Full premium theme for CMS
নাটকের লোকের ‘নাট্য-সমালোচনা’ ও নেতিবাচক মনোভাব
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স ম্পা দ কী য়
কয়েক বছর ধরেই দেখছি, আগের তুলনায় কিছুটা বেশি প্রযোজনা মঞ্চে আসছে। কিংবা বলা যায়, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে নতুন নাটকের নিয়মিত দেখা মিলছে বেশ। নাটকের পূর্ণতা তার দর্শনে। বহু বছর ধরেই এই দর্শনধারীদের অভাব মঞ্চনাটকে উপস্থিত। বর্তমানে সেই দর্শকখরা পুরোপুরি না কাটলেও কোনো কোনো নাটকে হলভর্তি দর্শক, রোজা আর ঈদের দিনে দর্শককে হলমুখি দেখতে পাওয়া, হারিয়ে যাওয়া মহিলা সমিতিতে আবারো দর্শক সমাগম- ইত্যাদি ঘটনাও নাট্যপাড়ায় ঘটতে দেখা যাচ্ছে। যোগাযোগ-অবান্ধব রাজধানীতে এ বড় কম পাওয়া নয়।
সংখ্যার বিচারে স্বস্তিকর নাটক মঞ্চে আসলেও, অনেক নাটকই কিংবা বলা যায়, বেশিরভাগ নাটকই তেমন দর্শকপ্রিয় হচ্ছে বলে মনে হয় না। কিছু কিছু নাট্য-সমালোচনা থেকে এ তথ্য জানা যায়। যদিও একথাও সত্য, আমাদের মঞ্চনাটকের সমালোচনা সেই অর্থে কখনোই প্রতিষ্ঠা লাভ করে নি। অনুরোধের ‘ঠেঁকি গিলতে’ গিয়ে, নাটকের প্রশংসা আর স্তুতিনির্ভর সমালোচনা তাই তোষামোদী আর ফরমায়েশি ‘ভালোচনা’ বলেই বেশি ‘খ্যাতি’ লাভ করেছে। বুক ফুলিয়ে যতই বলা হোক, ‘আমি সামালোচনা শুনতে ও মেনে নিতে উদার’, কিন্তু যুৎসই সমালোচনা পড়ার (শোনার) পর সমালোচকের সাথে শিল্পীর শানানো ও শাসানো বাক্য বিনিময়ের প্রকাশও নজরে পড়েছে সবার, বারবার। তাই, নিজ আগ্রহে এবং শিল্পের নান্দনিক বিকাশের স্বার্থে যারা মাঝে মধ্যে নাট্য-সমালোচনা প্রকাশে উৎসাহী ছিলেন, তারা এখন অনেকটাই নির্লিপ্ত।
নাট্য-সমালোচনা করে কাউকে যেনো বিরাগভাজন হতে না হয় কিংবা বিপরীতভাবে কোনো সমালোচক যেনো নিজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকেই স্বতঃসিদ্ধ মনে না করতে পারে, সমালোচকও যেনো সমালোচনার মুখোমুখি হতে পারে, এমন এক ইচ্ছা থেকে ‘থিয়েটারওয়ালা’ বেশ কিছু মুখোমুখি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। দর্শকের (পাঠকের) স্মরণে থাকতে পারে, প্রতি ৬ মাসের মঞ্চায়িত কিছু নির্বাচিত নাটকের নাট্যকার-নির্দেশক-কলাকুশলীরা এসব আয়োজনে সরাসরি মুখোমুখি হয়েছিল দর্শক-সমালোচকের। সেখানে প্রযোজনা নিয়ে উন্মুক্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, মতামতের আদান-প্রদান হয়েছে। কোনো দর্শক-সমালোচকের বক্তব্য হয়তো খণ্ডন করেছে দর্শক সারিরই কেউ। প্রযোজনায় জড়িত শিল্পীদের সাথে দর্শক-সমালোচকের এহেন মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃত নাট্য-সমালোচনা সৃষ্টি এবং শিল্পীর সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরিই ছিল এসব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।
প্রত্যাশা ছিল, এই উদ্যোগকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং নিয়মিত চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে নাট্যদলগুলো আগ্রহী হবে। অর্থাৎ নিজ নিজ দলের নতুন নাটকের আলোচনা-সমালোচনার বাহাস আয়োজন করে নিজেদের কাজকে আয়নায় দেখে নেবে। উন্মুক্ত আড্ডা শেষে সবার মতামত-সমালোচনা গ্রহণ করতে হবে কিংবা সম্পূর্ণ ছাটাই করতে হবে এমন কোনো বালাই নেই। তবে এমত আয়োজনে সমালোচনাকে গ্রহণ করতে পারার মানসিকতা তৈরি হওয়ার চর্চার শুরুটা হতে পারতো। অথচ তেমন কোনো আগ্রহ কোনো নাট্যদলের মধ্যে লক্ষ্য করা গেল না। তবে সুবচন নাট্য সংসদ তাদের ‘খনা’ প্রযোজনা নিয়ে এবং কিছুদিন আগে বটতলা তাদের ‘ক্রাচের কর্নেল’ নিয়ে এমত আয়োজন করেছিল। এসব যদি তাদের নিজস্ব চিন্তাপ্রসূতও হয়, তবু তাদের সাধুবাদ জানাই।
এদিকে, বর্তমানে, ‘ফেইসবুক সংস্কৃতি’র মধ্যে এসে, অনেকেই নিজের তাগিদ এবং তাগদে, নাট্য-সমালোচনা প্রকাশ বা ব্যক্ত করার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে। দুঃখজনকভাবে এরা বেশিরভাগই ইঁচড়ে পাকামীও দেখাচ্ছে বেশ। যেকোনো নাটক দেখে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার হীনচর্চার মজমা সাজাচ্ছে ‘মাত্র ২ টাকায় ৪ জিবি’ জাতীয় সেবা দানকারীদের কল্যাণে। তাদের অনেকের মধ্যেই এই সত্যটা বিবেচনায় নেই যে, নাটকের প্রশংসা-অপ্রশংসা যেকেউ করতে পারলেও নাট্য-সমালোচনার জন্য আলাদা যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন। থিয়েটার আর সাহিত্যের নানান বিষয়ের খুঁটিনাটি কলকব্জার জ্ঞান না থাকলে নাট্য-সমালোচনা করা ঠিক না। একটা নাটক যদি কারো ভালো না লাগে, সে তার অনুভূতি ব্যক্ত করতেই পারে। এটাকে তার ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত হিসেবে ধরে নেয়াই ভালো। কিন্তু যদি নাটকটির সমালোচনা করতে হয়, তাহলে কেনো ভালো লাগে নি, তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ তুলে ধরা উচিত। অনেক শিল্পীর সৃজনশীল সমন্বয়ে, দীর্ঘদিনের মহড়া শেষে ভূমিষ্ট হওয়া নাটকটিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়া মোটেও শোভনীয় ও রুচিশীল অনুশীলন নয়।
তারপরও কেউ যদি কোনো নাট্যদলের বা নাটকের কিংবা অভিনেতৃর কাজ দেখে তৃপ্ত না হয়, এবং ফলশ্রুতিতে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, তাকেও বিশেষ দোষ হয়তো দেয়া যায় না। দর্শক হিসেবে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার খেদ সে প্রকাশ করতেই পারে। কিন্তু অনুতাপের বিষয় হচ্ছে, নাট্যপাড়ায় (আক্ষরিক ও ভার্চুয়াল) নাটকের কিছু লোকজন আজকাল কোনো নাট্যদল কিংবা প্রযোজনা বা অভিনেতৃর সৃজনশীলতা প্রকাশের সীমাবদ্ধতায় বেশ পুলকিত বোধ করছে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, একটা সফল প্রযোজনার চেয়ে কোনো ব্যর্থ প্রযোজনাই তাদের আনন্দ দেয় বেশি। ‘আওয়াজ দিয়ে আসা একটা নাটকও তো কিছু ছিঁড়তে পারে নাই।- হা হা’, ‘বছরে তিনটা নাটক নামাতে মেধার দরকার হয় না, টাকা থাকলেই হয়।- হা হা’, ‘দেশে উৎসব করে, বিদেশেও উৎসব করে, লাইন-ঘাটতো ভালোই জানে দেখছি- হি হি’, ‘কবিতা লিখলেই পারে, নাটক লেখার দরকার কী? খিক খিক’, ‘দু’একটা সফল নাটক করে নিজেকে মেধাবী ভেবেছে। এবার নামিয়েছে ঘোড়ার আণ্ডা- হা হা হি হি’, ‘এসব সার্কাস ৩০ বছর আগেই দেখেছি। নাটক তো না, নিজের কারিশমা দেখানোই উদ্দেশ্য- চিঁ চিঁ চিঁ’, ‘টিভি-সিনেমায় কাজ করে টাকা কামাই করছো, তাই করো, মঞ্চে কাজ করার দরকার কী? সংলাপ শুনলে তো বিজ্ঞাপনের ভয়েজ মনে হয়।- হো হো’, ‘মেয়েকে দিয়ে নাটক লিখিয়ে নিজে ডিরেকশন দিয়েও লাভ হলো কী! এত বড় অশ্বডিম্ব এই দল প্রথম নামালো- হা হা হো হো’, ‘নতুন নাটকের আগে এত হাঁকডাক। এখনতো দেখছি নিত্যই কেবল পুরান নাটক করে যাচ্ছে- খিক খিক’। এ সবই হলো স্বঘোষিত নাট্যবোদ্ধাদের চায়ের আড্ডার বাখোয়াবাজি। নাটক নিয়ে এসব মন্তব্য যদিও-বা মেনে নেয়া যায় কিন্তু ঐ ‘হা হা হি হি খিক খিক হো হো চিঁ চিঁ’ ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ তো ভালো লক্ষণ না। থিয়েটারের ব্যর্থতায় এত আনন্দ প্রকাশ আসে কোত্থেকে! কেনোই-বা এত উচ্ছ্বাস! কারণ একটাই। থিয়েটার সৃজনশীল লোকদের কাজ। যারা গায়ের জোরে মেধাকে দমাতে চায়, যারা ঊর্বর মস্তিষ্ক নিয়ে সৃষ্টিশীলদের মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে- তারা কেবলি অন্যের ব্যর্থতায় নিজের সফলতার স্বাদ খোঁজে। নিজে যেহেতু উপরে উঠতে পারবে না, তাই অন্যকে টেনে না নামালে আর সমান হওয়া যাচ্ছে না।
নাটক নিয়ে নাটকের লোকের এহেন বাখোয়াবাজি নাটকের ক্ষতি টেনে আনছে। সাধারণ দর্শকের কানে যখন এসব খিস্তি-খেউর প্রবেশ করে, তখন তারা মঞ্চবিমুখ হয়ে পড়ে। যারা প্রকৃত অর্থে থিয়েটার শিল্পের সাথে জড়িত, তারা সারাক্ষণ আজিরা প্যাচাল পারার জন্য জটলা পাকায় না। ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠার জন্যও তাদেরকে পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু যারা ভিন্ন পথে আলোচিত হতে চায়, তারা থিয়েটারের ব্যর্থতার খোঁজে থাকে। গীবতই হয় তাদের উচ্ছ্বসিত সংলাপ।
যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজে সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও থাকবে। সেই ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে নিরন্তর কাজ করে যায় শিল্পী। নাটকের লোকের উচিত, এমত ব্যর্থতাকে তার নিজেরও খামতি হিসেবে বিবেচনা করা। শিল্পীর পাশে থেকে তাকে সমবেদনা জানানো, সাহস যোগানো, ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা দেয়া।
শিল্পের সমালোচনা নিশ্চয়ই করতে হবে, কিন্তু তা অবশ্যই সহমর্মিতার সাথে, উচ্ছ্বসিত হয়ে নয়।
ইতি
হাসান শাহরিয়ার
মোহাম্মদপুর, ঢাকা
২৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৫। ৭ জুন, ২০১৮