Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: ধাবমান
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: ধাবমান। রচনা: সেলিম আল দীন। মঞ্চ-রূপসজ্জা-আবহসংগীতপরিকল্পনা ও নির্দেশনা: শিমূল ইউসুফ। আলোকপরিকল্পনা: নাসিরুল হক খোকন। পোশাকপরিকল্পনা: শিমূল ইউসুফ ও নাসরিন নাহার। পোস্টার ডিজাইন: শিল্পী শাহাবুদ্দীনের চিত্রকর্ম অবলম্বনে পীযূষ দস্তিদার। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০০৯। একটি ‘ঢাকা থিয়েটার’ প্রযোজনা
[এখন আমরা হয়ে উঠেছি ওরা- আর কত বদল চাও তুমি বাজার?- শিরোনামে একটি সালতামামি ছাপা হয় ‘থিয়েটারওয়ালা’র ২৬তম সংখ্যায় (২০০৯ সালে প্রকাশিত)। সেখান থেকে ধাবমান নাটকের অংশটুকু এবারের বিশেষ-সংখ্যায় পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
‘আর কত ছোট হব প্রভু, আমি কি
আমারও সমান সদরে অন্দরে
বাহিরে?- শঙ্খ ঘোষ
সত্যিই তো বদল ঘটছে বিশ্বজোড়া, ‘বিশ্বজুড়ে ফাঁদ পেতেছো কেমনে দেই ফাঁকি?’ পৃথিবীটা বদলানোর সেই মার্কসীয় স্বপ্নকল্পন-ঘোষণা আজ উলটপুরাণে নাস্তানাবুদ, উদ্ভ্রান্তিতে দিশেহারা। শুরু হয়ে গেছে বাজারের সুশীল শপথনামা- ‘বদলে যাও বদলে ফেলো’। সবার আগে মোবাইল কোম্পানি হাঁক দিয়েছিল- ‘আমরা দিন বদলে বিশ্বাস করি’।
তারপর মার্কিনী ওবামা হয়ে বাংলাদেশে নির্বাচনী দিনবদলের অঙ্গীকার। এই কি সেই নেগেশান অব দ্য নেগেশান-এর একুশশতকীয় বদলেরও বদল ঘটার নব্যতত্ত্ব?
ছাপোষা মঞ্চনাট্যজন আর কী করে তাই! তাদেরও তো টিকে থাকতে হবে এই বাজারবিশ্বে। এমনিতেই উজাড় হয়ে গেছে মঞ্চ, দলে দলে নাম লেখাচ্ছে সবে মিডিয়ায় মিডিয়ায়। জীবিকার প্রশ্নও তো আছেই, নামযশ মালকড়ি ছাড়া চলবে কেন, তারাও তো রক্তমাংসের মানুষ, না-কি? যদিও সবাই আমরা একদিন বাস্তব এইসকল বৃত্তি-প্রবৃত্তি চেপে রেখে কত কত সব নীতি রাজনীতি শিল্পের, মঞ্চপ্রেমের উচ্চনিনাদ তুলেছি। তবু তাদের সফল-একাংশ মঞ্চেও হাজিরা দেয় নিয়মিত কী অনিয়মিত। দল চালাতেও তো কর্মীদের মিডিয়ায় একটু আধটু সুযোগ করে দিতে হয়। এ না করে আজ আর উপায় নাই বুঝি! কী আর করা তাহলে? ইহাও তো বাস্তবতা। তার বিপরীতে গিয়ে কিছু করা সম্ভব কি?- তাই ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’!- এসব নিয়ে কোনো সংকটবোধ আজ তাই নেইও, তা বড়ই অপ্রাসঙ্গিক বলেই হয় তো।
তবুও তো বন্ধ্যা নয় মঞ্চ আজও! নতুন নতুন নিরীক্ষাকর্মও চলছে। সেটা বড় কম কথা নয়, বরং অনেক বড় কথাই।
‘ঢাকা থিয়েটার’ সেলিম আল দীনের পুরাণপ্রতিম প্রতীককল্প আখ্যান ধাবমান রূপায়ণ করেছে। নির্দেশক আর নন স্বয়ং নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মঞ্চের আমূল-সংলগ্ন ধীমতি অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ রূপকার বহুস্তরসম্পন্ন এ রচনার। এটা নিশ্চয় তাঁর দীর্ঘপ্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতারই নান্দনিক-সম্প্রসারণ। দর্শক-সাধারণের তাই কোনো দ্বিধা হবার কথা নয় তার এই নবীন ভূমিকায়। অভিনয়ে যুক্ত হবেন কিনা সে নিয়ে হয়তো সংশয় ছিল কারো কারো। সঙ্গত প্রত্যাশাও পূরণ করেন তিনি, বিবেক হিসেবে অভিনয় করেন ধাবমান-এ।
নাটকের মুদ্রিত পুস্তিকায় তিনি জানান, ‘সেলিমভাই তোমার মৃত্যুশোককে পরাজিত করবো বলেই ধাবমান-এর নির্দেশনার কাজে হাত দিয়েছিলাম।’ অন্যত্র লেখেন এ নাট্যের রূপায়ণ-পদ্ধতি নিয়ে, ‘তাই এই বিস্তারিত ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির চারণভূমি থেকে তুলে নিলাম মাদারপীরের গীত, পদ্মার নাচন, মহররমের জারি, নটপালা, লাঠিখেলা, কাছনৃত্য। নাসির উদ্দিন ইউসুফও জানান, ‘দীর্ঘ তিনযুগ সেলিমের শিল্পদর্শনরীতি, প্রয়োগকৌশল আতœস্থ করে শিমূল নির্দেশনায় হাত দিয়েছেন। শিমূল কৃত্যনাট্য (রিচ্যুয়াল থিয়েটার)-এর আঙ্গিকে ধাবমান মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন। এ রীতিতে যেমন ব্যবহার করেছেন আদিবাসী গারোদের কৃত্য, তেমনি ব্যবহার করেছেন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নাট্য-আঙ্গিকে মাদার পীরের গীত, মহররমের জারি, পদ্মার নাচন, কাছনৃত্য, লাঠি খেলা, নটপালা। এমনকি যাত্রার বিবেকের সাক্ষাৎ পেয়ে যাই আমরা। ‘ঢাকা থিয়েটার’, ‘গ্রাম থিয়েটার’ এবং সেলিম আল দীনের যে দীর্ঘযাত্রা জাতীয় নাট্য-আঙ্গিকের আলোকে, চেতনায় বাংলার নিজস্ব আধুনিক নাট্যক্রিয়া, আঙ্গিক, তার একটা প্রায় পরিপূর্ণ রূপ হয়ত পেয়ে যাবো আমরা ধাবমান-এ।...দীর্ঘসময় ধরে আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজ একটি রূপ পেতে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা এবং তা যদি সত্যি সত্যি ঘটে যায়, তা হলে আমরা বলতে পারবো ঔপনিবেশিক শিল্পরীতি সম্পূর্ণ ত্যাজ্য করে বাঙলা নাটক দাঁড়িয়েছে তার পায়ে। এখন সম্মুখে চলার সময়।’
অথচ নাটকটি কিন্তু ঔপনিবেশিক শিল্পরীতির প্রসেনিয়াম মঞ্চেই হলো- তার কোনো সম্প্রসারণ ব্যতিরেকেই। পূর্ববর্তী নিরীক্ষাপর্বে কিন্তু নানা ভিন্ন মঞ্চ গড়ে নিয়েছিলেন তারা। সেসব মঞ্চ-ব্যবস্থাপনা কি অভিনেতৃ-দর্শকের অন্যতর কোনো সম্পর্ক-স্থাপনে করা হয় নি? মঞ্চস্থল দেশীয়-আঙ্গিকের মৌল একটি ভিত্তিভূমি নয় কি? নাকি নিত্য নতুন নিরীক্ষার উপাদান মাত্র- ‘আধুনিক’ ইউরোপীয় থিয়েটারে যেমন করা হয়? দর্শকের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো নন্দন নিহিত নেই কি পারস্পরিক পরিসর-স্থাপনা বা বিভাজনে? বিনোদিনী থেকেই দেখছি তাদের এই প্রসেনিয়ামে ফেরা। বাঙলারীতিতে অন্তর্ভুক্ত হলো কি এই ঔপনিবেশিক শিল্পরীতির প্রবর্তনা? কী তার নন্দনযুক্তি, আখ্যান-বর্ণনের কোনো নব্যন্যায় কি এর পিছনে আছে? কৃত্যনাট্য বা রিচ্যুয়াল থিয়েটার কথাটার মানেই বা কী? এরকম কোনো আঙ্গিকরীতি আদিবাসী বা বাঙলা নাট্যধারায় ছিল বা আছে কি? এই মিশ্র-সমন্বয়ের নবসৃষ্ট নাম-পরিচয় তাহলে কৃত্যনাট্য? কেবলি আঙ্গিক ব্যবহার নাগরিক থিয়েটারে? কৃত্য কেবল বুঝি আঙ্গিক? তা বিশিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর বিষয়-দর্শনজাত অঙ্গাঙ্গী কোনো ভাবরূপায়ণ নয়? নবনিরীক্ষা ভিন্ন আর কোনো শিল্পনন্দন দর্শনের ন্যায় নিশ্চয় তার আছে। তাতে নাগরিক-দর্শকের সঙ্গে সম্বন্ধপাতের বিবেচনাও তো থাকার কথা। স্বদেশীয় জনসমাজ আর তার ভাবমানসলোকের সঙ্গে বিদেশির ন্যায় সম্পর্কহীন অপরিচিত নাগরিকজনের মনে কী অভিঘাত হয় তাহলে এই মিশ্র থিয়েটারি রূপায়ণে? সর্বপ্রাণবাদিতার সঞ্চার ঘটাতে কি অবলম্বিত এহেন আঙ্গিক-রীতি? নাগরিকজনের যৌথমানস স্মৃতিভা-ারে এর কোনো সংলগ্নতা আছে তো?- এই নবভাব-ভাষায় দর্শকের সঙ্গে নান্দনিক সংযোগসূত্রের সন্ধানই তো অন্বিষ্ট। তাহলে বলা যায় কি ঔপনিবেশিক শিল্পরীতি সম্পূর্ণ ত্যাজ্য করে বাঙলা নাটক দাঁড়িয়েছে তার পায়ে?
ধাবমান প্রযোজনা নানা মিশ্র-আঙ্গিক আত্মস্থ করে অভিনব এক নাট্য হয়ে উঠেছে, সংগীত-নৃত্য-বাদ্য-বর্ণনা-অভিনয়ের অদ্বৈতে। ‘তিন দশকেরও অধিক সময় শিল্পের যে জমিনে শিমূলের বিচরণ সে পরিভ্রমণে রয়েছে ধ্রুপদ ও ঐতিহ্যবাহী নাট্য ও সংগীতরীতির অভিজ্ঞতা’- নির্দেশক বিষয়ে নাসির উদ্দিন ইউসুফের এই অভিমত সঙ্গত মনে হয়। নৃত্য-সংগীতময় গতিছন্দে, ব্যালেপ্রতিম স্বাচ্ছন্দ্যে এই নাট্য রূপায়িত। এ আখ্যানের ভাষাও তার অলংকারভার ছেড়ে নির্ভার শ্রুতিসম্মত হয়েছে। যেন তা নতুন এক নাট্যভাষা সকল কাব্যভাবদর্শন ধারণ করেও। বর্ণনা-সংলাপ-কথার এই ভাষার প্রতীক্ষাই তো করেছিলাম। অবশেষে তার সাক্ষাৎ মিলল। কথক-অভিনেতৃবর্গ অনায়াস স্বাচ্ছন্দে কথ্য বাকস্পন্দে তা বলে গেছেন। আখ্যানের জটিলতার সঙ্গে দর্শকের তাল মেলাতেও আরাম লেগেছে। শারীরমুদ্রাদিও ছন্দোময় হয়ে অঙ্গাঙ্গী নৃত্যলাবণ্যে পাখা মেলেছে।
বিরাট এক বাস্তবোত্তর পুরাণপ্রতীক এ আখ্যানের। তার কেন্দ্রে তো নগদি-গারোদের ‘হাজার বছরের সংঘাত-যুদ্ধ-ধর্মান্তর প্রক্রিয়ার বাস্তব। তাই তো পাহাড়ি গয়াল কর্তৃক হামেলার ‘গর্ভধারণ’ নিয়ে যে নাট্য-বীজ তার প্রতীককল্প মাহাত্ম্য। অথচ এই পটভূমি সেই মর্যাদায় গৃহীত হয় না প্রযোজনায়। আখ্যানের নানা ঘটনার ভিড়ে একটি মাত্র প্রায় নগণ্য হয়ে পড়ে। তাই কেবলি জাতি-ধর্ম-বর্ণ সমন্বয়ের সর্বপ্রাণবাদী ইচ্ছাপূরণের কল্পকথায় ভেসে যায় প্রযোজিত আখ্যান। সেলিম আল দীনের রচনায় ক্রমে যে রাজনীতিহীনতার অভিযোগ ওঠে সেটাই গ্রহণযোগ্য, ন্যায্য হয়ে যায় যেন। ‘ঢাকা থিয়েটার’ আর নির্দেশক শিমূল ইউসুফ ভাববেন কি এই বিপদটি নিয়ে? নইলে যে এহেন মহাকাব্যিক সমগ্রতা-সম্পন্ন নান্দনিক-আখ্যান খ-িত হয়ে তার মাহাত্ম্য হারায়।
তবে অভিনেতৃবর্গ একটি যূথ ভাব-অভিনয়-নৃত্য-সংগীত ছন্দে অদ্বৈত কুশীলব হয়ে উঠেছে এ নাট্যে। এষা যে প্রধান চরিত্রে নবাগতা কখনোই তা মনে হয় না। সোহরাবের মতো এক বয়ার বা ষ-মহিষের মানব-মানবোত্তর রূপায়ণ সহজ কথা নয়। হামেলা চরিত্রটি তো আদি এক যুগপৎ মানব-প্রাণী হয়ে উঠেছে। তাতে নারীর অন্তঃস্থ ঋজু দার্ঢ্য পৌরাণিক শক্তিমত্তা লাভ করেছে। জয়শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চ-অভিজ্ঞতা আছে জানি, কিন্তু সে তো প্রথাগত প্রচলিত চরিত্রাভিনয়ের। ধাবমান নাট্যের অভিনয়ে তার পুরাণপ্রতিম হয়ে ওঠা বাংলাদেশের মঞ্চে এক ঘটনাই বটে।
সব মিলে শিমূল ইউসুফের নন্দনসিদ্ধি বিস্ময়-সম্ভ্রম জাগায়। এই অকালে ‘ঢাকা থিয়েটার’ তার অর্জিত মহিমায় নব-উদ্ভাসনে ভাস্বর।
ড. বিপ্লব বালা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, সমালোচক