Full premium theme for CMS
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাটক: শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস। উপন্যাস: শাহ্যাদ ফিরদাউস (শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার)। রচনা: হাসান শাহরিয়ার। নির্দেশনা: আজাদ আবুল কালাম। মঞ্চ ও পোস্টার ডিজাইন: শাহীনুর রহমান। আলোকপরিকল্পনা: ফয়েজ জহির। পোশাকপরিকল্পনা: কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। আবহসংগীতপরিকল্পনা: অসিত কুমার।। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০১০। একটি ‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’ প্রযোজনা
[শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস নাটক নিয়ে নাট্যসমালোচনা লিখেছিলেন আলফ্রেড খোকন। ২০১০ সালে এটি ‘দৈনিক সমকাল’ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী ‘কালের খেয়া’য় ছাপা হয়। এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
শেক্সপীয়র বিক্রি হলো দশ টাকায়,
বোঁদলেয়ার বারো
রবীন্দ্রনাথ তের টাকায়
জীবনানন্দ দাশ বিশ
সক্রেটিস হেমলকে,
কার্ল মার্কস পাত্র থেকে সরাতে চেয়ে বিষ
নেমে এলেন ফুটপাতে
তাই জনতার কুর্নিশ;
নিজেকে ফুটপাতে বিক্রি হতে দেখে
তাঁরা বুঝেছিলেন
অনিবার্য সংঘাতের দিকে এগুচ্ছে পৃথিবী
এখন ফুটপাত বিক্রি হচ্ছে চড়াদামে
পায়ের আঙুল, নখ, কোমরের কটি
বুকের পশম আর নিম্নগামী লোম
তলপেটের ঢেউ, কিডনি ও হাড়
চোখের মণি, পরিত্যক্ত দাঁত ও মাড়ি
এখন পিক আওয়ার
তাই বিক্রি হচ্ছে আমার চারিধার
চাহনি বিক্রি হলো আজ, গতকাল চোখ
পরশু বিক্রি হয়েছে পেট
আজ তাই গর্ভাশয়,
শুক্রবার এখানে বাজার দর ভালো
তাই আমি বিস্তৃৃত হলাম মাংসের দোকানে
আমাকে যখন কেটে কেটে নিচ্ছিল
তখন একটা ফড়িং উড়ছিল গালের কিনারে
ওটাকেও ওরা ধরতে চাইল তীক্ষ্ণ ছুরির ধারে
তার একটা পাখনা কাটা পড়ল মাংসের বাজারে
এসবই আমি দেখছিলাম বসে
পাশের সেলুনে ঝোলানো কাঠের ফ্রেমে বন্দি
এই সভ্যতার আয়নায়।
এই আয়না হতে পারে অতীতের। অতীত মানেই তো এই আমি ও আমার ভবিষ্যৎ। যেখানে আমার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষারা ফড়িঙের উড়ন্ত পাখনায় উড়তে চেয়েছিল, তাও বিক্রির বাটখারায় তুলে দিয়েছে পুঁজিপতির দল। এই হচ্ছে গল্প, এই হচ্ছে শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস নাটকের আর্তি। অতীত বিক্রি মানে তো স্বপ্ন বিক্রি। স্বপ্ন যখন বিক্রি হয় তখন কী থাকে? এ মুহূর্তে মনে পড়ছে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের একটি গান: ‘... কলা বেচ কয়লা বেচ, বেচ মোটরদানা/বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না’...। মানুষের অতীত বেচা আর স্বপ্ন বেচা একই কথা। অতীত মানে তো সম্পর্ক, বর্তমানের। আর বর্তমান মানে তো স্বপ্ন, আগামীর। সেই অতীত যখন বিক্রি হয়ে যায়, তখন মানুষের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ লোপাট হয়। কিন্তু অতীতকে কেনেই বা কারা, কেনই বা তারা অতীত কেনে, এমন একটি ডিসকোর্সে দর্শক আপনি যখন অংশ নিতে যাবেন, তখন যা যা ঘটবে তার সারমর্ম আছে ঔপন্যাসিক শাহ্যাদ ফিরদাউসের শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার উপন্যাস অবলম্বনে হাসান শাহরিয়ারের নাট্যরচনা শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস-এ। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন আজাদ আবুল কালাম। আর নাটকটি মঞ্চে এনেছে নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’র থিয়েটার ট্রুপ- ‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’।
সম-সময়ে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যের ক্লেদ ও ক্লান্তি, ক্ষত ও পুঁজ এবং জনমানুষের বোবা ক্ষোভ ও বিক্ষোভ ভাষা পেয়েছে এই নাটকে। এই নাটকের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, সম-সময়ে মানুষের জিহ্বার সামনে অপেক্ষমান অস্ফুট যে কথা গোঙায়, ব্যক্ত হওয়ার ভাষা পেতে চায়, তাকে ভাষা দিয়ে ব্যক্ত করে বদ্ধতা থেকে মানুষকে আপাতত মুক্তির আস্বাদ দিতে চেয়েছেন নাটকটির নাট্যজনেরা।
পুঁজিবাদের আগ্রাসন এমনই চূড়ান্ত-পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, পৃথিবীর সব কিছুই আজ পণ্য। মানুষ ও মানবতা, নীতি ও নৈতিকতা, শ্রদ্ধা ও স্নেহ, মায়া ও মমতা, প্রেম ও স্বপ্ন, আশা ও আকাক্সক্ষা, কামনা ও বাসনা এবং মানুষের যা কিছু মূল্যবোধ, ব্যক্তির অবশেষ নিভৃতি, সবই পণ্য। সবকিছুই বাজারদরে বিক্রি হয়, জন্ম থেকে মৃত্যু এবং মৃত্যুপরবর্তী, এমনকি মানুষের কল্পনা, স্বয়ং স্রষ্টাও, ধর্ম-অধর্ম সবই এই কেনাবেচার বাটখারায় নিরূপিত। এর ফলে, যে জায়মান সেও এই কেনাবেচার হাত থেকে মুক্ত নয়। এই মুহূর্তে ভূমিষ্ঠ হলো যে সন্তান, তারও অতীত বিক্রি হয়ে আছে পুঁজিপতির হাতেÑএমনই এক নির্ধারিত মানবসভ্যতার জন্মদাতা, ভবিষ্যৎ মানবের শূন্য ইতিহাসের নির্মাতা এই পুঁজিবাদের পাঠ ও প্রকাশ শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস।
শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস নাটকের আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, ঘরের ভিতর থেকে বিশ্ব দেখা এবং বিশ্বের ভিতর দিয়ে ঘরের কোণ অবলোকন করা। অর্থাৎ নিজ ভূখ-ের প্রেক্ষাপটেই নাটকটি নির্মিত। একজন নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, সেকান্দর, যখন তার শেষসম্বল একটুকরো জমি বিক্রির আশায় তার বন্ধুর বাড়ির দিকে যায়, পথিমধ্যে সে কর্পোরেট বাণিজ্যের শিকার হয় এবং জমির পরিবর্তে সে তার অতীত বিক্রির ফাঁদে পা দেয়। একইসাথে তার পারিবারিক, সামাজিক, প্রেম-প্রণয়, স্নেহ-মমতা এবং স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাজনিত সবরকমের সম্পর্কই সে নিজের অজান্তে বিক্রি করে বসে। সেকান্দরের পিতা শুধু রি-অ্যাক্ট করে। সে বুঝতে চায় অতীত বিক্রির মানে কী। আদৌ তা বিক্রি করা যায় কিনা। বিক্রি হলে কী হয়। কারণ এই পিতা-ই অতীতের পরম্পরা, অতীতের ভিত্তিমূল। ভিত্তিমূলে নাড়া লাগলে সে তো টের পাবেই। এই টের পাওয়া যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রজন্মের মনযোগ আকর্ষণ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই শূন্য-সভ্যতা এই পুঁজিবাদী-সভ্যতার পচন প্রক্রিয়া শেষ হবে না।
নাটকটির সংলাপ নির্বাচনেও রয়েছে সারল্যে ভরা গরল উপহার। বাণিজ্যের চরম বিকাশের এই কালে বাণিজ্যভাষা বা কর্পোরেট ভাষাকে অবলম্বন করেছেন নাট্যকার। তাতে জনমানবের দীর্ঘদিনের জমানো ক্রোধ বা খেদ ভাষা পেয়েছে। এটাকে আমি একজন শিল্পী বা লেখকের দায়িত্বের অংশ হিসেবেও মনে করি। আর এই ক্রোধ বা খেদের দৃশ্যরূপায়ণ ঘটেছে নাটকের পাঁচ কুশীলব আজাদ আবুল কালাম, তৌফিকুল ইসলাম ইমন, ঋতু সাত্তার, দীপক সুমন আর হাসান শাহরিয়ারের যথাযথ অভিনয়ের মাধ্যমে।
শিল্পী শাহীনুর রহমানের সেট এই নাটকের সৃজনমাত্রায় বিকশিত করেছে পূর্ণতার অবয়ব। একটি ট্রেনের কামরার ত্রিমাত্রিক ব্যবহারের ফলে দর্শকও যেন নাটকের এই জার্নিতে অংশ নিয়েছে, যেখানে রয়েছে যাত্রী ও গন্তব্য। কুশীলবগণ ট্রেনে ওঠা মাত্রই দর্শকও যেন ট্রেনে চড়ে বসেছেন এই নাটকে।
ফয়েজ জহিরের হাতে প্রয়োজনীয় আলোর ব্যবহারও নাটকটির গতিকে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ করেছে, মুক্ত করেছে যুক্তও করেছে। দর্শকের স্বাভাবিক চৈতন্যে অবস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। অর্থাৎ যেখানে যেমন আলো, ছায়া, আলো এবং ছায়ার যৌথমিলন দরকারি হয়ে উঠেছিল, জহির তার পূর্ণ ব্যবহার করেছেন নিষ্ঠায়।
অসিত কুমারের সংগীত-বিন্যাস নাটকটিকে মনোসংযোগ ঘটাতে এবং নাট্যযাত্রাকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে সহযোগী হয়েছে এর পরিমিত প্রয়োগে। এই সমস্ত সমন্বয়ই একজন পরিচালকের সতর্ক-চিন্তার জাগরণে যে সম্ভব, তা প্রমাণ করলেন নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম।
কাহিনি, নাট্যায়ন, পরিচালনা, সেট, লাইট, সংগীতসৃজন কিংবা অভিনয় কেমন হয়েছে অথবা যা হয়েছে তার চেয়ে আরও ভালো হলে ভালো হতো, এরকম একশ’ একটা কারণ ও খুঁত বের করা কোনো অসহজ কাজ নয়। কিন্তু শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস নাটক নিয়ে আমার লেখার কারণ হিসেবে উপরোক্ত বিষয়গুলো মোটেও প্রধান নয়। এসব বিষয় নিয়ে যারা নিরন্তর নাটকের সঙ্গে আছেন তাদের বলার কথা, ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরিয়ে দেয়ার কথা, সেটা আমার কাজ নয়। আমি নাটকের সুধি-সমালোচকও নই। সমসময়ের একজন দর্শক হিসেবে এই নাটকটির বক্তব্য ও বোধ আমাকে তাড়িত করেছে। পুঁজির দাপটে যখন ভেসে যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন, যাবতীয় জীবনযাপন, আমরা মুহূর্তে মুহূর্তে বন্দি হচ্ছি, গোলাম হচ্ছি, অথর্ব হচ্ছি, দাস হচ্ছি আর শাইলকরা প্রভু হচ্ছে বারবার, যখন কেউ জোরেসোরে এর বিরুদ্ধে টু-শব্দটির বাইরে কিছুই করতে পারছে না, ঠিক সে সময়ে এরকম একটি নাটকের উপস্থাপন আমাদের নতুনভাবে চিন্তার সূত্র দেবে। দ্রোহীকে দেবে আরও ত্যাজ। বিবেককে দেবে নাড়িয়ে। মূকমুখে দেবে প্রতিবাদের ভাষা। আর আমাদের বোধের জগতে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সেই ক্ষতের উপশম খুঁজতেও সহায়তা করবে বলেই এই নাটকটি আমার কাছে অতিব গুরুত্বপূর্ণ ।
প্রিয় পাঠক, সময় পেলে নাটকটি দেখুন, এবং সিদ্ধান্ত নিন, আপনি আপনার অতীত বিক্রি করবেন কিনা।
আলফ্রেড খোকন ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): কবি