Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: অহরকণ্ডল

Written by থিয়েটারওয়ালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

নাটক: অহরকণ্ডল। রচনা: বদরুজ্জামান আলমগীর। মঞ্চপরিকল্পনা ও নির্দেশনা: কামালউদ্দিন কবির। আলোকপরিকল্পনা: নাসিরুল হক খোকন। পোশাকপরিকল্পনা: ফরিদা লিমা। আবহসংগীতপরিকল্পনা: অসিত কুমার। পোস্টার ডিজাইন: শাহীনুর রহমান। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০০৭। একটি ‘জন্মসূত্র’ প্রযোজনা

[অহরকণ্ডল নাটক নিয়ে নাট্যসমালোচনার আয়োজন করেছিল নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’। নাটকটির রচয়িতা বদরুজ্জামান আলমগীর ও নির্দেশক কামালউদ্দিন কবিরসহ আলোচনায় আরো ছিলেন নাট্যশিক্ষক ড. বিপ্লব বালা, কবি মুজিব মেহদী, কবি আলফ্রেড খোকন, গল্পকার আহমাদ মোস্তাফা কামাল, শিল্পী শাহীনুর রহমান, মোহাম্মদ বারী, শহীদুল মামুন ও দর্শকবন্ধু অপূর্ব। এছাড়াও ছিলেন অহরকণ্ডল নাটকের আবহসংগীতপরিকল্পক অসিত কুমার, অভিনেতা রতন দেব, দিলীপ চক্রবর্তী ও আনোয়ারুল হক। নাট্যালোচনায় সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ‘থিয়েটারওয়ালা’-সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার। ‘থিয়েটারওয়ালা’র ২৩তম সংখ্যায় (২০০৭ এ প্রকাশিত) অনুলিখন করে এটি ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]

হাসান শাহরিয়ার
সবাইকে শুভেচ্ছা। আমার মনে হয় অহরকণ্ডল নিয়ে আলোচনার শুরুটা নাট্যকারকে প্রশ্ন করা দিয়ে হতে পারে। নাট্যকারকে কোনো একজন প্রশ্ন করে আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে পারেন।

বিপ্লব বালা
এভাবে বোধহয় শুরু করা যায়, অহরকণ্ডল আমরা অনেকে দেখেছি এবং নানারকম রিয়েকশন হয়েছে, নতুন অভিজ্ঞতা পেয়েছে- সেটা তার টেক্সট এবং প্রোডাকশনের জায়গা থেকে। তো সেটা নিশ্চয়ই কোনো শিল্পের গুণের জায়গা। তো এই যে নতুন অভিজ্ঞতা দেয়া, সেটা নাট্যকারের কাছ থেকে জানতে চাই যে, এই ব্যাপারটা তিনি কীভাবে কনসিভ করেছিলেন। মানে এখানে গ্রামসমাজ এসেছে, লোকাল এবং ব্যক্তিগত নানারকম রেফারেন্স এসেছে। এবং টেক্সট-এর প্রকাশ-ভাষা সবটার ভেতরেই নতুন একটা ব্যাপার আছে...তো নাট্যকারকে প্রথমেই বলবো এটা লেখার প্রাথমিক প্রক্রিয়াটা বা শুরুর পর্বটা যদি আমাদের বলেন।

বদরুজ্জামান আলমগীর
প্রথমে আমি বলে নিই যে, আজকে এখানে যে এতজন ‘কাজের লোক’ জড়ো হয়েছি এবং অহরকণ্ডল নিয়ে কিছু বলবার বা শোনবার জন্য এসেছি, এটা আমার জন্য অত্যন্ত শ্লাঘার একটা ব্যাপার। আমি এখন মূলত বাইরের লোক। মানে আমি যেহেতু দেশের বাইরে থাকি সেখান থেকে বললে আমি বলবো যে, আমি আসলে এখানে যারা এসেছেন তাদের ট্র্যাকে নাই। আমি কিছুটা ছিটকেপড়া মানুষ এখানে। তো আমার প্রথম কাজ হবে সবার কথা শুনে নিজেকে আপনাদের লাইনে নিজেকে দাঁড় করাতে চেষ্টা করা।...সেই অর্থে আজকের এই আড্ডা বা আয়োজন আসলে আমাকেই বেশি উপকার করবে, যতটা না আপনাদেরকে করবে। বিপ্লব দা’র কথা থেকে যদি আমি কিছু বলতে চাই, তাহলে আমি বরং সব কিছুর আগে আমার একটা লেখা বা লেখার মতো একটা জিনিস, যা আমি লিখে এনেছি, সেটা যদি একটু পড়তে অনুমতি দেন, তাহলে অনেক কিছু বোঝাতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস। তো লেখার শিরোনাম দিয়েছি আমি ‘আবার নাভীমূলে যুক্ত হোন’। লেখাটি আমি একটু পড়ছি...

ভালো লক্ষণ এই, কালিজিরার তেল আবার ফিরে ফিরে আসে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ৩ পয়সার দাওয়াই-এর লাখ টাকার হুঙ্কার শুনে শুনে কার না কান ঝালাপালা করে?

তাহলে এবার কিছুটা নৈঃশব্দ আসুক।

নতুন জামাই হাতের মুঠোয় ১ পোটলা মিঠাই নিয়ে ৩ সন্ধ্যার মুখে রূপবান টিনের ঘরের আঙিনায় তাহলে এসে নামুক। মাথার ওপরকার কুপিবাত্তি এক সেকেন্ডের জন্য শরমে নিবুক।

পুঁজির দাপটে হারিয়ে বসেছি আমাদের নিজস্ব পছন্দ। মোবাইল ফোনে খালি ঝারিঝুরি মারি, ব্যাকুলতা বলি না। হাতের মুঠোয় দৃশ্যমান ইউনূসীয় ফোনের দাপটে বুকের অন্তঃপুরে অভিমান-রঙিন ছোট্ট মোবাইল ফোনটি একেবারে বসে গ্যাছে!

আসুন, বুকের ভেতরকার অদৃশ্য মোবাইল ফোনটি আবার চালু করি। এবার তাহলে একটু ব্যাকুলতা বলি।

লেখালেখির কাজটি ঘর্ষণজাত। চোখের সামনে যে দুনিয়াটি উপুড় হয়ে আছে তার দিকে দৃষ্টিপাত করা-মাত্র প্রকৃতি ও চরিত্রসমূহের মধ্যকার মিথষ্ক্রিয়াগুলো লাফিয়ে ওঠে। চরিত্রগুলো সেয়ানা হয়, লেখক তাদের আগে-পিছে ঘোরাঘুরি করে মাত্র।
 
প্রকৃতি ও চরিত্রদের ঘর্ষণপরিস্থিতি নিজেই বেছে নেয় আঙ্গিক অথবা সেখানে কোনো আঙ্গিকের ব্যাপারই নেই। আমরা নিজেদের বাছ-বিচারের সুবিধার জন্য একটি নাম বসিয়ে নিই। হ্যারিকেন ক্যাটরিনা কোনো নাম নয়, একটি ডাটা মাত্র।

কাল-পরম্পরায় আমরা চেতনে-অবচেতনে এক গাম্ভীর্য অর্জন করেছি। সে অতিশয় শুভলক্ষণ। সব গান পেরিয়ে পেরিয়ে ইদানিং আমরা বারবার বাউল গানের পাশে গিয়ে দাঁড়াই, যে ছেলে বা মেয়েটি অ্যামিনেম-এর গানে লাফ-ঝাঁপ দেবার কথা সে-ও বুঝে যায় এ-মিউজিকে ফ্যাশন হয় কিন্তু প্রাণের যোগ কিছুতেই হয় না।

চলচ্চিত্র কী চিত্রকলায় চেনা প্রাণের ধারাপাত দেখি, কবিতাও পাশ ফেরে পূর্ববাঙলায় ভোরের মন্দিরে শঙ্খসুন্দর, উপন্যাসও কম যায় কিসে, শেষমেশ নাটক এসে সামিল হয় আত্মার ঘ্রাণে পূর্বপুরুষের পরিশ্রমী বলিরেখায়।

মনে হয় নাটক এইডাই যা আমার ভিতর মায়ের নাভীমূলটি আবার যুক্ত করে; নাটক এইডাই যা নাটক নয়।।

... তো এই যে লেখাটা, লেখাটার মধ্যেই আমার মনে হয় যে, বিপ্লব দা’ যা জানতে চেয়েছেন, তার অনেক কিছু এসেছে।

বিপ্লব বালা
আপনি একটু নাভীমূলে আপনার যুক্ততার ব্যাপারে বলেন।

বদরুজ্জামান আলমগীর
অহরকণ্ডল নিয়ে যখন এই লেখাটা আমি লিখি, তখন একটা জিনিস দেয়ার চেষ্টা করেছি যে, লেখাটা আসলে কীভাবে হয়? আমি বলছি, লেখাটা হলো একটা ঘর্ষণজাত ব্যাপার। আমি যখন চোখটা খুলে পৃথিবীর দিকে তাকাই, পৃথিবী-দুনিয়া-মানুষ-চরিত্র-নিঃসর্গ-প্রকৃতি এ সব কিছুর মধ্যে একটা মিথষ্ক্রিয়া হয়। এবং এই মিথষ্ক্রিয়াটার মধ্যে আমি যখন অংশ নিই, তখন এর যে...কী বলবো...মানে এক ধরনের যে প্রতিক্রিয়া হয় আমার মধ্যে, সেই প্রতিক্রিয়াটাই হচ্ছে ‘লেখা’। আমি কোনো লেখা এভাবে লিখি না বা এই অহরকণ্ডল-ও এভাবে শুরু করি নি যে, এটা একটা ‘নাটক’। আমার কাছে মনে হয় যে, পূর্ববাঙলার যে একটা সৌন্দর্য, এর প্রকৃতির মধ্যে, মানুষ-মানুষের সম্পর্কের মধ্যে যে সৌন্দর্য এবং এর নৈঃশব্দের মধ্যে যে সৌন্দর্য থাকে, সেই সৌন্দর্যটা নানাভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে। সৌন্দর্যটা আমরা হারিয়ে ফেলতে বসেছি। অহরক-ল লেখার মূল-জায়গাটাও কিন্তু এটা। মানুষ যে নিজেকে প্রকৃতমানুষ হিসেবে বিকশিত করে তুলবে, সেখানে তার যে প্রতিবন্ধকতা...মানুষের যে বিরাটত্ব, বিশালত্ব, ঐটা যে সে হারিয়ে ফেলতে বসেছে, সেটার সাথে আমার যে দুঃখটা, সেই দুঃখটা আমি সবার পক্ষ থেকে, দানিউল-আকমল-বাহারের পক্ষ থেকে, তাদের যে অশ্রুপাত, সেই অশ্রুপাতটা আমি করলাম এবং নাম দিলাম অহরক-ল। অহরকণ্ডল-টা হচ্ছে, এই যে যুবকগণ, যাদের ভেতরে একটা অসাধারণ-নৈঃশব্দ থাকার কথা ছিল, সেই নৈঃশব্দটা ওরা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের ভেতরে অসাধারণ একটা বিশালত্ব থাকার যে কথা ছিল, সেই বিশালত্বটা তারা প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না। এই যে বেদনা, এই যে ইন্টারেকশন, এই ইন্টারেকশনটা যে অশ্রুপাতটা তৈরি করে, আমি একজন লেখক হিসেবে তাদের পক্ষ হয়ে সেই অশ্রুপাতটা করলাম। এবং এই অশ্রুপাতটার নামই হচ্ছে অহরকণ্ডল।

বিপ্লব বালা
এই যে ৩ যুবকের কথা বললেন, তাদের সাথে আপনার ব্যক্তিগত ইন্টারেকশনটা কী? মানে আপনার গ্রামজীবন, আপনার বেড়ে ওঠার যে পরিবেশ, এই সবটা মিলে এই যুবকদের আপনি কীভাবে চেনেন?

বদরুজ্জামান আলমগীর
এটা আমার কাছে মনে হয় এই সোসাইটিটাকে আমি যেভাবে দেখতে চাই, সেটার একটা রাজনৈতিক-পরিভাষা হচ্ছে এই আকমল-বাহার-দানিউল। তবে এটা তারুণ্যের, পরিস্থিতির একটা রাজনৈতিক-অভিজ্ঞান হলেও আমি এভাবে এটা আনতে চাই নি যে, এটা একটা রাজনৈতিক সাইন বোর্ড হয়ে উঠুক। এই চরিত্রগুলোর সাথে আমার একটা পলিটিক্যাল ঘর্ষণ...মানে এই চরিত্রগুলোকে আমি চিনি, এই চরিত্রগুলো আমার ভেতরেও আছে, আমি যেভাবে বড় হয়ে উঠেছি, আমার ভেতরে যে রাজনৈতিক-অঙ্গীকার ছিল, যে অভিজ্ঞানগুলো ছিল, যে রক্তপাত ছিল, সেগুলোকেই দানিউল-আকমল-বাহারের মিথষ্ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করেছি। এদের সাথে আমার খুবই সম্পর্ক আছে, আমি এদেরকে চিনি। এবং আমি একজন সামান্য লেখক হিসেবে বলতে পারি, আমি কখনো এমন লেখা লিখি নি বা লিখি না, যে লেখাটা বা যে কান্নাটা, যে অভিব্যক্তিটা, যে হাসিটা, সেই হাসিটা যদি আমি নিজের ভেতরে বা পাল্সের ভেতরে অনুভব না করি। তো এই লেখাটার ব্যাপারে আমি বলবো আমি আমার এক রাজনৈতিক-অভিজ্ঞান বর্ণনা করেছি কিন্তু যা কিনা রাজনৈতিক সাইন বোর্ড না, অ্যাসথেটিক্যালি ব্যালান্স একটা লেখা এবং এর নাম হয় অহরকণ্ডল। এটাকে কবিতা বলা হবে, না উপন্যাস বলা হবে, না দৃশ্যকাব্য বলা হবে এটা বড় কিছু না। একটু আগে যে বললাম, হ্যারিকেন ক্যাটরিনা-টা কী? যে হ্যারিকেনগুলো ঘটার সম্ভাবনা আছে তাদের আগাম কিছু নাম দেয় আমেরিকানরা। ফলে এই হ্যারিকেন ক্যাটরিনা আসলে কিছু না, এটা হচ্ছে একটা ডাটা। ঠিক তেমনি এই অহরক-লও হচ্ছে একটা ডাটা। এই ডাটার মাধ্যমে আমি আমার রাজনৈতিক-অভিজ্ঞান, নৈঃশব্দের প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছি।

হাসান শাহরিয়ার
আমি নির্জন (বদরুজ্জামান আলমগীর) ভাইকে একটা প্রশ্ন করি...সেটা হলো, আপনি আপনার লেখায় আকমল-দানিউল-বাহারকে যেভাবে দেখেছিলেন, তারপর এখন যে দৃশ্যকাব্য হিসেবে এটিকে দেখলেন, সেখানে কী চরিত্রগুলো আপনার কথাগুলোকেই প্রকাশ করতে পেরেছে?

বদরুজ্জামান আলমগীর
এটা আমার কাছে মনে হয় একটা চিরায়ত সংঘাত। কারণ, আমি যখন স্ক্রিপ্টটা লিখি, আমার ভেতরে তখন যে চিত্রকল্পগুলো তৈরি হয়, সেটা যখন আরেক শিল্পী, নির্দেশক, তিনি যখন করেন, তখন তার চিত্রকল্পের সাথে মিলবে না। এখন আমি যেভাবে চিত্রকল্প তৈরি করেছিলাম আর কবির (কামালউদ্দিন কবির) যেভাবে তৈরি করেছে, তার সাথে যে শতভাগ মিলেছে আমি বলবো না। অনেকাংশেই মেলে নি। এবং এই যে মেলে নি, তার মানে আবার এই না যে, কাজটা ফেল করেছে।

হাসান শাহরিয়ার
ঠিক আছে, কিন্তু একজন দর্শক হিসেবে আপনার অভিমত কী? মানে এই স্ক্রিপ্ট যদি আপনার না হতো, আপনি কেবলি একজন দর্শক, আমাদের মতোই, সেখানে দাঁড়িয়ে কী মনে হয়েছে...দৃশ্যকাব্যটা কি কমিউনিকেবল হয়েছে?

বদরুজ্জামান আলমগীর
ঐভাবে দেখলে আমার মনে হয় যে, স্ক্রিপ্টের মধ্যেও কিছুটা দুর্বল জায়গা আছে। আরেকটা কথা হলো...দর্শক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে এটা আরও লাইভলি করা যেত। যারা অভিনয় করেছে, তারা কিছু কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ চমকের মতো কিছু করেছে বটে, মানে তাদের করার যে ক্ষমতা আছে, শক্তি আছে, এটা কিছু কিছু জায়গায় দেখিয়েছে। কিন্তু সমস্ত নাটকজুড়ে সেই শক্তিটা আমি দেখি নি। মিউজিকের ব্যাপারেও বলবো, তাদের অনেক ডেডিকেশন ছিল, অ্যাটেনশন ছিল, অভিনিবেশ ছিল...তারপরও কোথায় যেন মনে হয়েছে একটার সাথে আরেকটার যে গেঁথে যাওয়ার ব্যাপারটা, সেটা হয় নি। আর আপনার (হাসান শাহরিয়ার) প্রশ্ন ধরেই বলছি, একজন দর্শকের জন্য এটা এক ধরনের উৎপাতই বটে। যে সমস্ত সংলাপ বলছে, সেটা কাব্যময়তার দিক থেকে হয়তো সহ্য করা যায়, কিন্তু দর্শক হিসেবে বসে বসে শোনা...এর মধ্যকার যে নৈর্ব্যক্তিকতার বিষয়, সেটা তো দর্শক হিসেবে আমার মধ্যে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে।

বিপ্লব বালা
তাহলে লেখার সময় এই ব্যাপারটা আপনি কীভাবে নিয়েছিলেন? আপনি চেয়েছেন তো যে এটা মঞ্চে আসবে, তাই না? তো তখন মনে হয় নি, এভাবে বললে বা এধরনের সংলাপ দর্শকের মধ্যে চাপ বোধ হবে?

বদরুজ্জামান আলমগীর
আমি অবশ্যই চেয়েছি যে এটা কোনো না কোনো স্পেসে যাবে। তো আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় বা এটার এক ধরনের নিষ্পত্তি বা সুরাহা হতে পারে যদি আমি নিজে নির্দেশক হতাম। কারণ, আমি যখন লিখছি তখন তো আমি দেখছি চরিত্রগুলো কী করছে, কেন করছে, কতটুকু জোরে চিৎকার করছে, সে কী কস্টিউম পড়েছে...

বিপ্লব বালা
এই ভাবনার সাথে কি দর্শকও আছে? মানে দর্শক আপনার মাথায় আছে কিনা?

বদরুজ্জামান আলমগীর
অবশ্যই। দর্শক ছাড়া আবার হয় কী করে? তো কথা হচ্ছে এটা যদি আমি নির্দেশনা দিতাম, তাহলে মুখোমুখি হতে পারতাম যে, দর্শককে কতটুকু কমিউনিকেট করতে পেরেছে।

হাসান শাহরিয়ার
আমি যদি আপনার কথার সূত্র ধরেই বলি...আপনি যখন লিখছেন তখন সবগুলো চরিত্রের গতি-প্রকৃতি, চাল-চলন আপনি দেখছেন, অনুভব করছেন। কিন্তু আপনি যখন নির্দেশক হবেন, তখন ঐ একই চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলার জন্য আপনার কিছু জীবন্ত মানুষের প্রয়োজন পড়বে। আপনার চরিত্র আপনার কল্পনার মতো ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারে কিন্তু ঐ জীবন্ত মানুষগুলোর সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, এবং সেই অর্থে আপনার অতৃপ্তি কিন্তু থেকেই যাবে।

বদরুজ্জামান আলমগীর
তা ঠিক। কিন্তু তখন আমি সেই দায়টা নিজের ঘাড়ে নিতে পারতাম। এর চেয়ে বেশি আমি কিছু বলতে চাই নি।

মোহাম্মদ বারী
আমরা লেখকের কাছে আবার যেতে চাই। যেহেতু সে সুদূরপ্রবাসী এবং অহরকণ্ডল দেখার পর থেকেই আসলে তাঁর সাথে কথা বলা বা কিছু জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল...এ সুযোগে সেটাই জানতে চাওয়া। সেটা হলো বিপ্লব দা’ একটা প্রশ্ন করেছিল, সেটার রেশ ধরেই এই প্রশ্ন...আপনি (বদরুজ্জামান আলমগীর) বলছেন, নাটকের চরিত্রগুলো দানিউল-আকমল-বাহার...এগুলো আপনি নিজেই হয়তো-বা। আপনার সাথে এদের মূলত প্রত্যক্ষ সম্পর্কটা কীভাবে তৈরি হয়েছিল? আপনার শৈশব, সাংস্কৃতিক-পরিম-ল, এসব দিয়েই তো হয়। তো সেটা একটু বিস্তারিত যদি বলেন।

বদরুজ্জামান আলমগীর
এটা আমার যে-কোনো লেখা থেকেই বোঝা যাবে। সেটা হলো আমি কিন্তু একটা খুবই পশ্চাদ্পদ গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ। আমার পরিবারও কিন্তু কৃষিনির্ভর। আধুনিক যে শিক্ষাদীক্ষা, সেটারও অনেক অভাব আছে আমাদের জনপদে। সেখানকার মানুষদের ভালোবাসার যে প্রচ-তা এবং বীভৎসতার যে রুক্ষতা দুটোই আমি দেখেছি। যেমন আমাদের ওখানে একজনের দুর্ঘটনাক্রমে ট্রেনের নিচে পড়ে পা কাটা যায়। সে খুবই অসচ্ছল ছিল। তো যখন পা কাটা গেল, ট্রেনটা চলে গেল, সে ঐ কাটা পা-টা হাতে নিয়ে নিজেকে বলছে- ‘মাঙ্গির পো এখন তুই ভাবতে থাক তুই কী করবি। দুই পা দিয়াই চলতো না, এখন আবার একটা গ্যাছে।’...রুক্ষতাটা একটু ভাবুন যে, কাটা যাওয়ার পর চিৎকার না, চেঁচামেচি না, সে পা-টা হাতে নিয়ে নিজেকে এটা বলছে।...তো এই মানুষগুলো তো আমার নিজের চোখে দেখা। আমার চারপাশের মানুষগুলো এমনই ছিল। আমি আরেকটা উদাহরণ দিতে পারি, এবার বাইরে থেকে এসে দেখি আমার এক বন্ধু একেবারে দাড়ি-টারি রেখে বুড়ো হয়ে গেছে। শুনলাম তার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, সে এখন শ্বশুর, তাই বয়স আনার জন্যই সে দাড়ি রেখেছে। খেয়াল করে দেখলাম তার দু-একটা দাঁত নাই। পরে জানলাম, যেহেতু সে শ্বশুর, তাই সে বেশ বয়স্ক, কিন্তু শরীরে বয়স্কভাবটা আসছে না। তাই রাত্রে সে হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে দু-একটা দাঁত ভেঙেছে।...তো আমি হলাম এমন পরিবেশের মানুষ, এমন পরিবেশে আমার বড় হওয়া। সুতরাং আমার প্রতিটি লেখায় এইসব মানুষেরই ভালোবাসা, বীভৎসতার চিত্র আসে। এবং আমার ভেতরে...যেটা আগেও বললাম, ভেতর থেকে যদি আমি ঝাঁকি না পাই, চরিত্রগুলোর সুখ-দুঃখ-বেদনা যদি আমি অনুভব না করি, তাহলে আমি কিছু লিখি না। আমি ৯ বছর ধরে প্রবাসী, অনেকে বলেন তুমি লেখ না কেন? আমার উত্তর হয় এটাই যে, ভেতর থেকে প্রচণ্ড ঝাঁকি না পেলে আমি লিখি না। এজন্যই এ-কয়দিন হয়তো কয়েকটা কবিতা লিখতে পেরেছি, আর কিছু লিখতে পারি নি।

মুজিব মেহদী
আমার ছোট্ট একটা জিজ্ঞাসা। আমি আমার জানার জন্য বলছি, আমি নিজে যেহেতেু কবিতা লেখার চেষ্টা করি, সেহেতু বলা। বদরুজ্জামান আলমগীর বললেন যে, ভেতর থেকে প্রচণ্ড ঝাঁকি না পেলে আপনি লিখতে পারেন না। এবং গত ৯ বছরে এই ঝাঁকি আপনি পান নি, তাই দু-একটা কবিতা লেখার বাইরে কিছু লিখতে পারেন নি। আমার প্রশ্ন কবিতা লিখতে তাহলে কম ঝাঁকি হলেও চলে, নাটক লিখতেই কেবল বড় ঝাঁকি লাগে? এটা আমার কেবল প্রশ্নই না, একটা উদ্বিগ্নতাও বটে।

বদরুজ্জামান আলমগীর
হাঃ হাঃ, না না তা কেন হবে? আমি বোধহয় বোঝাতে চেয়েছি ঝাঁকির দৈর্ঘ্যরে ব্যাপারে। অর্থাৎ কবিতা লিখতেও বড় ঝাঁকিই লাগে, কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী হলেও চলে। মানে যখন ঝাঁকিটা আসলো, তখনই লিখে ফেললাম। কিন্তু নাটক লিখতে গেলে ঐ ঝাঁকিটাকেই অনেক বেশি সময় ধরে থাকতে হয়, অনেকদিন ধরে থাকতে হয়...সেই অর্থে বলেছি। আপনি নিশ্চয়ই বলেন না যে, একটা কবিতা লেখায় হাত দিয়েছি...কিন্তু নাট্যকার বলে যে, একটা নাটক লেখায় হাত দিয়েছি, দেখি কী দাঁড়ায়। মানে ঝাঁকিটা অনেকদিন ধরে থাকতে হয়।

বিপ্লব বালা
আচ্ছা, আমি শেষবার দেখার পর এ ব্যাপারটা চোখে লাগল, সেটা হলো, আপনার নাটকে মিথ আসছে, কিন্তু ইসলামি মিথ কম কেন বা নাই কেন?

বদরুজ্জামান আলমগীর
এটা একটা ভালো জিনিস ধরেছেন। এক হচ্ছে, আমি যখন মিথ ব্যবহার করি, তখন এটা আসলে ঐ জনপদের মিথ হিসেবে ব্যবহার করি। হিন্দু মিথলজি বা ইন্ডিয়ান মিথলজি ভেবে কিন্তু করি না। আর মুসলিম মিথলজি না আসার কারণ হতে পারে এই যে, আমি যে রাজনৈতিক-আদর্শে বড় হয়েছি এবং যে দেশে বড় হয়েছি...সেখানে কোনো না কোনোভাবে আমাদেরকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছে। ফলে সেই বিদ্বেষ থেকেই এই মিথ অনুপস্থিত কিনা আমি বলতে পারবো না। যদিও আমি মনে করি এমনটা হওয়া ঠিক না, তবুও হয়তো একারণেই হয়েছে।  তবে বয়স বাড়ছে, ফলে যদি ঐ ধরনের সংকীর্ণতা থেকেও থাকে, সেগুলোকে পরিহার করার চেষ্টা করবো। আরেকটা কথা হচ্ছে, মিথ কখন ব্যবহার করি? যখন ঐ মিথটার মধ্যে আমি একটা নান্দনিকতা খুঁজে পাই। আমার যদ্দুর জানা-শোনা তা থেকে আমি দেখেছি যে, মুসলিম মিথে এমন নান্দনিক ব্যাপারগুলোর অনুপস্থিতি থেকে থাকতে পারে। আরেকটা বিষয় হলো এ-সবের ব্যবহারে মুসলিম মৌলবাদীদের খামাখা একটা চাপ সৃষ্টির প্রয়াস দেখা যায়। আমি আগেও বলেছি, আমার প্রত্যেকটা লেখা হচ্ছে আমার রাজনৈতিক-অভিজ্ঞান এবং পাশাপাশি অ্যাসথেটিক্যালি ব্যালান্সড একটা ব্যাপার। ফলে কেবল রাজনৈতিক সাইন বোর্ড হয়ে উঠুক এমন কিছু আমি চাই না। তাই যেখানে আমি নান্দনিকতা খুঁজে পাই না, সেটাকে আমি ব্যবহারও করি না।

অসিত কুমার
এই কনটেক্সটে আমার একটা গোপন নৈরাশ্য কাজ করছে। সেটা হলো নির্জন (বদরুজ্জামান আলমগীর) এমন একটা জনপদের মানুষ, যে জনপদে মুসলমান ঘরের ছেলে হয়ে তার একটা খুব ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক সংকটে হিন্দু পুরাণ বা ইন্ডিয়ান পুরাণের আশ্রয় নিতে হয়...

বদরুজ্জামান আলমগীর
আসলে হিন্দু মিথলজি না, আমি নির্দিষ্ট জনপদের মিথ ব্যবহার করেছি।

অসিত কুমার
হ্যাঁ, তবে সেটাও এক অর্থে ইন্ডিয়ান মিথলজি। তো এই যে মুসলমান সমাজে বেড়ে ওঠা, কিন্তু শিল্পী হিসেবে মুসলিম মিথলজি ব্যবহার করতে না পারা, এটার ভেতরে কোনো নৈরাশ্য আপনি অনুভব করেছেন কিনা?

বদরুজ্জামান আলমগীর
ঠিক নৈরাশ্য না। আমি তো মিথ খুঁজে বেড়াচ্ছি না। অটোমেটিক্যালি চরিত্রের সংকট, উচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রকাশের জন্য হাতের কাছে যে মিথ আমি পেয়েছি তাই ব্যবহার করেছি। তবে হ্যাঁ, একটু আগেও বললাম যে, এই যে জনপদের মিথ বা হিন্দু পুরাণ বা আপনি ব্রডলি যেটাকে ইন্ডিয়ান মিথলজি বলছেন, সেগুলোর মথ্যে যে শৈল্পিক ব্যাপারটা আছে, সৌন্দর্যের ব্যাপারটা আছে, সেটা মুসলিম মিথে পাই নি। এটা আমার জানা-শোনার ঘাটতির কারণেও হতে পারে। তবে কোনো নৈরাশ্য আমার ভেতরে কাজ করে না।

শহীদুল মামুন
একটা ব্যাপারে আমি একটু বলতে চাই, সেটা হলো নাটকটিকে নির্দিষ্ট জনপদের বলা হতে পারে, গ্রামসমাজ উঠে আসছে বলা হতে পারে। কিন্তু একজন নাগরিক-দর্শক হিসেবে নাটকটাকে কিন্তু আমার শহরের নাটকই মনে হয়েছে। বিষয়টা এমন যে আমি শহরের ছেলে হয়ে, এখানে বসবাস করেও কিন্তু একই ধরনের ক্রাইসিসের মুখোমুখি হচ্ছি। দানিউল-আকমল-বাহার-রা যেভাবে নিজেদের বিশালত্ব-নিঃসঙ্গতা ইত্যাদি প্রকাশে অক্ষম, তেমনি আমার মনে হয়েছে আমিও তো এসব প্রকাশে অক্ষম। বিভিন্নভাবে আমাদের বিশালত্ব প্রকাশ করার বা বিশাল হয়ে ওঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।

আর এই নাটকে যে ৩ চরিত্রের উপস্থিতি এটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। যেকোনো কিছুতে ৩ কিন্তু অনেক কিছু মিন করে। মোহনা হতে পারে, ৩ রাস্তার মোড় হতে পারে, মানে আপাত বিচ্ছিন্ন বা ইনডিভিজুয়াল চরিত্র কিন্তু কোথাও না কোথাও ওরা আসলে একজনই, এমন একটা বোধ আমার ভেতর তৈরি হয়। এই নাটকটি দৃশ্যকাব্যে রূপ নেয়ায় যে বিভ্রাটটি তৈরি হয়েছে সেটা একটু বলি...কিছু কিছু সংলাপ আছে যেগুলোর কাব্যময়তা এতই গভীর যে, সংলাপ-প্রক্ষেপণের পর আমি সেই সংলাপটির কথাই চিন্তা করছিলাম। ফলে এর পর ঘটে যাওয়া অনেক কিছু আমি লক্ষই করতে পারি নি। এখানে নির্দেশক এটা পারতো কিনা জানি না যে, ঐ ধরনের সংলাপের পর একটু সময় নেয়া, যাতে করে দর্শক একটু ধাতস্থ হতে পারে। এই নাটকটি আমাকে কিছু চিত্রকল্প উপহার দিয়েছে। ৩জন যুবক হত্যার পরিকল্পনা করছে, পশুহত্যা হয়েছে, এসব দেখতে দেখতে গোয়ের্নিকার কথা মনে পড়াটা অস্বাভাবিক না। আবার অনেক দর্শক এখনে ম্যাকবেথ নাটকের আবহও পেতে পারেন। হত্যা করার ইচ্ছা নেই, অথচ হত্যা করতে হবে, পরিকল্পনা চলছে, এবং শেষপর্যন্ত হত্যা করতে বাধ্য হওয়া...এসব মিলিয়ে ঐ ম্যাকবেথ-এর চিত্রকল্প ভেসে ওঠাও অস্বাভাবিক নয়। আমি আপাতত শেষ করবো এই বলে যে, মানুষ প্রতিনিয়ত সাফার করছে, এবং এই সাফারিংসগুলো যেন কারো সাথে শেয়ার করতে পারছে না, তার উদ্বেগগুলোর সাথে কাউকে কমিউনিকেট করাতে পারছে না। আবার যখন কমিউনিকেট করছে, তখন দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে...এই সবই আমার কাছে চিত্রকল্প মনে হয়েছে এবং আমার মনে হয়েছে পুরো নাটকটা যদি সিম্বলিকই হতো, পরিবার, দৈন্য ইত্যাদি না এসে যদি পুরোটাই সিম্বলিক হতো তাহলে আমি হয়তো আরও বেশি শৈল্পিকভাবে নিঃসঙ্গ হতে পারতাম।

বিপ্লব বালা
সমস্যার কথা যেগুলো এসেছে, তার মধ্যে এটাইও বোধহয় বড় ব্যাপার যে, এই অভিজ্ঞতাগুলো যে ভাষায়, যে ইমেজারি ওয়েতে বলা হয়েছে তাতে শুনতে গিয়ে দেখার একটা সমস্যা হয়। মানে পাঠে যেমন ভালো লাগবে, তা যখন দেখছি, সেই দেখার সময় ঐ ভাষা বেশ বাধা দেয় পরবর্তী ইমেজগুলো দেখতে। একই পেইসে পুরো নাটকটা যেভাবে শহুরে মেজাজে যায়, সেখানে বোধহয় আরও নৈঃশব্দ্য বা অন্য কিছু করা যেত। নইলে কমিউনিকেশনে বেশ সমস্যা হয়।  

হাসান শাহরিয়ার
আমরা এখন নাটকের নির্দেশক আর কলাকুশলীদের কাছ থেকে কিছু শুনতে পারি।

কামালউদ্দিন কবির
অহরকণ্ডল-এর ব্যাপারে বলতে চাই, আমরা কিন্তু বদরুজ্জামান আলমগীরের যে টেক্সট-টা আছে হুবহু সেই টেক্সটই করেছি। কারণ, বর্ণনাত্মক নাটক লেখার যে জার্নিটা আছে, সেটা যদি আমি কেটে-ছেটে মঞ্চে আনি, তাহলে আমাদের বিশ্বাস যে বর্ণনাত্মকরীতিটা মানা হয় না।...আমরা যারা এটাতে জড়িত আছি, তারা প্রত্যেকে প্রতিটি সংলাপ, উচ্চারণ বুঝে বুঝেই দিচ্ছি, করছি। এব্যাপারে আমাদের মধ্যে কোনো সংশয় নাই। মানে যেটা বলা হচ্ছিল, দর্শকের সাথে কমিউনিকেট করাতে পারছি কিনা...সেখানে আমাদের ধারণা আমরা পারছি। এখন যে কয়েকটা সংলাপের কথা বলা হলো যে, যেমন- ‘সৌন্দর্য বরাবরই নির্মমতার ছকে বাঁধা’ বা আরও অনেক সংলাপ, সেগুলোর পর একটু সময় দেয়া যায় কিনা ইত্যাদি...তো আমরা অবশ্যই এগুলো বিবেচনায় রাখছি। রাখছি বললাম এজন্য যে, এখনো আমরা প্রতি মহড়া এবং প্রদর্শনীতেই নিরীক্ষার মধ্যে আছি। এবং আপনাদের পরামর্শ নিচ্ছি। তবে এটা সত্য যে, পরামর্শ ততটাই গ্রহণ করছি যতটা আমাদের কাজটা যে বর্ণনাত্মকরীতিতে হচ্ছে এবং বর্ণনাত্মকরীতির আসল মানেটা কী বা দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্প-ভাবনাটা আসলে কী, সেটা বুঝের মধ্যে থেকে যে পরামর্শগুলো দেয়া হয়।

বিপ্লব বালা
নাটকের পারফরমারদের সাথে তোমার ইন্টারেকশন...এগুলো বলো।

কামালউদ্দিন কবির
আমি সেদিকেই যাচ্ছি...যদি ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়ে থাকি তাহলে ক্ষমা চাচ্ছি। এখন কথা হচ্ছে, আমরা কেন এই নাটকটি বাছাই করলাম। সেটি হলো একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে ও সুচিন্তিতভাবেই এটা আমরা হাতে নিয়েছি। আমাদের নাগরিক যে থিয়েটারচর্চাটা এখানে হয়, সেটা প্রায় সবটাই হচ্ছে মুখস্থ কিছু ছক দিয়ে তৈরি। বিষয় থেকে শুরু করে প্রয়োগ পর্যন্ত। এটা প্রকৃত-অর্থেই ঐ...ঔপনিবেশিক চিন্তা-কাঠামো...এসব কারণেই হচ্ছে।

বিপ্লব বালা
একটু পরিষ্কার করো, ঔপনিবেশিক কাঠামোটা কী, চিন্তাটা কী?

কামালউদ্দিন কবির
এটা তো তাহলে অনেক কিছু বলতে হবে, এখানে সেই অবকাশ আছে কিনা...

বিপ্লব বালা
দু-এক কথায় বলো।

কামালউদ্দিন কবির
দু-এক কথায় কী বলবো। তবুও চেষ্টা করি, সেটা হলো আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের নাটক রচনারীতির দিকে দেখি, তাহলে দেখবো যে তাঁর পূর্বেকার এবং পরের সবার চেয়ে তিনি আলাদা একটা রীতির সন্ধান করেছেন। এবং সেটা একেবারেই দেশজ, নিজস্ব। এবং এই জায়গায় তিনি একেবারেই নিঃসঙ্গ। যদিও তিনি বলে যান নি যে, তিনি দেশীয়রীতিতে লিখেছেন, কিন্তু এখন এসে আমরা বুঝতে পারি যে, তাঁর প্রতিটা নাটকরচনায় এই রীতির তিনি অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু তার কোনো ধারাবাহিকতা না থাকায় পরবর্তীসময়ে এসেও...এই এসময়েও আমরা নাটক বলতে বুঝে ফেলি ইউরোপীয় ধারার সংলাপনির্ভর নাটক। নির্দিষ্ট ছকের নাটক।

হাসান শাহরিয়ার
কবিরকে একটু বলি, তুমি কিন্তু এখনো পাণ্ডুলিপিতেই আছ, নির্মাণ-প্রক্রিয়ার কথা বলছ না। দর্শক যদি একটা ছকে-বাঁধা হয়ে থাকে, সেই ছক থেকে তাকে সরানোর জন্য তুমি কী কৌশল নিয়েছ, সেগুলো বলো।

রতন দেব
আচ্ছা একটা বিষয়ে একটু পরিষ্কার হয়ে নিই, সেটা হলো, আমরা কি ধরেই নিয়েছি, নাটকটা কমিউনিকেট করে নি?

হাসান শাহরিয়ার
না তা না। ছকে-বাঁধা দর্শককে যদি এই নাটক কমিউনিকেট করিয়ে থাকে তাহলে তার কৌশলটা কী ছিল, সেটা জানতে চাচ্ছি।

শহীদুল মামুন
আমি এখানে একটা কথা বলি, নাটক দেখার পর, ৩ জনের অভিনয় দেখার পর...বাইরে এসে কবিরকে আমি বলেছিলাম, এই নাটকে নির্দেশকের উপস্থিতি খুঁজে পাই নি। সেটা পজেটিভ অর্থেই বলেছিলাম। সেটা হলো অভিনেতাদের আমার কাছে বেশ স্বাধীন মনে হয়েছে। সংলাপ-প্রক্ষেপনের দিক থেকে, মুভমেন্টের দিক থেকে। তো আমার প্রশ্ন অভিনেতাদের কাছে, নির্দেশক আপনাদের কতটুকু স্বাধীনতা দিয়েছিলেন? বা আপনারা সেই স্বাধীনতাকে কতটুকু প্রপারলি ইউজ করেছেন?

রতন দেব
আমাদের কাজ শুরু তো হয়েছে পাণ্ডুলিপি হাতে নেয়ার পর থেকেই। কবিরভাই যেহেতু পাণ্ডুলিপি সিলেক্ট করেছেন, তাই ভাবনার দিক থেকে উনি তো আগে থেকেই অনেকটা পরিষ্কার ছিলেন। আমরা যারা অভিনয় করেছি, তারা শুরুতে তো একটু সমস্যাই মনে করেছিলাম। তারপর কবিরভাই তার ভাবনাগুলো আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন, আমরা পড়তে পড়তে আমাদের ভাবনাগুলো জানিয়েছি। তারপর আস্তে আস্তে দাঁড়িয়েছে। এখানে স্বাধীনতার কথা যেটা বলা হলো, সেটা সব নাটকেই থাকবে। নির্দেশক তার ভাবনাটা বলবেন, অভিনেতা সেটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবেন। নির্দেশক তো আর অভিনয় দেখিয়ে দিতে পারবেন না। ব্লকিং দেখে হয় তো মামুনভাইয়ের (শহীদুল মামুন) মনে হতে পারে যে, কোনো স্থিরতা নাই, ফলে আমরা নিজেরাই স্বাধীনভাবে এগুলো করছি কিনা। ব্যাপারটা হচ্ছে, আমরা আমাদের মতো করলে যদি নির্দেশকের সায় থাকে, তাহলেও বুঝতে হবে এটা নির্দেশকের কাজ। কারণ, আমরা অভিনয়, চলন-বলন সব কিছুতেই নানাভাবে কাজ করেছি। যখন কোনো একটা ধরন নির্দেশকের পছন্দ হয়েছে, তখন বলেছেন- হ্যাঁ, এভাবে করেন। উনি হ্যাঁ বলার পর ঐ কাজটা কিন্তু ওনার নির্দেশনাতেই হলো, ওটা আর আমার বা আমাদের থাকে না। সুতরাং নির্দেশক উপস্থিত ছিলেন না, ব্যাপারটা বোধহয় এমন না।

বিপ্লব বালা
দর্শক-ভাবনাটা কেমন ছিল? আপনার বা আপনাদের মাথায় দর্শক প্রেজেন্ট ছিল কিনা?

রতন দেব
অবশ্যই।

বিপ্লব বালা
যখন বর্ণনাতে যাচ্ছেন, তখন কি মনে হয় যে দর্শক আছে সামনে?

কামালউদ্দিন কবির
আপনার কী মনে হয়েছে?

বিপ্লব বালা
মানে দর্শকের দিকে আলো ছিল না, অভিনেতা বর্ণনা করে যাচ্ছে, অনেকটা স্বগতোক্তিই মনে হয়েছে। দর্শকের দিকে তাকাচ্ছিলও না।

কামালউদ্দিন কবির
দর্শকের দিকে তাকিয়েই বলতে হবে?

বিপ্লব বালা
না, তাকানো সেই অর্থে বলছি না। সামনে দর্শক আছে এটা ফিল করে কথাগুলো বলতে হবে তো।

কামালউদ্দিন কবির
দর্শক যদি মনে করে যে, পারফরমারদের ভাবনায় তারা অনুপস্থিত, তাহলে কতক্ষণ বসে থাকবে তারা?

বিপ্লব বালা
নতুন অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য বসে থাকতে পারে। পরে হয়তো চাপ বোধ করতে পারে।

বদরুজ্জামান আলমগীর
আমি একটা কথা একটু পরিষ্কার করি। সেটা হলো বর্ণনাত্মকরীতি বা দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পরীতি এগুলোর কোনোটাই সেলিম আল দীনের আবিষ্কার না বা ওনার কথা না। এগুলো শিল্পে বহু আগে থেকেই আছে। কিন্তু সেলিম আল দীনের লেখার বৈশিষ্ট্য যেটা, এবং যেটা তার শক্তি, সেটা হলো- অন্যান্য নাট্যকারদের সংলাপে আপনি একটা নির্দিষ্ট বিষয়কে যতবার ভাইব্রেট করাতে পারবেন, সেলিম আল দীনের সংলাপকে অনেক বেশিভাবে ভাইব্রেট করাতে পারবেন। আপনি গল্পের বেলাতেও দেখবেন, হাসান আজিজুল হকের লেখা আর মামুন হুসাইনের লেখার মধ্যে দুরকম আবহ পাবেন। মামুন হুসাইনের গল্পে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য হয়তো খুঁজে পাবেন না, চরিত্রগুলো কাটা-কাটাভাবে একই পেইসে যাচ্ছে না...মসজিদের গায়ে একটা দাগ, এক গৃহবধু এক কলসি পানি নিয়ে যাচ্ছে, তালগাছ থেকে একটা তাল টুপ করে পড়ছে...এসব ভাঙা ভাঙা ব্যাপার। মনে হবে যেন কোনো গল্প নাই। কিন্তু পড়তে পড়তে শেষে দেখা যাবে, এই ছোট ছোট বিষয়গুলো মিলে একটা জিনিস দাঁড়িয়েছে যা আপনার হৃদয়কে নানাভাবে ভাইব্রেট করবে। ঠিক তেমনি আমি সেলিম আল দীনের নাটক এবং এর সাথে আরও কারো কারো নাটকের সাথে অন্যান্য নাট্যকারদের, যেমন, উৎপল দত্ত, গিরিশ ঘোষ বা আমাদের এখানকার নাট্যকারদের পার্থক্য হচ্ছে, অন্যরা কেবল ফুলের রঙটা আঁকার চেষ্টা করেছেন। লাল বা হলুদ বা যেকোনো রঙ। আর সেলিম আল দীন সেই ফুলে ঘ্রাণটা আঁকার চেষ্টা করেছেন। এই কথাটি আমি শাহীনুরভাইয়ের (শিল্পী শাহীনুর রহমান) কাছ থেকে নিয়েছি। উনি কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন যে, একসময় শিল্পী কেবল ফুলের রঙটা আঁকতেন আর এখন চেষ্টা করা হচ্ছে সেই ফুলের ঘ্রাণটা আঁকতে। তো কথা হচ্ছে, নাটকে যখন আপনি ঘ্রাণ আঁকতে চাইবেন, তখন চরিত্রগুলোকে আসলে এভাবেই কথা বলাতে হবে এবং একসময় হয়তো বলবে, ‘সৌন্দর্য বরাবরই নির্মমতার ছকে বাঁধা’। এই সংলাপটা আপনি কেবল সংলাপ আকারে দিলে শুধু ফুলের ‘রঙটা’ বেরুবে। আর আমি যে কম্পমানতার কথা বলছি, একটা ভাইব্রেশন তৈরির কথা বলছি, সেই কম্পমানতা সৃষ্টি করতে হলে আপনাকে সংলাপের বাইরে এসে এই সংলাপগুলোকে বর্ণনার মধ্য দিয়েই আনতে হবে। এটা কোনো বিলাসিতা না, এটা কেবল বর্ণনাত্মক নাটক নাম দেয়ার জন্য না। যদি কম্পমানতা সৃষ্টি করতে চান, তাহলে এটা হচ্ছে অনিবার্যতা।

বিপ্লব বালা
কিন্তু সংলাপের মধ্যেই তো বর্ণনা থাকে। সেই সংলাপ কী কোনো কম্পন তৈরি করে না?

বদরুজ্জামান আলমগীর
অবশ্যই সংলাপের মধ্যেও বর্ণনা থাকে। এবং আমার কাছে মনে হয় এটা ঐ নাট্যকারদের একটা মুন্সিয়ানা। আমি ব্যাপারটা এভাবে বলতে পারি...একজন শিল্পী যখন ফিগারেটিভ ছবি আঁকে, তখন আমরা বলি এটা তো সহজ ব্যাপার। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ফিগার আঁকা কিন্তু মোটেই সহজ ব্যাপার না। অনেকে ফিগারে দুর্বল বলেও হয়তো-বা, আমি কিন্তু ‘হয়তো-বা’ বলছি, বিমূর্ত ছবির দিকে যায়। তেমনি আমার কাছে মনে হয়েছে, একজন শেক্সপীয়র বা আমাদের সৈয়দ হক বা উৎপল দত্ত বা মামুনুর রশীদ সংলাপের ভেতর দিয়েই যে কম্পমানতা সৃষ্টি করছেন, আমি সেটা পারছি না বলেই বর্ণনাটা আলাদা করে ফেলছি...হতে পারে। তবে আমার মনে হয় ঐ বিন্দুর কম্পমানতা সৃষ্টি করা, ফুলের রঙের চেয়ে ঘ্রাণটা বের করে আনাটাই হচ্ছে উদ্দেশ্য।

আহমাদ মোস্তফা কামাল
আমি একটু এখানে বলতে চাই, বদরুজ্জামান আলমগীরের ঐ গল্পের উদাহরণ থেকেই, যে, মামুন হুসাইনের গল্পের চরিত্র একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলে না। বা তাঁর গল্পের ভেতরে আরও অনেক গল্প এসে ডালপালার মতো ছড়াতে থাকে। ছড়াতে ছড়াতে বটবৃক্ষের মতো ছড়িয়েই থাকে। আরেকজনের নাম বলি মনিরা কায়েস। তাঁর গল্পও এমন, গল্পের ভেতরে গল্প আসে এবং ছড়াতে থাকে। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, শেষে এসে এই ডালপালাগুলো আবার একবিন্দুতে আসে। মনে হয় যেন গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে। তো এই দুজনের গল্পের পার্থক্যের দার্শনিক দিকটা কী? আমি এভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি যে, মামুন হুসাইন হয়তো ভাবেন যে, জীবনটা এমনই। নির্দিষ্ট গল্পহীন এবং এটা ছড়াতে থাকে আর শেষে এসে কোথাও মিলতে হবে এমনটা না-ও হতে পারে। মনিরা কায়েস হয়তো মনে করেন, জীবনে এমন ডালপালা ছড়ায় ঠিকই, কিন্তু তারও একটা গন্তব্য থাকে। এই উদাহরণ আমি আনলাম কমিউনিকেশনের প্রসঙ্গ ধরে। এই দুই গল্পের মধ্যে কিন্তু পাঠক হিসেবে মুনিরা কায়েসের গল্প কমিউনিকেট বেশি করে মামুন হুসাইনের গল্পের চেয়ে। তো এই অহরকণ্ডল দেখার পর আমার মনে হয়েছে, এখানেও অনেক গল্প আছে। গল্প তৈরি হচ্ছে আবার অতীতের গল্প আসছে, এভাবে গল্প ছড়াতে ছড়াতে ছড়িয়েই থেকে গেল শেষপর্যন্ত। ফলে দর্শক হিসেবে আমার অন্তত কমিউনিকেট করতে অসুবিধা হয়েছে। এবং এটা আমার নিজস্ব মত যে, নাটকে বোধহয় শেষপর্যন্ত গন্তব্য খুঁজে পেতে হয়, না হলে চলে না। একজন পাঠক হিসেবে মামুন হুসাইনের গল্প যতই ছড়ানো হোক একাধিকবার পড়লে হয়তো গন্তব্যহীনতার মধ্যেও একটা গন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়, অহরকণ্ডল পাণ্ডুলিপি পাঠ করলে তবু কিছু খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু নাটক হিসেবে, মঞ্চে দেখার পরও বলছি, কমিউনিকেট করতে...মানে আমার অসুবিধা হয়েছে। আর পাণ্ডুলিপিটা আসলে আমি নাটক হিসেবে পড়ি নি, অন্য কিছু হিসেবে পড়েছি। এটা একটা লেখা, সে হিসেবে পড়েছি।

নাটক দেখতে গিয়ে আমার একটা ব্যাপার খুব ভালো লেগেছে, সেটা হলো অভিনয়। এই ৩ জন অভিনেতাকে আমার সাধুবাদ যে, এমন একটা পাণ্ডুলিপিকে কমিউনিকেট করানোর চেষ্টা করেছেন এবং তাঁদের এই ক্ষমতার জন্যই অন্তত দর্শক হিসেবে আমি নাটকটি দেখতে পেরেছি। ৩ জনের অভিনয় সত্যিই প্রশংসাযোগ্য।

আলফ্রেড খোকন
আমি একটু বলি। আমাকেও নাটকটি আগে পড়তে দেয়া হয়েছিল। পড়ে কিছু বলার কথাও ছিল, এবং লিখিতভাবে অর্থাৎ একটা আর্টিকেল হিসেবে সেটা কবিরভাইকে দিয়েছি। ছাপার কথা ছিল, এখনো হাতে পাই নি। যাক, সেখানে আমি শেষে লিখেছি, ‘প্রিয় দর্শক, যেহেতু নাটকটি মঞ্চস্থ হবে, তাহলে মঞ্চে গিয়ে দেখি নাট্যকারের অহরকণ্ডল ডানাভাঙা, অথবা নির্দেশকের অহরকণ্ডল ডানাওয়ালা।’...আমি কী বোঝাতে পেরেছি? না চুপ থাকলে হবে না, কারণ, এর পর আমি পরের কথাগুলো বলবো।

দিলীপ চক্রবর্তী
এটুকু বুঝলাম, কারো না কারো অহরক-ল ডানাভাঙা। দুজনের অহরকণ্ডল ডানাওয়ালা হওয়ার সম্ভাবনা নাই।

শহীদুল মামুন
একটি ব্যর্থতার দায়ের পর একটি ধন্যবাদ জ্ঞাপন, একটি শিল্পের সৃষ্টি এবং শিল্পের সংগঠনকে প্রথমেই বাতিল করে দেয়া হচ্ছে? এখানে দাদাকে আমি একটা প্রশ্ন করি...

আলফ্রেড খোকন
আমাকে?

শহীদুল মামুন
না, বিপ্লব দা’কে।

আলফ্রেড খোকন
কিন্তু আমি তো একটা কথা বলছি, আমার কথাকে যেহেতু আপনি কমিউনিকেট করতে পারেন নি, তাই বিষয়টা আমি আরেকটু ক্লিয়ার করতে চাই। আমি লিখেছি, ‘চলুন দর্শক দেখি নাট্যকারের অহরকণ্ডল ডানাভাঙা, নাকি নির্দেশকের অহরকণ্ডল ডানাওয়ালা’। এবার পরিষ্কার কিনা?

দিলীপ চক্রবর্তী
আপনি যেটা খারিজ করছেন, সেটা হলো, দুজনের অহরকণ্ডল ডানাওয়ালা হতে পারে না।

আলফ্রেড খোকন
অর্থাৎ নাটকটি পড়ে আমার মনে হয় নি এটা মঞ্চের জিনিস, তাহলে আসুন দর্শক দেখি মঞ্চে এটা আদৌ উড়তে পারলো কিনা। কারণ, আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা আছে যে, পাণ্ডুলিপির চেয়ে নাটকের প্রেজেন্টেশন অনেক ভালো হয়। পাণ্ডুলিপি দুর্বল হলেও নির্দেশনার গুণে ভালো একটা নাটক পেয়ে যেতে পারি আমরা।

বিপ্লব বালা
মানে নাটকের স্ক্রিপ্ট দুর্বল কিন্তু প্রোডাকশন ভালো এমন অভিজ্ঞতা বেশি?

আলফ্রেড খোকন
অবশ্যই, এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ দিতে পারি।

বিপ্লব বালা
যাক, আমরা কথাটা এগিয়ে নিই। কিন্তু একটা কথা খোকনকে বলছি, এর বিপরীতটাই হলো সত্য। স্ক্রিপ্ট খারাপ আর প্রোডাকশন খুব ভালো হয়েছে এমন অভিজ্ঞতা ভুরি ভুরি তো দূরের কথা হাতে গোনা দু-একটা হয়তো দিতে পারবেন। তবে এখন আপনি আপনার আগের প্রসঙ্গে আসেন। এ নিয়ে না হয় পরে কথা হবে।

মুজিব মেহদী
এখানে একটু পরিষ্কার হয়ে নিই। খোকনের মন্তব্য হচ্ছে, নাট্যকারের অহরকণ্ডল-এর উড়বার ক্ষমতা নেই, যদি এটাকে ওড়াতে সক্ষমও হন, তাহলে তিনি হলেন নির্দেশক। এখন আমার প্রশ্ন খোকনকে যে, নাটক দেখার পর কী মনে হলো? পাখিটা কি উড়তে পারলো?

আলফ্রেড খোকন
এবার তাহলে বলি, নাটক দেখার পরও আমার মনে হয়েছে, অহরক-ল উড়তে পারে নি। এটা হলো আমার ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ এর উত্তর। কিন্তু শিল্পের বেলায় হ্যাঁ বা না বলে উত্তর দেয়ায় বিপদ আছে। এখন শিল্পের বিবর্তনের ধারা বলতে গিয়ে যদি আমরা মনে করি যে, প্রথমে ফুলটা আঁকা হয়েছে, তারপর ঐ ফুলে রঙ লাগানো হয়েছে আর এখন ঐ ফুলের গন্ধ আঁকার চেষ্টা হচ্ছে...তাহলে আমি বলবো, প্রথম দুই ধাপে কিন্তু সবাই প্রায় একই ইমেজ পাবে। গোলাপ ফুল বললে আমাদের সবার ভেতরেই গোলাপ ফুলের আদল আসে, টগর ফুলের আদল আসে না। আবার লাল গোলাপ মানে লালই, কালো মনে হয় না। কিন্তু রঙের গন্ধের বেলাতে একটু সমস্যা আছে, সবাই একই গন্ধ পাবে না। এখন যেটা বক্তব্য সেটা হলো, গন্ধ না থাকলেও কিন্তু সেটা ফুলই থাকে। সুতরাং সবাইকে নাটক করার সময় এমন জায়গায় যেতে হবে যে, আদল বা রঙ পেলে হবে না, রঙের গন্ধও পেতে হবে, এমন না। আর এমন যদি হয়েই থাকে আমি অহরক-ল দেখে সেই গন্ধ পাই নি। আমার এটুকুই বক্তব্য।

আরেকটা ধন্যবাদ আমি কামালের মতো করেই দিতে চাই, সেটা হলো অভিনেতাদের। সামনে প্রশংসা করাটা কেমন দেখায় জানি না। ওনারা ৩ জন আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তাদের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কমিউনিকেট করাতে।

শহীদুল মামুন
আমার একটা প্রশ্ন বোধহয় তামাদি হয়ে গেছে, একটি ব্যর্থতার দায়ের পর একটি ধন্যবাদ জ্ঞাপন...একটি শিল্পের সৃষ্টি এবং শিল্পের সংগঠনকে প্রথমেই বাতিল করে দেয়া হচ্ছে কিনা? আমি প্রথমেই একটা কথা বলেছিলাম যে, শিল্পীর যে অভিপ্রায় আর ভোক্তা যেভাবে গ্রহণ করে, এর মধ্যে পার্থক্য থাকবেই। তাহলে কোনটিকে আমি স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরবো? শিল্পীর অভিপ্রায়কে নাকি ভোক্তার গ্রহণ করার ব্যাপারটাকে? আপনি ডানাভাঙা বলছেন পুরো নাট্যপ্রক্রিয়াটিকে আর সাধুবাদ দিচ্ছেন ঐ ভাঙার সাথে জড়িত থাকা ক্রিয়েটিভ আর্টিস্টদের, এটা কেমন হলো?

আহমাদ মোস্তফা কামাল
আমি কিন্তু প্রথমে বলেছি যে, আমি যখন টেক্সট হিসেবে পড়েছি, আমার কোনো অসুবিধা হয় নি। এমন কী আমি প্রথম কয়েক পাতার পর এটাকে নাটক হিসেবেই পড়ি নি। কিন্তু মঞ্চায়ন দেখে আমার মনে হয়েছে, এটি ব্যর্থ হয়েছে। আমার কথায় যদি মনে হয়ে থাকে যে, আগাগোড়া নস্যাৎ করে দিয়েছি, তাহলে সেটা ভুল হবে। আমি টেক্সটকে নস্যাৎ করি নি। মঞ্চায়ন ব্যর্থ হয়েছে বলেছি, এবং সেই ব্যর্থতা একান্তই আমার কাছে মনে হয়েছে, অন্যদের সাথে আবার এটাকে মেলানো যাবে না। আর একটা কথা হলো এটাকে মঞ্চায়ন যদি করতেই হয় তাহলে নাট্যকারকে এটাতে আরও কিছু করার দরকার ছিল বলে মনে হয়েছে। অর্থাৎ একটা উপন্যাসকে বা গল্পকে মঞ্চে আনলে আমরা তো হুবহু আনি না। বা পথের পাঁচালী উপন্যাস হিসেবে এক ব্যাপার কিন্তু সত্যজিৎ যখন চলচ্চিত্র করেন, তখন তো চিত্রনাট্য লিখতে হয় তাই না?

হাসান শাহরিয়ার
এক্ষেত্রে কিন্তু সেই অবকাশ নাই। লেখক কিন্তু বলেছেন যে, লেখার সময়ই উনি চাচ্ছেন যে এটার মঞ্চায়ন হবে এবং এ-ও বলেছেন লেখার সময় ওনার মাথায় দর্শকের ব্যাপারটাও ছিল।  সুতরাং কমিউনিকেট করুক বা না করুক এটা নাটকের ফর্মেই লেখা হয়েছে, যদিও এই ফর্মটাই হয়তো প্রথাগত ফর্ম না।

মুজিব মেহদী
আমি একটু বলি, কবিরভাই আমাকেও এই পাণ্ডুলিপিটা পড়তে দিয়েছিলেন, বেশ আগে। তো কবিরভাই যেটা প্রথমে বললেন যে, পাণ্ডুলিপিটা হুট করে ধরেই নির্দেশনা দিয়েছেন তা না। অনেক দীর্ঘসময় ধরে তারা এটার পেছনে লেগে ছিলেন...যখন আমাকে পাণ্ডুলিপিটা দেয়া হলো, পড়তে, তখনও আমি ঠিক জানি নি বা শুনি নি যে, এটা মঞ্চে আসতে যাচ্ছে। বা এটা আদৌ একটা নাটক কিনা। টেক্সটটার একটা জায়গায় দৃশ্যকাব্য লেখা থাকলেও, আমি পড়েছি আসলে একটা টেক্সট হিসেবেই। আমার একটা গ্রন্থ ছেপেছিলাম, সেটার নাম- শ্রেণিকরণ এমন একটি সংকীর্ণতা যা সৃষ্টির মহিমাকে ম্লান করে দেয়। তো দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পরীতি বা সেলিম আল দীনের কিছু লেখার সাথে আমার পরিচয়ও আছে, সেখান থেকেও কিনা জানি না, পাণ্ডুলিপিটা আমার ভালো লেগে গেল। টেক্সট পড়ে একটা লেখা আমি দিয়েছিও কবিরভাইকে, কেমন হয়েছে জানি না। পাণ্ডুলিপিটা ভালো লেগেছে মানে, আমি রীতিমতো মুগ্ধ। এটার ভেতরে আমি পলিফোনি আবিষ্কার করতে পেরেছি, বহু স্বরের উপস্থিতি পেয়েছি। এর ভেতরকার চরিত্রগুলোÑদানিউল-আকমল-বাহারের যে ক্রাইসিস, মানে আমিও তো গ্রামসমাজ দেখেছি...এই যে পশুর চামড়া তুলে নেয়া, তারপর আবার কনফেশন যে, নিজের চামড়াটা দিয়ে দিতে চায়, এই সব তো নিশ্চয়ই আমারও দেখার কথা ছিল কিন্তু দেখেছি কি? বা দেখে থাকলে কখনো এভাবে তুলে আনতে পেরেছি কি? তুলে আনতে পারি নি ঠিক, কিন্তু ঐ চরিত্রগুলোর বেদনা, নৈঃশব্দ্য, সবই আমি নিজে অনুভব করতে পেরেছি। এভাবে উপমা দেয়া, কবিতা সৃষ্টি করা, আবার চরিত্রগুলোর গদ্যভাষায় সংলাপ বলে যাওয়া...এত সবের সমাহারে সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো একটা টেক্সটই বটে। এখন আমি বলতে চাই এর দৃশ্যরূপের ব্যাপারে। এর দৃশ্যরূপ বা মঞ্চায়ন দেখে আমি কিন্তু বিন্দুমাত্র আহত হই নি বা কমিউনিকেশনে আমার কোনো সমস্যা হয় নি। দুটো অবশ্যই দুটো শিল্প, দুটো সৃষ্টি, কিন্তু টেক্সট-এর যে বেদনা-নৈঃশব্দ্য এর সব আমি মঞ্চেও পেয়েছি। এখন কথা হলো, সবটা বোঝা তো সম্ভব না। কোনো নাটক কেউ মঞ্চে দেখে সবটা বুঝে তারপর ওঠে? কিন্তু সব মিলিয়ে যে ভালোলাগার জায়গাটা তৈরি করা, সেটা ওনারা করতে পেরেছেন বলে অন্তত আমার মন্তব্য।

হাসান শাহরিয়ার
আপনার কাছে তাহলে দুটোর কোনোটারই ডানাভাঙা মনে হয় নি।

মুজিব মেহদী
না হয় নি। এবং আমি বন্ধুবর আলফ্রেড খোকনের মন্তব্য প্রসঙ্গেই বলি, যদি অহরকণ্ডল ডানাভাঙাও হয়, তবুও ঐ জনপদের ডানাভাঙা চরিত্রদের নৈঃশব্দ্য, বেদনা এবং যে রাজনৈতিক-অভিজ্ঞান তুলে আনা হয়েছে, এত স্বল্প পরিসরে, সেটা লেখকের এক বিশাল ক্ষমতা হিসেবেই আমার কাছে ধরা দিয়েছে। আর মঞ্চেও আমি বঞ্চিত হয়েছি বলে মনে হয় নি।

হাসান শাহরিয়ার
শাহীনভাই বরাবরের মতোই নীরব আছেন, একটু সরব হবেন?

শাহীনুর রহমান
আমি তো আসলে শুনছিলাম। শুনতে ভালোই লাগে। যাক, প্রথম কথা হচ্ছে আমি যখন পাণ্ডুলিপিটা পাই, শুরু থেকে শেষপর্যন্ত আমি একরাতেই পড়তে পেরেছিলাম। আমি যখন কাটা-কাটা স্টোরিটা পাচ্ছিলাম, কিছু কিছু বর্ণনা, কাব্যময়তা...মানে, রুদ্ধশ্বাসে আমি পড়ে ফেললাম। এবং আমার কাছে এই লেখাটা বেশ স্মার্ট লেগেছে। আমি ওনার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম, কবিরভাই বললেন, উনি বাইরে থাকেন। তো এরপর যখন আমি মঞ্চে দেখলাম, সেখানে আমার ফিলিংসের তেমন কোনো পার্থক্য ঘটে নি। প্রসঙ্গক্রমে বলি, দর্শকের প্রসঙ্গে, ‘থিয়েটারওয়ালা’র এমন আরেকটি বৈঠকে আমি বলেছিলাম, দর্শককে মাথায় রাখতে গিয়ে বোধকরি বাঙলা নাটকের কিছু লিমিটেশন আমরা মাথায় রাখি। মানে নিরীক্ষা করার সুযোগগুলো কমে যায়। এখন আমি যদি মাথায় রাখি দর্শক একটা সরল গল্প চায়, একের পর এক সংলাপ চায়, তাহলে এই যে কাটা-কাটা গল্প, টুকরো টুকরো ফিলিং এবং এভাবেও যে মঞ্চে ফুলের কেবল রঙ না, গন্ধটাও আঁকা সম্ভব, সেই নিরীক্ষাগুলো হবে না। সফল কী ব্যর্থ সেটা পরের কথা।

অপূর্ব
আমি আসলে বক্তা না, কিন্তু কিছু যেহেতু বলতেই হবে, তাই বলছি, গুছিয়ে বোধহয় বলতে পারবো না। এই যে আকমল-দানিউল-বাহার, খুন করার জন্য এদের ক্রোধটা আসছে না- তার মানে কিন্তু এই না যে, তাদের ক্রোধ নাই। স্বপ্নে যে-রকম আমি দৌড়াতে চাইলেও দৌড়াতে পারি না, ঐরকম একটা আবহ এখানে আছে। এখানে ওরা ৩ জন একটা জায়গায় এসেছে, ট্রেন থেকে একজন নেমে এই রাস্তা দিয়ে যাবে, তাকে খুন করতে হবে, এটাও আপাতদৃষ্টিতে স্বপ্নের মতোই মনে হতে পারে। ভেতরে ক্রোধ আছে, এবং ক্রোধটা যে কার প্রতি...রাষ্ট্রের প্রতি না মানুষের প্রতি, না চেয়ারম্যানের প্রতি...তার কিছুই হয়তো তারা জানে না। এই না-জানা ক্রোধ যেহেতু আছে, তাই সেটা হয়তো স্বপ্নের মতোই, মূলে আঘাত না করে হয়তো অন্যকে আঘাত করতে যাচ্ছে...বিষয়টা এমনও হতে পারে, আমার কাছে মনে হয়েছে। এখন হামিদ মিয়ার ব্যাপারে কোনো ক্ষোভ কিন্তু তারা দেখাচ্ছে না, তেমনভাবে নাটকে আসে নি। এটা কিন্তু একটা সুপার ইগো হতে পারে। হামিদ মিয়ার উপরে যে ক্ষোভ, সেটা নিয়ামুলকে হত্যার মধ্য দিয়ে আসতে পারে। আবার দেখা যাচ্ছে, যাকে খুন করা হলো, সে হয়তো নিয়ামুল না, একটা কাকতাড়–য়া। স্বপ্নেও এরকম হয়, নিশ্চিতভাবে কাউকে খুন করে দেখা গেল খুন হয়েছে অন্যকিছু বা হয়তো নিজেরই গলা টিপে ধরে...মানে অনেক ঘ্রাণ এখানে কিন্তু আমরা পাই। এটাকে এমন করে আনার ব্যাপারে নির্জনভাই যেটা প্রথমেই বললেন, এটাকে তিনি স্লোগান বানাতে চান নি, কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই একটা রাজনৈতিক-অভিজ্ঞান, সে কারণে ওনার এমন একটা ফর্ম নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

বিপ্লব বালা
আর নির্দেশনার জায়গা থেকে কিছু বলবেন?

অপূর্ব
আমি আসলে নাটকের টার্মিউনোলজির ব্যাপারগুলো নিয়ে কিছু বলতে পারবো না।

বিপ্লব বালা
না টার্মিউনোলজি না। ধরুন কমিউনিকেট করার জায়গা থেকে?

অপূর্ব
কমিউনিকেট না করলে তো এই বোধদয়গুলোও বলতে পারতাম না।

দিলীপ চক্রবর্তী
বিপ্লব দা’ প্রথমে বলেছিলেন, চরিত্রগুলোর উপর আলো পড়ে না, বর্ণনা করে যাচ্ছে, তাকাচ্ছে না, একেবারে ড্রাই লাগে...

বিপ্লব বালা
না একেবারে ড্রাই না...

দিলীপ চক্রবর্তী
মানে কমিউনিকেট করছে না। দর্শকের দিকে তাকানো বা না তাকানো এটা বোধহয় বড় জায়গা না। আর তাকানোর ব্যাপারটা হচ্ছে, গ্রামে বহুদূর পর্যন্ত তাকানো যায়, শহরে যায় না, দৃষ্টি আটকে যায়। শহরে বদ্ধ ঘরে নাটক করছি, গ্রামে হলে খোলা জায়গায় হতো। এখন আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এই শহরের এই দর্শককে এই কথাগুলো শোনানোর জন্য আমাদের এভাবে তাকিয়ে আবার না-তাকিয়ে, এভাবে ছোট্ট পরিসরে মুভমেন্ট করে সংলাপ দিতে হয়েছে। একটা কথা যদি আমরা মনে রাখি, এই টেক্সটটা কিন্তু নতুন, এর স্বাদ নতুন হবে- নতুনকে গ্রহণ করতে গেলে একটু খটকা লাগবেই।

বিপ্লব বালা
এই নতুন টেক্সটটা কনসিভ করতে আপনি কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছেন?

দিলীপ চক্রবর্তী
সেটা বলতে গেলে আসলে, এটা যখন মঞ্চে আনার জন্য পাঠ করা হয় বা প্রাথমিক কাজগুলো করা হয়, আমি তার অনেক পরে এটার সাথে যুক্ত হয়েছি। আমি যখন পাণ্ডুলিপিটা হাতে পাই এবং পড়ি, তখন কবিরভাইকে বলেছিলাম, এটা কী করে সম্ভব! মানে মঞ্চে আনা কীভাবে সম্ভব! এটা অবশ্য বলেছিলাম, এতদিনে আমার যে টুকটাক থিয়েটারি অভিজ্ঞতা সেখান থেকে। কারণ, এই টেক্সট আমার অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা আমার দ্বারা সম্ভব না। এরপর আমরা যখন কাজে নামলাম...আমি রতন দা, আনোয়ার, কবিরভাই, তখন প্রতিনিয়তই আলোচনার মধ্য দিয়ে আমি আমার কিছু কথা তাদের জানালাম এবং তাদের মতামতগুলো আমি জানতে পারলাম।

বিপ্লব বালা
ঐ যে বললেন, গ্রাম হলে বিস্তৃতভাবে দেখা যায়, শহরে এটাকে আটকাতে হয়ে, তো সেগুলো এখানে কীভাবে করলেন, মানে স্পেস তৈরির ব্যাপারটা কীভাবে করলেন?

দিলীপ চক্রবর্তী
স্পেস তৈরির ব্যাপার তো সব নাটকে একই রকম দাদা। আমি অন্য যেকোনো নাটকেও তো স্টেজে মিথ্যা স্পেস বানাচ্ছি, এখানেও সেইরকম। যাক, আমি একটু আমার জার্নিটার কথা বলছিলাম। সেটা হলো আমরা এই ৫-৬ জন যখন কাজ শুরু করলাম, আমার ছিল সবচেয়ে বেশি আর্গুমেন্ট। এটা কেন বলবো, এটা এমন হবে কেন, এভাবে ওখানে যাব কেন, এই বর্ণনা আমি দেব কেন...ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন এসে উপলব্ধি করছি যে, এই প্রক্রিয়ায় হয়তো নির্দেশক এবং আর সহশিল্পীবন্ধুরাও বিরক্ত হয়ে থাকতে পারেন...হয়তো না, ওনারা বিরক্ত হওয়ারই কথা। তবে যে সহনশীলতা ওনারা দেখিয়েছেন সেটা আসলে অনেক বড় ব্যাপার।

হাসান শাহরিয়ার
প্রশ্নগুলো আপনাকে করতে হয়েছে, কারণ আপনার অভিজ্ঞতায় এধরনের কাজ এর আগে ছিল না।

দিলীপ চক্রবর্তী
অবশ্যই।...তো আমাদের কারো কোনো নির্দিষ্ট চরিত্র ছিল না। সবাই সবটা পড়তাম। এখানে যে বর্ণনাগুলো আপনারা পেয়েছেন, সেই বর্ণনা কে কোনটা দেবে এটা তো নির্দিষ্ট না। নাটকে কোথায়ও উল্লেখ নাই, কোনটা কার সংলাপ। আমাদের খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়েছে আসলে কে দেবে এই সংলাপ বা বর্ণনা। আর যখন নির্দিষ্ট হলো আমি করছি ওমক চরিত্র আর বলছি ঐ ঐ বর্ণনা, তারপর থেকে চরিত্রায়ণের ব্যাপারটা তো সব নাটকের মতোই।

রতন দেব
আমি যখন এই পাণ্ডুলিপিটা পাঠ করি, তখন কিন্তু মাথায় ছিল না যে, এটাকে মঞ্চে আনতে হবে। যেভাবে বর্ণনা আছে সেগুলো মঞ্চে আনা সম্ভব না এমনটা ভাবি নি, কিন্তু মঞ্চে আনার পরিকল্পনা নিয়ে আমি এটা পাঠ করি নি। তো পাঠ করে ভালো লেগেছিল। কবিরভাই হয়তো আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন যে, এটাকে মঞ্চে আনবেন। তো যখন পরিকল্পনার কথা বলা হলো...আমার মনে হয় না যে, আমি ‘অসম্ভব’ বলেছিলাম। কারণটা এমন হতে পারে, হতে পারে বলছি এ কারণে যে, এখন হয়তো আমি এই যুক্তিগুলো দিচ্ছি, সেটা হলো...আমি টেলিভিশনে নূরলদীনের সারাজীবন দেখেছিলাম। সেখানে নূরভাইয়ের অনেক বড় বড় বর্ণনাত্মক সংলাপ ছিল। সেগুলো বেশ ভালো লেগেছিল। তো অহরক-ল-এর এই বর্ণনা আমার কাছে ঐটার চেয়ে শক্তিশালী মনে হয়েছে। তার মানে, আমি কিছু একটা যদি শোনাতে চাই, তাহলে শোনানো সম্ভব। ফলে এই পাণ্ডুলিপিটা মঞ্চে করা সম্ভব, সেটা আমি প্রথম থেকেই মনে করেছি। ৩জন মানুষ একজনকে খুন করবে, কিন্তু যাকে খুন করবে সে তাদের শত্রু না, ফলে খুন করবার জন্য যে ক্রোধ দরকার সেটা জাগছে না...এই যে ব্যাপারগুলো...আবার এই কি তবে সত্য না যে, এটার পেছনে অন্য একটা শক্তি আছে, যে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে? তাহলে আমরা কি সেদিকেই যাচ্ছি? এসব ব্যাপারগুলোকে আনতে যে ভাষা-রূপক, কাব্য ব্যবহার করা হয়েছে, সব মিলিয়ে মনে হয়েছে এটা মঞ্চে আনা যাবে না কেন?

আনোয়ারুল হক
আমি একটু আগে থেকে আসি। আমি যেহেতু একটা নাট্যদলে কাজ করি, সেখানে নিয়মিত নাটক করা হয়, অভিনয় করা হয়। কিন্তু কবিরভাইয়ের সাথে কোনো কাজ করা হয়ে ওঠে নি। একবার নননপুর (নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী এবং একটি বাঘ আসে) পড়েছিলাম, মঞ্চে আনা হয় নি। আর উনি নারায়ণগঞ্জের ‘ঐকিক থিয়েটারে’ যেটা করেছিলেন, পূণ্যাহ, সেটা দেখা হয় নি...তো ওনার সাথে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। যখন উনি এই পাণ্ডুলিপিটা আনেন, তখন একটা অনুভূতি কাজ করলো যে, মঞ্চে সাধারণত যেরকম চরিত্র নিয়ে কাজ করি, এখানে এর বাইরে যাওয়া যাবে। এটা আমার ভালো লেগেছে। আরও ভালো লেগেছে, এটা আসলে কী দাঁড়াবে সেটা না বুঝে ওঠার কারণে একটা আগ্রহ সব সময়ই কাজ করেছে। আর যেটা বলা হলো যে, ৩ বছর যাবৎ এটার কাজ করছি, বিষয়টা এমন না। ৩ বছর ধরেই আমরা নানাভাবে এটার বিশ্লেষণ করছিলাম। টানা মহড়া করে মঞ্চে নিয়ে আসবো, এভাবে এই কাজটি হয় নি। পড়েছি, পড়ে বোঝার চেষ্টা করেছি। সেই বোঝা না-বোঝা নিয়ে আলাপ করেছি, করতে করতে এক সময় মহড়ায় আসা হয়েছে। আমরা যেভাবে নাটক করেছি, সেখানে দেখা গেছে যে চরিত্র বা চরিত্রায়ণের দিকে যে মনোসংযোগ লাগে, এই পাণ্ডুলিপিতে সেভাবে করলে হবে না। পুরো টেক্সটটার সাথে যে অভিনেতা সার্বক্ষণিকভাবে ইনভলব হবে না, সে এই নাটকটা করতে পারবে না। নাটকে যে বর্ণনা থাকে, অনেক সময় দেখা যায় কোনো কোনো নাটকে সূত্রধার এসে সেই কাজটি করে। কিন্তু এই নাটকে সেটা সম্ভব না। চরিত্রই বর্ণনা করছে, চরিত্রের বাইরে এসে না, চরিত্রের মধ্যে থেকেই। এবং এর যে শব্দ চয়ন, সেটাও যদি দর্শকের সাথে কমিউনিকেট করতে হয় তাহলে সমস্ত অভিনয় দিয়ে করতে হবে, কেবল সংলাপ আওড়ালে হবে না। এই যে ব্যাপারগুলো করলে পরে নাটকটি দাঁড়াবে, সেই চ্যালেঞ্জটা আমি এনজয় করেছি। এখন একটা হতে পারে যে, অভিনেতা হিসেবে যে ইনভলবমেন্ট এই নাটকে আমাদের ছিল, প্রথম থেকেই, সেই ইনভলবমেন্ট অন্য কোনো নাটকের থাকে না। বা থাকার হয়তো প্রয়োজনও পড়ে না। এখানে নির্দেশক আছেন, তারপরও আমাদেরকেও ঐ পরিমান ভাবনা দিয়ে আসতে হয়েছে প্রথম থেকেই যে, কী করলে কী দাঁড়াবে বা দাঁড়াতে পারে। এজন্যই বোধহয় এই নাটক দেখার পর অনেকের মনে হতে পারে যে, এখানে নির্দেশক কোথায়? এই যে নির্দেশকের অনুপস্থিতির মতো লাগা, সেটা কিন্তু পজেটিভ হতে পারে।

শহীদুল মামুন
আমি পজেটিভ অর্থেই কথাটা বলেছি। এই নাটকে আপনারা স্বাধীনতা পেয়েছেন, কিন্তু সেটা ভাবনার স্বাধীনতা এবং এই স্বাধীনতা না দিলে নির্দেশক এরকম একটি টেক্সটকে, বাচনিক টেক্সটকে...কেবলি বর্ণনা...সেটাকে মঞ্চে আনতে পারতেন না। আনোয়ার যেটা বলেছেন যে, আপনাদের ইনভলবমেন্ট ছিল, এই ইনভলবমেন্ট না থাকলে এই টেক্সট কখনোই দাঁড়াতো না আর এই ইনভলবমেন্ট আসতো না যদি আপনারা স্বাধীনতা না পেতেন। তো আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই, এই যে নির্দেশকের উপস্থিতি টের পাই নি, সেটা আমি পজেটিভ অর্থেই বলেছি।

দিলীপ চক্রবর্তী
এবং আমাদের এই অজানার দিকে যাওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু এখনও আছে। প্রতিটি প্রদর্শনীই আমাদের কাছে নতুন কিছু নিয়ে আসে। আমরা এখনও নিরীক্ষার মধ্যে আছি।

মুজিব মেহদী
এর অর্থ আসলে এমনই দাঁড়ালো যে, নির্দেশক কামালউদ্দিন কবির আবার তিনি একাই নির্দেশক নন। এটা একটা পার্টিসিপেটরি মেথডে করা হয়েছে।

আনোয়ারুল হক
হ্যাঁ। আমি আগের কিছু কথার সূত্র ধরে বলি...এখানে ন্যারেশনকে যেভাবে আনা হয়েছে সেটাও নতুন। এখানে একটা চরিত্র কিছু একটা বর্ণনা করে আবার একই সময়ে চরিত্র হয়েই কথা বলছে। যেমন, আকমল যখন বলেÑ‘আন্তির পাড়ে বমি করে দানিউল, তার মাথায় হাত দিয়ে রাখে বাহার। দূরে দাঁড়িয়ে থাকে আকমল।’ ট্রুলি সে কিন্তু তখন একজন ন্যারেটর। কী ঘটছে সেটা সে বলছে আর অন্য দুজন করে দেখাচ্ছে। সাথে সাথেই সে বলে, ‘মাস তিনেক আকমলের এরকম হয়। সে নিজের মধ্যে থাকে, সবার সঙ্গে মিশতে পারে না।’ এই চ্যালেঞ্জিং জায়গাটা আমি এনজয় করি। এখন যে কথাটা আগে এসেছে যে, এখানে যদি আমরা ৩জন না হয়ে আরও কেউ থাকতো, মুচি যদি অন্য কেউ হতো বা হামিদ মিয়ার কথা যদি হামিদ মিয়া বলতে পারতো তাহলে আপনাদের বেশি ভালো লাগতো। কিন্তু দানিউল যখন হামিদ মিয়ার সাথে তার কথপোকথনকে আমাদের জানায়, একই সাথে সে ন্যারেটর হয় আবার চরিত্রও হয়, সেটা আমি এনজয় করি বেশি।

আলফ্রেড খোকন
এই জন্যই কিন্তু মাঝেমাঝে আমার কাছে মনোটোনাসও লেগেছে। আমি দর্শক হিসেবে বলছি। আপনাদের ভালো লাগতেও পারে না-ও লাগতে পারে। মাঝেমাঝে বিরক্তিকরও মনে হয়েছে। চরিত্রগুলো আনলে সেই মনোটোনাস বা বিরক্তিটা হয়তো লাগতো না।

মুজিব মেহদী
কিন্তু তাহলে তো গতানুগতিক হয়ে যেত, এই টেক্সট তো সেটা ডিমান্ড করে না।

আলফ্রেড খোকন
করে না বলেই কমিউনিকেট করতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

মুজিব মেহদী
অনেকের কাছে। কিন্তু আজকের আলোচনাতেও উঠে আসলো যে, অনেকের কাছে আবার এটা বেশ ভালোও লেগেছে।

আলফ্রেড খোকন
হ্যাঁ লেগেছে। তারা কোনোভাবেই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী না। আমার কাছে যদি মনোটোনাস লেগে থাকে সেটাকে আপনি কীভাবে নিচ্ছেন সেটা হলো বড় কথা। আমি একটা থিয়েটার দেখার পরে তার শিল্পরীতি, বিশ্লেষণ, তত্ত্ব এসব বিষয় অন্যের কাছ থেকে শুনে ভালো লাগতে হবে, তা আমি বিশ্বাস করি না। আমি দেখবো, দেখে বলব, বাহ! ভালো লেগেছে, সেটাই আমার মূল কথা। সব দর্শক কি আপনার রীতি, তত্ত্ব এগুলো শোনার জন্য বসে আছে নাকি? সাধারণ-দর্শক কীভাবে নেয় সেটাও বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত।

আনোয়ারুল হক
তাহলে একটা প্রাসঙ্গিক কথা বলি...‘সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার’ একবার আমাদেরকে এন.এস.ডি-তে শো করার জন্য, অনেকটা বাছাইয়ের মতোই, শো করতে বললো তাদের মিরপুরের অডিটোরিয়ামে। সেখানে এন.এস.ডি-র অনেকে ছিলেন। তো দর্শকভর্তি হলে অভিনয় করে মজা পাব এজন্য তারা আশে-পাশের সবাইকে হলে ঢোকালো। একেবারে চা দোকানদার, বাচ্চা কোলে মা সবাইকে। তো এই যে ১ ঘণ্টার উপরে পারফরমেন্স, এটা তারা একেবারে হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। একজন দর্শকও একটু আওয়াজ পর্যন্ত করলো না। তো তারা কেন এভাবে দেখলো? তারা কী অহরকণ্ডল-র মতো একটা টেক্সট বুঝে ফেলছে? না, হয়তো তা না। তারা বসেছিল, কারণ, এই নাটকের টেক্সট আর অভিনয়ের শক্তির কারণে। এই নাটকটার সংলাপ থেকে শুরু করে সব কিছুতে এমন একটা পাওয়ার আছে, শক্তি আছে যা সবাইকে ডমিনেট করে। মানে যেভাবেই হোক এই নাটকটার এমন একটা শক্তি আছে যে, সে কাউকে উঠতে দেয় না। সুতরাং খোকনভাই যেটা বললেন যে, সাধারণ-দর্শককে বিবেচনায় নিতে, এখানে ওরা তো সাধারণ-দর্শকই ছিল, কিন্তু ওরা বিরক্ত হয় নি বা ওদের কাছে মনোটোনাসও লাগে নি।

আহমাদ মোস্তফা কামাল
এটা কি কেবল এই নাটকেরবেলায়ই বলছেন?

আনোয়ারুল হক
হ্যাঁ, আমি এই নাটকের কথাই বলছি।

আহমাদ মোস্তাফা কামাল
প্রায় সব সফল নাটকই তো দর্শককে এভাবে ডমিনেট করে। আবার ডমিনেট করা মানেই কিন্তু সফল নাটক, এটা বলা যাবে না। অনেক নাটক আছে দর্শককে ঘোরের মধ্যে রাখে। এই ঘোরের মধ্যে রাখাটা কিন্তু নাটকের কাজ না। যে ঘোরের মধ্যে থাকে সে নাটকের সাথে কমিউনিকেট না-ও করতে পারে। আবার আরেকটা ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি...সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও আছে...থিয়েটারের-বেলাতেও এটা আছে, সেটা হলো, সবাই কেমন যেন তাদের কাজ নিয়ে বেশ তৃপ্ত। আপনারাও দেখছি নিজেরাই আপনাদের কাজটা নিয়ে বেশ তৃপ্ত। নিজেরাই বলছেন, অভিনয়ের গুণে সবাইকে প্রভাব বিস্তার করছেন। কেন? এত তৃপ্ত কেন? আপনারা যদি অতৃপ্ত না হন, তাহলে এই যে একজন বললেন যে, তার কাছে মনোটোনাস মনে হয়েছে, তাকে কীভাবে আপনার দলে আনবেন?

অসিত কুমার
ডমিনেট করাকে যদি পজেটিভ অর্থে দেখি, পজেটিভ বলতে, তীব্র ভালোবাসায় কাউকে হাত দিয়ে টেনে বুকে আনাটাও ডমিনেশন, সেটা কিন্তু পজেটিভ, এই পজেটিভ অর্থে দেখলে, এই নাটকের যে ডমিনেশনের কথা বলা হলো, সেটা সব নাটকে ঘটে না। এই নাটকের মতো করে না। রক্তকরবী-ও করে না।

বিপ্লব বালা
রক্তকরবী-ও করে না?

অসিত কুমার
না, এভাবে করে না।

বিপ্লব বালা
একেকটা একেকভাবে করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

অসিত কুমার
অনেক সফল নাটক সব কিছু বুঝিয়েই দর্শককে বিদায় দেয়। কিন্তু এভাবে পুরোটা না বুঝিয়ে কাব্যের আবহ তৈরি করে দর্শককে বিদায় করা, এটা সব নাটকে ঘটে না। এই নাটকের সংলাপ, অভিনয় দ্বারা যে প্রভাব বিস্তার করে, অন্য নাটকে এমনটা হয় না।

আহমাদ মোস্তাফা কামাল
এতটা তৃপ্ত হয়ে গেলে তো বিপদ!

দিলীপ চক্রবর্তী
না, আমাদেরকে এতটা তৃপ্ত ভাবলেও বিপদ! আমরা মোটেই তৃপ্ত নই। তৃপ্ত হলে প্রতিটি নতুন শো-তে আমরা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতাম না। আমরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যারা কমিউনিকেট করেছে তাদেরকে আরও কাছে টানতে এবং যারা কমিউনিকেট করে নি তাদের কাছে যেতে।

অসিত কুমার
অহরকণ্ডল-র টেক্সটের শক্তিই এখানে যে, আমাদেরকে পরিতৃপ্ত হতে দেয় না। আমরা দর্শকের কথা শুনছি এবং পরবর্তী শো-তেই সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। অনেক ভালো টেক্সটেই কিন্তু বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ থাকে না, কিন্তু এটাতে সেই সুযোগটা আছে। সেখানেই এর শক্তি।

আলফ্রেড খোকন
এখানে আজকের আলোচনাটা যদি সবাই আমার এবং আহমাদ মোস্তাফা কামালের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারতেন, তাহলে এই প্রোডাকশনটার জন্য আরও ভালো হতো। আমি প্রথমেই ডানাভাঙা বলাতে যেভাবে আপনারা হামলে পড়েছেন আমার উপর, তাহলে তো বললেই হতো যে...একটা বিশ্বসেরা নাটক হয়েছে ভাই, এটার বিপক্ষে কিছু বলা যাবে না।

মুজিব মেহদী
কিন্তু বন্ধু, তুমি যা বলবে তার সমালোচনা করা যাবে না, এটাই-বা হবে কেন?

অসিত কুমার
বরং আমি বলবো খোকনভাই যেটা দিয়ে শুরু করেছেন, সেটাই বড় সত্য। এখানে যারা এসেছি, বসেছি এক সাথে, সব ব্যাটারই তো ডানাভাঙা। ডানাভাঙা বলেই তো ডানার সন্ধান করছি। উড়তে পারছি আমরা কেউ?

অপূর্ব
আচ্ছা আমার একটা প্রশ্ন ছিল, সেটা হলো, যখন উপেন্দ্র চামার আসে, তখন বাহার উপেন্দ্র চামারের ভূমিকায় অভিনয় করে এবং বাহার অনুপস্থিত থাকে। এটা কি সচেতনভাবেই করেছেন? যে-কেউ উত্তর দিতে পারেন।

আনোয়ারুল হক
আমরা যখন মহড়ায় ছিলাম, তখন এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি যে, উপেন্দ্র চামার কে হবে? আকমল, দানিউল না বাহার? তখন আমাদের মনে হয়েছে যে, এটা বাহারই করবে।

অপূর্ব
না, আপনাদের ৩জনের একজনকে করতে হবে কেন? অন্য সময় যে চরিত্রগুলো এসেছে সেখানে কিন্তু ন্যারেশন দিয়ে এনেছেন কিন্তু চরিত্রগুলো আপনারাই ছিলেন। কেবল এই জায়গায় উপেন্দ্র চামারের চরিত্র হয়েই একজন করলেন। এটা কি সচেতনভাবে? হলে এর ব্যাখ্যা কী?

রতন দেব
এখানে আমার ব্যাখ্যা বা আমরা যেটা ভেবেছি সেটা হলো...উপেন্দ্র চামার ওখানে আছে কিন্তু সেটা হয়তো বাহারও আছে, কিন্তু সে কথা বলছে না। এই যে চামড়া খুলে ফেলার কথা বলা হচ্ছে, এটা একদিকে যেমন উপেন্দ্র চামার বলছে, অন্য দিকে হয়তো বাহারও বলছে। এমন একটা জায়গাতেই আসলে আমরা দৃশ্যটা রেখেছি। এই ৩জনের যে ক্রাইসিস তার সাথে চামারের ক্রাইসিসও কিন্তু আলাদা কিছু না। আমরা সেভাবে করার চেষ্টা করেছি। এটা কতটুকু হয়েছে জানি না, তবে সচেতনভাবেই করেছি।

বিপ্লব বালা
আমি অন্য একটা প্রসঙ্গে বলি। শুরুতে অসাধারণ একটা সুরে গানটা করলেন (রতন দেব), শেষে এসে এমন জীবনমুখী কলকাত্তাইয়া সুর আনলেন কেন? এমন একটা স্ক্রিপ্টের সাথে এসব জীবনমুখী আশার আলো দেখাতে কে বলেছে আপনাকে? এটা তো হয় নি কিছু। একেবারে টিপিক্যাল জীবনমুখী কলকাত্তাইয় সুর। এটাকে বাদ দেন।

রতন দেব
এভাবে নেগেট করে দিলে তো আর কথা থাকে না। কিন্তু সুরটা মোটেই জীবনমুখী না। নাটক করতে করতে অভিনয় করতে করতে যখন এই পর্যায়ে আসি, তখন মনে হয়েছে এই কথাগুলোকে এভাবে বললে কেমন হয়। মানে এটাকে গান বললে বা সুর বললেও ভুল হবে। সংলাপই বলছি, কিন্তু এই রিদমটাকে মনে হয়েছে চরিত্রের এই পর্যায়ে, নাটকের এই পর্যায়ে খাপ খায়। অনেকভাবেই করেছি, কোনোটাই টানছিল না, শেষে এটার সময় মনে হয়েছে এভাবে বলা যায়। কিন্তু জীবনমুখী হতে যাবে কেন, বুঝলাম না।

বিপ্লব বালা
হয়েছে। অন্তত শুরুর এমন এক অসাধারণ সুরের পর এটাকে বেশ...মানে কেমন যেন খটকা লাগে, এই টেক্সটটের সাথে সম্পর্কহীন মনে হয়।

রতন দেব
শুরুরটা তো আমি কীর্তনের সুর ব্যবহার করেছি, আর শেষেরটাকে আমি গান বলতেই নারাজ। এখানে ধরে নিন যে, সুরে গান গাচ্ছি তা না, একটা সংলাপ দিচ্ছি...সেখানে এই সুরটা এসে গেছে এবং আসায় মনে হয়েছে আবেগের সাথে যাচ্ছে। ধরে নিতে পারেন এই সুরে আমি সংলাপটা বলেছি, গান গেয়েছি তা না।

অপূর্ব
আমার কাছেও প্রথম দিকে খটকা লেগেছিল, কিন্তু পরে মনে হয়েছে, এটা প্রার্থনার সুর।

বিপ্লব বালা
কিসের প্রার্থনার সুর? নাটকটা যেভাবে গিয়ে এই পর্যায়ে আসে, তারপর এই সুর যায় কী করে? কবির এটা নিয়ে একটু ভাবো। হঠাৎ করেই নিয়ামুল ‘উদীচীর রতন’ হয়ে একটা জীবনমুখী গান শুরু করে। এটা কিছু হলো?

কামালউদ্দিন কবির
ভাববো যদি এটাকে আগে জীবনমুখী ভেবে থাকি। আমরা তো এটাকে জীবনমুখী মনে করছি না।

রতন দেব
আমি আবারও বলছি, অবশ্যই দাদার কথা বিবেচনা করেই বলছি, এটাকে গান হিসেবে দেখবেন না বা বিচ্ছিন্ন করে দেখবেন না। পুরো নাটকটা করতে করতে এ পর্যায়ে এসে সংলাপটা আমি এই সুরে উচ্চারণ করেছি। সংলাপের যে কলি, ‘তারা চরাচরের অনন্তে দেখে অক্ষমতার ক্ষুরের আওয়াজ’...তো এই সংলাপ কখনো জীবনমুখী হয়? আবার আমি এ-ও বলতে চাই পুরো নাটকটা যদি জীবনমুখী না হতো তাহলে এটার সাথে আমি থাকতামই না।

হাসান শাহরিয়ার
আচ্ছা আমরা আলোচনাটা গুটিয়ে নিই। আলফ্রেড খোকন বলবেন ১ মিনিট, তারপর অন্যকে দিচ্ছি।

বিপ্লব বালা
আবার আলফ্রেড খোকন? আপনার এত পক্ষপাত কেন?

আলফ্রেড খোকন
দাদা, আপনার চেয়ে অনেক কম বলেছি।

বিপ্লব বালা
একটু বলেছেন, কিন্তু একটুতেই তো ডানাভাঙা বলে সবাইকে...হাঃ হাঃ

হাসান শাহরিয়ার
খোকনভাই ১ মিনিট থেকে কিন্তু কাটা যাচ্ছে সময়।

আলফ্রেড খোকন
আমি আসলে বেশি কিছু আর বলছি না। আলোচনা শুরু করতে হয় আবার শেষও করতে হয়। এখানে আলোচনা হবে সমালোচনা হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকে একটা কথা এখানে বলতে চাই, সেটা ছাপতেও পারেন, না-ও ছাপতে পারেন...সেটা হলো নাটকের মানুষজন, থিয়েটারের মানুষজন, সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। মানে এমন একটা ভাবের মধ্যে থাকেন যে, একটা কাজ করেছেন আর সবাই আপনাকে ফুল-চন্দন দেবে। কেন? একটু ধৈর্য ধরে শুনুন, অন্যের ভালো না-ই লাগতে পারে। সব শেষে ‘থিয়েটারওয়ালা’কে ধন্যবাদ, ‘থিয়েটারওয়ালা’ যখন ডাকবে তখনই আসবো, কিন্তু এসে নিজের কথাটা বললো, আপনাদের মনমতো কথাটি বলতে পারবো না।

হাসান শাহরিয়ার
সবাইকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।