Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: একশ’ বস্তা চাল
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: একশ’ বস্তা চাল। মূলরচনা: ইয়ামামতো ইয়াজো (কোমে হাপ্পিও)। অনুবাদ: আবদুস সেলিম। নির্দেশনা: গোলাম সারোয়ার। মঞ্চপরিকল্পনা: ফয়েজ জহির ও জুনায়েদ ইউসুফ। আলোকপরিকল্পনা: ঠাণ্ডু রায়হান। পোশাকপরিকল্পনা: আইরিন পারভীন লোপা। আবহসংগীতপরিকল্পনা: আহসান রেজা খান (তুষার)। রূপসজ্জা: শুভাশীষ দত্ত তন্ময়। পোস্টার ডিজাইন: সৈয়দ লুৎফুল হক। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০০৬। একটি ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাপান দূতাবাস, জাপান ফাউন্ডেশন, জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ যৌথ-প্রযোজনা
[একশ’ বস্তা চাল : নেতি-সত্তায় ইতির সন্ধান- শিরোনামে নাট্যসমালোচনাটি নাট্যপত্রিকা ‘দুই বাংলার থিয়েটার’-এ ছাপা হয়। ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
জাপানি কথাসাহিত্যে ইউসিনারি কাওয়াবাতা বা ওয়ে ক্যানজাবুরোর মতো জগৎ-কাঁপানো সাহিত্যিক পাওয়া গেলেও সরাসরি নাট্যকারের উদয় হয় নি। নাটক যা হয়েছে গড়পরতায় বিখ্যাত উপন্যাস ও গল্পের রূপান্তর। ব্যতিক্রম ছিলেন নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক ইউকিও মিশিমা, যিনি কাওয়াবাতার মতোই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর আত্মহত্যা পবিত্র আত্মহনন বা ‘সেপ্পুকো’, যা সামুরাই চেতনাজাত। তবে এত বৈচিত্র্যের দেশে নাট্যকার যে ছিলেন না এমন নয়। এদেরই একজন ইয়ামামতো ইয়াজো। তাঁর একশ’ বস্তা চাল (কোমে হাপ্পিও) জাপানের উন্নয়নে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
১৯ আগস্ট ২০০৬ তারিখে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি উদ্বোধনী মঞ্চায়ন করে এ নাটক। প্রযোজনা-কেন্দ্রিক নাট্যকর্মশালার এক অভাবিত ফসল একশ’ বস্তা চাল। যৌথ প্রযোজনার অংশীদার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাপান দূতাবাস, জাপান ফাউন্ডেশন, জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। অংশগ্রহণকারী নাট্যদল ও প্রতিষ্ঠান: আরণ্যক নাট্যদল, থিয়েটার (নাটক সরণি), নাট্যচক্র, লোকনাট্য দল, নাটক ও সংগীত বিভাগ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার, নান্দনিক নাট্য সম্প্রদায়, নাটভূম ও কণ্ঠশীলন। প্রথমাবস্থায় জাপানি বিশেষজ্ঞ সিনজি কিমুরা টানা দশ দিনের প্রশিক্ষণে নাট্যকর্মীদের শাণিত করে তোলেন। এ পর্যায়ে ছিল জাপানি কায়দায় ওঠাবসা, জেসচার, সমরবিদ্যা, লাঠিখেলা ইত্যাদি। দ্বিতীয়বার তিনি আসেন পুত্র কাতসুইয়া কিমুরা সহযোগে। এর আগেই নির্দেশক গোলাম সারোয়ার দেড় মাসের একটানা পরিশ্রমে নাটকের কাঠামো নির্মাণ করে ফেলেন। এ পর্বে থাকে পাণ্ডুলিপি-বিশ্লেষণ, চরিত্র-বিশ্লেষণ, তলনামূলক পঠন-পাঠন, ভিডিও-স্থিরচিত্র-দর্শন, তথ্য-প্রযুক্তির আশীর্বাদ গ্রহণ, ডেমোন্সট্রেশন, শিল্পীনির্বাচন ও মহড়া।
এ নাট্য-দর্শনে দর্শক ফিরে যান ১৪০ বছর আগের জাপানে। জাপানে তখন মেইজি শাসনের তৃতীয়বর্ষ, ট্রানজিশনাল পিরিয়ড। টকুগাওয়া শগুন অধ্যায় শেষে আধুনিক রাজবংশ মেইজিরা ক্ষমতারোহন করলে যোদ্ধা সামুরাইদের ক্ষমতা হ্রাসমান হয়। তাদের চুল কেটে ফেলতে বাধ্য করা এবং খাতানা (তলোয়ার) নিয়ে চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের কেবল সূত্রপাত। ১৪শ’ ও ১৫শ’ শতাব্দীর সামুরাই শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্য এবং গোষ্ঠী ও অঞ্চলভেদে বিরাজমান মাৎস্যন্যায়ের বাস্তব প্রতিচিত্র এ নাটক। ১৭শ’ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে জাপান আধুনিকায়নের পথে যাত্রা শুরু ও পশ্চিমাজীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে থাকলে সামুরাইদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসে। এরূপ পটভূমিকায় প্রায় দেড়শ’ বছর আগের অভাব অনটনযুক্ত জাপানি সামাজিকজীবন ও অস্থিরতা পেছনে ফেলে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে জাপানের উত্থানপর্বের সূচনাই এই নাটকের উপজীব্য হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ভাবলে নাটকের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর নয়। এ নাট্য-দর্শন ও শ্রবণে মনে হতে পারে, দেড়শ’ বছর আগের কালটা আজকের বাংলাদেশে বিরাজমান। দু-একটা সংলাপে তা স্পষ্ট করা যেতে পারে:
জেন্নাই
আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। এই শাকের সাথে খাওয়ার কিছু কি মিলবে?
কিহেইটা
খাওয়ার মতো কিছু? তুমি খাবার-দাবার সবই চাইতে পারো, কিন্তু আমার বাড়িতে কোনো কিছুই নেই।
জেন্নাই
একটা কিছু হলেই চলবে। যেমন, মামলেট।
কিহেইটা
ইয়ার্কি করছো? এই দিনে ডিম ছোঁয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে?
জাপানে যখন দ্রব্যাদি দুর্মূল্যের, বিশেষত ডিমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু, তখন দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ ডিম, এমনকি চাল-আটা-তেল ছুঁতে হিমশিম খায়। জাপানে এখন ছিঁচকে চুরি অবলুপ্ত। কিন্তু অভাবের তাড়নায় চুরি করছে এ চিত্র আমরা হরহামেশা পাই। নাটকের খ-চিত্র:
কিহেইটা
হারামীর বাচ্চা।
সোদে
কী হয়েছে?
কিহেইটা
একটুর জন্য ফসকে গেল। ফাঁদ পেতে রেখেছিলাম, কিন্তু হারামিটা কী করে ঠিক পালালো।
জেন্নাই
কী হয়েছে?
কিহেইটা
ঐ ব্যাটা ছিঁচকে চোরটা আবার এসেছিল।
সোদে
গতরাতে একবার এসেছিল। দামী কিছুই নেই, কিন্তু হাতের কাছে যা পেয়েছে চালা থেকে নিয়ে গেছে। এ এক মহাঝামেলা।
এসব ছাড়াও প্রসঙ্গ এসেছে অভাবের তাড়নায় মানুষ কীভাবে ধর্মালয়ে গমন করে, এ ভূখণ্ডে যেমন দরিদ্র কিশোর যায় মাদ্রাসা-এতিমখানায়। ‘তাহলে দুবেলা খাওয়াটা অন্তত পাবি।’ উভয় সমাজই সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে, যেখানে কৃষকের কোনো অধিকার নেই। ‘ভালো ফসল হলেই বা কী, আর না হলেই বা কী? ধান তো আর আমাদের ঘরে উঠছে না।’ গরিবের এই এক ধর্ম, সুখের ছল করে বেঁচে থাকা। ‘এই দুঃসময়ে যদি ভান না করি যে, আমরা বড় আরামে আছি, তা হলে তো বাঁচাই যাবে না।’
বোশিন যুদ্ধের পর (১৮৬৮-৬৯) যখন আধুনিকায়নের স্পর্শে সামুরাইরা পর্যুদস্ত হতে শুরু করেছে, নানাভাবে অপমানের কাঁটা তাদের গায়ে লাগছে, সে সময় নাগাওকার সামুরাইদের দিন-আনা-দিন-খাওয়া অবস্থা। এমনি পরিস্থিতিতে মিনিয়েমা রাজ্য থেকে সাহায্য হিসেবে আসে ১০০ বস্তা চাল। এ আনন্দ সংবাদে নাগাওকার যোদ্ধারা বেজায় খুশি। কিন্তু প্রধান-উপদেষ্টা কোবাইসি তোরাসাবুরো এ চাল দিয়ে স্কুল-নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হয় দ্বন্দ্ব, সামুরাইরা হত্যা করতে যায় তাকে। বিজ্ঞ প্রধান-উপদেষ্টার যুক্তি; একদিন একদিন করে বাঁচার কথা ভাবলে নাগাওকা উন্নত হবে না। সে জন্যই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে স্কুল-বানানোর, যা মানুষকে শিক্ষিত-আলোকিত করবে। প্রাপ্ত সাহায্য ভাগবাটোয়ারা করার চিন্তাটি আজকের এবং তাৎক্ষণিক, কিন্তু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে এ চাল ভোগে ব্যয় না করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজে খরচ সবচেয়ে যৌক্তিক। তৎসত্ত্বেও জঠরে ক্ষুধার আগুনজ্বালা সামুইরাইরা তার এ যুক্তি মেনে নেয় নি। বরং তাকে হত্যায় উদ্যত হয়। তিনি সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তাদের দেখান মিকাওয়া প্রদেশের উসিকুবোর দেয়ালের লিখন, পাথরে খোদাই-করা শব্দমালার অনুলিপি: ‘সব সময় যুদ্ধের ময়দানে’। এর অর্থ; যখন যুদ্ধ নেই, সবাই শান্তিতে আছে, তখনও সব কষ্ট এবং অভাব-অনটন যুদ্ধের ময়দানের মনোভাব নিয়ে মেনে নিতে হবে। তার এ আচরণে প্রত্যেকের অন্তর্জগৎ যখন নমনীয়তার স্পর্শে বিগলিত হতে থাকে তিনি শোনান প্রাচ্যজ্ঞানী মেনসিয়াসের বাণী: ‘ঈশ্বর যখন মানুষের উপর কোনো বিরাট দায়িত্ব দিতে চান, প্রথমেই তিনি মানুষের দৃঢ় মনোবল পরীক্ষা করেন, তার শারীরিক সহ্যক্ষমতা নিরীক্ষা করেন এবং অনাহারে ও কষ্টে ভোগান’।
এই যে নাটকের মধ্যে নান্দনিক-বিষয় পাশ কাটিয়ে সামাজিক-রাষ্ট্রিক মোটা-দাগের বিষয়কে টেনে আনা, তাতে এটিকে একটি প্রচারণামূলক নাটক মনে হতে পারে। এই ধরনের প্রচারণায় শিক্ষা, পুষ্টি, নারী ও শিশুশ্রমে সমান মজুরি ইত্যাদি বিষয় প্রমোট করা হয়। এখানেও হয়তো তা-ই হয়েছে। জাপানের সে সময় ছিল একেবারেই প্রাথমিক-অবস্থা। তবে এখন তারা এইসব প্রচারণায় একেবারেই নেই, উপমহাদেশে যদিও বিদ্যমান। এটিই নাটকের প্রাসঙ্গিকতা। এই নাটকের ব্যতিক্রমধর্মীতা যেখানে নিহিত সেটি; নেতিবাচক-নঞর্থক একটি সত্তা থেকে ইতিবাচক ফল নিংড়ে নেয়া হয়েছে। ইয়ামামতো ইউজো এক মহৎ শিল্পস্রষ্টার পরিচয় রেখেছেন মূলধারার নাটক না লিখেও। তলোয়ার একজন সামুরাইয়ের আত্মা, উভয়ে অভিন্ন অস্তিত্ব। কিন্তু এটি নেতির প্রতীক, ধ্বংসাত্মক। তবে প্রাজ্ঞ তোরাসাবুরোর কাছে; “আমার তলোয়ারই আমার প্রভু। তলোয়ার কখনো মিথ্যা বলে না, চাটুকারি করে না। মুহূর্তে স্বর্গ-নরকের পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। এর ভিতর একটা রাজকীয় ব্যাপার আছে। তলোয়ার ঈশ্বরের মতো ঋজু, স্বর্গের মতো বিশুদ্ধ। তাই যখনই আমি কোনো বড় সমস্যায় পড়ি, জটিল সমস্যা, আমি আমার তলোয়ারের কথা শুনি। এই নির্বাক-প্রভুর পরামর্শ চাই। বর্তমান সমস্যাতেও আমি গভীর রাতে আমার তলোয়ার বের করে তাকিয়ে ছিলাম। প্রথমে কোনো উত্তর পাই নি, কিন্তু ঐ চকচকে তলোয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পবিত্র তীর্থস্থানের পানির-পাত্রের মতো বিশুদ্ধ এবং রাজকীয়-বস্তুটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনটা ধীরে শান্ত হলো। আমার মন স্থির হলো। ঠিক তখনই তলোয়ারের ভিতর থেকে কথা শুনতে পেলাম। আমার নির্বাক-শিক্ষক ফিসফিস করে বললো; ‘করো’। সাথে সাথে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করবো।”
নির্দেশক গোলাম সারোয়ার নাট্যনির্মাণের সর্বাগ্রে পারফরমারদের শারীরিক ফিটনেসের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ-নির্দেশক শিনজি কিমুরা জাপানের নগুচি-মেথড প্রবর্তন করেন, যা বাংলাদেশে এই প্রথম। এই প্রক্রিয়াটি নাট্যনির্মাণের শেষদিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। জানা যায় জাপানের প্রায় সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীই দৈহিক সবলতা যথার্থ রাখার উদ্দেশ্যে এ পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। জাপানি পারফর্মেন্সে এ ধারণার মোদ্দাকথা; শরীরটা এক চামড়ার বস্তা। তাই ব্যায়ামের সময় শরীরটাকে বস্তার মতোই অকস্মাৎ ছেড়ে দিতে হয়।
গোলাম সারোয়ারের নির্দেশনা-স্টাইলের মূলদিক অভিনেতৃগণের সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে এক্সপ্লয়েট করা। প্রত্যেককে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট-মাত্রা-পর্যন্ত ভেতর থেকে প্রতিভার নির্যাস নিংড়ে নেয়া। রিয়ালিস্টিক নাটক হলে বাস্তবতার আবহ সৃষ্টির জন্য ইম্প্রোভাইজেশনের আশ্রয় গ্রহণ। এ নাটকেও তা-ই ঘটেছে। শুরুতে সামুরাইদের দুর্ধর্ষতা প্রদর্শনের জন্য তাদের পরস্পরের উপর ভয়ঙ্করভাবে নাঙ্গা তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। তারা যে অশ্বচালনায় পারদর্শী ছিল সেটিও ইম্প্রোভাইজড। প্রধান-উপদেষ্টাকে হত্যা করতে যাওয়ার পূর্বে সামুরাইদের তলোয়ার মহড়া জাপানি নাটককে বাংলাদেশের দর্শকের কাছে এক বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। নিয়ে গেছে ক্লাইমেক্সে। তা ছাড়া সামুরাইদের কেশকর্তনের খণ্ডচিত্র, তাদের তলোয়ার ছিনিয়ে নেয়া, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নীরব অহিংসাবাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে গমনাগমন, যুদ্ধ বিধ্বস্ত নাগাওকার বিরাণভূমি ও নারীদের করুণ-আর্তি সবই নাটকে বাস্তবতার বাতাবরণ তৈরি করে। বিশেষজ্ঞ-নির্দেশক শিনজী কিমুরা বরাবরই অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন অভিনেতৃদের। না-বোধক নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি নির্দেশ করেছেন কোন কোন আচার-আচরণ, ম্যানার, পরিচ্ছদ, মূল্যবোধ, প্রতিরূপক বা আদর্শ-জাপানি সমাজ-সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পারফর্মারদের শাসন নয়, বরং স্বায়ত্তশাসনের মাধমেই অধিকতর নন্দনতাত্ত্বিক ফল আশা করা যায়। তাদের নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং বিশ্বাস করে স্পেসে ছেড়ে দেয়ার কৌশলই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রায় নিয়ে যেতে পারে।
আবদুস সেলিম অনূদিত এ নাট্যে কেবল ভাষাটিই ‘বাংলা’ ছিল। আর সবই জাপানি। মঞ্চে আলো জ¦লতেই দর্শক ভাবতে থাকেন জাপানে একটি বাড়ির সামনে উপবিষ্ট আছেন। ফয়েজ জহির ও জুনায়েদ ইউসুফ-কৃত সেট ডিজাইনে একটি প্রথাগত জাপানি বাড়ির আদল নেমে আসে। ব্যাকস্টেজে বাড়ির সাজেশন, সামনে শূন্য স্পেস অভিনেতৃদের অভিনয়, যুদ্ধ-প্রদর্শনের সুযোগ করে দেয়। ঠাণ্ডু রায়হানের আলোকপরিকল্পনা ও প্রক্ষেপণ সারল্যপূর্ণ হলেও দ্যোতনাবোধক ও অর্থবোধক। আহসান রেজা খানের (তুষার) সংগীতপরিকল্পনা ও আবহ তৈরিতে জাপানি শিল্পতত্ত্বে যে স্বল্পতা ও বিষাদময় শূন্যতাবোধের ইংগিত দেয়, তার স্ফুরণ লক্ষ করা যায়। আবার যুদ্ধের ডামাডোলে উদ্দীপক-সংগীত ও পশ্চিমা-আবহ তৈরিতে সিদ্ধহস্ততার পরিচয় মেলে। এ ক্ষেত্রে শাহাদাৎ হোসেনের লাইভ মিউজিক ক্ষণে ক্ষণে যুগলবন্দি হয়ে নাটককে এক ভিন্নমাত্রা দান করেছে। একটি জাপানি নাটকনির্মাণের সাধারণ ইন্সন্ট্রাকশন ছিল বলেই প্রপ্স বা দ্রব্যসম্ভার এবং কস্টিউম ডিজাইনেও আইরিন পারভীন লোপা অবিকৃত শিল্পতত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। মোঃ রাফির কোরিওগ্রাফি নাটকে প্রকৃত প্রাণস্পন্দন জাগায় ও গতিময়তা অব্যাহত রাখে। শুভাশিষ দত্ত তন্ময়ের রূপসজ্জাকরণের মাধ্যমে সামুরাইদের ঐতিহ্যবাহী কেশবিন্যাস দ্বারা দর্শকের চোখে রঙ্গমঞ্চের আসল সম্মোহন সৃজিত হয়।
নাটক একটি যৌথশিল্প। অভিনয়, সংগীত, নৃত্য প্রতিটি শিল্পমাধ্যমের মধ্যে সিম্ফনি না আসলে এবং এগুলো সমসঙ্কালিক (সিনক্রোনাইজড) না হলে একটি সার্থক, পারফ্যাক্ট-নাট্য নির্মিত হয় না। এ প্রযোজনায় ১২টি দল থেকে ১৭জন প্রতিভাবান নাট্যকর্মীর সমাবেশ ঘটেছে। বোধহয় তারা কাজে ফাঁকি দেয় নি, তাই নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় ঐক্যতান লক্ষ করা গেছে। এরা একজন আরেকজনকে নির্মাণ করেছেন, একে অন্যকে শক্তি যুগিয়েছেন, সাইকেলের চেইনের মতো গায়ে গায়ে লেপ্টে থেকেছেন। প্রধান-উপদেষ্টা কোবাইসি তোরাসাবুরোর (নাট্যের প্রটাগনিস্ট) চরিত্রে শাহাদাৎ হোসেনের অনবদ্য রূপায়ণ দর্শকমানসে দাগ কেটে যায়। তবে সামুরাইদের সামনে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ালে একজন মানুষের যে অভিব্যক্তি হওয়া কাঙ্ক্ষিত সেটি তার অভিনয়ে অনুপস্থিত ছিল। চরিত্রটি যে উভয়সঙ্কটে (ডিলেমা) আছে সেটি অপ্রতিফলিত। তা ছাড়া তার শ্মশ্রুবিন্যাস পূর্ব-এশিয়ানদের অনুরূপ ছিল না। প্রাচ্য-দার্শনিকের মডেল-চেহারা এ নাট্যে অনুসরণ করলে বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পেত। এ ক্ষেত্রে সোদে চরিত্রে তাসমি তামান্নার প্রাপ্তিযোগ ঘটেছে, সুরতে-ভঙ্গিমায় অবিকল নিহনজি (জাপানি)। তার বাস্তবানুগ অভিনয়ের কারণে জাপানিরাও ভিড়মি খেয়েছে। আর তিনটি প্রধান-চরিত্র ইতো কেহিইটা হিসেবে জুনায়েদ ইউসুফ, ইগা জেন্নাই-রূপে মোঃ রাফি (সুমন), মোরি সেমপাচিরোর ভূমিকায় আবুল কালাম আজাদ (সেতু) সুঅভিনয়ের স্বাক্ষর রেখেছেন। উত্তম টিমওয়ার্কের একটি প্রকৃত-দৃষ্টান্ত এ প্রযোজনা। তবে নাটকটি যেহেতু প্রধানত সংলাপনির্ভর তাই ভিন্নমাত্রার স্বরপ্রক্ষেপণ ও আলাদা আলাদা দৈহিকভাষা প্রয়োগ করে অভিনয়ে আরও বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন ছিল। কোথাও সংলাপ এতটাই দীর্ঘ যে, কখনো তা একলাপ বা স্বগতোক্তি দোষে দুষ্ট। তাই দৃশ্য-বিশেষে বাচিক-অভিনয়ে জোর না দিয়ে শারীরিক-অভিনয়ে প্রাধান্যবিস্তার কাক্সিক্ষত ছিল। তবে অত্যন্ত দ্রুতই শেষ হয়ে যায় বিধায় দর্শকের কাঁধে একঘেয়েমির ভূত চাপে নি।
জনঅর্থে পরিচালিত একাডেমিসমূহ যেখানে নিয়ত অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে, সেখানে একশ’ বস্তা চাল হঠাৎ আলোর ঝলকানি। এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকা বাঞ্ছনীয়। তা কলাবরেটিভ হলেও করদাতা মেনে নেবেন। বোদ্ধাদর্শক এ নাটকের বহুলপ্রদর্শনী কামনা করে। একটি মঞ্চনাটক প্রতিদিনই নতুন করে নির্মিত হয় বিধায়, সেটি মূল্যায়নের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। বহুলচর্চিত হলেই ভ্রান্তিমোচনের মাধ্যমে বোঝা যায় আসল চেহারাটা কী দাঁড়ালো।
গোলাম শফিক ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): লেখক, নাট্যকার