক...দুটোকেই তুলতে চেয়েছো?
মান্নান হীরা
হ্যাঁ, সামাজিক এবং প্রশাসনিক।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
ষাটের দশকের?
মান্নান হীরা
ষাটের দশকের। এবং আমি এটাকে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করি যে, আজকে আমাদের এই সাম্প্রদায়িক চেতনা যে জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছে...আমি নাট্যসংস্কৃতির ইতিহাস খোঁজার জন্য যেমন ষাটের দশকের অনুসন্ধান করছি, তেমনি আমি সাম্প্রদায়িকতার চেতনার বীজ...সেটাও কিন্তু আমি ওখান থেকেই...মানে...এটা একটা মূল কারণ, যে তৎকালীন সরকার এবং সামাজিকব্যবস্থা কিন্তু আজকে আমাদেরকে এই জায়গায় এনেছে। এবং আজকে অনেক অনেক শিক্ষিত, ভদ্রলোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আমাদের মতো...শহরে বসবাস করে, দৈনন্দিন খবরের কাগজ পড়ে, সব নাগরিক-সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে অথচ গভীরে একটা সাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে এসেছে। এটা যেমন এখনকার সংস্কৃতির একটা প্রভাব আছে, আবার যেটা ফেলে এসেছি সেটারও কিন্তু...মানে সেই সাম্প্রদায়িকতাকে অন্তরের কোনো গভীরে বহন করছি, এটা আমরা নিজেরাও জানি না। এই যে, ষাটের দশক...এটা রাজনৈতিকভাবে আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আমরা সবাই জানি।...তার ভালো-মন্দ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সবটা মিলিয়ে একটা জায়গায় আনতে চেষ্টা করেছি এই ময়ূর সিংহাসনে। তবে শুভদা’র একটা কথা বলেই আমি এখনকার মতো কথা শেষ করবো...সেটা হলো...রাজনীতির যে ব্যাপারটা...অস্বচ্ছতার কথা বলছেন, সেই অস্বচ্ছতার ব্যাপারে আমার আত্মপক্ষ সমর্থন নেই কিন্তু আমি থিয়েটারের সমস্ত আয়োজন মঞ্চে ঘটবার পরেও কিন্তু রাজনৈতিকভাবেই নাটকটির সমাপ্তি হয়েছে। সেই সমাপ্তি হচ্ছে যে, অমূল্য একজন ‘মুসলমান’ জাহানারা পেয়ে সেই হত্যার প্রতিশোধ নিলো। এখানে আমার নিজস্ব বা আমাদের প্রযোজনার নানান দুর্বলতা থাকতে পারে কিন্তু সাম্প্রদায়িক চেতনা মানুষের কত গভীরে থাকে এবং প্রতিশোধের স্পৃহা যে কত নির্মম হয়...আমরা হয়তো এর ক্যাথারসিসটা সেভাবে দেখাতে পারি নি...দ্যাট ইজ আওয়ার লিমিটেশন কিন্তু আমরা চেষ্টা করেছি যে, শেষটা আসলে রাজনীতির উপরেই নির্ভর করে শেষ হোক।
হাসান শাহরিয়ার
পীযূষ দা’ এবার আপনার পালা, আপনি শুভ দা’ এবং বিপ্লব দা’র কথা শুনলেন আবার হীরাভাইয়ের কথাও শুনলেন।...নাটকের কনটেন্ট নিয়ে আগে কিছু বলুন।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
হ্যাঁ, বিপ্লবের (বিপ্লব বালা) কথা শুনছিলাম। ও খুব ভালো ভালো কিছু কথা বলেছে। ষাটের দশক...ঐ সময়টা বিপ্লবের জানা আছে...আবার শত্রু সম্পত্তি আইনের একজন খুব...মানে...ভিকটিমদের মধ্যে একজন বা কাছাকাছি ছিল সে। তারপর হীরা যেটা বললো...আজকে হীরা কথা বলাতে বেশ সুবিধা হয়েছে, যেমন, একটি বিষয়...আমি একজন সাধারণ-নাট্যকর্মী হিসেবে কথা বলছি...হীরা জাহানারা হত্যার বিষয়টি যেভাবে ব্যাখ্যা করলো, আজ যদি আমার নাট্যকার হীরার সাথে কথা না হতো, একজন সাধারণ-দর্শক হিসেবে সেদিন কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা গুবলেট অবস্থায় ছিল, ধোঁয়াটে ছিল। আমি বুঝতেই পারছিলাম না অমূল্য কেন বারবার একজন ‘মুসলমান’ জাহানারাকে দিয়ে অভিনয় করানোর কথা বলছিল এবং সেই আগের জাহানারার মৃত্যুর প্রসঙ্গ এসেছে...ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে এবং প্রতিশোধের কথাও এসেছে, মদ্যপ অবস্থায়। আমি মদ খাওয়া ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় কখনোই অমূল্য এবং দিলীপ দাসের মধ্যে বিষয়টি আলাপ হতে দেখি নি। আমি হীরাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি, আজকের আলোচানায় সে...মানে...নাট্যকারের স্বীকারোক্তির ফলেই বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হলো।
মান্নান হীরা
কিন্তু ব্যাপারটা আমার জন্য দুর্ভাগ্যজনক, কারণ আমিতো সব দর্শকের কাছে যেতে পারবো না। গিয়ে গিয়ে এটা পরিষ্কার করতে পারবো না।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
আচ্ছা, আমি একটু নাটকে ঢুকি, হ্যাঁ? প্রথমে আমি যখন নাটক দেখা শুরু করলাম, প্রথমদৃশ্য দেখে আমি রীতিমত অনুপ্রাণিত হলাম, এই জন্য অনুপ্রাণিত হলাম, কারণ আমি সমানুভূতি টের পেলাম। বিকজ সিক্সটি সিক্স-এর ঘটনা আমি মঞ্চে দেখা শুরু করলাম। ঐ সময়টায় মফস্বল শহরের নাট্যচর্চা দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, সাহজাহান দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি জানি ঐ সময় মফস্বল শহরগুলোতে কীভাবে থিয়েটার হতো।...তখনই একেকটা থিয়েটারের বয়স বা কোম্পানির বয়স বলতে গেলে ষাট-সত্তর হবে। আমি যে শহর থেকে এসেছি, বিপ্লব বালাও সেই শহর থেকেই এসেছেÑসেটা হচ্ছে ফরিদপুর। ফরিদপুরের যে টাউন থিয়েটার আছে, সেটির বয়সই তখন...ষাট...
বিপ্লব বালা
ষাটের বেশি।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
টাউন থিয়েটারে তখন নিয়মিত সাহজাহান হতো। এবং সাহজাহানে, যামিনী লাহিড়ী নামে একজন গুণী অভিনেতা নিয়মিত অভিনয় করতেন। আমি ঐখানে একমত, সবার সাথেই, বিপ্লবের সাথে এবং মান্নান হীরার সাথে, সেটা হচ্ছে যে, একাত্তরের পূর্ববর্তীসময়ে এদেশে কী নাটক হতো না? হতো তো। এবং সেখানে কি আন্তরিকতার অভাব ছিল?...বোধহয় ছিল না। সেখানে...মানে...যা যা বেসিক জিনিস লাগে, তার অনেকগুলোই তখনকার নাট্যকর্মীদের মধ্যে ছিল। একটু আগে যে অভিনেতার কথা বললাম, যামিনী লাহিড়ী, সেই যামিনী লাহিড়ীকে ফরিদপুর থেকে রাজবাড়ি যেতে হতো সাহজাহান করার জন্য। কারণ রাজবাড়িতেও সাহজাহান হতো। আর রাজবাড়ি কিন্তু...এখন হয়তো তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়, তখন হেঁটে যেতে হতো, অনেক দূর। তো যেবার যামিনী লাহিড়ী যেতে পারতেন না...অসুস্থতার কারণে হয়তো...সেবার মিয়া মতিন সাহেব, একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন, তার ছেলেকে আপনারা চিনবেন, এখনকার অভিনেতা-নির্দেশক কামালউদ্দীন নীলু, তো এই নীলুর বাবা সাহজাহান চরিত্র করবার চেষ্টা করতেন। আরেকজন ছিলেন, রাজবাড়ির রাজা যাকে বলা হয়, সূর্যকুমারের ছেলে...খুব সুদর্শন পুরুষ হিসেবেই তাকে অনেক সময় শাহজাহান করতে বলা হতো।...তো ঐ সময়ের ব্যাপারটি আসাতে...সমানুভূতি নিয়ে আমি নাটকের মধ্যে ইনভলব হয়ে গেলাম। ষাট দশকে আমিও থিয়েটার করেছি যেহেতু, থিয়েটার দেখার নেশা ছিল, যাত্রা দেখার নেশা ছিল, সেহেতু আমি নাটকের শুরুতেই ইনভলব হয়ে গেলাম, সমানুভূতির দিক দিয়ে। এবং আমার আরও প্রত্যাশা বেড়ে গেল যখন প্রায় শুরুর দিকেই আমি দেখলাম...সংলাপের মধ্যে চলে এলো...৪৬ থেকে ৬৬ পর্যন্ত। আমার প্রত্যাশা দুম করে চার হাত উপরে উঠে গেল...মনে হলো আমি বুঝি একটা দারুণ মহাকাব্যিক ব্যাপার...বিরাট ক্যানভাসের একটা ব্যাপার দেখবার সুযোগ পাবো। এবং সেটা দেখতেই বুঝি আমি এসেছি।...(দুষ্টুমি) মান্নান হীরা আমাকে টিকেট দিয়েছিল, টাকা নেয় নি এখনো। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই তাকে।
হাসান শাহরিয়ার
টাকাটা নিবে না তাতো বলে নি। দিলেই নিবে। তখন দেখা গেল কৃতজ্ঞতা-টা জলে গেলÑহাঃ হাঃ
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
চাইবে না বোধহয় হাঃ হাঃ...যাহোক...সেই জায়গা থেকে কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয় নি। টেক্সট-এর ব্যাপারে বলবো যে, এটা একটা থিয়েটার উইদিন দ্য থিয়েটার এবং এই জিনিস কিন্তু বাঙলা নাটকে এর আগেও হয়েছে।...এমনকি মান্নান হীরারই এজাতীয় নাটক এর আগেও দেখেছি। একাত্তরের ক্ষুদিরাম। টেক্সট-এর দিক দিয়ে সম্ভবত কাছের কিন্তু একাত্তরের ক্ষুদিরামকে আমার কাছে বেশি নাড়া দেয়ার মতো নাটক মনে হয়, কারণ হচ্ছে একাত্তরের ক্ষুদিরামের সাথে ’একাত্তর’ জড়িত। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোর মতো একটা বিরাট ব্যাপার...বিরাট মানে বাঙালিজীবনেতো এর চেয়ে বড় ব্যাপার নেইÑতাই না? সেই বিষয়টি যেহেতু নাটকের সাথে জড়িত ছিল, সেখানে আবেগ এবং অন্যান্য বিষয় এবং র্যাশনাল বিষয়গুলোও অর্থাৎ ইমোশনাল এবং র্যাশনাল দুবিষয় এক হয়ে গিয়েছিল...ইত্যাদি কারণে ঐ নাটকটি একটি আলাদা মাত্রা পেয়েছিল...একটি আলাদা গ্রহণযোগ্যতা আমার কাছে পেয়েছিল।
কিন্তু এখানে হচ্ছে কী...যদি পলিটিক্যাল ব্যাপার বলি...সরাসরি কোনো পলিটিক্যাল ব্যাপার আমি দেখি নি। সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপারটা এসেছে, সিক্সটি সিক্স বা ঐ সময়ের যুদ্ধের ধ্বংসরূপ, শত্রু সম্পত্তি আইন এগুলো ঐতিহাসিক সত্য। আমি যখন শত্রু সম্পত্তি আইনের কথা শুনলাম...এই নাটকে...তখনো আমি ভেবেছিলাম...মানে আরেকটা প্রত্যাশা বেড়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম নাটকটি বুঝি...আরও কিছু ব্যাপার...শৈল্পিকভাবে উঠে আসবে মঞ্চে। সেটি কিন্তু সব সময় পাই নি। মনে হয়েছে ডুবে গেছে আবার বুরবুরি উঠেছে, ভেসে ওঠার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমি বলবো যে, শত্রু সম্পত্তি আইনের ব্যাপারটি...তার রেশ, নাটকটাতে ছিল। তবে ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে আমার একটু সন্দেহ আছে। ব্যাপারটা পুরোপুরি জানি না। তা হলো...সিক্সটি ফাইভ-এর ওয়ার এর পরই তো শত্রু সম্পত্তি আইন হলো...এই আইনে কিন্তু সম্পত্তি পুরোপুরি ক্রোক বোধহয় হতো না...সেটি হচ্ছে...উত্তরসূরি যারা থাকতো, তাদের ভাগটুকু দিয়ে বাদবাকিটা এডিসি বা ডিসি নিয়ে নিতেন...মানে সরকার নিয়ে নিতো। তারপর নিলাম হতো এবং এই নিলামে উত্তরসূরিরা অগ্রাধিকার পেতো। এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ বোধহয় করা হতো না। আমার মনে হয় এটা নিয়ে আলোচনা করা উচিত; আলোচনায় উঠে আসা উচিত। ‘আরণ্যকে’র জয়জয়ন্তীতেও এমন একটা ব্যাপার এসেছিল...সেই বিষয়টা...সেই সামাজিক-দায়িত্বের জায়গাটা একটু বড় করে আলোচনায় আসুক এটা আমার প্রত্যাশা।
হীরার কথায় আসি, কেয়ারটেকারের আর্থিক অসচ্ছলতা দেখাতে গিয়ে...স্যোশিও-ইকোনোমিক কনডিশন যে খারাপ ছিল সেটি বলেছে। আসলে সে সময় যারা থিয়েটার করতেন তাদের বেশিরভাগ লোকের অবস্থা কিন্তু তাই ছিল। মফস্বল শহরে যারা থিয়েটারচর্চা করতেন...থিয়েটারের পোকা না থাকলে করতে পারতেন না। ফলে যারা গরীব ছিলেন তারা গরীবই থাকতেন আর যারা সচ্ছল ছিলেন, বৈষয়িক দিক দিয়ে...তখন তো আর এখনকার মতো ট্রেডিং ফ্রেডিং ছিল না, ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের ব্যাপার ছিল না...প্রপার্টিটাই ছিল মূলসম্পত্তি। তা-ও আবার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এবং দেখা যেতো যে, নাটক করতে এসে এগুলো বিক্রি হতে হতে শেষ হয়েছে। এটাই হয়। আবার তাদের কেউ কেউ সংসারজীবন থেকেও বেরিয়ে এসেছিলেন।
যাত্রার ব্যাপারটা এসেছে। এখানে কিছু কিছু সংলাপ খুবই টাচি...যেমন, একট সংলাপ আছে না যে, তুমিতো মদ খাও না, তা হলে এতো সুন্দর করে কথা বলো কীভাবে?...কিন্ত এর অর্থ খোঁজার চেষ্টা করলে কন্ট্রাডিক্টরি অর্থ বেরোয়। যারা অভিনয় করতেন বা যাত্রা করতেন তারা কি শুধু মদ খেয়েই ভালো কথা বলতেন? এই প্রতীকটা আমি হীরার কাছে জানতে চাইবো।
মান্নান হীরা
এখনই বলে দিই, তা হলে আমার সুবিধা হয়।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
না, যা বলতে চাচ্ছি, আমি ভুলে যাব। তুমি লিখে রাখ।
মান্নান হীরা
ঠিক আছে।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
যাত্রার কথা যেটা এসেছে, মেয়েদের সংকটের কথা...সেটা হলো...সত্যি বলতে গেলে, ভদ্রঘরের মেয়েরা আগেও যেমন আসতো না এই লাইনে, এখনো আসে না। ঐদিনও উল্লাপাড়ায়, সিরাজগঞ্জে বলছিলাম...তোমরা নাটক করো? তোমাদের বোনেরাতো আসে না। তোমাদের বড়ভাই, ভাবী...তারা নাটক করে না কেন?...তো যেটা বলছিলাম যে, আগেও আসতো না, মেয়েরা, এখনো আসে না। তবে আগে যারা আসতো, তাদের মধ্যে কেউ কিন্তু বাঙলা নাটকে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে গেছেন। তাদের নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। কলাকাতায় হচ্ছে।...এই বাঙলার কথাই ধরুন না। এই ঢাকা শহরে বিলকিস নামে এক অভিনেত্রী আছেন যিনি না খেয়ে, অসুস্থ হয়ে, এক্সট্রা হয়ে ফিল্মে কাজ করেন। যিনি থিয়েটার করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর ঘর ত্যাগ করেছেন। লেইট ফরটিজে। এমনও হয়েছে যে, তিনি মঞ্চে অভিনয়ের সময় খবর পেয়েছেন তাঁর কন্যা মারা গেছে। তিনি নাটক শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাঁদেন নি। নাটক শেষ হয়েছে...অঝোরে কেঁদে দিয়েছেন। বিলকিসের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে...তখন তিনি একা...তখন এই সমাজের শিক্ষিত, ভদ্র, এমনকি তার নাটকের কো-অভিনেতারা তাঁর শরীর নিয়ে টানা হ্যাঁচরা করেছে।...এই তো হয়। তো...ময়ূর সিংহাসন নাটক দেখতে দেখতে...তমালিকার (তমালিকা কর্মকার) অভিনয় দেখতে দেখতে, আমার মনে হচ্ছিল যে...এ ধরনের মেয়েদের, শিল্পের প্রতি যে কমিটমেন্ট ছিল, আগের যাত্রাদলের শিল্পীদের...সেই কমিটমেন্টের জায়গাটা ওর চরিত্রে কোথায় যেন অনুপস্থিত ছিল। এই প্রসঙ্গে আমি আমার দলের একটি নাটকের উদাহরণ টানবো...‘ঢাকা থিয়েটারে’র...সেটা হলো, বনশ্রী বালার (কিত্তনখোলা) একটা ছায়া এই চরিত্রে আমি দেখলাম, দেখবার চেষ্টা করলাম। এবং আমি খুশি হলাম যে, এই ধরনের একটি চরিত্র এখনকার একজন নাট্যকারের হাত দিয়ে আসলো। বনশ্রী বালার কিছু কিছু সংলাপে...যেহেতু ঐ নাটকে আমিও একজন অভিনেতা ছিলাম...কাছ থেকে বহুবার দেখেছি...আমি রীতিমতো কেঁদেছি। রবি দাসের প্রতি যে ভালোবাসা, এমনকি ছায়া রঞ্জনের প্রতি তার যে টান, এবং সবকিছু ছাড়িয়ে শিল্পের প্রতি, থিয়েটারের প্রতি, দলের প্রতি তার যে ভালোবাসা, ওটা কিন্তু এই কৃষ্ণার চরিত্রে ছিল না।
হাসান শাহরিয়ার
এখন কামালউদ্দিন কবির কিছু বলো। দুলালভাই (শাহ আলম দুলাল) আমরা আপনার কাছে আসছি। তার আগে বিষয় নিয়ে আরেকটু শুনে নিই।
কামালউদ্দিন কবির
বিষয় নিয়ে কথা বললে মনে হয়...বারবার ইতিহাস শব্দটা, ভিন্ন ভিন্নভাবে এসে যায়। একটা ব্যাপার হলো, যে সময়টা নিয়ে নাটক, সেই সময়ের উত্তরকালের কর্মী আমরা এবং নাটকের বিষয় হচ্ছে নাটক...নাটকের মধ্যে নাটক...পীযূষ দা’ও এটা বলেছেন। তো এখন একদিকে এখনকার নাট্যকর্মীদের একটা দায় শোধের ব্যাপার, বিপ্লব দা’ বেশ ভালোভাবে বলছিলেন। আর আমার দিক থেকে যেটা ব্যাপার সেটা হলো, নাটকের সাথে সমানুভূতি কিন্তু আমিও বোধ করছিলাম। এর একট কারণ হতে পারে...আমার বাবা সাহজাহান নাটকে অভিনয় করতেন। যদিও এখন তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটের মানুষ, তবুও এই কারণে শুরু থেকেই নাটকটিতে ইনভলব ছিলাম। আমি কিন্তু...যেহেতু অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে...এবং ফলে অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে, তাই নাটকের সব ব্যাপার নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন দেখি না। আমি সরাসরিই একটা বিষয়ে চলে যাই, সেটা হচ্ছে...যেহেতু ইতিহাসকে, বিশেষ করে তখনকার নাট্যচর্চার ইতিহাসও এসেছে...তো ইতিহাস নিয়ে নাটক লিখতে গেলে একটি বিষয় জরুরি হয়ে যায় যে, ইতিহাসের পরবর্তী সময়ের যে সত্যটা প্রকাশের চেষ্টা বা আরও বললে সমাজসত্য বা রাজনৈতিকসত্য প্রকাশের যে চেষ্টা...যেটা এই নাটকেও এসেছে, শত্রু সম্পত্তি আইন বা বিশেষ করে অমূল্য’র যে জাহানারাকে খুন করা...এই সত্যগুলো নিয়ে একটু ধন্ধে পড়ে গেছি। হীরাভাই একটু আগে যে গল্পটা বলছিলেন...মফস্বলের টাউন হলের কেয়ারটেকারের গল্প...তো ঐ গল্পে দুটো সত্য আছে। এক: কেয়ারটেকার শোল মাছ খেয়েছে এক বছর আগে। এবং এই মাছ খাওয়ার সৌভাগ্য তার হয়েছে, কারণ, নাটকের প্রপসের মধ্যে শোল মাছ ছিল। দুই: কেয়ারটেকার চায় নাটকে এধরনের প্রপস থাকুকÑমিষ্টি, বা অন্যান্যসহ। তো এই দুই সত্যের প্রথমটি নিয়ে যদি নাটক করি তবে দর্শক হিসেবে যে বোধ আমার ভেতরে তৈরি হবে দ্বিতীয় সত্যটি চলে আসলে সেই বোধটি একটি সাদামাটা-পর্যায়ে চলে আসবে। নাড়া ঠিক সেভাবে দিবে না। আমার মনে হয় ময়ূর সিংহাসনে এমন ব্যাপার ঘটেছে যে, অমূল্যের ভেতরের যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তার সবই আমাকে নাড়া দিচ্ছিল কিন্তু যখন সে মুসলমান জাহানারাকে হত্যা করলো, তখন কিন্তু...যদিও এটাও একটা সত্য, তবুও এই সত্যপ্রকাশে আগের ‘সত্য’ আমাকে যে নাড়া দিচ্ছিল সেটা শেষ হয়ে গেলো। আবার শত্রু সম্পত্তি নিয়ে সেই সত্যটি দেখানো হলো...আজকে পীযূষ দা’র আলাপে জানতে পারলাম যে, একেবার নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, এটা কিন্তু ইতিহাসসত্য নয়। বরং শত্রু সম্পত্তি আইন আরও বিস্তারিতভাবে হয়তো আসতে পারতো...রাজনৈতিকসত্য নিয়ে...তো আমি অন্য প্রসঙ্গ আসলে তখন কিছু বলতে চাচ্ছি।
হাসান শাহরিয়ার
শাহেদ ইকবাল, আপনি...
শাহেদ ইকবাল
ঠিক সমালোচনার সুরে না। আমি আলোচনার জন্যই বলছি...সাধারণ-দর্শক হিসেবেই। নাটকে কিছু ক্রাইসিস ছিল। ইনডিভিজ্যুয়াল ক্রাইসিস, কালেকটিভ ক্রাইসিস, স্যোশাল ক্রাইসিস। কিন্তু নাটকের ক্ষেত্রে আসলে যে কোনো একটা পয়েন্টকে প্রাধান্য দিতে হয়। আমার কাছে এ নাটকে মনে হয়েছে, কখনো ইনডিভিজ্যুয়াল ক্রাইসিসের উপর বেশি প্রাধান্য, কখনো কালেকটিভ এবং তখনকার সমাজ এবং রাজনীতি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এবং মাঝে মাঝে কনটেন্টে কিছু অস্পষ্টতা আমি ব্যক্তিগতভাবে ফিল করেছি। কখনো মনে হয়েছে যে, দিলীপ দাসের ক্রাইসিসটাই নাটকের মূল ক্রাইসিস, কখনো মনে হয়েছে কৃষ্ণাদের ক্রাইসিসটাই মূল ক্রাইসিস, কখনো মনে হয়েছে যে, পলিটিক্যাল ক্রাইসিসটা মূল ক্রাইসিস। ফলে এ জায়গাটাতে আমার একটু খটকা লেগেছে। দ্বিতীয়ত, আমার যেটা মনে হয়েছে...একটা মূল-ঘটনা, যেটি জাহানারাকে কেন্দ্র করে, অমূল্য খুন করছে। এখানে নাটকের প্রথম থেকে আমার কাছে অমূল্যকে অতটা অবসেসিভ মনে হয় নি যে ’ও একটা মার্ডার করতে পারে। প্রতিশোধটা বরং আরও অনেক ডিফিউজভাবে আসার কথা ছিল। এতটা পয়েন্টেডভাবে আসবে আমি আসলে ভাবি নি। তৃতীয়ত, দিলীপ দাসের সম্পত্তি ক্রোক হয়ে যাওয়ার পর ঐ নাট্যদলে যে টেনশনটা ফিল করার কথা, সেই টেনশনটা আমি দেখি নি। দেখলাম, অমূল্যকে সাথে সাথে বলা হলো তুমি করবে, অমূল্য রাজি হলো এবং নাটকটা এগিয়ে গেল। দিলীপ দাসকে যদি ওয়ান অব দ্য সেন্ট্রাল ক্যারেক্টরস ধরি, তবে আরেকটু টেনশন ফিল করা উচিত ছিল।
নাটকের কিছু কিছু জায়গা আমার কাছে আরোপিত মনে হয়েছে। ঐ যে...খোকা চৌধুরী ক্যারেক্টারটা আজকে হীরাভাই যেটা ব্যাখা করলেন যে, কোনো সিঙ্গেল ডায়মেনশনে রাখতে চান নি। কিন্তু আলটিমেটলি চরিত্রটি আমাকে খুব কনফিউজ করেছে। স্যোশাল আসপেক্টে বিচার করলে চরিত্রটি পজেটিভ না নেগেটিভ সেটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার না। কারণ, ময়ূর সিংহাসন নাটকটাতে যে নাট্যদল দেখানো হয়েছে, সেখানে আগে থেকেই পতিতারা কাজ করতো...তো সেখানে শেষপর্যায়ে এসে এই পতিতাদের সাথেই কাজ করতে যাওয়াটা খোকা চৌধুরী কেন অসম্ভব ভাবলেন বুঝলাম না। আরেকটা আরোপিত জায়গা হলো কৃষ্ণা যখন চলে যাচ্ছে...ফেরৎ যাচ্ছে, যাওয়ার পথে দিলীপ দাসের সাথে দেখা হলো, হারটা পাওয়া গেল...সেই হার নিয়ে জাহানারা বা অমূল্যের কাছে আসলো...এই ব্যাপারটা আরোপিত মনে হয়েছে।
হাসান শাহরিয়ার
আমরা নাটকের কনটেন্টে আর থাকছি না। প্রায়োগিক দিকে যেতে হবে। শাহ আলম দুলালভাই অনেকক্ষণ শুধু শুনছেন, বলতে পারছেন না। তো হীরাভাইকে বলছি যে, নাটকটার প্রায়োগিক দিকে চলে যাওয়ার আগে...কী কী যেন আপনি টুকে রেখেছেন মনে হচ্ছে...সেগুলোর আলোচনাটা সেরে ফেললে ভালো হয়।
মান্নান হীরা
হাসান, আমিতো আগেই বলেছি যে, এটা কোনো জবাবদিহিতার ব্যাপার না। তাঁরা সবাই যেটা বলেছেন, খুবই যৌক্তিকতার সাথে বলেছেন। আমার কাছে মনে হয়, স্ক্রিপ্ট-এর ব্যাপারে...মানে, কী তুলে ধরবো, সেটা একটা হতে পারে যে, কিছু জিনিস তুলে ধরা হলো, আউট অব দোজ, যদি একটা কিছু বেরিয়ে আসে। আমার একটি নাটক আছে খেলা খেলা। একটি পলিটিক্যাল স্যাটেয়ার। ওটাতে কোনো গল্প নেই। কিছু সিচ্যুয়েশন আছে...বলা যেতে পারে যে, আমি ঐ সময়কার রাশিয়া-প্রধান, আমেরিকা-প্রধানকে ভাঁড় বানিয়ে...কিছু মেসেজ, কিছু অ্যাক্টিং, সব মিলিয়ে পৌনে দুঘণ্টার একটি চিত্র তুলে ধরেছি। তো আমি চাচ্ছিলাম যে, একটি সময়ের কিছু চিত্র মঞ্চে তুলে ধরবো এবং সেটার টেনডেন্সিটা যদি গল্প বলা না হয়, তাহলে সেই নাটকটা কেমন হয়। ‘এক যে ছিল’...বলে যে গল্পটা শুরু হতে পারতো, সে রকম না হয়ে, একই সময়ে...একই সঙ্গে অনেক জিনিস ঘটেতো...এ রকম একটি সময়কে যদি মঞ্চে আনা হয়, এবং আনতে গেলেতো ধারাবাহিকভাবেই আনতে হয়...তাহলে একটা কিছু দেখে দর্শক যদি কিছু রিসিভ করে অথবা আমার দুর্বলতা থাকলে তারা কিছুই রিসিভ করবে না...
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
তুমি কি...ঐ যে, পলিটিক্যাল কোলাজের কথা বলছো?
মান্নান হীরা
না, আমি সেটাও বলছি না, এটা আমারই একটা এক্সপেরিমেন্ট। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে এই ঘরে বসেই আলাপ হচ্ছিল...অনেক আলাপ হয়েছে...উনি অনেক বড়মাপের সাহিত্যিক, আমি তাঁর পায়ের যোগ্য কিনা সন্দেহ আছে...তো তিনি আমার খেলা খেলা নাটকটা দেখে, এরকম একটা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, এটা একটা রীতি হতে পারে। তো ব্যাপারটা আমার কাছে অনুপ্রেরণার হয়েছিল।
ময়ূর সিংহাসন-এর ব্যাপারে এই প্রসঙ্গে বলি যে, কৃষ্ণাকে আমি বহুদূর নিয়ে যেতে পারতাম, জ্যোৎস্না চরিত্রটিকে নিয়ে অনেকদূর যাওয়া যায়...কৃষ্ণা, জ্যোৎস্না, খোকা চৌধুরী, অমূল্য, দিলীপ দাস...এই প্রত্যেকটি চরিত্রেরইতো একেকটা পরিণতি হতে পারতো। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু, এনিমি প্রপার্টি...এটাও অনেকদূর যেতে পারতো। কিন্তু একটা সময়ের অনেকগুলো মানুষের একটি চরিত্রকে যদি মঞ্চে আনি...তবে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়?...কোনো যৌক্তিক পরিণতির দিকে যেতেই হবে এমনটা আমি বিশ্বাস করি না। জ্যোৎ¯œা কোথায় গেল, কৃষ্ণার কী হলো, শেষে দিলীপ দাসেরই-বা কী হলো...ইত্যাদি আমার কাছে প্রধান ছিল না। আরেকটা ব্যাপারে...খোকা চৌধুরীর চরিত্র নিয়ে শাহেদ ইকবাল বলছিল...বলছিল যে, চরিত্রটি পজেটিভ নাকি নেগেটিভ বোধগম্য হয় নি, কনফিউজড ছিল। আসলে মানুষের এমন কোনো সংজ্ঞাই নেই যে, একটি মানুষ পজেটিভ না নেগেটিভ। যেমন শুভ দা’ (শুভ রহমান) কে যদি বলি যে, তিনি কী? আর তিনি যদি চিৎকার করে বলেন যে আমি পজেটিভ...তবে সেই চিৎকারে ঝামেলা আছে।
শুভ রহমান
হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাতো অবশ্যই।
মান্নান হীরা
এমনকি ময়ূর সিংহাসনের সেক্রেটারির কথা যদি ধরি, নাটকে সে একেবারে নেগেটিভভাবে এসেছে। কিন্তু বাস্তবজীবনে, যে অংশটা নাটকে আসে নি...ঐ সেক্রেটারিওতো একজন বাবা, একজন স্বামী এবং সেখানে নিশ্চয়ই তিনি এতটা ঘৃণিত নন। অর্থাৎ কোনো চরিত্রকেই নির্দিষ্টভাবে পজেটিভ বা নেগেটিভভাবে বলতে চাই নি। তবে, অস্বচ্ছ কিছু ব্যাপার আছে সেগুলোর ব্যাপারে আমিই দায়ী।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
দায়ী বলছো কেন? আমরা আমাদের ব্যাখ্যা দিয়েছি বা দিচ্ছি মাত্র।
মান্নান হীরা
না, না। মানে রচনাশৈলীর জন্য দায়ী। তবে অমূল্যের ব্যাপারে যে অস্বচ্ছতার কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে যে, শুরু থেকে তাকে এতটা অবসেসিভ মনে হয় নি। আসলে কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম এটাই। কারণ, আমরা চাই নি যে, ব্যাপারটা অমূল্যের চরিত্রে এমনভাবে আসুক যে, এটা প্রি-টোল্ড হয়ে যায়। আর পীযূষ দা’র একটা কথার সূত্র ধরে বলছি যে...উনি বলছিলেন...এটা ঘটবে, পরেই অন্যত্র চলে যাচ্ছে। আর মনে হচ্ছে ওটা ঘটছে, পরে সেটাও আর থাকছে না। এ প্রসঙ্গে আমার একটা কথা মনে পড়ল...কবি শামসুর রাহমানের কথা। তিনি একটা নাটকের প্রিভিউ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। একটু দেখেই তিনি চলে যাবেন, তখন তিনি বলছিলেন যে, আমি আশা করছি এর সমাপ্তি আরও সুন্দর হবে, যেভাবে আমরা আশা করছি। এর পরই বললেন যে, অবশ্য দর্শক যা আশা করে তা-ই যদি ঘটে, সেটাই-বা কতটা সার্থক তা নিয়ে ভাববার আছে।
হাসান শাহরিয়ার
দুলালভাই এবার আপনার পালা। আপনি বা আমরা সবাই স্বীকার করবো যে, এতক্ষণ আমরা যত কথা বললাম তার কিছুই হয়তো আমাদের জানা হতো না, যদি আপনি এই ময়ূর সিংহাসনকে দৃশ্যকাব্যে রূপ না দিতেন। অর্থাৎ আমরা কিন্তু ময়ূর সিংহাসনের টেক্সটটা পড়ি নি বা পড়ার সুযোগ হয় নি। টেক্সট-এ যা-ই থাকুক না কেন একজন নির্দেশকের সৃষ্টিশীলতা কিংবা চিন্তাভাবনার উপর নির্ভর করে, টেক্সটের কোন জায়গায় প্রাধান্য দেয়া হবে কিংবা কোন বক্তব্যকে শেষপর্যন্ত দর্শকের সামনে উপস্থিত করা হবে...
বিপ্লব বালা
হ্যাঁ, সেতো বটেই।
হাসান শাহরিয়ার
তো টেক্সটটার অন্তর্নিহিত ভাবটা কী করার ইচ্ছা ছিল, সেটা হীরাভাই বললেন। আপনি বলুন যে, আমরা যেভাবে দেখলাম সেটা একদম টেক্সট-নির্ভর নাকি টেক্সট থেকে বেরিয়েও কিছু করতে চেয়েছেন।
শাহ আলম দুলাল
আসলে মূলত যখন হীরা এই স্ক্রিপ্টটি দেয় এবং আমাদের দল এটা পড়ে...পড়ার পর দল থেকে সিদ্ধান্ত হলো যে, এই নাটকটি আমার নির্দেশনায় মঞ্চে আসবে।...তো বিভিন্ন ধাপে ধাপে স্ক্রিপ্টের অ্যানালাইসিস করতে হয়Ñতা আমরা জানি। প্রথমে নিজের ও নাট্যকারের সাথে বোঝাপড়া, তারপর স্ক্রিপ্ট রিডিং-এর সময় একধরনের অ্যানালাইসিস, চরিত্র বণ্টনের পর একধরনের অ্যানালাইসিস, চরিত্র ধরে এবং চূড়ান্তভাবে মঞ্চায়নের পরও একধরনের অ্যানালাইসিস হয়...যেটা আজকে হচ্ছে।
তো শুরুতে আমি আসলে চেয়েছি, স্ক্রিপ্টের মতো করেই এগিয়ে যাবো। যদি কিছু পরিবর্তন করতে হয় তা হবে প্রয়োজনানুসারে এবং সেটা পরে দেখা যাবে। তো যখন এগুচ্ছিলাম...প্রথমেই নাটকের সময়টা ইম্পর্টেন্ট হয়ে উঠলো। ষাটের দশক। অবেলা। হ্যাঁ, বিভিন্ন সোর্স থেকে যে, তথ্য/ইতিহাস পেলাম ঐ সময়টা আমাদের জীবনে খুব ক্রাইসিসকাল। তো যখন নাটকের পাত্র-পাত্রী অভিনয় শুরু করলো...তারা কিছুদূর এগিয়েই বলা শুরু করলো যে, আমার এইসব ক্রাইসিস কীভাবে ব্যাখ্যা করবো? আমিও দেখলাম যে, ঠিকইতো, সবাই কিছুদূর যেতে না যেতেই কেবল ক্রাইসিসে পড়া শুরু করলো। আপনাদের মতো আমিও দুচোখে কেবল পাত্র-পাত্রীদের ক্রাইসিস দেখতে শুরু করলাম। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও দেখতে শুরু করলো। একজনের ক্রাইসিস আসে তো আরেকজন বলেÑআমরা এই ক্রাইসিস নিয়ে কি করবো। তো আমিও হীরাকে বলা শুরু করলাম যে, একটার ক্রাইসিস শেষ না হতেই তুই আরেকটা বড় সংকট নিয়ে আসলি কেন?
হাসান শাহরিয়ার
আপনি কি স্পেসিফিক্যালি কিছু বলতে পারবেন?
শাহ আলম দুলাল
হ্যাঁ, যেমন পীযূষ দা’ বললেন না যে, ষাটের দশক এসেছে এখন বুঝি ষাটের দশক নিয়েই এগিয়ে যাবে। কিন্তু না সাথে সাথে ছেচল্লিশের প্রসঙ্গ আসলো। আবার কৃষ্ণার বিয়ে সারা হচ্ছে তো শত্রু সম্পত্তি আইন এসে পড়লো।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
আমি কিন্তু আমার প্রত্যাশার কথা বলছিলাম।
শাহ আলম দুলাল
হ্যাঁ, আমার প্রত্যাশাও সে দিকেই যাচ্ছিল।...পরে আমি নাট্যকারের সাথে আলাপ করে ঐ পয়েন্টে একমত হলাম বা কনভিন্সড হলাম যে, হ্যাঁ কিছু পাত্র-পাত্রী একটা সময়ে একটা কাজে তারা এক হয়েছে...তাদের জীবন আমি তুলে ধরবো না....অর্থাৎ ঘটনাটা আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট না, তাদের কর্মের ইফেক্ট আমার কাছে বড় ছিল। যেমন...আমি বলছি...দিলীপ দাসের সম্পত্তি ক্রোক হয়েছে। তো পীযূষ দা’ যে ঐতিহাসিক সত্যের কথা বললেন...তা কিন্তু আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট ছিল না। শত্রু সম্পত্তি আইনটাই আমার কাছে ইস্পর্টেন্ট ছিল। এর ফলে দিলীপ দাস নিঃস্ব হয়ে গেল কিংবা ভিটেমাটি থাকলো কিনা...সেটা কোনো বড় ব্যাপার না...কারণ এই দিলীপ দাস, যে কিনা পঁচিশ বছর দোলনপুরে দেশপ্রেমের বাণী উচ্চারণ করেছে, মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছিল সে...সেই দিলীপ দাস, মানে...
হাসান শাহরিয়ার
অর্থাৎ সে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এটাই বড় কথা...যদি ভিটেমাটি ক্রোক না হতো তবুও সমান বেদনাদায়ক, সমান ক্রাইসিস হতো এই তো?
শাহ আলম দুলাল
হ্যাঁ, সমান ক্রাইসিস। সে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে...এটাই মুখ্য। এক খ- ভিটে দিলো কী দিলো না...আমার কাছে সেটা ইম্পর্টেন্ট মনে হয় নি। তারপর শাহেদ ইকবালের একটা কথায় আসি। ঐ যে বললে যে...দিলীপ দাসের সম্পত্তি ক্রোক হয়ে যাওয়ার পরেও ঐ নাট্যদলের কারো তেমন রিয়েকশন হয় নি। সেটাতে আমার কিছু বলার আছে। সেটা হলো...তখন কিন্তু...মনে করে দেখো যে, পুরো মঞ্চ কিন্তু ডমিনেট করছিল সেক্রেটারি। কেউ প্রতিবাদ করতে চায় নি তা কিন্তু না, খোকা চৌধুরী করেছিল। কিন্তু সেক্রেটারির যুক্তি এতই শক্তিশালী ছিল যে, তার প্রতিবাদ ধোপে টেকে নি। যেমন...সেক্রেটারি বলছে যে, নির্দেশককে আমি অগ্রিম টাকা দিয়েছি ঠিক? নির্দেশক বলছে ঠিক। প্রিন্সেস বলাকাকে তিনগুণ টাকা দিয়ে আনা হয়েছে, ঠিক? সবাই বলছে ঠিক। তোমাদের কথামতো ‘মুসলমান’ জাহানারা আনা হয়েছে, ঠিক? সবাই বলছে ঠিক। তখন সেক্রেটারি বলছে, তোমাদের সব কথাই রাখলাম, তবে সাহজাহান নাটক হবে না কেন? সেক্রেটারি আরও বললো যে, আমি আমার পাটের গুদামের জন্য দিলীপ দাসকে ভিটেহীন করলে দোষ হয় আর তোমরা নাটকের প্রয়োজনে কৃষ্ণাকে মুসলমান করলে দোষ হয় নাÑনা? তো...আসলে ওরা তখন প্রতিবাদ করলে কোনো কাজ হতো না বলেই করে নি। শাহেদ ইকবালের খটকা লেগেছে...কিন্তু ঐ সময়কালে সেক্রেটারি লেভেলের লোকজন তাদের ক্ষমতা দেখানোর জন্য শিল্পটিল্প মানতো না, সেই ব্যাপারটা কিন্তু স্পষ্ট। আর...
কামালউদ্দিন কবির
আমি একটু বলি, টেক্সট না, প্রায়োগিক ব্যাপার নিয়ে বলছি। আমার কাছে কিছু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে যে, সবটাই বলা হয়ে গেছে...মানে কিছু বলার বাকি রাখা হয় নি। আমি সবিনয়ে একটা উদাহরণ টানছি...অন্য উদাহরণ...সেটা হলো ঋত্বিক ঘটকের ঐ ছবিটার নাম যেন কী...সুবর্ণরেখা, ঐ যে...আমের তলায় ঝামুর ঝুমুর কলাতলায় বিয়া...শুধু এই গল্পটি শুনে...মানে গল্পটির প্রয়োগটা ওখানে শুনে...মানে, যে কান্নাটা আসে, দেশভাগের কান্না, অসাধারণ এক অনুভূতি...সে রকম অনুভূতি এই নাটকে হওয়ার সুযোগ থাকলেও সেটা হয় নি। এটা একেবারেই আমার অনুভূতির কথা বলছি...মানে এই নাটকে বেশি খোলামেলা করে, উচ্চস্বরে কান্না-প্রতিশোধ-উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া...খুন...ঐ যে, হাহাকার করা...এগুলো সম্পূর্ণভাবে আসার ফলে, শেষেরদৃশ্যটি আমার অনুভূতিতে সেভাবে নাড়া দেয় নি...
শাহ আলম দুলাল
আসলে শেষদৃশ্যটি নিয়ে...মানে শেষদিন পর্যন্ত ভাবছিলাম...কীভাবে করবো। নানাভাবেই সাজানো হয়েছিল...আমি যতই ভাবি যে, অমূল্যকে মহত্তম চরিত্র হিসেবে এস্ট্যাবলিশ করবো...তখন এই ভাবনাটা আসে যে, যদি অমূল্য এমন হৃদয়ের হয়, শিল্পের প্রতি অনুগত হয়, তাকে দিয়ে এভাবে খুন করানো কি ঠিক হবে? কিন্তু শেষভাবনা এই হয় যে, মানুষের প্রতিশোধস্পৃহা...ঐ যে হীরা বললো...প্রতিশোধ স্পৃহা যে কোথায় লুকিয়ে থাকে, তা আমরা কেউ বলতে পারি না।
মান্নান হীরা
আমি একটু ইন্টারেক্ট করি। সেটা হলো, এই অমূল্য চরিত্র নিয়ে দলেও অনেকে অনেক কথা বলেছে। আজ যে কারণে বা যে জন্য নাটকটি খোলামেলা দোষে দুষ্ট, দলের অনেকেও কিন্তু এধরনের কথা বলেছে। তারা বলেছে, অমূল্যের চরিত্রে একটি মহত্ত্ব থাকা দরকার। কিন্তু আমার পূর্বের আলোচনার সূত্র ধরে যদি বলি, তা হলে দেখবেন যে, আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না যে, কোনো চরিত্রের মহত্ত্ব দেয়া না দেয়া, এটা নাট্যকারের কাজ। চরিত্র যদি এমনিতে মহৎ হয়ে ওঠে তবে উঠবে, আর যদি না হয়ে ওঠে তবে উঠবে না। আমি আসলে দেখাতে চেয়েছি, যে মানুষটি আমার পাশে আছে, সে যে কত বড় প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে আছে, সেটা আমরা নিজেরাই জানি না। আজ সারা ভারতবর্ষের উন্মাদনাকে আমরা প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। কে, কোথায়, কীভাবে, সেটাকে...সেই প্রতিশোধস্পৃহাকে সঞ্চয় করে রেখেছে এটা আমরা কেউ জানি না।
বিপ্লব বালা
আমার এই পয়েন্টটাতে একটু বলার আছে...মানে অমূল্য চরিত্রটা যে এমন একটা প্রতিশোধস্পৃহার জায়গায় গেল...এই যাওয়াটাকে আমার কাছে একটু বাস্তবতাবহির্ভূত মনে হয়েছে। মানে বাস্তবতার এই অমূল্য-শ্রেণির লোকদের...তাদের ভেতরে যদি প্রতিহিংসা থাকে, সেটার প্রকাশ কিন্তু অন্যরকম। এরকম না। এরকম করার কোনো সুযোগ নেই। এবং তারা কুঁকড়ে কুঁকড়ে যায়, মাটির সাথে মিশে যায় এবং সেখানে প্রতিশোধ যেটা হয়, সেটা অন্যরকম...সেই ট্র্যাজেডিটা অন্যরকম। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি এখানে কিন্তু ব্যাপারটা নাটকীয়ই হলো। স্বাভাবিক হলো না।
মান্নান হীরা
বিপ্লব দা’ আপনি সঠিকভাবেই বলেছেন, কিন্তু আমার একটি ব্যাখ্যা আছে...এই অমূল্য যদি সাহজাহানের চরিত্রটি করার সুযোগ না পেতো, তবে তার ভেতরে যে প্রতিশোধস্পৃহাটা আমরা দেখছি, সেটা পেতাম না...সে হয়তো কুঁকড়েই যেত, নির্জীব, মাটি কামড়েই পড়ে থাকতো...
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
তার মানে বলতে চাও, দর্শক হিসেবে আমরা যখন সহানুভূতির মধ্যে পড়ে যাচ্ছি, তখন অমূল্যও ঐ নাটকের মধ্যেই সাহজাহানের সহানুভূতির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে?
মান্নান হীরা
হ্যাঁ, কারণ এই চরিত্রটি প্রদান করায় তার মধ্যে...মানে...
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
নিজেকে সাহজাহান ভাবতে শুরু করলো?
শাহ আলম দুলাল
এই জন্যই কিন্তু যখন বলা হলো যে, তুমি করবে সাহজাহান...তখন সে বলে, আমার একটি শর্ত আছে...
মান্নান হীরা
খুব বলিষ্ঠভাবে বলে, উচ্চকণ্ঠে বলে।
শাহ আলম দুলাল
হ্যাঁ, শর্ত দেয় যে, জাহানারাকে এই টাউন হলেই থাকতে হবে।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
তার মানে অমূল্য মদ খেয়ে যেমন মাতাল হয়, আবার যাত্রার পোশাক পড়েও ঐ চরিত্রের হয়ে যায়?
মান্নান হীরা
পীযূষ দা’ আমাকে একটু ব্যাখ্যা করতে দিন। অমূল্যর প্রতিশোধস্পৃহা কীভাবে দানা বাঁধলো দেখেন। প্রথমদিনে অমূল্য খুবই অবনতভাবে বললো যে একটা অনুরোধ করি, জাহানারা চরিত্রে একটি মুসলমান মেয়ে আনা যায় না? সেই সময় অমূল্যের ভোকাল অ্যাক্টিং, ফিজিক্যাল জেশচার এক রকম ছিল। আবার তাকে যখন সাহজাহান চরিত্রে মনোনয়ন দেয়া হলো, তখন সে বলল, প্রিন্সেসকে টাউন হলে থাকতে হবে। তার উত্তরে নির্দেশক (নাটকের মধ্যে নির্দেশক চরিত্র) বলেছিল, কেন? তখন অমূল্য দৃঢ় কণ্ঠে বললো, সাহজাহান এক কথা দুবার উচ্চারণ করে না।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
আমি এ জায়গাটা ধরতে পেরেছিলাম। কিন্তু একটা কথা হচ্ছে...খুব ভালো হলো আজকের আলোচনার জন্য...আমরাতো টেক্সটটা পড়ি নি। দুলাল যা মঞ্চে দেখালো, যেটাকে মঞ্চপৃষ্ঠা বলতে পারি; সেটা দেখেইতো আলোচনা হচ্ছে। ভালো লাগছে আমার, অনেক কিছু পরিষ্কার হচ্ছে। একটি কথা হলো, প্রিন্সেস বলাকাকে টাউন হলে রাখা এবং নিরালা বোর্ডিং এ রাখা...এসব নিয়ে ততক্ষণে কিন্তু অনেক তর্ক হয়ে গেছে। সেই মুহূর্তে অমূল্য যখন বলে যে, বলাকা এই টাউন হলেই থাকবে, তখন কিন্তু অমূল্যের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।
মান্নান হীরা
হ্যাঁ, অবশ্যই বেড়ে যায়।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
কিন্তু তখন অমূল্যোর এই ইনটেনশনটা কিন্তু বুঝতে পারি নি। আজকে হীরা যদি পরিষ্কার না করতো...আমি যেটা বলেছিলাম যে, থিয়েটার উইদিন দ্য থিয়েটার, আমরা যখন দর্শক হিসেবে ইনভলব হয়ে যাচ্ছি, তখন নাটকের একটি চরিত্র, পাত্র, অভিনেতাও আরেকটি চরিত্রের প্রভাবে...
মান্নান হীরা
তার ভেতরে একটি কেমিস্ট্রি ডেভালপ করছে।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
অর্থাৎ আর্থিকভাবে অসচ্ছল একজন লোক শুধুমাত্র নাটককে ভালোবেসে নিজের গণ্ডি থেকে উঠতে উঠতে নিজেকে সাহজাহান মনে করছে।...হীরা তোমার এই যুক্তিটি আমি গ্রহণ করলাম। হীরা বাঙলা সাহিত্যে কিন্তু তোমার এ ধরনের একটি ঘটনা আছে। হ্যাঁ, এভাবে কেমিস্ট্রি বিল্ডআপ করা সম্ভব। আমাদের এক কথা সাহিত্যিকের একটি গল্পে আছে...গোয়ালন্দের ওদিককার একজন লোক সিরাজউদ্দৌলার ভূমিকায় অভিনয় করতেন। তো ’৭১ সালের কথা। যখন গোয়ালন্দ ঘাট পাক আর্মি দ্বারা আক্রান্ত হয়, সেইরাতে লোকটি কোনো একটি চর এলাকায় সিরাজউদ্দৌলা নাটক করে এসেছে।...তো কস্টিউম পরা অবস্থায় বাসায় ঘুমিয়ে পড়েছে...নিজের ঘরে। ভোররাতে যখন শুনেছে পাক আর্মি গোয়ালন্দ ঘাট আক্রমণ করেছে, তখন সে বলছে, কী এতো বড় কথা! আমি সিরাজউদ্দৌলা এখনো বেঁচে আছি, আর রাজাকার বাহিনী আমার ঘাট দখল করবে! এবং...হি রাশড টু দ্য গোয়ালন্দ ঘাট এবং হি ওয়াজ কিলড অ্যাজ ফলস সিরাজউদ্দৌলা, বাট হ্যাভিং দ্য স্পিরিট অব সিরাজউদ্দৌলা।
বিপ্লব বালা
ইন্টারেস্টিং!
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
তো এভাবে কেমিস্ট্রি ডেভালপ করানো বাঙলা সাহিত্যে হয়েছে। এবার বিপ্লব যে বাস্তবতার কথা বলেছে সে কথায় আসি। বিপ্লব যে জায়গা থেকে বাস্তবতাকে ধরতে চেয়েছে সেটা সত্য। আমি জানি না শুভ দা’ আমার সাথে একমত হবে কিনা...সেটি হলো শেষদৃশ্যে যখন প্রিন্সেস বলাকাকে খুন করা হলো...এটা কি রাজনীতি? এট কি সত্যিকারের বৈপ্লবিক চিন্তা? সত্যিকারের বাস্তবতা? আমার মনে হয় না। কারণ, বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে কখনো বিপ্লব হয় না। খুন করবে, খুনের আগের প্রস্তুতিটি তাহলে স্পষ্ট হতে হবে। এবং খুনপরবর্তী একটি ব্যাখ্যা নাট্যকার না দিলেও দর্শকের ভেবে নিতে হবে...কোন সমাজে বসে এই নাটক দেখছি...
শুভ রহমান
একটু ইন্টারেক্ট করছি। আসলে আমাকে ময়ূর সিংহাসনের উপর একটি রিভিউ পত্রিকায় দিতে হয়েছে। সেখানেও বলেছি যে, একটি নাটকের রাজনীতিটাই আমার কাছে বড়। যদি রাজনীতি না থাকে তবে, অভিনয়, সেট...এ-সবই অর্থহীন। তো আমি কিন্তু ঐ রিভিউতে শেষপর্যন্ত এটাই লিখেছি...কেউ কিছু মনে করবেন না...ওটা আমার মন্তব্য...সেটা হলো নাটকটাকে আমি ‘মেলোড্রামা’ বলে উল্লেখ করেছি। শেষটা। সেটা নাট্যকারের দুর্বলতা হতে পারে কিংবা নির্দেশকের ব্যর্থতা হতে পারে...কারণ, হীরাভাই হয়তো ডিফেন্স নিয়েছেন, নিজের পক্ষে বলেছেন যে, তিনি অনেকগুলো ঘটনা, চরিত্রের ক্রাইসিস এভাবেই দেখাতে চেয়েছেন। তবুও আমি বলবো যে, প্রত্যেকটা ব্যাপারই আরও শার্পলি আসতে পারতো, সেই সম্ভাবনা ছিল...কিন্তু আসে নি। আসলে আমি আবারও বলছি যে, এই নাটকে...ময়ূর সিংহাসনে...রাজনীতিটাই ফোকাল পয়েন্ট হওয়া উচিত ছিল, তা না হলে আমি এই নাটক করার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না।
বিপ্লব বালা
আমার এখানে...মানে একটা দুর্বলতার কথা বলি...এটা কিন্তু শুধু এই নাটকের বেলায় হয়েছে তা না। আমাদের প্রায় সব নাটকেই এটা হচ্ছে। সেটা হলো, ইচ্ছাপূরণের একটা ব্যাপার হয়েছে। অর্থাৎ অনেক জটিল দ্বন্দ্বের সমাধান অনেক সরলভাবে দেয়া হয়েছে। আমি উদাহরণ দিচ্ছি, সেটা হলো...যখন দিলীপ দাসের সম্পত্তি ক্রোকের ঘোষণাটা শোনাা হলো, তখন প্রায় সবাই একই রিয়েক্ট করেছে। কিন্তু আমি মনে করি না যে এটা ঠিক। কারণ, দিলীপ দাসের সম্পত্তি ক্রোকে...কেউ হয়তো বলবে, ঠিকই আছে, সে আসলে গোপনে গোপনে ইন্ডিয়া গিয়ে এই এই করে, কেউ হয়তো বলবে, তার যা হওয়ার হয়েছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না, আমরা চাই নাটক হোক অর্থাৎ এর মধ্যে অনেক জটিলতা আছে। হীরা একবার বলেছিল, আমার মনে হয় ওটাই ঠিক যে, রাষ্ট্র যেমন সাম্প্রদায়িক ছিল, তেমনি মানুষেরাও সাম্প্রদায়িক ছিল। কার ভেতরে কী সাম্প্রদায়িকতা লুকায়িত ছিল আমরা কেউ জানি না। এই-ই যদি হয়, তবে বলবো, রিয়েকশনটাকে আদর্শায়িত করে ফেলা হয়েছে, এটা বাস্তব না। মানুষগুলোকে, চরিত্রগুলোকে, তখন সাম্প্রদায়িক দেখানো হয় নি। আদর্শায়িত করে ইচ্ছাপূরণ করা হয়েছে।
শাহেদ ইকবাল
আমি একটা কথা বলি। যেহেতু টেক্সট এবং প্রায়োগিক ব্যাপার এক সাথে আলাপ হচ্ছে...সেটা হলো, একটা লোক যখন কোনো কিছু দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কোনো কাজ করবে...অযৌক্তিক কাজ হলেও সেই কাজের পেছনেও একটা যুক্তি থাকতে হবে। বলা হলো যে, অমূল্য সাহজাহানের পোশাক পরে অভিনয় করতে করতে সাহজাহানের চরিত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে সে খুন করলো। আমরা টারজানে অনুপ্রাণিত হয়েও অনেক কাজ করি।...তো সাহজাহানের কোন ব্যাপার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সে খুনটা করলো?
শাহ আলম দুলাল
না, একদম সাহজাহানের চরিত্র করেই সে খুন করেছে তা কিন্তু ১০০% ঠিক না। অমূল্যের ভেতরে...বহু আগে থেকেই তা কাজ করছিল...মানে ঐ যে বললো যে, জাহানারা চরিত্রে একজন মুসলমান মেয়ে আনা যায় না?...তখন থেকেই...
মান্নান হীরা
আমি বলতে চাচ্ছিলাম অমূল্য চরিত্র লাউড হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা, মানে সে যে অ্যালিভেটেড হয়ে উঠলো সেটা। প্রকৃতপক্ষে ভেতরের ব্যাপারটাতো অন্য। সে তো ভেতরে ভেতরে প্রতিহিংসা পুষছিল। সেটা প্রকাশ পাওয়ার সুযোগ ঘটলো ঐ কারণে...মানে...ঐ সাহজাহান চরিত্র পাওয়ার পর।
শাহেদ ইককাল
ঠিক আছে...হীরাভাই প্রথমে বলেছিলেন যে, এই নাটকটি হচ্ছে খ- খ- চিত্র। অর্থাৎ কোনো চরিত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ কিংবা পরিণতি দেখানোর প্রয়োজনবোধ আপনি করেন নি। তা হলে আমার একটু জানার ইচ্ছে যে... যদি তাই হয়, তবে নাটকের শেষে এসে এমন মেলোড্রামাটিক করার প্রয়োজন ছিল কি?...মানে একদম ঐ জায়গায় ঐভাবে গলার হার পাওয়া...ঐভাবে অমূল্যকে বলা যে, এই যে...এ তো তোর সেই হারিয়ে যাওয়া কন্যা...ইত্যাদি ইত্যাদি।
শাহ আলম দুলাল
সেটাতো বললাম যে, শেষপরিণতির ব্যাপারে আমরা এখনো নিরীক্ষার পর্যায়ে আছি। মানে...এখনো অনেক সুযোগ আছে নাটকের শেষটা পরিবর্তন করার।...আপনাদের এই আলোচনাও আমি অবশ্যই মাথায় রাখবো।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
দিলীপ দাসের ইন্টেগ্রিটির ব্যাপারে একটু বলি। আমার কাছে মনে হয়েছে, তাকে শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা বা শত্রু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ফলে যে রিয়েকশন সবার ভেতরে আসার কথা সেটা কিন্তু তার ইন্টেগ্রিটির উপর নির্ভর করবে। আমি বলতে চাচ্ছি যে, তার উপর অন্যের শ্রদ্ধাবোধ থাকবে কী করে? তার নিজেরই তো দেশের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। সেতো সাহজাহান করে কিন্তু সাহজাহানকে সে নকলনাটক বলেছে।
মান্নান হীরা
সেটাতো ডি.এল. রায়কে বলেছে।
কামালউদ্দিন কবির
এই প্রসঙ্গটা আসাতে ভালো হলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে নাটকীয়ভাবেই এসেছে এটা। যখন দিলীপ দাস বলছে যে, ডি.এল. রায় চুরি করেছে...এবং আসলেই তাই। ঐ সংলাপগুলোই বলেছেন...ঐ যে, মিসফরচুন নেভার কামস এলোন...
মান্নান হীরা
যখন ওটার বাঙলা বলতে বলা হলো তখন সে...মানে দিলীপ দাস বলেছেÑওটা বলবো কেন?
কামালউদ্দিন কবির
হ্যাঁ, এবং ডি.এল. রায়ের ব্যাপারে একটি মতামত আছে। সেটা হলো তিনি ইতিহাসের সত্য এবং নাটকের দাবি- এ দুটোকে সমানভাবে মিটিয়েছেন। এখন আমার একটি জানতে চাওয়া, সেটা হলো, আমরা যখন নাট্যচর্চা করছি, এই সময়ে নাটক রচনা এবং নাট্যচর্চা এই দুটো ব্যাপারেই আমরা ইতিহাসের দাবি এবং নাটকের দাবি কতখানি মেটাচ্ছি? হীরাভাইয়ের কাছে প্রশ্ন...
মান্নান হীরা
আমার কাছে আসলে প্রশ্নটা পরিষ্কার না...আরেকবার বলো।...একটু সহজ করে বলো...হাঃ হাঃ অনেকক্ষণ আলোচনার পর মাথায় সহজে সব কিছু ধরছে না।
কামালউদ্দিন কবির
হাঃ হাঃ, বলছি। উদাহরণ দিয়ে বলি। ময়ূর সিংহাসনে দিলীপ দাস বলছে যে, ডি.এল রায় চুরি করেছে...তো সময়টা ছিল ষাটের দশকের। তো ঐ সময়ের রচনাশৈলী একধরনের ছিল...ঐ যে, প্লটবিভাগ, দ্বন্দ্ব-বিন্যাস ইত্যাদি ইত্যাদি। তো এখন, বর্তমানে নাটকের রচনাশৈলীতে কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা, নাকি সেই জায়গাতেই আছি।
বিপ্লব বালা
নাট্যকারের বলার আগে আমি একটু বলতে চাই।...সেটা হলো নাটক অনেক ধরনের হতে পারে। এই যে, আমরা দাবি করি, চরিত্রের পরিণতি হলো কিনা...এটা কিন্তু একটি রীতির চাহিদা বা দাবি। নাটক অনেক রীতির হতে পারে...এ যে, ইতিহাসের দায় মিটাবে এটা একটি রীতি। কিন্তু এই রীতিই থাকতে হবে, এটাই সেরা রীতি...এমন বলার কোনো মানে নেই। কাজেই কোনো রীতিকে আদর্শ ভাববার কোনো কারণ নেই। এটা বলাটাই গোলমেলে। একেক নাটকের একেক রীতি। সেই নাটকটায় রীতিটা কী দাঁড়ালো সেটা বোঝাই ভালো। অমুক ধারার হলো কিনা, এই ধরনের পারসপেক্টিভে দেখতে গেলেই ভুল হবে। এটাকে এটার পারসপেক্টিভেই দেখতে হবে।
কামালউদ্দিন কবির
বিবর্তনের ফলে এখন যেটা দেখতে পাচ্ছি যে, সেই শেক্সপীয়রের ছিল একটি ধরন...আবার ষাটের দশকে অন্য ধরনের সাথে শেক্সপীয়রের ধরনেরও উপস্থিতি দেখলাম। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রে...যেমন, চিত্রকলা, সংগীত...এতে অনেক বাঁক-বদল যেভাবে এসেছে...আঙ্গিকের, বিষয়ের বিশাল পরিবর্তন এসেছে...তো এই সময়ের নাটকে সেটা কি এসেছে? নাকি আসে নি?
বিপ্লব বালা
কোনো ধারা তৈরি হয়েছে কিনা?
কামালউদ্দিন কবির
হ্যাঁ। এক জায়গায় থেমে আছি কিনা?
বিপ্লব বালা
না, একটু বোধহয় হয়েছে...ধারার দিক থেকে, ঐ রকম ধারার ব্যাপারটাই ভেঙ্গে গেছে। একটি ধারা চলতে থাকবে আরেকটি ধারা আসবে, এরকম গতির চরিত্রটি নেই।...এখন কেউ মাথাই ঘামাচ্ছে না যে, এটা কোন ধারার হলো। কারণ, ধারাটাকেই বাধা মনে হচ্ছে। কেন একটা ধারা ফলো করতে যাব? আমি আমারটা করতে গিয়ে যেমন হবে সেটাই ইউনিক।
কামালউদ্দিন কবির
সেটাই। আমি বলছি যে, ময়ূর সিংহাসনের বিষয়বিন্যাস এবং উপস্থাপনা...এতে ঐ পরিবর্তনটা দেখতে পাচ্ছি কিনা? আমি কোনো পূর্বের ধারা-অনুযায়ী করা না করার কথা বলছি না। মানে কোনো রীতি দাঁড়ালো কিনা?
বিপ্লব বালা
এটাই একটা রীতি দাঁড়িয়েছে।
কামাল উদ্দিন কবির
ঠিক আছে, আমি সেটাই জানতে চেয়েছিলাম।
মান্নান হীরা
আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হলো...বিপ্লব দা’র সূত্র ধরেই বলতে চাচ্ছি...সেটা হলো, এখন নাট্যরচনা...কবির যেটা বলছিল কোনো ফর্ম-এর ইন্ডিকেশন কিন্তু অবশ্যই থাকে। সেটা হচ্ছে প্রত্যকটা নাটকের আলাদা আলাদা রীতি। এবং আমরা জানি যে, উপন্যাসের ঢঙে নাটক লেখা হচ্ছে এবং কোনো দৃশ্যবিভাগ নেই এবং প্রয়োগের ব্যাপারেও বিন্যাসটা অন্যরকম হচ্ছে। ঠিক একইভাবে...নাটক প্রযোজনার পর এটা কোন রীতিতে পড়লো, সেটাও কিন্তু আজকের আধুনিক নাট্যসমালোচকরা দেখতে চান না। বা দেখা উচিতও না।
কামালউদ্দিন কবির
আমি কিন্তু এটা সন্ধান করতে চাচ্ছি না। চাচ্ছিলাম যে, রীতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে...মানে যেটা করছি সেটাইতো রীতি বলছেন...তো সেই রীতিতেই লেখায় এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নতুনত্ব এসেছে কিনা?
বিপ্লব বালা
তুমি কি টেক্সটের কথা বলছো, নাকি প্রয়োগের কথা বলছো?
কামালউদ্দিন কবির
দুটোই। আসলে...মানে এই জায়গাটায় আমি জোর দিতে চাই, সেটা হলো...শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে যে আঙ্গিক ও বিষয়গত বিপ্লব ঘটে গেছে...সেখানে আমাদের নাটকের বা এই নাটকেই, ময়ূর সিংহাসনে কোনো নতুনত্ব এসেছে কিনা?
মান্নান হীরা
এটাই যদি বলো তবে আমার মনে হয় এসেছে। ময়ূর সিংহাসনে ঐ ব্যাপারটা নেই...ঐ যে, একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকবে, তাকে নিয়ে প্লট এগিয়ে যাবে...এসব ব্যাপার এই নাটকে নেই। ঐ যে, একটি মেইন-প্লট, তার আশেপাশে সাব-প্লট...এসব নেই। এখানে প্রত্যেকটা চরিত্রের সংকট আছে। এবং আজকের আলোচনাতেই যখন কেউ কেউ বললো যে প্যারালাল সংকট নাটকে সমস্যা করে তখন আমি ডিজএগ্রি করেছি।
কামালউদ্দিন কবির
এখানেই কিন্তু আমি একমত। এবং আধুনিকতা নির্দেশ করে বোধহয় এখানেই। কেননা আগে ছিল একটি গল্প নিটোলভাবে বলে যাওয়া...এখন কিন্তু একটি মানুষ না কেবল বরং আশপাশের সব কিছুই, মানে সময়ট চলে আসে। এটাই আধুনিকতা। তো হীরাভাই, ময়ূর সিংহাসনকে আপনি যেভাবে ব্যাখ্যা করছেন, মঞ্চপৃষ্ঠায় কিন্তু আমরা সেভাবে দেখি নি। এটা অবশ্য উপস্থাপনার কারণেও হতে পারে।
মান্নান হীরা
আমার অন্য একটি নাটক একটি দল করেছে...ইট ইজ আ ডিরেক্টর’স প্রবলেম...নির্দেশক কীভাবে দেখাবে সেটা সে-ই ভালো জানে।
হাসান শাহরিয়ার
আমরা এব্যাপারে আর বেশি সময় নিতে পারবো না। নাটকের কয়েকটি দিক অভিনয়, আলো, সেট ডিজাইন...ইত্যাদি নিয়ে একটু কথা বলতে হবে। তো...টেক্সট ও প্রায়োগিক ব্যাপারে সংক্ষিপ্তভাবে আর কিছু যদি বলার থাকে তো বলুন।...আমি একটু বলে নিই। সেটা হচ্ছে...হীরাভাইয়ের কথার সূত্র ধরে...টেক্সট এবং প্রয়োগ এ দুটো অবশ্যই আলাদা আলাদা দুই শিল্পীর কাজ। ফলে এই দুই শিল্পীর আলাদাভাবেই ভালো-মন্দের প্রশংসা-দায় নিতে হবে। সেদিক থেকে যদি বলি, স্ক্রিপ্টে যাই থাকুক...এই যে, ময়ূর সিংহাসনে যেভাবে সংলাপ লেখা হয়েছে আর যেভাবে সংলাপ চরিত্রায়ণ করা হয়েছে এর মধ্যে কিন্তু পার্থক্য হয়ে গেছে, যা আমরা আমাদের আলোচনায় পেয়ে গেছি।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
তবে আমি বলতে চাই যে...দুলাল নিজেও বলেছে, এখনো অনেক কাজ সে করবে। তো এটাই হয়। আমরা সবাই নাটকের সাথে জড়িত। সবাই জানি, প্রদর্শনী বাড়তে বাড়তেই পারফেকশনটা আসে। এই জন্যেই আমি টেক্সটটে বারবার ফিরে যেতে চাই। কবির যেট বলছে...সেখান থেকেই আমি বলি। তা হলো ময়ূর সিংহাসন কোনো বিচ্ছিন্ন নাটক না। এটা বাংলাদেশেরই বা বাঙলা নাট্যচর্চারই একটি অংশবিশেষ। আমরা সবাই মিলে নাটক করছি। কী জন্য করছি? করছি এই জন্য যে, সামনের শতকে বাঙলা নাটককে যেন আরও এগিয়ে নিতে পারি। এখন আমাদের আরও সুবিধা হয়েছে। আমাদের কারণে একটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পর্যন্ত হয়েছে। এখন কিন্তু আমাদের সুবিধা বেশি। দাবিও বেশি। টেক্সটটাকে বেসিক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। রচনাশৈলী নিয়ে ভাবতে হবে। দুলাল যে মাঝে মাঝে মনে করে যে, আমরা আক্রমণ করছি...তা কিন্তু না।
মান্নান হীরা
পীযূষ দা’ একটি প্রশ্নের কিন্তু উত্তর দেয়া হয় নি। সেটা হলো আপনি বলেছিলেন যে, কৃষ্ণা বলে, খোকা দা’ তুমিতো মদ খাও না তাহলে এমন সুন্দর করে কথা বলো কীভাবে?
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
হ্যাঁ। বলো।
মান্নান হীরা
এটা আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে...প্রত্যেকেরই একটি প্রফেশনাল লাইফ থাকে, যেটার সাথে সে যুক্ত থাকে, যেটা করতে সে অভ্যস্ত...যাবতীয় দেখাগুলোকে সে সেই নিরিখেই দেখতে চায়। আমি একটা বাসে আমার দুই নাট্যবন্ধুকে নিয়ে আরিচা পার হচ্ছিলাম, সন্ধ্যা হবে হবে...এমন সময় ঠাণ্ডু রায়হান (দুই বন্ধুর একজন) বলে উঠলো, দেখছো, মেঘের ব্যাপারটা দেখছো, ইস এটা যদি কোনোভাবে মঞ্চে আনতে পারতাম।
শুভ রহমান
যেহেতু সে লাইটের কাজ করে।
মান্নান হীরা
হ্যাঁ, আবার আরিচার ঘাটে এসে দাঁড়িয়ে আছি...জাহাজের উপর...তো একজন মুড়িওয়ালকে দেখিয়ে পীযূষ দা’ বললো (দ্বিতীয় বন্ধু) দেখো গেট-আপটা দেখো। এমন গেট-আপ আমাদের কেউ নিতে পারবে না।...তো কৃষ্ণার এই যে বলা, তুমি এতো সুন্দর করে কথা বলো কীভাবে? আমি বলি কী...কৃষ্ণার তো একটা জীবন আছে, সেটা হচ্ছে সে একজন বারবণিতা। তো তার ওখানে হরহামেশাই মদ্যপদের আনাগোনা। এবং খেলে বা ঢাললে মানুষ একটু উদার হয়। সুন্দর সুন্দর কথা শুনতে শুনতে সে এতো বেশি অভ্যস্ত এবং সকালবেলা হয়তো চাদরটাই কেড়ে নেয়, পয়সা দেয় না। তো এটাইতো কৃষ্ণার অভিজ্ঞতা। তাই সে যখন দেখে যে, কেউ সুন্দর করে কথা বলে, তখন সে ধরেই নেয় যে, সে মদ খেয়েছে। আর যখন সে শোনে যে সে মদ খায় নি, তখন ভাবতেই পারে না যে এটা কীভাবে সম্ভব।
হাসান শাহরিয়ার
আমরা এখন কিছু টেকনিক্যাল ব্যাপারে আলোচনা করবো। আলো। ময়ূর সিংহাসনের আলোর ব্যাপারে কিছু...
কামালউদ্দিন কবির
আমার একটা জানার ব্যাপার আছে। নাটকের শুরুতে দেখলাম যে দিলীপ দাস চেয়ারে বসা। আলো ছিল না, আলো আসলো। দিলীপ দাস সাহজাহান নাটকের মহড়া শুরু করলো। তো...ঠিক এভাবে অন্ধকারে বসা থাকবে, লাইট আসবে এ ব্যাপারটা বেশ আগের নাটকের মতো মনে হয়েছে। এটা কি ইচ্ছাকৃত?
শাহ আলম দুলাল
হ্যাঁ, এটা আমি ঠাণ্ডুকে (ঠাণ্ডু রায়হান, এ নাটকের আলোকপরিকল্পক) বলেছি যে, ঐ সময়ের, মানে মফস্বলে যেভাবে নাটক শুরু হয়...ঐ সময়টা ধরবার জন্য আবহটা তৈরি করবার জন্য।
কামালউদ্দিন কবির
পুরো নাটকে কিন্তু পাই নি।
শাহ আলম দুলাল
না, নাটকের মধ্যে সাহজাহান নাটকের যে মহড়া ছিল সেখানে করেছি। অন্যত্র করি নি।
কামালউদ্দিন কবির
যদি ঐ সময়ের আবহ তৈরির জন্য হয়, তবে ঠিক হয়েছে। আমার কাছেও সেই আবেদন এসেছে।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
আমি একটা কথা বলি। মানে...থিয়েটার তো ঘটার ব্যাপার, আগে থেকে হয় না। এটা ঘটে। ঘটতে গিয়ে ভুল হওয়াও স্বাভাবিক। আমি শ্মশানঘাটের ব্যাপারে বলছিলাম। শ্মশানঘাটটা ভিজ্যুয়ালি যতখানি ভালো লাগার কথা ছিল, ততখানি লাগলো না। এমনকি শ্মশানঘাটে একটা আগুনের কাঠও দেখতে পেলাম না, আগুনটা নিভু নিভু করে জ্বলছে এমন কিছু থাকলেও...মানে আমি গিমিক তৈরির কথা বলছি না। ভিজ্যুয়াল একটি ইফেক্ট চাইছিলাম। এখানে ঠা-ু বোধহয় কিছু করতে পারতো।
শাহ আলম দুলাল
আর কিছু?
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
আচ্ছা, শেষদৃশ্যে যখন খুন হয় তখন কি লাল লাইট ফেলা হয় নাকি?
শাহ আলম দুলাল
না, জানালার ভেতর দিয়ে একটা আলো ফেলা হয়। অন্য কিছু না।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
আমার কাছে রেডিশ মনে হলো।
শুভ রাহমান
না তো। আমার তো এমন মনে হয় নি।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
না, আমি আবার ভাবলাম...মানে, বিপ্লবের রঙ লাল তো।
কামালউদ্দিন কবির
দর্শক হিসেবে যেটা মনে হয়েছে...মানে ফর্ম-এর দিকেতো নজর থাকে না...যা হচ্ছে তা-ই দেখছি। তো সেট ডিজাইনে...আমরা তো চাইবো যে, পুরো নাটকটা সেট ডিজাইনে গেলো কিনা। সেখানে আমার একটু...মানে জহিরভাইয়ের সাথে (ফয়েজ জহির, এ নাটকের সেট ডিজাইনার) আমার কথা হয়েছে...চিতা জ্বালানোর সময় ওখানে একটি মরা গাছের মতো আছে। সেখানে ছোট ছোট দুটি সজীব পাতা আছে।...নিশ্চয়ই এর উদ্দেশ্য আছে। তো আলো দ্বারা হোক বা যেভাবে হোক সেটা হাইলাইট করার কথা ছিল। আমি জানি না...কেউ দেখেছে কিনা। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি, কারণ, আমি সেট ডিজাইন করি...আমার নিজের প্রয়োজনেই দেখেছি। তো সেই পাতা দুটোকে আলাদাভাবে দেখানো কিন্তু হয় নি। যেমন, শুরুতেই...ডাউন রাইট এ হারমোনিয়ামটা ঢাকা থাকে...মানে আমার কাছে সেট ডিজাইনের এই ব্যাপারটা খুব ভালো লেগেছে যে, বাদক আসলো, কাপড়টা তুললো, দেখা গেল হারমোনিয়াম। মানে মহড়া কক্ষটা উন্মোচিত হলো।
হাসান শাহরিয়ার
এমনিতে ওভার অল সেট ডিজাইন বোধহয় ভালো হয়েছে। একটি ডিজাইনে বহু কিছু দেখাতে হয়েছে। আবহ তৈরিতে বোধহয় সফল।
কামালউদ্দিন কবির
হ্যাঁ, তবে ঐ যে, দেয়ালের যে রঙ করা হয়েছে...সেখানে খুব উজ্জ্বল হলুদ রঙ করা হয়েছে...সেটাকে একটু পুরনো করে দেয়া যায় কিনা। মফস্বলের টাউন হলতো...
শাহ আলম দুলাল
হ্যাঁ, আমি আরও কিছু ইলিমেন্ট যোগ করবো, ঐ যে আপ রাইট স্টেজে ফাঁকা জায়গা আছে না? ওখানে একটা গোল সিঁড়ি থাকবে যেখানে...ঐ...বলাকার কক্ষটা থাকবে।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
সেটটা আমার কাছে খুব নিট মনে হয়েছে। অতটা না থাকাই ভালো।
শাহেদ ইকবাল
দুলালভাই, শেষদৃশ্যে মামুনভাইয়ের যে সংলাপটা অফ ভয়েজে দেয়া হয়, সেটা হঠাৎ করেই কানে বাজে। ইংরেজিতে উনি অনেক সংলাপ কিন্তু নাটকে দেন। এবং সেগুলো খুবই ভরাট গলায়...ভালো লাগে। কিন্তু শেষসংলাপটা অফ ভয়েজে দেয়ার প্রয়োজন নেই মনে হয়। মামুনভাইয়ের গলায় সরাসরি দিলেই ভালো লাগবে।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
তা ছাড়া আমাদের সাউন্ড সিস্টেম এতো বাজে, ঐগুলো ব্যবহার না কারাই ভালো।
হাসান শাহরিয়ার
অভিনয় নিয়ে যদি...
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
যামিনী লাহিড়ীর কথা আমি বারবার বলছি। ময়ূর সিংহাসনে...সাহজাহান চরিত্রের অভিনেতা, আমাদের শ্রদ্ধেয় অভিনেতা অগ্রজ নাট্যাভিনেতা মামুনুর রশীদের অভিনয়...যামিনী লাহিড়ীর যে জিনিসটি সেই সিক্সটিজে এ দেখেছি...এর থেকে কোনো অংশেই এগুনো মনে হয় নি। এটা আমাদের কষ্টের কথা, অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমি যুক্তি দিই যে, আমিতো তখন ছোট ছিলাম। আমার মধ্যে আবেগ বেশি কাজ করতো।...তবুও যামিনী লাহিড়ীর সাহজাহান চরিত্রে অভিনয়...আমার স্মৃতিতে এতোই উজ্জ্বল...তার চেহারা, তার ভয়েজ, তার প্রজেকশন সব কিছু মিলিয়ে কোনোভাবেই আমি আজকের এই...মানে সব ধরনের আধুনিক সুবিধাপ্রাপ্ত এবং বিশ্বনাট্যচর্চার সাথে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও কেন যেন মামুনভাইকে যামিনী লাহিড়ীর থেকে উপরে স্থান দিতে পারছি না, এটি সাংঘাতিকভাবে আমাকে পীড়া দিচ্ছিল। আই অ্যাম ভেরি স্যরি। মামুনভাইকে অনুরোধ করবো তিনি যেন কষ্ট না পান, তিনি আমার শ্রদ্ধেয়।
বিপ্লব বালা
আমার একটা কথা আছে...শুরুতে যেটা বলছিলাম...মানে ষাটের দশকের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাথে এখনকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মিল অমিলের কথা বলছিলাম। সেখানে একটি সমস্যার কথা বলতে চাই...সেটা অবশ্য শুধুই এই নাটক নিয়ে নয়...প্রায় সব নাটকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেটা হলো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ক্ষমতার কথা...যামিনী লাহিড়ী এবং মামুনভাইয়ের কথা। আমি বলতে চাই যে, যামিনী, মানে আগের জেনারেশনের অভিনয়...যত আতিশয্য, ভাবালুতা সবটা-সহ যে অভিনয়ক্ষমতা...তার সাথে শুধু মামুনভাই কেন...কোনো অভিনেতার নাম আপনি করতে পারবেন কিনা? কাজেই শুধু মামুনভাই বলার কোনো মানে নেই।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
আধুনিক থিয়েটারের যা যা দরকার তার সবটুকু চর্চা, মানে...কেন যামিনী লাহিড়ীর প্রসঙ্গ আনছি...সত্তর বছর বয়সেও আমরা তাকে দেখেছি ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে...গোসল সেরে, তানপুরা নিয়ে রেওয়াজ করতেন। তিনি কিন্তু গান করতেন না। শুধু গলা সাধার জন্য, অভিনয় করার জন্য গলা সাধতেন।
বিপ্লব বালা
আমি এই জন্যেই বলতে চাই...মানে এখনকার অভিনেতা আর তখনকার অভিনেতার মধ্যে সামাজিকভাবে শ্রেণিগত দূরত্ব ছিল। তারা নি¤œমানের ছিল, তাদের সামাজিকমর্যাদা ছিল না। অর্থ ছিল না। আর আমাদের থিয়েটারের লোকজন অনেক উপরের জায়গায় বসে আছে। তারা ঐ পূর্বপুরুষদের অনেক ছোটচোখে দেখে...তার শ্রেণিগত দৃষ্টি এটা। এটা যেমন একটা পয়েন্ট আর একটা...আমি পারফর্মেন্সের দিক থেকে বলতে চাই...শুধু ময়ূর সিংহাসনের অভিনয় না, এখানকার সবার অভিনয়ই এই ধারার...ধারাটা হলো যে, যখন কোনো পূর্বপুরুষ কিংবা অন্য কোনো ঐতিহাসিক কিংবা কোনো পরিচিত শ্রেণির চরিত্রে অভিনয় করে, তখন তারা মূলত ব্যঙ্গ করে। ঐ চরিত্রে অভিনয় করার ক্ষমতা অর্জন করতে চায় না কেউ। কেবল ব্যঙ্গ করে।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
ময়ূর সিংহাসনেও কিন্তু আছে।
বিপ্লব বালা
হ্যাঁ আছে। আমি বলতে চাই, আমাদের ভেতরে অজান্তেই একটা অশ্রদ্ধা আছে এবং সেটা ব্যঙ্গাত্মকভাবে আছে। চরিত্রের ভেতরে না গিয়ে কেবল মেলোড্রামা করে, ব্যঙ্গ করে। ফলে চরিত্ররূপায়ণে একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়।
কামালউদ্দিন কবির
এবং যে কারণেই বোধহয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর কিছু কিছু দৃশ্যে দর্শক হেসে ফেলে।
বিপ্লব বালা
হ্যাঁ, দর্শকতো মজা পায়। কারণ, কোনো শ্রদ্ধাবোধ থেকে যেহেতু সে অভিনয় করে নি, তাই সে মজা দেয় এবং দর্শকও মজা নেয়। এটা খুব অন্যায় বলে আমি মনে করি।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
সে সময়ে...অমলেন্দু বিশ্বাস...বা অন্যান্য যারা যাত্রা করতেন...অর্থাৎ অমলেন্দু বিশ্বাস মঞ্চে যখন মাইকেল করতেন, আমারতো মনে হয়...আমাদের মঞ্চের কয়জন অভিনেতা-অভিনেত্রীর মেঘনাদবধ কাব্য পড়া আছে, মুখস্ত আছে? যদি কেবল দেখে দেখেও পড়তে দেয়া হয় তবে একপৃষ্ঠার মধ্যে কতবার থামতে হবে? আমি কিন্তু ছোট করছি না কাউকে। মানে যখনই পারফেকশনের ব্যাপার আসে এবং যখনই আমি পারছি না, তখনই কৌতুক জুড়ে দিচ্ছি এবং কৌতুক করতে গিয়েই অন্যকে ছোট করে ফেলছি।
মান্নান হীরা
এটা যে অক্ষমতা থেকেই করছে তা বোধহয় না। আমার মনে হয় দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার আছে। কে কীভাবে তাদেরকে (পূর্বপুরুষ/অভিনেতাদের) দেখছে সেই দৃষ্টিভঙ্গিটাই প্রধান।
কামালউদ্দিন কবির
তবে সার্বিকভাবে বললে বলতে হয়, অনেকের অভিনয়ই আমার কাছে ভালো লেগেছে। বাবুভাইয়ের অভিনয় সব সময়ই ভালো লাগে। ময়ূর সিংহাসনেও ভালো লেগেছে। উনি চরিত্রের মধ্যে থাকেন, চরিত্রটাকে উপভোগ করেন, এটাই ওনার বড় গুণ। দু-একজন ছাড়া সবার অভিনয়ই প্রশংসনীয় হয়েছে।
হাসান শাহরিয়ার
হ্যাঁ, এবং সেক্রেটারির ভূমিকায় যিনি অভিনয় করলেন...ওনাকে অবশ্য এত বড় চরিত্রে কখনো দেখি নি...আমার কাছে ওনার অভিনয়ও খুবই ভালো লেগেছে। যাক, আমরা আমাদের আলোচনার একেবারে শেষপর্যায়ে চলে এসেছি। এবার...
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যয়
শাহরিয়ার, আমার একটা কথা আছে। কথাটা অবশ্য শেষকথাই বলতে পারো। সেটা হচ্ছে, সব আলোচনা-সমালোচনার পর আমি বলতে চাই, ময়ূর সিংহাসন যে ধরনের নাটক...বিষয়গত এবং উপস্থাপনাগত দিক দিয়ে...তাতে করে আমার মনে হয় এ নাটকটা ঢাকার বাইরে, মফস্বল শহরে, খুব বেশি বেশি মঞ্চায়ন হওয়া দরকার। ফর্ম এবং কনটেন্ট-এর দিক দিয়ে এটা ওখানে খুবই উপভোগ্য হবে বলে আমার ধারণা। ‘আরণ্যকে’র জন্য সুবিধা আছে, ওরা মফস্বলে প্রচুর নাটক করে। তাহলে মফস্বল শহরে নাটক মঞ্চায়নের যে দায় আমাদের থাকা উচিত, সেটাও পূরণ হয়।
হাসান শাহরিয়ার
আমরা আজ এখানেই শেষ করতে চাই। ‘আরণ্যক নাট্যদলে’র প্রযোজনা ময়ূর সিংহাসন নিয়ে যত কথা বলা হলো, তা এই নাটকের বহুল মঞ্চায়নের প্রত্যাশা নিয়েই করা হয়েছে। কোনো নাটক নিয়ে অনেক কথা বলা যায় তখনই, যখন ঐ নাটকটি আলোচিত-নাটক হয়ে ওঠে, দর্শকের গ্রহণযোগ্য নাটক হয়ে ওঠে। ময়ূর সিংহাসনের বহুলপ্রদর্শনীর আশা ব্যক্ত করেই আজ শেষ করছি। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ডাকে সাড়া দিয়ে যাঁরা আজ এতটা সময় এখানে দিলেন, তাঁদের সবাইকে ‘থিয়েটারওয়ালা’র পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।