Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার : ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে

Written by হাসান শাহরিয়ার.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

স ম্পা দ কী য়

এস এম সোলায়মান মাথা নিচু করে ঢুলুঢুলু বিড়বিড় করছে আর ভাবছে, নাট্যোৎসব করার পরিকল্পনা হাতে নেয়ার সাথে সাথে তা সফল করার জন্য সবাই কেমন ‘উন্মাদ’ হয়ে উঠেছে। সে যেন বলছে- থিয়েটার করতে এমন ক্ষ্যাপামীই তো চাই। আবার এ-ও ভাবছে, গত ২০ বছরে অনেকেই পৃথিবী ছাড়লো ঠিকই, কিন্তু থিয়েটার ছাড়তে পারলো কৈ? সত্যিই- ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।’

সে বসে আছে বজরা টাইপের একটা নৌকার সামনের গলুইয়ের একেবারে শীর্ষবিন্দুতে। এটা ইহজাগতিক বজরা নৌকার চেয়ে অনেক বড় সাইজের। তিন/চার না যেন পাঁচ/ছয় তলা। লম্বায়ও উচ্চতা-অনুপাতে দীর্ঘ। গত ২০ বছরে আমাদের যত নাট্যজন গত হয়েছে, সবাই গিয়ে উঠেছে এই বজরায়। যেন বোঝাতে চায়, থিয়েটারের মানুষকে একজোট হয়ে থাকতে হয়- কী একালে, কী সেকালে। বজরার ছাদে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে নাটক লিখছিল আবদুল্লাহ আল-মামুন। লেখার এক ফাঁকে, যখন পরের সংলাপটা কী হবে বা চরিত্রটা ঠিকঠাক আকার পাচ্ছে কিনা, এমন ভাবনা নিয়ে এদিক ওদিক আনমনে তাকাচ্ছিল, তখন দেখলো সোলায়মান গলুইতে বসে ঝিমাচ্ছে আর বিড়বিড় করছে। সে উচ্চস্বরে ডাকে-

ঐ সোলায়মান, গলুইয়ের অত উঁচুতে কেউ বসে নাকি? পড়ে যাবে তো।

পড়ে গেলে ক্ষতি কী? মরবো তো না। ঐ কাজ তো সেরেই এখানে এসেছি- হি হি।

নাহ- এই ক্ষ্যাপাকে নিয়ে কী যে করি। (আবার ডাকে) একটু এদিকে আসো- লেখাটা হঠাৎ করেই আটকে গেছে। জটটা একটু খুলতে পারো কিনা দেখোতো।

নাটকের জট খোলা ছাড়াও, সোলায়মানকে কাছে ডাকার আরেকটা উদ্দেশ্য হলো আড্ডা মারা। এই বজরা নৌকায় গত ২০ বছরে যারা আশ্রয় নিয়েছে তারা পরস্পরকে কাছে পেতে, দু’টো কথা বলতে যেন মরিয়া হয়ে থাকে। বেঁচে থাকতে যার যার শিল্পকর্মের মাধ্যমে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসতো- আর এখন সান্নিধ্যে থেকে শিল্পচর্চা করে।

‘সোলায়মান আপনার লেখার জট খুলতে পারবে না মামুনভাই। ও আমার ঘরানার লেখক।’- মন্তব্য শুনে পেছন ফিরে দেখে সেলিম আল দীন দাঁড়িয়ে আছে। ‘সোলায়মান মোটেও তোমার ঘরানার লেখক না। ও আমার ঘরানার নাট্যকার’- মামুন বলে। ‘তবে নির্মাণকৌশলে সে সর্বমুখী- সে-অর্থে তোমামুখীও বটে’- বলেই হাসতে থাকে আবদুল্লাহ আল-মামুন। ‘নির্মাণকৌশল কেমন হবে তা অনেক সময় পাণ্ডুলিপিই বলে দেয় মামুনভাই।’- সেলিম আল দীন বলে চলে- “ধরেন সোলায়মানের ‘গোলাপজান’ বা ‘আমিনা সুন্দরী’র কথা। এসব পাণ্ডুলিপি দিয়ে আপনি আপনাদের পাশ্চাত্য-ঘরানার থিয়েটার নির্মাণ করতে পারবেন না।” ‘তুমি কী যে বিভেদ তৈরি করেছো- তার জটতো এখনো খুলছে না।’- সৈয়দ শামসুল হক তার ভরাট কণ্ঠে অভিযোগ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে বজরার ছাদে ওঠে। চোস্ত শার্টপ্যান্ট পরে বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় সৈয়দ হক। “আপনার একথাটা ঠিক না হকভাই, আমি মোটেও কোনো বিভেদ তৈরি করি নি। আমি আমার প্রাচ্যকে চিনতে শিখিয়েছি মাত্র। আপনি নিজে আমার ‘চাকা’র গ্রন্থমুখ লিখেছেন। সেখানে কেনো এটাকে ‘কথানাট্য’ বলছি, সেটার বয়ানও আছে। অথবা ধরেন, অন্য কোনো নির্দিষ্ট রচনাকে কেনো ‘উপাখ্যান’, ‘আখ্যান নাট্য’ ইত্যাদি বলছি তার ব্যাখ্যাও আছে”- সেলিম আল দীন থামে। ‘তাই বলে কেবল এইসব রীতির নাটকই করে যেতে হবে? পাশ্চাত্য নাট্যরচনারীতি ও প্রয়োগরীতির চর্চা করা যাবে না- আমার করোটি এমত সিদ্ধান্ত নিতে অনিচ্ছুক।’- সৈয়দ হকের তীব্র বিরক্তি প্রকাশ। ‘এমন কথা আমিও বিশ্বাস করি না হকভাই’- সেলিম আল দীন সাফ জানায়।

বজরার বিভিন্ন তলা থেকে গান-বাজনার সুর ভেসে আসছে। সবাই ঠিক করেছে বজরায় অবস্থান নেয়া নাট্যকার-নির্দেশক-কলাকুশলী মিলে একটা নাট্যোৎসব করবে। সেই উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন জায়গায় কলাকুশলীরা নেমে পড়েছে প্রস্তুতিতে- নাট্যকাররা বসে গেছে নাটক লিখতে। আবদুল্লাহ আল-মামুন, সেলিম আল দীন আর সৈয়দ হকও লিখছে। একটানা আর কতক্ষণ লেখা যায়। তাই গায়ে বাতাস লাগানোর অভিপ্রায়ে সেলিম আল দীন আর সৈয়দ হক বজরার ছাদে এসেছে। আসার পরতো সারাক্ষণ তর্কই হচ্ছে যেন। “তুমি সব সময় এমন ভাব করতে, আমাদেরকে এমন বার্তা দিতে যেন ‘আমাকে দেখো। আমি কে দেখো’ এমন ঘোর তৈরি করতে। আমরা বাদ-বাকিরা যেন তুচ্ছ।”- এবার আবদুল্লাহ আল-মামুন একটু রাগতই সেলিম আল দীনের উদ্দেশে কথাগুলো বললো। “মামুনভাই, ক্ষেত্রবিশেষে ‘আমাকে দেখো’ এমনটা জরুরিও বটে।”- সেলিম আল দীন কথার ঝড় ছোটাতে লাগলো। “যখন আপনারা আমার কাজকে স্বীকৃতি দিবেন না- পশ্চিমা নাট্য নিয়ে মজে থাকবেন- শিকড়কে ভুলে যাবেন- তখন বাধ্য হয়েই অ্যাসার্ট করেছি- আমাকে দেখা হচ্ছে না। অতএব আমাকে দেখো। উপনিবেশবাদ তার নিজের জিনিস চাপাতে গিয়ে অনেক সময় আমার ঐতিহ্যকে খারিজ করে দিতে চায়। সে-ক্ষেত্রে ‘আমি আছি’ বা ‘আমাকে দেখো’ বলাটাও জরুরি হয়ে পড়ে।”

এদিকে এস এম সোলায়মান আবদুল্লাহ আল-মামুনের ডাকে বজরার ছাদের দিকে রওনা দিয়েছে সেই কখন। কিন্তু প্রতিটি তলায় যার সাথেই দেখা হচ্ছে তার সাথেই কিছু-না-কিছু কথা না বলে উঠে আসতে পারছে না। সামনেই উৎসব। অনেক নাটক নামবে। সেই নিয়ে সবাই ব্যস্ত। সোলায়মান এই উৎসবের আহ্বায়ক। সুতরাং সবার সাথে সব সময় যোগাযোগ রেখে চলেছে সে। সাঈদ আহমদ দোতলার একটা জানালার ধারে বসে নদীর দিকে মুখ করে ইংরেজিতে একটা নাটক লিখছে। সেটার কিছুটা শুনতে হলো সোলায়মানকে। ‘নাটকে স্মার্টনেস থাকতে হয় বুঝলে। কেউ ডাকলো আর অমনি থিয়েটারে নেমে গেলাম- তা দিয়ে নাটক হয় না। আভিজাত্য এক প্রজন্মে তৈরি হয় না। দুই/তিন প্রজন্ম ধরে যার রক্ত থিয়েটার দেখে নি- সে বিশ্বনাটকের কী বুঝবে বলো দেখি।’ সাঈদ আহমদের সাথে এস এম সোলায়মান কখনোই চোখে চোখ রেখে কথা বলে নি। বিশ্বনাটককে বাংলাদেশের মঞ্চশিল্পীদের কাছে পরিচয় করিয়েছে এই লোকটি। তার জ্ঞানগরিমা সবই শ্রদ্ধার সাথে দেখে এসেছে। স্বাধীনতার আগেই যে কিনা নাট্যকার হিসেবে স্বীকৃত, নন্দিত- তার সামনে এমনিতেই মাথা নুয়ে যায়। সোলায়মানের মাথাও নুয়ে গেলো। মাথা নিচু করেই উপরে ওঠার সিঁড়ি ধরলো সে। যাওয়ার সময় যে গন্ধ ছড়িয়ে গেলো, তাতে বিনয়ে নাকি অতিরিক্ত পানের কারণে সোলায়মানের মাথা নত হয়েছে সাঈদ আহমদ ঠিক বুঝতে পারলো না। টেবিলের কোণায় রাখা গ্লাসটা হাতে নিয়ে, ঠোঁটটা স্কচে ভিজিয়ে আবারও লেখায় মনোযোগ দিলো সাঈদ আহমদ।  

উচ্চস্বরে হাসির শব্দ শুনে বজরার পিছনের গলুইয়ের দিকে গেল সোলায়মান। সে দেখে নদীতে পড়ে প্রায় হাবুডুবু খাচ্ছে ‘কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারে’র মঞ্চশিল্পী সোহাগী জাহান তনু আর প্রাঙ্গণেমোরে’র মাসুদ পারভেজ। সে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচের পাটাতনে নেমে এলো। তনু আর মাসুদের এমন অসহায় অবস্থায় হুমায়ুন ফরিদী কেনো উচ্চস্বরে হাসছে, সেটা মাথায় ঢুকছে না সোলায়মানের। ‘দেখ দেখ- বাঁচার জন্য কেমন আপ্রাণ চেষ্টা করছে স্টুপিড দুইটা। হা হা।’- ফরিদী যেন বেশ মজা পাচ্ছে ঘটনাটিতে। চকিত নদীতে ঝাঁপ দিলো নারায়ণগঞ্জের ‘ঐকিক থিয়েটারে’র দিদারুল ইসলাম চঞ্চল। সে একাই দু’জনকে দুই কাঁধে নিয়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে বজরার কাছে নিয়ে এলো।

ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে হুমায়ুন ফরিদীই ওদেরকে নদীতে ফেলে দিয়ে তামাশা দেখছিল। তার অট্টহাসির তোড়ে রীতিমতো একটা ভীড় জমে গেছে জায়গাটায়। কেউ নিচে, কেউ সিঁড়িতে, কেউ-বা বিভিন্নতলা থেকে উঁকি মেরে দেখছে। ক’জনার সহযোগিতায় ওরা তিনজন পাটাতনে পা রাখলো। ‘এটা আবার কেমন ধরনের পাগলামী ফরিদীভাই? ওরা কেমন ভয় পেয়ে গেলো না?’- সোলায়মানের ইতস্তত প্রশ্ন। ‘নাটকের বিষয়-ভাবনা কী হওয়া উচিত, কেমন থিয়েটার করা উচিত- ইত্যাদি নিয়ে গৌতম রায়চৌধুরী, আসকার ইবনে শাইখ আর মমতাজউদদীন আহমদ স্যার কথা বলছিলেন। তখন আমার মাথায় এই খেলাটা খেলার ইচ্ছা জাগলো।’- হো হো করে হাসতে হাসতেই বললো ফরিদী। আসল ঘটনা হলো উল্লেখিত তিন নাট্যকার তাদের নাট্যচিন্তা নিয়ে কথা বলছিল। বাংলা থিয়েটারে কি বিদেশি নাটকের প্রভাব থাকবে? নাকি গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির হাত ধরে বাস্তবের পথে এগিয়ে যাবে থিয়েটার? এমন প্রশ্ন তুলেছিল পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের ‘ঋত্বিক’-প্রাণ গৌতম রায়চৌধুরী। মমতাজউদদীন আহমদ বললো স্বদেশ-বিদেশ বুঝি না। আমার সামনে যে সংকট আসবে, তাতে যে চরিত্ররা মুখ্য ভূমিকা নেবে- সেই সংকট আর সেই চরিত্র নিয়েই আমি নাটক করবো। আসকার ইবনে শাইখ বলছিল- নাটকের পাণ্ডুলিপিই আসলে নাটক না। অভিনয় আর নির্দেশনার সংমিশ্রণ যথাযথ না হলে নাটক দাঁড়ায় না। নাটকে মহড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব শুনেও সোলায়মান ফরিদীর পাগলামীর কারণ খুঁজে পেলো না। অন্যরাও হা করে তাকিয়ে থাকলো। ফরিদী নিজ থেকেই যেন ব্যাখ্যা দিতে থাকে- ‘তখন আমি ওনাদের দেখাতে চাইলাম, সবার প্রথমে মানুষ চিনতে হবে। মানুষের প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইচ্ছা হলো, বাঁচার ইচ্ছা। প্রত্যেকটা মানুষ বাঁচতে চায়। তনু আর মাসুদ জানে যে তারা মরবে না। কারণ, মরার পরই এখানে তারা এসেছে। তারপরও বাঁচার জন্য কী হাবুডুবুই না খাচ্ছিল। আবার চঞ্চলও জানে ওরা মরবে না, তারপরও নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তাদেরকে বাঁচিয়ে দিলো।’ ‘তা দিয়ে আমরা কী বুঝতে পারলাম?’- গৌতম-শাইখ-মমতাজউদদীন একসাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ফরিদীর দিকে। ‘মরবে না জেনেও যারা বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, জীবিতাবস্থায় তাদেরকে যখন খুন করা হচ্ছিল, তখন তারা কতটা আর্তনাদ করেছিল বেঁচে থাকার জন্য একবার ভেবে দেখেন। মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার সেই অনুভূতিটা নাট্যকার-অভিনেতা-নির্দেশক সবাইকে হৃদয়ঙ্গম করতে হয়। তবেই থিয়েটারে প্রাণসঞ্চার করা সম্ভব হয়।’- ফরিদী তার ‘লেকচার’ শেষ করে। তখন সবাই যেন অনুভব করতে থাকে- তনুকে যখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় খুন করা হলো, মাসুদ যখন রিয়েলস্টেট কর্পোরেট সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হলো কিংবা দিদারুল ইসলাম চঞ্চলকে যখন গুম করে খুন করে শীতলক্ষ্যায় ফেলছিল, তখন তারা বাঁচার জন্য কতটা আকুতি জানিয়েছিল! সবাই যেন চুপ হয়ে গেল। ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙ্গে একটা প্রশ্ন তেড়ে এলো সবার উদ্দেশে- ‘বুঝলাম, যারা খুন হয়েছে, তারা বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু যে স্বেচ্ছায় মরে এখানে এলো- তার কেনো বাঁচতে ইচ্ছা করলো না?’ প্রশ্ন শুনে প্রশ্নকর্তাকে সবাই খুঁজতে লাগলো। দেখা গেলো সবার পিছনে ‘এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে’ দাঁড়িয়ে আছে নৃপেন্দ্র সাহা- মানে নৃপেন দা। পাকা গোঁফের ফাঁক দিয়ে বের হওয়া মুচকি হাসি দেখেই সবাই বুঝে ফেললো প্রশ্নকর্তা আর কেউ না, স্বয়ং নৃপেন্দ্র সাহা।

‘কী আশ্চর্য! আপনি এখানে আছেন অথচ চোখেই পড়লো না।’- দীর্ঘদেহী নৃপেন্দ্র সাহাকে দেখতে না পাওয়ায় যেন লজ্জাই পেলো এস এম সোলায়মান। ‘আরে দেখবে কীভাবে? আমাদের চোখ কি অত উঁচু জিনিস দেখতে পায় নাকি? আমাদের নজর তো নিচু- হো হো।’- আকাশ কাঁপিয়ে হো হো হাসতে থাকে হুমায়ুন ফরিদী। ‘নৃপেন বাবু, আপনি কার কথা বলছেন? কে স্বেচ্ছায় এখানে এসেছে?’- প্রশ্ন করে গৌতম রায়চৌধুরী। ‘অভাগার নাম রিঙ্কন শিকদার। দল ‘প্রাচ্যনাট’। মৃত্যুর কারণ- আত্মহত্যা। হি হি।’- হেসেখেলেই নিজের পরিচয় দেয় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ‘প্রাচ্যনাট’ সদস্য রিঙ্কন। সবাইকে সে জানালো, ইচ্ছামৃত্যুর একটাই কারণ, তাহলো, বাঁচার ইচ্ছাটা মরে গিয়েছিল। ‘ফরিদীভাই, মানুষ বাঁচতে চায় কথাটা ঠিক। কিন্তু একজন শিল্পী অসম্মান নিয়ে বাঁচার চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করে।’- কথাটা বলেই হু হু করে কেঁদে নিজেকে আড়াল করে রিঙ্কন। ‘তোমার মতো অনেকেই হয়তো আত্মহত্যার পথেই যেতে চেয়েছিল, কিন্তু যায় নি। থিয়েটারের বন্ধুর পথের শেষটা দেখতে চেয়েছিল। তারপরও লাভ হয় নি। দুঃশ্চিন্তা-অনিশ্চয়তা-সমাজের অবহেলার শিকার হয়ে অল্প বয়সেই তারা এপারে আসতে বাধ্য হয়েছে। ওরা এই বজরাতেই আছে।’- নৃপেন্দ্র সাহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ‘আপনি ওপার বাংলার লোক হয়ে এপার বাংলার এতো খবর জানেন কী করে দাদা?’- আসকার ইবনে শাইখের কণ্ঠে বিস্ময়। ‘উনিই তো জানবেন স্যার। নৃপেন দা’ হলেন আমাদের দুই বাংলার নাট্যসাঁকো।’- সোলায়মানের স্বীকৃতিতে সবাই জোরে হাততালি দিতে থাকে।

কবীর চৌধুরী বেশ ফিটফাট, কেতাদুরস্ত মানুষ। বসে আছে চারতলায়, তীরের দিকে মুখ করে, বজরার বিশাল জানালার পুরোটাই খোলা রেখে। বসে আছে বললে ভুল বলা হয়। একটা বিদেশি নাটকের অনুবাদের কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছে। এমন সময় ট্রে হাতে কাছে আসে অলক। কবীর চৌধুরী ট্রে’র দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়।

তোমার নামটা যেন কী?

জ্বি, আমার নাম ছিল সৈয়দ মোশতাক আহমেদ। থিয়েটার আর্ট ইউনিটে এসে হয়ে গেলাম সৈয়দ অলক।

কেনো বলো তো?

‘সৈয়দ’-এর জায়গায় সবাই ‘খন্দকার’ বসিয়ে ডাকতো তো, আমার সহ্য হতো না।

বাহ, বেশ বলেছো অলক। তা আমার জন্য চা এনেছো ভালো কথা, কিন্তু এতকাপ কেনো?

আপনার জন্য এককাপই স্যার। অন্যগুলি অন্যদের জন্য। এই যে- সবাই এসে গেছেন।

অলকের কথা শেষ না হতেই হুড়মুড় করে সবাই কবীর চৌধুরীর চারপাশে বসে পড়ে। ‘আরে আরে সব বুড়োরা দেখছি একসাথে জড়ো হয়েছেন। কী ব্যাপার বলেন তো?’- কবীর চৌধুরী যেন সত্যিই একটু ইতস্তত। ‘দাদা, আমি এসেছি একটা অনুরোধ নিয়ে।’- বলতে থাকে শোভা সেন, ‘যে-ই নাটক লিখছে, সেই আমার জন্য একটা লম্বা চরিত্র সৃষ্টি করে ফেলছে। এতোগুলো নাটকে তো অভিনয় করতে পারবো না। তাই আপনার কাছে অনুরোধ- অন্তত আপনার নাটক থেকে যেন আমি রেহাই পাই।’ ‘এটাতো নাট্যকার-নির্দেশকের দোষ না শোভাদি’, সব দোষ তো আপনার।’- নিখিল সেন দু’জনের কথার মধ্যে না-ঢুকে যেন পারে না।

আমার দোষটা কোথায় শুনি?

‘আপনি অত বড় অভিনেত্রী হতে গেলেন কেনো? হা হা।’- নিখিল সেনের হাসির দমকে যেন বজরা দুলে ওঠে। “আপনি ‘নবান্ন’ নাটকের অভিনেত্রী। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘তিতুমির’ নাটকের অভিনেত্রী- সুতরাং সব নাট্যকারই চাইবে তার নাটকে আপনার একটা চরিত্র থাকুক।”

‘নিখিল সেন বাবু একেবারে ঠিক কথা বলেছেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন দিদি, আমার নাটক থেকেও আপনার রেহাই নেই।’- কথা বলেই কবীর চৌধুরী এবার তাকায় কুমার রায়ের দিকে- ‘দাদা আপনিও কি একই আবদার নিয়ে এসেছেন?’ কুমার রায় কিছুটা ইতস্তত। ‘ইয়ে- মানে- শোভাদি’-কে যেভাবে বললেন, তারপর আমি যে কী বলি- মানে- আমাকে রেহাই দিলে...’- কথাটা শেষ করতে দেয় না খালেদ চৌধুরী। সে কবীর চৌধুরীকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বলতে থাকে- “কুমারদা’ আপনি নিজেকে প্রশ্ন করেন তো, ‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘রাজা’, ‘পুতুল খেলা’, ‘বিসর্জন’ নাটকের অভিনেতা, আপনার জন্য কোন নাট্যকার একটা চরিত্র লিখবে না?” ‘সবার ওই একই কথা। হয়েছে বাবা, আমার ঘাট হয়েছে। করবো, সব নাটকেই অভিনয় করবো, কথা দিয়ে গেলাম। এবার হলো?’- কথা শেষ করেই এক মুহূর্তও না বসে চলে গেল কুমার রায়। খালেদ চৌধুরী এবার তাকায় অলকের দিকে, ‘চা খুব ভালো হয়েছে অলক। আরেক কাপ আনা যাবে?’ ‘জ্বি অবশ্যই।’- অলক যেতে নেয়। শোভা সেন থামায়।

অলক, তুমি এমন কুঁজো হয়ে হাঁটো কেনো বলো তো?

জ্বি মানে- আমার পিঠে একটু সমস্যা আছে। আগে মাঝে মাঝে  প্রচণ্ড পেইনও হতো। মানে- ইয়ে-

অলকের ইতস্তত ভাব দেখে কবীর চৌধুরী ফ্লোর নেয়- ‘শোনো, তোমাকে এখনই বলে রাখি। আমার নাটকে কিন্তু তোমাকে চাপরাশীর একটা চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। তুমি রাজি থাকলে নির্দেশককে বলবো।’ ‘ঐসব চরিত্র পেলে আমাকে অভিনয় করতে হয় না স্যার। আমার জেসচারই নব্বইভাগ পুষিয়ে দেয়। হা হা।’- হাসতে হাসতে চলে যায় অলক। সবাই যেন তার কথায় বেশ মজা পায়। কবীর চৌধুরী আবার আলোচনায় ফিরে আসে, খালেদ চৌধুরীকে বলে, ‘বলেন দাদা- আমার কাছে আপনার কোনো আবদার আছে কিনা।’ ‘আবদার একটাই।’- খালেদ চৌধুরী বিনয়ের সাথে বলে, ‘নাটকের অনুবাদটা তাড়াতাড়ি শেষ না করলে আমি মঞ্চ আর আবহসংগীত নিয়ে কাজ শুরু করতে পারছি না।’

কথাটা সত্য। যতগুলো নাটক এবারের উৎসবে মঞ্চস্থ হবে তার সবগুলোর মঞ্চ ও আবহসংগীত পরিকল্পনার প্রধান দায়িত্ব দেয়া হয়েছে খালেদ চৌধুরীকে। দেবেই বা না কেনো? খালেদ চৌধুরী, যে কিনা বহুরূপী’র ‘রক্তকরবী’ দিয়ে মঞ্চ ও আবহসংগীত পরিকল্পনা শুরু করেছে, তাকে তো একটু বেশি দায়িত্ব নিতেই হবে।

‘অবশ্যই’- কবীর চৌধুরী বলে, “আমি আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে যাবে ‘চিরকুমারদা’”। সম্বোধনটা ‘চিরকুমার’ শুনে খালেদ চৌধুরী ইতস্তত করে। ‘আগে তো আপনি আমাকে এই নামে ডাকতেন না কবীরভাই। এখন প্রায়ই দেখি...’ খালেদ চৌধুরীর কথা কেড়ে নিয়ে কবীর চৌধুরী বলে- “অনেকেই তো জানে না যে, আপনি শুরুতে ছিলেন ‘চিরকুমার’, তারপর বাবার দেয়া নামে ‘চিররঞ্জন’, সবশেষে নিজের দেয়া ‘খালেদ চৌধুরী’ নাম নিয়ে বাংলামঞ্চ কাঁপিয়ে দিলেন।

নিখিল সেন এবার শোভা সেন আর কুমার রায়ের একেবারে উল্টো একটা আবদার জানায়, ‘কবীরভাই আপনার নাটকে আমার একটা চরিত্র থাকা চাই।’

চরিত্র লিখলেও লাভ নাই। নির্দেশক আপনাকে নিতে পারবে না।

আপনিও একই কথা বলছেন?

হুম। সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপনি সব নাটকের সব অভিনেতা-অভিনেত্রীর উচ্চারণের বিষয়টা দেখভাল করবেন। আপনি হচ্ছেন সুদ্ধউচ্চারণের জাদুকর। সুতরাং আপনার অভিনয় করার সাধ আপাতত অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে।

বজরার ছাদটা খালি পেয়ে খালেদ খান তার নাটকের প্রাথমিক মহড়া শুরু করেছে। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা নাটকটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। অভিনয়নির্ভর নাটক। তাই সবার আগেই সেরা অভিনেতৃ বাছাই করে ফেলেছে খালেদ খান। নিজের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে নাজমা আনোয়ার, হুমায়ুন ফরিদী, ‘দেশ নাটকে’র দীলিপ চক্রবর্তী, ‘প্রাচ্যনাটে’র সঞ্জীবন শিকদার, ‘আরণ্যক নাট্যদলে’র তাজিন আহমেদ আর ‘রঙ্গনা নাট্যগোষ্ঠী’র প্রতিষ্ঠাতা সিরাজ হায়দারের মতো অভিনেতৃদের। আলোক নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে’র অমল বিশ্বাস কথা’কে আর আবহসংগীত নিয়ন্ত্রণের ভার দিয়েছে ‘দৃশ্যপটে’র সাকি-এ-ফেরদৌসকে।

খালেদ খানের নাটকে যারা সুযোগ পেয়েছে তাদের মধ্যে কাকতালীয়ভাবে অদ্ভুত-করুণ একটা মিল আছে। তারা সবাই বিদায় নিয়েছে থিয়েটারের সবাইকে অপ্রস্তুত করে। নাজমা আনোয়ার রাতে অসুস্থ হলো- তারপর অ্যাম্বুলেন্স-হাসপাতাল- তারপর সব শেষ। হুমায়ুন ফরিদী রাতেও অনেকের সাথে কথাটথা বলেছে- সকালে বাথরুমে পাওয়া গেল তার নিথর দেহ। দীলিপ চক্রবর্তী ঘুমিয়েছিল, কোন এক অভিমানে আর জাগলোই না। সঞ্জীবন শিকদার আর অমল বিশ্বাস কথা ভিন্ন নাট্যদলের হলেও মারা গেছে একইদিনে, কাছাকাছি সময়ে, অকস্মাৎ। তাজিন আহমেদ সকাল ১০ টায় অসুস্থ-হাসপাতাল বিকালে ডাক্তারের ঘোষণা। রাতে সিরাজ হায়দারের বুক-ব্যথা শুরু, ভোরেই সব শেষ। আর সাকি-এ-ফেরদৌসের ছিল শ্বাসকষ্টের সমস্যা। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ব্যাগ হাতিয়ে দেখে নেবুলাইজার নাই। আরও দ্রুত চললো ঘরের দিকে। নেবুলাইজারের প্রয়োজন ততক্ষণে ফুরিয়ে গেছে।

কী অদ্ভুত সমাপ্তি এই থিয়েটারওয়ালাদের!

সব নাটকের মহড়া শুরু হয়ে গেছে জোর কদমে। বজরার বিভিন্ন তলা থেকে ভেসে আসছে সংলাপ আর সংলাপ। গান আর গান। ঢোল-তবলা-মন্দিরার আওয়াজ। নেপথ্যের কাজও এগিয়ে চলেছে সমান গতিতে। তাপস সেন সব সহকারীকে নিয়ে বসেছে বজরার সামনের দিকটার পাটাতনে, মাস্তুলের গোড়াটায়। তাপস সেনের লাইট ডিজাইন শেষ। যারা আলোক নিয়ন্ত্রণের কাজটা করবে তাদের সাথে কিছু আলাপ সেরে নিচ্ছে। ঠিক এই সময় ‘মফস্বলের জাতীয় নাট্যকর্মী’ বলে খ্যাত টাঙ্গাইলের আবদুর রহমান রক্কু গজগজ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে যাচ্ছিল।

কী হলো রক্কু? এতো চটে আছো কেনো?- তাপস সেন প্রশ্ন করে।

রক্কুও চাচ্ছিল, কেউ একজন তাকে ডাকুক। রাগের কারণ জিজ্ঞাসা করুক। তাহলে তার রাগ থামাতে সুবিধা হয়। নিজ থেকে রাগ থামিয়ে দেয়াটা লজ্জার ব্যাপার না? তাপস সেনের কাছে এসে সে জানায়, সে হচ্ছে এই নাট্যোৎসবের প্রোডাকশন ম্যানেজার। অথচ তার কথা কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনছে না। কাছেই নদীর হাওয়া উপভোগ করছিল উৎসবের প্রধান সমন্বয়ক, বরিশালের ‘খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারে’র মিন্টু বসু। মিন্টু বসু রক্কুর এই ধরনের ‘খামাখা’ হৈচৈ-এর সাথে পরিচিত। তার ভেতরে দুষ্টুমি ভর করে। কাছে এসে বলে-

রক্কু, তুমি কি একাই প্রোডাকশন ম্যানেজার, নাকি আরও কেউ আছে?

(ইতস্তত) ইয়ে মানে- বরিশালের ‘খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারে’র আকবর হোসেনও একজন প্রোডাকশন ম্যানেজার। মানে আমরা দু’জন...

ও। তা, তোমরা দু’জনই নাকি আরও কেউ আছে?

(ইতস্তত) ইয়ে মানে- মিন্টু দা’ আপনি তো জানেনই- অনেক অনেক কাজ, বড় বড় দায়িত্ব। ১/২জনে কি হয়? মানে- ‘ঢাকা পদাতিকে’র গাজী জাকির হোসেন আছে না- ঐ যে নিরলসকর্মী, কাজপাগল, আরে ঐ যে, মরণব্যাধি জাপটে ধরলো, মুম্বাইয়ের একটা  হাসপাতালে...

তাহলে তোমরা তিনজন প্রোডাকশন ম্যানেজার- এই তো?

(ইতস্তত) ইয়ে মানে- ‘সুবচন নাট্য সংসদে’র এস এম আরজু রহমানও আছে। আরজু’র মতো দাপুটে ছেলে না থাকলে অন্যরা ঠিক কথা শুনতে চায় না।

নাদিম আর সুলতান সেলিমের কথাটা কি আমাকে বলতে হবে নাকি তুমিই বলবে?

(ইতস্তত) ইয়ে মানে- হ্যাঁ হ্যাঁ- ‘বটতলা’র নাদিম আছে, ‘ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে’র সুলতান সেলিমও আছে। কর্মচঞ্চল ছেলেপেলেরা যতটা উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করে, আমরা কি ততটা পারি বলেন? তবে এই শেষ- আর কেউ নাই। প্রোডাকশন ম্যানেজার আমরা এই ৬ জন।

‘তাহলে অন্যরা চেঁচাচ্ছে না, আপনি একা একা চেঁচাচ্ছেন কেনো?’- খুব বিরক্ত হয়েই মহড়া থামিয়ে প্রায় যেন তেড়ে আসে সাইদুর রহমান চঞ্চল। তার পিছু পিছু আসে ‘থিয়েটার’-এর জগলুল আলম আর ‘নাট্যধারা’র তনুশ্রী গায়েন। সেলিম আল দীনের নাটকটা নির্দেশনা দিচ্ছে সাইদুর রহমান চঞ্চল। সে নাট্যকারের এক সময়ের কৃতি ছাত্র। ‘দেখেছেন মিন্টু দা’, দেখেছেন তাপস দা’ চঞ্চল কেমন অ্যাগ্রেসিভ মুডে কথা বলছে!’- রক্কু যেন চঞ্চলের বিরুদ্ধে বিচার দেয়। ‘অ্যাগ্রেসিভ হবো না কেনো? আপনার চিৎকারের জ্বালায় রিহার্সেলে মনোযোগ দিতে পারছি না।’- এবার জগলুল আলম তাদের ক্ষোভের কারণ জানায়। ‘তোমাদের রিহার্সেলের শব্দ আমার চেঁচামেচির চেয়ে তীব্র। ঢোল, তবলা বাজাচ্ছো আবার সংলাপও আওড়াচ্ছো। একটা হৈচৈ কা- বাঁধিয়ে দিয়ে দোষ ঝাড়ছো কিনা আমার উপর।’- রক্কু এবার যেন রাগ থামিয়ে অভিমান করে। ‘আমাদের প্রয়োগরীতি এমনই। এখানে সংলাপ-গীত-নৃত্য সব একসাথে চলে। দ্বৈতাদ্বৈতবাদ শিল্প বোঝেন?’ ‘ধুর ছাতা- কিছু বলতে গেলেই তত্ত্ব কপচানো শুরু করে দেয়। থাকো তোমরা ঐ দ্বৈতাদ্বৈতবাদ শিল্প নিয়ে। আমি গেলাম।’- বলেই দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় আবদুর রহমান রক্কু। তাপস সেন আর মিন্টু বসু রক্কুর ছেলেমানুষী নিয়ে হাসে। চঞ্চল আবার রিহার্সেল শুরু করে।

জগলুল-তনুশ্রী-চঞ্চল এই ত্রয়ীর ভিতরে বাস করে এক গভীর কষ্ট, অসহ্য বেদনা। এই তিনজনেরই আছে ক্যান্সারে ভুগে তিলে তিলে নিঃশেষ হওয়ার অভিজ্ঞতা।

পেছনের গলুইয়ের কাছে, যেখানে মাঝি দাঁড় নিয়ে বসে আছে, তার একটু সামনে একাগ্রচিত্তে গলা সাধছে দিনাজপুরের ‘নবরূপী’ থিয়েটারের মাজেদ রানা। দূর থেকে তা খেয়াল করে সৈয়দ মহিদুল ইসলাম। সে বজরার পেছনের সিঁড়ি ভেঙে ধীর পায়ে এসে মাজেদ রানার পাশে বসে। ‘আপনার রিহার্সেল নাই মাজেদভাই?’- মহিদুল প্রশ্ন করে। ‘এখনো ডাক পাই নি। মফস্বলের অভিনেতা, কে পোছে বলেন?’- আক্ষেপ ঝরে মাজেদ রানার কণ্ঠে। ‘আমি তো মফস্বলের না। এনএসডি ফেরৎ ঢাকার অভিনেতা-নির্দেশক। আমাকে, কে, কবে, কতটুকু চিনেছে বলেন?’- উত্তরের অপেক্ষা না করেই মহিদুল জানতে চায়, ‘আপনি সত্যি অভিনয় করতে চান?’

আমি ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’, ‘রক্তকরবী’, ‘টিপু সুলতান’, ‘ঈদিপাস’ নাটকে অভিনয় করেছি, জানেন তো?

জানি মাজেদভাই।

মৃত্যুর আগে বহুদিন আমি বাকহারা ছিলাম। কথা বলতে পারতাম না। জানেন তো?

জানি মাজেদভাই।

‘এবার আপনিই বলেন, সারাজীবন মঞ্চে সংলাপ আওড়ানোর পর শেষজীবনটা কাটালাম বোবা হয়ে। একটু কথা বলার জন্য যে মানুষটা দিনরাত ছটফট করতো, সে যদি আবার সুযোগ পায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলার....’ মাজেদ রানা কথা শেষ করতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। সৈয়দ মহিদুল ইসলামের চোখও ভিজে যায়। ‘তাহলে আর কোনো কথা নাই। দুই চরিত্রের একটা নাটক নির্দেশনা দেয়ার কথা ভাবছিলাম।’- মহিদুল বলে চলে, ‘দ্বিতীয়জনকে যেহেতু পাওয়া গেল, তাহলে আর দেরি না করাই ভালো। ওঠেন, ওঠেন মাজেদভাই।’ মহিদুল মাজেদ রানাকে প্রায় টানতে টানতে বজরার ভিতরে নিয়ে যায়।

সবাই বজরার ছাদে জড়ো হয়েছে। উৎসবের প্রস্তুতির অগ্রগতি নিয়ে সবাইকে অবহিত করছে আহ্বায়ক এস এম সোলায়মান। ‘ঐ যে দেখছেন নদীর পাড়ে বিশাল উঁচু জায়গা, সেই জায়গাটাতে মঞ্চ করে আমরা আমাদের নাটকগুলো মঞ্চস্থ করবো।’- সোলায়মান বলে আর সবাই সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে জায়গাটা দেখে। কেউ একজন জানতে চায়, জায়গাটাতে নাটক করার অনুমতি নেয়া আছে কিনা। উত্তরে সোলায়মান বলে, ‘অনুমতির দরকার নাই। জায়গাটা আমাদের নিজস্ব।’ কথা শুনে সবাই সবাইর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকায়। ‘আমরা বেঁচে থাকতে নিজস্ব মঞ্চ নির্মাণ করতে পারি নি।’- বলতে থাকে সোলায়মান, “তবে এটাও ঠিক, কেউ-ই পারি নি, কথাটা সত্য না। রাজধানী থেকে বহু দূরে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ঘটে আশ্চর্য এক ঘটনা। ‘মণিপুরি থিয়েটার’কে  নিজস্ব বসতভিটার একটা অংশ দিয়ে নাটম-প তৈরি করে দিয়েছেন লালমোহন সিংহ। সেই লালমোহন সিংহ দাদাই আমাদের জন্য নদীর পাড়ের এই জায়গাটা কিনে দিয়েছেন। এখন থেকে এটাই হবে আমাদের নিজস্ব নাট্যমঞ্চ।” সবার করতালিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত। এবার এস এম সোলায়মান উৎসবের খরচ নিয়ে কথা বলে। ‘উৎসবের খরচ নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। টাকার জোগাড় হবে কীভাবে?’- বলার পরই সোলায়মানের মুখে হাসি, ‘চিন্তার দিন শেষ। বেঁচে থাকতে থিয়েটারের পেছনে টাকা ঢালতে যার সমস্যা হয় নি, টাকা দিতে এখন তার সমস্যা হবে কেনো? আমাদের উৎসবের পুরো খরচ বহন করবে বরিশালের ‘শব্দাবলী’র প্রায় ১০ বছরের সহসভাপতি শেখ নূর মোহাম্মদ নূর। তালি হবে।’ আবারও গগনবিদারী করতালির আওয়াজ।

ক্লাসে শিক্ষার্থী যেভাবে হাত উঠিয়ে শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনি হাত উঠিয়েছে জিয়া হায়দার। কেউ একজন এ ব্যাপারে সোলায়মানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘কিছু বলবেন জিয়া হায়দারভাই?’- সোলায়মান জানতে চায়। ‘আমি কিন্তু তোমাদের ঐ মঞ্চে নাটক নামাচ্ছি না।’- জিয়া হায়দার বলে চলে, “আমার সারাজীবনের শখ ছিল ‘ক্যাফে থিয়েটার’ করবো। তোমরা জানো বোধহয় ’৮৭-’৮৮’র দিকে আমার রচনা-নির্দেশনায় চট্টগ্রামে এই ফর্মে একটা নাটক করেছিলাম। এখানেও সেভাবেই করতে চাই। বজরায় নাটক চলতে থাকবে। দর্শক নাটক দেখবে, চা খাবে, কফি খাবে অর্থাৎ যার যা ইচ্ছা করবে আবার নাটকও চলবে।’ আবদুল্লাহ আল-মামুন, মমতাজউদদীন আহমদসহ অনেকেরই ঐ নাটকের কথা মনে পড়ে। সবার সম্মতিতে জিয়া হায়দারের ‘ক্যাফে থিয়েটারে’র প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়।

‘আমার প্রস্তাব কি উত্থাপন করতে হবে নাকি এমনি এমনি পাশ হয়ে যাবে?’- বাদল সরকার চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আমি গ্রামের ভিতরে, হাট-বাজারে চলে যাবো। ওখানেই করবো আমার মনের মতো থিয়েটার। তোমাদের ঐসব প্রসেনিয়াম ঢঙে আমি থিয়েটার করতে পারবো না।’ “আপনার ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আপনি আপনার ‘থার্ড থিয়েটার’ চর্চা চালিয়ে যান। কারো কোনো আপত্তি নাই।”- বাদল সরকারের কাজকে সম্মান জানালো সোলায়মান।

‘দাদা, সিগারেট খাওয়া শেষ হলে এদিকে একটু আসেন। কাজের কথাটা শেষ করি।’ জটলা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আনমনে সিগারেট টানছিল বঙ্গজিৎ দত্ত। তার উদ্দেশেই সোলায়মানের এই হাঁকডাক। বঙ্গজিৎ দত্ত কাশতে কাশতে কাছে আসে। ‘সারাক্ষণ কাশবেন আবার সিগারেটও টানবেন। এসব ছেড়ে দিলে কী হয়?’- জটলা থেকে হুমায়ুন ফরিদী উপদেশ ছুঁড়ে দেয়। ‘ভূতের মুখে রাম নাম দেখছি। তোমার কাশির দমকে তো বজরা কাঁপতে থাকে।’- বঙ্গজিৎ দত্তের প্রতিক্রিয়া। ‘আমি তো আপনার হয়ে কাজটা করছিই, তাহলে শুধু শুধু আপনি কষ্ট করবেন কেনো? হো হো, খুক খুক’- হো হো হাসতে থাকে আর খুক খুব কাশতে থাকে ফরিদী।

বঙ্গজিৎ দত্ত তার কথা শুরু করে, ‘আমার কথা খুবই সংক্ষিপ্ত। আপনারা অনেক দল, অনেক নাটক, তারচেয়ে অনেক বেশি আপনাদের পারফরমার। কিন্তু আমরা মেকআপ আর্টিস্ট মাত্র দু’জন। আমি আর... (খোঁজে) কৈ গেলো... ।’ ‘এই যে আপনার সামনেই।’- বঙ্গজিৎ দত্তের একেবারে পায়ের কাছে বসা ‘আরণ্যক নাট্যদলে’র নূরুল হক গমগম কণ্ঠে তার উপস্থিতি জানায়। ‘ছেলেটা খুব ভদ্র, আপনাকে খুব মান্য করে দাদা। সব সময় আপনার পায়ের কাছে পড়ে থাকে। হো হো, খুক খুক।’- আবারও ফরিদীর হাসি আর কাশি। ‘যাক’- বঙ্গজিৎ দত্ত বলতে থাকে, ‘আমরা দু’জন আপনাদের মেক-আপ দেয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকবো। ফাঁক পেলেই মেক-আপ রুমে চলে আসবেন। বাকিটা আমাদের কাজ।’

গত ২০ বছরে চলে যাওয়া থিয়েটারওয়ালা’রা এভাবেই একটা নাট্যোৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি চালাতে থাকে। তারা এই সিদ্ধান্তও নেয় যে, এই উদযোগের কথা যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্য একটা প্রকাশনা বের করবে। নাটকগুলোর নাট্যসমালোচনা লিখবে শান্তনু কায়সার আর প্রকাশক হবে ‘মুক্তধারা’র কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহা।

সত্যিই- থিয়েটার যারা করতে আসে, একজনমে তাদের সাধ মেটে না।

ইতি
হাসান শাহরিয়ার
( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. )
ভাদ্র ১৪২৬। অগাস্ট ২০১৯।
মোহাম্মদপুর, ঢাকা।