Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: কহে বীরাঙ্গনা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: কহে বীরাঙ্গনা। রচনা: মধুসূদন দত্ত। নির্দেশনা: শুভাশিস সিনহা। মঞ্চপরিকল্পনা: আলী আহমেদ মুকুল। আবহসংগীতপরিকল্পনা: শর্মিলা সিনহা। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০১০। একটি ‘মণিপুরি থিয়েটার’ প্রযোজনা
[মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিরাঙ্গনা কাব্যে-র নির্বাচিত চারটি সর্গ নিয়ে শুভাশিস সিনহা নির্দেশিত ‘মণিপুরি থিয়েটার’ প্রযোজনা কহে বীরাঙ্গনা নাটকের এই নাট্যসমালোচনাটি পুরাণ ভাঙার পালা- শিরোনামে আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় ছাপা হয় পৌষ ১৪২৫ সংখ্যায়। ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
পৌরাণিক আখ্যানকে সামনে রেখে একটি বাংলা মঞ্চনাটক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ‘মণিপুরি থিয়েটারে’র কহে বীরাঙ্গনা। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ৭৫ অভিনয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেছে এটি। আট বছরের মধ্যে এত অভিনয় এমন কিছু অভিনব ব্যাপার নয়। এ প্রযোজনার অভিনবত্ব লুকিয়ে তার সাংস্কৃতিক-পরিচয়ে। দলটি ঢাকার নয়। সিলেটের মৌলবীবাজার এলাকার কমলগঞ্জ মহল্লায় যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের বাস, তাদের শাঁসেজলে পুষ্ট। এমন একটি দল আপন বেগে চলে এমন একটি আধুনিক নাট্যভাষ রচনা করেছে যে ঢাকা সমেত সারা বাংলাদেশ তো বটেই, কলকাতাও আলোড়িত হয়েছে।
বীরাঙ্গনা শব্দের অন্য একটি ব্যঞ্জনা গত সাড়ে চার দশকে তৈরি হলেও, এ নাটকে সাবেক ব্যঞ্জনাটিই মুখ্যত ক্রিয়াশীল। ভারতীয় পুরাণের আধুনিক ভাষ্যকে আধার করে তৈরি কহে বীরাঙ্গনা-র উৎসে আছে মহাভারত। বাংলাদেশে এ ধরনের পৌরাণিক আখ্যাননির্ভর অনেক ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা আছে যা ধর্মীয় কৃত্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ‘মনিপুরি থিয়েটারে’র নাটকে ঐ কৃত্য নাক গলাচ্ছে না বললেই চলে। তা সম্প্রদায়নিরপেক্ষভাবে পৌরাণিক-সমাজে নারীর অবস্থানের আনাচে-কানাচে সন্ধানী আলো ফেলেছে। পশ্চিমিগতের রেনেসাঁ ও এনলাইটমেন্টের সারস্বত ধাঁচকে আকর করে বেড়ে ওঠা যে প্রবণতাকে সেলিম আল দীন বলতেন পুরাণ ভাঙার শিল্প, মোটের-ওপর সেই ধরতাই নিয়েই আধুনিককালের সঙ্গে সেতুবন্ধন করছে এই নাটকটি।
এবং এ কথা বলতে তৃপ্তি হচ্ছে যে, একক অভিনয়ের এক উচ্চাশী-মাত্রায় আমাদের পৌঁছে দিতে পারছে কহে বীরাঙ্গনা। আধুনিক নাট্যশালার উপযোগী, আধুনিক শিল্পউপভোক্তার আকাঙ্ক্ষিত এমন নির্মাণ কীভাবে এমন সার্থকতা পেল, তার গভীরে গেলে এমন অনেক সূত্র পাওয়া যাবে যা আমাদের নাট্যচর্চার ভাবীকালের ইঙ্গিত বয়ে আনছে।
‘মণিপুরি থিয়েটারে’র এই এক ঘণ্টার নাটক আসলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য-র খণ্ডিত নাট্যরূপ। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে বেরোনো এই পত্রকাব্যে সাকুল্যে এগারোটি পত্র ওরফে সর্গ ছিল। রোমান কবি ওভিদের রচনার অনুসরণে লেখা এসব পত্র কোনো না কোনো পৌরাণিক নারীর বকলমা নিয়ে লিখেছিলেন মধুসূদন। এই পত্রকাব্য আদতে স্বগতোক্তিসম্পুট। মধুসূদনের কাছাকাছি সময়ে বিলেতে বসে ড্রামাটিক মনোলগস লিখে রবার্ট ব্রাউনিঙের খুব নামযশ হয়েছিল। ব্রাউনিঙ নারীপুরুষ ভেদ করেন নি। লিখেছিলেন পাঁচমিশিলি ডঙে, রকমারি খেই ধরে। মধুসূদনের পদ্যকাব্যে এক ধরনের মাপা ধ্রুপদিয়ানা আছে। তা বলে পুরাণের বাঁধা গতে পা ফেলার বান্দা তো তিনি ছিলেন না। মেঘনাদবধ কাব্য-র মতো অত বৈপ্লবিক ভাষ্য না হলেও বীরাঙ্গনা কাব্য হয়ে উঠেছিল অভিজাত নারীর অনভিজাত আকাক্সক্ষার কথামালা।
কহে বীরাঙ্গনা-এর খণ্ডিত নাট্যরূপ, কারণ এগারোটির মধ্য থেকে চারটি সর্গ বেছে নিয়ে নাট্যরূপ দিয়েছেন নির্দেশক শুভাশিস সিনহা। দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা ও নীলধ্বজের প্রতি জনা। শকুন্তলার কথা নতুন করে বলার নয়। মধুসূদনের শকুন্তলা একদিকে বেদব্যাস, অন্যদিকে কালিদাসের শকুন্তলার হাত ধরে পথ কেটেছেন। যুক্তিতর্ক নয়, দ্রৌপদী-পর্বে জোর পড়েছে প্রেম আর প্রতীক্ষার ওপর। যে অর্জুন উচ্চতর অস্ত্রশিক্ষার্থে স্বর্গে গেছেন তাঁকে চোখে হারাচ্ছেন তাঁর নবপরিণীতা। জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা-পর্বে আর প্রেমিকা নয়, পত্নীও নয়, ভরকেন্দ্রে চলে এসেছেন এক মা। অসমযুদ্ধে নিজের ছেলে অভিমন্যুর মৃত্যুর পর মুখ্য ঘাতক জয়দ্রথকে হত্যার সংকল্প করেছেন অর্জুন। কেঁপে উঠেছে জয়দ্রথজায়া দুঃশলার প্রাণ। স্বামী-সন্তান নিয়ে হস্তিনাপুর ছেড়ে যাবার চিন্তায় মেতে আছেন তিনি। কহে বীরাঙ্গনা-র চতুর্থ তথা অন্তিম আখ্যানের কেন্দ্রে আছেন জনা। কে এই জনা? বাঙালির তেমন করে জানা নেই। মহাভারত-এর মাপ ধরলেও বেশ খাপছাড়া চরিত্র। ওদিকে অথচ তাঁর কথা দিয়েই কহে বীরাঙ্গনা-র যবনিকাপাত ঘটাতে চেয়ে বড়সড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন শুভাশিস। মধুসূদনের মূলরচনাকে তিনি একটুও বদলান নি। কাটছাঁট করেন নি। প্রামাণ্য জেনেছেন। অথচ মধুসূদনের এই পত্রকাব্য আদপে নাটকীয়তায় ঠাসা নয়। একবার শুনেই মর্মস্থলে পৌঁছনো এমন সুলভ নয়। তা বিলীয়মান এক সমন্বয়ী-সংস্কৃতির সিক্তবালুরাশি।
এখন ওস্তাদের মার শেষ রাতে না দিতে পারলে উলটপুরাণ হতে পারত। এর প্রধান কারণ শকুন্তলা বা দৌপদীর কথা কমবেশি সকলের জানা। দুঃশলার হাহারবের খেই ধরা এমন কিছু শক্ত না। মধুসূদনের জাঁদরেল বাংলা, অমিত্রাক্ষরের গেরামভারী চাল, চরিত্রায়ণের আঁকাচোরা কায়দা, এসবকে ডিঙিয়ে একবার শুনে নাট্যবস্তুর মর্মে ঢুকে পড়া এমনিতেই দুরূহ ব্যাপার। কী ব্যাপার জানা থাকলে ধরতে সুবিধে হয়। নইলে শোনায় মন দেব, না দেখায়, ভাবতে ভাবতে পালা ফুরিয়ে যায়। জনার কথা মহাভারত-এ পাদটীকা মাত্র। রোজকার জীবনের সঙ্গে তাঁর অত মিলজুল নেই। কাজেই মুশকিল ছিল। যিনি তা আসান করতে পারতেন সেই ব্যাসদেব তাঁর আখ্যানে জনা নিয়ে কোনো জিগির তোলেন নি। তুলেছেন ব্যাসশিষ্য জৈমিনী। এবং তাঁর খেই ধরে জনাকে আমাদের ঘরে এনে তুলেছেন কাশীরাম দাস। তাঁকে বাংলার মাটি দিয়ে, মায়া দিয়ে নতুন করে গড়েছেন। মাতৃত্বের এক আলাদা চেহারা তৈরি করেছেন। মধুসূদন এই কাশীদাসী আখ্যানকেই মাথায় রেখেছিলেন। তাঁর অশ্বমেধপর্ব থেকেই যে এর আদল পেয়েছেন মধুসূদন, একাদশ-সর্গের প্রাককথনে এ কথা ফলাও করেই জানিয়েছিলেন।
মহেশ্বরী পুরীর যুবরাজ প্রবীর অশ্বমেধ-যজ্ঞাশ্ব ধরিলে,- পার্থ তাহাকে রণে নিহত করেন। রাজা নীলধ্বজ রায় পার্থের সহিত বিবাদপরান্মুখ হইয়া সন্ধি করাতে, রাজ্ঞী জনা পুত্রশোকে কাতর হইয়া এই নিম্নলিখিত পত্রিকাখানি রাজসমীপে প্রেরণ করেন। পাঠকবর্গ মহাভারতীয় অশ্বমেধপর্ব পাঠ করিলে ইহার সবিশেষ বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারিবেন।
দেড়শো বছর আগেকার বাঙালি পাঠকবর্গের হাতে মধুসূদন যা তুলে দিতে চেয়েছিলেন, তার কদর আজকের সমঝদার বাঙালি পাঠক একইভাবে করবেন এমনটি ভাবার কোনো কারণ দেখি না। তার ভিন্নতা, তার রসগ্রাহিতার ভিন্ন ভিন্ন পরিসর তৈরি করবে। কমলগঞ্জে সিলেট বা ঢাকার নাট্যমঞ্চে তার কদরদারির ধরন ভিন্ন হবে না। তবু শুভাশিস ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আন্দাজ করি, একটি মহাভারতীয় সূত্র রচনার পাশাপাশি, শকুন্তলা-দৌপদী-দুঃশলার জীবননাট্যের ধারাবাহিকতা রচনার পাশাপাশি, একটি তুঙ্গ নাট্যমুহূর্তের সন্ধানী ছিলেন তিনি। কারণ, হলোই-বা রানি, জনা আদতে ছেলে-হারানো এক মা। তাঁর মধ্যে কি হাজার-চুরাশির মায়ের ছবি দেখেছিলেন শুভাশিস? দেখতে পারেন। প্রবীর নামে যে দামাল ছেলে পা-বদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে তুড়ি মেরে বুক ফুলিয়ে অশ্বমেধের ঘোড়ার লাগাম হাতে তুলে নিয়েছিল, সেই প্রতিস্পর্ধীর মধ্যে কি মুক্তিযোদ্ধার আদল পেয়েছিলেন শুভাশিস? পেতেই পারেন। যে অর্জুনের ছোঁড়া তিরে তাঁর ছেলে মারা গেছে সেই অর্জুনের মধ্যে কি পাক হানাদারের আদল পেয়েছিলেন শুভাশিস? পেতে পারেন। যে নীলধ্বজ বুকে পাথর চাপা দিয়ে নিজের ছেলের খুনিকে অভ্যর্থনা করেছিলেন তাঁর মধ্যে কি গদি আঁকড়ে থাকা ক্ষমতাসীন ব্যক্তির আদল পেয়েছিলেন সিনহা? পাবার কথা। পেয়ে থাকলে আরও অনেকের মধ্যে সেই বোধ ছড়িয়ে দেবার তাগিদ তিনি অনুভব করবেন। ২০১০ বা ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের বাংলাদেশ ইতিহাসের যে বাঁকে এসে পৌঁছেছে, যেখানে শহিদ হয়ে উঠেছেন বরণীয়, শহিদের মা হয়ে উঠেছেন মাননীয়, লক্ষ লক্ষ বীরাঙ্গনা হয়ে উঠেছেন দেশপ্রেমিকোত্তম, সেখানে জনার মতো এক প্রতিবাদী চরিত্র তো জনগণমনে ঈপ্সিত প্রতিক্রিয়ারই জন্ম দেবে। গঙ্গার জলে ডুবে তাঁর আত্মহত্যার মধ্যে যে করুণরসের সূচক আছে, তা ছেলেহারানো মায়ের অসহায় হাহাকারে পর্যবসিত না হয়ে, সন্তানের মর্যাদার ওপর পুরুষতান্ত্রিক খবরদারির মুখে সপাট চপেটাঘাতের চেহারা নেবে। গ্রিক পুরাণের মেদেয়ার এক পাল্টা ছবি জনার মধ্যে আছে। সেটি মধুসূদনের নজর এড়ানোর কথা নয়। ইউরিপিডিসে সড়গড় শুভাশিসও তার নাগাল পেয়ে থাকবেন।
যাও চলি, মহাবল, যাও কুরুপুরে
নব মিত্র পার্থ সহ! মহাযাত্রা করি
চলিল অভাগা জনা পুত্রের উদ্দেশে!
ক্ষত্র-কুলবালা আমি; ক্ষত্র-কুল বধূ
কেমনে এ অপমান সব ধৈর্য ধরি?
ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে;
দেখিব বিস্মৃতি যদি কৃতান্তনগরে
লভি অন্তে! যাচি চির বিদায় ও পদে!
ফিরি যবে রাজপুরে প্রবেশিবে আসি,
নরেশ্বর, কোথা জনা? বলি ডাক যদি,
উত্তরিবে প্রতিধ্বনি কোথা জনা? বলি।
এই বলে জনার কথা ফুরিয়েছিল। জুড়িয়েছিল- ইতি শ্রীবীরাঙ্গনা কাব্যে জনাপত্রিকার নাম একাদশ পর্ব এই ভণিতা। নাটকীয়তার এই শীর্ষবিন্দুতে উঠে শুভাশিস মঞ্চ ঢেকে দিলেন সাদা কাপড়ে। তার নিচে কুশীলবদের কেরামতিতে ফুলে-ফেঁপে উঠল জাহ্নবীর জল। যেন জোয়ার এল গাঙদরিয়ায়। কাপড়ের ওপর এসে পড়ল হালকা নীল আলো। নেচে নেচে উঠল ঢেউয়ের মাথা। আবছায়ার এই অবকাশে মঞ্চ থেকে উধাও হয়ে যাওয়া জ্যোতি চকিতে মুখ গলিয়ে দিলেন ঐ আদিগন্ত প্রসারিত কাপড়ের মাঝে যেখানে গোল করে কাটা, তার মধ্য দিয়ে। জ্যোতির সেই অভিব্যক্তিতে শোক আছে। অভিমান আছে। ক্ষোভ আছে। আবার অপার নির্লিপ্তি আছে। আছে উদাসীনতা। ঐ উথালপাথাল ঢেউয়ের মধ্যে ক্রমে মিলিয়ে গেলেন তিনি। এটিই নাটকের তুরুপের তাস। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের নিজস্বতাময় আবহসংগীত আর পশ্চিমি-নাট্যপ্রকরণের এই চারুপ্রয়োগ আমাদের মনে হচ্ছিল, বুঝি জলে ডুবেছি আমারাও।
বাচিক অভিনয়ের উৎকর্ষের পাশাপাশি দৃশ্যরচনার যে বৈভব এ নাটককে সম্পদশালী করেছে তার নির্মাণে আরও মালমশলা আছে। এমনিতে হালকা মঞ্চ। ছাদ থেকে ইতিউতি মোটা গাছির দড়ি ঝুলছে। চাইলে ছুঁতে পারা যাবে। ডিপ সেন্টারস্টেজে একটি নিচু ধাপি। দরকারে তলবিন্যাসকে উনিশ-বিশ করে নেওয়া যায়। ডাউন রাইটে মেটেরঙের এক ছোটখাট কাঠামো। তার ওপর আরাম করে আলগোছে বসে কনুইতে ভর করে গালে হাত দিয়ে আনমনা হওয়া যায়। আবার ময়ূরের পালক দোয়াতে ডুবিয়ে পদ্য রচনা করা যায়। ‘মণিপুরি থিয়েটারে’র অন্যান্য প্রযোজনার মতো এ নাটকের জুড়ির দল জনসমক্ষে নেই। তাদের উপস্থিতি নেপথ্যে। জ্যোতি সিনহা আছেন মঞ্চজুড়ে। তাঁকে সঙ্গত দিচ্ছেন আরও পাঁচজন। কখনও তাঁরা শকুন্তলার সখী অনসূয়া-প্রিয়ম্বদা সাজছেন। সম্মেলক মণিপুরি অঙ্গবিন্যাসে অরণ্যবালা হচ্ছেন। কখনও জ্যোতির কথকতার সমান্তরালে একটি নাট্যনির্মাণ করছেন। শকুন্তলা-দুষ্মন্তের গান্ধর্ব-বিবাহের বাসরসজ্জা রচনা হচ্ছে ডিপ সেন্টারস্টেজের ঐ বেদীমূলে। মূকাভিনয়ে। দুই কুশীলব গাঁদাফুলের মালা পরছেন। একজন টেনে দিচ্ছেন ঘোমটা। ফুলসজ্জা রচনা হচ্ছে অন্য একটি লাইট জোনে। স্নিগ্ধপ্রেমের মাধুরী দিয়ে। ঐ মালা, ঐ ঘোমটা, ঐ ফুলসজ্জা কতখানি মহাভারতসম্মত এ প্রশ্ন তখন গৌণ হয়ে যাচ্ছে। শুভাশিস পরম নিশ্চয়তার সঙ্গে নিজের ঘরের উঠোনে এনে ফেলেছেন শকুন্তলাকে। পরাচ্ছেন বঙ্গীয়-মণিপুরি সাংস্কৃতিক-অভিজ্ঞান। এর ফলে সমান্তরাল একটি চিত্রমালা তো তৈরি হচ্ছেই, মধুপদাবলি একবার শুনে যে অতৃপ্তি থাকে, আকাক্সক্ষা থাকে তারও নিবৃত্তি হচ্ছে। অনেকাংশে। আমাদের কল্পনার ওপর আস্থা নেই বলেই কি শকুন্তলার স্মৃতিচারণের সম্পূরক এ সব দ্যোতক দৃশ্যনির্মাণ? এ আমাদের মনে হয় না। মনে হয়, ভিন্ন ভিন্ন রসনিষ্পত্তির সংকেত দেওয়াই আধুনিক নাট্যনির্দেশকের মুখ্য কর্তব্য। এসব অণুনাট্যায়ন তারই সহায়ক।
আঙ্গিক ও আহার্য অভিনয়ের আধারও বটে। যখন প্রয়োজন হচ্ছে তখন আবরণ-আভরণের তরবেতর ঘটিয়ে দিচ্ছেন শুভাশিস। দুঃশলা-পর্বে ঝুলন্ত রজ্জুর কোলেপিঠে কয়েকটি স্বচ্ছ রেশমি কাপড় রেখে রাজঅন্তঃপুরের আবহাওয়া এনে দিয়েছেন। এ পর্বের শেষে জয়দ্রথকে রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে রাজদ্বারে চলে আসার আবেদন করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, অবিলম্বে যাব/এ পাপ নগর ত্যাজি সিন্ধুরাজালয়ে!/কপোতমিথুনসম যাব উড়ি নীড়ে!- এর উপযোগী একটি চলচ্চিত্র রচনা করেছেন শুভাশিস। জ্যোতিকে সামনে রেখে লম্বা এক ফালি সাদা কাপড় দিয়ে উড়ে চলেছে লাল পাড় কালো শাড়ি পরা চার-পাঁচজন। পর্ব থেকে পর্বান্তরের খানিক বিরাম এ নাটকের নড়বড়ে জায়গা দৃষ্টিবিভ্রমে ভাবাতুর প্রসেনিয়াম থিয়েটারের এ এক চোরাবালি। তার উপভোক্তাও ঐ শর্তে অভ্যস্ত। ঐতিহ্যবাহিত পরম্পরা আর আধুনিক মঞ্চভাষের সাঁকো গড়তে আসা শুভাশিস জানেন ঐ বিরামকালে ভরিয়ে রাখতে হবে কল্পনার মুগ্ধতায়, সাংগীতিক মূর্চ্ছনায়, ঘনায়মান অন্ধকারে। নইলে জ্যোতির পরিচ্ছদের অদলবদল ঘটবে না। অনিবার্য হয়ে উঠবে দৃশ্যগত ক্লান্তি। এক ঘণ্টার এ মহানাটকের মহানায়িকা জ্যোতিও দম ফেলবার ফুসরত পাবেন না। তাই বুঝি একেকটি পর্বের সমাপ্তিবিন্দুকে এমন প্রলম্বিত করেন নির্দেশক। দর্শকের অস্তিত্বকে টেনে রাখেন পরের পর্বের নিরুত্তাপ সূচনাবিন্দু পর্যন্ত।
নাটকীয়তার এই তুঙ্গস্পর্শী নির্মাণে শুভাশিসের সহায় শর্মিলা সিনহার আবহপরিকল্পনা। বিধান সিনহার বাজনা। এমনিতে ওপেন কার্টেন প্রডাকশন। যবনিকার বালাই নেই। অভিনয় শুরুর আগেই হারমোনিয়াম-বাঁশি-খোল-করতালের ঐকতানে যে মন, যে মেজাজ তৈরি করে দেন শর্মিলা তা আমাদের নাটকের ভেতরে ঢুকতে খুব সাহায্য করে। খোলের বোল মাতন তোলে রক্তস্রোতে।
তবে এ নাটকের প্রাণভোমরা জ্যোতি সিনহা। ৭৫তম মঞ্চায়নে এসে নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেছেন, বাচিক অভিনয়ের সাথে সংগীত, নৃত্য ও দেহের ভাষাকে একাত্ম করে মধুসূদনের দুরূহ কাব্যকে জ্যোতি যেরকম অনায়াসে সহজ-সুন্দর করে উপস্থাপন করেছে, তা বিস্ময়কর! মামুনুর রশীদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলি, জ্যোতি যা পেরেছেন তার তুলনা একমাত্র গৌতম হালদার। প্রথমে ‘নান্দিকার’, পরে ‘নয়ে নাটুয়া’ থেকে মেঘনাদবধ কাব্য-র যে ঐতিহাসিক মঞ্চায়ন করেছিলেন তা শুভাশিসকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে থাকবে। মধুসূদনের আধুনিক মঞ্চায়নে সেটি মাইলফলক বইকি! কিন্তু জ্যোতির বিশিষ্টতা তাঁর মগ্নতায়। সূত্রধারের কথাটি সেরে নিয়েই জ্যোতি যেই চরিত্রে ঢুকে পড়ছেন ইতি টানার আগে আর বেরোচ্ছেন না। এবং এমনই সম্মোহনী শক্তি সেই অভিনয়ে যে, আমরাও বশ হয়ে থাকছি। যেমন চালাচ্ছেন তেমন চলছি। মধুসূদনের কাব্যের অন্তর্গত ছন্দকে খুঁজে পাওয়া এমন কিছু কঠিন নয়। কঠিন হলো তাঁর কানায় কানায় গুঁজে দেওয়া ছায়াছবিকে ফুটিয়ে তোলা। কোনো রকম পুনরুক্তির ধার না ধেরে একবার বলেই সেসব চরণের প্রতি সুবিচার করা। নিহিত কাব্যগুণ ও চিত্রভাষাকে জলজ্যান্ত করা। শুভাশিস ও সহশিল্পীদের সহযোগিতায় সেটি যেন অনায়াসেই পেরেছেন জ্যোতি। বীরাঙ্গনা কাব্য-র শকুন্তলার মধ্যে যে নিঃশর্ত সমর্পণ আছে, বিহ্বল বিরহ আছে, সেটি তাঁর করতলগত অম্বলক। দ্রৌপদী তাঁর স্বামীকে সখা ভেবে জানেন। তাঁর মধ্যে অভিমানী স্ত্রী আর ঈর্ষান্বিত প্রেমিকার দোরোখা ছবির মধ্যে যে টানাপোড়েন, তাকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন জ্যোতি। দুঃশলার মর্যাদাবোধ উঠে এসেছে জ্যোতির তেজস্বী কটাক্ষে। যখন চক্রব্যূহে অভিমন্যুর হত্যাদৃশ্য স্মরণ করতে করতে নিজের সন্তানের অনুরূপ ভবিতব্যের দিকে চেয়ে শিউরে উঠছেন দুঃশলা, লেখা থামিয়ে অনবধানে উঠে দাঁড়াচ্ছেন, তখন সেই চরিত্রের দ্বিধাবিভক্তি উঠে আসছে জ্যোতির আকুল চাউনিতে। পুত্রশোকাতুর জনার মধ্যে যে দার্ঢ্য ঢেলে দিয়েছিলেন মধুসূদন তার অকাতর চরিত্রায়ণের কথা তো আগেই বলা হয়েছে।
‘মণিপুরি থিয়েটারে’ এ নাটকের আদত পারফরমেন্স কমলগঞ্জে তাদের নিজস্ব নাট্যশালায়, যার পোশাকি নাম ‘নটমণ্ডপ’। অনুমান করি নটমণ্ডপের ঘরের লোকের সামনে এ নাটকের অভিনয়ে তাদের পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে। ঢাকায় বিভিন্ন ছোট-বড়-মাঝারি মিলনায়তনে হরেক রকম দর্শকের সামনে কহে বীরাঙ্গনা মঞ্চস্থ করতে গেলে এক ধরনের ঠোকাঠুকি লাগে। সেই ঠোকাঠুকির মূলে থাকে সাংস্কৃতিক-ভিন্নতা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির দূরত্ব। দেখে ভালো লেগেছে যে ঠোকাঠুকি অচিরেই মিলে গেছে, টক্করে দাঁড়ায় নি। আর বিস্মিত হয়েছি সিলেটে ঐ স্পোর্টস কমপ্লেক্সে প্রযুক্তি ও প্রকরণগত হাজারো উপদ্রব সয়ে এবং মানিয়ে কহে বীরাঙ্গনা-র উপস্থাপন দেখে। যে বাংলাদেশ তার মৃত্তিকালগ্ন সংস্কৃতির ঊনকোটি অভিব্যক্তিকে খুঁজে পেতে চিনে-বুঝে আধুনিক মঞ্চনাটককে সাজাতে চায়, সেই বাংলাদেশে এমনতর নাটকের সাফল্য আরও দূরতর দ্বীপের সন্ধান দিক।
অংশুমান ভৌমিক ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। ভারতের প্রথমসারির দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ আর বাংলা মাসিক ‘কৃত্তিবাস’ এর নাট্যসমালোচক